চিকিৎসা বিজ্ঞানের ইউনানী মৌল ধারণা (আয়ুর্বেদিক, যোগ ও প্রাকৃতিক চিকিৎসা, ইউনানী ...

চিকিৎসা বিজ্ঞানের ইউনানী মৌল ধারণা
হাকীম সাইয়েদ মুহাম্মদ আহছান উল্লাহ
চিকিৎসা বিজ্ঞানের মূলনীতি আলোচনাই হলো এই প্রবন্ধের মূল উদ্দেশ্য। তাই সৃষ্টির রহস্যের আলোচনার ধারায় কিছু না কিছু কথা এসে যাবে বিধায় এর ক্রমবিকাশ ও বিবর্তন সম্পর্কে আলোচনা এ প্রবন্ধের বিষয়বস্তু নয়। পক্ষান্তরে একে মৌলবাদী আলোচনাও বলা যেতে পারে। কেননা প্রাচীন চিকিৎসা বিজ্ঞানের একজন ধারক ও ছাত্র হিসেবে প্রাচীন সংজ্ঞার নিরিখে আধুনিক সংজ্ঞাকে অবহেলা করা যায় না। তবে অধুনা একচোখা চিন্তাধারার দৌরাত্ম্য নিয়ে নয় বরং সমন্বয়মূলক দৃষ্টিভঙ্গির আলোকে আলোচনা করা যেতে পারে।
সৃষ্টির মূলে যে বিষয়াদি ক্রিয়াশীল, তাকে প্রাচীন চিকিৎসা বিজ্ঞানীরা অসূরে তাবীইয়া তথা প্রাকৃতিক বিষয়াদি নামে আখ্যায়িত করেছেন। এর উপরে সৃষ্টির অস্তিত্ব নির্ভরশীল। এদের একটির অনুপস্থিতিতে সৃষ্টির অস্তিত্ব সম্ভব নয়। এগুলো সাতটি—
১. আরকান বা আনাসের তথা মৌলিক উপাদান বা বস্তুসমূহ। ২. মিজাহ্ তথা স্বভাব বা প্রকৃতিসমূহ। ৩. আখলাত তথা ধাতু রসসমূহ। ৪. আ-জা তথা অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সমূহ। ৫. আরওয়াহ তথা জীবনীশক্তিসমূহ। ৬. কুওয়াহ তথা বল বীর্যসমূহ। ৭. আআল তথা ক্রিয়া ও কার্যক্রমসমূহ।
প্রথমে আরকান বা আনাসের তথা মৌলিক উপাদান বা বস্তুসমূহ সম্পর্কে আলোচনা করা যাক । প্রাচীন বিজ্ঞানীদের মতে মৌলিক উপাদান বা বস্তু চারটি যথা- ১. 'মা' তথা পানি, ২. নার তথা আগুন, ৩. আরজ তথা মাটি, ৪. রীহ তথা বায়ু।
উল্লিখিত চারটি মৌলিক উপাদান বা বস্তু দ্বারা জীব, উদ্ভিদ ও জড় জাতীয় পদার্থের প্রাথমিক গঠনের সূচনা। জীবদেহকে পর্যালোচনা করলে সর্বশেষ এ বস্তু চতুষ্টয়েরই প্রকাশ ঘটে, যা কোনক্রমেই আর বিভক্ত করা যায় না। বস্তু চতুষ্টয়ের পারস্পরিক যোজনের ফলে কোনও একটি যৌগিক অস্তিত্ব রূপ পরিগ্রহ করে। কিন্তু আধুনিক বিজ্ঞানীরা কথাটি মানতে চান না। তাঁদের দাবি, প্রতিটি যোজনেই যে চারটি উপাদান থাকতে হবে তা শর্ত নয়। এতদভিন্ন তাঁরা উল্লিখিত চারটি বস্তুকে মৌলিক বলেও স্বীকার করেন না। অতএব নিম্নে সংক্ষেপে চারটি উপাদানের প্রাচীন ও আধুনিক ব্যাখ্যা দেয়া হলো ।
বায়ু : প্রাচীন বিজ্ঞানীরা বায়ুর মিজায্ বা স্বভাবকে উষ্ণ-আর্দ্র বলে সাব্যস্ত করেছেন। তবে আমাদের পারিপার্শ্বিক বায়ু, পানি ও মাটির বোখারাত তথা আবদ্ধ বাষ্পের মিলনে বাহ্যত শীতল হয়ে থাকে, আবার কখনো সূর্যের তাপে উষ্ণ হয়ে যায়। অধিক উঁচু স্থানে সূর্যের আলোর প্রতিঘাতজনিত প্রভাব বায়ুর উপর কম হওয়াতে এবং পানিমিশ্রিত বাষ্প বায়ুর সাথে মিলনের ফলে উঁচু স্থানের বায়ু অপেক্ষাকৃত শীতল হয়। যে বায়ু আমাদের নিকট দিয়ে চলাফেরা করে তাতে মিশ্রণ রয়েছে। শায়খুর রাঈস আবু আলী ইবনে সীনা তাঁর 'আল কানুন' নামক বিখ্যাত গ্রন্থের কুল্লিয়াত অংশে লিখেছেন যে, বায়ুতে অবস্থিত নিম্নলিখিত অংশসমূহ পাওয়া যায়, যথা ঃ ১. রীহে বাসীত তথা মৌলিক বায়ু। ২. বোখারাত তথা আবদ্ধ বাষ্প, অর্থাৎ যে দ্রব্যসমূহের উপর উষ্ণতা প্রভাব বিস্তার করে, তথা হতে আবদ্ধ বাষ্প বা বোখারাত সৃষ্টি হয়। ৩. দুখান তথা ধূম্র, অর্থাৎ কোনও শুষ্ক দ্রব্যের উপর যখন উষ্ণতা প্রভাব বিস্তার করে তখন তা থেকে রাকী তথা দাহ্য ক্রিয়ার প্রভাব ধূম সৃষ্টি করে। ৪. আজযায়ে নারিয়াহ তথা আগুন বা দাহ্য অংশ। এ চারটি মিশ্রিত বস্তু ব্যতীতও কোন কোন জৈবিক ও উদ্ভিদ বস্তুজনিত সংমিশ্রণ বায়ুতে উপস্থিত থাকে ।
আধুনিক গবেষকদের মতে বায়ুতে নিম্নলিখিত অংশের মিশ্রণ থাকে, যেমন : ১. আবকরীন তথা মৌলিক বায়ু বা ক্ষার জাতীয় পদার্থ (নাইট্রোজেন), ২. হেমজীন তথা দাহ্য বায়বীয় অংশ (অক্সিজেন)। ৩. আদখেনা তথা কয়লা জাতীয় ক্ষারজনিত আবদ্ধ বায়বীয় পদার্থ (কার্বনিক এসিড গ্যাস)। এতদভিন্ন বায়ুতে কিঞ্চিত মাত্রায় গাজে নওশাদর তথা নিশাদল জাতীয় বাষ্প (এ্যামোনিয়ামে গ্যাস), হেমজুন তথা তীব্র দাহ্য বায়বীয় অংশ (ওজন), এবং সামান্য সংখ্যক এঞ্জেরায়ে মাঈয়াহ তথা পানির অংশ (একোয়াজ) ইত্যাদি। উল্লিখিত অংশসমূহের প্রমাণ কেবল রাসায়নিক প্রক্রিয়ায় পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমেই দেয়া যেতে পারে।
বস্তুসমূহকে সম্যকভাবে বোঝার জন্য ব্যাখ্যা তুলে ধরা হলো ।
১. “হেমজীন” তথা দাহ্য বায়বীয় পদার্থ (অক্সিজেন) নিতান্ত সূক্ষ্ম, রঙ, গন্ধ ও স্বাদহীন, বায়ু যা প্রতিটি জীবের জীবন রক্ষায় অপরিহার্য। এটি ফুসফুসে প্রবেশ করে রক্তকে পরিষ্কার করে তাকে লাল টকটকে করে।
২. “দুখান” তথা কয়লা জাতীয় ক্ষারজনিত বাষ্প (কার্বনডাই অক্সাইড গ্যাস); যা রঙহীন একপ্রকার বাষ্প, এতে অল্প বিস্তর স্বাদ ও কিছু গন্ধ থাকে। এটি বায়ু অপেক্ষা দ্বিগুণ ভারী।
৩. “আবকরীন” তথা মৌলিক বায়ু (নাইট্রোজেন), এটি রং, গন্ধ ও স্বাদহীন বায়ু-বিশেষ। যা “হেমজীন” তথা দাহ্য বায়বীয়: (অক্সিজেন) পদার্থের সাথে মিলে তার তীব্রতা ও দহন ভাবকে দমিয়ে দেয়ার কারণে জীব-এর দাহ্যক্রিয়া হতে পরিত্রাণ পেয়ে উপকারী ক্রিয়া গ্রহণ করতে পারে। কেননা বিশুদ্ধ দাহ্য বায়ু
(হেমজীন বা অক্সিজেন) এমন তীব্র ও দহন শক্তিসম্পন্ন হয় যে, তাতে শ্বাস-প্রশ্বাস নিয়ে কোনও জীবের পক্ষে বেঁচে থাকা অসম্ভব।
৪. “গাজে নওশাদর” তথা নিশাদলজনিত বাষ্প (এ্যামোনিয়াম গ্যাস)-এ বাষ্প জীব ও উদ্ভিদের আবর্জনা এবং বিকৃত ও পচা-গলা দ্রব্য হতে সৃষ্টি হয়ে বায়ুর সাথে মিশে যায়। জীবের স্বাস্থ্যের জন্য যদিও তা ক্ষতিকর কিন্তু উদ্ভিদের জন্য উপকারী। বায়ুতে উল্লিখিত বস্তু সাধারণত অল্প মাত্রাতেই উপস্থিত থাকে, তাই তার ক্ষতিকর ক্রিয়া, জীব অনুভব করতে পারে না। বায়ুতে যদি তার পরিমাণ বৃদ্ধি পায় তবে নিশ্চিতভাবে স্বাস্থ্যের ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায় ।
৫. “হেমজুন” তথা অতি তীব্র দহন শক্তিসম্পন্ন বায়বীয় পদার্থ (ওজন) । এটি হেমজীন তথা দাহ্য বায়বীয় পদার্থের (অক্সিজেন) তীব্রতর দহন ক্ষমতার অধিকারী অংশ, যা নিতান্ত পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন বায়ুতে অতি অল্প মাত্রায় অবস্থান করে। বিশেষত পাহাড়ের চূড়ায় ও সমুদ্রপৃষ্ঠে এর বিচরণ অধিক । পানি : প্রাচীন বিজ্ঞানীগণ পানিকে মৌলিক উপাদান বলে দাবি করেছেন। পানির মিজায্ তথা প্রকৃতি বা স্বভাব শীতল-আর্দ্র। পানিকে তিনটি আকারে পাওয়া যায়। যেমন : ১. “ এঞ্জেরায়ে মাঈয়াহ্” তথা পানীয় বাষ্পাকারে । ২. “মাইয়াল” বা তরল আকারে। ৩. “জামেদ” তথা জমাট আকারে। সাধারণত প্রাকৃতিক পানি বিশুদ্ধাকারে পাওয়া যায় না। অনেক প্রকার আবর্জনার সংমিশ্রণ পানিতে উপস্থিত থাকে। কোন কোন পানিতে মিশ্রণ হয় যেমন, লবণমিশ্রিত পানি । কোন কোন পানি বিভিন্ন দ্রব্য দ্বারা প্রভাবিত হয়। যেমন- চুনা প্রভাবিত পানি। কোনও কোনও পানিতে বায়ুমিশ্রিত থাকে। যেমন- পানিকে সিদ্ধ করলে তা বুদ বুদ আকারে দেখা যায়। কোন কোন পানিতে খনিজ দ্রব্য মিশ্রিত থাকে। যেমন- গন্ধক, ফিটকিরি, লৌহ, লবণ ইত্যাদি।
আধুনিক বিজ্ঞান পানিকে দুটি বাষ্পীয় বায়ু দ্বারা যোজনীয় বলে সাব্যস্ত করেছেন। যেমন : ১. হেমজীন তথা দাহ্য বায়বীয় পদার্থ (অক্সিজেন)। ২. মা-ঈন তথা পানীয় পদার্থ (হাইড্রোজেন)। যখন পানীয় অংশ ও দাহ্য বায়বীয় অংশ একত্রে মিলিত হয় তখন তা সাথে সাথে জ্বলতে আরম্ভ করে এবং হালকা এক প্রকার শব্দ হতে থাকে। উভয় দ্রব্য একত্র হয়ে পানির রূপ ধারণ করে। অনুমান করা হয়েছে যে, পানিতে দু'অংশ মা-ঈন ও একাংশ হেমজীন (যথাক্রমে পানীয় অংশ ও দাহ্য বায়বীয় অংশ) হয়ে থাকে। যখন পানিকে বিদ্যুতের দ্বারা উড়ানো হয়, তখন এ দুটি অংশ পরিমিত অবস্থা হতে পৃথক হয়ে যায়। আগুন সৃষ্টির অস্তিত্বের জন্য একটি অপরিহার্য ও মৌলিক উপাদান বা বস্তু । এর মিজায্ বা স্বভাব উষ্ণ-শুষ্ক। তার স্থান প্রতিটি বস্তুর ঊর্ধ্বে, যা আকাশের সাথে সম্পর্কযুক্ত। অথচ আধুনিক বিজ্ঞান তাকে কোনও গুরুত্বই দিতে চায় না। তাদের মতে “হেমজীন” বা দাহ্য বায়বীয় পদার্থ (অক্সিজেন) যখন কোন দ্রব্যের উপর প্রবলভাবে প্রক্রিয়া আরম্ভ করে তখন "এতে আল” বা উগ্র-মূর্তি ধারণ করত রাসায়নিক প্রক্রিয়ায় সৃষ্ট দৃশ্যই আগুন নামে পরিচয় লাভ করে ।
মাটি : প্রাচীন বিজ্ঞানীগণ মাটিকেও চারটি মৌলিক উপাদানের একটি হিসেবে সাব্যস্ত করেছেন, যার মিজায় শীতল শুষ্ক। কিন্তু আধুনিক বিজ্ঞান মাটিকে মুরাক্কাব বা যৌগিক পদার্থ হিসেবে সাব্যস্ত করার পর তাতে অনেক মৌলিক উপাদানের যোজন আছে বলে দাবি করেন।
আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গির নিরিখে মৌলিক উপাদান প্রায় শতাধিক। এদের কিছু “ফিলজী” বা ধাতব (মেটালিক) আর কিছু “গায়রে ফিলজী” বা অধাতব (নন- মেটালিক) হয়ে থাকে। আমার মতে এ সংখ্যা অতি সাধারণ, কেননা উক্ত চারটি মৌলিক উপাদান এ ধরণীতে যে যে মৌলিক বস্তু সৃষ্টি করে রেখেছে তা আবিষ্কার হলে এ সংখ্যার কত যে বিস্তৃতি ঘটবে তা গুণে শুমার করা অসম্ভব হয়ে পড়বে। কেবল তখনই সৃষ্টির রহস্য মানুষের আয়ত্তে আসা সম্ভব হবে। পক্ষান্তরে আমরা এ যাবত যা গবেষণা করে আবিষ্কার করেছি, তা শুধু যোজন ও মিশ্রণের সূত্র ধরেই। কিন্তু খালকাত বা সৃষ্টিসূত্র আরো ব্যাপক, যাকে পর্যালোচনা করার জ্ঞান প্রাচীন বিজ্ঞানীদের কাছ থেকে জন্মসূত্রে অর্জন করতে পারি নাই। বর্তমানে আমরা শুধু কামানো মাথার উপর কেবল ক্ষুরই বুলিয়ে যাচ্ছি, না হয় এখনো ল্যাটিন এবং অন্যান্য বিজ্ঞানের ভাষাকে অনুকরণ করছি কেন ? আমাদের নিজস্ব ভাষা কি বিজ্ঞানের ভাষা হতে পারে না ? আক্ষেপের সুরে কথাগুলো বলতে হলো।
আধুনিক বিজ্ঞানের দৃষ্টিতে যে ১৮টি মৌলিক উপাদান মানবদেহে অবস্থান করে তা নিম্নরূপ : ১. “হেমজীন” বা দাহ্য বায়বীয় পদার্থ (অক্সিজেন), ২. “নূরীন” বা দীপক পদার্থ (ফসফরাস), ৩. “খেজরীন” বা আবহ পদার্থ (ক্লোরিন), ৪. “সীলীন” বা আস্ত পদার্থ (ফ্লোরিন)। ৫. আবক্করীন বা ক্ষার জাতীয় পদার্থ (নাইট্রোজেন)। ৬. “মা- ঈন” বা পানি জাতীয় পদার্থ (হাইড্রোজেন)। ৭. “মুহমীন” বা কয়লা জাতীয় পদার্থ (কার্বন), ৮. “মেগনেশিয়া” বা চৌম্বকীয় পদার্থ (মেগনেসিয়াম), ৯. আরদ্বীন বা মাটি জাতীয় পদার্থ (ইথিয়াম), ১০. হাদীদ তথা লৌহ জাতীয় পদার্থ (আয়রন), ১১. “কেলসীন” বা চুনা জাতীয় পদার্থ (কেলসিয়াম)। ১২. “ক্লোবীন” বা উপক্ষার জাতীয় পদার্থ (পটাসিয়াম), ১৩. “নীহাস” বা তাম্র জাতীয় পদার্থ (কপার), ১৪. “আসরুব” বা শিশা জাতীয় পদার্থ (লেড), ১৫. “কিবরীত” বা গন্ধক জাতীয় পদার্থ (সালফার) ১৬. “রমলীন” বা বালি জাতীয় পদার্থ (সিলিকাস), ১৭. “বনফসেজীন" বা সমুদ্র শাকীন পদার্থ (আয়োডিন) ১৮. “নাতরুনী” বা সোডা জাতীয় পদার্থ (সোডিয়াম)। সাধারণ দৃষ্টিতে দেখলে প্রাচীন ও আধুনিক মতের মধ্যে অনেক গরমিল রয়েছে এবং উভয়ের মধ্যে কোনও সামঞ্জস্য খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। সূক্ষ্মভাবে দৃষ্টিপাত করলে তা আকাশ-পাতাল দূরে বলেও মনে হয় না।
চারটি মৌলিক উপাদানের পর্যালোচনা করতে গিয়ে যদি আমরা প্রাচীন বিজ্ঞানীদের উল্লেখিত কথাগুলোকে সামনে রাখি, (যেমন তাঁরা বলেছেন যে, আমাদের নিকটে আগুন, পানি, মাটি ও বায়ুকে মৌলিক বা বাসীত বলা যায় না) তবে মতানৈক্য অনেক হ্রাস পাবে। শুধু কি তাই বরং প্রাচীন বিজ্ঞানীদের পর্যালোচনা এবং আধুনিক বিজ্ঞানীদের গবেষণাকে যদি আমরা পাশাপাশি রেখে দেখি, তবে অধিক পরিমাণে উভয়ের মধ্যে সমন্বয় খুঁজে পাওয়া যাবে।
যেমন বায়ুর ব্যাপারে প্রাচীন প্রকৃতি বিজ্ঞানীদের ব্যাখ্যা তাকে “মুজাইয়েজ” বা মিশ্রণ বলে প্রমাণ করেছে। আধুনিক রসায়নবিদগণ এ রায় মেনে নিয়েছেন কিন্তু তা “মুরাককাব” বা যোজন নয় । “মুরাককাব” বা যোজনের অর্থ বিভিন্ন দ্রব্যের একত্রে রাসায়নিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে একত্রিত হয়ে কোনও নতুন দ্রব্যের রূপ গ্রহণ করা এবং তার বিশেষ বিশেষ অংশের নিজ বিশেষত্ব হতে সম্পূর্ণ ভিন্ন হওয়া। কিন্তু বায়ু তেমন নয়। কেননা “হেমজীন” বা দাহ্য পদার্থ (অক্সিজেন) “আবকরীন” বা ক্ষার জাতীয় পদার্থের (নাইট্রোজেন) বিশেষত্ব বায়ুতে উপস্থিত থাকে। এভাবে প্রাচীন ও আধুনিক রসায়ন বায়ুর যে অংশসমূহ সাব্যস্ত করেছেন তার সমন্বয় নিম্নে দেয়া হলো :
১. প্রাচীন রসায়ন মতে, “রীহে বাসীত” বা আবকরীন” তথা মৌলিক বায়ু বা ক্ষার জাতীয় পদার্থ আধুনিক বিজ্ঞান যাকে 'নাইট্রোজেন' বলে তা বায়ুতে তুলনামূলকভাবে ৩০.৭৮ শতাংশ কম । ২. প্রাচীন রসায়ন মতে “আজায়ে নারীয়াহ” বা “হেমজীন ও হেমজুন” তথা দাহ্য পদার্থ বা তীব্র দাহ্য পদার্থ, আধুনিক রসায়ন মতে অক্সিজেন ও ওজন বায়ুতে তুলনামূলকভাবে ০.২১ শতাংশ ও প্রয়োজনসাপেক্ষ।
৩. প্রাচীন রসায়ন মতে “বোখারীতে মা-ঈয়াহ” বা পানিযুক্ত বাষ্প আধুনিক রসায়ন মতে “একোয়াজ” তুলনামূলকভাবে পরিবর্তনশীল । ৪. প্রাচীন রসায়ন মতে “আজায়ে দুখনিয়াহ” বা ধূম্র জাতীয় অংশ, আধুনিক রসায়ন মতে, “কার্বন ডাই অক্সাইড” তুলনামূলকভাবে ৩০ শতাংশ ।
৫. প্রাচীন রসায়ন মতে “নাবাতী ওয়া হায়ওয়ানী গেলজাত” বা “গাজে নাওশাদরী” তথা উদ্ভিদ ও প্রাণীজ আবর্জনা বা নিশাদলীয় বাষ্প, আধুনিক রসায়ন মতে “এ্যামোনিয়াম” তুলনামূলকভাবে প্রয়োজনীয় অনুপাত ।
“রীহে বাসীত” বা মৌলিক বায়ু নাইট্রোজেন এবং “আজায়ে নার” বা দাহ্য বায়বীয় পদার্থকে “অক্সিজেন ও ওজন” জল আখ্যায়িত করা কঠিন কোনও ব্যাপার নয়। কেননা “আবকরীন” বা ক্ষার জাতীয় পদার্থ “নাইট্রোজেন” বায়ুর বেশির হয়ে
থাকে। হেমজীন ও হেমজুন বা দাহ্য ও তীব্র দাহ্য পদার্থ (অক্সিজেন ও ওজন ) প্রকৃতপক্ষে “উনসুরে নারী” বা আগুন জাতীয় উপাদান যে তাতে সন্দেহ থাকার কথা নয়।
“মা-য়ী বোখারাত” বা পানিধার বাষ্প ও দুখান বা ধূম্রকে প্রাচীন ও আধুনিক রসায়ন বায়ুর অংশ বলে স্বীকার করেছে। অতঃপর ‘দুখান” বা নাবাতী ওয়া হায়ওয়ানী গেলজাত” তথা নিশাদলজনিত বাষ্প বা জৈবিক ও উদ্ভিদজাতীয় গলিত আবর্জনা বায়ুর সাথে মিশে বলেও প্রাচীন বিজ্ঞানীগণ স্বীকার করেছেন। আমরা যখন জানতে পারলাম যে, আধুনিক গবেষণায় জৈবিক ও উদ্ভিদজনিত আবর্জনা হতে নিশাদলীয় বাষ্প বা “এ্যামোনিয়াম” গ্যাস সৃষ্টি হয় বলে প্রমাণ করলো তখন আশ্চর্য না হয়ে পারা যায় না । কেননা প্রাচীন বিজ্ঞানীদের যুগে আজকের মত অত উন্নত ধরনের যন্ত্রপাতি না থাকা সত্ত্বেও তাঁরা শুধু জ্ঞান ও দৃষ্টিশক্তির উপর নির্ভর করে এমন একটি সূত্র আবিষ্কার করতে পারলেন ।
প্রাচীন ও আধুনিক বিজ্ঞানীগণ বায়ুর প্রাকৃতিক অংশের ব্যাপারে যদিও একমত হতে পারেননি, তবু অপ্রাকৃতিক অংশসমূহের ব্যাপারে কিন্তু দ্বিমত পোষণ করেননি। আধুনিক-বিজ্ঞানীদের গবেষণা মতে বায়ুতে চার প্রকারের “কেসাফাত” বা আবর্জনা থাকে। যেমন ঃ ১. “দুখানী” বা ধূম্রজনিত। ২. “মে-দেনী” বা খনিজজনিত। ৩. “নাবাতী” বা উদ্ভিদজনিত। ৪. “হায়ওয়ানী” বা জীবজনিত। “দোখানী কেসাফাত” বা ধূম্রজনিত আবর্জনা, যাকে আধুনিক বিজ্ঞান 'কার্বন ডাই অক্সাইড' নাম দিয়েছে “বোখারাতে নাবাতী ওয়া হায়ওয়ানী বা "বোখারাতে নাওশাদরী” তথা জীব ও উদ্ভিদ জনিত বাষ্প বা নিশাদলীয় বাষ্প। এর নাম দেয়া হয়েছে “এ্যামোনিয়াম গ্যাস”। “মা- দেনা কেসাফাত” বা খনিজ আর্বজনাজাতীয় বাষ্পীয় ধূম্র, যেমন : মাটি, চুনাপাথর, সিসা ও তাম্র ইত্যাদির অংশ বা কণা বায়ুতে মিশ্রিত হয়ে শ্বাস-প্রশ্বাসের মাধ্যমে ফুসফুসে প্রবেশ করে বিভিন্ন প্রকার রোগ সৃষ্টিতে সহায়তা করে । এতদ্ব্যতীত নাবাতী ওয়া হায়ওয়ানী কেসাফাত বা জৈবিক উদ্ভিদজনিত আবর্জনা- সমূহও বায়ুতে প্রচুর পরিমাণে মিশে বায়ুকে দূষিত করে নানা প্রকার সংক্রামক রোগ বিস্তারে সহায়তা করে । মূলত তা জৈবিক ও উদ্ভিদজনিত আবর্জনার পচন হতেই সৃষ্টি হয়।
এর সমর্থনে প্রাচীন বিজ্ঞানী 'আল্লামা আলাউদ্দীন কারশী” তাঁর “মুজেফুল কানূন” নামক গ্রন্থে বায়ুতে নিম্নলিখিত আবর্জনা পাওয়া যায় বলে উল্লেখ করেছেন। ১. “নিতিয়ান” বা এঁদো ডোবার আবদ্ধজনিত বাষ্প। ২. “নাবাতী কেসাফাত” বা লতাগুল্ম ও ক্ষতিকর বৃক্ষাদি পচা আবদ্ধজনিত বাষ্প। ৩. “মুতাওয়াতের কেসাফাতী দুখান” বা অবিরাম ধূলাবালিজনিত ধূম্র বায়ু, ৪. “বদবুয়ে মুরদেগান” বা মৃতজনিত দুর্গন্ধ জাতীয় বায়ু, ৫. “দোখান” বা ধূম্রজনিত বায়ু ।
এর মধ্যে প্রথম দুটি উদ্ভিদজনিত আবর্জনা। অবিরাম ধূলাবালিজনিত বাষ্প হলো খনিজ আবর্জনা। “দোখান” হলো ধূম্রজনিত আবর্জনা এবং মৃতের দুর্গন্ধ জৈবিক আবর্জনা । উল্লেখিত আলোচনার দ্বারা পরিষ্কার হয়ে গেলো যে, উদ্ভিদ ও জৈবিক আবর্জনা পচনের কারণে “বোখারতে নাওশাদরী" বা নিশাদলীয় বাষ্প (এ্যামোনিয়াম গ্যাস) সৃষ্টি হয়, যাকে আধুনিক গবেষণায় বায়ুর একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষাক্ত আবর্জনা বলে স্বীকার করা হয়েছে। উক্ত আলোচনা দ্বারা প্রমাণ হলো যে, আধুনিক গবেষণা প্রাচীন মতবাদকে প্রমাণ করে দেখিয়ে দিয়েছে। বায়ুর ব্যাপারে বিস্তারিত আলোচনা করা হলো। বাকি তিনটি মৌলিক উপাদানের ব্যাপারে অত গভীরে না গিয়ে শুধু ইঙ্গিত করেই ক্ষান্ত হবো।
পানিকে আধুনিক বিজ্ঞান “মা-ঈন” বা পানীয় (হাইড্রোজেন) এবং “হেমজীন” বা (দাহ্য) (অক্সিজেন) পদার্থের “মুজাইয়েয্” বা মিশ্রণ বলে আখ্যায়িত করে থাকে। প্রাচীন প্রকৃতি বিদ্যায় যদিও পানিকে মৌলিক বস্তু বলে স্বীকার করা হয়েছে কিন্তু তার সাথে ব্যাখ্যায় গিয়ে বলা হয়েছে যে, পানিতে বায়ুর অংশ মিলিত থাকে। আধুনিক বিজ্ঞান “হেমজীন” বা দাহ্য পদার্থকে (অক্সিজেন) বায়ুর যুজে আমেল বা ক্রিয়াশীল অংশ বলে সাব্যস্ত করেছে। এভাবে প্রাচীন ও আধুনিক চিন্তাধারায় অধিক পার্থক্য অনুমান করা যায় না। শায়খুর বাঈস আবু আলী ইবনে সীনা বলেছেন যে, আমাদের আশেপাশের পানি মৌলিক নয়। জমাকৃত স্থানের পানিতে “আজায়েরীহী” বা বায়ু ও দাহ্যজনিত অংশ (নাইট্রোজেন ও অক্সিজেন) উপস্থিত থাকে। আধুনিক বিজ্ঞানও তা স্বীকার করে। তাদের মত হলো পানিতে “মা-ঈয়াত” বা পানির অংশ (হাইড্রোজেন) ও “আযজায়ে নারী” বা দাহ্য অংশ (অক্সিজেন) পাওয়া যায়। এর সাথে সাথে বায়ু অংশও (নাইট্রোজেন) থাকে, যা পানিকে সিদ্ধ করলে বুদবুদ আকারে দেখা যায়। এতদৃভিন্ন প্রাচীন বিজ্ঞানীদের একটি বিখ্যাত দলের (যাদের আসহাবে খালীত বা ধাতুরস সম্পর্কে গবেষক দল বলা হয়) দৃষ্টিভঙ্গি এই যে, পানিতে “আজায়ে নারী” বা দাহ্য অংশ মৌলিকভাবে পাওয়া যায়। এদের ধারণা আধুনিক চিন্তাধারার সাথে কোনও দ্বিমত সৃষ্টি করে না। কেননা আধুনিক রসায়ন শাস্ত্র পানিকে মা-ঈন ও হেমজীন বা পানীয় ও দাহ্য অংশের (হাইড্রোজেন ও অক্সিজেন) মিশ্রণ বলে সাব্যস্ত করে থাকে। এ মতবাদের সমর্থনে প্রাচীন মুসলিম রসায়ন বিশেষজ্ঞদেরও স্বীকৃতি পাওয়া যায়। এদের মধ্যে বিখ্যাত বুযুর্গ সূফী সাধক হযরত জিনুন মিসরী (রা) সবিশেষ বিখ্যাত হয়ে রয়েছেন।
মাটির ব্যাপারে আধুনিক বিজ্ঞানীদের মত হলো, মাটি অনেক উপাদানের মিলনের সমষ্টি এবং উপাদান অধিক পরিমাণে মাটিতেই পাওয়া যায়। সুতরাং স্বর্ণ, রৌপ্য, লৌহ, তাম্র, পারদ, গন্ধক, তুতে ইত্যাদি সকল বস্তু মাটি হতেই আহরিত হয়। প্রাচীন বিজ্ঞানীগণ কিন্তু এর বিরোধী নন। বরং তাঁরা ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলেন যে, খনিজ দ্রব্য মাটিতেই পাওয়া যায়। এতদ্ব্যতীত তাঁরা আরও ব্যখ্যা করে দেখিয়েছেন যে, ইত্যাদির ভস্মে মাটির অংশের প্রাধান্য থাকে বেশি।
কাঠ
আধুনিক বিজ্ঞানীগণও বলেন যে, তাতে “মুহমীন” বা কয়লার অংশের প্রাধান্য (কার্বন) বেশি থাকে। প্রাচীন বিজ্ঞানীগণ আরো বলেছেন যে, ভস্মে মাটির অংশ ব্যতীত অল্প-বিস্তর "নারী” বা দাহ্য, "রীহী” বা বায়ু এবং মায়ী বা পানির অংশও উপস্থিত থাকে। আধুনিক বিজ্ঞানও তা স্বীকার করে। তাদের মতে ভস্মে “কার্বন" ব্যতীত “অক্সিজেন”, “নাইট্রোজেন” এবং “হাইড্রোজেন”ও পাওয়া যায়।
আগুনের ব্যাপারে আধুনিক বিজ্ঞানের দৃষ্টিভঙ্গি হলো, এটি “হেমজীন” বা দাহ্য পদার্থের (অক্সিজেন) একপ্রকার রাসায়নিক প্রক্রিয়া। মূলত আগুনের কোনও ভিন্ন অস্তিত্ব নেই। প্রাচীন বিজ্ঞানীদের মধ্যে “একাররাকীন” নামক সম্প্রদায়ও এর ভিন্ন অস্তিত্ব স্বীকার করেনি। তাঁদের কেউ কেউ ব্যাখ্যাসূত্রে বলেছেন যে, বায়ু যখন “এতে আল” বা উগ্রভাব গ্রহণ করে তখন তা আগুনে রূপান্তরিত হয়। কথাটি আধুনিক বিজ্ঞানীদের ব্যাখ্যার সমসাময়িক যে, তাতে সন্দেহের কোনও অবকাশ নেই।
আনাসের তথা মৌলিক উপাদানের ব্যাপারে প্রাচীন ব্যাখ্যা আলোচনা করতে হলে প্রাচীন ও আধুনিক মতবাদের মধ্যকার তুলনামূলক আলোচনার পূর্বে দুটি মৌলিক বিষয়কে বিশেষভাবে স্মরণ রাখতে হবে। এদের মধ্যে প্রথমটি হলো প্রাচীন বিজ্ঞানীগণ উপাদানের সংজ্ঞা বর্ণনা করতে গিয়ে বলেছেন যে, “হায়ওয়ানাত ও নাবাতাত” বা জীব ও উদ্ভিদ এবং “জমাদাত” বা জড় পদার্থের আজায়ে উলিয়া বা প্রাথমিক ভিত্তি হলো উল্লিখিত চারটি মৌলিক উপাদান। অর্থাৎ জীব, উদ্ভিদ ও জড় জগতের অস্তিত্বের মূলে অপরিহার্যভাবে এ চারটি মৌলিক উপাদান অংশগ্রহণ করে থাকে। এ সংজ্ঞার ভিত্তিতেই আমরা এমন কোনও বস্তু নিয়ে আলোচনা করব, যা অপরিহার্যভাবে সৃষ্টি গঠনে অংশগ্রহণ করেনি।
দ্বিতীয়টি হলো, প্রাচীন প্রকৃতি বিদ্যায় বার বার ব্যাখ্যা দেয়া হয়েছে যে, চারটি মৌলিক উপাদানের ব্যাপারে আমরা আমাদের পরিবেশ ও পারিপার্শ্বিকতার বায়ু, মাটি, পানি ও আগুনকে নিয়ে চিন্তা করি না। কেননা এগুলোতে মিশ্রণ রয়েছে। সুতরাং উল্লিখিত চারটি মৌলিক উপাদান নিজ নিজ প্রকৃত অবস্থা নিয়েই সৃষ্টির গঠনে সংযুক্ত হয়েছে।
উল্লিখিত দুটি বিষয়কে সামনে রেখে যদি আমরা অগ্রসর হই তবে প্রাচীন ও আধুনিক উপাদানের মধ্যে সমন্বয় সাধন কোনও কঠিন ব্যাপার নয়।
সৃষ্টির তিনটি ধারা হতে যদি আমরা জড় পদার্থকে পৃথক করেই দেই (যদিও তা অনেক আধুনিক গবেষকদের মতে চারটি উপাদানেই সমষ্টি) এবং অন্যান্য গঠনের ব্যাপারে চিন্তা করি, তবে বোঝা যাবে যে, তাদের অধিকাংশেই উল্লিখিত চারটি উপাদানের উপস্থিতি দিবালোকের মতই সত্য। “হেমজীন” বা দাহ্য পদার্থ, (অক্সিজেন), “আবকরীন” বা ক্ষার জাতীয় পদার্থ (নাইট্রোজেন), “মা-ঈন” বা পানি জাতীয় পদার্থ (হাইড্রাজেন), “মুহমীন” বা কয়লা জাতীয় পদার্থ (কার্বন) ইত্যাদির যদিও আধুনিক বিজ্ঞান ব্যাখ্যা দিয়েছে যে, পানি দাহ্য ও কয়লাজাতীয় পদার্থ, জৈবিক ও উদ্ভিদের পেশীজাতীয় তন্ত্রী এবং অন্যান্য নামীয় যোজন বা “মুরাককাব”সমূহের অংশ-হাড়। পক্ষান্তরে ক্ষার জাতীয় পদার্থ (নাইট্রোজেন) জৈবিক ও উদ্ভিদ পেশীতন্ত্রীতে এককভাবে অংশগ্রহণ করেনি বটে, তবে এতে সন্দেহ নেই যে, “আবকরীন” বা ক্ষারজাতীয় পদার্থ (নাইট্রোজেন) উল্লিখিত পেশীতন্ত্রীর প্রয়োজনীয় ও স্থায়ী গঠনে নিশ্চিতভাবে অংশগ্রহণ করে থাকে।
আধুনিক বিজ্ঞান এ রহস্যকে উদ্ঘাটন করার জন্য বিভিন্ন দ্রব্য নিয়ে গবেষণা করেছে প্রচুর। সুতরাং এ ব্যাপারে নিম্নের কোনও কোনটির দৃষ্টান্ত লিপিবদ্ধ করা হলো।
শুষ্ক কাঠে নিম্নলিখিত অংশ পাওয়া যায়। যেমন “মুহমীন” বা কয়লাজাতীয় (কার্বন) ৫৫ শতাংশ, “মা-ঈন” বা পানিজাতীয় পদার্থ (হাইড্রোজেন) ৬ শতাংশ, “হেমজীন” বা দাহ্য পদার্থ (অক্সিজেন) ও “আবকরীন” বা ক্ষারজাতীয় পদার্থ (নাইট্রোজেন) ৪৪ শতাংশ ৷
যখন উদ্ভিদ পচন আসে বা পচে যায়, তখন তাতে সাধারণত নিম্নলিখিত অংশসমূহের উপস্থিতি পাওয়া যায়। যেমন : “মুহমীনও বা কয়লাজাতীয় পদার্থ (কার্বন) ৫৮ শতাংশ। “মা-ঈন” বা পানি জাতীয় পদার্থ (হাইড্রোজেন) ৫ শতাংশ । “হেমজীন" বা দাহ্য পদার্থ (অক্সিজেন) ও “আবকরীন” বা ক্ষারজাতীয় পদার্থ (নাইট্রোজেন) ৩৭ শতাংশ। জ্বালানোর পর তথায় সাধারণত ১ শতাংশ “আরদীন” বা মাটি (ইথিয়াম) পাওয়া যায় ।
“মাওয়াদে লাহসিয়াহ” বা মাংসল পদার্থে নিম্নলিখিত অংশসমূহের উপস্থিতি থাকে। যথা ঃ “হেমজীন” বা দাহ্য পদার্থ (অক্সিজেন) ২৯ শতাংশ, “মা-ঈন” বা পানিজাতীয় পদার্থ (হাইড্রোজেন) ৫ শতাংশ। “আবকরীন” বা ক্ষারজাতীয় পদার্থ (নাইট্রোজেন) ৪ শতাংশ। “মুহমীন” বা কয়লাজাতীয় পদার্থ (কার্বন) ১২ শতাংশ । তা ছাড়া নিতান্ত অল্প মাত্রায় অর্থাৎ ০০ শতাংশ “কিবরীত” বা গন্ধকও (সালফার) থাকে ।
উল্লেখিত আলোচনার দ্বারা বোঝা গেল যে, অধিকাংশ “মুরাককাবাত” বা যোজনে উক্ত চারটি মৌলিক উপাদানই ক্রিয়াশীল। সুতরাং প্রাচীন বিজ্ঞানীগণ যে উপাদান- সমূহকে আগুন, বায়ু, মাটি ও পানি নামে পরিচিত করেছেন, তাদেরকেই আধুনিক বিজ্ঞান, অক্সিজেন, নাইট্রোজেন, কার্বন ও হাইড্রোজেন নামে আখ্যায়িত করে থাকেন ।
প্রাচীন বিজ্ঞানীগণ আমাদের পরিবেশের উপাদানসমূহকে মিশ্রণের সমষ্টি বলে উল্লেখ করেছেন। তবে উক্ত উপাদানের “বসীত”, বা মৌলিক রূপ আমাদের দেহে রয়েছে। অক্সিজেন দ্বারা আগুনের অস্তিত্ব, নাইট্রোজেন দ্বারা বায়ুর অস্তিত্ব, হাইড্রোজেন দ্বারা পানির অস্তিত্ব ও কার্বন দ্বরা মাটির অস্তিত্বকে স্বীকার করে নিয়েছেন।
এ স্থানে একটি বিষয় পরিষ্কার হওয়া প্রয়োজন যে, প্রাচীন বিজ্ঞানিগণও চারটি মৌলিক উপাদানের ব্যাপারে একমত ছিলেন না। এদের মধ্যে এক সম্প্রদায়ের মত, “আনাসের” বা মৌলিক উপাদান তিনটি যথা :- জামেদ” বা শক্ত (থলিট), “সাইয়াল” বা তরল (ফ্লোয়েড) ও “রীয়াহ” বা বায়বীয় (গ্যাস)। “আনাসের আরবাআ” বা চারি উপাদান উল্লিখিত তিনটি উপাদান দ্বারাই যোজিত। সুতরাং পানিতে 'উনসুরে সাইয়াল' বা তরল উপাদানের প্রভাব বেশি। আবার বায়ুতে উনসুরে রীহী বা বায়বীয় উপাদান এবং ঊনসুরে সাইয়ালী বা তরলীয় উপাদান। অতঃপর মাটিতে 'উনসুরে জামেদী' বা শক্ত উপাদান এবং আগুনে উনসুরে নারী বা দাহ্য উপাদান ইত্যাদির প্রভাব বেশি। এ মতবাদ অনুযায়ী প্রাচীন ও আধুনিক বিজ্ঞানের সমন্বয় সাধনে কোনও প্রকার সংশয়ের কিছু থাকে না।
উল্লিখিত আলোচনার দ্বারা মনে হয় আধুনিক বিজ্ঞান উক্ত মতবাদকে সর্বসম্মত মতবাদের উপর স্থান দিয়েছে। এ মতবাদ অনুযায়ী যেমন একদিকে চার মৌলিক উপাদানের প্রমাণ করার প্রয়োজন হয় না, অন্যদিকে চারটি উপাদানের আধুনিক সংস্করণ প্রাচীন দৃষ্টিভঙ্গির অনুরূপই মনে হয়। সুতরাং উল্লিখিত মতবাদের ব্যাখ্যা ও আধুনিক মতবাদের ব্যাখ্যাকে আমরা এ হিসেবে সমন্বয় সাধন করতে পারি। যেমন ঃ “উনসুরে জামেদ” বা শক্ত উপাদান অর্থে শক্ত বস্তু কার্বন “উনসুরে সাইয়াল” বা তরল উপাদান অর্থে তরল বস্তু হাইড্রোজেন, “উনসুরে রীহী' বা বায়বীয় উপাদান অর্থে বায়বীয় বস্তু অক্সিজেন। এ মতবাদের ব্যাখ্যা মতে পানিতে “উনসুরে সাইয়ালের” (হাইড্রোজেন), মাটিতে “উনসুরে জামাদের” (কার্বন) ও আগুনে “উনসুর রীহীর” (অক্সিজেন) প্রভাব অধিক থাকে এবং বায়ুতে উনসুরে রীহী” ও উনসুরে সাইয়ালী” উভয়েই মিলিত থাকে ।
বায়ুর ব্যাপারে প্রথমেই আলোচনা করা হয়েছে যে, তাতে “হেমজীন” বা অক্সিজেন ব্যতীতও আবদ্ধ বাষ্প উপস্থিত থাকে এবং তা সন্দেহাতীতভাবে হাইড্রোজেন ।
প্রকাশ থাকে যে, কোনও কোনও প্রাচীন বিজ্ঞানী “উনসুরে রীহী” বা বায়ুর উপাদানকে (গ্যাস) দুভাগে ভাগ করেছেন। যেমন : যদি বায়ু উগ্রতায় প্রভাবিত না হয়, তবে তা প্রকৃত বায়ুরূপে গণ্য হবে। আর যদি তা উগ্রতা প্রভাবিত হয়, তবে তা আগুন হিসেবে পরিচিত হবে। এ অবস্থায় প্রয়োজনীয় উপাদান থাকে মাত্র তিনটি I
অর্থাৎ “উনসুরে রীহী” বা বায়বীয় পদার্থ (অক্সিজেন), “উনসুরে মা-য়ী” বা পানীয় পদার্থ হাইড্রোজেন “উনসুরে আরদী" বা মাটি জাতীয় পদার্থ (কার্বন)- এই তিনটি হতেই “মুরাককারাত” বা যোজন এবং জৈবিক উদ্ভিদজনিত দৈহিক তন্ত্ৰী গঠিত হয়। তা ছাড়া শ্বেতসার জাতীয় রসে “আবকরীন” বা ক্ষারজাতীয় পদার্থ (নাইট্রোজেন) পাওয়া যায় না, তাই যারা তিনটি উপাদানে বিশ্বাসী তাদের মতবাদই আধুনিক বিজ্ঞানীদের একান্ত কাছের মতবাদ বলে মনে হয় ।

FOR MORE CLICK HERE
NTRCA COLLEGE LEVEL HISTORY/ইতিহাস গাইড/ বেসরকারি শিক্ষক নিবন্ধন ইতিহাস
১০ তম বিসিএস -৪৪তম বিসিএস এর প্রশ্ন ও সমাধান 10th BCS to 44th Bcs MCQ Question Solution
বিসিএস ব্যাংক প্রাইমারি পরীক্ষার-এর প্রশ্ন ও সমাধান
সার্চ ইঞ্জিন অপটিমাইজেশন SEO বই লেখক : মোঃ মিজানুর রহমান
মাতৃস্বাস্থ্য/Motherhood
ওষুধ নির্দেশিকা
সহীহ বুখারী শরীফ হাদিস আরবি বাংলা (৭৫৬৩ টি হাদিস)
সহীহ মুসলিম শরীফ হাদিস আরবি বাংলা (৭৪৫৩ টি হাদিস)
সুনানে তিরমিজি শরীফ হাদিস আরবি বাংলা (৩৯৫৬ টি হাদিস)
সুনানে নাসায়ী শরীফ হাদিস আরবি বাংলা (৫৭৫৮ টি হাদিস)
সুনানে ইবনে মাজাহ শরীফ হাদিস আরবি বাংলা (৪৩৪১ টি হাদিস)
সুনানে আবু দাউদ শরীফ হাদিস আরবি বাংলা (৫২৭৪ টি হাদিস)

Copyright © Quality Can Do Soft.
Designed and developed by Sohel Rana, Assistant Professor, Kumudini Government College, Tangail. Email: [email protected]