ইব্নে খালদুনের প্রতিভার যথার্থপ্রতিফলন ঘটেছে তাঁর ইতিহাস দর্শনের মধ্যে। ইতিহাস
সম্পর্কেতাঁর বৈজ্ঞানিক মতবাদ আধুনিক বিদগ্ধ সমাজে অকুন্ঠ প্রশংসা লাভ করেছে। চতুর্দশ
শতাব্দীতে তিনি ইতিহাসের যে যুক্তিবাদী ও বস্তুনিষ্ঠ ব্যাখ্যা দান করেছিলেন, অষ্টাদশ শতাব্দীর
পাশ্চাত্যের ঐতিহাসিকগণ ইতিহাসকে তাঁর উপর ভিত্তি করে বৈজ্ঞানিক ও বস্তুতাত্তি¡ক
বিবর্তনবাদের উপর প্রতিষ্ঠিত করেছেন। ইতিহাসকে নিরপেক্ষভাবে মূল্যায়ন করার মানসে
ভল্টেয়ার, মন্টেস্কু, গিবন প্রমুখ পাশ্চাত্য চিন্তাবিদগণ ইতিহাসের যে বৈজ্ঞানিক ও যুক্তিবাদী
ব্যাখ্যা দান করেন তা মুসলিম মনীষী ইবনে খালেদুনের কাছ থেকে প্রাপ্ত। ইতিহাসকে তিনি
নির্দিষ্ট কোন ব্যক্তি, বংশ বা কালের প্রেক্ষিতে বিচার না করে বিচার করেছেন শ্বাশত ও
সর্বজনীন মানবসভ্যতার পরিপ্রেক্ষিতে। তিনিই সর্বপ্রথম ইতিহাসের বিবর্তনবাদী প্রকৃতিকে
আবিস্কার করেছেন। ইতিহাস সম্পর্কেইবনে খালদুনের যুক্তিবাদী ও বস্তুনিষ্ঠ ব্যাখ্যা ইতিহাস
সম্পর্কেআগের ধারণার আমূল পরিবর্তন ঘটায়। তিনি বলেন যে, মানব সমাজের নির্ভুল
ইতিহাস রচনা করা একটি গুরুত্বপূর্ণকাজ। এজন্য ইতিহাসবিদকে নিরপেক্ষ হতে হয়। ইবনে
খালেদুনের রচনাবলীর মধ্যে ‘কিতাবুল ইবার’ নামক ইতিহাসদর্শন গ্রন্থটি অমর কীর্তি। এই
পুস্তকটি তিন খন্ডে বিভক্ত। এর প্রথম খন্ডের নাম হচ্ছে-মুকাদ্দিমা বা উপক্রমনিকা। এ
মুকাদ্দিমার মধ্যে তিনি ইতিহাসের যে বৈজ্ঞানিক, বস্তুতাত্তি¡ক ও যুক্তিবাদী বিশ্লেষণ দান
করেছেন তা রাষ্ট্রচিন্তার ইতিহাসে তাঁকে স্থায়ী গৌরবের আসনে অধিষ্ঠিত করেছে। ইতিহাস
সম্পর্কেতিনি ঐতিহ্যমুখী ঐতিহাসিকদের সমালোচনা করে বলেন, “ইতিহাস কেবল রাজাবাদশাহর জয় পরাজয়, বিভিন্নরাজবংশের উত্থান-পতন, রাষ্ট্রবা ধর্মের কাহিনী নয়, ইতিহাস
হচ্ছে মানুষের সামগ্রিক কার্যাবলীর বিবরণ, সভ্যতা বিকাশের ঘটনা পরম্পরার প্রকাশ। মানব
সমাজের প্রকৃতিতে যে পরিবর্তন সাধিত হচ্ছে তা উপলব্ধি করা, তার যথাযথ বিবরণ লিপিবদ্ধ
করাই ঐতিহাসিকের কাজ।” এ পরিবর্তন নানা রকমের হয় এবং নানা ভাবে প্রকাশ পায়।
নগর সামাজিকতায়, কিংবা ধর্মীয়,জাতীয় বা গোষ্ঠীসুলভ সংহতিতে। নতুন নতুন শ্রেণীর
উত্থান, পতন, বিপ্লব, রাজ্যজয়, রাষ্ট্রগঠন বা রাষ্ট্র-পরিবর্তনই এর উদাহরণ। মানুষের আহারবিহারের অভাব পূরণ, জীবন যাত্রার জন্য বিভিন্নশিল্পকলার উদ্ভাবন ও উৎকর্ষসাধন এই
পরিবর্তনেরই বহি:প্রকাশ। এই পরিবর্তন প্রকৃতির অমোঘ নিয়মে হয় এবং এতে ব্যক্তি
বিশেষের বড় একটা হাত নেই। তাঁর এ উক্তি থেকে স্পষ্টভাবেই বুঝা যায় যে, ইতিহাসের
আধুনিক যুক্তিবাদী ব্যাখ্যার সাথে খালেদুনের চিন্তাধারার যথেষ্ট মিল রয়েছে।
ইবনে খালেদুনের পূর্বেপাশ্চাত্য ঐতিহাসিকগণ ইতিহাসের যে ব্যাখ্যা করেন, তার মধ্যে
বাইবেলের কাহিনী, কিংবা খ্রিষ্টান সেইন্টদের অলৌকিক কার্যাবলীর বিবরণ স্থান পায় এবং
খ্রিষ্টপূর্বপ্রাচীন সভ্যতাগুলোকে উপেক্ষা করে ইতহাস রচিত হয়। ইবনে খালদুনই সর্বপ্রথম
ইতিহাসকে এই সংকীর্ণদৃষ্টিভঙ্গি থেকে মুক্ত করে বিশ্বজনীন দৃষ্টিভঙ্গির সূচনা করেন। ইতিহাস
এমন একটি বিজ্ঞান যা সমাজ জীবনের গতি পরিবর্তন সম্পর্কেনিয়ম আবিস্কার করে। বস্তত:
তাঁর এ সংজ্ঞা থেকেই আধুনিক যুক্তিবাদী ইতিহাস শাস্ত্রের সূচনা ঘটেছে। তাঁর মতে, রাষ্ট্রও
মানব সমাজের
নির্ভূল ইতিহাস
রচনা করা একটি
গুরুত্বপূর্ণ কাজ
সভ্যতার ক্রমবিকাশ কোন অমানবীয় শক্তির অধীন নয়। তার মূল চালিকা শক্তি হলো কতগুলো
নিয়ম যা সমাজের বাস্তব পরিস্থিতির ফল। এই নিয়মগুলো সর্বোতভাবে প্রযোজ্য ও কার্যকরী।
স্থান ও কালের পার্থক্য সত্তে¡ও একই বাস্তব পরিবেশে ও অভিন্নকাঠামোতে গঠিত সমাজে
ঐতিহাসিক ক্রমপরিবর্তন একই নিয়ম অনুসরণ করতে বাধ্য।
সমাজবিজ্ঞান সম্পর্কেধারণা
সমাজ বিজ্ঞানের মূল সূত্রের ওপর ভিত্তি করে ইবনে খালদুন ইতিহাসের ঘটনা প্রবাহকে বিচার
বিশ্লেষনের চেষ্টা করেছেন। ইতিহাসের বৈজ্ঞানিক ও যুক্তিবাদী ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে তিনি
বলেন, “বিজ্ঞানভিত্তিক ইতিহাস রচনা করার জন্য সমাজবিজ্ঞানের জ্ঞান একান্তঅপরিহার্য।
তাঁর মতে যে ঐতিহাসিক ইতিহাসকে সমাজবিজ্ঞানের তত্ত¡ও তথ্যের উপর প্রতিষ্ঠা করতে
পারেন না, তাঁর পক্ষে যথার্থইতিহাস রচনা করাও সম্ভব নয়। এ দৃষ্টিকোন থেকে তাঁর
‘মুকাদ্দিমা’ গ্রন্থটি ইতিহাস ও সমাজবিজ্ঞান এ উভয় জ্ঞানভান্ডারের একটি মৌলিক গ্রন্থহিসেবে
সর্বজন স্বীকৃত।
ইবনে খালদুন তাঁর মুকাদ্দিমায় মানব সমাজের জীবনযাত্রার রীতি-নীতি উদ্ভাবনে এবং সমাজ
ও রাষ্ট্রের বাস্তব রূপায়ণে, আবহাওয়া ও প্রাকৃতিক উৎপন্নদ্রব্য প্রভৃতির প্রভাব কিভাবে
প্রতিফলিত হয় তার বিজ্ঞানসম্মত ও বিস্তারিত ব্যাখ্যা দেন। তিনি সমাজবিজ্ঞানকে ইতিহাসের
একটি অতি গুরুতপূর্ণশাখা হিসাবে আবিস্কার করেন এবং এভাবে তাঁর হাতে বিশ্বইতিহাসের
দর্শন পূর্ণাঙ্গভাবে রূপায়িত হয়েছিল। মানবসভ্যতা সম্পর্কেখালদুনের ইতিহাস এক মৌলিক
রচনা।
সমাজবিজ্ঞানের সূত্র ধরে ইবনে খালদুন অভিমত ব্যক্ত করেন যে, পৃথিবীর যে অংশ
নাতিশীতোষ্ণ মন্ডলে অবস্থিত সেখানে প্রধান প্রধান বিজ্ঞান ও কলার উদ্ভব হয় এবং ইতিহাসের
খ্যাতনামা ব্যক্তিবর্গ সে স্থানে জন্মগ্রহণ করেন। অপরদিকে, যে সব দেশের জলবায়ু
চরমভাবাপন্ন, সে সব দেশের সভ্যতা ও কৃষ্টি নি¤œমানের হয়ে থাকে। শুধুতাই নয়, মানুষের
সাধারণ জ্ঞান ও প্রজ্ঞা পৃথিবীর দ্রাঘিমাংশ ও অক্ষাংশের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে থাকে। আর তা
মানুষের অভ্যাস ও রীতিনীতির উপর বিরাট প্রভাব বিস্তার করে। তার মতে যারা বিষুব রেখার
নিকটবর্তী অঞ্চলে বসবাস করে তারা অত্যধিক গরমের কারণে প্রগতি অর্জনের পথে বাধা
প্রাপ্ত হয়। পক্ষান্তরে রোমান, পারসিয়ান ও গ্রীকদের ন্যায় যে সব জাতি নাতিশীতোষ্ণ অঞ্চলে
বসবাস করে, তারা সভ্যতা ও কৃষ্টির ইতিহাসে সবচেয়ে বেশী অবদান রাখতে সক্ষম হয়।
নৈতিক ও আধ্যাত্মিক শক্তি মানব সভ্যতার গতি প্রকৃতিকে প্রভাবিত করে। নাগরিকদের
আদর্শিক ঐক্যবোধ সমাজ সংহতি ও রাষ্ট্রশক্তিকে দৃঢ়তর করে। তিনি ইতিহাসে সমাজ
বিজ্ঞানের মূলসূত্র প্রয়োগ করে ঘটনা প্রবাহকে বিচার বিশ্লেষণ করেছেন।
সারকথা
ইবনে খালদুন ইতিহাসকে সংকীর্ণদৃষ্টিভংগি থেকে মুক্ত করে বিশ্বজনীন দৃষ্টিভংগির সূচনা
করেন। তিনি বিজ্ঞানভিত্তিক ইতিহাস রচনা করার জন্য সমাজবিজ্ঞানের জ্ঞানের প্রতি
বিশেষ গুরুত্বআরোপ করেছেন। তিনি ইতিহাসকে দর্শনের মর্যাদায় অধিষ্ঠিত করেছেন।
তাঁর যুক্তিবাদী ও বস্তুনিষ্ঠ ব্যাখ্যা রাষ্ট্রচিন্তার ইতিহাসকে বাস্তবতার আসনে অধিষ্ঠিত
করেছে।
“যথার্থ
বিজ্ঞানভিত্তিক
ইতিহাস রচনা
করার জন্য
সমাজবিজ্ঞানের
জ্ঞান একান্ত
অপরিহার্য।
সঠিক উত্তরের পাশে টিক () চিহ্ন দিন।
১। সর্বপ্রথম ইতিহাসে বিশ্বজনীন দৃষ্টিভঙ্গির সূচনা করেন কে?
(ক) সেন্ট অগাষ্টিন; (খ) টমাস একুইনাস;
(গ) কার্লমার্কস; (ঘ) ইবনে খালদুন।
২। “ইতিহাস হচ্ছে মানুষের কার্যাবলীর বিবরণ”-এই উক্তিটি কে করেছেন?
ক। এঙ্গেলস; খ। লেনিন;
গ। মাওসেতুং; ঘ। ইবনে খালদুন।
৩। ইবনে খালদুন মানব সমাজের জীবন যাত্রার রীতি নীতি বিজ্ঞানসম্মত ভাবে আলোচনা
করেন কোন গ্রন্থে?
ক। মোকাদ্দিমায়; খ। দি স্পিরিট অব লজ;
গ। গভর্মেন্ট এন্ড পলিটিকস; ঘ। পৃথিবী প্রসঙ্গ।
৪। বিজ্ঞানভিত্তিক ইতিহাস রচনা করার জন্য খালদুন কোন জ্ঞানের প্রতি বিশেষ গুরুত্ব
দিয়েছেন?
ক। অর্থনীতি; খ। ইতিহাস;
গ। রাষ্ট্রনীতি; ঘ। সমাজ বিজ্ঞান।
উত্তরমালা : ১। ঘ ২। গ ৩। ক ৪। ঘ
রচনামূলক প্রশ্ন:
১। ইতিহাসের যুক্তিবাদী ব্যাখ্যা বলতে ইবনে খালদুন কী বুঝিয়েছেন?
২। ইবনে খালদুন সমাজবিজ্ঞানের তত্ত¡ও তথ্যের প্রতি কেন গুরুত্বআরোপ করেছেন?
FOR MORE CLICK HERE
এইচএসসি বাংলা নোট ১ম পত্র ও ২য় পত্র
ENGLISH 1ST & SECOND PAPER
এইচএসসি আইসিটি নোট
এইচএসসি অর্থনীতি নোট ১ম পত্র ও ২য় পত্র
এইচএসসি পৌরনীতি ও সুশাসন ১ম পত্র
এইচএসসি পৌরনীতি নোট ২য় পত্র
এইচএসসি সমাজকর্ম নোট ১ম পত্র
এইচএসসি সমাজকর্ম নোট ২য় পত্র
এইচএসসি সমাজবিজ্ঞান নোট ১ম পত্র ও ২য় পত্র
এইচএসসি ইতিহাস নোট ১ম পত্র
এইচএসসি ইতিহাস নোট ২য় পত্র
এইচএসসি ইসলামের ইতি. ও সংস্কৃতি নোট ১ম পত্র
এইচএসসি ইসলামের ইতি. ও সংস্কৃতি নোট ২য় পত্র
এইচএসসি যুক্তিবিদ্যা ১ম পত্র ও ২য় পত্র
এইচএসসি ভূগোল ও পরিবেশ নোট ১ম পত্র ও ২য় পত্র
এইচএসসি ইসলামিক স্টাডিজ ১ম ও ২য় পত্র