পরিবারের উৎপত্তি
আমরা জানি, পরিবার হচ্ছে মাতা-পিতা, সন্তান, নিকট রক্ত সম্পর্কিত আতœীয়-স্বজন এবং দাস-দাসী বা চাকরবাকর নিয়ে একত্রে বসবাসকারী বৈধ সামাজিক সংগঠন। ইসলামের দৃষ্টিতে পরিবার ব্যবস্থা পৃথিবীতে প্রথম মানব
হযরত আদম (আঃ) হতে শুরু হয়েছে। কারণ আল্লাহতা‘আলা হযরত আদম (আঃ) কে সৃষ্টি করে তার থেকে
তার স্ত্রী হযরত হাওয়া (আঃ) কে সৃষ্টি করেছেন। পরে তাঁদের দুজন থেকে জন্ম হয় তাদের অগণিত
সন্তান-সন্ততি। পরিবারের প্রথম সদস্য হিসেবে আমরা তাদের দুজনকেই জানি। সৃষ্টির পর আল্লাহতা‘আলা
পৃথিবীর এ প্রথম পরিবারটিকে জান্নাতে বসবাস করতে দেন। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তা‘আলা বলেনÑ
وَ قُ ل᠔ نَ ـا ᘌ َـاآدَ مُ ٱسْ ـك᠑ نْ أ᠐ نْ ـتَ وَ زَ وْ جُ ـكَ ٱل᠔ جَ نَّ ـةَ وَ ᠑ᝏ ـᢿ َمِ نْ هَ ـا رَ غَ ـدا᠍ حَ ᘭ ْـثُ شِ ـᚊ ْتُ مَ ا وَ ᢻ َتَ قْ ᖁ ᗖ َـا
هَ ᅮ ٰذِ ەِ ٱلشَّ جَ ر ةَ فَ تَ ᠑ ونَ ا مِ نَ ٱل᠔ ظᡐ الِ مِ ينَ .
‘এবং আমি বললাম, হে আদম! তুমি ও তোমার স্ত্রী জান্নাতে বসবাস কর এবং যেথা ইচ্ছা স্বচ্ছন্দে আহার কর,
কিন্তু এ গাছের নিকটবর্তী হয়ো না, অন্যথায় তোমরা যালিমদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে পড়বে’। (সুরা আল-বাকারা :
৩৫)
কিন্তু শয়তান কল্যাণকামীর বেশে এসে তাঁদের ধোঁকায় ফেলে এবং প্রতারণার জালে আবদ্ধ করে নিষিদ্ধ গাছের
ফল আস্বাদন করতে বাধ্য করে। পরবর্তীতে তাঁরা নিজেদের ভুল বুঝতে পারেন এবং বিনয়াবনত হয়ে মহান
আল্লাহর দরবারে ক্ষমা প্রার্থনা করেন। অতঃপর আল্লাহ তাঁদেরকে ক্ষমা করে দেন এবং পৃথিবীতে পাঠিয়ে দেন
বসবাস করতে। হযরত আদম ও হাওয়া (আ.)-এর পৃথিবীতে আগমন করার পর তাঁরা দুজনেই পরিবারভুক্ত হয়ে
জীবন যাপন করতে থাকেন এবং তাঁদের দু’জনের মাধ্যমেই এ পৃথিবীতে মানব ধারার বিস্তার লাভ করে। আর
পারিবারিক জীবন ব্যবস্থার ক্রমধারা তাঁদের দু’জন থেকেই উৎসারিত পারিবারিক জীবন ব্যবস্থার ক্রমধারা সম্পর্কে
আল্লাহতা‘আলা বলেনÑ
ᘌ ٰأ᠐ يُّ هَ ــا ٱلنَّ ــاسُ ٱتَّ قُ ــوا᠔ رَ ᗖَّ ᠑ᝣ ــمُ ٱلᡐ ــذِ ى خَ ل᠐ قَ ᠑ᝣ ــمْ مِّ ــن نَّ فْ ــس᠏ وَ احِ ــدَ ةٍ وَ خَ ل᠐ ــقَ مِ نْ هَ ــا زَ وْ جَ هَ ــا
وَ ᗖ َثَّ مِ نْ هُ مَ ا ر᠒جَ اᢻ ًك᠐ ثِ يرا᠍ وَ ᙏ ِسَ ቯءً .
‘হে মানব মন্ডলী ! তোমরা তোমাদের পালনকর্তাকে ভয় কর, যিনি তোমাদেরকে এক ব্যক্তি হতে সৃষ্টি করেছেন
এবং যিনি তা থেকে তার সঙ্গীনীকে সৃষ্টি করেছেন। আর বিস্তার লাভ করিয়েছেন তাঁদের দু’জন থেকে অগণিত
পুরুষ ও নারী।’ (সুরা আন-নিসা : ১)
উপরোক্ত আয়াত ও আলোচনা হতে আমরা এ কথা দ্বিধাহীন চিত্তে বলতে পারি যে, পরিবার নামক সংগঠনটি
হযরত আদম (আ.) হতে শুরু হয়েছিল। কালের প্রবাহে পরিবার নামক সংগঠনটির মধ্যেও অনেক পরিবর্তন
হয়েছে বলে সমাজবিজ্ঞানীদের ধারণা। তাই তাঁরা পরিবারের বিভিন্ন শ্রেণি বিভাগ করেছেন।
পরিবারের ক্রমবিকাশ
আল-কুরআনের ধারণা অনুযায়ী যেমন প্রথম মানব আদম (আ.) তেমনি মানব জাতির প্রথম পরিবার গড়ে
উঠেছিল আদম ও হাওয়াকে (আ.) কেন্দ্র করে। উত্তরকালে তাদের সন্তানদের মধ্যে এ পারিবারিক জীবন পূর্ণ
মাত্রায় ও পূর্ণ মর্যাদা সহকারেই প্রচলিত ছিল। এই প্রথম পরিবারের সদস্যদ্বয়Ñআদম ও তাঁর স্ত্রীকে লক্ষ্য করেই
আল্লাহ তা‘আলা বলেছিলেনÑ
وَ ᗫ َا آدَ مُ ٱسْ ك᠑ نْ أ᠐ نتَ وَ زَ وْ جُ كَ ٱل᠔ جَ نَّ ةَ فَ ᠑ᝣ ᢿ َمِ نْ حَ ᘭ ْثُ شِ ᚊ ْتُ مَ ا.
‘হে আদম! তুমি ও তোমার স্ত্রী জান্নাতে বসবাস কর এবং যেথা ইচ্ছা পানাহার কর’। (সুরা আল-আরাফ : ১৯)
প্রকৃতপক্ষে মানব ইতিহাসের সর্ব প্রথম পরিবার যেমন সর্বতোভাবে একটি পূর্ণাঙ্গ পরিবার ছিল, তেমনি তাতে ছিল
পারিবারিক জীবনের প্রয়োজনীয় যাবতীয় উপকরণ এবং তার ফলে সেখানে বিরাজিত ছিল পরিপূর্ণ তৃপ্তি, শান্তি,
স্বস্তিও আনন্দ। এ সূচনাকালের পরও দীর্ঘকাল ধরে এ পারিবারিক জীবন-পদ্ধতি মানব সমাজে অব্যাহত থাকে।
অবশ্য ক্রমবিবর্তনের কোন স্তরে মানব-সমাজের কোন শাখায় এর ব্যতিক্রম ঘটেনি, তেমন কথা বলা যায় না।
বরং ইতিহাসের ধারাবাহিকতায় কোন কোন স্তরে মানব জাতির কোন কোন শাখায় পতনযুগের অমানিশা ঘনীভূত
হয়ে এসেছে এবং সেখানকার মানুষ নানাদিক দিয়ে নিতান্তপশুর ন্যায় জীবন যাপন করতে শুরু করেছে বলে
প্রমাণ পাওয়া যায়। এ পর্যায়ে এসে তারা ভুলেছে সৃষ্টিকর্তার প্রতি মানবীয় কর্তব্য। নবীগণের উপস্থাপিত জীবনআদর্শকে অস্বীকার করে সম্পূর্ণ ভিন্ন পথে ধাবিত হয়েছে এবং একান্তভাবে নফসের দাস ও জৈব লালসার গোলাম
হয়ে জীবন যাপন করেছে। তখন সব রকমের ন্যায়নীতি ও মানবিক আদর্শকে যেমন পরিহার করা হয়েছে,
তেমনি পরিত্যাগ করা হয়েছে পারিবারিক জীবনের বন্ধনকেও। এই সময় কেবল যৌন লালসার পরিতৃপ্তিই নারীপুরুষের সম্পর্কের একমাত্র বাহন হয়ে দাঁড়িয়েছিল। কিন্তু তা সত্তে¡ও এ অবস্থা ছিল সাময়িক। বর্তমান সময়েও
এরূপ অবস্থা কোথাও-না-কোথাও বিরাজিত দেখতে পাওয়া যায়। তবে মানব সমাজের সমগ্র ইতিহাস যে তা নয়
তা স্বীকার করতে কোন দ্বিধা নেই। বর্ণিত অবস্থাকে বড় জোর সাধারণ নিয়মের ব্যতিক্রমই বলা যেতে পারে।
অথচ এই ব্যতিক্রমের কাহিনীকেই ইউরোপীয় ইতিহাসে গোটা মানব সমাজ ও সভ্যতার ইতিহাস বলে ধরে নেয়া
হয়েছে। অতএব বলিষ্ঠ কণ্ঠে বলা যায়, সেটা মানব সমাজের ইতিহাস নয়, তা হল ইতিহাসের বিকৃতি, মানবতার
বিজয়দৃপ্ত অগ্রগতির নিরবচ্ছিন্ন ধারাবাহিকতার নগণ্য ব্যতিক্রম মাত্র।
বস্তুত ইসলামী সমাজবিজ্ঞানের দৃষ্টিতে পরিবার এবং পারিবারিক জীবন হচ্ছে সমাজ জীবনের ভিত্তিপ্রস্তর। এখনেই
সর্বপ্রথম ব্যষ্টি ও সমষ্টির সম্মিলন ঘটে এবং এখানেই অবচেতনভাবে মানুষের সামাজিক জীবন যাপনের হাতেখড়ি
হয়। ইসলামের শারীর-বিজ্ঞানে ব্যক্তি দেহে ‘কলব’ (قلـب (এর যে গুরুত্ব, ইসলামী সমাজ জীবনে ঠিক সেই
গুরুত্ব পরিবারের, পারিবারিক জীবনের। তা সত্তে¡ও আধুনিক ইউরোপীয় ঐতিহাসিক ও নৃবিজ্ঞানীরা মানব
সভ্যতার ইসলামী ক্রমধারাকে অস্বীকার করে সভ্যতার ক্রম বিবর্তনের কথা চাপিয়ে দিতে চায়। তাদের ইতিহাস
ও সভ্যতা প্রাচীন হওয়া সত্তে¡ও মধ্যযুগে ধর্ম ও বিজ্ঞানের সাথে সংঘর্ষ হওয়ায় তারা ধর্মীয় সভ্যতার ইতিহাসকে
গ্রহণ করতে চায় না। এবং ধর্মীয় সভ্যতার বিপরীতে তারা সেই সভ্যতার যুগকে অন্ধকারাচছন্ন গুহাবাসীর যুগ
হিসেবে উপস্থাপন করে। তারা পারিবারিক জীবন যাপনকে গুরুত্ব না দিয়ে পরিবার প্রথা ভেঙ্গে দেওয়ার অপচেষ্টা
চালাচেছ। সমাজে পরিবার বিরোধী মতবাদ প্রচার করে মানুষকে উৎসাহিত করছে। তারা পরিবার প্রথাকে
বিলোপ করার জন্য যে সকল যুক্তি তর্ক উপস্থাপন করছে তারই কতিপয় জবাব নি¤েœউপস্থাপন করা হল।
পরিবার বিরোধী চিন্তা ও তাদের অভিমতের জবাব
১. মানুষ স্বাধীন হয়ে জন্মগ্রহণ করে, তাই সকল প্রকার বন্ধন থেকে মুক্তিই তার স্বাভাবিক দাবি, স্বভাবের
প্রবণতা। পরিবারের সুদৃঢ়-সুরক্ষিত পরিবেষ্টনীতে বন্দী করে তার এ স্বাধীনতার অধিকার হরণ করা অবিচার বৈ
কিছুই নয়।
প্রথমত পরিবার নামক সংগঠনটি মূলত নারী পুরুষের সম্মিলিত ও পরস্পরের সম-অধিকারসম্পন্ন এক যৌথ
প্রতিষ্ঠান। এখানে উভয়ই একত্রে সম্মিলিত জীবন যাপন করে। এ সম্মিলিত জীবনে পুরুষ ঘরের বাইরের কাজকর্মের জন্যে দায়িত্বশীল, আর স্ত্রী ঘরের অভ্যন্তরীণ যাবতীয় ব্যাপারে নিয়ন্ত্রকÑঘরের রানী। এখানে একজনের
উপর অপরজনের মৌলিক শ্রেষ্ঠত্ব ও প্রধান্যের কোন প্রশ্নই উঠতে পারে না। একটি প্রাসাদ রচনার জন্যে যেমন
দরকার ইটের, তেমনি প্রয়োজন চুনা-সুরকি বা সিমেন্ট-বালির। যদি বলা যায়, ইট সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ ও প্রধান;
তাহলে প্রশ্ন হবে, কেবল ইটই কি পারবে বিরাট বিরাট প্রাসাদ নির্মাণ করতে ? প্রাসাদ তৈরিতে ইট ও সিমেন্ট
যেমন গুরুত্বপূর্ণ পরিবার গঠনেও নারী ও পুরুষের ব্যাপারটি ঠিক তেমনি। একটি সুন্দর পরিবার গঠনে যেমন
পুরুষের যোগ্যতা-কর্মক্ষমতার একান্তপ্রয়োজন, তেমনি অপরিহার্য নারীর বিশেষ ধরনের যোগ্যতা ও কর্ম-
প্রেরণারÑ যা অন্য কারো মধ্যে পাওয়া যাবে না। সুতরাং পরিবার প্রথা একজন মানুষকে পরাধীন করে না এবং
তারা বন্দী জীবন যাপন করে না। যারা পারিবারিক প্রথাকে স্বাধীনতার প্রতিবন্ধক এবং মুক্ত ও স্বাভাবিক জীবন
যাপনের বিপরীত মনে করেন তারা আসলে ইসলামী পরিবার স¤পর্কে কোন ধারণাই রাখেন না।
২. পরিবার মানুষের স্বভাবের দাবি নয়। পারিবারিক জীবনে স্ত্রীকে পুরুষের অধীন হয়ে প্রায় ক্রীতদাসী হয়ে
থাকতে হয়, অথচ স্বাধীনভাবে থাকা তার মানবিক অধিকার। পারিবারিক জীবনে তা নির্মমভাবে হরণ করা হয়।
একমাত্র পুরুষই সেখানে উপার্জন করে, স্ত্রীকে তার জীবন-জীবিকার জন্যে পুরুষের মুখাপেক্ষীÑ গলগ্রহ হয়ে
থাকতে হয়।
দ্বিতীয়ত বলা যায়, যে সমাজে নারীর পক্ষে অর্থোপার্জনের সকল দ্বারই চিররুদ্ধ কেবল সে সমাজ সম্পর্কেই
একথা খাটে। কেননা সেখানে নারীর অস্তিত্ব কেবল পুরুষের পাশবিকবৃত্তি চরিতার্থের উদ্দ্যেশ্যই একান্তভাবে
নিয়োজিত থাকে। নারী সেখানে না কোন জিনিসের মালিক হতে পারে, না পারে কোন ব্যাপারে নিজের মত
খাটাতে। কিন্তু এখানে যে সমাজ-পরিবারের কথা বলা হচেছ তার সম্পর্কে একথা কিছুতেই সত্য ও প্রযোজ্য হতে
পারে না। কেননা, ইসলাম নারীকে ধন-সম্পত্তির মালিক হওয়ার অধিকার দেয়, উত্তরাধিকার সূত্রে ও স¤পত্তির
অংশ সে আইনত লাভ করে থাকে। কিন্তু নারীর দৈহিক গঠন ও মন-মেজাজের বিশেষ রূপ ও ধরন রয়েছে, যা
পুরুষ থেকে ভিন্নতর। এ কারণে অর্থোপার্জনের মত কঠিন ও কঠোর কাজের দায়িত্ব তার উপর অর্পণ করা
হয়নি। পুরুষই তার যাবতীয় আর্থিক প্রয়োজন পুরণের জন্যে দায়িত্ব প্রাপ্ত, বিশেষত ইসলামের পারিবারিক
ব্যবস্থায় নারী এক দায়িত্বপূর্ণ মর্যাদায় অধিষ্ঠিত। অর্থোপার্জনের চিন্তাভাবনা ও খাটা-খাট্নীর সাথে তার কোন মিল
নেই, তা সত্বেও একজন নারী যদি ব্যবসা-বাণিজ্য বা চাকরি করে অর্থোপার্জন করতে চায় ইসলাম তাতে বাধা
প্রদান করে না বরং স্ত্রীর অর্জিত টাকা-পয়সার মালিক স্ত্রীই হয় এবং সে তার প্রয়োজনমত তা খরচ করার অধিকার
রাখে। সুতরাং পারিবারিক জীবনে নারী বা স্ত্রী ক্রীতদাসীর ন্যায় জীবন যাপন করে তা সঠিক নয়। তবে পশ্চিমা ও
ইউরোপীয় সমাজ ব্যবস্থায় যদি নারীদেরকে সকল অধিকার থেকে বঞ্চিত রাখা হয় তবে তার সাথে ইসলামী
পরিবারের কোন স¤পর্ক নেই। কাজেই তাদের দাবী এখানে প্রযোজ্য নয়।
তাছাড়া বিষয়টি অন্যভাবে পর্যালোচনা করা যেতে পারে। প্রকৃত ব্যাপারকে ভুল দৃষ্টিতে বিচার করলে ঠিক ফল
লাভ সম্ভব হতে পারে না। অতীতে নারী স¤প্রদায় অর্থনৈতিক ব্যাপারে পুরুষের মুখাপেক্ষী ছিল বলেই যে সে
পুরুষের অধীন বা দাসী হয়ে থাকতে বাধ্য হত এমন কথা বলা আদৌ যুক্তিসঙ্গত নয়Ñপারিবারিক জীবনের বহুতর
ঘটনা এর তীব্র প্রতিবাদ করছে।
৩. প্রাচীনকালের রাষ্ট্র ব্যবস্থা বর্তমানের ন্যায় সর্বাত্মক ও ব্যাপক ভিত্তিক ছিল না। তখন মানুষ পরিবারের
মুখাপেক্ষী ছিল, মানুষের জন্যে তা ছিল প্রয়োজনীয়। এখন রাষ্ট্রের ব্যবস্থাপনা থেকেই তার যাবতীয় প্রয়োজন
পূরণ হতে পারে। কাজেই আগের কালে পরিবারের প্রয়োজন থাকলেও বর্তমানে তার আবেদন শেষ হয়ে গেছে।
তৃতীয়ত আমরা যদি বিষয়টির প্রতি গভীরভাবে মনোনিবেশ করি তা হলে দেখা যাবে যে, তৃতীয় যুক্তিটি মানবীয়
অনুভূতি ও আন্তরিক ভাবধারার ভুল ব্যাখ্যার উপর নির্ভরশীল। সন্তানের প্রতি ¯েœহ-বাৎসল্যের পশ্চাতেও কোন
অর্থনৈতিক স্বার্থবোধ নিহিত রয়েছে বলে ধরে নিলে বলতে হয় যে ধনী লোকদের মনে সন্তান কামনা বলতে কিছুই
থাকা উচিত নয়। আর সন্তান হলে তাদের জন্য কোন ¯েœহ-মায়াও থাকা স্বাভাবিক নয়। কিন্তু প্রকৃত ব্যাপার তো
তা নয়। যে শিশু পঙ্গু-অন্ধ, যার থেকে কোন প্রকারের অর্থনৈতিক স্বার্থ লাভের একবিন্দু আশা থাকে না, বরং মাবাবার উপর যে কেবল বোঝা হয়েই রয়েছে, এমন সন্তানকে বাবা-মা কেন বুকে জড়িয়ে রাখে? তার খবরাখবরের
জন্যে তার সেবা-শুশ্রƒষা ও তাকে আদর-যতœ করার জন্যে পিতা মাতা কেন সতত উদ্বিগ্ন হয়ে থাকে? সে অনেক
টাকা রোজগার করে বাবা-মাকে সাহায্য করবে, এমন কোন আশা কেউ পোষণ করে কি?Ñ বিবেকের কাছে এ
যুক্তিটি আদৌ টিকে না।
প্রকৃত ব্যাপার এই যে, সৃষ্টিকর্তা একটা নির্দিষ্ট সময় পর্যন্তমানব বংশকে ও গোটা সৃষ্টিলোককে বাঁচিয়ে রাখতে
চান। এজন্যে প্রত্যেক সৃষ্টির মধ্যেই এমন কিছু স্বাভাবিক দাবি ও প্রবণতা রেখেছেন যা তাকে আত্মসচেতন করে
বাঁচিয়ে রাখে এবং তার নিজের ধ্বংসের পূর্বেই তার স্থলাভিষিক্ত, তার বংশধর তৈরী করতে তাকে বাধ্য করে।
এই স্বাভাবিক ধারা নিঃশেষ হয়ে গেলে কোন সৃষ্টিকেই আর অস্তিত্বে দেখা যাবে না। তখন পরিবার কেন, রাষ্ট্রেরও
কোন অস্তিত্ব থাকবে না। তাই মানব বংশধারার পবিত্রতা রক্ষার জন্যই পরিবার ব্যবস্থা অতীব প্রয়োজন।
৪. পূর্বে সম্মিলিত পারিবারিক জীবন (ঔড়রহঃ ভধসরষষু ষরভব) থাকার কারণে পিতা-মাতা, আত্মীয়-স্বজনের গুরুত্ব
ছিল অসাধারণ, কিন্তু এখন সে অবস্থা বদলে গেছে। এখন শিশু পালনের জন্যে নার্সারী, ডে-কেয়ার হোম ও
কিন্ডারগার্টেন ইত্যাদি বিদ্যমান। কাজেই আজ পারিবারিক সম্বন্ধ অপ্রয়োজনীয়।
চতুর্থত বলা যায় যে, পারিবারিক ব্যবস্থা এক বিশেষ উদ্দেশ্যে প্রতিষ্ঠিত। এ উদ্দেশ্যের বাস্তবিকই যদি কোন
গুরুত্ব থেকে থাকে আর মানবতার কল্যাণের জন্যেই তার বাস্তবায়ন জরুরী হয়ে থাকে, তাহলে এ ব্যবস্থাকে দুর্বল
করে দেয় যেসব অবস্থা, তা মানবতার পক্ষে কিছুতেই কল্যাণকর হতে পারে না। কোন প্রতিষ্ঠান
প্রতিষ্ঠা করাই কোন উদ্দেশ্য হতে পারে না, মানবতার দুঃখ-দরদ ও যন্ত্রণা-লাঞ্ছনা বিদূরণই
হচ্ছে আসল লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য। কোন প্রতিষ্ঠান এ উদ্দেশ্যের প্রতিবন্ধক হলে তার মূলোৎপাটনই বাঞ্ছনীয়। সন্তান
ও পিতা-মাতার পারস্পরিক সম্পর্ক ছিন্নকরা ও তাদের মধ্যে বিচ্ছেদ এনে দেয়ার জন্যে আজ যে-সব প্রতিষ্ঠান
দাঁড় করানো হয়েছে, পারিবারিক ব্যবস্থাকে যথাযথভাবে প্রতিষ্ঠিত রেখে সে সব প্রতিষ্ঠানকে কল্যাণকর ভূমিকায়
নিয়োজিত করা যায় কিনা, তাও তো গভীরভাবে ভেবে দেখা আবশ্যক। এ যদি সম্ভবই না হয়, তাহলে বলতে
হবে, মানুষ প্রথমে পরিবারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেছে, তারপরে তারা কৃত্রিম বিকল্প ব্যবস্থা
হিসেবেÑশূন্যস্থান পূরণের জন্যেÑ এসব প্রতিষ্ঠানকে দাঁড় করিয়েছে। বস্তুত পরিবার ব্যবস্থাকে যথাযথ প্রতিষ্ঠিত
রেখেও এসব প্রতিষ্ঠানকে ভবিষ্যৎ মানব বংশের জন্যে কল্যাণকর বানানো যেতে পারেÑকিংবা পরিবার ব্যবস্থার
অনুক‚লে এ ধরনের নবতর আরো প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠিত করা যেতে পারেÑতাতে কোন সন্দেহ নেই। বরং এতে
পরিবারের কার্যক্রমে গতিশীলতা আসে এবং পরিবারের কার্যাবলি সুষ্ঠুভাবে স¤পাদিত হয়।
৫. বর্তমানে রাষ্ট্র শিশু থেকে শুরু করে বিভিন্ন বয়সের মানুষের স্বাচ্ছন্দ্যপূর্ণ জীবনযাত্রার জন্যে যেরূপ সর্বাত্মক
ব্যবস্থা গ্রহণ করতে সমর্থ হচ্ছে, পিতা-মাতার পক্ষে তা করা কিছুতেই সম্ভব নয়। তাই আজ পরিবার ভেঙ্গে গেলে
রাষ্ট্র থেকেই সব প্রয়োজন অনায়াসেই পূরণ করা যেতে পারে। এতে মানুষের কোনরূপ অনিষ্ট হওয়ার আশংকা
থাকতে পারে না।
পঞ্চমত বলা যায় যে, যুক্তিটি এমন যা পেশ করতে আধুনিক যুগের মানুষের লজ্জাবনত হওয়া উচিত বলেই মনে
হয়। বর্তমান যুগে যেভাবে শিশু-সন্তানদের লালন-পালন করা হচ্ছে, তার বীভৎস পরিণতি দুনিয়ার সামনে উন্মুক্ত
হয়ে গেছে। এসব প্রতিষ্ঠান মানুষকে প্রকৃত মনুষ্যত্বের দিকে এগিয়ে নেয়ার পরিবর্তে নিতান্তপশুর স্তরে নামিয়ে
দিয়েছে। আজকের মানুষের হিংস্রতা ও বর্বরতা জঙ্গলের পশুকেও লজ্জা দেয়। আজকের মানব সমাজ জাহান্নামে
পর্যবসিত হয়েছে। তার একটি মাত্রই কারণ, আর তা হচ্ছে এই যে মানুষকে-ভালবাসা, দরদ, প্রীতি, সহানুভূতি
সুকোমল ভাবধারা থেকে বঞ্চিত করে দিলে তখন আর মানুষ মানুষ থাকে না। তখন জঙ্গলের হিংস্র জন্তু ও তার
মধ্যে কোন পার্থক্য খুঁজে পাওয়া যায় না। অথচ মানুষের স্বভাবগত এই প্রেম-ভালবাসা, দরদ-প্রীতি স্বাভাবিকভাবে
লালিত-পালিত হলে তা মানুষকে ফেরেশতার চেয়েও অধিক উন্নত করে দিতে পারে। আইনের কঠোর শাসন
দিয়ে মানুষকে বন্দী জানোয়ার তো বানানো যেতে পারে, কিন্তু তার মধ্যে মনুষ্যত্বকে জাগিয়ে তোলা সম্ভব নয়।
মায়ের মমতা ও ¯েœহময় ক্রোড়ই মানুষের মধ্যে মনুষ্যত্ব জাগাতে পারে। মা তার মমতাসিক্ত দৃষ্টি দিয়ে দুগ্ধপোষ্য
শিশুকে মনুষ্যত্বের এমন উচ্চতর জ্ঞান শিক্ষা দিতে পারেন, এমন সব মহৎ গুণে তাকে ভূষিত করতে পারেন, যা
এখনকার কোন প্রশিক্ষণ কেন্দ্র আর কোন গবেষণাগারও করতে পারবে না। বস্তুত মা শিশুকে কেবল স্তনই দেন
না, প্রতি মুহূর্তের সাহচর্যে অলক্ষ্যে এমন সব ভাবধারা মগজে বসিয়ে দেন, যার দরুণ এক ক্ষীণ, দুর্বলপ্রাণ শিশু
জীবিত থাকে, লালন-পালনে ক্রমশ বর্ধিত হয়ে উঠে। মায়ের ঘুমপাড়ানি গান শিশুর চোখে কেবল ঘুমই এনে দেয়
না, শত্রæতা, ঘৃণা, হিংসা ও মানসিক কুটিলতাকেও ¯েœহ-মমতার নির্মল স্রোতধারায় ভাসিয়ে দেয়।
একটু সহজ দৃষ্টিতে বিচার করলেই দেখা যাবে, পরিবার অতি ক্ষুদ্র ও হালকা একটি প্রতিষ্ঠান মাত্র। তার অবশ্য
কিছু বাধ্যবাধকতা আছে, আছে কিছু দাবি ও দায়দায়িত্ব। লালন-পালন ও সংগঠনের জন্যে তার নিজস্ব কতগুলো
বিশেষ নিয়ম-প্রণালীও রয়েছে। যারা পারিবারিক জীবন যাপন করতে অভ্যস্ত, তারা সেসব সহজেই অনুধাবন
করতে সক্ষম। আর তারাই সেসবের মনস্তাত্তি¡ক ও অভ্যন্তরীণ ভাবধারাকে যথাযথ রক্ষা করে তার লালনপালনের কর্তব্যও সঠিকভাবে পালন করতে পারে। পক্ষান্তরে রাষ্ট্র হচ্ছে একটি ব্যাপক, বড় ও ভারী প্রতিষ্ঠান,
যাকে প্রধানত আইন ও শাসনের ভিত্তিতেই চলতে হয়। এখন পরিবারকে ভেঙ্গে দিয়ে যদি গোটা রাষ্ট্রকে একটি
পরিবারে পরিণত করে দেয়া হয়, তাহলে পরিবারের লোকদের মধ্যে পারস্পরিক যে আন্তরিকতা ও দরদ-প্রীতির
ফল্গুধারা প্রবাহিত তা নিঃশেষে ফুরিয়ে যাবে। রাষ্ট্র পরিবারের আইন-বিধানের প্রয়োজন তো পূরণ করতে পারে;
কিন্তু নিকটাত্মীয় ও রক্ত সম্পর্কের লোকদের পারস্পরিক আন্তরিক ভাবধারার বিকল্প সৃষ্টি করতে সক্ষম নয়
কোনক্রমেই।
মানুষের প্রকৃতিই এমন যে, তাকে যতদূর সীমাবদ্ধ পরিবেশের মধ্যে রেখে লালন-পালন করা হবে, তার
অভ্যন্তরীণ যোগ্যতা-প্রতিভা তত বেশী বিকাশ, স্বচ্ছ ও পবিত্রতা লাভ করতে সক্ষম হবে। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দায়িত্ব
পালনের অভিজ্ঞতার ভিতর দিয়ে অগ্রসর হয়েই মানুষ বৃহত্তর দায়িত্ব পালনের যোগ্য হতে পারে। পরিবার
ব্যবস্থাকে ধ্বংস করে দিয়ে মানব সন্তানকে যদি রাষ্ট্রের বিশাল উন্মুক্ত পরিবেশে সহসাই নিক্ষেপ করে দেয়া হয়,
তাহলে তার পক্ষে সঠিক যোগ্যতা নিয়ে গড়ে ওঠা কখনই সম্ভব হবে না। পরন্তু পরিবারকে রাষ্ট্রীয় প্রভাবের বাইরে
যথাযথভাবে রক্ষা করা হলে তা মানব বংশের জন্যে এক উপযুক্ত প্রশিক্ষণ-কেন্দ্র (ঞৎধরহরহম পবহঃবৎ) হতে
পারে, যার ফলে মানব প্রজন্ম উত্তরকালে রাষ্ট্রের বিরাট দায়িত্ব পালনের যোগ্যতা অর্জনের সুযোগ পাবে।
১. আমরা পরিবারবদ্ধ জীবনের ধারণা পাইক. আল-কুরআনের মাধ্যমে খ. আল-হাদিসের মাধ্যমে
গ. ইতিহাস পাঠের মাধ্যমে ঘ. সমাজবিজ্ঞানীদের মাধ্যমে।
২. পৃথিবীতে মানুষের আবির্ভাব কীভাবে ঘটেছে?
ক. বিবর্তনের মাধ্যমে খ. হযরত আদম ও হাওয়ার (আ.) মাধ্যমে
গ. মিকাঈল ফেরেশতার মাধ্যমে ঘ. জিবরাইল ফেরেশতার মাধ্যমে।
৩. ‘‘পারিবারিক জীবন হচেছ সমাজ জীবনের ভিত্তিপ্রস্তর’’-এটি কার মতবাদ?
ক. নৃতাত্তি¡কদের খ. সমাজবিজ্ঞানীদের
গ. ইসলামী সমাজবিজ্ঞানীদের ঘ. সকল উত্তরই সঠিক।
সংক্ষিপ্ত উত্তর-প্রশ্ন
১. পরিবারের উৎপত্তি স¤পর্কে ধারণা দিন।
২. পরিবারের ক্রমবিকাশ সংক্ষেপে লিখুন।
৩. পরিবার বিলুপ্ত করা কি যুক্তিসংগত? আপনার মতামত লিখুন।
৪. পরিবার প্রথা বিলুপ্তির কুফল বর্ণনা করুন।
রচনামূলক উত্তর-প্রশ্ন
১. পরিবারের উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ স¤পর্কে আলোকপাত করুন।
২. পরিবার বিরোধী চিন্তা ও তাদের যুক্তিগুলো খন্ডন করুন।
FOR MORE CLICK HERE
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস মাদার্স পাবলিকেশন্স
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস ১ম পর্ব
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস
আমেরিকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস
বাংলাদেশের ইতিহাস মধ্যযুগ
ভারতে মুসলমানদের ইতিহাস
মুঘল রাজবংশের ইতিহাস
সমাজবিজ্ঞান পরিচিতি
ভূগোল ও পরিবেশ পরিচিতি
অনার্স রাষ্ট্রবিজ্ঞান প্রথম বর্ষ
পৌরনীতি ও সুশাসন
অর্থনীতি
অনার্স ইসলামিক স্টাডিজ প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত
অনার্স দর্শন পরিচিতি প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত