তামাক ও তার প্রতিক্রিয়া ধূমপান স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর কেন

তামাক ও তার প্রতিক্রিয়া ডা. গোলাম মুয়ায্যাম
তামাক বলতে নিকোটিয়ানা টোবেকাম (Nicotiana tebacum) নামক গাছের পাতা বোঝায়। তামাক পাতা শুকনা অবস্থায় সাদা অথবা জরদা হিসেবে ব্যবহৃত হয় কিংবা ধূমপানের জন্য ব্যবহৃত হয় আর এর গুঁড়ো ব্যবহৃত হয় নস্যি হিসেবে।
ধূমপানের অভ্যাস সম্ভবত ১০০ খৃস্টাব্দে পশ্চিম গোলার্ধে প্রথম শুরু হয়। যে সমস্ত ক্ষতিকর জিনিস নতুন পৃথিবী (New World) থেকে পুরাতন পৃথিবীতে (Old World) আমদানী করা হয়েছে তার মধ্যে যৌন রোগ, সিফিলিস এবং সর্বশেষটি হলো AIDS (Acquired Immune Deficieny Syndrome) নামক এক মারাত্মক যৌনরোগ, যা সমকামীদের মধ্যে বেশি ব্যাপক
১৪৯২ সালের দিকে ইউরোপীয়রা কলম্বাসের আমেরিকা আবিষ্কারের পর কিউবাবাসীদের নিকট (Carib Indians) ধূমপান করার অভ্যাস শিক্ষা করে সেখানকার আদিবাসীরা ধর্মীয় আচারের অংশ হিসেবে ধূমপান করতো। ওরা এ জন্য যে ধরনের যন্ত্রের সাহায্যে ধূমপান করতো তার নাম ছিল টোবাগ্যো বা টোবাকা যাকে ' স্পেনীয়রা টাকো (Tobacco) বলতো। সেই থেকে তামাক গাছ ও তার পাতা উভয়ই টোবাকো বা তামাক বলে পরিচিত হয়ে আসছে।
১৫৩৫ সালে স্পেনীয়রা প্রথমে ওয়েস্ট ইণ্ডিজে এবং পরে মূল স্পেনে তামাক চাষ শুরু করে। ইউরোপে প্রথম দিকে এই তামাক পুলটিস (Poultice বা খলম) ও নস্যিরূপে রোগের ওষুধ হিসেবে ব্যবহৃত হয় । শীঘ্রই ফ্রান্সের রাণী ক্যাথেরীন (Catherine de Medicis )-এর দরবারে নস্যির ব্যবহার ফ্যাশনে পরিণত হয়। রাণী নিজেও ১৪৬১ সালে পর্তুগালে নিযুক্ত ফরাসী রাষ্ট্রদূত জিন নিকোট (Jean Nicot)-এর পরামর্শ মতে ওষুধ হিসেবে নস্যি ব্যবহার করতে শুরু করেন। সর্দিতে নাক বন্ধ হলে নস্যি নাক দিয়ে শ্বাস নেয়া সহজ করে দেয় বলে আজও বহুলোক নস্যি ব্যবহার করে থাকেন। এই রাষ্ট্রদূতের সম্মানে পরবর্তীকালে তামাক গাছের বোটানিক্যাল (Scientific) নাম দেয়া হয় নিকোটিয়ানা (Nicotiana)। অল্পদিনের মধ্যেই ডাচ, পর্তুগীজ ও ইংরেজগণ আমেরিকার ভার্জিনিয়া এলাকায় তামাক চাষ শুরু করে।
আজও এখনকার তামাক বিশ্বের সেরা বলে বিবেচিত। এসব দেশের মাধ্যমেই অষ্টাদশ শতাব্দীতে ভারতীয় উপমহাদেশে এই ক্ষতিকর গাছের চাষ শুরু হয়। বর্তমানে বাংলাদেশ একটি তামাক রপ্তানিকারক দেশ। সারা বিশ্বে ধূমপানের অভ্যাস ব্যাপক ভাবে ছড়িয়ে পড়েছে। ষষ্ঠদশ শতাব্দীতে স্যার জন হকিনস্ ও স্যার ওয়ালটার রেলের (Raleigh) মাধ্যমে বৃটিশ দ্বীপ পুঞ্জের ইংল্যাণ্ড ও স্কটল্যাণ্ডে তামাক চাষ শুরু হয় এবং যুক্তরাজ্যে ধূমপানের অভ্যাস জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। ধূমপান জনপ্রিয়তা অর্জন সত্ত্বেও বহু শাসক ও সমাজপতি ধূমপানকে না- পছন্দ ও ঘৃণা করতেন। পোপ তামাককে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন, তুরস্ক ও রাশিয়ায় ধূমপান শাস্তিযোগ্য অপরাধ বলে ঘোষিত হয়। ইংল্যান্ডের রাজা প্রথম জেম্স্ তামাকের বিরুদ্ধে ফরমান জারি করতে বাধ্য হন (Counterblast to Tobacco)। যাতে তিনি ধূমপানকে চক্ষুর জন্য একটি বিরক্তিকর বদঅভ্যাস, নাকের জন্য ঘৃণ্য, মস্তিষ্কের জন্য ক্ষতিকর এবং ফুসফুসের জন্য বিপদজনক বলে ঘোষণা করেছেন।
ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষভাগে ধূমপানের বিরুদ্ধে সর্বশেষ রাজকীয় ফরমান জারি হয় আবিসিনিয়াতে। নেশাকর ও অপব্যয় বলে ইসলামী ফকীহগণ ধূমপানকে বর্জনীয় মনে করেন এবং কারো কারো মতে ধূমপান হারাম না হলেও হারামের কাছাকাছি (মাকরূহ তারিমা)। আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের নবীন মুসলিম দল জামা'আতুল ইসলাম ধূমপানকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে। বর্তমান বিশ্বজোড়া ধূমপানবিরোধী আন্দোলন সকল উম্মা ও পাশ্চাত্য দেশসমূহে জোরদার হয়ে উঠেছে।
তামাকের রাসায়নিক উপাদান
তামাক পাতায় ১২-২০% পরিমাণ Ash রয়েছে, তামাক গাছ উৎপন্নের জমিতে কতটুকু খনিজ পদার্থ রয়েছে তার উপর নির্ভরশীল। তামাক সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান নিকোটিনের (Nicotine) পরিমাণও বিভিন্ন। হাভানা তামাকের শুষ্ক পাতায় নিকোটিনের পরিমাণ ১৫-৩.০%, ভার্জিনিয়া তামাকে ৬-৮% এবং কোন কোন আলজেরীয় তামাকে এর পরিমাণ আরও বেশি।
তামাকের ব্যবহার
১. ধূমপানের জন্যই তামাক পাতা সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হয়। ধূমপানের জন্য বিড়ি, সিগারেট, চুরুট, পাইপ ও বিভিন্ন প্রকারে হুক্কা ব্যবহৃত হয়। প্রতি সিগারেট থেকে ০.৯২ মিলিগ্রাম নিকোটিন ধূমপানকারীর মুখে প্রবেশ করে থাকে ।
এই নিকোটিনের পরিমাণ প্রতিটি চুরুট (Cigar) থেকে ৩.৬ মি.গ্রা. এবং প্রতি গ্রাম পাইপ তামাক (Pipe tobacco ) থেকে ২.৭ মি.গ্রা. ধূমপানকারীর মুখগহ্বরে প্রবেশ করে। আমাদের দেশের বিড়ি ও হুক্কার মাধ্যমে কত নিকোটিন মুখে প্রবেশ করে সে হিসেব বের করা প্রয়োজন। হুক্কাজাতীয় ধূমপানযন্ত্রে পানি থাকে এবং ধূম সেই পানিতে ধুয়ে মুখে যায় বলে নিকোটিনের পরিমাণ কম হতে পারে, এ বিষয়ে গবেষণার প্রয়োজন। আমাদের দেশের নবাব-জমিদারদের দামী ফুরসী যা গ্রামের নারিকেল খোলের তৈরি হুক্কার উন্নত সংস্করণ। এতে তামাকের সঙ্গে নানারূপ খুশবুদার দ্রব্য ব্যবহৃত হতো। এসব লম্বা লাইপের ফুরসী হুক্কা আজও আরব দেশ ও উপহমাদেশের কোন কোন অঞ্চলে চালু আছে।
ধূমপানের সময় কতটুকু নিকোটিন ফুসফুসে প্রবেশ করে তা নির্ভর করে কতটুকু ধূম শ্বাসের সঙ্গে ভিতরে প্রবেশ করছে। ফুসফুসের ভিতর প্রবেশ করা ধূম থেকে নিকোটিন alveoli কর্তৃক শুষে নেয়। ২. ধূমপান ব্যতীত শুকনো তামাক পাতা পানের সঙ্গে মিশিয়ে (জর্দা) খাওয়ার রেওয়াজ উপমহাদেশের সর্বত্রই চালু রয়েছে। জর্দার সঙ্গে নানারূপ সুগন্ধী মিশিয়ে একে লোভনীয় করা হয় । এই উপমহাদেশের উলামাদের মধ্যে এই জর্দাপ্রীতি বেশ উল্লেখযোগ্য ।
দাঁতের মাড়ির ব্যথা দূর করার জন্য খৈনির ব্যবহার ভারতের উত্তরাঞ্চলে খুব ব্যাপক। চুন ও তামাকের গুঁড়ো হাতের তালুতে পিষে তা মাড়ির কাছে রেখে দেয়া হয়। বাংলাদেশে এর প্রচলন খুব কম । ৩. ষষ্ঠদশ শতাব্দীতে ফ্রান্স রাজদরবারে প্রথম প্রচলিত নস্যির ব্যবহার আজও বিশ্বের সর্বত্র কম-বেশি চালু রয়েছে। তামাক পাতার গুঁড়ো হাতের চিমটার সাহায্যে নাকে ঢুকানোকেই নস্যি নেয়া বলা হয়। বাংলাদেশে এর ব্যবহার খুব ব্যাপক নয় ।
তামাকের গুণাগুণ ও প্রতিক্রিয়া
একটিমাত্র সিগারেটের সামান্য নিকোটিন মানসিক ও শারীরিক শক্তির উপর উত্তেজক হিসেবে কাজ করে। কিন্তু অধিক পরিমাণে নিকোটিন হতোদ্যম (depres sion) সৃষ্টি ও মাদকদ্রব্য হিসেবে কাজ করে। ধূমপানে আসক্তদের মধ্যে নিকোটিন তাদের স্নায়ুর উত্তেজনা হ্রাস ও শান্ত করতে সাহায্য করে। এতে তাদের হৃৎপিণ্ড বা অন্যান্য অঙ্গের কর্মক্ষমতার কোন হ্রাস হয় না। স্নায়ুর উত্তেজনা হ্রাস করার জন্য ধূমপানের শ্রেষ্ঠ সময় হলো আহারের পর এবং সারাদিনের কাজ থেকে অবসর নেয়ার পর। ধূমপান যে কোন মাদকদ্রব্যের মত নেশাকর বা অভ্যাস সৃষ্টিকারী, তাই সামান্য ধূমপানে সীমিত রাখা অনেকের জন্যই সম্ভব হয় না এবং অনেকেই এই বদ-অভ্যাসের শিকার হয়ে পড়ে। সুতরাং পরিমিত ধূমপানের সামান্য উপকারের জন্য শেষ পর্যন্ত এতে আসক্ত হয়ে পড়ার ঝুঁকি নেয়া বুদ্ধিমানের কাজ নয়। ধূমপানে আসক্তদের নিয়ত নিকোটিন সেবনের ফলে তাদের মধ্যে অবসাদ সৃষ্টি করতে পারে এবং এতে স্নায়ু, হৃৎপিণ্ড ও পরিপাক যন্ত্রকে উত্তেজিত (Irritable) করতে পারে। যারা বদ্ধ ঘরে ধূমপান করে তাদের তুলনায় খোলা জায়গায় ধূমপানকারীদের মধ্যে ক্ষতির পরিমাণ কম। তাই ঘরের ভিতর, রেল-স্টিমার, গাড়ী, উড়োজাহাজ প্রভৃতি যে সব স্থানে বহু লোক একসঙ্গে থাকে সে সব স্থানে ধূমপান বেশি ক্ষতিকর।
১. নতুন ধূমপায়ীদের মধ্যে সাময়িক বমি বমি ভাব, হতোদ্যম, মাথাঘোরা এবং বমিও হতে পারে। নিত্য ধূমপায়ীদের মধ্যে এইসব প্রভাব দেখা যায় না।
২. অতিরিক্ত ধূমপান (So-called chain smoking) নাড়ীর গতি বৃদ্ধি বা (Palitation) সৃষ্টি করতে পারে। এছাড়া এতে হৃদপিণ্ডের সংকোচন অনিয়মিত হয়, এমনকি হঠাৎ অজ্ঞান হয়ে যাওয়াও সম্ভব।' এ সমস্ত লক্ষণগুলোকে একত্রে Tobacco heart Syndrome বলা হয়। ৩. অতিরিক্ত ধূমপানের ফলে সামান্য পরিশ্রমে কাহিল হয়ে যাওয়া, বদহজম, দৃষ্টিশক্তি হ্রাস এবং রঙ প্রত্যক্ষ করার শক্তি (Colour perception) নষ্ট হতে পারে । বিশেষ করে লাল ও সবুজ রং পার্থক্য করা কঠিন হয়। এর ফলে গাড়ী চালান কঠিন হবে। কারণ রাস্তার মোড়ের লাল সবুজ বাতির পার্থক্য বোঝা গাড়ী চালকের জন্য একান্ত প্রয়োজন ।
৪. অতিরিক্ত ধূমপানের সঙ্গে ফুসফুসের ক্যান্সার রোগের ঘনিষ্ঠ যোগাযোগের যথেষ্ট প্রমাণ রয়েছে। গবেষকদের মতে প্রতিদিন ২৫টি বা ততোধিক সিগারেট পান করলে ফুসফুসের ক্যান্সার হওয়ার যথেষ্ট সম্ভাবনা থাকে।
৫. দীর্ঘস্থায়ী ব্রঙ্কাইটিস ফুসফুসের মধ্যস্থ শ্বাস নালীর প্রদাহ, ক্ষুদ্র অন্ত্রের ঘা এবং করোনারী হৃদরোগের সঙ্গে অতিরিক্ত ধূমপানের সরাসরি যোগাযোগ রয়েছে বলে যথেষ্ট প্রমাণ পাওয়া যায় ।
৬. ধূমপানের ফলে খুসখুসে কাশ এবং গলায় প্রদাহ হয়ে থাকে যা ধূমপান বন্ধ করলে নিরাময় হয়।
৭. নিকোটিন পেটের সন্তানের শারীরিক গঠনের বিকৃতি ঘটাতে পারে। তাই গর্ভাবস্থায় ধূমপান করা নিষিদ্ধ।
৮. তামাক ও সিগারেট কারখানায় হঠাৎ করে প্রচুর তামাকের গুঁড়ো ফুসফুসে প্রবেশ করলে বা ভুলে নিকোটিনজাত পোকা মারার ওষুধ খেয়ে ফেললে তীব্র নিকোটিন বিষক্রিয়া হতে পারে। শিশুরা তামাক গিলে খেলেও এরূপ হতে পারে। নিকোটিন একটি মারাত্মক বিষ এবং এর মৃত্যু-পরিমাণ হলো ৪০ মিলিগ্রাম আর তামাকের মারাত্মক পরিমাণ হলো ২ গ্রাম। এ ধরনের বিষক্রিয়ায় সাধারণত নতুন ধূমপায়ীদের লক্ষণগুলোই দেখা যায়। তবে নিকোটিনের পরিমাণ খুব বেশি হলে রোগী অজ্ঞান ও মৃত্যুবরণ করতে পারে। এ অবস্থার সফল চিকিৎসা হলো রোগীকে char - coal খাওয়ানো এবং রাবার টিউবের সাহায্যে পটাশিয়াম পারমাঙ্গানেট (Im5000) দিয়ে পাকস্থলির ভিতর পরিষ্কার করা। এ ছাড়া শ্বাসকষ্ট হলে কৃত্রিম শ্বাস প্রক্রিয়ারও প্রয়োজন হতে পারে।

FOR MORE CLICK HERE
NTRCA COLLEGE LEVEL HISTORY/ইতিহাস গাইড/ বেসরকারি শিক্ষক নিবন্ধন ইতিহাস
১০ তম বিসিএস -৪৪তম বিসিএস এর প্রশ্ন ও সমাধান 10th BCS to 44th Bcs MCQ Question Solution
বিসিএস ব্যাংক প্রাইমারি পরীক্ষার-এর প্রশ্ন ও সমাধান
সার্চ ইঞ্জিন অপটিমাইজেশন SEO বই লেখক : মোঃ মিজানুর রহমান
মাতৃস্বাস্থ্য/Motherhood
ওষুধ নির্দেশিকা
সহীহ বুখারী শরীফ হাদিস আরবি বাংলা (৭৫৬৩ টি হাদিস)
সহীহ মুসলিম শরীফ হাদিস আরবি বাংলা (৭৪৫৩ টি হাদিস)
সুনানে তিরমিজি শরীফ হাদিস আরবি বাংলা (৩৯৫৬ টি হাদিস)
সুনানে নাসায়ী শরীফ হাদিস আরবি বাংলা (৫৭৫৮ টি হাদিস)
সুনানে ইবনে মাজাহ শরীফ হাদিস আরবি বাংলা (৪৩৪১ টি হাদিস)
সুনানে আবু দাউদ শরীফ হাদিস আরবি বাংলা (৫২৭৪ টি হাদিস)

Copyright © Quality Can Do Soft.
Designed and developed by Sohel Rana, Assistant Professor, Kumudini Government College, Tangail. Email: [email protected]