কৃষককুলের মুক্তির দিসারী ফজলুল হক-ব্যাখ্যা করুন। শিক্ষা বিস্তারে ফজলুল হকের অবদান

আধুনিক আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থায় রাজনীতি সর্বব্যাপী গুরুত্ব লাভ করেছে। সামাজিক সম্পদ ও
সুবিধার বন্টন এবং সমাজকে পরিচালনার নীতি-পদ্ধতি নির্ধারণের লক্ষ্যে আর্থ-সামাজিক
নিয়ামকসমূহের সমন্বয় বিধানের আধুনিক প্রক্রিয়াই হ’ল রাজনীতি। বর্তমান যুগে রাজনীতি প্রধানত:
সাংগঠনিক ও প্রাতিষ্ঠানিক চরিত্র লাভ করেছে। কোন জনপদের ঐতিহ্য, ইতিহাস ও ইপ্সিত লক্ষ্যের
সাথে সমসাময়িক অবস্থার পরিপ্রেক্ষিত একত্রিত হ’য়ে সামাজিক শক্তিসমূহকে ক্রিয়াশীল করে। মানুষ
এ সব শক্তির দ্বারা চালিত হয়। আবার, কোন কোন মানুষ যুগে যুগে আবিভর্‚ত হ’য়ে এ সব সামাজিক
ও রাজনৈতিক শক্তিকেই নিয়ন্ত্রণ বা বিশেষ গন্তব্যে প্রবাহিত করে থাকেন। স্থান ও কালের সম্ভাব্য
সকল প্রতিক‚লতাকে মোকাবেলা ক’রে এ সব মানুষের কেউ কেউ তাঁদের জনগোষ্ঠীকে অভীষ্ট লক্ষ্য
পাইয়ে দিতে পারেন। এঁদের আসন তখন ঐসব জনগোষ্ঠীর ইতিহাসে স্থায়ী হয় কালোত্তীর্ণ গৌরবের
সাথে। তাঁরা একদিকে যেমন ইতিহাসের সৃষ্টি, অন্যদিকে আবার ইতিহাস সৃষ্টিকারী ব্যক্তিত্বও বটে।
তাঁদের জীবন ও কীর্তি জানার সাথে সাথে সমসাময়িক ইতিহাসেরও অনেকখানি জানা হ’য়ে যায়।
বাংলাদেশের আধুনিক কালের ইতিহাসে স্থান সৃষ্টিকারী এ রকম কয়েকজন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের
প্রাসঙ্গিক জীবনকথা বর্তমান ইউনিটে আলোচিত হবে। জাতির তৎকালীন ও ভবিষ্যতের জীবনপ্রবাহ
উপলব্ধির ক্ষেত্রে এ সকল জীবনালেখ্য অশেষ সাহায্যকারী ভ‚মিকা পালন করে। স্ব স্ব ক্ষেত্রে কীর্তিমান
যে সব ব্যক্তিত্বের জীবনকথা
শেরে বাংলা একে ফজলুল হক বাঙালি জাতির গৌরব শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক। তার মহতী কর্ম ও অবদানের জন্য তিনি
স্মরণীয় হয়ে আছেন আমাদের মাঝে। তিনি ছিলেন এদেশের কৃষক-শ্রমিক ও সাধারণ মানুষের
মুক্তিদাতা। শিক্ষার আলো জ্বেলে এবং প্রজাস্বত্ত¡ আইন পাশ করে সাধারণ মানুষের মুখে তিনি হাসি
ফুটিয়েছিলেন। তিনি ছিলেন সাধারণ মানুষের দরদী বন্ধু। এ দেশের সাধারণ মানুষ, বিশেষ করে
বাংলার মুসলমান সমাজ যখন অশিক্ষা, দারিদ্র্য আর হতাশার মধ্যে নিমজ্জিত, তখন এই অধ:পতিত
জাতিকে উদ্ধার করেন শেরে বাংলা ফজলুল হক।
জন্ম
শেরে বাংলা আবুল কাসেম ফজলুল হক ১৮৭৩ সালের ২৬ অক্টোবর বরিশালের রাজাপুর থানার
সাতুরিয়া গ্রামে মাতুলালয়ে জন্ম গ্রহণ করেন। তার পিতার নাম মোহাম্মদ ওয়াজেদ আলী এবং মাতার
নাম বেগম সৈয়দুন্নেছা। তার পিত্রালয় ছিল চাখার নামক গ্রামে। তার শৈশব, কৈশোর ও যৌবনের
বেশির ভাগ সময়ই কেটেছে চাখার গ্রামে। ছাত্র জীবনে তিনি অসাধারণ মেধার পরিচয় দেন। তিনি
বহুমুখী এবং বিরল প্রতিভার অধিকারী ছিলেন।
শিক্ষা বিস্তারে ফজলুল হকের অবদান দেশের প্রবাহমান রাজনৈতিক ঘটনা থেকে ফজলুল হক উপলব্ধি করেছিলেন শিক্ষা ছাড়া মুসলমান তথা বঞ্চিত মানুষের দারিদ্র্য দূরীকরণ এবং তাদের রাজনৈতিক অধিকারবোধ ও স্বাধীন চেতনা ফিরিয়ে আনা সম্ভব নয়। তাই শিক্ষা বিস্তারকে তিনি তার রাজনৈতিক জীবনের প্রথম কর্মোদ্যোগ হিসেবে গ্রহণ করেন। ফজলুল হক শিক্ষা বর্জননীতি কখনও সমর্থন করেন নি। শিক্ষা বর্জন করলে পশ্চাৎপদ ও বঞ্চিত মুসলমান সমাজ আরো পিছিয়ে যাবে, শিক্ষা ও রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠা লাভের ক্ষেত্রে অধিকার বৈষম্য নীতির শিকার হবে, তা তিনি উপলব্ধি করেছিলেন। শিক্ষা বিস্তারে ফজলুল হকের ভ‚মিকা সত্যই তুলনাহীন। বরিশালে তিনি একটি কলেজ স্থাপন করেন এবং তিনি সেই কলেজের গণিত শাস্ত্রের অধ্যাপনার ভার গ্রহণ করেন। ১৯১২ সালে ফজলুল হক কলকাতায় কেন্দ্রীয় মুসলিম শিক্ষা সমিতি গঠন করেন। এই
শিক্ষা সমিতির মাধ্যমে তিনি মুসলমানদের শিক্ষাকে স্তরে স্তরে এগিয়ে নিয়েছিলেন।
ফজলুল হক ছিলেন
সাধারণ মানুষের
দরদী বন্ধু।
আবুল কাশেম ফজলুল হকের প্রচেষ্টায় ১৯১৬ সালে কলকাতায় ‘বেকার হোস্টেল’ ও ‘কারমাইকেল
হোস্টেল’ প্রতিষ্ঠিত হয় এবং তারই একক প্রচেষ্টায় উক্ত দু’টি ছাত্রাবাস থেকে লেখা-পড়া শিখেছেন
এপার ও ওপার বাংলার বহু জ্ঞানী-গুণী ব্যক্তি। এ ছাড়া তারই প্রচেষ্টায় ইলিয়ট হোস্টেল, টেইলর
হোস্টেল, মেডিক্যাল কলেজ, ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ, মুসলিম হোস্টেল এবং মুসলিম ইনস্টিটিউটের
বিরাট ভবন প্রতিষ্ঠিত হয়।
১৯২৪ সালের ১লা জানুয়ারি এ, কে, ফজলুল হক অবিভক্ত বাংলার শিক্ষামন্ত্রীর পদ গ্রহণ করেন। এই
মন্ত্রীত্বের কাল ছয়মাস হলেও উক্ত সময়ের মধ্যে তিনি কলকাতায় একটি প্রথম শ্রেণীর কলেজ স্থাপন
করেন। এই কলেজই পরে ইসলামিয়া কলেজ নামে অভিহিত হয়। বর্তমানে এই কলেজটির নাম
মৌলানা আযাদ কলেজ। ইতিপূর্বে মুসলমানদের শিক্ষক পদে নিয়োগ করা হতো না। ইসলামিয়া
কলেজ প্রাতিষ্ঠার পর সারা ভারতের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে মুসলমান শিক্ষকদের এনে এই কলেজে তিনি
নিযুক্ত করেছিলেন। এই সময় তিনি মুসলমানদের মধ্যে শিক্ষাবিস্তারের জন্য আলাদা ডাইরেক্টরেট
স্থাপন করেন এবং একটি স্বতন্ত্র মুসলিম তহবিল গঠন করেন। তখন স্কুলসমূহে সংখ্যালঘু হিন্দুদেরই
একাধিপত্য ছিল। মুসলমান ছাত্রদের স্কুলে ভর্তীর ব্যাপারটাও ছিল খুবই কষ্টসাধ্য। তা ছাড়া মুসলমান
ছাত্রদের সংস্কৃত পড়তে হতো। কারণ, সরকারী স্কুল ছাড়া অন্য কোন স্কুলে আরবি, ফার্সী পড়ানো
হতো না। তিনি উপলব্ধি করলেন মফস্বল স্কুলে আরবি ও ফার্সী পড়ানোর ব্যবস্থা না করলে
মুসলমানদের শিক্ষার প্রতি আগ্রহ বাড়বে না। তাই তিনি আদেশ জারী করলেন কোন স্কুল সরকারী
সাহায্য পেতে চাইলে একজন মুসলমান শিক্ষক ও একজন মৌলভী রাখতে হবে। তাই শিক্ষা দরদী
ফজলুল হক মুসলমান ছাত্রদের জন্য সকল স্কুল, কলেজ, ইঞ্জিনিয়ারিং ও মেডিক্যাল কলেজে রিজার্ভ
সিটের ব্যবস্থা করলেন। এমন ব্যবস্থা করলেন যে মুসলমান ছাত্র পাওয়া না গেলেও রিজার্ভ সিট শূন্য
থাকবে। এই ব্যবস্থার ফলে মুসলমানের শিক্ষা বিশেষভাবে অগ্রসর হতে পেরেছিল। তাই বলে তিনি
হিন্দু বিদ্বেষ পরায়ন ছিলেন না।
মুসলমানদের মধ্যে শিক্ষা বিস্তারে আর একটি বাঁধা ছিল, পরীক্ষার খাতায় নাম লেখার নিয়ম। যার
ফলে হিন্দু শিক্ষকগণ মুসলমান নাম দেখলেই পরীক্ষার খাতায় ভাল লিখলেও অকৃতকার্য করিয়ে দিত।
এতে মুসলমানদের পরীক্ষা পাসের হার ছিল অতি নগন্য, যার ফলে উপযুক্ত স্থান দখল করা তাদের
জন্য অসম্ভব ব্যাপার ছিল। শিক্ষাক্ষেত্রে হিন্দু-মুসলমানদের সমান বিচারের জন্য ফজলুল হক প্রবল
প্রতিক‚লতা ও বিরুদ্ধতা ব্যর্থ করে পরীক্ষার খাতায় নাম লেখার পরিবর্তে ক্রমিক নম্বর লিখার নিয়ম
প্রবর্তন করেন। ফলে মুসলমান ছাত্রদের পাসের হার বাড়তে লাগলো।
ছয় মাস শিক্ষামন্ত্রী থাকাকালীন সময় শেরে বাংলা এ, কে, ফজলুল হক মহামান্য আগা খান ও নবাব
মোহসীন-উল-মুলক প্রমুখ ‘আলীগড় এ্যাঙ্গলো ওরিয়েণ্টাল’ কলেজকে বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তরিত করার
ব্যাপারে একজন নেতৃস্থানীয় উদ্যোক্তা ছিলেন। উল্লেখ্য যে স্যার সৈয়দ আহমদ খান ১৮৭৭ সালে
মুসলমানদের উন্নতমানের শিক্ষাকেন্দ্র হিসেবে প্রথমে আলীগড় কলেজটি প্রতিষ্ঠা করেন। ফজলুল হক
নব প্রতিষ্ঠিত আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম কোর্টের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ছিলেন।
১৯৩৭ খ্রিষ্টাব্দের নির্বাচনের পর শেরে বাংলা এ, কে, ফজলুল হক ভারতের অন্যান্য প্রদেশের
মুখ্যমন্ত্রীদের মত দেশরক্ষা বিভাগ নেওয়ার পরিবর্তে নিলেন শিক্ষা বিভাগ। এ দেশের সাধারণ
মানুষদের শিক্ষিত করে তোলার জন্য তিনি এ কাজ হাতে নিলেন। তিনি ছিলেন গণশিক্ষা বিস্তারে
আগ্রহী এবং শিক্ষার ক্ষেত্রে হিন্দু-মুসলমান যাতে সমান অধিকার পায়, তার সঠিক নিয়ম প্রণয়ন ও
প্রয়োগের ব্যবস্থা করা এবং বিশেষ করে শিক্ষাক্ষেত্রে বঞ্চিত মুসলমানগণ যাতে শিক্ষার আলো দেখতে
পায়, তার সুব্যবস্থা করা।
ফজলুল হক মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালে কলকাতায় লেডী ব্রাবোর্ণ কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন। বেগম শামসুন্নাহার
মাহামুদকেও এই কলেজের বাংলা বিভাগের প্রধানরূপে তিনিই নিযুক্ত করেন। যদিও বেগম
শামসুন্নাহার তখনও এম, এ ডিগ্রি প্রাপ্তা নন। কলকাতার বেগম রোকেয়ার প্রচেষ্টায় প্রতিষ্ঠিত
সাখাওয়াত মেমোরিয়াল গার্লস্ স্কুলটি প্রাদেশিক সরকারের পরিচালনাধীনে আনয়ণ করে তিনি স্কুলটির অনেক উন্নতি সাধন করেছিলেন। মুসলমানদের মধ্যে শিক্ষাবিস্তারের জন্য আলাদা ডাইরেক্টরেট স্থাপন করেন।
১৯২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে ফজলুল হক গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন। ১৯৪০
সালে শেরে বাংলার প্রচেষ্টায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক হল প্রতিষ্ঠিত হয়। একই বছর তারই
প্রচেষ্টায় প্রতিষ্ঠিত হয় মুন্সিগঞ্জের হরগঙ্গা কলেজ। এই সময় তার নিজ গ্রাম চাখারে তিনি একটি
কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন। পাশাপাশি সেখানে একটি মাদ্রাসা ও একটি হাইস্কুল তারই সৃষ্টি। রাজশাহীর
আদিনা ফজলুল হক কলেজ, শর্ষিনা মাদ্রাসার প্রতিষ্ঠা ও উন্নতির জন্য শেরে বাংলার দান অপরিসীম।
তপশিলী স¤প্রদায়ের শিক্ষার জন্য তিনিই প্রথম বাজেটে অর্থ বরাদ্দের ব্যবস্থা করেন। শিক্ষার উন্নতির
জন্যে একে ফজলুল হকের অবদান বাঙালি জাতি চিরদিন গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করবে।
কৃষক-প্রজার মুক্তি দূত ফজলুল হক
ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী ও ঔপনিবেশিক শাসক ও শোষকগোষ্ঠী ১৭৫৭ সালের পলাশী যুদ্ধের পর তাদের
শাসন ও শোষণ ব্যবস্থাকে সুদৃঢ় করার জন্য জমিদার, মজুতদার ও মহাজন শ্রেণীর সৃষ্টি করে। ফলে
এই জমিদার ও মহাজন শ্রেণীই ঔপনিবেশিক ব্রিটিশ সরকারের শক্তির প্রধান উৎস হয়ে দাঁড়ায় এবং
প্রায় দু’শ’ বছরকাল অত্যাচারী জমিদারের সহায়তায় ব্রিটিশ শোষকগোষ্ঠী এ দেশের সাধারণ কৃষক
প্রজাদের উপর নির্মম অত্যাচার ও শোষণের ষ্টিম রোলার চালায়।
ব্রিটিশ শোষকগোষ্ঠীর প্রতিনিধি তৎকালীন বড়লাট লর্ড কর্ণওয়ালিশ ১৭৯৩ সালে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের
প্রবর্তন করেন। এই চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের নামে তহশীলদারগণ জমিদারশ্রেণীতে উত্তীর্ন হয়।
জমিদারগণ ইচ্ছে মত খাজনা নির্ধারণ এবং আদায়ের সুযোগ পায়। চিরস্থায়ী ব্যবস্থা অনুযায়ী জমিদার
প্রজার কাছ থেকে কোটি কোটি টাকা খাজনা আদায় করতে পারত এবং ঔপনিবেশিক সরকারকে
দিতো মাত্র তিন কোটি টাকা। কিন্তু জমিদার দ্বারা প্রজাপীড়ন রোধ করবার আইনগত কোন ব্যবস্থা না
থাকায় জমিদার হয়ে ওঠেন একজন প্রভাবশালী রাজা। এই টাকা আদায় করার জন্য জমিদারগণ
কৃষক-প্রজা পীড়ন, অনাচার ও অত্যাচারের পথ বেছে নিয়েছিলো। এরূপ অত্যাচার চলতে থাকে প্রায়
দু’শত বছর যাবৎ।
শাসন, শোষণ, অত্যাচার ও উৎপীড়নে জর্জরিত অবিভক্ত বাংলায় ব্রিটিশ সৃষ্ট জমিদার, মহাজন, রাজা
মহারাজাদের প্রতাপ প্রতিপত্তির সীমা ছাড়িয়ে যায়। শেরে বাংলা আবুল কাশেম ফজলুল হক ১৯১৪
খ্রিষ্টাব্দ থেকেই জমিদার ও মহাজন শ্রেণীর বিরুদ্ধে প্রথম সংগ্রামের সূচনা করেন। তারই নির্দেশে খোশ
মোহাম্মদ চৌধুরী ময়মনসিংহের জামালপুর মহকুমার কুমারচরে এক বিরাট কৃষক-প্রজা সাধারণের
সম্মেলনের আয়োজন করেন। এতে সভাপতিত্ব করেন কৃষক প্রজাদের অকৃত্রিম বন্ধু শেরে বাংলা এ,
কে, ফজলুল হক নিজে। সভাপতির ভাষণে তিনি কৃষক-প্রজাদের ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহবান জানান।
তার আহবানে সাড়া দিয়ে জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে সকল কৃষক প্রজাসাধারণ একতাবদ্ধ হয়। তখন থেকে
মেহনতী জনগণের মধ্যে জাগরণের সাড়া পরিলক্ষিত হয়। এই আন্দোলন অল্প সময়ের মধ্যে বরিশাল,
ফরিদপুর, চট্টগ্রাম, খুলনা, ঢাকা, কুমিল্লা এবং কুষ্টিয়াসহ সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে। শেরে বাংলার
নেতৃত্বে অপ্রতিরোধ্য আন্দোলন গড়ে উঠে এবং এ সময় তারই নেতৃত্বে ‘নিখিল বঙ্গ প্রজা সমিতি’র
জন্ম হয়। এই সমিতিই জমিদার ও মহাজন শ্রেণীর বিরুদ্ধে আন্দোলন পরিচালনা করে।
এই সময় শেরে বাংলা এ, কে, ফজলুল হকের নেতৃত্বে কৃষক-প্রজাদের দেয় ঋণ সম্পর্কে জরিপ করা
হয়। এতে দেখা যায়, জমিদাররা কৃষক-প্রজাদের কাছ থেকে তেষট্টি কোটি টাকা আদায় করতো।
সরকারীভাবে আদায় দেখাতো মাত্র আঠারো কোটি টাকা এবং ব্রিটিশ সরকারকে তারা খাজনা হিসেবে
দিতো মোট ছয় কোটি টাকা। তেষট্টি কোটি টাকা থেকে ছয় কোটি টাকা দিয়ে বাকী সাতান্ন কোটি
টাকা জমিদার ও মহাজনরা আত্বসাৎ করতো। উপরোক্ত টাকা কৃষক-প্রজা সাধারণের উপর নির্মম
অত্যাচার চালিয়ে আদায় করা হতো।
শেরে বাংলার নেতৃত্বে পরিচালিত নিখিল বঙ্গ প্রজা সমিতির উপরোক্ত জরিপে আরো দেখা যায় কৃষকপ্রজাদের ঋণের পরিমাণ চারশত কোটি টাকা। এই ঋণ চক্রবৃদ্ধি হারে সুদের পরিমাণ দাঁড়ায় চারপাঁচগুণ। কৃষক-প্রজা সাধারণের উপর শোষণ-অত্যাচারের বিরুদ্ধে শেরে বাংলা এ, কে, ফজলুল
হকের নেতৃত্বে ১৯২১ খ্রিষ্টাব্দে বরিশালের গৌরনদীর আগৈলঝরাতে এক বিরাট কৃষক-প্রজা সম্মেলন
অনুষ্ঠিত হয়। এই ভাবে তিনি দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে কৃষক-প্রজা সম্মেলন করে কৃষকদের মুক্তির পথ প্রসারিত করেছিলেন। শেরে বাংলা প্রজাস্বত্ব আইন পাশ করে জমির উপর কৃষকের মালিকানা কায়েম করেন।
শেরে বাংলা এ, কে, ফজলুল হক ১৯৪০ খৃষ্টাব্দে মহাজনী আইন পাস করে বাংলার কৃষক-প্রজাদেরকে
মহাজনদের অত্যাচার, অনাচার এবং শোষণের রাহুমুক্ত করেন। কৃষককুলের মুক্তিদূত শেরে বাংলার
নির্দেশেই ৬০ হাজার ঋণসালিশী বোর্ড স্থাপিত হয়। সারা দেশের জমিদার-মহাজন শ্রেণী উপরোক্ত
আইনের বিরোধিতা করলেও শেরে বাংলার অনমনীয় দৃঢ়তা এবং সহকর্মীদের প্রচেষ্টায়
প্রতিক্রিয়াশীলদের চক্রান্ত ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। একই বছর শেরে বাংলা প্রজাস্বত্ব আইন পাস করে
জমির উপর কৃষকদের মালিকানা কায়েম করেন। ফলে কৃষকদের মুক্তিদূত শেরে বাংলা এ, কে,
ফজলুল হকের সুমহান নেতৃত্বে কৃষককুল তাদের হারানো জমি ফিরে পায়। কৃষকদের ওপর শাসন,
শোষণ ও নির্যাতন চিরতরে অবসান ঘটে।
রাজনীতিতে শেরে বাংলার অবদান
শেরে বাংলা একে ফজলুল হকের রাজনৈতিক জীবন বিচিত্র ঘটনায় ভরপুর। ১৯১১ সালে বঙ্গভঙ্গ
রদের ঘোষণার পর পূর্ব বাংলার মানুষ যখন চরম হতাশাগ্রস্থ তখন তিনি সক্রিয়ভাবে রাজনীতিতে
অংশগ্রহণ করেন। উল্লেখ্য যে নবাব স্যার সলিমুল াহ ফজলুল হককে বিশ্বস্ত, যোগ্য ও শক্তিশালী -
সহযোগী হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন। তার মহান ব্যক্তিত্ব ও রাজনৈতিক দক্ষতা স্বল্পসময়ের মধ্যে তাকে
রাজনৈতিক অঙ্গনে সুপ্রতিষ্ঠিত করে। ১৯১৩ সালে তিনি বেঙ্গল লেজিসলেটিভ কাউন্সিলের সদস্য
নির্বাচিত হন। ১৯১৫ সালে তিনি কৃষক-প্রজা আন্দোলনে যোগদান করেন। ১৯১৬ সালে স্বাক্ষরিত
লৌ² প্যাক্ট ফজলুল হকের অক্লান্ত পরিশ্রমের ফসল। ১৯১৮ সালে তিনি একদিকে মুসলিম লীগের
সভাপতি অন্যদিকে নিখিল ভারত কংগ্রেসের যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদকের পদ অলংকৃত করেন। এ সময়
তিনি মুসলিম লীগ ও কংগ্রেসের মধ্যে ঐক্য স্থাপনে প্রচেষ্টা চালান। ১৯২৯ সালে তিনি ‘নিখিল প্রজা
সমিতি’ গঠন করেন।
একে ফজলুল হক একজন অবিসংবাদিত নেতা হিসেবে ব্রিটিশ ভারতের শাসনতান্ত্রিক সংকট মিমাংসার
ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভ‚মিকা পালন করেছিলেন। তিনি ছিলেন বাংলার প্রথম নির্বাচিত মুখ্যমন্ত্রী। ১৯৪০
সালের ঐতিহাসিক লাহোর প্রস্তাবে শেরে বাংলা ভারতের শাসনতান্ত্রিক ও রাজনৈতিক সমস্যা
সমাধানের জন্য যে প্রজ্ঞা প্রদীপ্ত সুপারিশ করেছিলেন তার মধ্যে বাঙালির স্বতন্ত্র জাতিসত্তার ইঙ্গিত
পাওয়া যায়। ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনে ফজলুল হকের অসাধারণ নেতৃত্ব বাঙালি জাতিকে
স্বাধীকারের সংগ্রামে উদ্বুদ্ধ করেছিল। এরই সূত্র ধরে পূর্ব বাংলার মানুষ ঝাঁপিয়ে পড়েছিল মহান
স্বাধীনতা যুদ্ধে।
মৃত্যু:
সুদীর্ঘ কর্মময় জীবনের অবসান ঘটিয়ে আপামর জনসাধারণের ‘প্রিয় হক সাহেব’ ১৯৬২ সালের ২৭
এপ্রিল মৃত্যুবরণ করেন। ঢাকার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের দক্ষিণপ্রান্তে জাতীয় তিন নেতার মাযারের
মধ্যে তার কবরটি অন্যতম।
সারকথা: শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক শুধু একটি নাম নয়, তিনি বাংলার প্রায় অর্ধ শতাব্দীর মূল
ইতিহাস। তিনি ছিলেন বাংলার কৃষককুলের প্রিয় ‘হক সাহেব’ এবং সাধারণ মানুষের অতি আপনজন।
কৃষক প্রজার স্বার্থ রক্ষা করতে গিয়ে তিনি যে ভ‚মিকা গ্রহণ করেছিলেন তা অবিস্মরণীয়। বাঙালি
মুসলমানদের মধ্যে শিক্ষা বিস্তারে ফজলুল হকের অবদান ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তার মহান ব্যক্তিত্ব
ও রাজনৈতিক পারদর্শিতা স্বল্প সময়ের মধ্যে তাকে রাজনৈতিক অঙ্গনে সুপ্রতিষ্ঠিত করে।
সঠিক উত্তরটি লিখুন।
১. কোলকাতায় কেন্দ্রীয় মুসলিম শিক্ষা সমিতি কত সালে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল ?
ক. ১৯০৬;
খ. ১৯১২;
গ. ১৯১১;
ঘ. ১৯১৫।
২. ফজলুল হক কত সালে অবিভক্ত বাংলার শিক্ষামন্ত্রী ছিলেন ?
ক. ১৯১৯;
খ. ১৯২০;
গ. ১৯২১;
ঘ. ১৯২৪।
৩. আলীগড় কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন কে ?
ক. এ কে ফজলুল হক;
খ. স্যার সৈয়দ আহমদ খান;
গ. মৌলানা আবুল কালাম আযাদ;
ঘ হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী।
৪. কতসালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয় ?
ক. ১৯১৬;
খ. ১৯১৮;
গ. ১৯২১;
ঘ. ১৯৪৭।
৩. ১৯১৮ সালে কংগ্রেসের যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক ছিলেন
ক. মহাত্বা গান্ধী;
খ. জওহরলাল নেহেরু;
গ. এ কে ফজলুল হক;
ঘ মতিলাল নেহেরু।
সংক্ষিপ্ত উত্তরমূলক প্রশ্ন:
১. শিক্ষা বিস্তারে ফজলুল হকের অবদান আলোচনা করুন।
২. কৃষককুলের মুক্তির দিসারী ফজলুল হক-ব্যাখ্যা করুন।
উত্তরমালা: ১. খ, ২. ঘ, ৩. খ. ৪. গ, ৫. গ।

FOR MORE CLICK HERE
এইচএসসি বাংলা নোট ১ম পত্র ও ২য় পত্র
ENGLISH 1ST & SECOND PAPER
এইচএসসি আইসিটি নোট
এইচএসসি অর্থনীতি নোট ১ম পত্র ও ২য় পত্র
এইচএসসি পৌরনীতি ও সুশাসন ১ম পত্র
এইচএসসি পৌরনীতি নোট ২য় পত্র
এইচএসসি সমাজকর্ম নোট ১ম পত্র
এইচএসসি সমাজকর্ম নোট ২য় পত্র
এইচএসসি সমাজবিজ্ঞান নোট ১ম পত্র ও ২য় পত্র
এইচএসসি ইতিহাস নোট ১ম পত্র
এইচএসসি ইতিহাস নোট ২য় পত্র
এইচএসসি ইসলামের ইতি. ও সংস্কৃতি নোট ১ম পত্র
এইচএসসি ইসলামের ইতি. ও সংস্কৃতি নোট ২য় পত্র
এইচএসসি যুক্তিবিদ্যা ১ম পত্র ও ২য় পত্র
এইচএসসি ভূগোল ও পরিবেশ নোট ১ম পত্র ও ২য় পত্র
এইচএসসি ইসলামিক স্টাডিজ ১ম ও ২য় পত্র

Copyright © Quality Can Do Soft.
Designed and developed by Sohel Rana, Assistant Professor, Kumudini Government College, Tangail. Email: [email protected]