সূরা আল-নূর নাযিল হওয়ার ঐতিহাসিক পটভূমি আলোচনা করুন। ইফকের ঘটনা বর্ণনা করুন। হযরত আয়েশা (রা)-এর উপর মিথ্যা রটনার কারণ

সূরা আল-নূর ঃ অনুবাদ ব্যাখ্যা ও শিক্ষা (১-৩৩ নং আয়াত)
সূরা আল-নূর মহাগ্রন্থ আল-কুরআনের ২৪তম সূরা। এ সূরা নাযিল হয়েছিল এক কঠিন উত্তেজনাপূর্ণ পরিস্থিতি ও
পরিবেশে। শক্তির দাপটে নবোত্থিত ইসলামী শক্তিকে পরাজিত করতে না পেরে ইয়াহূদী, মুশরিক ও মুনাফিকগোষ্ঠী
মুসলমানদের নৈতিক চরিত্রের উপর মিথ্যা কলংক লেপনের মাধ্যমে-এর গতিরোধ করতে চেয়েছিল। কিন্তু তাদের সেই
হীন চক্রান্তসফল হয়নি। আল্লাহ তাআলা ব্যক্তি ও সমাজের নৈতিক সংশোধনমূলক এবং অপরাধ প্রতিরোধমূলক
গুরুত্বপূর্ণ বিধানাবলী এ সূরায় নাযিল করেন। এর দ্বারা সমাজকে সংশোধন ও বিনির্মাণ করা হয়। সূরায় আলোচিত
বিষয়গুলোর মধ্যে রয়েছে অপরাধ প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের উপদেশ, ব্যভিচারের শাস্তি, ব্যভিচারের মিথ্যা
অপবাদের শাস্তির বিধান, পরিবার ও দাম্পত্য জীবনের সুস্থতা এবং পূণর্গঠনের বিধান। এ সূরায় সমাজ-সভ্যতাকে
কলুষমুক্ত করার লক্ষ্যে অশ্লীলতা, নির্লজ্জতা, বেহায়াপনার চর্চা ও চরিত্রহীনতা প্রতিরোধের বিধান দেয়া হয়েছে। মিথ্যা
রটনা, উড়ো কথায় কান দেওয়া, নারী-পুরুষের চরিত্র অপবাদ দেওয়া জঘন্য অপরাধ। শুভ ধারণা, চোখের নিয়ন্ত্রণ,
নারীর ইজ্জত-আবরু ও চলাফেরার শালীনতা, অপরের গৃহে প্রবেশের নিয়মাবলী, পারিবারিক জীবনের শিষ্টাচার,
সামাজিক জীবনের শৃঙ্খলা রক্ষার নানা প্রসঙ্গ ও নিয়ম-নীতি পরিষ্কারভাবে এ সূরায় আলোচিত হয়েছে। এ ছাড়া নৈতিক
চরিত্র সংরক্ষণে বিবাহ প্রথায় উৎসাহ প্রদান, পতিতাবৃত্তি নিষিদ্ধকরণ, দাস প্রথা বিমোচনের বিধান, বৃদ্ধ মহিলাদের
আচরণবিধি, প্রতিবন্ধীদের সাথে ব্যবহার ও খাঁটি ঈমানদারদের জীবনাচারের পরিচ্ছন্ন ধারণা দেওয়া হয়েছে। সুষ্ঠু সমাজ প্রতিষ্ঠায় ইসলামী রাজনীতির মূলনীতি ও কর্মসূচি তুলে ধরা হয়েছে। সূরা আল-নূর নাযিল হওয়ার সময়কাল
এ সূরাটি পঞ্চম হিজরী সনে নাযিল হয়েছে। হযরত ইবনে আব্বাস ও ইবনে যুবায়র (রা) থেকে বর্ণিত। এ সূরাটি বনী
মুস্তালিক যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর মদীনায় নাযিল হয়। পঞ্চম হিজরীতে বনী মুস্তালিক যুদ্ধ সংঘটিত হয়। সে অভিযান
থেকে ফেরার কিছুদিন পরই এ সূরা নাযিল হতে থাকে। ইফকের ঘটনাটিও পঞ্চম হিজরীতেই সংঘটিত হয়েছিল, যা এ
সূরার একটি মূল আলোচিত বিষয়। এ সকল প্রমাণ থেকে প্রতীয়মান হয় যে, পঞ্চম হিজরী সনে এ সূরাটি নাযিল হয়।
নামকরণ
নামহীন বস্তুর অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া কঠিন। তাই যে কোন কিছুর নামকরণ একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। নামকরণের মাধ্যমেই
কোন বস্তুর বিমূর্ত বিষয় মূর্ত হয়ে উঠে। তাই নামকরণের গুরুত্ব অপরিসীম।
সুরাসমূহের নাম আল্লাহ কর্তৃক নির্ধারিত। পবিত্র কুরআনের সূরাগুলোর নামকরণ মানব রচিত সাহিত্য কর্মের মত নয়।
এ নামগুলো প্রতিটি সূরার জন্যে এক একটি প্রতীক স্বরূপ। সূরা আল-নূরের নামকরণের ভিত্তি হচ্ছে ‘নূর’ শব্দটি। এ
শব্দটি এ সূরার পঞ্চম রুকুর প্রথম আয়াত থেকে গৃহীত। তাফসীরবিদগণ এ সূরার নামকরণে কতিপয় কারণ উল্লেখ
করেছেন। এখানে সংক্ষেপে তা আলোচনা করা হলক. মহান আল্লাহ নূর
মহান আল্লাহ তাআলা হলেন নূর, আর একথাটি অত্র সূরায় বর্ণিত হয়েছে। এ সূরায় বলা হয়েছে ‘আল্লাহ নভোমন্ডল ও
ভূ-মন্ডলে নূর। এখানে নূর বলতে হিদায়াতের নূর বা আলোকে বুঝানো হয়েছে। ফলে এর নাম ‘সূরা আল-নূর’ রাখা
হয়েছে।
খ. সমাজকে নূর বা আলো প্রদানকারী
নূর অর্থ আলো বা জ্যোতি। নূর বলতে এমন বিষয় বা বস্তুকে বুঝায় যার সাহায্যে অন্য বস্তু আলোকিত, বিকশিত ও
উদ্ভাসিত হয়।
ইসলামের আগমনের পূর্বে অন্ধকারে নিমজ্জিত সমাজে ব্যভিচার, অনাচার, অবিচার এবং অসামজিক কাজকর্ম সংঘটিত
হতো, যার ফলে মানব সমাজ অন্ধকারে আবদ্ধ হয়ে পড়ে। সূরা আল-নূর এসব অপকর্মের বিরুদ্ধে কঠোর আইন করে
জাহিলিয়াত তথা অন্ধকার থেকে মানুষকে আলোর সন্ধান দেয়। তাই এ সূরাকে সূরাতুন নূর বা আলোর সূরা হিসেবে
নামকরণ করা হয়েছে।
গ. বিষয়বস্তুর আলোকে
তাফসীরবিদগণ মনে করেন, সূরা আল-নূরে এমন কতিপয় বিধান ও হিদায়াত বিধিবদ্ধ করা হয়েছে, যা মেনে চললে
মানব জীবন আলোকময় হয়ে উঠে। এ সব বিধিবিধান মূলত হিদায়াতের নূর বা আলো এবং এ নূরের কেন্দ্রবিন্দু হলেন
স্বয়ং আল্লাহ তাআলা। আর এ কারণেই এ সূরার নামকরণ করা হয়েছে সূরা আল-নূর।
পটভূমি
বদরের যুদ্ধের পর যে অবস্থায় এ সূরাটি নাযিল হয় তা আমাদের জানা আবশ্যক। এ সূরাটি নাযিল হওয়ার পেছনে যে
কারণসমূহ রয়েছে তা জানা না থাকলে এ সূরার গুরুত্ব সঠিকভাবে অনুধাবন করা আমাদের পক্ষে সম্ভব হবে না। বদর
যুদ্ধে মুসলমানদের জয়লাভ করার পর আরবে ইসলামী বিপ্লবর যে উত্থান শুরু হয়, খন্দক যুদ্ধ পর্যন্তসে বিপ্লব এত বেশি
ব্যাপকতা লাভ করে যে, আরবের মুশরিক, ইয়াহূদী, মুনাফিক ও প্রতীক্ষমান লোকেরা স্পষ্টভাবে অনুধাবন করতে
পেরেছিল যে, ইসলামী শক্তির এ উত্থানকে অস্ত্র দ্বারা আর বাধা দিয়ে লাভ নেই। তথাপি খন্দকের যুদ্ধে ইসলামের
শত্রæরা এক জোট হয়ে দশ হাজার সৈন্য নিয়ে মদীনা আক্রমণ করে। কিন্তু তারা মদীনা উপকন্ঠে একমাস কাল মাথা
ঠুকেও মুসলমানদের কিছুই করতে সক্ষম হয়নি। ফলে এ অভিযান ব্যর্থ হয়ে পড়ে এবং তারা স্বদেশে ফিরে যায়।
তাদের ফিরে যাওয়ার সাথে সাথেই নবী (স) ঘোষণা দেনتغزونھم ولكنكم ھذا عامكم بعد قریش تغزوكم ما
‘এরপর কুরায়শরা আর তোমাদের বিরুদ্ধে আক্রমণ করতে পারবে না বরং তোমরাই তাদের উপর আক্রমণ করবে।’
(ইবনে হিশাম, খ. ৩, পৃ. ২৬৬)
রাসূল (স)-এর এ উক্তি দ্বারা একথারই আভাস দেওয়া হয়েছে যে, ইসলাম বিরোধী শক্তির ক্ষমতা শেষ হয়ে আসছে।
মুসলমানরাই এখন শত্রæদের বিরুদ্ধে বিজয়লাভ করবে।
বদর থেকে খন্দক যুদ্ধ পর্যন্তএ সময়কালের মধ্যে মুসলমানরাই কাফিরদের উপর বিজয় লাভ করেছিল। যদিও কাফিররা
সংখ্যায় কয়েকগুণ বেশি ছিল। ইসলামের এই ক্রমবর্ধমান উন্নতি ও অগ্রগতিতে তারা ভীত হয়ে পড়ে। অস্ত্র ও জনবলের
দিক দিয়ে শক্তিশালী কাফির-মুশরিক বাহিনী এটা বুঝতে পারে যে, অস্ত্র ও শক্তির দ্বারা মুসলমানদেরকে প্রতিহত করা
যাবে না। তাই ইসলাম ও মুসলমানদেরকে প্রতিহত করার জন্যে তারা বিভিন্ন পথ বেছে নেয়। তারা মুসলমানদের
বিজয়ের মূল উৎস ‘নৈতিক শক্তি’কে ধ্বংস করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়। তারা রাসূল (স) ও সাহাবা কিরামের নির্মল ও
নিষ্কলুষ চরিত্রের উপর কালিমা লেপনের চেষ্টা করতে থাকে। কেননা এ চরিত্রের পবিত্রতা, দৃঢ়তা ও শক্তিমত্তা মানুষের
হৃদয় জয় করে চলছে যা অস্ত্র দ্বারা রোধ করা সম্ভব নয়। অন্যদিকে তারা পরিস্কারভাবে দেখতে পায়, ব্যক্তিগত ও
সামষ্টিক নৈতিক পবিত্রতা মুসলমানদের মধ্যে এমন ঐক্য, শৃংখলা ও পারস্পরিক সহমর্মিতা সৃষ্টি করে যার সামনে
মুশরিকদের শিথিল ও বিশৃঙ্খল সামাজিক ব্যবস্থাপনা সর্বাবস্থায় তাদের পরাজয়ের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। মুশরিকদের দুর্বল
চরিত্র ও সামাজিক ব্যবস্থা তাদের মাঝে হীন মনমানসিকতারই জন্ম দেয়। আর এ কদর্যপূর্ণ মন-মানসিকতার কারণেই
তারা উন্নত চরিত্রের অধিকারী রাসূল (স) ও তাঁর সাহাবীদের বিভিন্নভাবে হেয় করতে থাকে এবং তাঁদের চরিত্রের উপর
কালিমা লেপন করতে আরম্ভ করে। আর এজন্য ইচ্ছায় হোক, অনিচ্ছায় হোক, মদীনার মুসলিমদের মধ্যে নানারূপ
ফিত্নার সৃষ্টি করে ইসলামের শত্রট্ট ইয়াহূদী ও মুশরিকরা বেশি-বেশি ফায়দা লুটার লক্ষ্যে তাদের সকল কর্ম কৌশল ও
কর্মসূচী নির্ধারণ করে।
এ নতুন চেষ্টা ও ষড়যন্ত্রের প্রকাশ ঘটে পঞ্চম হিজরীর যিলকাদ মাসে। এ সময় মহানবী (স) পালক পুত্র গ্রহণের
জাহেলী প্রথার চূড়ান্তঅবসানের জন্যে নিজেই তাঁর পালক পুত্র যায়দ ইবন হারিসার তালাক প্রাপ্তা স্ত্রী জয়নাব বিনতে
জাহাশ (রা)-কে বিয়ে করেন। এতে মদীনার মুনাফিকরা রাসূলের (স) বিরুদ্ধে মিথ্যা প্রচারণার এক সর্বাত্মক অভিযান
শুরু করে। আর ইয়াহূদীরাও মুনাফিকদের সুরের সাথে সুর মিলিয়ে মিথ্যা দোষারোপের এক মহাতুফান সৃষ্টি করে।
অনুরূপভাবে মুসলমানদের বিরুদ্ধে- তারা দ্বিতীয় আক্রমণ চালায় বনী মুস্তালিক যুদ্ধের সময়, যা ছিল কঠিনতর এক
আক্রমণ ও ষড়যন্ত্র। বনী মুস্তালিক ছিল বনী খোজায়া নামক গোত্রের একটি শাখা। পঞ্চম হিজরী সনের শাবান মাসে নবী
করীম (স) এদের আক্রমণ প্রতিহত করার জন্যে অগ্রসর হন। মুনাফিক নেতা আবদুল্লাহ ইবনে উবাই বিপুল সংখ্যক
মুনাফিক নিয়ে এ যুদ্ধে নবী করীম (স)-এর সঙ্গী হয়। ‘মুরাইসী’ নামক স্থানে পৌঁছে নবী করীম (স) শত্রট্টর উপর
হামলা পরিচালনা করেন এবং কিছুক্ষণ যুদ্ধের পরই সমগ্র গোত্রটিকে তাদের সম্পদসহ গ্রেফতার করে ফেলেন। এ
অভিযান থেকে অবসর লাভের পর মুসলিম বাহিনী মুরাইসীতে তাঁবু খাঁটিয়ে অবস্থান করার সময় একদিন হযরত উমর
(রা)-এর জনৈক কর্মচারী এবং খাজরাজ গোত্রের জনৈক সহযোগীর মধ্যে পানি নিয়ে ঝগড়া হয়। তাদের একজন
আনাসারদেরকে এবং অপরজন মুজাহিরদেরকে ডাকে। এতে উভয় দিকে লোক সমবেত হতে থাকে। মহানবী (স)-এর
হস্তক্ষেপে উপস্থিত ক্ষেত্রেই বিষয়টি মীমাংসা হয়ে যায়। কিন্তু আবদুল্লাহ ইবনে উবাই (মুনাফিক-সর্দার) তিলকে তাল
বানিয়ে ব্যাপারটিকে জটিল করে তুলে। সে আনসার বাহিনীকে এই বলে উত্তেজিত করতে থাকে যে, এই মুহজিররা
আমাদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়েছে। আমাদের ও কুরায়শ কাঙ্গালদের উদাহরণ এরূপ যে, “কুকুর পাল যেন তোমাকেই
খেয়ে ফেলে”। এ সবকিছু তোমাদেরই সৃষ্টি। তোমরা নিজেরাই ওদের এখানে নিয়ে এসে বসিয়েছ। তোমরাই এদেরকে
নিজেদের বিত্ত-সম্পত্তিতে অংশীদার বানিয়েছ, এখন তোমরাই যদি এদের থেকে সাহায্যের হাত গুটিয়ে নাও তখন দেখবে এদের আর কোথাও আশ্রয় মিলবে না।
অতপর আবদুল্লাহ ইবনে উবাই কসম খেয়ে বলল, মদীনায় পৌঁছার পর আমাদের মধ্যে যে সম্মানিত সে সম্মানহীনকে
বহিস্কার করবে। (সূরা মুনাফিকুন) নবী করীম (স) যখন এ সব কথাবার্তা শুনতে পেলেন, তখন হযরত উমর (রা)
মহানবী (স)-কে পরামর্শ দিলেন যে, এ ব্যক্তিকে খুন করে ফেলা উচিত, কিন্তু নবী করীম (স) বললেনاصحابھ یقتل محمدا ان الناس یتحدث اذا، عمر یا فكیف
‘হে উমর! তা কেমন করে হয় ? তা করলে তো লোকেরা বলবে, মুহাম্মদ (স) তাঁর সঙ্গীদেরকে হত্যা করছে।’
তারপর নবী করীম (স) সে স্থান ত্যাগ করে সবাইকে অবিলম্বে চলে যাওয়ার নির্দেশ দিলেন। পরের দিন দ্বি-প্রহর পর্যন্ত
কোথাও অবস্থান না করে বিরামহীনভাবে চলতেই থাকলেন। পথিমধ্যে উসায়েদ ইবন হুজাইর (রা) বললেন, হে
আল্লাহর নবী আজ তো আপনি আপনার নীতির বিপরীত অসময়ে চলবার নির্দেশ দিলেন। জবাবে তিনি বললেন-
তোমাদের সঙ্গীটি কি সব কথা বার্তা বলছে তা তুমি শুনতে পাচ্ছ না? তিনি জিজ্ঞেস করলেন- ‘কে সে সঙ্গী”? নবী
করীম (স) বললেন, আবদুল্লাহ ইবনে উবাই। তিনি বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! এই ব্যক্তির অপরাধ ক্ষমা করে দিন।
আপনি যখন মদীনায় এসেছিলেন, তখন এ ব্যক্তিকে আমরা নেতা বানাবার সিদ্ধান্তনিয়েছিলাম। তার জন্য নেতৃত্বের
মুকুট তৈরি হয়েছিল। আপনার আগমনে তার সকল আশা নস্যাৎ হয়ে যায়। এ কারণে তার মনে যে জ্বালার সৃষ্টি
হয়েছিল সে এখন তাই উদগীরণ করছে মাত্র।
এ হীন কারসাজির রেশ তখনো শেষ হয়নি। এরই মধ্যে একই সফরে আরেকটি ভয়াবহ অঘটন ঘটে যায়। ঘটনাটি
এমন যে, নবী করীম (স) এবং তাঁর সাহাবীগণ যদি পরিপূর্ণ ধৈর্য, সহিষ্ণুতা ও বিচক্ষণতার সঙ্গে এর মোকাবিলা না
করতেন তা হলে মদীনার এই নবোত্থিত মুসলিম সমাজ এক সর্বাত্মক আত্মকলহ ও গৃহযুদ্ধে ধ্বংস হয়ে যেতো।
ঘটনাটি ছিল এরূপ: এ পাপাত্মা মুনাফিক হযরত আয়েশা সিদ্দিকার (রা) বিরুদ্ধে এক চরম আপত্তিকর ও অবমাননাকর
মিথ্যা অপবাদ দিয়ে বসলো। এ অপবাদকে মিথ্যা সাব্যস্তকরেই মহান আল্লাহ অপবাদের ও সংশ্লিষ্ট বিষয়াবলীর
বিধানসহ সূরা আল-নূরের বেশ কতিপয় আয়াত নাযিল করেন। আর এ অপবাদের ঘটনাটিই হল মূলত অত্র সূরার
ঐতিহাসিক পটভূমি।
হযরত আয়েশার (রা) ঘটনা
বুখারী মুসলিমসহ অন্যান্য সমস্তহাদীস ও তাফসীর গ্রন্থে ঘটনাটি বিস্তারিতভাবে উল্লেখ করা হয়েছে। সংক্ষেপে ঘটনাটি
নি¤œরূপপঞ্চম অথবা ষষ্ঠ হিজরীতে মহানবী (স) যখন বনী মোস্তালিক নামান্তরে মুরাইসী-এর যুদ্ধে গমন করেন। উম্মুল
মু,মিনীনগণের মধ্যে হযরত আয়েশা সিদ্দিকা (রা) এ যুদ্ধে তাঁর সফরসঙ্গী ছিলেন। ইত:পূর্বে নারীদের পর্দার বিধান
নাযিল হয়েছিল। তাই এ সফরে হযরত আয়েশা (রা)-এর জন্যে উটের পিঠে পর্দা বিশিষ্ট আসনের ব্যবস্থা করা হয়।
হযরত আয়েশা (রা) প্রথমে পর্দা বিশিষ্ট আসনে সওয়ার হতেন এরপর উটের চালক আসনটিকে উটের পিঠে বসিয়ে
দিত। এটাই ছিল স্বাভাবিক নিয়ম। যুদ্ধ শেষে মদীনায় ফেরার পথে এক দুর্ঘটনা ঘটে যায়। কোন এক মনযিলে
কাফেলা অবস্থান করার করার পর শেষ রাতের দিকে প্রস্থানের কিছু পূর্বে ঘোষণা করা হল যে, কাফেলা কিছুক্ষণের
মধ্যে এখান থেকে রওয়ানা হয়ে যাবে। সবাইকে প্রস্তুত হতে বলা হল। উম্মুল মুমিনীন হযরত আয়েশা (রা) প্রাকৃতিক
প্রয়োজন সারতে দূরে গেলেন। ঘটনাক্রমে ফেরার পথে তাঁর গলার হার হারিয়ে যায়। তিনি গলার হার খোঁজ করতে
গিয়ে বেশ কিছু সময় বিলম্ব করে ফেলেন। ইতোমধ্যে কাফেলা তাকে রেখে সে স্থান ত্যাগ করে। তাঁর উট চালকও
যথারীতি যাত্রা শুরু করেন। সে ধারণা করেছিল যে, হযরত আয়েশা (রা) হাওদার ভেতরেই আছে। কেননা হযরত
আয়েশা (রা) ছিলেন ক্ষীণকায়, তাঁর দেহের ওজন ছিল অত্যন্তহালকা। তাই বাহকগণ তাঁর অনুপস্থিতি অনুভব করতে
পারেননি। তারা মনে করেছিলেন যে, হযরত আয়েশা (রা) হাওদার মধ্যেই রয়েছেন একং তাঁকে নিয়েই এগিয়ে
যাচ্ছেন। কিছুক্ষণ পর উম্মুল মুমিনীন হযরত আয়েশা (রা) সে স্থানে ফিরে এসে দেখেন কাফেলা সেখান থেকে চলে
গেছে। তখন তিনি অত্যন্তবুদ্ধিমত্তার পরিচয় দিলেন, তিনি কাফেলার পেছনে না দৌঁড়ে স্ব-স্থানে চাদর মুড়িয়ে বসে
থাকলেন। তিনি ভাবলেন, প্রিয় নবী (স) যখন তাকে পাবেন না, তখন তাঁর খোঁজে তিনি নিশ্চয় এখানেই লোক
পাঠাবেন। সেজন্য তিনি ঐ স্থানে অবস্থান করাই সমীচীন মনে করলেন। তখন সময় ছিল শেষ রাত। ফলে কিছুক্ষণের
মধ্যেই তিনি ঘুমিয়ে পড়লেন।
প্রিয় নবী (স)-এর যাবতীয় কাজ ছিল অত্যন্তসুশৃংখল। কাফেলার কোন কিছু যেন ভুলক্রমে রাস্তায় পড়ে না থাকে তার
জন্য তিনি একজন তত্ত¡াবধায়ক নিয়োগ করতেন, সে সবার শেষে রওয়ানা হতো। কোন কিছু পড়ে থাকলে সে তা
কুড়িয়ে নিয়ে আসত। এ সফরে হযরত সাফওয়ান ইবন মুয়াত্তালকে (রা) তত্ত¡াবধায়ক নিয়োগ করা হয়েছিল। ফেরার
পথে অতি প্রত্যুষে সাফওয়ান একজনকে চাঁদর মুড়িয়ে ঘুমিয়া থাকতে দেখেন। তিনি কাছে এসে হযরত আয়েশা
সিদ্দিকা (রা)-কে দেখতে পান, তখন তিনি অত্যন্তবিস্ময় প্রকাশ করে বলে উঠেন, ‘ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি
রাজেউন’। হযরত সাফওয়ানের (রা) মুখ থেকে উচ্চারিত বাক্যটি শোনা মাত্রই হযরত আয়েশা (রা) জেগে উঠেন।
হযরত সাফওয়ান (রা) সঙ্গে সঙ্গে তাঁর উটটি হযরত আয়েশার (রা) সামনে এনে বসিয়ে দিলেন। হযরত আয়েশা (রা)
উটের পিঠে পর্দা করে বসে পড়লেন। হযরত সাফওয়ান (রা) উটের লাগাম ধরে পায়ে হেঁটে সামনের দিকে হাটতে
লাগলেন এবং দুপুরের সময় মূল কাফেলার সঙ্গে মিলিত হলেন। এটাই ছিল প্রকৃত ঘটনা।
মিথ্যা অপবাদ রটনা
মুনাফিকরা সর্বদা ইসলাম ও মুসলমানদের ক্ষতি সাধন করার অপচেষ্টায় লিপ্ত থাকতো। তাই তারা তিলকে তাল
বানিয়ে মিথ্যা রটনায় ব্যস্তহয়ে পড়ে। এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে মুনাফিক নেতা আবদুল্লাহ ইবনে উবাই উম্মুল মুমিনীন
হযরত আয়েশার (রা) নামে মিথ্যা অপবাদের ঝড় তুলে। মুনাফিকদের এ ষড়যন্ত্রের সূ²জালে কতক সরল প্রাণ
মুসলমানও জড়িয়ে পড়ে। পুরুষদের মধ্যে হযরত হাসসান, মিসতাহ এবং নারীদের মধ্যে হামনাহ ছিলেন এদের
অন্তর্ভুক্ত। রটে যাওয়া অপবাদে স্বয়ং মহানবী (স) খুবই দুঃখিত হলেন। হযরত আয়েশার (রা) তো দুঃখের সীমাই ছিল
না। সাধারণ মুসলমানগণও তীব্রভাবে বেদনাহত হলেন। একমাস পর্যন্তএ আলোচনার ঝড় বইতে থাকল। অবশেষে
মহান আল্লাহ হযরত আয়েশার (রা) পবিত্রতা বর্ণনায় ও অপবাদ রটনাকারী এবং এতে অংশ গ্রহণকারীদের নিন্দায় সূরা
আল-নূরের ১১ থেকে ২০তম আয়াত পর্যন্তদশটি আয়াত নাযিল করেন।
আবদুল্লাহ ইবনে উবাই এই ঘটনার সৃষ্টি করে একই ঢিলে একাধিক পাখি শিকার করতে চেয়েছিল। প্রথমত: সে রাসূল
(স) ও হযরত আবু বকর (রা)-এর ইজ্জতের উপর হামলা করল। দ্বিতীয়ত: সে ইসলামী আন্দোলনের সর্বোচ্চ নৈতিক
মান ও মর্যাদাকে বিনষ্ট করতে চেষ্টা করল।
তৃতীয়ত: সে এমন এক অগ্নি-স্ফুলিঙ্গ নিক্ষেপ করল যে ইসলাম যদি মুসলমানদের মধ্যে সত্যি কোন পরিবর্তনের সূচনা
না করত, তা হলে মুহাজির ও আনসার এবং আনসারদের উভয় গোত্রেই পরস্পরের সাথে কঠিন লাড়াইয়ে লিপ্ত হয়ে
পড়ত। আল্লাহ তাআলা এরূপ একটি বিপদ থেকে মুসলমানদের রক্ষা করলেন।
সারকথা
সূরা আল-নূর পবিত্র কুরআনের ২৪তম সূরা। ইসলাম শুধু বাহ্যিক কিছু আচার অনুষ্ঠানের নাম বিশেষ নয়। বরং একটি
পূর্ণাঙ্গ জীবন বিধান। এ সূরা তারই একটি অকাট্য প্রমাণ। সূরা আল-নূরের ৬৪টি আয়াতে মানব জীবনের পারিবারিক,
সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক প্রভৃতি দিক ও বিভাগের বিধান উল্লেখ করা হয়েছে। এ সূরাটি সামাজিক
বিশৃংখলা নিরসনের ক্ষেত্রে একটি চ্যালেঞ্জ হিসেবে স্বীকৃত। বিশেষ করে ব্যভিচার ও মিথ্যা অপবাদের মত মারাত্মক
সামাজিক ব্যাধি ও নারী নির্যাতন প্রতিরোধ করার ক্ষেত্রে এ সূরা উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখেছে। একটি
শান্তিপূর্ণ কল্যাণকর সমাজ প্রতিষ্ঠাই মানুষের কাম্য, আর ইসলাম চায় এ জাতীয় একটি কল্যাণকর সমাজ উপহার
দিতো। এ লক্ষ্যে আল্লাহ তাআলা যে সব বিধি-বিধান নির্ধারণ করে দিয়েছেন সূরা আল-নূর তারই সমষ্টি।
নৈর্ব্যক্তিক উত্তর-প্রশ্ন
সঠিক উত্তরে টিক চিহ্ন দিন
১. সূরা আল-নূর পবিত্র কুর-আনের কততম সূরা?
ক. ১০৮তম খ. ৯২তম
গ. ২৪তম ঘ. ৪৪ তম
২. সূরা আল-নূরের আয়াত সংখ্যাক. ৬৪ টি খ. ৭৪টি
গ. ৮০ টি ঘ. ৫৪ িিট
৩. মুসলমানদের বিজয়ের মূল হলক. ঈমানী শক্তি খ. নৈতিক শক্তি
গ. সামরিক কৌশল ঘ. আধুনিক অস্ত্রশস্ত্র
৪. সূরা আল-নূর কত হিজরীতে নাযিল হয় ?
ক. ৭ম হিজরী খ. ৪র্থ হিজরী
গ. ৫ম হিজরী ঘ. ৬ষ্ঠ হিজরী
৫. সূরা আল-নূরের নামকরণে কয়টি বিষয়ের উল্লেখ আছে?
ক. ৫টি খ. ৪টি
গ. ৭টি ঘ. ৩টি
৬. বনী মুস্তালিক যুদ্ধ সংঘটিত হয়ক. ৫ম হিজরীতে খ. ৮ম হিজরীতে
গ. ৭ম হিজরীতে ঘ. ৬ষ্ঠ হিজরীতে
নৈর্ব্যক্তিক প্রশ্নের উত্তর ঃ ১. গ, ২. ক, ৩. ক, ৪. গ, ৫. ঘ, ৬. ক
সংক্ষিপ্ত উত্তর-প্রশ্ন
১. সূরা আল-নূর-এর নামকরণ আলোচনা করুন।
২. হযরত আয়েশা (রা)-এর উপর মিথ্যা অপবাদ রটনার কারণ লিখুন।
বিশদ উত্তর-প্রশ্ন
১. সূরা আল-নূর নাযিল হওয়ার ঐতিহাসিক পটভূমি আলোচনা করুন।
২. ইফকের ঘটনা বর্ণনা করুন। হযরত আয়েশা (রা)-এর উপর মিথ্যা রটনার কারণ ব্যাখ্যা করুন।

FOR MORE CLICK HERE
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস মাদার্স পাবলিকেশন্স
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস ১ম পর্ব
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস
আমেরিকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস
বাংলাদেশের ইতিহাস মধ্যযুগ
ভারতে মুসলমানদের ইতিহাস
মুঘল রাজবংশের ইতিহাস
সমাজবিজ্ঞান পরিচিতি
ভূগোল ও পরিবেশ পরিচিতি
অনার্স রাষ্ট্রবিজ্ঞান প্রথম বর্ষ
পৌরনীতি ও সুশাসন
অর্থনীতি
অনার্স ইসলামিক স্টাডিজ প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত
অনার্স দর্শন পরিচিতি প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত

Copyright © Quality Can Do Soft.
Designed and developed by Sohel Rana, Assistant Professor, Kumudini Government College, Tangail. Email: [email protected]