প্রতিকারমূলক চিকিৎসায় ইসলামী অনুশাসন ইসলামে মানসিক রোগ

প্রতিকারমূলক চিকিৎসায় ইসলামী অনুশাসন
ডা. কে. এম. আবদুল আজিজ
রাসূলুল্লাহ (সা) প্রতিরোধমূলক চিকিৎসা ব্যবস্থা বাতলে দিয়েই ক্ষান্ত হননি, তিনি দুনিয়ার মানুষের জন্য প্রতিকারমূলক চিকিৎসারও গোড়াপত্তন করে গেছেন দেড় হাজার বছর পূর্বে। যেগুলি নবীর অনুসারীরা সুন্নত হিসেবে পালন করছে এবং তাদের দেখাদেখি অন্য মানুষেরাও সেগুলি অনুশীলন করে উপকার পাচ্ছেন। নিম্নে এর সামান্য কয়টি উদাহরণ পেশ করা হল।
চিকিৎসায় নবী করীম (সা)-এর সুন্নত
(ক) হাফেয ইবনে কাইয়্যিম (র) তাঁর প্রসিদ্ধ গ্রন্থ যাদুল মাআদে হযরত বিলাল * ইবনে সাইয়্যাফ (রা) থেকে বর্ণনা করেন, “একদা নবী করীম (সা) এক রুগ্ন ব্যক্তিকে দেখার জন্য রোগীর বাড়িতে তাশরীফ নিয়ে গেলে তিনি রোগীর নিকট উপস্থিত ব্যক্তিদের বললেন—ডাক্তার ডেকে আনো। এ কথা শুনে উপস্থিত লোকদের একজন বললেন, হে আল্লাহ্র রাসূল, আপনিও এরূপ বলছেন ? হুযুর (সা) বললেন, হ্যাঁ, মহান আল্লাহ্ রাব্বুল আলামীন এমন কোনও রোগ সৃষ্টি করেন নাই যার ঔষধ পাঠান নাই।” রোগ হলে ডাক্তারের কাছ থেকে ব্যবস্থা নেওয়া, ঔষধ ব্যবহার করা আল্লাহ্র উপর তাওয়াক্কুলের পরিপন্থী নয় বরং সুন্নত। রোগমুক্তি ঔষধের নিজস্ব গুণ বা বৈশিষ্ট্য নয় বরং আল্লাহ্ প্রদত্ত বৈশিষ্ট্য যা তার মর্জিয়তের উপর কাজ ক'রে রোগমুক্তি ঘটায়। অন্যথায় ঔষধের কাজ তো দূরের কথা, ডাক্তারের ঔষধ নির্বাচনেরই ক্ষমতা থাকে না। এ প্রসঙ্গে একজন বুজুর্গ লোকের উক্তি স্মরণ করা যায়, “যখন মানুষের মৃত্যু ঘনিয়ে আসে তখন অভিজ্ঞ ডাক্তার পর্যন্ত বোকা হয়ে যায়।”
(খ) রোগীর মনকে আশ্বস্ত করা (Assurance) : আধুনিক চিকিৎসার একটি অঙ্গ হল রোগীকে মানসিকভাবে স্থিতিশীল করা। সেটা করতে হবে কিভাবে, তাও নবীর জীবন থেকে আমরা জানতে পারি । এ কাজে রোগীর প্রতি আচরণ, রোগী দেখার বিশেষ পদ্ধতি, রোগীর কাছে অবস্থান, রোগীকে সান্ত্বনা দান ইত্যাদি।
রোগীর প্রতি আচরণ : রাসূল (সা) হযরত আবূ সায়্যিদ খুদরী (রা)-কে উদ্দেশ্য করে বললেন, “তুমি যখন কোন রুগ্ন ব্যক্তির কাছে যাবে তখন তাঁর দীর্ঘ জীবন (হায়াত) সম্পর্কে আশাবাদ ব্যক্ত করবে। এটা অবশ্য তকদীরকে রদ করতে পারবে না। তবে এতে রোগীর মন অবশ্যই খুশি হবে” (ইবনে মাজাহ)। হুযূর (সা)-এর অভ্যাস ছিল তিনি যখন কোন রোগী দেখতে যেতেন তখন তাকে বলতেন : “চিন্তার কোন কারণ নেই, ইনশাআল্লাহ্ সুস্থ হয়ে যাবে।” (বুখারী শরীফ) অন্যত্র হুযুর (সা) বলেন, “তোমরা যখন কোন রুগ্ন ব্যক্তির নিকট যাবে তখন তাঁর সাথে ভাল ভাল কথা বলবে। ”
রোগী দেখার পদ্ধতি ঃ হযরত আবূ উমামা (রা) বর্ণনা করেন যে, “রোগী দেখার উত্তম নিয়ম হল এই যে তুমি রোগীর কপাল বা তাঁর হাতে হাত রাখবে এবং তাকে জিজ্ঞাসা করবে, আপনি কেমন আছেন ?” (তিরমিযী শরীফ) অনুরূপ হযরত ইবনুছ (র) বর্ণিত একটি রেওয়ায়েতে বলেন, “রোগী দেখার নিয়ম হল যে, তুমি রোগীর শরীরে তোমার হাত রাখবে এবং জিজ্ঞাসা করবে, আপনার সকালটা কেমন কাটল? আপনার সন্ধ্যা কেমন কাটল ? (অর্থাৎ আপনি সকালে কেমন ছিলেন এবং সন্ধ্যায় কেমন ছিলেন)” উপরোক্ত দু'টি হাদীস থেকে বোঝা যায় রাসূল (সা) চাইতেন চিকিৎসকরা পরিচিতি পর্বেই রোগীর প্রতি তাঁর দরদী ও সমব্যথী হয়ে রোগীকে উৎফুল্ল এবং রোগ-ব্যাধি হালকা করার ব্যাপারে মনোযোগী হবেন। এ ছাড়াও সহমর্মিতার জন্য হাত বাড়ানো। মাথায় হাতে হাত রাখার মাধ্যমে রোগীর শরীরের তাপমাত্রার খবর নিয়ে তা ডাক্তার সাহেবকে প্রদান করবে।
স্বল্প সময়ে রোগী দেখা ঃ হযরত সায়ীদ ইবনুল মুসাইয়িব (র) বর্ণিত হাদীসে নবী করীম (সা) বলেন, “সওয়াব ও প্রতিদানের দিক থেকে সর্বোত্তম রোগী দেখা হলো রোগীর নিকট স্বল্প সময় অবস্থান করা।” (ফতহুল কবীর) হযরত আনাস (রা) হতে বর্ণিত, রাসূল (সা) বলেন, “কোন রুগ্ন ব্যক্তিকে দেখতে গিয়ে তাঁর কাছে দীর্ঘক্ষণ অবস্থান করবে না। রোগীর নিকট দর্শনার্থীর দীর্ঘ সময় অবস্থান করা অপছন্দনীয় কাজ। বাস্তবে দেখা দর্শনার্থীরা অধিক সময় অবস্থান করলে রোগীর পরিজন ও চিকিৎসা কর্মে সহায়ক ব্যক্তিবর্গের অসুবিধা হয়। এ ছাড়াও দর্শনার্থীদের দ্বারা সংক্রামক ব্যাধি ইতিমধ্যেই অসুস্থ মানুষটিকে আরও একটি রোগে (Super infection) জড়িয়ে ফেলতে পারে। তাছাড়া দর্শনার্থীর অসাবধান কথাবার্তায় রোগী যে কোনওভাবে আঘাত পেতে পারে বা সামাজিক হীনমন্যতায় ভুগতে পারে এবং এ মনোপীড়া তার রোগ বৃদ্ধি করতে পারে এবং কষ্ট দীর্ঘায়িত করতে পারে।
রোগীকে সান্ত্বনা : হযরত মুয়ায ইবনে জাবাল (রা) প্রাণপ্রিয় পুত্রের ইনতিকালের পর রাসূল (সা) সমবেদনা জানিয়ে তাকে সান্ত্বনাপত্র দেন। পত্রটি হুবহু উদ্ধৃত করা হল : “আল্লাহ্র নামে শুরু করছি, যিনি অত্যন্ত দয়াশীল এবং বড়ই মেহেরবান। আল্লাহ্র রাসূল মুহাম্মদ মোস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া- সাল্লাম-এর পক্ষ হতে মুয়ায ইবনে জাবাল (রা)-এর প্রতি। তোমার উপর শান্তি বর্ষিত হোক। “আমি আল্লাহ্ প্রশংসা করছি যিনি ব্যতীত কোনও মাবুদ নাই । আল্লাহ্ তোমাকে বড় প্রতিদান (পুরস্কার) দান করুন এবং ধৈর্য ধরার তাওফীক দান করুন। আমাদেরকে এবং তোমাকে শুকরিয়া আদায় করনেওয়ালা করুন। নিশ্চয়ই আমাদের জীবন, আমাদের সম্পদ এবং আমাদের সন্তান-সন্ততি মহান আল্লাহ্র উত্তম দান এবং ধার গ্রহণ করা আমানতস্বরূপ। যার থেকে আমরা একটা নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত ফায়দা লুটছি এবং তিনি নির্ধারিত সময়ে আবার তা কাজা করে নিচ্ছেন। তাই আমাদের উপর তাঁর দানের শুকরিয়া আদায় করা ওয়াজিব এবং তিনি যখন আমাদের পরীক্ষায় ফেলেন তখনও ধৈর্য ধারণ করা ওয়াজিব। তোমার পুত্র মহান আল্লাহ্ দান এবং তোমার নিকট ধার দেওয়া আমানত ছিল । আল্লাহ্ তাকে তোমার জন্য লোভনীয় এবং সুখ ও উল্লাসের কারণ বানিয়েছিলেন। তিনিই তাকে তোমার থেকে এক বড় প্রতিদানের বদলে নিয়ে নিয়েছেন। এখন তুমি যদি ধৈর্য ধর তবে রহমত, বরকত ও হেদায়েত লাভ করবে। তোমার অধৈর্য যেন তোমার প্রতিদানকে নষ্ট করে তোমাকে লজ্জিত না করে।
“আর খুব স্মরণ রেখ, অধৈর্যের মাধ্যমে কিছুই অর্জিত হয় না এবং আগত পেরেশানীও তাতে দূর হয় না। ধৈর্য ধারণ কর। কারণ আল্লাহ তা'আলা নিশ্চয়ই নেককার লোকদের প্রতিদান নষ্ট করেন না।” (বুখারী শরীফ ও আবৃ দাউদ শরীফ)
সংক্রামক ব্যাধি থেকে নিজেকে দূরে রাখা ঃ “নিজে কোনও সংক্রামক ব্যাধিতে সংক্রমিত হয়ে গেলে অন্যকে সংক্রমিত করে তোলে। তাতে জাতি ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে যায় কিন্তু তাতে তোমার কোন উপকার হবে না বরং অন্যকে ক্ষতি করার অনধিকার চর্চা করার অন্যায় হবে। প্লেগ এক প্রকার নিকৃষ্ট কষ্টদায়ক রোগ, যা আবার বনি ইসরাঈল অথবা তোমাদের পূর্ববর্তী কোন সম্প্রদায়ের উপর পাঠানো হয়েছিল। যখন জানতে পারবে যে অমুক জায়গায় প্লেগ রোগ ছড়িয়ে যাচ্ছে তবে সেখানে যাবে না। আর তোমরা যেখানে আছ সেখানে যদি প্লেগ রোগ আসে তবে ঐ স্থান থেকে পলায়ন করা যাবে না।” (বুখারী ও মুসলিম)
, চিকিৎসাকার্যে নিয়োজিত ব্যক্তির যোগ্যতা সংরক্ষণের উপর গুরুত্বারোপ ঃ নবী মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ্ (সা) বলেন, “যদি এমন কোনও ব্যক্তি চিকিৎসা করে যার চিকিৎসা বিষয়ে কোনও পূর্ব অভিজ্ঞতা নেই, এমতাবস্থায় (যদি রোগীর কোনও ক্ষতি হয়) রোগীর সমস্ত দায়-দায়িত্ব উক্ত চিকিৎসকের উপর বর্তাবে।” (আবূ দাউদ, নাসায়ী ইবনে মাজাহ, দারে কুতনী, মুসতাদরাক) এ হাদীস থেকে বোঝা যায়, নবী (সা) পরোক্ষভাবে চিকিৎসাকে পেশা হিসাবে এবং পেশাদার ঊর্ধ্বতন পেশাদার দ্বারা প্রশিক্ষিত হবেন এবং পেশার মান নির্ধারিত রাখা হবে ।
ঔষধের গুণাগুণ সম্পর্কিত গুরুত্বারোপ ঃ হযরত আবূ দারদা (রা) থেকে বর্ণিত, নবী করীম (সা) ইরশাদ করেছেন, “নিশ্চয়ই আল্লাহ্ তা'আলা রোগ ও দাওয়া (ঔষধ) দুটিই পাঠিয়েছেন। প্রতিটি রোগেরই ঔষধ প্রেরণ করেছেন। সুতরাং তোমরা চিকিৎসা গ্রহণ কর। তবে হারাম বস্তু দিয়ে চিকিৎসা করো না।” (মিশকাত, সুনানে আবূ দাউদ) হযরত আব্দুল্লাহ্ ইবনে মাসউদ (রা) হতে বর্ণিত অন্য এক হাদীসে রাসূল (সা) ইরশাদ করেন, “নিশ্চয়ই আল্লাহ তা'আলা ঐ জিনিসের মধ্যেও তোমাদের আরোগ্য রাখেন নাই যা তোমাদের উপর হারাম করা হয়েছে।” (যাদুল মাআদ, মুসতাদরাক)
ঔষধ হিসাবে মদ ও অন্যান্য নাপাক দ্রব্য নিষিদ্ধ : হযরত উম্মে সায়মা (রা) হতে বর্ণিত, নবী করীম (সা) নেশাযুক্ত এবং মস্তিষ্ক বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারী কোনও কিছু ব্যবহার করা থেকে নিষেধ করেছেন। (আবূ দাউদ, মিশকাত) অন্য এক হাদীস যা তারেক ইবনে সুরাইদ (রা) বর্ণনা করেন যে, “নবী করীম (সা)-এর কাছে শরাব (মদ) সম্পর্কে প্রশ্ন করলে হুযুর তা ব্যবহার করতে নিষেধ করেছেন। তিনি বললেন, আমি তো এটা ঔষধ হিসাবে তৈরি করেছি। নবী করীম (সা) বললেন, “শরাব ঔষধ নয় বরং এটা নিজেই রোগের কারণ।” (মুসলিম, মিশকাতুল মাসাবীহ)
নবী করীম (সা) ঔষধ হিসাবে মদ ব্যবহার করতে শুধু নিষেধই করেন নাই বরং এ কথাও বলেছেন, “যে ব্যক্তি শরাবের মাধ্যমে চিকিৎসা গ্রহণ করে আল্লাহতা'আলা তাকে আরোগ্য না করুন।” (ইবনে মাজাহ, যাদুল মা'আদ ) হযরত যাবের (রা) বর্ণিত আরও এক হাদীসে নবী করীম (সা) বলেন, “যার অধিক পরিমাণে নেশা আনে তার অল্প পরিমাণও হারাম। হযরত আবূ হুরায়রা (রা) বর্ণনা করেন, “নবী করীম (সা) খবীশ বা নাপাক ঔষধ ব্যবহার করতে নিষেধ করেছেন।” ঐ সকল জিনিস যা বাজে, ক্ষতিকর এবং নষ্ট হওয়ার কারণে খারাপ করেছেন।” ঐ সকল জিনিস যা বাজে, ক্ষতিকর এবং নষ্ট হওয়ার কারণে খারাপ মনে হয় এবং ঐ সকল জিনিস বা অকেজো, যেমন মদ মিথ্যা এবং অপছন্দনীয় কার্যকলাপও খবীশের অন্তর্ভুক্ত।
উপরোক্ত আলোচনায় এটা প্রতীয়মান হয়েছে মদ নিজেই রোগের কারণ। দেড় হাজার বছর পূর্বে রসূল (সা)-এর সেই তত্ত্ব ভেষজবিদরা গ্রহণ করেছেন এবং যেসব ঔষধ আসক্তি হয় সেগুলি বাতিল হয়েছে, হচ্ছে এবং বাকিটা অদূর ভবিষ্যতে বাতিল হবে বলে ঈমানদার ডাক্তাররা বিশ্বাস করেন। শিংগা লাগান ও তার স্থানসমূহ : (ক) হযরত সামুরা (রা) হতে বর্ণিত, নবী করীম (সা) ইরশাদ করেছেন, “তোমাদের চিকিৎসাসমূহের মধ্যে সর্বোত্তম চিকিৎসা হ'ল শিংগা লাগান”। (মুসতাদরাক) (খ) নবী করীম (সা) জিব্রাঈল (আ)-কে এ সংবাদ দিয়েছেন, “মানুষ যে সমস্ত জিনিস দ্বারা চিকিৎসা করে তন্মধ্যে উত্তম চিকিৎসা হচ্ছে শিংগা লাগান”। (মুসতাদরাক) শিংগা লাগানোর স্থানসমূহ :
(১) হযরত আনাস (রা) থেকে বর্ণিত, নবী করীম (সা) উভয় কাঁধ এবং কাঁধের মাঝে (গ্রীবা বা ঘাড়ের উপর) শিংগা লাগিয়েছেন। (বুখারী, মুসলিম, আবূ দাউদ, তিরমিযী ও ইবনে মাজাহ)
(২) হুযূর (সা) ইহরাম অবস্থায় ব্যথার জন্য মাথা মুবারকে শিংগা লাগিয়েছেন (বুখারী, আবূ দাউদ, নাসায়ী)।
(৩) হুযুর (সা) ইহরাম বাঁধা অবস্থায় পায়ের পিঠের (পাহার) উপর শিংগা লাগিয়েছেন (ইবনে খুজাইমা, ইবনে হাব্বান)।
(৪) হুযূর (সা) ক্লান্তি বা অবসন্নতার জন্য স্বীয় রান মোবারকে শিংগা লাগিয়েছেন (আবূ দাউদ, নাসায়ী, ইবনে মাজাহ)।
আমাদের দেশে বংশ পরম্পরায় শিংগা লাগানোর ইতিহাস আছে। এখনও কিছু মানুষের মধ্যে শিংগা লাগানোর প্রচলন রয়েছে। তারা উপকারও পাচ্ছেন বলে মন্তব্য করেন। তবে চীন দেশের আকুপাংচার এবং শিংগা লাগানোতে কতটা পার্থক্য তার আধুনিককালের একটি জিজ্ঞাসা। শিংগা লাগান ও আকুপাংচারের স্থান এবং পদ্ধতি কিন্তু প্রায় একই। যা কিছু পার্থক্য তা হাজার বছরের ব্যবধানের জন্যও হতে পারে। আকুপাংচার পদ্ধতিতে চিকিৎসার স্থান তার প্রসিদ্ধি এবং পদ্ধতিগত উন্নতির জন্য যে দেশ যে জাতি যেভাবে ভেবেছেন ঠিক তেমনিভাবেই গুছিয়ে নিয়েছেন।
৭. রাসূল (সা)-এর জীবনে সার্জারীর (শৈল্যবিদ্যার) কিছু চিকিৎসা ঃ প্রিয়নবীর সংগ্রামী জীবনে বহু যুদ্ধ-বিগ্রহে অংশগ্রহণ করেছেন এবং নিজে আহত হয়েছেন। সংগী সাথীদের এবং নিজের চিকিৎসা নিয়েছেন। তাঁর তাঁবুতে যুদ্ধকালীন সময়ে প্রাথমিক চিকিৎসার একটি ব্যবস্থা থাকত। সেখানে প্রায়ই মহিলা সাহাবীরা দায়িত্ব পালন করে পুরুষ মুজাহিদ (সাহাবী)-দের যুদ্ধক্ষেত্রে বিজয়ের ঝাণ্ডা ছিনিয়ে আনার কাজে সাহায্য করতেন। এ সম্পর্কে কিছু বিবরণ তুলে ধরছি : (১) হযরত আনাস (রা) বর্ণনা করেন যে, ওহুদের যুদ্ধে নবী করীম (সা)-এর কাছ থেকে যখন সাহাবীরা সরে গিয়েছিল তখন আমি দেখলাম হযরত আয়েশা সিদ্দীকা (রা) ও উম্মে সুলাইমা (রা) উভয়েই পাজামার পা উঠিয়ে মশক পিঠে বহন করে তৃষ্ণার্তদের পানি পান করাচ্ছেন। পানি শেষ হয়ে গেলে ফিরে যেতেন। আবার পাত্র ভর্তি করে নিয়ে এসে পিপাসার্ত গাজীদের মুখে ঢেলে দিতেন । এতে বোঝা যাচ্ছে, মুজাহিদদের রক্তে পানির সমতা রক্ষার প্রয়োজনীয়তা নিশ্চিতকরণে মুসলিম শিবিরে প্রতিষ্ঠিত একটি বিধান ছিল, যা চিকিৎসা শাস্ত্রে এক অনবদ্য পাঠ। সার্জারীর আগে, পরে ও চলাকালীন সময়ে পানির সমতা সংরক্ষণ শৈল্য চিকিৎসকের একটি উল্লেখযোগ্য দায়িত্ব ও কর্তব্য। এ ছাড়া শৈল্য চিকিৎসার ভার বহন করার মতো কোনও রোগীরই ক্ষমতা নেই ।
পেটে পানি আসা (Assites) : রোগে নবীজী অপারেশনের আদেশ করেন। হযরত আবূ হুরায়রা (রা) হতে বর্ণিত : নবী মুহাম্মদ (সা) ইসতেসকা বা সৌর্যরোগগ্রস্ত এক রোগীর চিকিৎসককে হুকুম করলেন, “তার পেটে শেগাফ (অর্থাৎ অপারেশন) কর।” আধুনিক চিকিৎসায় আজও পেটের পানি বের করার জন্য অপারেশন করা হয়- যার নাম প্যারাসেনটাসিস (Peracentasis ) । ফোঁড়ার অপারেশন করার জন্য নবীজীর নির্দেশ ছিল : হযরত আলী (রা) হতে বর্ণিত, এক রুগ্ন ব্যক্তিকে দেখার জন্য আমি নবী করীম (সা)-এর সঙ্গে ছিলাম। সে ব্যক্তির কোমরে ফোঁড়ার কারণে ফোলা ছিল। লোকেরা বলতে লাগল, এতে পুঁজ হয়েছে। নবী করীম (সা) উক্ত ফোঁড়া শেগাফ (Operation ) করার নির্দেশ দিলেন। হযরত আলী (রা) বললেন, আমি তৎসামান্য শেগাফ (Operation) করে ফেললাম। তখনও নবী করীম (সা) সেখানে উপস্থিত ছিলেন। (যাদুল মাআদ, ২য় খণ্ড)
এতে বোঝা যায়, রাসূল (সা)-এর সার্জারীতে অসাধারণ ব্যুৎপত্তি ছিল এবং এগুলো করানোর জন্য তার লোকও নির্ধারিত ছিল। যেমন হযরত আলী (রা) তন্মধ্যে একজন। আজকের এই সার্জারীর উন্নতির পেছনে নবী করীম (সা) এবং তাঁর অনুপম চরিত্রের অধিকারী সাহাবীরাও ভূমিকা রেখেছিলেন। নিরপেক্ষ বিচারে অবশ্যই নবীর সাহাবীদের ত্যাগ ও অভিজ্ঞতার সন্ধান পাওয়া যাবে।
মলম ও ব্যান্ডেজ (পট্টি) ব্যবহারের প্রচলন ঃ হযরত রবী বিনতে মু'আয (রা) বর্ণনা করেন, “আমরা নবী করীম (সা)-এর সঙ্গে জিহাদে অংশগ্রহণ করে
আহতদের পানি পান করাতাম এবং তাদের ক্ষতস্থানে মলম ও পট্টি লাগাতাম এবং শহীদদের মদীনায় নিয়ে যেতাম।” (বুখারী শরীফ, কিতাবুল জিহাদ) এতেও দেখা যায় (১) পানি সমতা সংরক্ষণ। (২) রক্তক্ষরণ বন্ধের এবং ক্ষত- স্থান রোগজীবাণু দ্বারা সংক্রমণ বন্ধের জন্য মলম ও পট্টি (ব্যান্ডেজ) ব্যবহার করতেন এবং লাশবিহীন যুদ্ধক্ষেত্র নিয়ন্ত্রণ করে যোদ্ধাদের মনোবল চাঙ্গা রাখতেন (৩) ওহুদের যুদ্ধে নবী করীম (সা) জখম হলে হযরত ফাতেমা (রা) রাসূল (সা)-কে পট্টি (ব্যান্ডেজ) বেঁধে দিয়েছিলেন। ঘটনাটির বিস্তারিত বিবরণ হলো, “আবূ হাখেম (রা)-এর ভাষায় আল্লাহ্র রাসূল (সা)-এর মেয়ে হযরত ফাতেমা (রা) হযরত (সা)-এর ক্ষত ধুয়েছিলেন আর হযরত আলী (রা) ক্ষতস্থানে পানি ঢালছিলেন কিন্তু রক্ত বন্ধ হচ্ছিল না। তখন হযরত ফাতেমা (রা) খেজুর পাতার তৈরি মাদুরের এক টুকরা পুড়িয়ে ছাই ক্ষতস্থানে চেপে ধরেন এবং রক্ত বন্ধ হয়ে যায়।” (বুখারী শরীফ, কিতাবুল মাগাযী) এখানে ক্ষতস্থান পরিষ্কার করে সংক্রমণের প্রতিরোধ করা, পানি ঢেলে সেটাকে গভীর থেকে ময়লা বের করার একটি প্রয়াস এবং ছাই পোড়ানোর উপাদান হিসাবে জীবাণুমুক্ত এবং এর সংস্পর্শে এসে রক্তে থ্রম্বোপাস্টীন তৈরি শুরু হওয়াতে রক্ত জমাট বেঁধে রক্তক্ষরণ বন্ধ হয়।
লবণ পানিতে এন্টিসেপটিক হিসাবে ব্যবহার : হযরত আলী (রা) থেকে বর্ণিত, এক রাত্রে নবী মুহাম্মদ (সা)-এর হাত মুবারকে মাটি লাগলে এক বিচ্ছু তার পবিত্র হাত দংশন করে। তখন রাসূল (সা) একটু লবণ চেয়ে পানিতে মেশালেন। অতঃপর ঐ লবণমিশ্রিত পানি বিচ্ছুর দংশিত স্থানে ঢালতে লাগলেন। নবীজী এক হাতে পানি ঢালছিলেন। অন্য হাতে ক্ষতস্থান মালিশ করছিলেন এবং সূরা ফালাক ও সূরা নাস পড়ছিলেন। (তিরমিযী, বায়হাকী, মিশকাত)
বর্তমান বিশ্বেও ক্ষতস্থানে সেলাইন ওয়াশ (লবণ পানিতে ধোয়া) হয়। এটা অত্যন্ত কার্যকর বিধায় দেড় হাজার বছর ধরে চলছে প্রিয়নবীর এ সুন্নতে পাবন্দ শুধু রোগী হিসাবেই নয়, এমনকি মুসলমান ডাক্তারদেরও চিকিৎসা জীবনে ব্যবহার করতে পারেন। যে কোনও চিকিৎসকের জীবনেই কোন-না-কোন রোগের জন্য সেলাইন ওয়াশ না করে শেষ হওয়ার কথা নয়। আমাদের নবীর সুন্নত কতই না স্বাস্থ্যকর!
১০. মধু ও পেটের ব্যাধি ঃ হযরত সায়ীদ খুদরী (রা) হতে বর্ণিত, এক ব্যক্তি হুযুর (সা)-এর খেদমতে উপস্থিত হয়ে আরয করলেন, আমার ভাইয়ের পেটে ব্যথা অথবা একথা বললেন যে, সে আমাশয়ে ভুগছে। হুযুর (সা) বললেন, “তাকে মধু পান করিয়ে দাও। সে ব্যক্তি চলে গেল এবং এভাবে অকৃতকার্য হয়ে চতুর্থ- বার এসে বললো যে তার আমাশয় থামছে না। হুযুর (সা) বললেন, আল্লাহ্ তা'আলা সত্যিই বলেছেন, হয়তো তোমার ভাইয়ের পেট মিথ্যা। মধুর সর্বশেষ উপাদান হচ্ছে গ্লুকোজ যা রক্তে শোষণ হওয়ার সময় পানিকেও শোষণ (absorption) করে রক্তে নিয়ে যায়। পেটের পীড়ায় পানির স্বল্পতা রোধই প্রকৃত চিকিৎসা। আজকাল বাংলাদেশের ঘরে-বাইরে সর্বত্রই অনুশীলন হচ্ছে পেটের পীড়ায় খাওয়ার স্যালাইন। এ ছাড়াও মধুর নিজস্ব কোন উপাদান এই রোগে অগ্রণী ভূমিকা রাখতে পারে। যা আমাদের চিকিৎসাবিজ্ঞানীদের অনুসন্ধানে বেরিয়ে আসবে। যেমন রাসূল (সা) মধুর অনেক প্রশংসা করেছেন, “যে ব্যক্তি প্রতি মাসে তিন দিন সকাল বেলা মধু চেটে সেবন করবে তার কোন কঠিন রোগ-ব্যাধি হবে না।” (মিশকাতুল মাসাবীহ, সুনানে ইবনে মাজাহ) আজ আধুনিক বিজ্ঞানের গবেষণায় প্রমাণিত, মধুর মধ্যে ভিটামিন এ. বি. সি. প্রচুর পরিমাণে আছে। এটা কোষ্ঠকাঠিন্য (Constipation) দূরকারী, বাত ব্যাধির ব্যথা উপশমকারী ও দুর্গন্ধ দূরকারী। শরীর ও ফুসফুসকে শক্তিশালী করে, রুচি বৃদ্ধি করে এবং শক্তি-সামর্থ্য স্থায়ী করে। কাশি হাঁপানী ও ঠাণ্ডা রোগের জন্য মধু বিশেষভাবে উপকারী। মুখের পক্ষাঘাত (Facial paraly- sis) রোগের প্রতিরোধক। মধু রক্ত পরিশোধনকারী এবং মানসিক রোগের জন্যও উপকারী। এটা চক্ষু রোগের ও দৃষ্টিশক্তি বৃদ্ধির মহৌষধ। (মুফরাদাত, খাওয়াসুল আদবিয়্যা)
১. জ্বরের চিকিৎসায় ঠাণ্ডা পানি : জ্বর কোনও রোগ নয় তবে বহু রোগেরই তা একটা উপসর্গ। এই উপসর্গকে দূর করতে গিয়ে কোনও ঔষধ প্রয়োগ করা বিষয়ে চিকিৎসকের প্রেসক্রিপশনে আসে না। একটি কৌশলী পরিচর্যায় (Intelligent nursing) যথেষ্ট। অর্থাৎ উচ্চ তাপের শরীরকে নিম্ন তাপের পানি দিয়ে শরীরের অতিরিক্ত তাপ শরীর থেকে বের করে নেওয়া যায়। তাই আধুনিক চিকিৎসকরা জ্বর নিবারণের জন্য শরীরে পানি ঢালা, ভেজানো কাপড় দ্বারা শরীর বার বার মুছে নেওয়া অথবা বরফব্যাগ (Ice bag), জলপট্টি, জলধারা ব্যবহার করে জ্বর নামিয়ে নেন। হয়ত ইতিমধ্যেই জ্বরের কারণ বের হয়ে যায় এবং সে মোতাবেক চিকিৎসা চলতে পারে। রাসূলে পাক (সা) দেড় হাজার বছর পূর্বেই এই পানি দিয়ে জ্বর সারানোর তাগিদ দিয়েছেন। পাঠকদের কাছে সহজবোধ্য করার জন্য এ সংক্রান্ত হাদীসগুলি পেশ করা হল। (ক) হযরত আবূ হুরায়রা (রা) হতে বর্ণিত হয়েছে, জ্বর জাহান্নামের একটি উত্তপ্ত নমুনা বিশেষ। তোমরা ঠাণ্ডা পানির দ্বারা এটাকে দূর কর। (সুনানে ইবনে মাজাহ) (ক) কোন কোন রেওয়ায়েতে আছে যমযমের পানি দ্বারা ঠাণ্ডা করবে। (খ) হযরত সামুরা (রা) হতে বর্ণিত, জ্বর জাহান্নামের উত্তাপের অংশবিশেষ । তোমরা ঠাণ্ডা পানি দ্বারা এটা ঠাণ্ডা কর। (মুসতাদাকে হাকেম, তাবরানী) (গ) হযরত ইবনে উমর (রা) হতে বর্ণিত, জ্বর জাহান্নামের তাপ। পানি দ্বারা এটাকে ঠাণ্ডা কর।” (ইবনে মাজাহ, মালেক, আহমাদ, নাসায়ী, হাকেম) প্রায় অনুরূপ আরেকটি হাদীস হযরত আনাস (রা) থেকেও বর্ণিত আছে ।
রাসূল (সা)-এর জীবনী পর্যালোচনা করলে শত শত ঘটনা পাওয়া যাবে, যা প্রতিকারমূলক চিকিৎসা হিসাবে তিনি বাতলে দিয়েছেন, যা কিয়ামত পর্যন্ত মানুষ ব্যবহার করে উপকার পাবে। এটা যুক্তিতর্কে বা আধুনিক চিকিৎসা ব্যবস্থায় উপকারী হিসেবে একদিন প্রমাণিত হবে ইনশাআল্লাহ্। রাসূলে পাক (সা) মেহেদী, মধু, সিনা বা সোনামুখী গাছের পাতা, মুসাব্বর, সুরমা, আগর কাঠ, কুসত, কালোজিরা, দুম্বার চাকি, কুম্বা, যয়তুন (Olive oil), সফর জাল (মিহিদানা), আজওয়া, খেজুর, বরনী খেজুর, আনজির বা বিলাতি ডুমুর প্রভৃতির চিকিৎসাজনিত উপকারিতা বর্ণনা করে প্রতিকারমূলক চিকিৎসা এগিয়ে দিয়েছেন। যাঁরা এ দ্রব্যাদির রাসূল-বর্ণিত উপকারিতা চেয়েছেন তাঁরাই উপকৃত হয়েছেন। আমাদেরকে আল্লাহ্ রাসূল (সা)-এর বাতলে দেওয়া পথের উপকারিতা উদ্ঘাটন ও আমল করার সুযোগ দিন ।

FOR MORE CLICK HERE
NTRCA COLLEGE LEVEL HISTORY/ইতিহাস গাইড/ বেসরকারি শিক্ষক নিবন্ধন ইতিহাস
১০ তম বিসিএস -৪৪তম বিসিএস এর প্রশ্ন ও সমাধান 10th BCS to 44th Bcs MCQ Question Solution
বিসিএস ব্যাংক প্রাইমারি পরীক্ষার-এর প্রশ্ন ও সমাধান
সার্চ ইঞ্জিন অপটিমাইজেশন SEO বই লেখক : মোঃ মিজানুর রহমান
মাতৃস্বাস্থ্য/Motherhood
ওষুধ নির্দেশিকা
সহীহ বুখারী শরীফ হাদিস আরবি বাংলা (৭৫৬৩ টি হাদিস)
সহীহ মুসলিম শরীফ হাদিস আরবি বাংলা (৭৪৫৩ টি হাদিস)
সুনানে তিরমিজি শরীফ হাদিস আরবি বাংলা (৩৯৫৬ টি হাদিস)
সুনানে নাসায়ী শরীফ হাদিস আরবি বাংলা (৫৭৫৮ টি হাদিস)
সুনানে ইবনে মাজাহ শরীফ হাদিস আরবি বাংলা (৪৩৪১ টি হাদিস)
সুনানে আবু দাউদ শরীফ হাদিস আরবি বাংলা (৫২৭৪ টি হাদিস)

Copyright © Quality Can Do Soft.
Designed and developed by Sohel Rana, Assistant Professor, Kumudini Government College, Tangail. Email: [email protected]