সার্বভৌমত্বের বিকাশধারা সম্পর্কে আলোচনা করুন।

সার্বভৌমত্বের বিকাশ ধীরে ধীরে সাধিত হয়েছে। যদিও প্রাচীন যুগে রাষ্ট্র ও রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা সম্পর্কে বিভিন্ন দার্শনিক
তাঁদের রাষ্ট্র দর্শনে আলোচনা করেছেন তবু কেউই সার্বভৌম ক্ষমতা সম্পর্কে সুস্পষ্ট কোন ধারণা ব্যক্ত করেন নি। গ্রীক
দার্শনিক এরিস্টটল অবশ্য আইনের সার্বভৌমত্বের কথা বলেছেন। তিনিই সর্বপ্রথম রাষ্ট্রের ক্ষমতার কথা বলেছেন।
তথাপি তার এ ধারণা তখন তেমন সুস্পষ্ট হয়ে উঠে নি। অবশ্য প্রাচীন রোমে সার্বভৌমত্বের ধারণা অপেক্ষাকৃত অধিক
পরিমাণে সুস্পষ্ট হয়ে উঠে যখন রোমান চিন্তাবিদগণ জনগণকে সার্বভৌম ক্ষমতার উৎসরূপে বর্ণনা করতে সচেষ্ট হন।
মধ্যযুগে এসে সার্বভৌমত্বের উপরোক্ত ধারণা পুনরায় স্থবির হয়ে যেতে থাকে। কেননা, তখন রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ ক্ষমতা
গীর্জার পোপ এবং সামন্তবাদীদের মধ্যে বিভক্ত হয়ে পড়ে। একদিকে সম্রাট এবং অপরদিকে গীর্জার পোপের মধ্যে
ক্ষমতার দ্ব›দ্ব শুরু হয়। এতে শেষ পর্যন্তসম্রাট জয় লাভ করলে জনগণ সম্রাটের প্রতি আনুগত্য প্রদর্শন করতে থাকে।
ধীরে ধীরে সম্রাটের ক্ষমতা ও কর্তৃত্বের প্রসার ঘটতে থাকে। মধ্যযুগের অবসানান্তেজনগণ মুক্তি পাগল হয়ে উঠলে
ওকহ্যামের ইউলিয়ম (ডরষষরধস ড়ভ ঙপযধস) এবং পাদুয়ার মার্সিলিও এর মত চিন্তাবিদদের
কণ্ঠে ধ্বনিত হয় জনগণের সার্বভৌমত্বের কথা।
ইউরোপে নবজাগরণের সূচনার সঙ্গে সঙ্গে সম্রাটের নেতৃত্বে জাতি রাষ্ট্র (ঘধঃরড়হ ঝঃধঃব) গঠনের উদ্যোগ সফলকাম
হয়। আর সেই সঙ্গে সার্বভৌম ক্ষমতার উদ্ভব ঘটে। প্রকৃতপক্ষে আধুনিক যুগের শুরুতে তথা ষোড়শ শতাব্দীর প্রারম্ভে
জাতি রাষ্ট্র ও সার্বভৌম ক্ষমতা পরিপূর্ণতা লাভ করে।
ষোড়শ শতাব্দীতে ইটালিতে মেকিয়াভেলীর () রাষ্ট্রচিন্তার মধ্য দিয়ে আধুনিক জাতি রাষ্ট্র তথা
সার্বভৌমত্বের ধারণা বিকাশিত হয়। মেকিয়াভেলী নিরঙ্কুশ সার্বভৌম ক্ষমতার সমর্থক ছিলেন। তৎকালীন ইটালীর
ভৌগলিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলা অবলোকন করে তিনি সংযুক্ত ইটালি এবং শক্তিশালী জাতি রাষ্ট্রের
প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করেন। তিনি সকল প্রকার গণতান্ত্রিক পথ পরিহার করে এক স্বৈরাচারী ও নিরঙ্কুশ রাজতন্ত্রের
মতবাদ প্রচার ও প্রতিষ্ঠা করতে পরামর্শ দেন। মেকিয়াভেলী সে জন্য সার্বভৌম শাসককে সর্বোচ্চ ক্ষমতার অধিকারী
করেন। তাঁর রাষ্ট্রচিন্তার একটি বিশেষ দিক হলো তিনি উদ্দেশ্যের মাধ্যমে যে কোন কাজের মূল্যায়ন করা যুক্তিসঙ্গত
বলে মনে করেন। এ ধারণার বশবর্তী হয়ে তিনি সার্বভৌম শাসককে ইটালির একত্রীকরণ ও শক্তিশালী করার উদ্দেশ্যে
যে কোন অন্যায় আচরণ, বিশ্বাসঘাতকতা করার পরামর্শ প্রদান করেন। এ ভাবে মেকিয়াভেলী আধুনিক রাজনৈতিক
দর্শনে সার্বভৌমত্বের ব্যাখ্যা দেন এবং তাঁর দর্শনে তিনি শাসককে চরম সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী করে তোলেন।
মেকিয়াভেলীর অব্যবহিত পরেই ফ্রান্সে জিন বদিনের আবির্ভাব ঘটে (১৫৩০-১৫৯৬ খ্রীঃ) তাঁর
রাজনৈতিক চিন্তাধারা পান্ডিত্যবাদ ও রক্ষণশীলতার প্রতিভ‚ হওয়া সত্বেও রেনেসাঁর অনুপ্রেরণায় তিনি বাস্তব রাষ্ট্রনীতির
ভিত্তিতে এক শক্তিশালী রাজতন্ত্রপ্রতিষ্ঠায় সচেষ্ট হন।
বদিনের মতে সার্বভৌম ক্ষমতার উপস্থিতি রাষ্ট্রকে অন্যান্য সংঘ থেকে পৃথক করে এবং সে অনুসারে তিনি নাগরিকতাকে
সার্বভৌম ক্ষমতার অধীন বলে মনে করেন। সার্বভৌমত্ব ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বদিন বলেন, “আইনের প্রতিবন্ধকতা
ব্যতীত নাগরিক ও প্রজাদের উপর সর্বোচ্চ ক্ষমতা প্রয়োগের অধিকারই হচ্ছে সার্বভৌমত্ব” এ ধারণা থেকে সার্বভৌমত্বের
দু’টো রূপ স্পষ্ট হয়ে উঠে। প্রথমত, এ ক্ষমতা বলে রাষ্ট্র অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে সকল ব্যক্তি ও সংঘের উপর চরম ক্ষমতা
প্রয়োগ করতে সক্ষম। দ্বিতীয়ত: এ ক্ষমতার মাধ্যমে রাষ্ট্র সব ধরনের বৈদেশিক নিয়ন্ত্রণ ও আক্রমণ থেকে নিজেকে মুক্ত ও স্বাধীন রাখতে সক্ষম।
জিন বদিনের পদাঙ্ক অনুসরণ করে সপ্তদশ শতাব্দীর ইংরেজ দার্শনিক টমাস হবস্ সার্বভৌমত্বের ধারণাকে অধিকতর
সুস্পষ্ট ও প্রাণবন্তকরে তোলেন। তাঁর মতে, জনগণ যেহেতু চুক্তির মাধ্যমে তাদের সকল অধিকার একজন ব্যক্তির হাতে
ছেড়ে দিয়েছে কাজেই সেই ব্যক্তি তার ইচ্ছানুসারে রাষ্ট্রীয় শাসনকার্য পরিচালনা ও নিয়ন্ত্রণ করেন। অর্থাৎ তিনি হবেন
সার্বভৌম শক্তির আধার। এই সার্বভৌম শক্তির বিরুদ্ধে জনগণ কোনরূপ অভিযোগ করতে পারবে না এবং সার্বভৌম
শাসককে ক্ষমতাচ্যুতও করতে পারবে না। এ ভাবে হবস্ সার্বভৌম শাসকের হাতকে অত্যন্তশক্তিশালী করতে এবং
তাকে নিরঙ্কুশ ক্ষমতার অধিকারী করতে বলেন।
হবসের অব্যবহিত পরে সপ্তদশ শতাব্দীর অপর একজন ইংরেজ দার্শনিক জন লক সার্বভৌত্ব সম্পর্কে তাঁর নিজস্ব ধারণা
ব্যক্ত করেন। প্রকৃতপক্ষে লকের সামাজিক চুক্তির স্বরূপ থেকেই সার্বভৌম ক্ষমতার স্বরূপ প্রতিভাত হয়ে উঠে। তাঁর
সামাজিক চুক্তির বিশ্লেষণ থেকে এটি স্পষ্ট হয়ে উঠে যে, এ চুক্তি প্রথমত সমগ্র জনগণের মধ্যে এবং দ্বিতীয়ত তা জনগণ
এবং শাসকের মধ্যে সংঘটিত হয়েছিল। এতে করে শাসক যেহেতু চুক্তির অংশে পরিণত হন কাজেই তাঁর পক্ষে আর
স্বৈরাচারী হয়ে উঠা সম্ভবপর ছিল না। কেননা জনগণ তাদের হাতে শাসককে ক্ষমতাচ্যুত করার ক্ষমতা রেখে দিল। ফলে
শাসক জনগণের নিকট দায়ী থাকতে বাধ্য হলেন। এ ভাবে তার রাষ্ট্রদর্শনে সার্বভৌম শাসককে জনগণের সম্মতির উপর
নির্ভরশীল করে তোলেন।
অতঃপর অষ্টাদশ শতাব্দীতে ফরাসী দার্শনিক রুশোর রাষ্ট্র দর্শনে সার্বভৌম ক্ষমতার ধারণা অধিকতর স্পষ্ট হয়ে উঠে।
এ ক্ষেত্রে তিনি জন লককে অনেকাংশে অনুসরণ করেন। রুশো জনগণকে সার্বভৌম ক্ষমতার উৎস বলে ঘোষণা করেন।
তার মতে, সামাজিক চুক্তির মাধ্যমে সৃষ্ট রাজনৈতিক সমাজই প্রকৃতপক্ষে সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী। সামাজিক চুক্তির
মাধ্যমে সকলেই তাদের অধিকার সকলের নিকট সমর্পণ করে এবং ‘সাধারণ ইচ্ছার’ অধীনে আসে যা মানুষের প্রকৃত
ইচ্ছার সমষ্টি। রুশোর মতে, এই ‘সাধারণ ইচ্ছাই’ হলো সার্বভৌম। আর সাধারণ ইচ্ছা হলো সকলের কল্যাণের লক্ষ্যে পরিচালিত ইচ্ছা।
এভাবে প্রাচীন গ্রীক যুগ থেকে শুরু করে মধ্যযুগ পেরিয়ে আধুনিক যুগে এসে সার্বভৌমত্ব তার পরিপূর্ণ অবয়বে বিকাশ লাভ করেছে।
সারকথা
সার্বভৌম ক্ষমতার বিকাশ একদিনে হঠাৎ করে সাধিত হয় নি। এর বিকাশ ধারায় সুদীর্ঘ সময় লেগেছে। প্রাচীন যুগে
সার্বভৌমত্বের ধারণা তেমন স্পষ্ট হয়ে উঠে নি। রোমান যুগে তা অনেকটা স্পষ্ট হয়ে উঠলেও মধ্যযুগের সূচনায় তা স্থবির
হয়ে পড়ে। অবশ্য ক্রমে তা এক সুনির্দিষ্ট রূপ পরিগ্রহ করতে থাকে। তবে আধুনিককালে জাতীয় রাষ্ট্রের উদ্ভবের ফলে সার্বভৌমত্বের ধারণা পূর্ণাঙ্গ রূপ লাভ করে।
সঠিক উত্তর লিখুন।
১। সার্বভৌমত্বের বিকাশ কিভাবে সাধিত হয়েছে?
ক. বেশ দ্রæত;
খ. হঠাৎ করে;
গ. বিশেষ কোন ব্যক্তির উদ্যোগে;
ঘ. ধীরে ধীরে।
২। মধ্যযুগে সার্বভৌমত্বের ধারণা কিরূপ ছিল?
ক. ক্রমে স্পষ্ট হতে থাকে;
খ. ক্রমে অধিকতর ঘোলাটে হয়ে উঠে;
গ. গীর্জার পোপের হাতে নিয়োজিত হয়;
ঘ. সম্রাটের হাতে কুক্ষিগত হয়।
৩।সার্বভৌমত্বের ধারণা পরিপূর্ণ রূপ লাভ করে কোন্ শতাব্দীতে?
ক. পঞ্চদশ শতাব্দীতে;
খ. ষোড়শ শতাব্দীতে;
গ. সপ্তদশ শতাব্দীতে;
ঘ. অষ্টাদশ শতাব্দীতে।
৪। আধুনিক জাতি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সঙ্গে সার্বভৌমত্ব কিরূপ পরিগ্রহ করে?
ক. সার্বভৌমত্ব সুসংহত হয়;
খ. সার্বভৌমত্ব বিকশিত হতে থাকে;
গ. সার্বভৌমত্ব পরিপূর্ণ রূপ লাভ করে;
ঘ. সার্বভৌমত্ব আরো অস্পষ্ট হয়ে উঠে।
উত্তরমালা: ১. ঘ, ২. গ, ৩. খ, ৪. গ।
সংক্ষিপ্ত উত্তরমূলক প্রশ্ন
১. সার্বভৌম ক্ষমতা নিয়ে গীর্জার পোপ ও সম্রাটের মধ্যকার বিরোধের প্রকৃতির উপর আলোকপাত করুন।
২. ‘সার্বভৌমত্ব ও জাতি রাষ্ট্রের উদ্ভব পরস্পর সম্পর্কযুক্ত’। অতি সংক্ষেপে ব্যাখ্যা করুন।
রচনামূলক প্রশ্ন
১. সার্বভৌমত্বের বিকাশধারা সম্পর্কে আলোচনা করুন।
২. ‘আধুনিক রাষ্ট্র মূলত জাতীয় সার্বভৌম রাষ্ট্র’- বক্তব্যটি সম্প্রসারিত করুন।

FOR MORE CLICK HERE
এইচএসসি বাংলা নোট ১ম পত্র ও ২য় পত্র
ENGLISH 1ST & SECOND PAPER
এইচএসসি আইসিটি নোট
এইচএসসি অর্থনীতি নোট ১ম পত্র ও ২য় পত্র
এইচএসসি পৌরনীতি ও সুশাসন ১ম পত্র
এইচএসসি পৌরনীতি নোট ২য় পত্র
এইচএসসি সমাজকর্ম নোট ১ম পত্র
এইচএসসি সমাজকর্ম নোট ২য় পত্র
এইচএসসি সমাজবিজ্ঞান নোট ১ম পত্র ও ২য় পত্র
এইচএসসি ইতিহাস নোট ১ম পত্র
এইচএসসি ইতিহাস নোট ২য় পত্র
এইচএসসি ইসলামের ইতি. ও সংস্কৃতি নোট ১ম পত্র
এইচএসসি ইসলামের ইতি. ও সংস্কৃতি নোট ২য় পত্র
এইচএসসি যুক্তিবিদ্যা ১ম পত্র ও ২য় পত্র
এইচএসসি ভূগোল ও পরিবেশ নোট ১ম পত্র ও ২য় পত্র
এইচএসসি ইসলামিক স্টাডিজ ১ম ও ২য় পত্র

Copyright © Quality Can Do Soft.
Designed and developed by Sohel Rana, Assistant Professor, Kumudini Government College, Tangail. Email: [email protected]