৬ দফা কর্মসূচীর দফাগুলো সম্পর্কে আলোচনা করুন।

পাকিস্তান রাষ্ট্রটির জন্মলগ্ন থেকেই পাকিস্তানী শাসকচক্র পূর্ব বাংলার প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ শুরু
করে। প্রতিটি ক্ষেত্রেই পূর্ব পাকিস্তানের ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হয়েছিল। শাসকগোষ্ঠী
যতই শোষণ, অত্যাচার ও নির্যাতনের ষ্টীমরোলার চালাতে থাকে পূর্ব বাংলার জনমনে পুঞ্জিভ‚ত
বিক্ষোভ ততই দানা বেঁধে উঠতে থাকে। শাসকশ্রেণীর সুপরিকল্পিত নীলনকশার ফলে পাকিস্তানের
দু’টি অংশ পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে ব্যাপক সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বৈষম্য গড়ে
উঠে। এর ফলে পূর্ব বাংলার জনমনে স্বায়ত্তশাসনের দাবী তীব্র হয়ে উঠে। ১৯৬৫ সালে পাক-ভারতের
যুদ্ধকালে সামরিক ব্যবস্থায় পূর্ব বাংলার প্রতি চরম অবহেলা স্বায়ত্তশাসনের দাবীকে আরও জোরদার
করে তুলে। পূর্ব পাকিস্তানের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থায় কেন্দ্রীয় সরকারের উদাসীনতার বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগ
সভাপতি শেখ মুজিবুর রহমান তীব্র প্রতিবাদ জানান। তার এই প্রতিবাদ ব্যাপক গণসমর্থন লাভ করে।
পাকিস্তানের সামরিক ব্যয়ের শতকরা ৬০ ভাগ পূর্ব পাকিস্তান বহন করা সত্তে¡ও পূর্ব পাকিস্তানের
প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ছিল খুবই দুর্বল। নিরাপত্তার প্রশ্নে এই অঞ্চলের মানুষ সোচ্চার হয়ে ওঠে এবং
সামরিক ক্ষেত্রে স্বয়ংসম্পূর্ণ করে তোলার দাবী তোলে। পূর্ব পাকিস্তানের সামাজিক, রাজনৈতিক,
অর্থনৈতিক ও প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রে চরম হতাশার পটভ‚মিতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বায়ত্তশাসন ও
গণতন্ত্রের দাবিতে ১৯৬৬ সালে ৫ ফেব্রæয়ারী লাহোরে অনুষ্ঠিত সম্মিলিত বিরাধীদলের এক বৈঠকে ৬
দফা কর্মসূচি ঘোষণা করেন। তার ওই ঘোষণা ছিল বাঙালির স্বাধীকার প্রতিষ্ঠার সর্বোচ্চ দাবী।
৬ দফা কর্মসূচি
প্রথম দফা : শাসনতান্ত্রিক কাঠামো ও রাষ্ট্রীয় প্রকৃতি
ঐতিহাসিক লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতে শাসনতন্ত্র রচনা করে পাকিস্তানকে একটি সত্যিকার যুক্তরাষ্ট্রীয়
সরকার গড়তে হবে। তাতে পার্লামেন্টারী পদ্ধতির সরকার থাকবে। সকল নির্বাচন সার্বজনীন
প্রাপ্তবয়স্কদের সরাসরি ভোটে অনুষ্ঠিত হবে এবং আইন সভাসমূহের সার্বভৌমত্ব থাকবে।
দ্বিতীয় দফা : কেন্দ্রীয় সরকারের ক্ষমতা
যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকারের এখতিয়ারে কেবলমাত্র দেশরক্ষা ও পররাষ্ট্র-এই দু’টি বিষয় থাকবে। অবশিষ্ট
সমস্ত বিষয় প্রদেশগুলোর হাতে থাকবে।
তৃতীয় দফা : মুদ্রা ও অর্থ সম্বন্ধীয় ক্ষমতা
ক. এই দফায় মুদ্রা সম্পর্কে দু’টি বিকল্প প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের জন্য দু’টি
সম্পূর্ণ পৃথক অথচ সহজে বিনিময়যোগ্য মুদ্রার প্রচলন করতে হবে। এই ব্যবস্থা অনুসারে মুদ্রা
কেন্দ্রের হাতে থাকবে না, আঞ্চলিক সরকারের হাতে থাকবে। দুই অঞ্চলের জন্য দু’টি স্বতন্ত্র
কেন্দ্রীয় ব্যাংক থাকবে।
খ. দুই অঞ্চলের জন্য একই মুদ্রা থাকবে। এই ব্যবস্থায় মুদ্রা কেন্দ্রের হাতে থাকবে। এই অবস্থায়
শাসতন্ত্রের এমন সুনির্দিষ্ট বিধান থাকতে হবে যাতে পূর্ব পাকিস্তানের মুদ্রা পশ্চিম পাকিস্তানে
পাচার না হতে পারে। এই বিধানে পাকিস্তানের একটি ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক থাকবে। দুই
অঞ্চলে দু’টি পৃথক রিজার্ভ ব্যাংক থাকবে।
চতুর্থ দফা : রাজস্ব কর ও শুল্ক বিষয়ক ক্ষমতা
সকল প্রকার কর ধার্য ও আদায়ের ক্ষমতা আঞ্চলিক সরকারের হাতে থাকবে। কেন্দ্রীয় সরকারের
ক্ষমতা থাকবে না। তবে কেন্দ্রীয় সরকারের ব্যয় নির্বাহের জন্য আঞ্চলিক সরকারের আদায়কৃত
রাজস্ব-এর নির্ধারিত অংশ কেন্দ্রীয় তহবিলে জমা হবে। এই মর্মে রিজার্ভ ব্যাংকসমূহের উপর
বাধ্যতামূলক বিধান শাসনতন্ত্রে থাকবে। দুই অঞ্চলের জন্য দু’টি স্টেট ব্যাংক ও দু’টি রিজার্ভ ব্যাংক থাকবে। শেখ মুজিবুর রহমান স্বায়ত্তশাসন ও গণতন্ত্রের দাবীতে ঐতিহাসিক ৬ দফা কর্মসূচি ঘোষণা করেন।
পঞ্চম দফা : বৈদেশিক বাণিজ্য বিষয়ক ক্ষমতা
এই দফায় বৈদেশিক বাণিজ্যের ব্যাপারে শাসনতান্ত্রিক বিধানের সুপারিশ করা হয়েছে।
১. দুই অঞ্চলের বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের পৃথক পৃথক হিসাব রাখতে হবে।
২. পূর্ব পাকিস্তানের অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রা পূর্ব পাকিস্তানে এবং পশ্চিম পাকিস্তানের অর্জিত
বৈদেশিক মুদ্রা পশ্চিম পাকিস্তানের এখতিয়ারে থাকবে।
৩. কেন্দ্রীয় সরকারের প্রয়োজনীয় বিদেশী মুদ্রা-দুই অঞ্চল হতে সমানভাবে অথবা শাসনতন্ত্রে
নির্ধারিত হারে আদায় হবে।
৪. দেশজাত দ্রব্যাদি বিনাশুল্কে উভয় অঞ্চলের মধ্যে আমদানী-রফতানী চলবে।
৫. বিদেশের সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্য, চুক্তি সম্পাদন, বিদেশে ট্রেড মিশন স্থাপন ও আমদানী-রফতানি
করার জন্য আঞ্চলিক সরকারকে শাসনতান্ত্রিক অধিকার দিতে হবে।
ষষ্ঠ দফা : আঞ্চলিক সেনাবাহিনী গঠনের ক্ষমতা
এই দফায় পূর্ব পাকিস্তানে প্যারা-মিলিটারী বা আঞ্চলিক সেনাবাহিনী গঠনের সুপারিশ এবং পূর্ব
পাকিস্তানের অস্ত্র কারখানা ও নৌবাহিনীর হেডকোয়ার্টার স্থাপনের কথা বলা হয়েছে।
৬ দফার গুরুত্ব
৬ দফা কর্মসূচি প্রচারিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পূর্ব পাকিস্তানে বিরাট সাড়া পড়ে যায়। পূর্ব পাকিস্তানের
মানুষ ব্যাপকভাবে এই কর্মসূচী সমর্থন করে। আওয়ামী লীগ স্বল্প সময়ের ব্যবধানে জনগণের হৃদয়
জয় করে নিল। পূর্ব বাংলার বুদ্ধিজীবী ব্যবসায়ী, আইনজীবী, সরকারী কর্মকর্তাসহ, সর্বস্তরের মানুষ
স্বতঃস্ফ‚র্তভাবে ৬ দফা কর্মসূচী সমর্থন করেছিল। ৬ দফার মূল বক্তব্য ছিল, পররাষ্ট্র ও প্রতিরক্ষা বিষয়
বাদ দিয়ে আর সব ব্যাপারে পূর্ব-বাংলার স্বায়ত্তশাসন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ৬ দফার মধ্যে
দেশের দুই অঞ্চলের মাঝে বিদ্যমান আর্থ-সামাজিক বৈষম্য তুলে ধরেন। এই গুরুত্বপূর্ণ দাবী নিয়ে
আওয়ামী লীগ রাজনীতি ক্ষেত্রে প্রাধান্য লাভ করে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ৬ দফাকে বাঙালি জাতির মুক্তিসনদ হিসাবে ঘোষণা করে জনগণকে চ‚ড়ান্ত
সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ার আহবান জানান। সর্বস্তরের জনগণ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের নেতৃত্বে ঐক্যবদ্ধ
হয়ে দুর্বার আন্দোলন গড়ে তোলে। শুরু হয় বাঙালি জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে এক গণজাগরন। কৃষক
শ্রমিক ছাত্র জনতা ঐক্যবদ্ধভাবে গণতান্ত্রিক আন্দোলনের মধ্যদিয়ে আইয়ুব খানের স্বৈরাচারী শাসনের
শক্ত ভিতকে নড়বড়ে করে দিয়েছিল। ৬ দফা আন্দোলন পাকিস্তানী শাসকচক্রকে বুঝিয়ে দিতে সক্ষম
হয় যে, সামরিক শক্তি নয়, গণশক্তিই হচ্ছে সকল রাজনৈতিক শক্তির উৎস। আওয়ামী লীগ ৬ দফার
সংগ্রাম শুরু করে জাতীয় মুক্তিযুদ্ধের আবশ্যিক পটভ‚মি রচনা করতে সক্ষম হয়েছিল। আমেরিকার
স্বাধীনতা যেমন ব্যক্তি স্বাধীনতার আন্দোলন, ব্রিটিশ গণতন্ত্রের ইতিহাসে যেমন ম্যাগনা কার্টা ও
অধিকার বিল, ফরাসী বিপ্লবের ভিত্তি যেমন সাম্য ও স্বাধীনতা, বাংলাদেশের স্বাধীনতার তেমন মৌল
ভিত্তি ছিল ঐতিহাসিক ৬ দফা কর্মসূচি। ৬ দফাকে কেন্দ্র করেই বাংলাদেশের স্বাধীনতার বীজ
অংকুরিত হয়েছিল।
তাই বাংলাদেশের ইতিহাসে ৬ দফা কর্মসূচির গুরুত্ব অপরিসীম। এই কর্মসূচির গুরুত্ব আরও
গভীরভাবে উপলব্ধি করা যায় আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা, ৬৯’র গণঅভ্যুত্থান এবং ১৯৭০ সালের
নির্বাচনের মধ্য দিয়ে।
সারকথা ঃ ৬ দফার মূল বক্তব্য ছিল, পররাষ্ট্র ও প্রতিরক্ষা বিষয় বাদ দিয়ে সমস্ত বিষয়ে পূর্ব-বাংলার
স্বায়ত্তশাসন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ৬ দফার মধ্যে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মাঝে বিদ্যমান
আর্থ-সামাজিক বৈষম্য তুলে ধরেন। পূর্ব বাংলার স্বায়ত্তশাসন, বাঙালি জাতীয়তাবাদের উত্থানে ও
ক্রমবিকাশে ৬ দফা কর্মসূচির ভ‚মিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আওয়ামী লীগ ৬ দফার সংগ্রাম শুরু করে জাতীয় মুক্তিযুদ্ধের আবশ্যিক পঠভ‚মি রচনা করতে সক্ষম হয়েছিল। বাংলাদেশের-স্বাধীনতা সংগ্রামে ৬ দফা কর্মসূচির ভ‚মিকা বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ।
সঠিক উত্তরটি লিখুন।
১। ঐতিহাসিক ৬ দফা কর্মসূচি কে ঘোষণা করেন ?
(ক) এ.কে ফজলুল হক;
(খ) হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী;
(গ) বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান;
(ঘ) মাওলানা ভাসানী।
২। কত সালে ৬ দফা কর্মসূচি ঘোষণা করা হয় ?
(ক) ১৯৬৫;
(খ) ১৯৫২;
(গ) ১৯৭১;
(ঘ) ১৯৬৬।
৩। স্বল্প সময়ে কোনদল জনগণের হৃদয় জয় করেছিল ?
(ক) মুসলিম লীগ;
(খ) আওয়ামী লীগ;
(গ) ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি;
(ঘ) বিএনপি।
৪। বাঙালির স্বাধীকার প্রতিষ্ঠার সর্বোচ্চ দাবী ছিল-
(ক) ৬ দফা;
(খ) ২১ দফা;
(গ) ৫ দফা;
(ঘ) ১১ দফা।
সংক্ষিপ্ত উত্তরমূলক প্রশ্ন
১। ৬ দফার গুরুত্ব বর্ণনা করুন।
রচনামূলক প্রশ্ন
১। ৬ দফা কর্মসূচীর দফাগুলো সম্পর্কে আলোচনা করুন।
উত্তরমালা ঃ ১. গ, ২. ঘ, ৩. খ, ৪. ক

FOR MORE CLICK HERE
এইচএসসি বাংলা নোট ১ম পত্র ও ২য় পত্র
ENGLISH 1ST & SECOND PAPER
এইচএসসি আইসিটি নোট
এইচএসসি অর্থনীতি নোট ১ম পত্র ও ২য় পত্র
এইচএসসি পৌরনীতি ও সুশাসন ১ম পত্র
এইচএসসি পৌরনীতি নোট ২য় পত্র
এইচএসসি সমাজকর্ম নোট ১ম পত্র
এইচএসসি সমাজকর্ম নোট ২য় পত্র
এইচএসসি সমাজবিজ্ঞান নোট ১ম পত্র ও ২য় পত্র
এইচএসসি ইতিহাস নোট ১ম পত্র
এইচএসসি ইতিহাস নোট ২য় পত্র
এইচএসসি ইসলামের ইতি. ও সংস্কৃতি নোট ১ম পত্র
এইচএসসি ইসলামের ইতি. ও সংস্কৃতি নোট ২য় পত্র
এইচএসসি যুক্তিবিদ্যা ১ম পত্র ও ২য় পত্র
এইচএসসি ভূগোল ও পরিবেশ নোট ১ম পত্র ও ২য় পত্র
এইচএসসি ইসলামিক স্টাডিজ ১ম ও ২য় পত্র

Copyright © Quality Can Do Soft.
Designed and developed by Sohel Rana, Assistant Professor, Kumudini Government College, Tangail. Email: [email protected]