সমাজতন্ত্রের মূল বক্তব্য ও পূর্ব ইতিহাসের বর্ণনা দিন। ইতিহাসের বস্তুুবাদী ব্যাখ্যা, শ্রেণী সংগ্রাম, সম্পর্কে মার্কস কি বলেছেন-তা আলোচনা করুন।

সমাজতন্ত্রহ’ল পুঁজিবাদের বিপরীতধর্মী মতবাদ। পুঁজিবাদী শোষণ অবসান কল্পে এ মতবাদের সৃষ্টি হয়েছিল। এর মূল
আবেদন হলো অর্থনীতির ক্ষেত্রে মানুষের মধ্যে সমতা বিধান করা।
সমাজতন্ত্রের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস
উনিশ - শতকের প্রথমদিকে যে চিন্তাধারা ইউরোপ হতে শুরু করে তার প্রভাব বলয় সারা পৃথিবীতে বিস্তৃত করে তার
নাম সমাজতন্ত্রবা সমাজবাদ। উনিশ শতকে আলোড়ন সৃষ্টি করলেও এই মতবাদের উৎপত্তি আরো বহু পূর্বে। গ্রীক
দার্শনিক প্লেটোর চিন্তাধারায় সাম্যবাদ (ঈড়সসঁহরংস) নামে এই মতবাদের পরিচয় মেলে। এতে তিনি সমাজের তিন
শ্রেণীর মানুষের মধ্যে উচ্চ দু’শ্রেণী (১) শাসক ও (২) যোদ্ধা শ্রেণীর জন্য ব্যক্তিগত সম্পত্তি ও পারিবারিক জীবন রহিত
করে শাসক শ্রেণীর জন্য সাম্যভিত্তিক সমাজব্যবস্থার কল্পনা করেন। খৃষ্টপূর্ব তেরোশত সালে ক্রীট নামের এক দ্বীপে
সর্বপ্রথম সমাজতন্ত্রঅনুশীলনের সাক্ষ্য পাওয়া যায় ইতিহাস গ্রন্থে। অনেকে ইহুদীদের ‘ওল্ড টেস্টামেন্ট’ নামক ধর্মশাস্ত্রে
সমাজতন্ত্রের চিহ্ন খুঁজে পান। ১৫১৬ সালে রচিত ‘ইউটোপিয়া’ নামক গ্রন্থে টমাস মোর, ১৬২৩ সালে ‘সিটি অব দি
সান’ গ্রন্থে টমাস ক্যাম্পানেলার প্রমুখ দার্শনিক সমাজতন্ত্রের কথা উল্লেখ করেন। এসব গ্রন্থে সম্পদের অসম মালিকানা ও
বিলিবন্টনকেই সব ধরনের সামাজিক অকল্যাণের মূল বলে চিহ্নিত করে সাধারণ মালিকানার মাধ্যমে তা’ থেকে
মুক্তিলাভের ব্যবস্থাপত্র দেয়া হয়েছে।
উপরে বর্ণিত সমাজতন্ত্রের এসব ধারণা খুব স্পষ্ট কিংবা প্রকৃত দৃষ্টিভঙ্গি হতে উদ্ভুত ছিল না। আদর্শ হিসেবে সমাজতন্ত্র
প্রথম সূচিত হয় আঠার শতকের ফ্রান্স ও ইংল্যান্ডে। বা কাল্পনিক সমাজতন্ত্রনামক এই মতবাদের
প্রবক্তা ও প্রচারক ছিলেন ফ্রান্সের সেন্ট সাইমন ও চার্লস ফুরিয়ের, ইংল্যান্ডের রবার্ট ওয়েন প্রমুখ। উনিশ শতকেই চার্লস
হল , টমাস স্পেস (ঞযড়সধং ঝঢ়ধপব) ও উইলিয়াম ওগিলভি নামক ব্রিটিশ লেখকগণ সমাজতন্ত্র
সম্বন্ধে মতামত প্রদান করেন। ধারাবাহিকতার পথ বেয়ে উনিশ শতকে সমাজতন্ত্রসম্বন্ধে যার চিন্তাধারা বিশ্বব্যাপী
চিন্তাজগতে তোলপাড় সৃষ্টি করে এবং ১৯১৭ সালে বিপ্লবের মধ্য দিয়ে রাশিয়াতে ‘সোভিয়েত ইউনিয়ন’ নামে একটি
সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র গঠনে উদ্ধুদ্ধ করে, তিনি হলেন জার্মান দার্শনিক কার্ল মার্কস (১৮১৮-১৮৮৩)। আজকের দিনে
সমাজতন্ত্রবললে আমরা কার্ল মার্কস-এর মতবাদকেই বুঝি। কাজেই সমাজতন্ত্রবিষয়ে কার্ল মার্কস- এর চিন্তাধারা
আলোচনা করাই সমীচীন হবে।
মূল বক্তব্য
সমাজতন্ত্রের মূলকথা হ’ল, উৎপাদন ও বন্টনের উপকরণগুলো ব্যক্তি মালিকানা হতে ক্রমান্বয়ে সামাজিক নিয়ন্ত্রণে আনতে
হবে। এ মতবাদ অনুসারে পুঁজির বাস্তব প্রয়োজনীয়তা রয়েছে কিন্তব্যক্তি পুঁজিপতির প্রয়োজন নেই। রাষ্ট্রীয় সমাজতন্ত্রীগণ
মানবসমাজকে একটি রাজনৈতিক সংস্থা হিসেবে সংগঠিত করবে। এই রাজনৈতিক সংস্থাই হবে ভ‚মি, পুঁজি ও উৎপাদন
উপকরণের মালিক ও ব্যবস্থাপক। এই সংস্থা জীবনের সর্বক্ষেত্রে তার নিয়ন্ত্রণের আওতা বিস্তৃত করবে যাতে সাম্য ও
সামাজিক কল্যাণ নিশ্চিত করা যায়। দ্রব্য উৎপাদনে ব্যক্তিগত মালিকানা থাকবে না। পুঁজি ব্যবহৃত হবে সকলের কল্যাণ
উদ্দেশ্যে, এখানে মুষ্টিমেয় লোকের স্বার্থ বিবেচনা করা হবে না। রাষ্ট্র যেহেতু সাধারণের কল্যাণ নিশ্চিত করার দায়িত্ব
পালন করবে তাই সবকিছুরই নিয়ন্ত্রক হবে রাষ্ট্র। সমাজতন্ত্রেসরকারের কার্যাবলী এবং তার সীমানা বৃদ্ধির কথা বলা
হয়। এর উদ্দেশ্য রাষ্ট্রের গুরুত্ব বৃদ্ধি নয়। বরং সমাজতন্ত্রের ধারণা মতে এ ভাবেই ব্যক্তির ন্যায় ও স্বাধীনতার চাহিদা মেটান সম্ভব।
সমাজতন্ত্রসম্বন্ধে কার্ল মার্কস
আধুনিক রাষ্ট্রদর্শনের ইতিহাসে কার্ল মার্কস সেই ব্যক্তিত্ব যার সমাজতান্ত্রিক মতবাদ বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রনামে বিপুল
পরিচিতি অর্জন করে ব্যক্তিস্বাত্যন্ত্রবাদী ধনতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থার ভিত্তিমূল কাঁপিয়ে দিয়েছে। তাঁর মতবাদই ১৯১৭ সালে
এক রক্তক্ষয়ী সামাজিক বিপ্লবের মাধ্যমে তার একনিষ্ঠ অনুসারী নেতা ও সংগঠক মহামতি লেনিনের নেতৃত্বে রাশিয়ায়
প্রতিষ্ঠা লাভ করে। বিশ্বে মাথা তুলে দাঁড়ায় সোভিয়েত ইউনিয়ন নামক নতুন অর্থব্যবস্থা নিয়ে গড়ে-ওঠা এক বিশাল
রাষ্ট্রশক্তি। মার্কস তাঁর চিন্তাধারা তথা সমাজতান্ত্রিক দর্শনকে দ্বা›িদ্বক বস্তুবাদের বৈজ্ঞানিক ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত, করেন
এবং এটাকে ভাবরাজ্যের বৃত্ত হতে বাস্তবতার আলোকে নিয়ে আসেন। এ জন্য তাঁর সমাজতন্ত্র‘বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র
নামে পরিচিত হয়েছে। মার্কস নিজেই এ দর্শনকে 'ধ হবপবংংধৎু ঢ়ৎড়ফঁপঃ ড়ভ যরংঃড়ৎরপধষ ফবাবষড়ঢ়সবহঃ' বা
ঐতিহাসিক বিকাশের অবশ্যম্ভাবী পরিণতি বলে চিহ্নিত করেছেন। তাঁর সমাজতন্ত্রচারটি মূল স্তম্ভের ওপর নির্মিত। এগুলো
নি¤েœআলোচনা করা হ’ল।
দ্ব›দ্বমূলক বস্তুবাদ
মার্কস মনে করেন যে, জগতে বস্তুই একমাত্র সত্ত¡া। গতি এর স্বাভাবিক ধর্ম। এর অস্তিত্ব মানবমনে নয়। বরং মানুষের
মনের অস্তিত্ব ও গতিবিধি বস্তুর ওপর নির্ভরশীল। বস্তুজগত অখন্ড এবং সামগ্রিকভাবে সুহংহত। দ্ব›দ্বমূলক বস্তুবাদ অনুযায়ী,
প্রকৃতির কোন বস্তু বা ঘটনাকে পরিবেশ নিরপেক্ষভাবে ব্যাখ্যা করা যায় না। প্রতিটি ঘটনাই বস্তগত পরিবেশ দ্বারা
নিয়ন্ত্রিত ও প্রভাবিত। বিশ্বের সবকিছুই পরিবর্তনশীল এবং এই পরিবর্তনের কারণ অভ্যন্তরীন স্ববিরোধিতা। যে কোন
বস্তুর পরিমাণগত পরিবর্তন ঘটলে তার গুণগত পরিবর্তনও ঘটে। পুরোনোকে অস্বীকার করার মধ্যে দিয়েই সৃষ্টি হয়
নতুনের।
উদ্বৃত্ত মূল্যতত্ত¡
মার্কসের মতে পুঁজিবাদী সমাজে শ্রমিক তার ব্যবহৃত শ্রমশক্তি খাটিয়ে তার যে মূল্য পায় তা’ কখনই তার ব্যবহৃত
শ্রমশক্তির প্রকৃত মূল্য নয়। বরং তার চেয়ে অনেক কম। শ্রমিকের মোট সময়ের একটি অংশ হতে সৃষ্ট মূল্য শ্রমিককে
তার পারিশ্রমিক হিসেবে দেয়া হয়। শ্রম-সময়ের অবশিষ্ট অংশ কাজ করে শ্রমিক যে মূল্য সৃষ্টি করে সেটি যায় উদ্যোক্তা
ও বিনিয়োগকারী পুঁজিপতির পকেটে। শ্রমিকের শ্রমের এই শেষ অংশকে বলা হয় উদ্ধৃত্ত শ্রম-সময়। আর এই উদ্বৃত্ত শ্রমসময়ে সৃষ্ট মূল্যকে উদ্বৃত্ত মূল্য বলা হয। অন্যভাবে বললে, মোট শ্রম-সময় সৃষ্ট মূল্য  শ্রমিকের
মজুরী = উদ্বৃত্ত মূল্য। উদ্বৃত্ত মূল্য শ্রমিককে না দিয়ে পুঁজিপতিরা শ্রমিককে ন্যায্য পাওনা থেকে বঞ্চিত করে থাকে।
ঐতিহাসিক বস্তুবাদ বা ইতিহাসের বস্তুবাদী ব্যাখ্যা
মার্কসের মতে মানবসমাজ ও তাতে বিদ্যমান প্রতিষ্ঠানগুলো সম্বন্ধে দ্ব›দ্বমূলক বস্তুবাদের মূল সূত্রগুলোর প্রয়োগই হচ্ছে
ঐতিহাসিক বস্তুবাদ। এ মতবাদের মূল কথা হ’ল সমাজ পরিবর্তনশীল এবং এই পরিবর্তনের মূল কারণ নিহিত রয়েছে
সমাজের উৎপাদন ব্যবস্থার মধ্যে। উৎপাদন ব্যবস্থার দুটি দিক। উৎপাদনের শক্তি এবং উৎপাদনের সম্পর্ক। এ দুটির
মধ্যে দ্ব›েদ্বর ফলে সমাজে পরিবর্তন ঘটে। মার্কস বলেন, ‘ উৎপাদনের ফলে সৃষ্ট বিভিন্ন সম্পর্কের যোগফল নিয়েই গড়ে
ওঠে সমাজের অর্থনৈতিক কাঠামো। এটিই সমাজের প্রকৃত ভিত্তি। এ ভিত্তির উপরই গড়ে ওঠে আইনগত ও রাজনৈতিক
কাঠামোসমূহ। গড়ে ওঠে সামাজিক চেতনা। বস্তগত জীবনে উৎপাদনের যে পদ্ধতি প্রতিষ্ঠিত থাকে তাই মানুষের
সামাজিক, রাজনৈতিক ও আধ্যাতিœক জীবন প্রক্রিয়ার সাধারণ চরিত্র নির্ধারণ করে। মানুষের চেতনা তার অস্তিত্বের
নির্ধারক নয় বরং সামাজিক অস্তিত্বই মানুষের চেতনাকে নিয়ন্ত্রণ করে।’
অর্থনৈতিক নির্ধারণবাদ
মার্কস এর ঐতিহাসিক বস্তুবাদ ও অর্থনৈতিক নির্ধারণবাদ পরস্পর ঘনিষ্টভাবে সম্পর্কযুক্ত। মার্কস মনে করেন যে,
ইতিহাসের সমস্তঘটনাই অর্থনৈতিক উপাদানের সাথে যুক্ত। অন্যভাবে বলতে গেলে, মানবসভ্যতার ইতিহাস অর্থনৈতিক
কার্যকারণের ফলে গড়ে উঠেছে। ইতিহাসের নির্ধারক হচ্ছে অর্থনীতি। মার্কস-এর মতে, মানবসমাজের প্রতিটি
রাজনৈতিক ব্যবস্থা তার বিশেষ অর্থনৈতিক উৎপাদন ব্যবস্থার ফল। অর্থাৎ অর্থনীতির উপকরণগুলো যে শ্রেণীর নিয়ন্ত্রণে
থাকে সেই শ্রেণীই সামাজিক ও রাজনৈতিক জীবনে প্রাধান্য ও নেতৃত্ব লাভ করে। তাদের দ্বারাই সামাজিক ও রাজনৈতিক
জীবন ব্যবস্থার গতিপ্রকৃতি নির্ধারিত হয়।
শ্রেণীসংগ্রাম
মার্কসের রাষ্ট্রদর্শনের অন্যতম বিষয় হচ্ছে তার শ্রেণীসংগ্রাম তত্ত¡। মার্কস বলেন, রাষ্ট্র হচ্ছে শোষক শ্রেণীর হাতিয়ার।
এর সাহায্যে তারা তাদের স্বার্থ রক্ষা করে। এই শ্রেণী তাদের রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান, নীতিধর্ম ও বিশ্বাসপদ্ধতি এমনভাবে
গড়ে তোলে যাতে তা’ তাদের স্বার্থের প্রতিভ‚ হিসেবে কাজ করে। তবে প্রতিটি উৎপাদন ব্যবস্থার মধ্যেই দুটি পরস্পর
বিরোধী শ্রেণীর অস্তিত্ব রয়েছে। একটি শোষক বা ধনিক শ্রেণী এবং অন্যটি শোষিত বা শ্রমজীবী শ্রেণী। শিল্প বিপ্লবের
পর থেকে আধুনিক সমাজে এ দুটি শ্রেণীর অবস্থান খুবই স্পষ্ট হয়েছে। মানবসভ্যতার ইতিহাস হচ্ছে এক শ্রেণীর উপর
অপর শ্রেণীর আধিপত্যের ইতিহাস। উৎপাদন ব্যবস্থার নিয়ন্ত্রক হিসেবে পুঁজিপতি শ্রেণী শ্রমিকের দ্বারা সৃষ্ট উদ্বৃত্ত মূল্য
তার ভোগবিলাস ও সম্পদবৃদ্ধির কাজে লাগায়। শ্রমিক ক্রমশ তার ক্রয়ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে এবং সর্বহারা শ্রেণীতে
পরিণত হয়। এভাবে সর্বহারাদের সংখ্যা বৃদ্ধি পেতে থাকে। পুঁজিপতি ও সর্বহারা শ্রমিকশ্রেণী তাদের নিজ নিজ অস্তিত্ব
টিকিয়ে রাখার স্বার্থে পরস্পর বিরোধে জড়িয়ে পড়ে। পুঁজিপতিগণ উৎপাদন ব্যবস্থার উপর একচেটিয়া আধিপত্য বজায়
রাখার জন্য মরিয়া হয়ে ওঠে এবং শ্রমিকশ্রেণীও তাদের অস্তিত্বের স্বার্থে ঐক্যবদ্ধ হয়ে পুঁজিপতিদের বিরুদ্ধে স্বার্থরক্ষার
সংগ্রামে লিপ্ত হয়। এই হচ্ছে শ্রেণীসংগ্রাম তত্তে¡র মূলকথা। মার্কস-এর মতে শ্রেণী সংগ্রামের মধ্যদিয়েই সামাজিক পরিবর্তন আসে।
সামাজিক বিপ্লব ও সর্বহারার একনায়কত্ব প্রতিষ্ঠা
মার্কসের মতে, সংখ্যাবৃদ্ধির সাথে সাথে সর্বহারা শ্রমিক শ্রেণী সচেতন হয়ে উঠতে থাকে। পুঁজিপতিদের সীমাহীন
শোষণের ফলে তাদের দুঃখকষ্ট এতই বৃদ্ধি পায় যে, তা’ একসময় ধৈর্যের সীমা অতিক্রম করবে। তাদের সামনে দুটো
পথ খোলা থাকবে। হয় আঘাত কর নয় উপোস কর। এছাড়া তাদের কোন উপায় থাকবে না। এ পর্যায়ে পুঁজিপতি
শ্রেণীও শোষণের নতুন নতুন প্রক্রিয়া অবলম্বন করবে। তারা পরিণামের কথা ভাববে না। উভয় পক্ষের এ চরম অবস্থায়
সর্বাহারা শ্রেণী বিপ্লবের দিকে এগিয়ে যাবে। এ বিপ্লবে পরাজয় ঘটবে পুঁজিপতি বুর্জোয়াদের। উৎপাদন ও বন্টনের কর্তৃত্ব
চলে যাবে সর্বহারাদের হাতে। তাদেরই হাতে থাকবে রাজনৈতিক কর্তৃত্ব। এ কর্তৃত্ব বলে তারা বুর্জোয়াদের পুঁজি কেড়ে
নেবে এবং রাজনৈতিক প্রাধান্য কাজে লাগিয়ে উৎপাদন বৃদ্ধির চেষ্টা করবে।
শ্রেণীহীন সমাজ ও রাষ্ট্রের তিরোধান
মার্কস সর্বহারাদের একনায়কত্বকে (সমাজতন্ত্রকে) একটি সাময়িক ও মধ্যবর্তী ব্যবস্থা বলে গণ্য করেন। কারণ তার
সমাজতান্ত্রিক চিন্তাধারার মূল লক্ষ্য হচ্ছে সমাজ থেকে শ্রেণীভেদের চ‚ড়ান্তঅবসান ঘটান। যেহেতু শ্রেণীভেদ থাকবে না
তাই রাষ্ট্রেরও প্রয়োজন থাকবে না। সমাজতন্ত্রএ অবস্থায় উপনীত হবার মাধ্যম হিসেবে কাজ করবে। সমাজের
উৎপাদনব্যবস্থা রাষ্ট্রের হাত থেকে ক্রমশঃ সম্প্রদায়ের হাতে চলে আসবে। তখন, আর রাষ্ট্রের প্রয়োজন থাকবে না।
কারণ মার্কসের মতে রাষ্ট্র শ্রেণীবিশেষের শোষণের জন্য ব্যবহৃত যন্ত্র। যখন শ্রেণী থাকবে না, শোষণ ও থাকবে না।
শোষণ না থাকলে মানুষের শাসনের পরিবর্তে প্রতিষ্ঠিত হবে বস্তুর শাসন। এ অবস্থায় বিভেদ ঘুচে যাবে এমনকি নারীপুরুষ
অসাম্য থাকবেনা। প্রেম ও ভালবাসা হবে তাদের মিলনের মূলমন্ত্র।
সমাজতন্ত্রের বৈশিষ্ট্য
 সমাজতন্ত্রের লক্ষ্য হল পুঁজিবাদী সমাজের পরিবর্তে সমবায়মূলক ও পারস্পরিক সহযোগিতা ভিত্তিক সমাজব্যবস্থা।
 সমাজতন্ত্রপ্রতিযোগিতামূলক সমাজের পরিবর্তে সমবায়মূলক ও পারস্পরিক সহযোগিতা ভিত্তিক সমাজব্যবস্থার কথা
বলে।
 সমাজতন্ত্রউদারনীতিবাদ ও ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদের বিরোধী।
 সমাজতন্ত্রউৎপাদনের উপায় এবং বন্টন ও বিনিময়ের ওপর সামাজিক মালিকানা ও নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার কথা বলে।
 সমাজতন্ত্রসব রাষ্ট্রকে অশুভ প্রতিষ্ঠান বলে মনে করে না এবং রাষ্ট্রের কার্যাবলীর সম্প্রসারণ চায় এবং রাষ্ট্রের সাহায্যে
বুর্জোয়া শ্রেণীকে উৎখাত করতে চায়।
 সর্বহারা শ্রেণীর বিপ্লবের মাধ্যমে পুঁজিবাদী রাষ্ট্রের ধ্বংস সাধন এবং সর্বহারার একনায়ত্ব প্রতিষ্ঠা।
 ‘প্রত্যেকে কাজ করবে এবং কাজ অনুযায়ী সামাজিক সম্পদের অংশ পাবে’ ।
সমাজতন্ত্রের পক্ষে যুক্তি
 নৈতিক যুক্তি: পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় প্রচলিত বল্গাহীন প্রতিযোগিতা, কালোবাজারী, মুনাফাবাজি, শোষণ, অসাধুতা
ইত্যাদি মানুষের নৈতিক অধঃপতন ঘটায়। ফলে সমাজের মধ্যে ধনী-দরিদ্রের ব্যবধান বাড়ে। সমাজতন্ত্রেপুঁজিবাদী
ব্যবস্থার এই কুফলগুলো থাকে না, মানুষে মানুষে সাম্য প্রতিষ্ঠিত হয় এবং মানুষের নৈতিক মান উন্নত হয়। তাই
গার্নার (এধৎহবৎ) বলেছেন,
 দার্শনিক যুক্তি: পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় ব্যক্তিস্বাধীনতার ওপর মাত্রাতিরিক্ত গুরুত্ব আরোপ করা হয় বলে ব্যক্তিস্বার্থের
বেদীমূলে সমষ্টি স্বার্থকে বিসর্জন দেওয়া হয়। সমাজতন্ত্রবাদীদের মতে, সমষ্টির কল্যাণ সাধিত হলেই ব্যক্তির কল্যাণ
সাধিত হতে পারে। তাই তাঁরা সমাজতন্ত্রপ্রতিষ্ঠার মাধ্যমে সমাজের সামগ্রিক কল্যাণ সাধনের ব্যাপারে বেশি
আগ্রহী।
 রাজনৈতিক যুক্তি: পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় ধনী - দরিদ্রের মধ্যে বৈষম্য বাড়ে এবং রাষ্ট্রক্ষমতা ধনিক শ্রেণীর হাতে
থাকে বলে সম্পত্তিহীন শ্রেণী নানারকম সুযোগ - সুবিধা থেকে বঞ্চিত হয়। ফলে গণতন্ত্রমিথ্যায় পর্যবসিত হয়।
সমাজতন্ত্রেঅর্থনৈতিক ক্ষেত্রে সাম্য প্রতিষ্ঠিত হয় বলে সকলের জন্য রাজনৈতিক স্বাধীনতা ও অধিকার ভোগ নিশ্চিত
হতে পারে। বস্তুত, গণতন্ত্রের অন্যতম রক্ষাকবচ হল অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে সাম্য।
 অর্থনৈতিক যুক্তি: ধনতান্ত্রিক সমাজে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে অবাধ প্রতিযোগিতা অনিবার্যভাবে একচেটিয়া পুঁজিবাদের
জন্ম দেয়। আর এই একচেটিয়া পুঁজিবাদের ফলে মালিকদের মুনাফা বাড়ে, শ্রমিক - শোষণ বাড়ে, দারিদ্র্য,
বেকারত্ব, অনিশ্চয়তা প্রভৃতি বাড়ে। সমাজতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় অকাম্য প্রতিযোগিতার পরিবর্তে পরিকল্পিত
অর্থনীতি ও রাষ্ট্রিয় নিয়ন্ত্রণ প্রবর্তনের ফলে উৎপাদন দ্রæত বৃদ্ধি পায়, মূল্যস্তর হ্রাস পায় এবং জীবনযাত্রার মান উন্নত
হয়।
 মানবিক মূল্যবোধের যুক্তি: ধনতান্ত্রিক সমাজে পণ্য অর্থনীতির দাপটে মানুষে মানুষে সম্পর্ক সম্পূর্ণরূপে আর্থিক
বন্ধনে পরিণত হয়। ব্যক্তির মূল্য, ব্যক্তিগত যোগ্যতা ইত্যাদির বিচার হয় বিনিময় মূল্যে। সমাজতান্ত্রিক সমাজে
মানুষ এই অমানবিক বাজারের সম্পর্ক থেকে মুক্তি পায় এবং সুস্থ মানবিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত হয়।
 সৃজনশীলতার স্ফূরণ: ধনতান্ত্রিক সমাজে শোষণ, দারিদ্র্য, বঞ্চনা ইত্যাদির ফলে মানুষের সর্বাঙ্গীন বিকাশের পথ
রুদ্ধ থাকে। পক্ষান্তরে সমাজতান্ত্রিক সমাজে প্রত্যেকে তার সামর্থ্য অনুযায়ী কাজ করার সুযোগ পায় বলে প্রত্যেকের
সৃজনক্ষমতার বিকাশ ঘটে, বিচ্ছিন্নতার অবসান ঘটে এবং ব্যক্তিত্বের পূর্ণতা ঘটে।
সমাজতন্ত্রবাদের বিপক্ষে যুক্তি
ব্যক্তিস্বাধীনতার বিরোধী: সমালোচকদের মতে সমাজতন্ত্রে ব্যক্তিস্বাধীনতা থাকে না। সমষ্টিগত কল্যাণের নামে
সমাজতন্ত্রের ব্যক্তি - জীবনের ওপর সর্বাঙ্গীন নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা হয়। লীকক (খবধপড়পশ) বলেছেন “টহফবৎ
ংড়পরধষরংস ভৎববফড়স রং মড়হব.”। তাই সমাজতন্ত্রেব্যক্তির স্বাভাবিক বিকাশ ব্যাহত হয়।
গণতন্ত্রবিরোধী: সমাজতন্ত্রেমানুষের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক স্বাধীনতা নানাভাবে সীমিত। এখানে একটিমাত্র দলের
প্রাধান্য ও কঠোর নিয়ন্ত্রণ থাকার ফলে স্বাধীনভাবে মত প্রকাশের সুযোগ থাকে না। তাছাড়া এখানে অর্থনীতি রাষ্ট্রীয়
নিয়ন্ত্রণ ও পরিকল্পনায় পরিচালিত হয় বলে উদ্যেগের স্বাধীনতা, বৃত্তি নির্বাচনের স্বাধীনতা ইত্যাদি থাকে না। তাই
সমাজতন্ত্রকে গণতন্ত্রের পরিপন্থি বলে মনে করা হয়।
উৎপাদন ব্যাহত হয়: ব্যক্তিগত মুনাফা বা লাভের সম্ভাবনাই ব্যক্তির কর্মোদ্যম ও উৎসাহ বাড়ায়। সম্পত্তির ওপর
ব্যক্তিগত মালিকানার অবসান ঘটিয়ে সমাজতন্ত্রসেই কর্মোদ্যমকেই ধ্বংস করে এবং তাতে উৎপাদন ব্যাহত হয়।
নতুন শ্রেণীর সৃষ্টি: সমাজতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় পুঁজিপতি শ্রেণীর অস্তিত্ব লোপ পেলেও, রাষ্ট্র পরিচালনার সঙ্গে জড়িত
বিশাল আমলা বাহিনী, রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ, পরিচালকবৃন্দের নিয়ে একটি নতুন সুবিধাভোগী শ্রেণীর উদ্ভব ঘটে। এই
নতুন শ্রেণীটি সামাজিক উদ্বৃত্তের একটা বড় অংশ ভোগ করে এবং ধীরে ধীরে সমাজতন্ত্রের সংকট ডেকে আনে। পূর্বতন
সোভিয়েত রাশিয়া এবং পূর্ব ইউরোপের সমাজতান্ত্রিক দেশগুলোতে এই ঘটনাই ঘটেছিল।
মার্কস সবকিছুর মধ্যে বস্তুর উপস্থিতিজনিত যে দ্ব›েদ্বর কথা বলেছেন তা’ সত্য নয়। মানুষ বুদ্ধি, বিবেক, জ্ঞান, প্রজ্ঞা
সম্পন্ন জীব। শুধুমাত্র বস্তুর প্রভাবে তার জীবন নিয়ন্ত্রিত হবে এমন ভাবা যায় না। তাহলে মানুষের শ্রেষ্ঠত্ব থাকে না।
ইতিহাসে এমন অনেক ঘটনারই সন্ধান পাওয়া যায় যেখানে মানুষের প্রতি মানুষের মমত্ব ও ভালবাসাই একজনকে
আরেকজনের জন্য নিজেকে উৎসর্গ করতে উদ্বুদ্ধ করেছে। বস্তু পাবার কথা কেউ ভাবে নি।
সমাজতন্ত্রহতে সাম্যবাদে উত্তরণ ঘটলে শ্রেণীভেদ থাকবে না, রাষ্ট্রের তিরোধান ঘটবে - এ কথা সত্য নয়। এ তত্তে¡
মানুষের প্রকৃতির মধ্যে বিদ্যমান লোভ, হিংসা, স্বেচ্ছাচার, স্বার্থপরতা ইত্যাদিকে অস্বীকার করা হয়েছে। রাষ্ট্র না থাকলে
কোন জাদু মন্ত্রবলে মানুষ সাধুসন্তহয়ে যাবে মার্কস তা’ বলেন নি। তার কথার সাথে সঙ্গতি রেখেই বলতে হয় যে, রাষ্ট্র
শুধু বুর্জোয়ার শোষণের যন্ত্রই নয় - বরং কল্যাণ রাষ্ট্র সর্ব সাধারণের রক্ষকও। ফলে এই রাষ্ট্র না থাকলে সর্বত্রই যে
নৈরাজ্য সৃষ্টি হবে তা’ বলার অপেক্ষা রাখেনা। এ কারণেই দীর্ঘ প্রায় সত্তর বছরেও সোভিয়েত ইউনিয়নে সমাজতন্ত্রহতে
সাম্যবাদে উত্তরণের যেমন কোন চিহ্ন দেখা যায়নি - তেমনি রাষ্ট্র বিলুপ্তির লক্ষণও দেখা যায় নি।
সারকথা
সমাজতন্ত্রের সবচেয়ে বড় সার্থকতা এখানেই যে, পুঁজিপতি বা ধনিকশ্রেণীর সম্পদে যে সকলেরই হিস্যা রয়েছে - এটা
যে পুঁজিপতি ইচ্ছামত ভোগ বিলাসে ব্যয় করতে পারে না, সমাজতান্ত্রিক মতবাদ এ কথাটা পৃথিবীর মানুষকে স্পষ্টভাবে
জানাতে পেরেছে। শুধু তাই নয় নতুন এক ধরনের সমাজ ব্যবস্থাও প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছে। এ রকম প্রথম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা
করছেন মার্কসবাদের অনুসারী ও নতুন আঙ্গিকে এর প্রতিষ্ঠাতা লেনিন। এই প্রতিষ্ঠার পর চীনসহ বিশ্বে অনেক দেশেই
সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র গড়ে উঠেছে। পুঁজিবাদী বিশ্বনতুন করে মানুষের কথা, সমাজের কল্যাণের কথা ভাবতে শিখেছে এই
মতবাদের বিকাশের ফলেই। এর পরিণতিতে সৃষ্টি হয়েছে কল্যাণ রাষ্ট্রের ধারণা। অনেক দূর্বলতা সত্তে¡ও সমাজতন্ত্রের
বড় সার্থকতা এখানেই।
পাঠোত্তর মূল্যায়ন
বহু নির্বাচনী প্রশ্ন
সঠিক উত্তর লিখুন।
১. সমাজতন্ত্রঅনুযায়ী সবকিছুর নিয়ন্ত্রক কে হবে ?
ক. ব্যক্তি;
খ. গোষ্ঠী;
গ. সমাজ;
ঘ. সম্প্রদায়;
ঙ. রাষ্ট্র।
২. মার্কস - এর মতে জগতে একমাত্র সত্ত¡া কোনটি ?
ক. সুখ;
খ. মানুষ;
গ. অর্থ;
ঘ. বস্তু।
সঠিক উত্তর : ১.ঙ ২.ঘ।
রচনামূলক প্রশ্ন
১. সমাজতন্ত্রের মূল বক্তব্য ও পূর্ব ইতিহাসের বর্ণনা দিন।
২. মার্কস উদ্বৃত্ত মূল্য সম্বন্ধে যে বক্তব্য রেখেছেন তা’ আলোচনা করুন।
৩. ইতিহাসের বস্তুুবাদী ব্যাখ্যা, শ্রেণী সংগ্রাম, সম্পর্কে মার্কস কি বলেছেন-তা আলোচনা করুন।
৪. সমাজতন্ত্রের পক্ষে ও বিপক্ষে কি কি যুক্তি রয়েছে ? আলোচনা করুন।

FOR MORE CLICK HERE
এইচএসসি বাংলা নোট ১ম পত্র ও ২য় পত্র
ENGLISH 1ST & SECOND PAPER
এইচএসসি আইসিটি নোট
এইচএসসি অর্থনীতি নোট ১ম পত্র ও ২য় পত্র
এইচএসসি পৌরনীতি ও সুশাসন ১ম পত্র
এইচএসসি পৌরনীতি নোট ২য় পত্র
এইচএসসি সমাজকর্ম নোট ১ম পত্র
এইচএসসি সমাজকর্ম নোট ২য় পত্র
এইচএসসি সমাজবিজ্ঞান নোট ১ম পত্র ও ২য় পত্র
এইচএসসি ইতিহাস নোট ১ম পত্র
এইচএসসি ইতিহাস নোট ২য় পত্র
এইচএসসি ইসলামের ইতি. ও সংস্কৃতি নোট ১ম পত্র
এইচএসসি ইসলামের ইতি. ও সংস্কৃতি নোট ২য় পত্র
এইচএসসি যুক্তিবিদ্যা ১ম পত্র ও ২য় পত্র
এইচএসসি ভূগোল ও পরিবেশ নোট ১ম পত্র ও ২য় পত্র
এইচএসসি ইসলামিক স্টাডিজ ১ম ও ২য় পত্র

Copyright © Quality Can Do Soft.
Designed and developed by Sohel Rana, Assistant Professor, Kumudini Government College, Tangail. Email: [email protected]