বাংলার নবযুগে রাজা রামমোহন রায়ের ভূমিকা ডিরোজিও এবং ইয়ং বেঙ্গল মুভমেন্ট ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের সমাজ সংস্কার নারী মুক্তিতে বেগম রোকেয়ার

মূখ্য শব্দ রাজা রামমোহন রায়, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, নওয়াব আবদুল লতিফ ও সৈয়দ আমির আলী
ভূমিকা: আঠারো শতকের শেষার্ধে ইংল্যান্ডে শিল্প বিপ্লব এবং ফ্রান্সে রক্তক্ষয়ী ফরাসি বিপ্লবের (১৭৮৯ খ্রি:)
প্রভাব এসে পড়ে ভারতবর্ষের রাজনীতি ও অর্থনীতিতে। এ সময়ে বাংলার কিছু সংখ্যক ব্যক্তি এই বৈপ্লবিক
পরিবর্তনের সংস্পর্শে আসেন। তাঁরাই বাংলায় ‘রেনেসাঁস’ বা নবজাগরণের সূচনা করেন। এই সময়ে বাংলায়
প্রচলিত ধর্ম, শিক্ষা-সংস্কৃতি, সাহিত্য, সমাজ রীতি-নীতি ও ঐতিহ্যের বিরুদ্ধে এক ধরনের চিন্তার বিপ্লব সূচিত হয়।
বাংলার সর্ব ক্ষেত্রে দেখা দেয় পরিবর্তনের বিরাট সম্ভাবনা, যা ইঙ্গিত করে এক নবযুগের। এই নবযুগের জন্ম দিয়েছিলেন
বাংলার একদল শিক্ষিত তরুণ যাঁদের নেতৃত্বে ছিলেন রাজা রামমোহন রায়, ডিরোজিও, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, নওয়াব
আবদুল লতিফ, সৈয়দ আমির আলী প্রমুখ। তাঁদের নেতৃত্বের প্রভাবে দেশবাসীর মধ্যে আত্মসচেতনতা, আত্মমর্যাদাবোধ ও
স্বাতন্ত্রবোধ তীব্রভাবে জাগ্রত হতে থাকে। নবজাগরণের প্রভাবেই দেশবাসীর মধ্যে জাতীয়তাবাদী চেতনার প্রাথমিক ভিত
রচিত হয়, যা শেষ পর্যন্ত বাঙালিকে তথা ভারতীয়দের স্বাধীনতার পথে ঠেলে দেয়।
রাজা রাম মোহন রায়
উনিশ শতকে বাংলায় প্রচলিত ধর্ম, শিক্ষা-সংস্কৃতি, সামাজিক রীতি-নীতি ও ঐতিহ্যের বিরুদ্ধে এক ধরণের চিন্তার বিপ্লব
সূচিত হয়। এই পরিণতিতে জন্ম হয় নতুন মত (ব্রাহ্মধর্ম ও নব হিন্দুবাদ), নতুন শিক্ষা, নতুন সাহিত্য, নতুন সামাজিক
আদর্শ ও রীতিনীতির। এভাবেই উপমহাদেশে অর্থাৎ ভারতবর্ষের মধ্যে বাংলায় প্রথম নবজাগরণ বা ‘রেনেসাঁসের’ উদ্ভব
ঘটে। ফলে সারা ভারতবর্ষের মধ্যে বাংলা হয়ে উঠে আধুনিক চিন্তাচেতনার কেন্দ্রস্থল। ইংরেজি শিক্ষা ও পাশ্চাত্য
ভাবধারার প্রভাবে বাঙালি পরিণত হয় পাশ্চাত্য সভ্যতা ও সংস্কৃতির ধারকবাহকে।
বাঙালি বুদ্ধিজীবীদের অনেকেই মধ্যযুগীয় চিন্তা-চেতনা প্রত্যাখ্যান করে যুক্তিবাদ,
ব্যক্তিস্বাধীনতা, বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গিকে গ্রহণ করে আধুনিক মানুষে পরিণত হন। তাছাড়া
খ্রিস্টান মিশনারিদের প্রতিষ্ঠিত ছাপাখানাও আধুনিক শিক্ষার ভাবধারা প্রসারে
উল্লেখযোগ্য ভ‚মিকা পালনে সক্ষম হয়। এ সময় বাংলার প্রবাদ পুরুষ হিসেবে আবির্ভূত
হয়েছিলেন রাজা রামমোহন রায়। বাংলার নবজাগরণের অন্যতম পথিকৃত রাজা
রামমোহন রায় ১৭৭৪ খ্রিস্টাব্দে হুগলী জেলার রাধানগর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন।
রামমোহন আরবি, ফারসি, উর্দু, ল্যাটিন ও গ্রিক ভাষায় অসামান্য দক্ষতা অর্জন করেন।
তিনি সুফি মতবাদে বিশেষভাবে প্রভাবিত ছিলেন। হিন্দু ও মুসলমান শাস্ত্রে পারদর্শী
রামমোহন কিছুকাল তিব্বতে বসবাস করে বৌদ্ধ ধর্ম সম্পর্কে পাÐিত্য অর্জন করেন।
তিনি বেদান্তসূত্র বেদান্তসারসহ উপনিষদের অনুবাদ প্রকাশ করেন। তাঁর অন্যান্য রচনার
মধ্যে আছে ‘তুহফাত-উল-মোয়াহিদ্দীন’ (একেশ্বরবাদ সৌরভ) ‘মানাজারাতুল আদিয়ান’
(বিভিন্ন ধর্মের উপর আলোচনা)। হিন্দুদিগের পৌত্তলিক ধর্মপ্রণালি ইত্যাদি। তাছাড়া
তিনি ‘সম্বাদ কৌমুদী’, ‘মিরাত-উল-আখবার’ ও ‘ব্রাহ্মনিকাল ম্যাগাজিন’ নামে তিনটি পত্রিকার প্রকাশকও ছিলেন। রাজা
রামমোহন তৎকালীন সমাজের সামাজিক ও রাজনৈতিক গতিধারা পর্যবেক্ষণ করেন। নিজ চিন্তাধারার আলোকে নতুন
সমাজ গঠনে প্রয়াসী হয়েছিলেন তিনি। তখনকার হিন্দু সমাজের সতীদাহ, বাল্যবিবাহ, কৌলিন্য প্রথা, মূর্তিপূজা ও অন্যান্য
কুসংস্কার দূর করে তিনি একেশ্বরবাদের ভিত্তিতে হিন্দুধর্ম পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে সচেষ্ট হন। হিন্দুধর্মের সংস্কার তথা নিজ
ধর্মীয় মতবাদ প্রচারের উদ্দেশ্যে ‘আত্মীয় সভা’ নামে একটি সমিতি গঠন করেন। ১৮২৮ খ্রিস্টাব্দে ২০ আগস্ট তিনি
ব্রাহ্মসমাজের উপাসনালয় স্থাপন করেন। তার ব্রাহ্মসমাজ প্রতিষ্ঠা উপমহাদেশের ধর্মীয় ইতিহাসে এক নবযুগের সূচনা
করেছিল। সামাজিক আর ধর্মীয় বিষয় নয়, শিক্ষা বিস্তারেও তাঁর অবদান ছিল। রাজা রামমোহন ১৮২২ খ্রিস্টাব্দে
কলকাতায় ‘এ্যাংলো হিন্দু কলেজ’ প্রতিষ্ঠা করেন। যেখানে ইংরেজি, দর্শন আধুনিক বিজ্ঞান পড়াবার ব্যবস্থা ছিল।
এদেশবাসীকে সংস্কৃত শিক্ষার বদলে আধুনিক জ্ঞান, বিজ্ঞান, দর্শন শিক্ষার গুরুত্ব ব্যাখ্যা করে তিনি গভর্নর জেনারেল লর্ড
আমহার্স্টকে চিঠি লেখেন। তাছাড়া ভারতীয়দের শিক্ষার জন্য ইংরেজ সরকার কর্তৃক নির্ধারিত ১ লক্ষ টাকা তিনি সংস্কৃত ও
মাদরাসা শিক্ষায় ব্যয় না করে আধুনিক শিক্ষায় ব্যয় করার জন্য আবেদন করেন। ১৮৩৩ সালে রাজা রামমোহন রায়ের মৃত্যু হয়।
ডিরোজিও ও ইয়াং বেঙ্গল মুভমেন্ট
উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে বাঙালি যুব সমাজের মধ্যে আলোড়ন সৃষ্টিকারী ‘ইয়াং বেঙ্গল’ আন্দোলনের প্রবক্তা ছিলেন
ডিরোজিও। তিনি ১৮০৯ খ্রিস্টাব্দে কলকাতা শহরে জন্ম গ্রহণ করেন। ডিরোজিও তাঁর স্কুল শিক্ষক ডেভিড ড্রামন্ডের
প্রগতিবাদী, সংস্কারমুক্ত, অসাম্প্রদায়িক চেতনা সমৃদ্ধ মানবতাবাদী চিন্তাধারা দ্বারা গভীরভাবে প্রভাবিত ছিলেন। শিশুকাল
থেকে মৃত্যু পর্যন্ত এই শিক্ষকের আদর্শ ধারণ করে। বয়সে তরুণ হলেও তিনি ইতিহাস, ইংরেজি, সাহিত্য, দর্শন শাস্ত্রে
গভীর জ্ঞানের অধিকারী ছিলেন।
ডিরোজিওর অনুসারী ইয়াং বেঙ্গল আন্দোলনের সদস্যরা দেশবাসীকে বার বার এ কথাই বোঝাতে চেয়েছেন যে তারা
ব্রিটিশ কর্তৃক শাসিত ও শোষিত হচ্ছে। তরুণ সমাজের পুরোনো ধ্যান-ধারণা পাল্টে দিতে ডিরোজিও কর্তৃক ১৮২৮
খ্রিস্টাব্দে প্রতিষ্ঠিত ‘একাডেমি এ্যাসোসিয়েশন’ গুরুত্বপূর্ণ ভ‚মিকা রাখে। একাডেমির তরুণদের এই শিক্ষা দেয়া হয় যে
যুক্তিহীন বিশ্বাস হলো মৃত্যুর সমান। নতুন চিন্তাধারায় প্রভাবিত তরুণরা সনাতনপন্থী হিন্দু এবং গোঁড়াপন্থী খ্রিস্টানদের
ধর্মবিশ্বাস ও কুসংস্কারের বিরুদ্ধে সমালোচনা মুখর হয়ে উঠে। ডিরোজিও এবং তার ছাত্রদের প্রকাশিত সাপ্তাহিক এবং
দৈনিক পত্রিকাতেও সমাজ, ধর্মের বিভিন্ন কুসংস্কারের বিরুদ্ধে নিন্দাসূচক লেখা প্রকাশিত হয়। যে কারণে তারা রক্ষণশীল
মহলের আক্রমণের শিকার হতে থাকেন বারবার। বাংলার ‘রেনেসাঁস’ যুগের এই প্রতিভাবান তরুণ মাত্র তেইশ বছর বয়সে
১৮৩১ খ্রিস্টাব্দে মৃত্যুবরণ করেন।
ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর
পাÐিত্য, শিক্ষা বিস্তার ও সমাজ সংস্কারে এক অনন্য ব্যক্তিত্ব ছিলেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। তার জন্ম ১৮২০ খ্রিস্টাব্দে
মেদেনীপুর জেলার বীরসিংহ গ্রামে। তার বাবার নাম ঠাকুরদাস বন্দোপাধ্যায়, মা ভগবতীদেবী। দারিদ্রের কারণে শৈশব
থেকে শিক্ষাজীবন তেমন সুখকর ছিল না তাঁর। কথিত আছে ঈশ্বরচন্দ্র সন্ধ্যার পর থেকে গভীর রাত পর্যন্ত রাস্তার গ্যাস
বাতির নিচে দাড়িয়ে-বসে পড়ালেখা করতেন। তিনি ইংরেজি সংখ্যা গণনা শিখেছিলেন তাঁর বাবার সঙ্গে গ্রামের বাড়ি থেকে
পায়ে হেঁটে কলকাতায় আসার সময়, রাস্তার পাশের মাইল ফলকে লেখা সংখ্যার হিসেব গুণতে গুণতে। অসাধারণ মেধা
আর অধ্যবসায়ের গুণে তিনি মাত্র একুশ বছর বয়সে সংস্কৃত সাহিত্য, ব্যাকরণ, বেদান্ত, স্মৃতি, অলঙ্কার শাস্ত্র ইত্যাদি
বিষয়ে অগাধ পাÐিত্য অর্জন করেছিলেন। কর্মজীবনে প্রবেশের সঙ্গে সঙ্গে তিনি সাহিত্য চর্চায়ও মনোযোগী হন। বাংলা
ভাষায় উন্নতমানের পাঠ্যপুস্তকের অভাব দেখে তিনি গদ্যসাহিত্য রচনা শুরু করেন। তিনি বাংলা গদ্যসাহিত্যকে নবজীবন
দান করেন। এ জন্য তাঁকে বাংলা গদ্যসাহিত্যের জনক বলা হয়। তিনি একজন সফল সমাজ সংস্কারকও ছিলেন। দেশে
প্রচলিত নানা ধরণের কুসংস্কারের বিরুদ্ধে তিনি রুখে দাঁড়ান। উদার ও সংস্কারমনা বিদ্যাসাগর হিন্দু সমাজে প্রচলিত,
বাল্যবিবাহ, বহুবিবাহ, বিধবা বিবাহ নিষিদ্ধ, সতীদাহ প্রথা, কন্যা শিশু হত্যাসহ সামাজিক উন্নয়ন ব্যাহতকারী, মানবতা
বিরোধী সব ধরনের অশুভ কর্মকাÐের বিরুদ্ধে জোর আন্দোলন পরিচলনা করেন। তাঁর নিরলস প্রচেষ্টার কারণে ১৮৫৬
খ্রিস্টাব্দে গভর্নর জেনারেলের সম্মতিক্রমে বিধবা বিবাহ আইন পাশ হয়। ১৮৭২ খ্রিস্টাব্দে বহুবিবাহ ও বাল্যবিবাহ বন্ধ
করার জন্য ‘সিভিল ম্যারেজ অ্যাক্ট’ প্রণয়নে তার গুরুত্বপূর্ণ অবদান রয়েছে। ১৮৯১ সালে ৭১ বছর বয়সে তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
নওয়াব আবদুল লতিফ
ভারতীয় মুসলমানদের জন্য চরম হতাশার কাল হিসেবে ১৯ শতকের কথা বলা যায়। বিশেষ করে এসময়ে মুসলমানরা
ইংরেজদের প্রতি অসহযোগিতার মনোভাব প্রদর্শন করে। তারা ইংরেজি ভাষা শিক্ষায় বিমুখ হওয়ার কারণে সকল
অর্থনৈতিক কর্মকাÐ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিল। ফলে দারিদ্রের নি¤œতম ধাপে নেমে আসে। এই অধঃপতিত অবস্থা ও
দুর্দিনে যে সব মনীষীর আন্তরিক ও নিঃস্বার্থ প্রচেষ্টায় বাংলার মুসলমানদের মধ্যে নবজাগরণ আসে নওয়াব আবদুল লতিফ
তাঁদের মধ্যে অন্যতম। নওয়াব আবদুল লতিফ ১৮২৮ খ্রিস্টাব্দে ফরিদপুর জেলায় জন্মগ্রহণ করেন। তিনি কোলকাতা
মাদরাসায় ইংরেজি শিক্ষা লাভ করেন। শিক্ষাজীবন শেষ করে তিনি প্রথমে ঢাকা কলেজিয়েট স্কুল এবং পরে কোলকাতা
মাদরাসায় অধ্যাপনা করেন। এরপর ১৮৪৯ খ্রিস্টাব্দে তিনি ডিপুটি ম্যাজিস্ট্রেটের পদে যোগদান করেন। ১৮৭৭ খ্রিস্টাব্দে
তাঁকে কোলকাতা প্রেসিডেন্সির ম্যাজিস্ট্রেট পদে উন্নীত করা হয়। আবদুল লতিফ প্রথম বারের মত বাঙালি মুসলমানদের
মধ্যে ইংরেজি শিক্ষা বিস্তারের চেষ্টা চালান। তিনি এর প্রয়োজন এবং এর গুরুত্ব বুঝতে পেরেছিলেন। তিনি মুসলমানদের
ইংরেজ ও সংশ্লিষ্ট শিক্ষায় শিক্ষিত করে তাদের কল্যাণের প্রচেষ্টা চালিয়েছিলেন। এই উদ্দেশ্যে জনমত গঠনের জন্য তিনি
১৮৫৩ খ্রিস্টাব্দে ‘মুসলমান ছাত্রদের পক্ষে ইংরেজি শিক্ষার সুফল’ শীর্ষক এক রচনা প্রতিযোগিতার আয়োজন করেন। তাঁর
প্রচেষ্টায় কোলকাতা মাদরাসায় এ্যাংলো পার্সিয়ান বিভাগ খোলা হয়। সেখানে উর্দু ও বাংলা শিক্ষারও ব্যবস্থা করা হয়।
উচ্চশিক্ষা গ্রহণে মুসলমান ছাত্রদের সমস্যার কথা তিনি সরকারের কাছে তুলে ধরেন। তাঁর প্রচেষ্টায় হিন্দু কলেজ
প্রেসিডেন্সি কলেজে রূপান্তর করা হলে মুসলমান ছাত্ররা সেখানে পড়ালেখার সুযোগ পায়। তিনি ঢাকা, রাজশাহী, চট্টগ্রাম
প্রভৃতি স্থানে মাদরাসা স্থাপন করেন। আবদুল লতিফের প্রচেষ্টার কারণে ১৮৭৩ খ্রিস্টাব্দে মুহসিন ফান্ডের টাকা শুধু বাংলার
মুসলমানদের শিক্ষায় ব্যয় হবে এই সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। তাঁর প্রতিষ্ঠিত মাদরাসাগুলোতে ধর্মীয় শিক্ষার পাশাপাশি ইংরেজি শিক্ষা চালু করা হয়। আবদুল লতিফের উল্লেখযোগ্য কৃতিত্ব হচ্ছে ১৮৬৩ খ্রিস্টাব্দে কোলকাতায় প্রতিষ্ঠিত মোহামেডান
লিটারারি সোসাইটি বা মুসলিম সাহিত্য সমাজ। বলতে গেলে তার প্রচেষ্টায় পিছিয়ে পড়া মুসলিম সম্প্রদায় নতুনভাবে ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করেছিল।
সৈয়দ আমির আলী
১৯ শতকের শেষভাগে এসে বাংলার মুসলিম সমাজের নবজাগরণে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছিলেন সৈয়দ আমির আলী।
পাশ্চাত্য শিক্ষার মাধ্যমে বাঙালি মুসলমানদের সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নতি করতে চেয়েছেন তিনি। পাশাপাশি তাদের
রাজনৈতিকভাবেও সচেতন করতে চেয়েছেন। সৈয়দ আমির আলী ১৮৪৯ খ্রিস্টাব্দে হুগলীতে জন্ম গ্রহণ করেন। তিনি
কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এম.এ ও বি.এল ডিগ্রি লাভ করেন। ১৮৭৩ খ্রিস্টাব্দে লন্ডনের লিঙ্কন্স ইন থেকে ব্যারিস্টারি
পাস করে দেশে ফেরেন। কর্মজীবনে তিনি বিভিন্ন দায়িত্বপূর্ণ পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। তিনি ১৮৯০ খ্রিস্টাব্দে কোলকাতা
হাইকোর্টের বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ পেয়েছিলেন। এরপর ১৯০৯ খ্রিস্টাব্দে তিনি লন্ডনে প্রিভি কাউন্সিলের সদস্য হন।
বাংলা তথা ভারতে তিনিই প্রথম মুসলমান নেতা, যিনি বিশ্বাস করতেন মুসলমানদের জন্য একটি পৃথক রাজনৈতিক সংগঠন
থাকা প্রয়োজন। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে, মুসলমানদের স্বার্থ রক্ষা এবং তাদের দাবি দাওয়ার প্রতি সরকারের দৃষ্টি
আকর্ষণের জন্য নিজস্ব রাজনৈতিক সংগঠন থাকা প্রয়োজন। এই উদ্দেশ্যে তিনি ১৮৭৭ খ্রিস্টাব্দে কোলকাতায় ‘সেন্ট্রাল
মোহামেডান এ্যাসোসিয়েশন’ নামে একটি সমিতি গঠন করেন। সৈয়দ আমির আলী বিভিন্ন পত্র পত্রিকায় শিক্ষা ও বিভিন্ন
ক্ষেত্রে মুসলমানদের পিছিয়ে পড়ার বিষয়টি নিয়ে লেখালেখি করেন। ফলে ১৮৮৫ খ্রিস্টাব্দে সরকার মুসলমানদের শিক্ষার
অগ্রগতির জন্য কতগুলো ব্যবস্থা গ্রহণ করে। আমির আলী কোলকাতা মাদ্রাসা এবং কলেজ পর্যায়ে ইংরেজি শিক্ষা এবং
করাচিতে একটি কলেজ প্রতিষ্ঠায় উৎসাহিত করেন। মুসলিম রেনেসাঁসের অগ্রদূত আমির আলী ছিলেন একজন সুলেখক।
তাঁর বিখ্যাত দুটি গ্রন্থ হচ্ছে। এতে ইসলাম ধর্মের
বিজ্ঞানসম্মত ব্যাখ্যা ও ইসলামের অতীত গৌরবের কথা তুলে ধরা হয়েছে। সৈয়দ আমির আলী ১৯২৮ সালে লন্ডনে
মৃত্যুবরণ করেন।
বেগম রোকেয়া
বাংলাদেশের নারী অধিকার প্রতিষ্ঠায় যাঁরা অবদান রেখেছেন তাঁদের মধ্যে বেগম রোকেয়া ছিলেন অগ্রদূত। ব্রিটিশ আমলে
নারীরা ইংরেজ আমলে বেশ পিছিয়ে ছিল। তারা সব ধরনের অধিকার থেকেও বঞ্চিত ছিল। লেখাপড়া শেখা তাদের জন্য
একরকম নিষিদ্ধই ছিল। সমাজ ধর্মের নামে তাদের রাখা হতো পর্দার আড়ালে গৃহবন্দি করে। মুসলমান মেয়েদের এই
বন্দিদশা থেকে বেরিয়ে আসার জন্য যিনি আহবান জানান তিনি বেগম রোকেয়া। এই মহীয়সী নারীর জন্ম ১৮৮০ খ্রিস্টাব্দে
রংপুর জেলার মিঠাপুকুর উপজেলার পায়রাবন্দ গ্রামে। তাঁর পিতার নাম জহিরুদ্দীন মোহাম্মদ আবু আলী সাবের। মায়ের
নাম মোসাম্মৎ বাহাতন্নেসা সাবেরা চৌধুরী। ঐ অঞ্চলে সাবের পরিবার ছিল অত্যন্ত সম্ভ্রান্ত এবং রক্ষণশীল। মেয়েরা ছিল
খুবই পর্দানশিন। বেগম রোকেয়া তাঁর বড় ভাই ইবরাহিম সাবের এবং বড় বোন করিমুন্নেসার কাছে শিক্ষা লাভ করেন।
কিশোর বয়স থেকেই তিনি সাহিত্য চর্চায় মনোনিবেশ করেন। তার সাহিত্য চর্চার বিষয়বস্তুও ছিল নারী সমাজকে নিয়ে।
তিনি সমাজের কুসংস্কার, নারী সমাজের অবহেলাÑ বঞ্চনার করুণ চিত্র নিজ চোখে দেখেছেন। যা উপলব্ধি করেছেন, তা-ই
তিনি তাঁর লেখার মধ্যে তুলে ধরেছেন। তিনি নারীদের করুণ দশা, তাদের প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণের নমুনা প্রভৃতি
স্পষ্টভাবে দেখাতে চেয়েছেন সাবলীল লেখনীর মাধ্যমে। বেগম রোকেয়ার লিখিত গ্রন্থ অবরোধবাসিনী, পদ্মরাগ, মতিচুর,
সুলতানার স্বপ্ন প্রভৃতিতে সে চিত্র ফুটে উঠেছে।
বিবাহিত জীবনে তিনি তাঁর স্বামীর কাছ থেকে জ্ঞান চর্চায় উৎসাহ লাভ করেছিলেন। স্বামীর মৃত্যুর পর তিনি তাঁর জীবনের
বাকি সময় নারী শিক্ষা আর সমাজসেবায় ব্যয় করেন। তিনি স্বামীর নামে ভাগলপুরে একটি প্রাথমিক বালিকা বিদ্যালয়
স্থাপন করেন। ১৯১১ খ্রিস্টাব্দে তিনি কোলকাতায় সাখাওয়াত মেমোরিয়াল উর্দু প্রাইমারি স্কুল স্থাপন করেন। ১৯৩১
খ্রিস্টাব্দে এটি উচ্চ ইংরেজি গার্লস স্কুলে উন্নিত হয়। তাঁর মৃত্যু পর্যন্ত তিনি এই স্কুলের প্রধান শিক্ষিকা এবং
সুপারিনটেনডেন্টের দায়িত্ব পালন করেছেন। বাংলার নারী জাগরণের এই অগ্রদূত ১৯৩২ সালে কোলকাতায় মৃত্যুবরণ করেছিলেন।
সারসংক্ষেপ :
আঠারো শতকে বাংলায় ‘রেনেসাঁস’ বা নবজাগরণের সূচনা হয়। এই সময়ে বাংলায় প্রচলিত ধর্ম, শিক্ষা-সংস্কৃতি,
সাহিত্য, সমাজ রীতি-নীতি ও ঐতিহ্যের বিরুদ্ধে এক ধরনের চিন্তার বিপ্লব সূচিত হয়। তখনকার নবযুগের জন্ম
দিয়েছিলেন বাংলার একদল শিক্ষিত তরুণ যাঁদের নেতৃত্বে ছিলেন রাজা রামমোহন রায়, ডিরোজিও, ঈশ্বরচন্দ্র
বিদ্যাসাগর, নওয়াব আবদুল লতিফ, সৈয়দ আমির আলী প্রমুখ। তাঁদের নেতৃত্বের প্রভাবে দেশবাসীর মধ্যে
আত্মসচেতনতা, আত্মমর্যাদাবোধ ও স্বাতন্ত্রবোধ তীব্রভাবে জাগ্রত হতে থাকে। অন্যদিকে নারীমুক্তির জন্য কাজ করেন বেগম রোকেয়া।
পাঠোত্তর মূল্যায়ন-৮.৬
বহু নির্বাচনী প্রশ্ন
সঠিক উত্তরের পাশে টিক (√) চিহ্ন দিন।
১। এ্যাংলো হিন্দু কলেজ কে প্রতিষ্ঠা করেন? (জ্ঞানমূলক)
ক) ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর খ) রাজা রামমোহন রায় গ) হাজী মুহম্মদ মুহসিন ঘ) স্যার সৈয়দ আহমদ
২। রাজা রামমোহন আত্মীয়সভা গঠন করেন কেন? (অনুধাবন)
ক) পারস্পারিক সম্পর্ক বৃদ্ধির জন্য খ) সামাজিক সংস্কার সাধন কল্পে
গ) ধর্মীয় মতবাদ প্রচারের জন্য ঘ) জনগণকে নিজের মত চাপিয়ে দেওয়ার জন্য
৩। ডিরোজিও কত বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন? (জ্ঞানমূলক)
ক) একুশ খ) বাইশ গ) তেইশ ঘ) চব্বিশ
৪। ইয়ং বেঙ্গল আন্দোলনের প্রবক্তা হিসেবে নিচের কোন নামটি অধিক যুক্তিযুক্ত?
ক) রাজা রামমোহন রায় খ) ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর গ) হেনরী লুই ডিরোজিও ঘ) প্যারিচাদ মিত্র
৫। বেগম রোকেয়া কোন জেলায় জন্ম গ্রহণ করেন? (জ্ঞানমূলক)
ক) ভাগলপুর খ) রংপুর গ) বগুড়া ঘ) দিনাজপুর
৬। বেগম রোকেয়ার সময়কালে মেয়েরা কেমন ছিল? (অনুধাবন)
ক) উগ্র মানসিকতা সম্পন্ন খ) লাজুক প্রকৃতির গ) অত্যন্ত পর্দানশীন ঘ) ভীরু প্রকৃতির
চূড়ান্ত মূল্যায়ন
সৃজনশীল প্রশ্ন:
করটিয়া গ্রামের আর্থ-সামাজিক অবস্থা হঠাৎ বদলে যাচ্ছে। কয়েকজন শিক্ষিত তরুণ সেখানকার সমাজ বদলে গুরুত্বপূর্ণ
ভূমিকা রাখছেন। সাব্বির, মাসুম, ইফতেখার, মোহাইমিন এবং সুশান্ত এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। অন্যদিকে
নারীদের নানা উন্নয়নে ভূমিকা রাখছে নাবিলা। ব্রিটিশ আমলে এমনি অনেকের ভূমিকায় বদলে গিয়েছিল বাংলার আর্থ-
সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পরিবেশ। উদ্দীপকটি পড়ে উত্তর দিনÑ
১. বাংলার নবযুগে রাজা রামমোহন রায়ের ভূমিকা কি ছিল? ১
২. ডিরোজিও এবং ইয়ং বেঙ্গল মুভমেন্ট সম্পর্কে কি জানেন? ২
৩. ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের সমাজ সংস্কার সম্পর্কে আলোচনা করুন। ৩
৪. নারী মুক্তিতে বেগম রোকেয়ার অবদান কি? ৪

FOR MORE CLICK HERE
এইচএসসি বাংলা নোট ১ম পত্র ও ২য় পত্র
ENGLISH 1ST & SECOND PAPER
এইচএসসি আইসিটি নোট
এইচএসসি অর্থনীতি নোট ১ম পত্র ও ২য় পত্র
এইচএসসি পৌরনীতি ও সুশাসন ১ম পত্র
এইচএসসি পৌরনীতি নোট ২য় পত্র
এইচএসসি সমাজকর্ম নোট ১ম পত্র
এইচএসসি সমাজকর্ম নোট ২য় পত্র
এইচএসসি সমাজবিজ্ঞান নোট ১ম পত্র ও ২য় পত্র
এইচএসসি ইতিহাস নোট ১ম পত্র
এইচএসসি ইতিহাস নোট ২য় পত্র
এইচএসসি ইসলামের ইতি. ও সংস্কৃতি নোট ১ম পত্র
এইচএসসি ইসলামের ইতি. ও সংস্কৃতি নোট ২য় পত্র
এইচএসসি যুক্তিবিদ্যা ১ম পত্র ও ২য় পত্র
এইচএসসি ভূগোল ও পরিবেশ নোট ১ম পত্র ও ২য় পত্র
এইচএসসি ইসলামিক স্টাডিজ ১ম ও ২য় পত্র

Copyright © Quality Can Do Soft.
Designed and developed by Sohel Rana, Assistant Professor, Kumudini Government College, Tangail. Email: [email protected]