জলজ বিভীষিকা আর্সেনিক Causes and remedy of Ar-senicosis

জলজ বিভীষিকা আর্সেনিক
নিক্সন তালুকদার
অগণিত প্রাকৃতিক দুর্যোগ কবলিত এই বাংলাদেশে সাম্প্রতিককালে আর্সেনিক দূষণ সৃষ্টি করেছে ভয়াবহ এক পরিস্থিতি। আমরা জানি, পানির অন্য নাম জীবন। দুঃখজনক হলেও সত্য, এই পানিই একসময় মরণের কারণ হয়ে যায়। আর্সেনিক দূষিত পানিই তার অন্যতম প্রমাণ। ইদানীং এই আর্সেনিক একটি অন্যতম ভয়াবহ বিভীষিকারূপে আবির্ভূত হয়েছে।
একটা সময় ছিলো যখন এদেশে বিশুদ্ধ পানির অভাবে অনেক পানিবাহিত রোগে বহু লোকের প্রাণহানি ঘটতো। পরবর্তীকালে এসব রোগের আক্রমণ থেকে রক্ষার জন্য আমাদের দেশের প্রায় ৯৭% মানুষকে নলকূপের বিশুদ্ধ পানির আওতায় আনা হয়। কিন্তু সেই নিশ্চিত নিরাপত্তার নলকূপই এখন ছড়াচ্ছে এক মরণ-বিষ। নলকূপের পানিকেই আমরা সবাই নিরাপদ ভাবতাম। সময়ের বিবর্তনে বহু ক্ষেত্রে এই নলকূপের পানিই আজ সবচে বেশি অনিরাপদ। সেই নলকূপ আজ আক্রান্ত হয়েছে আর্সেনিক দূষণে- যা থেকে পরিত্রাণের তেমন কোন নির্ভরযোগ্য প্রতিষেধক আজ পর্যন্ত আবিষ্কৃত হয়নি। তবে এ বিষয়ে বিস্তর গবেষণা চলছে এবং এ বিষয়ে সফলও হচ্ছে কমবেশি। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) নলকূপের পানিতে ০.০১ থেকে ০.০৫ মিলিগ্রাম পর্যন্ত আর্সেনিক মানুষের জন্য সহনীয় বলে ঘোষণা করেছে। তবে ইদানীং এর চেয়ে বেশি যাচ্ছে বলেই গুরুতর সমস্যা সৃষ্টি হয়েছে।
আর্সেনিক কি তা আগে জানা দরকার। প্রকৃতিতে আর্সেনিককে মুক্ত-মৌল হিসেবে সাধারণত পাওয়া যায় না। আর্সেনিক একটি সর্বব্যাপ্ত উপাদান, যা প্রকৃতপক্ষে একটি মারাত্মক বিষ। বিষধর সাপের বিষে আর্সেনিকের উপাদান রয়েছে। এ ছাড়াও প্রকৃতির আরো অনেক উৎসের মাঝে আর্সেনিক রয়েছে। আর্সেনিক স্ফটিকের মতো একটি ভঙ্গুর ধাতব মৌল – যা ফিকে, ধূসর ও সাদা বর্ণের হয়ে থাকে। পর্যায় সারণীতে এর অবস্থান ৫নং গ্রুপে। এর আণবিক সংখ্যা ৩৩ এবং আনবিক ওজন ৭৪.৯২। রাসায়নিক বিক্রিয়ায় সক্ষম মৌলিক পদার্থ হিসেবে একটি অন্য পদার্থের সাথে রঞ্জনের মাধ্যমে আত্মপ্রকাশ করে থাকে। ৭৬ মিলিগ্রামের একটি পুরিয়া (আর্সেনিকের) একটি বা হ্যাপা ও হলগাম
মানুষের জীবননাশের জন্য যথেষ্ট। সারা পৃথিবীতে তেরটির মতো আর্সেনিক যৌগের উপস্থিতি বিদ্যমান। তবে মূলত তিনটি খনিজ (Mineral) পদার্থকে আর্সেনিকের আকর (Ore) হিসেবে গণ্য করা হয়। এগুলো অতি সহজলভ্য এবং পরিমাণেও অত্যধিক। এই তিনটি খনিজ হচ্ছে- (১) রিয়ালগার (Realgar) বা আর্সিনিক সালফাইড (২) অরপিমেন্ট বা আর্সেনিক ট্রাই সালফাইড (৩) আনোসোপাইরাইট বা আয়রণ আর্সেনিক সালফাইড। এসব খনিজের গন্ধ কাঁচা রসুনের মত, তবে আর্সেনিকযুক্ত পানিতে এ ধরনের গন্ধ পাওয়া যায় না। তাই এটা ধরা পড়ে না সহজ। আর আর্সেনিকযুক্ত পানিকে আলাদা করারও তাৎক্ষণিক সহজসাধ্য কোনও উপায় নেই । দেশের প্রায় সব অঞ্চলে গভীর নলকূপ থেকে, কোথাও বা অগভীর নলকূপ থেকে আর্সেনিকযুক্ত পানি নির্গত হচ্ছে বলে খবর পাওয়া যায়। দেশের বেশীর ভাগ মানুষ আজ আর্সেনিক দূষণে আক্রান্ত হবার ঝুঁকি নিয়ে মানবেতর দিনাতিপাত করছে। আর্সেনিক বিষের মাত্রা ১২৫ মিলিগ্রাম। এমনকি পারদের চেয়েও যা ৪গুণ বেশি শক্তিশালী। আর্সেনিক বিক্রিয়ার ফলে যেসব উপসর্গ বা রোগ বালাই দেখা দিতে পারে, তার মধ্যে রয়েছে— প্রাথমিক পর্যায়ে (ক) চামড়ার রং কালো হয়ে যাওয়া (ছোট ছোট কালো দাগ বা সম্পূর্ণ কালো হয়ে যাওয়া (মেলানোসিস), (খ) চামড়া শক্ত ও খসখসে হয়ে যাওয়া (বিশেষ করে হাত ও পায়ের তালু (কেরাটোসিস), (গ) চোখ লাল হয়ে যাওয়া (কনজাংটিভাইটিস) (ঘ) শ্বাসতন্ত্রের প্রদাহ (ব্রঙ্কাইসিক), (ঙ) বমি বমি ভাব, বমি ও পাতলা পায়খানা (প্যাস্ট্রোএন্টারাইটিস)। দ্বিতীয় পর্যায়ে (ক) ত্বকের বিভিন্ন স্থানে সাদা-কালো দাগ (লিউকোমেলানোসিস), (খ) হাত পায়ের তালুতে শক্ত গুটি ওঠা (হাইপারকেরাটোসিস) (গ) পা ফুলে যাওয়া (নন্পিটিং ইডেমা), (ঘ) প্রান্তীয় স্নায়ুরোগ (পেরিফেরাল নিউরোপ্যাথি), (ঙ) কিডনি ও লিভারের জটিলতা (কার্যক্ষমতা লোপ পাওয়া) । তৃতীয় পর্যায়ে (ক) দেহের প্রান্তদেশীয় অংশের পচন (গ্যাংগ্রিন), (খ) ত্বক, মুত্রথলি ও ফুসফুকের ক্যান্সার ইত্যাদি।
আক্রান্ত ব্যক্তির চুল ও নখ পরীক্ষার মাধ্যমে আর্সেনিকের অস্তিত্ব প্রমাণ করা যায়। কারণ শরীরস্থ আর্সেনিকের একটা বড় অংশ চুল ও নখে এসে জমা হতে থাকে। তবে আর্সেনিকযুক্ত পানি পান করার সাথে সাথেই এর উপসর্গ ধরা পড়বে না। এর উপসর্গগুলো
প্রকাশ হতে কখনও বা কারো কারো ক্ষেত্রে ৫ থেকে ১০ বছর সময় লাগতে পারে । আর্সেনিকোসিস নামের এই ভয়াবহ রোগটি সম্পর্কে চিকিৎসা বিজ্ঞানীদের কিছুটা ধারণা থাকলেও বিস্তরভাবে তা জনগোষ্ঠীকে আক্রান্ত করতে পারে— এমন ধারণা কিছু দিন আগেও কারো ছিল না। ভূ-গর্ভস্থ পানিতে আর্সেনিকদূষণ ইতিপূর্বে বিশ্বের কয়েকটি দেশে দেখা দিয়েছিল। যেমন- তাইওয়ান, আর্জেন্টিনা, আলাস্কা, চিলি, মেক্সিকো, ঘানা, হাঙ্গেরীতে। তবে তা আশঙ্কাজনক ব্যাপক আকারে নয় ।
ইদানীং বাংলাদেশে আর্সেনিক এক ভয়াবহ পরিস্থিতি সৃষ্টি করলেও জনসাধারণের মধ্যে এ ব্যাপারে তেমন সচেতনতা বিশেষ লক্ষণীয় নয়। শিক্ষার অনগ্রসরতাই এর অন্যতম প্রধান কারণ। এছাড়া সামাজিক কারণে, লোকলজ্জার ভয়েও অনেকে, বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলে মহিলারা অতি গুরুত্ব বিষয়টি যথাসম্ভব চেপে রাখে। দেশের অনেক প্রত্যন্ত অঞ্চলে আর্সেনিক আক্রান্ত মেয়েদের পর্দার আড়ালে রাখা হয়। ছোঁয়াচে না হলেও আর্সেনিকআক্রান্ত রোগীর পারিবারিক ও সামাজিক বন্ধনও অনেক ক্ষেত্রে শিথিল হয়ে পড়ছে। আর্সেনিকের এই বহুমুখী সমস্যাটি নিয়ে দেশের শিক্ষিত সচেতন মানুষ, সমাজবিজ্ঞানী স্বাস্থ্যকর্মী ও পরিবেশ বিজ্ঞানীরা খুবই উদ্বিগ্ন।
বাংলাদেশে ভূ-গর্ভস্থ পানিতে সর্বপ্রথম আর্সেনিকের দূষণ ধরা পড়ে প্রকৃতপক্ষে আজ থেকে ১৮ বছর আগে এদেশের উত্তর পশ্চিমাঞ্চলে। তারপর থেকে দেশের প্রায় ৮ কোটি মানুষ আর্সেনিক সমস্যায় আক্রান্ত হয়েছে। দেশের প্রায় ১৫টি জেলায় অতি মাত্রায় ও ১৫টি জেলার স্বল্পমাত্রায় আর্সেনিকের প্রভাব রয়েছে। আর বিশেষ খবর এই এ সকল চিহ্নিত এলাকা থেকে এ পর্যন্ত ১০ সহস্রাধিক আর্সেনিক রোগী সনাক্ত করা হয়েছে।
আর্সেনিকবিশেষজ্ঞ ও বিজ্ঞানীদের অভিমত অনুযায়ী বিষক্রিয়া মারাত্মক হবার অন্যতম মূল কারণ হচ্ছে ভূগর্ভস্থ পানির অতিরিক্ত ব্যবহার। কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের তথ্য অনুযায়ী দেশে প্রায় ৮২ লাখ হেক্টর আবাদযোগ্য জমির প্রায় ৪০ শতাংশই সেচ ব্যবস্থার অধীন। সেচের কাজে ব্যবহার করা হয় ৭০ শতাংশ ভূগর্ভস্থ ও ৩০ শতাংশ ভূপৃষ্ঠের পানি। ভূগর্ভস্থ পানিতে সেচ কাজের পরিমাণ দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। সেই সাথে খাবার পানি ও গৃহস্থালীর কাজে দেশে প্রায় ২৫ লক্ষ টিউবয়েল ও ৫ লক্ষাধিক বিভিন্ন ধরনের গভীর-অগভীর নলকূপে পানি উত্তোলন করা হয়। সর্বনাশা ফারাক্কার কারণে শুষ্ক মৌসুমে আবাদী জমির সেচ ব্যবস্থা নির্ভর করে ভূগর্ভস্থ পানির ওপর। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, ভূগর্ভস্থ পানি এই অতিরিক্ত উত্তোলনের ফলে এর আর্সেনোপাইরাইট খনিজ পদার্থ পানিতে দ্রবীভূত হয়ে বিষক্রিয়া ঘটাচ্ছে। এ কারণে বিশেষজ্ঞ ও বিজ্ঞানীরা আর্সেনিক বিষক্রিয়া প্রতিশোধনের পাশাপাশি ভূগর্ভস্থ পানির ব্যবহার, বণ্টন, সংরক্ষণ সম্পর্কে বিজ্ঞানসম্মত নীতি প্রণয়ন অত্যন্ত জরুরী বলে অভিমত ব্যক্ত করেছেন। তবে সরকার এ ব্যাপারে কার্যকর তেমন কোনও ব্যবস্থা নিতে পারেনি। যার ফলে দেশজুড়ে আর্সেনিকের ব্যাপকতা বেড়েই চলেছে। আর্সেনিক আক্রান্ত রোগী এবং মৃত্যুর সংখ্যাও সংশ্লিষ্ট দপ্তর থেকে যথাসময়ে পাওয়া যাচ্ছে না। নিঃশব্দ ঘাতক এই আর্সেনিক নিয়ে হৈ চৈ হচ্ছে অনেক দিন থেকেই অথচ এর প্রতিরোধ ব্যবস্থা সীমাবদ্ধ রয়েছে কেবল দায়সারা গোছের পানি পরীক্ষা-নিরীক্ষা এবং সাড়ম্বর জরিপ কর্মসূচির মধ্যে। সরকার করার মধ্যে করেছে ভিটামিন এ. ই. সি. ট্যাবলেট, ক্লোট্রিমাজল ক্রিম ও আর্সেনিকমুক্তকরণ কেমিক্যাল ও প্রচারপত্র বিতরণ ও গণমাধ্যমে অবহিতকরণ। ডাক্তার ও স্বাস্থ্যকর্মীকে ট্রেনিংও দিয়েছে সরকার এই কাজে। বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চল এবং দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলীয় জেলাগুলোতে আর্সেনিকের ব্যাপকতা তুলনামূলকভাবে অত্যন্ত বেশি। বৃহত্তর রাজশাহী, ফরিদপুর, খুলনা, যশোর, কুষ্টিয়া এ ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য। বিভিন্ন বিদেশী সংস্থার বিশেষ প্রতিনিধি দল এসব আর্সেনিক-উপদ্রত এলাকা সরেজমিন পরিদর্শনও করেছেন। সঙ্গে ছিলেন দেশের উচ্চ পর্যায়ের বিশেষজ্ঞ, বিজ্ঞানী ও জনস্বাস্থ্য প্রকোশল অধিদপ্তরের ব্যক্তি। তাদের সমন্বিত প্রতিবেদনের ভিত্তিতে দেশের কটি অঞ্চলে আর্সেনিক রিম্যুভার মুভম্যান্ট প্লান্ট স্থাপনের কার্যক্রম বাস্তবায়িত হচ্ছে না। নেদারল্যান্ড সরকারের সহায়তায় মেহেরপুরে ১৮-শহর বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ প্রকল্পটির অবস্থা এ ক্ষেত্রে একটি উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করা যায়। বাংলাদেশের পানিতে আর্সেনিকের মাত্রা নির্ভুলভাবে পরিমাপ করার জন্য ‘আর্সেনেটর' নামে নতুন উদ্ভাবিত একটি যন্ত্র ব্যবহারের কথা বলেছে UNICEF. অস্ট্রিয়ার রসায়নবিদ ড. কসমাস এই যন্ত্রটির উদ্ভাবক। প্রায় ৩ হাজার ডলার মূল্যের এই যন্ত্রটির সাহায্যে মাত্র ১৫ মিনিটের মধ্যে পানিতে আর্সেনিকের মাত্রা নির্ভুলভাবে পরিমাণ করা সম্ভব বলে জানানো হয়। ব্যাটারী চালিত এই যন্ত্রের সাহায্যে ০.৫ পিপিবি (পার্টস পার বিলিয়ন) পর্যন্ত আর্সেনিক পরিমাপ করা যায়। তবে দেশের মোট কত শতাংশ নলকূপ থেকে আর্সেনিক নির্গত হয়, তার যথার্থ - পরিসংখ্যান এখনও পাওয়া যায়নি। পরিস্থিতি যে ভয়াবহ এবং বিপজ্জনক সে ব্যাপারে সন্দেহের অবকাশ নেই। বিশেষজ্ঞদের অভিমত এবং সাম্প্রতিক জাপানভিত্তিক এশিয়া নেটওয়ার্ক-এর জরিপ এবং বৃটিশ দাতা সংস্থা অক্সফার্মের রিপোর্টে এমন আশঙ্কা ব্যক্ত হয়েছে। বাংলাদেশে ভয়াবহ আর্সেনিক দূষণ ঘটনাটি স্বভাবতই আন্তর্জাতিক মিডিয়াগুলোকেও আকৃষ্ট করেছে। বিভিন্ন টি. ভি স্যাটেলাইট চ্যানেল ছাড়াও ওভারসীজ প্রিন্ট মিডিয়ায় এ নিয়ে অনেক প্রচার ও লেখালেখি হয়েছে ও হচ্ছে। নিউইয়র্ক টাইমস্ পত্রিকায় এ নিয়ে '৯৮ সালে একটি বিশেষ রিপোর্ট প্রকাশ পেয়েছে। যাতে বাংলাদেশের সাম্প্রতিক আর্সেনিক দূষণের ভয়াবহ পরিস্থিতি বিস্তারিত ও বিশ্লেষণাত্মকভাবে ফুটে উঠেছে। (Barry Bearak লিখিত (Death by Arsenic : Natural poison in water spreads disaster in Bangladesh
রিপোর্টে বাংলাদেশের সাম্প্রতিক আর্সেনিক দূষণকে ইতিহাসের সবচে' বড় 'গণ বিষক্রিয়া' বলে বর্ণনা করা হয়েছে। এই মন্তব্য করা হয়েছে আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞদের অভিমত উদ্ধৃত করে।
সাংবাদিক Barry Bearak বাংলাদেশের বিভিন্ন আর্সেনিক-উপদ্রুত অঞ্চলে সরেজমিন সফর শেষে এই রিপোর্টটি তৈরি করেছেন। প্রত্যন্ত এলাকা পরিদর্শনকালে তিনি অসংখ্য আর্সেনিক আক্রান্ত মানুষের সাথে কথা বলেছেন। প্রত্যক্ষ করেছেন তাদের বিশেষ ফোস্কা পড়া এবং ঘা ও কালো দাগ-সম্বলিত হাত-পা, যা তার কাছে একটি ভয়াবহ ও মর্মন্তুদ দৃশ্য বলে মনে হয়েছে। খাবার পানিতে আর্সেনিক দূষণে সর্বোচ্চ ক্যান্সারের ঝুঁকি রয়েছে - বলেছেন ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের এপিডি মিউলজিস্ট (ত্বক বিশেষজ্ঞ) ড. এ্যাল্যান এইচ স্মিথ - যিনি ১৯৯৮ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার জন্য বাংলাদেশের ওপর তিনটি গবেষণা তৈরি করেছেন। বিশ্ব ব্যাংকের হাইড্রোলজিস্ট বাবর এন কবির এক সমীক্ষায় দেখেছেন যে, বাংলাদেশের ৬৪টি জেলার ৪৯টিতে ২৫ মিলিয়নেরও বেশি মানুষ আর্সেনিকের বিষক্রিয়ায় গুরুতর আক্রান্ত। এটা যদি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে হতো তাহলে সেখানে রাষ্ট্রীয় প্রতিরক্ষা ব্যবস্থায় প্রত্যেকের জন্য বোতলজাত পানি সরবরাহ করা হতো। বাংলাদেশ অত্যন্ত গরীব দেখে বাংলাদেশের সে সামর্থ্য নেই।
এদেশের অধিকাংশ মানুষ দারিদ্র সীমার নিচে বাস করে এবং এখানকার ৯০ শতাংশ মানুষ কৃষক, ৬০ শতাংশেরও বেশি মানুষ অশিক্ষিত এবং সরকারি চিকিৎসা ব্যবস্থার চিত্রও অত্যন্ত করুণ! বাংলাদেশের পল্লী এলাকায় চিকিৎসা কাজে নিয়োজিত ডাঃ কাজী কামরুজ্জামান এবং মাহ্মুদুর রহমানও জানালেন সে কথা। তারা দেখেছেন যে, কেবল শারীরিক সমস্যাই নয় নানাবিধ পারিবারিক ও সামাজিক বিপর্যয়ও দেখা দিয়েছে আর্সেনিকের কারণে। আর্সেনিক আক্রান্ত লোকজন একঘরে হয়ে যাচ্ছে। অনেক দম্পতি হয়ে যাচ্ছে বিচ্ছিন্ন। কুমারীদের হচ্ছে না বিয়ে। একটা বিক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া এসেছে কাজী মতিন আহমেদ নামে একজন বিজ্ঞানীর কাছ থেকে - যিনি বৃটিশ জিওলজিক্যাল সার্ভের পক্ষে গবেষণা কর্ম করছেন। তিনি অত্যন্ত ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। আর্সেনিক দূষণ প্রতিরোধে সরকারি ব্যবস্থাপনায় নলকূপের পানিকে দূষণমুক্ত করতে কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণের তাগিদ দিয়েছেন তিনি। কেননা, প্রত্যন্ত অঞ্চলের আর্সেনিক আক্রান্তরা অভিযোগ করে যে, ঢাকা থেকে অনেকেই আসে নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য পরে আর কোনও খবর রাখে না। সরকারি মহলও না, এনজিও রাও না। অথচ বর্তমানে দেশে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর, পানি উন্নয়ন বোর্ড, কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগ, নিপসম, এশিয়া আর্সেনিক নেটওয়ার্ক, ঢাকা কমিউনিটি এবং বেশ কটি বেসরকারি সংস্থা এ বিষয়ে কাজ করে যাচ্ছে। এর মধ্যে কিছু ব্যতিক্রমী ও কার্যকর উদ্যোগ নিয়েছিল ঢাকা কমিউনিটি হাসপাতাল। এর মধ্যে একটি হচ্ছে নিয়মতি ভিটামিন 'এ' ও 'সি' সেবন। এ দুটি ভিটামিনের অভাব হলে আর্সেনিকআক্রান্তদের অবস্থার অবনতি ঘটতে থাকে বলে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান।
এদিকে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে যে, কেবল গ্রামাঞ্চল বা প্রত্যন্ত এলাকার লোকজনই এই আর্সেনিকের শিকার নয় নগর এলাকায় বসবাসকারী অভিজাত ব্যক্তিরাও আর্সেনিকের আক্রমণের বাইরে নয়, সম্প্রতি মালয়েশিয়ার সাবেক উপপ্রধানমন্ত্রী আনোয়ার ইব্রাহীম-এর শরীরেও আর্সেনিকের দূষণ পাওয়া গেছে । সম্পূর্ণ দেশজ প্রযুক্তিতে নামমাত্র খরচে আর্সেনিক দূষিত পানিকে বিশুদ্ধ করার একটি পদ্ধতি অতি সম্প্রতি বাংলাদেশে উদ্ভাবিত হয়েছে। এই প্রযুক্তিটি উদ্ভাবন করেছেন বেসরকারি গংগঠন এলাজিং অ্যাজমা এনভায়রনমেন্টাল রিসার্চ এনড্ঙ্কিন কেয়ার ইনস্টিটিউট-এর প্রেসিডেন্ট ডাঃ এম. এ. হাসান। এতে পানি আর্সেনিক দূষণমুক্ত করতে দরকার শুধু ধানের তুষ বা নারকেলের মালা (খোল) কিংবা ছোবড়া পোড়ানো ছাই। এ পদ্ধতি অনুযায়ী নারিকেলের ছোবড়া, মালা বা ধানের তুষের যে কোনও একটি পুড়িয়ে ছাই করতে হবে। এই ছাই চালনিতে ঢেলে সংরক্ষণ করতে হবে শুকনো পাত্রে। একমুঠো ছাইয়ের মধ্যে আধমুঠো পরিমাণ ফিটকিরি আর্সেনিকযুক্ত ৪ লিটার পরিমাণ পানিতে মিশিয়ে ১২ ঘন্টা রেখে দিলেই পানির আর্সেনিক আলাদা হয়ে যাবে। তবে ১২ ঘন্টা না রেখে এরচেয়ে অল্প সময় আর্সেনিক বিযুক্ত করার একটি প্রক্রিয়াও ডাঃ হাসান উদ্ভাবন করেছেন। ছাই ও ফিটকিরিমিশ্রিত পানি ১০ মিনিট ফুটিয়ে ফিল্টারে ছেকে নিলেও পানি আর্সেনিকমুক্ত হবে। এই পদ্ধতি অনুযায়ী পানি ফিল্টার করার জন্য ৩টি পাত্র দরকার হবে। প্রথম পাত্রের তলায় পরিষ্কার কাপড়, মাপের ও দু'ইঞ্চি পুরো করে বালি দিয়ে ফিল্টার তৈরি করতে হবে । দ্বিতীয় পাত্রে ফিল্টার বানাতে হবে কাপড়ের ওপর ৩ইঞ্চি পুরো করে বালি দিয়ে। এ দুটি পাত্রের তলাতেই ছিদ্র থাকবে- যাতে পানি নিচে নামতে পারে। সবচেয়ে নিচে থাকবে বিশুদ্ধ পানি ধারণ করার পাত্র। প্রথম পাত্রে ছাই ও ফিটকিরি দিয়ে ফোটানো বা থিতানো পানি ঢাললে ধীরে ধীরে তা সংক্রমণমুক্ত হয়ে তৃতীয় পাত্রে জমা হবে ।
এদিকে ডাঃ হাসান ১৯৯৯ সনের ২৩ শে সেপ্টেম্বর ঢাকার সিরডাপ মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত সেমিনারে তার এই প্রযুক্তি ব্যাখ্যা করার এক পর্যায়ে এই কার্যক্রমে সরকারি সহায়তা না পাওয়ার সমালোচনা করে বলেন- বিদেশী প্রতিষ্ঠান এমনকি জাতিসংঘ পর্যন্ত পরামর্শ চাইলে এগিয়ে আসে। আর্সেনিক সমস্যা সমাধানে সরকারকে আন্তরিক মনোভাব নিয়ে এগিয়ে আসার আহবান জানান। তিনি বলেন- তার উদ্ভাবিত এই পদ্ধতির সাফল্য পরীক্ষাগারের বাইরেও সুন্দর প্রমাণিত হয়েছে। প্রয়োজনীয় সহায়তা পেলে তিনি দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের আর্সেনিক দূষণে আক্রান্ত এলাকায় গিয়ে এই পদ্ধতি প্রয়োগ করে দেখাবেন । এই প্রযুক্তিকে অভূতপূর্ব আখ্যা দিয়ে তিনি আরো জানান যে, তার এই প্রক্রিয়ায় কেবল আর্সেনিকই নয়, ক্রোমিয়াম, ক্যাডমিয়াম, সায়ানাইড, আয়রনসহ পানিতে বিদ্যমান সব ধরনের ধাতব দূষণই দূর হয়।
এদিকে ভূগর্ভস্থ পানিকে আর্সেনিকমুক্ত করার ক্ষেত্রে শতভাগ সাফল্য অর্জনের দাবি করেছে সিডকো লিমিটেড নামে একটি স্থানীয় প্রতিষ্ঠান। জার্মান হারবাউয়ার প্রতিষ্ঠানের কারিগরি সহায়তায় দেশীয় সংস্থাটি ১৯৯৯ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর যশোরের জাফর নগরে আর্সেনিক দূরীকরণ প্লান্ট স্থাপন করেও এ সাফল্যের ব্যাপারে নিশ্চিত হয়েছে।
আমরা আশায় বুক বেঁধে আছি। কারণ মানুষ আশার ওপরই বেঁচে থাকে। সরকারের সাদিচ্ছা, সঠিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও প্রকল্প গ্রহণের মাধ্যমে আর্সেনিক সমস্যার সঠিক সমাধান হবে, জলজ বিভীষিকা থেকে রেহাই পাবে এদেশের আতঙ্কিত জনপদ ।
তথ্যসূত্র :
1. Natural Institute of Preventive and Social Medicine. (NIPSOM)

FOR MORE CLICK HERE
NTRCA COLLEGE LEVEL HISTORY/ইতিহাস গাইড/ বেসরকারি শিক্ষক নিবন্ধন ইতিহাস
১০ তম বিসিএস -৪৪তম বিসিএস এর প্রশ্ন ও সমাধান 10th BCS to 44th Bcs MCQ Question Solution
বিসিএস ব্যাংক প্রাইমারি পরীক্ষার-এর প্রশ্ন ও সমাধান
সার্চ ইঞ্জিন অপটিমাইজেশন SEO বই লেখক : মোঃ মিজানুর রহমান
মাতৃস্বাস্থ্য/Motherhood
ওষুধ নির্দেশিকা
সহীহ বুখারী শরীফ হাদিস আরবি বাংলা (৭৫৬৩ টি হাদিস)
সহীহ মুসলিম শরীফ হাদিস আরবি বাংলা (৭৪৫৩ টি হাদিস)
সুনানে তিরমিজি শরীফ হাদিস আরবি বাংলা (৩৯৫৬ টি হাদিস)
সুনানে নাসায়ী শরীফ হাদিস আরবি বাংলা (৫৭৫৮ টি হাদিস)
সুনানে ইবনে মাজাহ শরীফ হাদিস আরবি বাংলা (৪৩৪১ টি হাদিস)
সুনানে আবু দাউদ শরীফ হাদিস আরবি বাংলা (৫২৭৪ টি হাদিস)

Copyright © Quality Can Do Soft.
Designed and developed by Sohel Rana, Assistant Professor, Kumudini Government College, Tangail. Email: [email protected]