মূখ্য শব্দ সুবাদার, ইসলাম খান, শায়েস্তা খান ও মুর্শিদ কুলী খান
মুঘল সুবাদারি শাসন (১৫৭৬-১৭৫৭ খ্রি.)
বাংলায় বিভিন্ন প্রতিনিধির মাধ্যমে মুঘলদের সরাসরি শাসনকে সুবাদারি শাসন হিসেবে অভিহিত করা হয়।
শাসনকার্য পরিচালনার সুবিধার্থে সমগ্র মুঘল সা¤্রাজ্যকে কয়েকটি সুবা’য় বা প্রদেশে বিভক্ত ছিল। মুঘল প্রদেশগুলো ‘সুবা’
নামে পরিচিত ছিল। সুবা প্রধানকে সুবাদার, সাহিব-ই-সুবাহ, নাজিম, ফৌজদার-ই-সুবা প্রভৃতি নামে পরিচিত ছিল। বাংলা
ছিল মুঘলদের অন্যতম সুবা। বার ভূঁইয়াদের দমনের পর সমগ্র বাংলায় সুবাদারি প্রতিষ্ঠিত হয়। সতের শতকের প্রথম দিক
থেকে আঠার শতকের শুরু পর্যন্ত ছিল সুবাদারি শাসনের স্বর্ণযুগ।
রাজমহলের যুদ্ধে জয়ী হয়ে মুঘলরা পুরো বাংলার উপর নিজেদের আধিপত্য বিস্তারে মনোনিবেশ করে। এ লক্ষে স¤্রাট
জাহাঙ্গীর সুবাদার ইসলাম খান চিশতিকে (১৬০৮-১৬১৩ খ্রি.) বাংলার সুবাদার হিসেবে নিয়োগ দিলে সুবাদার ইসলাম খান
১৬১০ খ্রিস্টাব্দে বার ভূঁইয়াদের দমন করে সমগ্র বাংলায় সুবাদারি শাসন প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি ১৬১০ খ্রিস্টাব্দে ঢাকাকে
বাংলা সুবার রাজধানী হিসেবে ঘোষণা করেন। ১৬১৩ খ্রিস্টাব্দে তাঁর মৃত্যুর পর সুবাদার কাশিম খান চিশতি (১৬১৩-
১৬১৭ খ্রি.) বাংলার শাসন ক্ষমতা গ্রহণ করেন। এরপর দিল্লির সম্রাজ্ঞী নূরজাহানের ভাই ইব্রাহিম খান ফতেহ জঙ্গ
(১৬১৭-১৬২৪ খ্রি.), দারার খান (১৬২৪-১৬২৫ খ্রি.), মহব্বত খান (১৬২৫-১৬২৬ খ্রি.), মুকাররম খান (১৬২৬-১৬২৭
খ্রি.) এবং ফিদাই খান (১৬২৭-১৬২৮ খ্রি.) দায়িত্ব পালন করেন।
সম্রাট শাহজাহান ক্ষমতা গ্রহণ করার পর ১৬২৮খ্রিস্টাব্দে বাংলার সুবাদার হিসেবে কাসিম খান জুয়িনীকে (১৬২৮-১৬৩২
খ্রি.) নিয়োগ করেন। হুসেন শাহী যুগ হতেই বাংলায় পর্তুগীজরা বাণিজ্য করত। এ সময় পর্তুগীজ বণিকদের প্রতিপত্তি
অনেক বেড়ে যায়। ক্রমে তা বাংলার জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়ায়। কাসিম খান জুয়িনী শক্ত হাতে পর্তুগীজদের দমন করেন।
এরপর সুবাদার আজম খান (১৬৩২-১৬৩৫ খ্রি.) বাংলার সুবাদার হিসেবে নিয়োগ পান। এরপর সুবাদার ইসলাম খান
মাসহাদী (১৬৩৫-১৬৩৯ খ্রি.) চার বছর বাংলা শাসন করেন। অতঃপর শাহজাহান তাঁর দ্বিতীয় পুত্র শাহ সুজাকে বাংলার
সুবাদার হিসেবে নিয়োগ দেন। সুজা কুড়ি বছর দায়িত্বে ছিলেন। যুবরাজ শাহ সুজার শাসনকাল মোটামুটি শান্তিপূর্ণ ছিল।
বিদেশি বণিক গোষ্ঠির মধ্যে ইংরেজরা এ সময় সুবাদারের কাছ থেকে কিছু বাড়তি সুবিধা লাভ করছিল। এতে বাণিজ্যের
পাশাপাশি ইংরেজদের ক্ষমতাও বৃদ্ধি পায়। ১৬৫৭ খ্রিস্টাব্দে সম্রাট শাহজাহান অসুস্থ হয়ে পড়লে তাঁর চার পুত্রের
প্রত্যেকেই সম্রাট হওয়ার জন্য বিদ্রোহ করে। এ সময় আওরঙ্গজেবের সাথে শাহ সুজার দ্ব›দ্ব শুরু হয়। দুই ভাইয়ের যুদ্ধে
১৬৫৯ খ্রিস্টাব্দে শাহ সুজা পরাজিত হন। পরাজিত হয়ে তিনি আরাকানে পলায়ন করেন এবংসেখানে সপরিবারে নিহত
হন।
উত্তরাধিকার যুদ্ধে জয়ী হতে আওরঙ্গজেব সেনাপতি মীর জুমলাকে বাংলায় শাহ সুজাকে দমন করার জন্য প্রেরণ করলে
মীর জুমলা রাজধানী জাহাঙ্গীরনগর পর্যন্ত এসেছিলেন। সম্রাট হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের পর আওরঙ্গজেব মীর জুমলাই
(১৬৬০-১৬৬৩ খ্রি.) বাংলার সুবাদারের দায়িত্ব দেন। সুবাদার হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করে মীর জুমলা অহোমরাজের
বিরুদ্ধে অভিযান চালনা করেন। এক্ষেত্রে তেমন উল্লেখযোগ্য সাফল্য অর্জিত না হলেও কুচবিহার ও আসাম বিজয় মীর
সুবাদার শায়েস্তা খান
জুমলা সামরিক প্রতিভার স^াক্ষর বহন করে। তাঁর সময়েই কুচবিহার সম্পূর্ণরূপে প্রথমবারের মতো মুঘল সাম্রাজ্যের অধীনে
আসে। আসাম অভিযানের দ্বারা তিনি মুঘল সাম্রাজ্যের সীমান্ত আসাম পর্যন্ত বর্ধিত করেন।
মীর জুমলার মৃত্যুর পর প্রথমে দিলির খান (১৬৬৩ খ্রি.) ও পরে দাউদ খান (১৬৬৩-১৬৬৪ খ্রি.) অস্থায়ী সুবাদার হিসেবে
বাংলা শাসন করেন। অতঃপর আওরঙ্গজেব তাঁর মামা শায়েস্তা খানকে (১৬৬৪-
১৬৮৮ খ্রি.) বাংলার সুবাদার নিয়োগ দেন। দুই দফায় তিনি প্রায় ২৩ বছর বাংলা
শাসন করেন এর মাঝে ১৬৭৮ খ্রিস্টাব্দে স¤্রাট তাঁকে কিছুদিনের জন্য দিল্লিতে ডেকে
পাঠিয়েছিলেন। শায়েস্তা খান ছিলেন একজন সুদক্ষ সেনাপতি ও দূরদর্শী শাসক। তিনি
মগদের উৎপাত হতে বাংলার জনগণের জানমাল রক্ষা করেন। তিনি স›দ্বীপ ও চট্টগ্রাম
অধিকার করে আরাকানী জলদস্যুদের সম্পূর্ণরূপে উৎখাত করেন। সুবাদার শায়েস্তা
খান কুচবিহার, কামরূপ, ত্রিপুরা প্রভৃতি অঞ্চলে মুঘল শাসন সুষ্ঠুভাবে প্রতিষ্ঠিত
করেন। সীমান্তএলাকার নিরাপত্তারও ব্যবস্থা করা হয়। তাঁর ভয়ে আসামের রাজা
মুঘলদের বিরুদ্ধে শত্রæতা করতে সাহস পাননি। সুবাদারির শেষ দিকে শায়েস্তা খানের
সাথে ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বিরোধ বাঁধে। ইংরেজদের ক্ষমতা এত বৃদ্ধি
পেতে থাকে যে তারা ক্রমে এদেশের জন্য হুমকি হিসেবে দেখা দেয়। দীর্ঘদিনের
চেষ্টার পর শায়েস্তা খান বাংলা থেকে ইংরেজদের বিতাড়িত করেন। শায়েস্তা খানের
পর একে একে খান-ই-জাহান বাহাদুর (১৬৮৮-১৬৮৯ খ্রি.), ইব্রাহিম খান(১৬৮৯-
১৬৯৮ খ্রি.) ও আজিমুদ্দিন (১৬৯৮-১৭১২ খ্রি.) বাংলার সুবাদার হন। তাঁদের সময়
বাংলার ইতিহাস তেমন ঘটনাবহুল ছিলনা। শায়েস্তা খান তাঁর শাসন আমলের বিভিন্ন
জনহিতকর কার্যাবলীর জন্য স্মরণীয় হয়ে রয়েছেন। তাঁর সময়ে সাম্রাজ্যের সর্বত্র অসংখ্য সরাইখানা, রাস্তা ও সেতু নির্মিত
হয়েছিল। দেশের অর্থনীতি ও কৃষি ক্ষেত্রে তিনি অভাবিত সমৃদ্ধি আনয়ন করেছিলেন। জনকল্যাণকর শাসনকার্যের জন্য শুধু
বাংলায় নয়, সমগ্র ভারতবর্ষেই তিনি খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। তাঁর সময়ে দ্রব্যমূল্য সস্তা ছিল টাকায় আট মণ চাল পাওয়া
যেত।
শায়েস্তা খানের আমলে বাংলার অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির মূলে ছিল শিল্প ও ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার। এ আমলে কৃষিকাজের
সঙ্গে শিল্প ও ব্যবসা-বাণিজ্যেরও যথেষ্ট উন্নতি হয়। শায়েস্তা খান ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে বিদেশী বণিকদের বাণিজ্যিক
সুবিধা প্রদান করতেন। শায়েস্তা খানের শাসনকাল বাংলার স্থাপত্য শিল্পের জন্য সবিশেষ উল্লেখযোগ্য। বিচিত্র সৌধমালা,
মনোরম সাজে সজ্জিত তৎকালীন ঢাকা নগরী স্থাপত্য শিল্পের প্রতি তাঁর গভীর অনুরাগের সাক্ষ্য বহন করে। স্থাপত্য শিল্পের
বিকাশের জন্য এ যুগকে বাংলায় মুঘলদের ‘স্বর্ণযুগ’ হিসেবে অভিহিত করা যায়। তাঁর আমলে নির্মিত স্থাপত্য কার্যের মধ্যে
ছোট কাটরা, লালবাগ কেল্লা, পরী বিবির সমাধি-সৌধ, হোসেনি দালান, সুফি খানের মসজিদ, বুড়িগঙ্গার মসজিদ, চক
মসজিদ প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। মোটকথা, অন্য কোনো সুবাদার বা শাসনকর্তা ঢাকায় শায়েস্তা খানের ন্যায় নিজের স্মৃতিকে
এতো বেশি জ্বলন্ত রেখে যেতে পারেননি।
দক্ষ সুবাদার হিসাবে এবার বাংলার ক্ষমতায় আসেন মুর্শিদ কুলী খান (১৭০০-১৭২৭খ্রি.)। স¤্রাট আওরঙ্গজেব প্রথমে
তাঁকে বাংলার দিউয়ান হিসেবে নিয়োগ দেন। দিউয়ানের কাজ ছিল সুবার রাজস্ব আদায় ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণ
করা। সম্রাট ফখরুখ শিয়ারের রাজত্বকালে মুর্শিদ কুলী খান বাংলার সুবাদার নিযুক্ত হন। মুর্শিদ কুলী খান যখন বংলায়
আগমণ করেন তখন বাংলার রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অবস্থা শোচনীয় হয়ে পড়েছিল। এ পরিস্থিতির মুখে তিনি অত্যন্ত
সাহসিকতার সাথে বাংলায় মুঘল শাসন পুনরুদ্ধারে সচেষ্ট হন। স্বীয় ব্যক্তিত্ব, বিচক্ষণতা ও বুদ্ধিমত্তা দ্বারা তিনি বাংলার
ইতিহাসের গতিকে পরিবর্তিত করেছিলেন। সম্রাট আওঙ্গজেবের মৃত্যুর পর দুর্বল মুঘল সম্রাটগণ দূরবর্তী সুবাগুলোর দিকে
তেমন দৃষ্টি দিতে পারেননি। ফলে এসব অঞ্চলের সুবাদারগণ অনেকটা স্বাধীনভাবে শাসন করেন। মুর্শিদ কুলী খানও
অনেকটা স্বাধীন হয়ে পড়েন। তিনি নামমাত্র সম্রাটের আনুগত্য প্রকাশ করতেন এবং দিল্লিতে বার্ষিক ১ কোটি ৩ লক্ষ টাকা
রাজস্ব পাঠাতেন। মুর্শিদ কুলী খানের পর তাঁর জামাতা সুজাউদ্দিন খান বাংলার সিংহাসনে বসেন। এভাবে বাংলার সুবাদারি
বংশগত হয়ে পড়ে। আর এই পথ ধরে পুনরায় প্রতিষ্ঠিত হয় বাংলার স্বাধীন নবাবী শাসন।
সারসংক্ষেপ :
বাংলার রাজনৈতিক ইতিহাসে মুঘল সুবাদারি শাসন এক উল্লেখযোগ্য অধ্যায়। বার ভূঁইয়াদের দমনের পর বাংলায়
দীর্ঘদিন ধরে এ সুবাদারি শাসন চালু ছিল। এ সময় বাংলায় শান্তি ও নিরাপত্তা বজায় ছিল। সুবাদার শায়েস্তা খানের
সময় এক টাকায় ৮ মণ চাল পাওয়া যেত। মুঘলদের সাথে পর্তুগীজদের মধ্যকার দ্ব›দ্ব এবং কুচবিহার ও আরাকানের
সাথে সম্পর্ক এ সময়কার একটি বিশেষ উল্লেখ্য ঘটনা।
পাঠোত্তর মূল্যায়ন-৬.৪
১। ঢাকাকে কত সালে বাংলার রাজধানী করা হয়?
ক. ১৬০৮ খ্রিস্টাব্দে খ. ১৬১০ খ্রিস্টাব্দে গ. ১৬১৩ খ্রিস্টাব্দে ঘ. ১৬২৮ খ্রিস্টাব্দে
২। কোন সুবাদার পর্তুগীজদের দমন করতে সমর্থ হন?
ক. সুবাদার ইসলাম খান খ. সুবাদার কাসিম খান জুয়িনী গ. সুবাদার শায়েস্তা খান ঘ. সুবাদার মীর জুমলা
৩। পরী বিবির সমাধি কোথায় অবস্থিত?
ক. ছোট কাটরায় খ. বড় কাটরায় গ. ঈমাম বাড়ায় ঘ. লালবাগের কেল্লায়
চূড়ান্ত মূল্যায়ন
সৃজনশীল প্রশ্ন:
রনি ও সোমা টিভি দেখছিল। টিভিতে বাংলাদেশের ঐতিহাসিক স্থাপনা বিষয়ে অনুষ্ঠান চলছিল। এ সময় লালবাগের কেল্লা
বিষয়ে একটি প্রতিবেদন শুরু হয়। প্রতিবেদক বলেন, এটি মুঘল শাসনামলের একটি স্থাপত্য নিদর্শন। মুঘলরা বাংলায়
শাসন প্রতিষ্ঠার পর ঢাকাকে রাজধানী ঘোষণা করে। লালবাগের কেল্লাকে দুর্গ কেন্দ্র করে বাংলায় দীর্ঘদিন মুঘল শাসন চালু
রেখেছিল।
ক. মুঘল প্রদেশগুলো কি নামে পরিচিত ছিল? ১
খ. সুবা বাংলার শাসন বলতে কী বুঝ? ২
গ. উদ্দীপকে নির্দেশিত শাসকবর্গ কিভাবে বাংলায় মুঘলদের অবস্থানকে সুদৃঢ় করেন তা তুলে ধরুন। ৩
গ. “মুঘল বাংলা সমৃদ্ধিশালী ছিল”- ঐতিহাসিক তথ্যের আলোকে মন্তব্যটি পর্যালোচনা করুন। ৪
FOR MORE CLICK HERE
এইচএসসি বাংলা নোট ১ম পত্র ও ২য় পত্র
ENGLISH 1ST & SECOND PAPER
এইচএসসি আইসিটি নোট
এইচএসসি অর্থনীতি নোট ১ম পত্র ও ২য় পত্র
এইচএসসি পৌরনীতি ও সুশাসন ১ম পত্র
এইচএসসি পৌরনীতি নোট ২য় পত্র
এইচএসসি সমাজকর্ম নোট ১ম পত্র
এইচএসসি সমাজকর্ম নোট ২য় পত্র
এইচএসসি সমাজবিজ্ঞান নোট ১ম পত্র ও ২য় পত্র
এইচএসসি ইতিহাস নোট ১ম পত্র
এইচএসসি ইতিহাস নোট ২য় পত্র
এইচএসসি ইসলামের ইতি. ও সংস্কৃতি নোট ১ম পত্র
এইচএসসি ইসলামের ইতি. ও সংস্কৃতি নোট ২য় পত্র
এইচএসসি যুক্তিবিদ্যা ১ম পত্র ও ২য় পত্র
এইচএসসি ভূগোল ও পরিবেশ নোট ১ম পত্র ও ২য় পত্র
এইচএসসি ইসলামিক স্টাডিজ ১ম ও ২য় পত্র