ঐতিহাসিক বা বিবর্তনমূলক মতবাদকে বিজ্ঞানসম্মত মতবাদ বলা হয় কেন?

রাষ্ট্রের উৎপত্তি সম্পর্কে ঐতিহাসিক বা বিবর্তনবাদ আধুনিককালে সর্বাপেক্ষা গ্রহণযোগ্য মতবাদ। যদিও উপযুক্ত প্রমাণ
ও দলিলের অভাবে রাষ্ট্রের উৎপত্তি কিভাবে হয়েছে তা আজও সঠিকভাবে নির্ধারিত হয় নি। তবে আধুনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা
এ বিষয়ে মোটামুটি একমত যে, রাষ্ট্র ঐতিহাসিক বিবর্তনের ফল।
রাষ্ট্র বিধাতা কর্তৃক হঠাৎ একদিন সৃষ্ট হয় নি, এটি বল প্রয়োগের মাধ্যমেও সৃষ্ট হয় নি। রাষ্ট্র কোন চুক্তির ফলও নয়।
এসব ধারণা কাল্পনিক। কাজেই এগুলো রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা বর্জন করেছেন। অধ্যাপক গার্নার (এধৎহবৎ) এ প্রসঙ্গে বলেন
‘‘রাষ্ট্র বিধাতার অমোঘ সৃষ্টি নয়, এটি দৈহিক বলপ্রয়োগের ফলশ্রæতিও নয়, কোন প্রস্তাব বা সম্মেলনের ফসল নয় ;
এমনকি পরিবারের সম্প্রসারণের মধ্য দিয়েও এর জন্ম হয় নি’’বস্তুত বহু যুগের, বহু কালের এবং বিভিন্ন উপাদানের সংমিশ্রনে বিভিন্ন স্তর পেরিয়ে রাষ্ট্র তার বর্তমান
পর্যায়ে এসে পৌঁছেছে। এটি এক ক্রমবিবর্তন প্রক্রিয়ারই ফলস্বরূপ ।
রাষ্ট্রের উৎপত্তির ক্ষেত্রে বিবর্তনবাদী প্রক্রিয়ায় বিভিন্ন উপাদান কাজ করেছে। এসব উপাদানের মধ্যে রক্তের সম্পর্ক,
ধর্মীয় বন্ধন, যুদ্ধ বিগ্রহ, অর্থনৈতিক ব্যবস্থা এবং সর্বোপরি রাজনৈতিক চেতনা সবিশেষ উল্লেখযোগ্য। নি¤েœ এ
উপাদানগুলো সংক্ষেপে বর্ণনা করা হলো:
ক. রক্তের সম্পর্ক
রাষ্ট্রের বিবর্তন ধারায় রক্তের সম্পর্কে বা আতœীয়তার বন্ধন এক গুরুত্বপূর্ণ ভ‚মিকা পালন করেছে। বিশেষ করে আদি
সমাজে রক্তের সম্পর্কই ছিল রাষ্ট্র গঠনের একমাত্র ভিত্তি। প্রথমদিকে রক্তের সম্পর্ক একই পরিবারের সদস্যদের মধ্যে
সীমাবদ্ধ ছিল। বিয়ের বন্ধন, সন্তানাদির লালন-পালন স্বাভাবিকভাবেই পরিবারের সৃষ্টি করে। পরিবারের সদস্যরা সর্বপ্রথম
পরিবার থেকেই আদেশ প্রদান ও আদেশ পালনের দীক্ষা লাভ করে। পরিবারের প্রধানই ছিলেন পরিবারের সর্বময় কর্তা।
কালক্রমে লোকসংখ্যা বৃদ্ধি এবং নতুন নতুন সমস্যার উদ্ভবের ফলে পরিবারের বি¯তৃতি ঘটে। এতে করে সৃষ্টি হয় বিভিন্ন
গোষ্ঠী, সম্প্রদায় ও উপজাতির। পরবর্তীকালে এগুলো জাতিগত ঐক্যের বন্ধনকে সুদৃঢ় করে তোলে। আর এই ঐক্যবোধ
থেকেই শেষ অব্দি রাষ্ট্রের উদ্ভব ঘটে। রক্তের সম্পর্ক ও আত্মীয়তা এভাবে রাষ্ট্রগঠনে অন্যতম উপাদান হিসেবে কাজ
করেছে।
খ. ধর্মীয় বন্ধন
ধর্মীয় প্রভাব এবং ধর্মের বন্ধনও রাষ্ট্রের বিবর্তন প্রক্রিয়ার গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হিসেবে কাজ করেছে। বিভিন্ন সম্প্রদায়
গোষ্ঠী ও উপজাতির সদস্য সংখ্যা বৃদ্ধি পাবার সঙ্গে সঙ্গে রক্তের বন্ধন তথা আতœীয়তার সম্পর্ক শিথিল হয়ে আসতে
থাকে। ধর্ম তখন আত্মীয়তার সর্ম্পকের স্থান দখল করে নেয়। ধর্মীয় বন্ধনই তখন মানুষের পারস্পারিক সম্পর্ক ও মিলনের উপাদান হয়ে দাড়াঁয়।
অতীতে মানুষ প্রকৃতিকে ভয় করত। বন্যা, খরা, ঝড়-বৃষ্টি বজ্রপাত প্রভৃতি প্রাকৃতিক দুর্যোগের ভয়ে মানুষ সর্বদা ভীত
থাকত। এ থেকে মুক্তি পাবার উপায় হিসেবে তারা পূঁজা পার্বন, ধর্ম - কর্ম করা শুরু করে। গোত্রপতি ধর্মানুষ্ঠান ও শাসন
কার্য উভয়ই পরিচালনা করতেন।
ধর্ম- কর্ম ও উপাসনার ফলে ধীরে ধীরে মানুষের মাঝে সৃদৃঢ় ঐক্যবোধ গড়ে উঠতে থাকে। এ ঐক্যবোধ অবশেষে
মানুষকে রাজনৈতিক সংস্থা গঠনে সাহায্য করে। ধর্মই প্রচলিত আইন ও শাসনের পেছনে থেকে মানুষের মনে আনুগত্য,
কর্তব্যবোধ এবং ঐক্যবোধ জাগ্রত করে। তখন ধর্ম ও রাজনীতি পরস্পর সম্পর্কযুক্ত ছিল।
গ. যুদ্ধ - বিগ্রহ
রাষ্ট্র গঠনের ক্ষেত্রে যুদ্ধ-বিগ্রহ, আক্রমণ ও পাল্টা আক্রমণের ভ‚মিকাও অনস্বীকার্য। আদি সমাজের ইতিহাস মূলত যুদ্ধ-
বিগ্রহের ইতিহাস। সে সমাজে যুদ্ধ-বিগ্রহ, দ্ব›দ্ব-কলহ লেগেই থাকত। যে ব্যক্তি যত বেশী পরাক্রমশালী সে ব্যক্তির
আধিপত্যও ছিল তত অধিক। বিজয়ী শাসক পরাজিতদের উপর কর্তৃত্ব খাটাতেন। এভাবে ক্রমাগত যুদ্ধ, দ্ব›দ্ব আর
কলহের ফলে অপেক্ষাকৃত দুর্বল সম্প্রদায়গুলো বিজয়ী শাসক ও শাসকবৃন্দের করতলগত হতে থাকে।
এ ভাবে ক্রমশ গোষ্ঠীর সম্প্রসারণ ঘটে এবং উপজাতীয় সংগঠনের সংখ্যা বৃদ্ধি পায়। এক উপজাতি অপর উপজাতির
আক্রমণ থেকে রক্ষা পাবার জন্য একজন স্বীকৃত যুদ্ধনায়কের অধীনে কাজ করতে সম্মত হয়। ক্রমে উদ্ভব ঘটে বল
প্রয়োগকারী শক্তির যা ধীরে ধীরে সার্বভৌম শাসকের জন্ম দেয়। মানুষ এ শাসকের আনুগত্য স্বীকার এবং ঐক্যবদ্ধ হয়ে
এক বৃহত্তর জাতিসত্ত¡ার সৃষ্টি করে।
ঘ. অর্থনৈতিক ব্যবস্থা
রাষ্ট্রের বিবর্তন ধারায় অর্থনৈতিক ব্যবস্থার গুরুত্বও অপরিসীম। শুধু উৎপত্তিতে নয়, রাষ্ট্রের বিকাশ সাধনে ব্যক্তিগত
সম্পত্তির উদ্ভব ও এর রক্ষণাবেক্ষণ এবং তা থেকে উদ্ভ‚ত অর্থনৈতিক কর্মকান্ডের সৃষ্টি রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাকে ধীরে ধীরে সুসংহত
করেছে। আদিম মানব গোষ্ঠীর অর্থনৈতিক কর্মকান্ড কেবল খাদ্য আহরণ ও আশ্রয়ের মধ্যেই সীমিত ছিল। খাদ্যের
অন্বেষায় তারা সংঘবদ্ধভাবে শিকার করত এবং দলপতির নির্দেশে তা সকলের মধ্যে বন্টন করা হতো। ক্রমে পশু
পালন প্রথার প্রবর্তন ঘটে। এ প্রথা এক ধরণের অর্থনৈতিক ব্যবস্থার জন্ম দেয় যাকে বলা হয় পশুপালন অর্থনীতি। এ
অর্থনীতিতে যে ব্যক্তির অধীনে যত বেশি পশু থাকত সে ব্যক্তি তত অধিক ক্ষমতা ভোগ করত। এরপর উদ্ভব ঘটে কৃষি
জীবনের। মানুষ তখন চাষাবাদের মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহ করতে শেখে।
এভাবে ভ‚-সম্পত্তির উদ্ভবের সাথে সাথে মানুষ বিভিন্ন শ্রেণীতে বিভক্ত হতে থাকে। এর ফলে সম্পত্তিগত ও আইনগত
সমস্যার সৃষ্টি হয়। এক শ্রেণী অপর শ্রেণীকে শোষণ করতে থাকে। এ সমস্যা সমাধানকল্পে সৃষ্ট হয় রাজনৈতিক কর্তৃপক্ষের
আর এই রাজনৈতিক কর্তৃপক্ষই হল সরকার।
ঙ. রাজনৈতিক চেতনা
মানুষ তাদের সামাজিক ও অর্থনৈতিক নিরাপত্তার প্রয়োজনে যখন সংঘবদ্ধ জীবন যাত্রায় অভ্যস্তহয় তখন থেকেই
তাদের মধ্যে রাজনৈতিক চেতনার বিকাশ ঘটে। এই চেতনা সর্বপ্রথম তাদের অবচেতন মনে বিরাজমান ছিল এবং
নিজেদের অজান্তেই তা জন্মলাভ করে। কালের আবর্তে যে নতুন ও উন্নত শাসন ব্যবস্থা প্রবর্তিত হয় সেটিও মানুষের
রাজনৈতিক চেতনারই ফলে। মানুষ নিজের স্বার্থ ও অধিকার সংরক্ষণকল্পে এই রাজনৈতিক সংগঠন গড়ে তুলতে উদ্ধুদ্ধ
হয়েছে। বলা বাহুল্য যে, আধুনিক রাষ্ট্রগঠনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হচ্ছে রাজনৈতিক চেতনাবোধ।
পরিশেষে একথা বলা আবশ্যক যে, রাষ্ট্রের বিবর্তনে রক্তের সম্পর্ক বা জ্ঞাতি, ধর্ম, যুদ্ধবিগ্রহ, অর্থনৈতিক ব্যবস্থা এবং
সর্বোপরি রাজনৈতিক চেতনা উল্লেখযোগ্য অবদান রেখেছে। অবশ্য এসব উপাদান পরস্পর স্বতন্ত্রনয়, এসবের মিথস্ক্রিয়ার
ফল হচ্ছে রাষ্ট্র। কাজেই বলা যায় যে, রাষ্ট্র ঐতিহাসিক প্রক্রিয়া বা বিবর্তন প্রক্রিয়ার মাধ্যমেই সৃষ্টি হয়েছে। একদিনে
হঠাৎ করে বা আকস্মিকভাবে রাষ্ট্রি সৃষ্ট হয়নি। রাষ্ট্রের উৎপত্তি সম্পর্কে এই মতবাদই সর্বাপেক্ষা বৈজ্ঞানিক ও গ্রহণযোগ্য।
সারকথা
রাষ্ট্র বিধাতার সৃষ্টি নয়। বল প্রয়োগের মাধ্যমেও রাষ্ট্রের উৎপত্তি হয়নি। এমনকি কোনরূপ চুক্তির মাধ্যমেও রাষ্ট্রের উৎপত্তি
হয়নি। রাষ্ট্র মূলত, ঐতিহাসিক প্রক্রিয়া ও বিবর্তনের ফলস্বরূপ। আর এই ঐতিহাসিক ও বিবর্তন প্রক্রিয়ায় রক্তের সম্পর্ক,
ধর্মের বন্ধন, যুদ্ধ-বিগ্রহ, অর্থনৈতিক ব্যবস্থা এবং সর্বোপরি রাজনৈতিক চেতনা কাজ করেছে। রাষ্ট্রের উৎপত্তির ক্ষেত্রে
এ মতবাদই সর্বাধিক বৈজ্ঞানিক বলে রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা স্বীকার করেন।
পাঠোত্তর মূল্যায়ন
বহু নির্বাচনী প্রশ্ন
সঠিক উত্তর লিখুন।
১.রাষ্ট্রের উৎপত্তি সম্পর্কে ঐতিহাসিক বা বিবর্তনমূলক মতবাদের মূল বক্তব্য কি?
ক. রাষ্ট্রের উৎপত্তি হয়েছে বিধাতার ইচ্ছায়;
খ. রাষ্ট্রের উৎপত্তি হয়েছে বল প্রয়োগের মাধ্যমে;
গ. সামাজিক চুক্তির ফলে রাষ্ট্রের উৎপত্তি হয়েছে;
ঘ. ঐতিহাসিক বা বিবর্তন প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে রাষ্ট্রের উৎপত্তি হয়েছে।
২.রাষ্ট্রের উৎপত্তির ক্ষেত্রে ঐতিহাসিক বা বিবর্তনমূলক মতবাদের একনিষ্ঠ সমর্থক হলেনক. উইলোবী;
খ. গার্নার;
গ. লাস্কী;
ঘ. হার্বাট স্পেন্সার।
৩.রাষ্ট্রের উৎপত্তির যে উপাদানটি বেশি পরিমাণে কাজ করেছে তা হলোক. আত্মীয়তার বন্ধন;
খ. যুদ্ধ-বিগ্রহ;
গ. অর্থনৈতিক উপাদান;
ঘ. রাজনৈতিক চেতনা।
সঠিক উত্তর: ১. ঘ, ২. খ, ৩. ক।
সংক্ষিপ্ত উত্তরমূলক প্রশ্ন
১. ঐতিহাসিক বা বিবর্তনমূলক মতবাদকে বিজ্ঞানসম্মত মতবাদ বলা হয় কেন?
রচনামূলক প্রশ্ন
১. ‘‘ রাষ্ট্রকে সৃষ্টি করা হয় নি, এটি ক্রমবিবর্তনের ফলস্বরূপ’’- বক্তব্যটি বিশ্লেষণ করুন।

FOR MORE CLICK HERE
এইচএসসি বাংলা নোট ১ম পত্র ও ২য় পত্র
ENGLISH 1ST & SECOND PAPER
এইচএসসি আইসিটি নোট
এইচএসসি অর্থনীতি নোট ১ম পত্র ও ২য় পত্র
এইচএসসি পৌরনীতি ও সুশাসন ১ম পত্র
এইচএসসি পৌরনীতি নোট ২য় পত্র
এইচএসসি সমাজকর্ম নোট ১ম পত্র
এইচএসসি সমাজকর্ম নোট ২য় পত্র
এইচএসসি সমাজবিজ্ঞান নোট ১ম পত্র ও ২য় পত্র
এইচএসসি ইতিহাস নোট ১ম পত্র
এইচএসসি ইতিহাস নোট ২য় পত্র
এইচএসসি ইসলামের ইতি. ও সংস্কৃতি নোট ১ম পত্র
এইচএসসি ইসলামের ইতি. ও সংস্কৃতি নোট ২য় পত্র
এইচএসসি যুক্তিবিদ্যা ১ম পত্র ও ২য় পত্র
এইচএসসি ভূগোল ও পরিবেশ নোট ১ম পত্র ও ২য় পত্র
এইচএসসি ইসলামিক স্টাডিজ ১ম ও ২য় পত্র

Copyright © Quality Can Do Soft.
Designed and developed by Sohel Rana, Assistant Professor, Kumudini Government College, Tangail. Email: [email protected]