ইংল্যান্ডের ডার্বিতে ১৮২০ সালে স্পেনসারের জন্ম। ব্রিটিশ দার্শনিক হার্বার্ট স্পেনসার ফ্রান্সের
সমাজতান্ত্রিক অগাস্ট কোঁতের ন্যায় দৃষ্টবাদ কথাটি ব্যবহার করেননি তাঁর রচনায়। কিন্তু
স্পেনসারও প্রাকৃতিক বিজ্ঞান বিশেষত: জীববিজ্ঞান ও পদার্থ বিজ্ঞানের ভিত্তিতে সমাজ, রাষ্ট্র,
সরকার এবং রাষ্ট্র ও ব্যক্তির মধ্যেকার সম্পর্ক বিশ্লেষণ করার প্রয়াস পেয়েছেন। এ কারণে
ভাষাকারগণ তাঁকেও দৃষ্টবাদী দর্শনের প্রবক্তা বলে মনে করেন। প্রাকৃতিক বিজ্ঞান দ্বারা
প্রভাবিত হওয়াতেই স্পেনসারের দর্শনে বিবর্তনবাদ, রাষ্ট্রের জৈবিক মতবাদ ও
ব্যক্তিস্বাতন্ত্রবাদের সম্মিলন লক্ষণীয়।
ব্যক্তি জীবন, পারিবারিক পরিমন্ডল ও রচনাবলী
ইংল্যান্ডের ডার্বিতে ১৮২০ সালে স্পেনসারের জন্ম। একযোগে পারিবারিক দারিদ্র ও বংশগত
বিদ্রোহী ঐতিহ্যের কারণে উচ্চ শিক্ষা লাভ করা সম্ভব হয় নি স্পেনসারের পক্ষে। তবে স্বীয়
মেধা ও প্রচেষ্টাকে ব্যবহার করে ইঞ্জিনীয়ারিং-এ তিনি গভীর জ্ঞান অর্জন করেন। মাত্র ১৭
বছর বয়সে রেলওয়ে ইঞ্জিনীয়ার হিসেবে নিয়োগ পেয়ে তিনি লন্ডন এবং বার্মিংহামে ১০ বছর
চাকুরী করেন। এরপর ১৮৫৩ সাল পর্যন্ত দীর্ঘকাল তিনি দুনিয়াখ্যাত “দি ইকোনমিস্ট”
পত্রিকার প্রথমে সহকারী সম্পাদক ও পরে সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। এর আগে তিনি
“নন-কনফর্মিস্ট” পত্রিকায় ‘দি প্রপার স্ফীয়ার অব গভর্নমেন্ট’ শিরোনামে কয়েকটি মূল্যবান
প্রবন্ধ প্রকাশ করেন। স্পেনসারের লেখক খ্যাতি এখান থেকেই প্রসারিত হয়। ‘ইকোনমিস্ট’এর সম্পাদক পদে অবস্থানের সময়ই স্পেনসারের খ্যাতনামা গ্রন্থ “দি সোশ্যাল স্ট্যাটিক্স”
প্রকাশিত হয় ১৮৫১ সালে। ১৮৫৩ সালে ‘ইকোনমিস্ট’ পত্রিকার চাকুরী ত্যাগ করার পর
স্পেনসারের যে সব বই প্রকাশিত হয় তার ভিতর রয়েছে ঃ ‘প্রিন্সিপল্স অব
সাইকোলজি”(১৮৫৫), “ফার্স্ট প্রিন্সিপল্স”(১৮৬২), ‘প্রিন্সিপল্স অব
সোশিওলজি”(১৮৭৩), “দি ম্যান ভার্সাস দি স্টেট”(১৮৮৪) এবং মরণোত্তর
“অটোবায়োগ্রাফী” (১৯০৪)। এখনকার ভিন্ন পৃথিবীতে এগুলোর পাঠ উঠে গেলেও এক সময়
ব্রিটেন, আমেরিকায় স্পেনসারের এসব বই বহুলভাবে পঠিত হয়েছে।
ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্যায়ন ও ডারউইন-পূর্ব বিবর্তনবাদ
হার্বার্ট স্পেনসারের রাষ্ট্র দর্শনের মূল দু’টি দিক হচ্ছে চরম ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ(র্যাডিকাল
ইনডিভিজ্যুয়ালিজম) এবং ডারউইন-পূর্ব বিবর্তনবাদ(প্রি-ডারউইনিয়ান ইভোলিউশন)।
সমকালের দর্শন ও বিজ্ঞানের সরাসরি প্রভাব স্পেনসারীয় দর্শনে লক্ষণীয়। জন বাউল তাঁর
“পলিটিক্স এ্যান্ড ওপিনিয়ন ইন দি নাইনটিন্থ সেঞ্চুরী” গ্রন্থে মত প্রকাশ করেছেন যে,
স্পেনসারের দর্শনে চরমপন্থী ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ এসেছে তাঁর পারিবারিক ঐতিহ্য এবং দুই প্রবল
ব্রিটিশ ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্যবাদী উইলিয়াম গডউইন ও টমাস হজকিনের চিন্তা থেকে। এ দু’জন
জেরেমী বেন্থামের থেকে খানিকটা আলাদা ধরনের হলেও ব্যক্তির চরম স্বাতন্ত্র্যবাদে আস্থাশীল
ছিলেন। সে কারণে তাঁরা মানুষের প্রাকৃতিক অধিকারের নীতি এবং রাজনীতি ও অর্থনীতিতে
‘লেসেফের’ নীতির উপর জোর দিয়েছেন। এদিকে আর্নেস্ট বার্কার তাঁর “পলিটিক্যাল থট ইন
ইংল্যান্ড” গ্রন্থে ব্যাখ্যা করেছেন যে, বেন্থাম ভিন্নভাবে অর্থনীতিকে প্রকৃতির অবাধ খেয়ালের
উপর নির্ভরশীল করে আইন ও রাজনীতিকে বৈজ্ঞানিক নিয়ন্ত্রণের অধীন বলে মত দেন।
অপরপক্ষে স্পেনসার বেন্থামীয় উপযোগবাদে বিশ্বাসী হয়েও “সর্বাধিক সংখ্যক মানুষের আনন্দ”
নীতির প্রয়োগের সম্ভাব্যতা নিয়ে সন্দেহ করেন এবং এর কড়া সমালোচনা করেন। স্পেনসারের
উপর বরং গডউইন ও হজকিনের চরমবাদ ও ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যের প্রভাবই অধিক দৃষ্ট হয়।
জার্মান ভাববাদ ও নন-কনফর্মিজমের প্রভাব
স্পেন্সারের দর্শনের উপর দ্বিতীয় প্রভাবটি আসে কোলেরিজের মাধ্যমে পাওয়া জার্মান ভাববাদ
এবং ল্যামার্কের ডারউইন-পূর্ব বিবর্তনের ধারণা হতে। জন বাউল মন্তব্য করেছেন, ল্যামার্ক
বিবর্তনের যে ধারণা দেন সেটার ভিতর তিনি পুরুষানুক্রমে প্রাপ্ত চারিত্রিক গুণসমূহের উপর
সবিশেষ জোর দিয়েছেন। এতদ্ব্যতীত, স্পেনসারের পারিবারিক প্রভাব এবং তাঁর চাচা
রেভারেন্ড টমাস স্পেনসার ও নটিংহামের জোসেফ স্টার্জ কর্তৃক প্রকাশিত “ননকনফর্মিস্ট”পত্রিকার সঙ্গে সংযোগ এবং সেখানে ‘নন-কনফর্মিজম’-এর পক্ষে লেখার মধ্য
দিয়েও তাঁর ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদী দর্শন গড়ে উঠে।
স্পেনসার প্রাকৃতিক বিজ্ঞান ও জার্মান ভাববাদ - এ দুই পরস্পর সঙ্গতিহীন উপাদানদ্বয় থেকেও
প্রভাবিত হন। আর্নেষ্ট বার্কারের মতে, জার্মান ভাববাদের প্রভাব স্পেনসারের দর্শনে পড়ে
ইংরেজ দার্শনিক কোলেরিজের মাধ্যমে জার্মান দার্শনিক শেলিং এর কাছ
থেকে।
স্পেনসার তাঁর “সোশ্যাল স্ট্যাটিক্স” গ্রন্থে ‘জীবনের ধারণা’ বলে যে, প্রত্যয়টি তুলে ধরেন
তার উৎস জার্মান ভাববাদ। এ ধারণা মতে, জীবন প্রকৃতির কোনো ঘটনা নয় এবং এটা
নির্দিষ্ট কোন প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের বিষয়ও নয়। এটা এক অতীন্দ্রিয় নীতি। এই নীতি অনুয়ায়ী
সার্বিকভাবে প্রকৃতি, আর প্রকৃতির অংশরূপে সমাজ বহিমূর্খী প্রবণতার ভিতর দিয়ে চ‚ড়ান্ত
‘স্বাতন্ত্রয়নের’ (ওহফরারফঁধঃরড়হ) পথে বিবর্তিত হয়। এরূপ নীতি অনুযায়ী জীবনই বিশ্বজনীন
বিবর্তনের একমাত্র কারণ।
প্রাকৃতিক বিজ্ঞান ও যোগ্যতমের উদ্বর্তন
তবে এর পরও অর্থাৎ জার্মান ভাববাদের দ্বারা প্রভাবিত হয়েও স্পেনসার পরবর্তী সময়ে
জীববিজ্ঞান ও পদার্থ বিজ্ঞানের ন্যায় প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের প্রভাবে চলে যান। ওদিকে অগাস্ট
কোঁতের বিবর্তন নীতি বিষয়ে স্পেনসারের কোনো প্রত্যক্ষ ধারণা না থাকলেও ঐশ্বরিক ও
অতীন্দ্রিয় ধারণা পরিত্যাগকরতঃ স্বীয় অজ্ঞাতেই তিনি যেন কোঁতীয় দর্শনের কাছাকাছি চলে
যান। এভাবে ১৮৫৯ সালে চার্লস ডারউইনের “অরিজিন অব স্পেসিস” রচিত হবার আট বছর
আগেই স্পেনসার ‘যোগ্যতমের উর্দ্বতন’(সারভাইভাল অব দি ফিটেস্ট) নীতির বিকাশ ঘটান।
স্পেনসারের বিবর্তন তত্ত¡কে এজন্যে “ডারউইনপূর্ব বিবর্তনবাদ”(প্রি-ডারউইনিয়ান থিওরী অব
ইভোলিউশন) আখ্যা দেয়া হয়। এ ছাড়া স্পেনসার যথাক্রমে জীববিজ্ঞানী জে.বি.ল্যামার্ক এবং
সমাজবিজ্ঞানী এইচ.টি.বাক্ল-এর দ্বারা প্রভাবিত হয়ে স্বীয় বিবর্তন তত্তে¡ ‘চারিত্রিক প্রবণতার
পুরুষানুক্রমিক সম্প্রসারণ’ (হেরিডিটারী ট্রান্সমিশন অব একোয়ার্ড ক্যারেক্টারিস্টিক্স) এবং
‘বাহ্যিক পরিবেশের প্রভাব’(ইনফ্লুয়েন্স অব এক্সটার্নাল এনভার্নমেন্ট)-এ দু’টি ধারণা সংযুক্ত
করেন।
স্পেনসার বিবর্তনবাদের কট্টর সমর্থক হলেও তাঁর বিবর্তনবাদ ডারউইনের মতো কেবল
প্রাকৃতিক বিজ্ঞান থেকে বিকশিত নয়। তাঁর বিবর্তন তত্তে¡র প্রথম পর্যায়ে কোলেরিজমের
মাধ্যমে প্রাপ্ত জার্মান ভাববাদের প্রভাবে ঐশ্বরিক ও অতীন্দ্রিয় ধারণা উপস্থিত। দ্বিতীয় পর্যায়ে
প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের দ্বারা সৃষ্ট প্রভাব। ফলে একদিকে চরম ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ (এক্সট্রিম
ইনডিভিজ্যুয়ালিজম), আর অপরদিকে সামাজিক জৈববাদ (সোশ্যাল অরগানিজম) একত্রে
এসে এক মৌলিক অসঙ্গতি,স্ববিরোধিতা ও অবাস্তবতা তৈরি করে।
রাষ্ট্র সম্পর্কিত ধারণা
স্পেনসার এখানে যে যুক্তি দেখান, তা থেকে বোঝা যায় যখন মানুষের পক্ষে তার পারিপার্শ্বিক
অবস্থার সঙ্গে পরিপূর্ণভাবে খাপ খাওয়ানো সম্ভব হয়, অর্থাৎ যখন শক্তি ও সমাজের ভিতর
ভারসাম্য প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হয়, একমাত্র তখন পূর্ণাঙ্গ সমাজ প্রতিষ্ঠা পায়। স্পেনসারের
বিবর্তন তত্তে¡ রাষ্ট্র ও সমাজ তুলনীয় হয়েছে জীবন্ত প্রাণীর(লিভিং অরগানিজম)-এর সঙ্গে।
জীবন্ত প্রাণীর ন্যায় রাষ্ট্র দীর্ঘকাল যাবৎ পরিচালিত মন্থর ও সচেতন বিকাশের ফল। এটি
কলকারখানায় প্রস্তুতকৃত যন্ত্রের ন্যায় কোনো বস্তু নয়। স্পেনসারের ভাষায় ‘দি স্টেট ইজ এ
গ্রোথ, এ্যান্ড নট এ ম্যানুফেকচার’। সামাজিক চুক্তি মতবাদ ও ঐশ্বরিক মতবাদের প্রচন্ড
বিরুদ্ধাচরণ করে রাষ্ট্র সম্পর্কে স্পেনসারের এই মতবাদ। স্পেনসার মনে করেন, জীববিজ্ঞান
ও মনোবিজ্ঞানের ভ‚মিকা হচ্ছে যথাক্রমে মানুষের দেহ ও মনের বিবর্তন নিয়ে আলোচনা করা।
অন্যদিকে সমাজ বিজ্ঞানের কাজ হচ্ছে মানুষের সমাজ, রাষ্ট্র, সরকার এ সবের বিবর্তন বিষয়ে
বিশ্লেষণ।
সরল থেকে জটিল
স্পেনসারের বিবর্তন তত্তে¡র মূলনীতি হচ্ছে সমগ্র প্রকৃতিতে ব্যতিক্রম ছাড়াই বিবর্তন নীতি
ক্রিয়াশীল। প্রতিটি বস্তু বা প্রাণী তাই সরল অবস্থা থেকে জটিল অবস্থার(ফ্রম সিম্পল টু
কমপ্লেক্স) দিকে এগোয়। মানব সমাজও এই বিবর্তন নীতির ফল। বিবর্তনের কারণেই
প্রকৃতির প্রত্যেক বস্তু, জীব, জড় নির্বিশেষে নিরবচ্ছিন্নভাবে প্রগতিমুখী। কেননা এর ফলে
প্রতিটি বস্তুই সমসাদৃশ্যের অবস্থা থেকে অসমসাদৃশ্যের অবস্থায় রূপান্তরিত হয়(ট্রান্সফর্মেশন
অব দি হোমোজিনিয়াস ইন টু দি হেটেরোজিনিয়াস)। স্পেনসার তাই বিবর্তন ধারাকে
আকস্মিক নয়, অবশ্যম্ভাবী বলে আখ্যা দেন(নট এ্যাজ এ্যান এ্যাক্সিডেন্ট বাট এ্যাজ এ
নেসেসিটি)।
আধুনিক যুগে স্পেনসারের এই চ‚ড়ান্ত ভারসাম্যের নীতিকে প্রত্যাখ্যান করেন বিজ্ঞানীরা।
বিবর্তনের ধারা তাদের মতে স্তব্ধতা পায় না। এটা চির প্রবহমান প্রক্রিয়া। এই প্রক্রিয়ায় প্রতিটি
‘সামঞ্জস্যায়ন’(এ্যাডাপটেশন) নব নব অবস্থা তৈরি করে এবং আবারও নতুন করে সামনে
আসে ‘সামঞ্জস্যায়নের’ আবশ্যকতা। এটা ‘ধফধঢ়ঃধঃরড়হ, ‘ধফ রহভরহরঃঁস’ অর্থাৎ সীমাহীন
এক প্রক্রিয়া। এ ভাবে স্পেনসারের দর্শন ও রাজনীতিক চিন্তার কেন্দ্রীয় নীতিই পরিত্যক্ত হয়।
জীবদেহ ও সমাজদেহ
স্পেনসার জীবদেহের সঙ্গে সমাজদেহের সাদৃশ্য তুলে ধরলেও তাঁর দর্শনে এ উভয়
‘অর্গানিজম’-এর বৈসাদৃশ্যও স্পষ্টভাবে জানিয়ে দিয়েছেন। ফলে রাষ্ট্র কর্তৃত্ববাদীরা
স্পেনসারের তত্ত¡কে তাদের চিন্তার অনুক‚লে নিয়ে ব্যবহার করতে ব্যর্থ হয়েছেন এবং
স্পেনসারের ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদই স্পষ্টতর হয়েছে। সাদৃশ্যের পর সকল বৈসাদৃশ্য প্রদর্শন করে
স্পেনসার যে বিষয়টি স্বচ্ছ করতে পেরেছেন তা হলো জীবদেহের অংশগুলো জীবদেহের সঙ্গে
মিশে যায় এবং সমগ্র জীবদেহ এককভাবে যৌথ চেতনার(কর্পোরেট কনশাসনেস) অধিকারী
হয়ে একযোগে সুখ-দুঃখ অনুভব করে। কিন্তু একেবারেই বিপরীতে সমাজদেহে সেটা ঘটে
না। এখনে প্রত্যেক ইউনিট স্বতন্ত্র চেতনার (ইনডিপেন্ডেন্ট কনশাসনেস) অধিকারী। “ফ্রম
লুথার টু হিটলার” গ্রন্থে ডবিøউ এম. ম্যাকগভার্ন তুলে ধরেন যে, এ ভাবে সমাজের যৌথ
চেতনার অস্বীকৃতির মাধ্যমে রাষ্ট্রের কল্পিত কল্যাণে নয় বরং ব্যক্তির কল্যাণে ব্যক্তির টিকে
থাকার নীতি সামনে আসে। রাষ্ট্রের প্রয়োজনে ব্যক্তির উৎসর্গকরণ নয়, বরং ব্যক্তির প্রয়োজনে
রাষ্ট্রকে উৎসর্গকরণই নীতি হয়ে দাঁড়ায়।
ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য ও লেসেস ফেয়ার
এভাবে স্পেনসার বিবর্তনবাদী জৈবিক মতবাদী হয়েও শেষাবধি ব্যক্তি স্বাতন্ত্রবাদী হিসেবেই
গৃহীত হন। তাঁর “স্যোশাল স্ট্যাটিক্স“ সামাজিক জৈববাদের বøুপ্রিন্ট। আর তাঁর “দি ম্যান
ভার্সাস দি স্টেট” নি:সংশয়ে ব্যক্তি স্বাতন্ত্রবাদদের বøুপ্রিন্ট। স্পেনসার পুরো রাষ্ট্রতত্ত¡কে
বিশেষভাবে তাঁর ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ ও অর্থনৈতিক ‘লেসেস ফেয়ার’ তত্ত¡কে প্রাকৃতিক অধিকারের
সঙ্গে সম্পর্কিত করেন। তাঁর মতে এ সব নীতি প্রগতির সঙ্গে সঙ্গতিমূলক।
স্পেনসারের ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদের দর্শন তাঁর “দি ম্যান ভার্সাস দি স্টেট’ গ্রন্থে তুলে ধরা হয়েছে।
এই গ্রন্থের ‘দি নিউ টোরিজম’ প্রবন্ধে স্পেনসার ইংল্যান্ডের ‘হুইগ’, ‘লিবারাল’ এবং ‘টোরী’ বা
‘কনজারভেটিভ’দের সামাজিক সংস্কার ও কল্যাণ রাষ্ট্রনীতি গ্রহণের বিরোধিতা করে একশো
ভাগ ‘লেসেস ফেয়ার’ নীতি গ্রহণ করার দাবি তুলেছেন। স্পেনসার সামারিক রাষ্ট্র ও শিল্প রাষ্ট্র
এই দুই ভাগে রাষ্ট্রকে ভাগ করে শিল্প রাষ্ট্রের পক্ষে স্বীয় মত দিয়েছেন। একই গ্রন্থের ‘দি কামিং
úেভারী’ প্রবন্ধে ব্যক্তি ও সমাজ জীবনে রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণকে ‘কৃত্রিমভাবে স্বাভাবিকের নিয়ন্ত্রণ’
বলে কড়া সমালোচনা করে ‘যোগ্যদের উদ্বর্তন’ নীতিকে স্বাভাবিক নীতি হিসেবে আখ্যায়িত
করেছেন স্পেনসার। রাষ্ট্রের কর্তৃত্ব বৃদ্ধি ও রাষ্ট্রের উদ্যোগে কাজ সমাধা ও সমস্যা সমাধানের
ফলে মানুষ অভ্যাসবশত রাষ্ট্রের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে এবং নিজেদের উদ্যোগ,
কর্মক্ষমতা ও স্বাধীনতা হারিয়ে ‘নয়া দাসত্বে’ আবদ্ধ হয়। এটা কেবল সমাজ কল্যাণ ব্যবস্থাকেই
নয়, তৎকালে আসন্ন সমাজতন্ত্র ও সাম্যবাদেও ঘটবে বলে স্পেনসার মত দেন। ‘দি সিন্স
অব লেজিসলেটর্স’ প্রবন্ধে স্পেনসার দেখান যে, সমাজের কোনো আবিষ্কার, উদ্ভাবন, প্রগতি,
কল্যাণ, বিজ্ঞানের উৎকর্ষ এবং মানুষের জীবনোপকরণের উন্নয়ন সরকারী ও রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণে
হয়নি, অথচ এর পরও রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণের সুযোগে মানুষের কল্যাণের ভান করে আইন প্রণেতারা
আইন বানায়, না বুঝে মানুষের কল্যাণের নামে অকল্যাণ করে। এটাই স্পেনসারের ভাষায়
আইন প্রণেতাদের পাপ।
এরপর “দি গ্রেট পলিটিক্যাল সুপারস্টিশন” প্রবন্ধে স্পেনসার পূর্বকালে রাজাদের দৈব
অধিকারকে এভাবে পার্লামেন্টসমূহের দৈব অধিকার বলে আখ্যা দেন। প্রবন্ধে স্পেনসার
অধিকার রাষ্ট্রের সৃষ্টি - এই মতকে সম্পূর্ণ অস্বীকার করে জন লকের সাথে একমত হয়ে ঘোষণা
দেন যে, অধিকার রাষ্ট্রের পুর্বে আসে (রাইট প্রিসিড্স দি স্টেট)। “দি গ্রেট পলিটিক্যাল
থিংকার্স” গ্রন্থে ইউলিয়াম ইনেস্টেইন বলেন, এভাবে ১৮৪২ সনে “প্রপার স্ফীয়ার অব
গভার্নমেন্ট” বই প্রকাশ থেকে আরম্ভ করে ১৯০৩ সালে মৃত্যু পর্যন্ত স্পেনসার সমাজ ও
অর্থনীতির বিরাট বদল সত্তে¡ও চরম ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদের প্রবক্তাই রয়ে যান।
মূল্যায়ন
হার্বার্ট স্পেনসার বিবর্তনবাদে অবদান রাখলেও তাঁর আসল পরিচয় ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদী হিসাবে।
তিনি রাষ্ট্রকে কোনো কৃত্রিম প্রতিষ্ঠান না বলে বিকাশের ফল বলে আখ্যা দেন। আজকে
স্পেনসারের ব্যাখ্যার ন্যায় চরম ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্যবাদ অপ্রয়োজনীয় ও বাতিল বিবেচিত হলেও
সর্বাÍকবাদ, সমাজতন্ত্র ও সাম্যবাদের প্রাবল্যে নিস্পিষ্ট মানুষের ব্যক্তি স্বাধীনতার প্রশ্নে এ দর্শন
কার্যকারিতা রেখেছে। চেস্টার সি. ম্যাক্সীর ভাষায়, স্পেনসার ছিলেন ভিক্টোরিয়া যুগের
ইংল্যান্ড ও আমেরিকার এরিস্টটল। স্পেনসার ছাড়া অপর কোনো দার্শনিক স্বীয় জীবনকালে
এত বেশি প্রভাব ছড়াতে পারেন নি।
স্পেনসার রাষ্ট্রচিন্তায় অবদান রাখলেও তাঁর দর্শন ছিল পরস্পরবিরোধিতা, ভ্রান্তি, অসম্পূর্ণতা
ও অসঙ্গতিতে ঠাঁসা। তাঁর ‘যোগ্যতমের উদ্বর্তন’, ‘প্রাকৃতিক তথা স¦াভাবিক বাছাই নীতি’ -
এসব বিবর্তনবাদী তত্ত¡ পরবর্তীকালে যেমন বিজ্ঞানেও ভ্রান্ত প্রমাণিত হয়েছে, তেমনি সমাজ ও
রাষ্ট্রবিজ্ঞানেও। এগুলো যেমন ছিল অনৈতিক ও অযৌক্তিক, তেমনি অস্বাভাবিক ও অবাস্তব।
এ ছাড়া জীববিজ্ঞান আর রাষ্ট্রবিজ্ঞানকে যে একই জোয়ালে আবদ্ধ করা যায় না (ক্যান নট বি
ইয়োকড্ টুগেদার) - এটা বোঝেন নি স্পেনসার। এদিকে রাষ্ট্রের কর্তৃত্ব সীমিত করতে গিয়ে
স্পেনসার যে মত দেন, তাতে করে রাষ্ট্র অস্তিত্বহীনতার সামিল হয়ে পড়ে। অথচ সভ্য সমাজ
রাষ্ট্র ব্যতিরেকে চলে না। আসলে উইলিয়াম গডউইন, টমাস হজকিন এসব নৈরাজ্যবাদী
স্বাতন্ত্রবাদীদের দ্বারা প্রভাবিত হওয়ায় স্পেনসারের চরম ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদও কার্যত
নৈরাজ্যবাদের স্মারক হয়ে দাঁড়ায়। স্পেনসারের বুদ্ধিবৃত্তি বিরোধী বিবর্তনবাদী ‘লেসেস ফেয়ার’
ও চরম ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ এক সময়ে স্বৈরাচারের প্রতিপক্ষ হিসেবে উঠে এলেও সময়ের
পরিক্রমায় আজ তা পরিত্যক্ত।
সারকথা
হার্বার্ট স্পেনসারের দর্শনে উপযোগবাদ, নন কনফর্মিজম, জার্মান ভাববাদ, লেসেস
ফেয়ার,ডারউইন-পূর্ব বিবর্তনবাদ ও চরম ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদের সম্মিলন ঘটেছে। অগাস্ট
কোঁতের ন্যায় প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের প্রভাব থাকায় তাঁর দর্শনকেও দৃষ্টবাদী বলা হয়। তার
যোগ্যতমের উদ্বর্তন, প্রাকৃতিক বাছাই নীতি, খাপ খাওয়ানোর নীতি এবং লেসেস ফেয়ার
তাকে শেষাবধি চরম ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদী করে তুলেছে। রাষ্ট্র কর্তৃত্বকে তিনি সীমিত করে
প্রায় শূন্যের কোঠায় ঠেলে দেন। আজকে স্পেনসারের ব্যাখ্যার ন্যায় চরম
ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ অপ্রয়োজনীয় ও বাতিল বলে বিবেচিত হলেও সর্বাতœকবাদ, সমাজতন্ত্র
ও সাম্যবাদের প্রাবল্যে নিস্পিষ্ট মানুষের ব্যক্তি স্বাধীনতার প্রশ্নে এ দর্শন কার্যকারিতা
রেখেছে। স্পেনসারকে ভিক্টোরিয়া যুগের ইংল্যান্ড ও আমেরিকার এরিস্টটল বলা হয়।
স্পেনসার ছাড়া অপর কোন দার্শনিক স্বীয় জীবনকালে এত বেশি প্রভাব ছড়াতে পারে
নি।
সঠিক উত্তরের পাশে টিক () চিহ্ন দিন।
১। হার্বাট স্পেনসার কোথায় জন্ম গ্রহণ করেন?
ক) জার্মানীতে; খ) ইংল্যান্ডে;
গ) ফ্রান্সে; ঘ) স্পেনে।
২। হার্বাট স্পেনসার কোন গ্রন্থে ব্যক্তি স্বাতন্ত্রবাদের দর্শন তুলে ধরেন?
ক) সোশাল স্ট্যাটিকস; খ) প্রিন্সিপাল অব সোশিওলজি;
গ) দি ম্যান ভার্সাস দি স্টেট; ঘ) প্রিন্সিপল অব সাইকোলজি।
সংক্ষিপ্ত উত্তরমূলক প্রশ্ন
১। স্পেনসার কি একজন বিবর্তনবাদী ছিলেন?
২। ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্যবাদ কী?
রচনামূলক প্রশ্ন
১। হার্বাট স্পেনসারের রাজনৈতিক জীবন সম্পর্কে আলোচনা করুন।
সঠিক উত্তর : ১। খ, ২। গ
FOR MORE CLICK HERE
এইচএসসি বাংলা নোট ১ম পত্র ও ২য় পত্র
ENGLISH 1ST & SECOND PAPER
এইচএসসি আইসিটি নোট
এইচএসসি অর্থনীতি নোট ১ম পত্র ও ২য় পত্র
এইচএসসি পৌরনীতি ও সুশাসন ১ম পত্র
এইচএসসি পৌরনীতি নোট ২য় পত্র
এইচএসসি সমাজকর্ম নোট ১ম পত্র
এইচএসসি সমাজকর্ম নোট ২য় পত্র
এইচএসসি সমাজবিজ্ঞান নোট ১ম পত্র ও ২য় পত্র
এইচএসসি ইতিহাস নোট ১ম পত্র
এইচএসসি ইতিহাস নোট ২য় পত্র
এইচএসসি ইসলামের ইতি. ও সংস্কৃতি নোট ১ম পত্র
এইচএসসি ইসলামের ইতি. ও সংস্কৃতি নোট ২য় পত্র
এইচএসসি যুক্তিবিদ্যা ১ম পত্র ও ২য় পত্র
এইচএসসি ভূগোল ও পরিবেশ নোট ১ম পত্র ও ২য় পত্র
এইচএসসি ইসলামিক স্টাডিজ ১ম ও ২য় পত্র