বিচারকার্য ও জনগণের মধ্যকার পারস্পরিক ঝগড়া-বিবাদ মীমাংসা করা ইসলামের দৃষ্টিতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ
কাজ। এ কাজটি সুষ্ঠুভাবে সুসম্পন্ন হওয়ার উপরই মানব সমাজের শান্তি, স্বস্তি, নিরাপত্তা ও অগ্রগতি
সর্বতোভাবে নির্ভর করে। কেননা যে সমাজে বিচার নেই, জনগণের ফরিয়াদ পেশ করার কোন স্থান নেই এবং
তার প্রতিকার করারও কোন সুষ্ঠু ব্যবস্থা নেই তা পাশবিক সমাজ হতে পারে, তা কখনোই মানুষের
বাসোপযোগী সমাজ হতে পারে না। মানুষের জন্য শুধু বিচার নয় বরং সুবিচারের ব্যবস্থা থাকা জরুরি। ফরিয়াদ
পেশ করার একটা স্থান থাকাই যথেষ্ট নয়, বরং তা আন্তরিকতা সহকারে শোনার এবং তার নিরপেক্ষ ও
ইনসাফপূর্ণ প্রতিকারের ব্যবস্থা থাকাও একান্ত আবশ্যক। ইসলামী সমাজ ব্যবস্থায় শুধু বিচারের ব্যবস্থা আছে
বলা ঠিক হবে না, এতে আছে সর্বতোভাবে ন্যায়সংগত নিরপেক্ষ ও আদর্শ ভিত্তিক সুবিচার। এ সুবিচার
মানুষকে দেয় পূর্ণ মানবীয় মর্যাদা নিয়ে মানব সমাজে বসবাস করার অপূর্ব সুযোগ আর প্রতিটি নাগরিকের জন্য
নিশ্চিত করে তার মানবিক ও মৌলিক অধিকার এবং তার ব্যক্তি স্বাধীনতা। পক্ষান্তরে সমাজে যদি বিচারের
নামে চলে জুলুম, শোষণ, নির্যাতন, সুবিচার বলতে কোথাও কিছু খুঁজে না পাওয়া যায়, তবে চারিদিকে
অরাজকতা-উচ্ছৃঙ্খলতা মারামারি, হানাহানি, চুরি ডাকাতি দেখা দেয়া অবধারিত এবং তখন পুরো সমাজটাই হয়
চরমভাবে বিপর্যস্ত।
কুরআন-সুন্নাহর আলোকে বিচারব্যবস্থা
ইসলাম একমাত্র পূর্ণাঙ্গ জীবন ব্যবস্থা। এ জীবন দর্শনে মানুষের ইহ ও পারলৌকিক জীবনের সকল বিষয়ের
নির্ভুল ও সুষ্ঠু সমাধান রয়েছে। কাজেই মানব জীবনে রাষ্ট্র যেমন অপরিহার্য বিষয় তদ্রƒপ বিচারব্যবস্থাও রাষ্ট্রের
অপরিহার্য অংগ। আল-কুরআনের দৃষ্টিতে প্রকৃত বিচারক হচ্ছেন আল্লাহ। তাই তাঁর দেয়া বিধান মোতাবেক
বিচার-মীমাংসা করা একান্ত কর্তব্য।
‘‘তোমরা যখন মানুষের মধ্যে বিচার কার্য পরিচালনা করবে তখন ন্যায়পরায়ণতার সাথে বিচার করবে।’’ (সূরা
আন-নিসা : ৫৮)
অতএব বিচারকের দায়িত্ব হল জনগণের মধ্যে আল্লাহর বিধান মোতাবেক বিচার নিষ্পত্তি করা। বিচারক
নিয়োগের উদ্দেশ্য যেহেতু একটি ফরয প্রতিষ্ঠা করা, সেজন্য বিচারক নিয়োগও নিঃসন্দেহে একটি ফরয কাজ।
তাছাড়া মহানবী (স) দেশের বিভিন্ন এলাকায় তাঁর সাহাবীগণকে বিচারক হিসেবে প্রেরণ করতেন। তিনি মুআয
পাঠ ঃ ২
ইসলামিক স্টাডিজ-৪ : ইসলামী রাষ্ট্র ব্যবস্থা বিএ/বিএসএস প্রোগ্রাম
ইউনিট-৩ : ইসলামী রাষ্ট্রের প্রশাসনিক পদ্ধতি পৃষ্ঠা- ৫৬
ইবনে জাবাল (রা.)-কে ইয়ামনে এবং আত্তাব ইবনে উসায়দ (রা.) কে মক্কায় বিচারক নিয়োগ করেছিলেন। এর
দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, বিচারক নিয়োগ রাষ্ট্রপ্রধানের একটি অন্যতম ফরয-কর্তব্য।
আল্লাহর বিধান মোতাবেক বিচার না করা কুফরী
মানুষ আল্লাহর সৃষ্টি। কাজেই নিঃশর্তভাবে তাঁর নির্দেশ মান্য করা অপরিহার্য কর্তব্য। কেননা যিনি সৃষ্টি করেছেন
তাঁর বিধানই চলবে। এটাই হওয়া উচিত। এহেন অবস্থায় আল্লাহর নির্দেশ অমান্য করে অপর কারো নির্দেশ
মান্য করা কুফরী।
“কিন্তু না, তোমার প্রতিপালকের শপথ! তারা মুমিন হবে না যতক্ষণ পর্যন্ত তারা তাদের নিজেদের বিাবদ-
বিসস্বাদের ভার তোমার উপর অর্পণ না করে।’’ (সূরা আন-নিসা : ৬৫)
উপরিউক্ত আয়াতদ্বয় দ্বারা প্রমাণিত হয়, যারা আল্লাহর বিধান মোতাবেক বিচার-মীমাংসা করে না এবং নবীর
সিদ্ধান্ত সন্তুষ্টচিত্তে মেনে নিতে পারে না তারা কখনও মুমিন হতে পারে না। অন্য দিকে বলা যায়, নবীর সিদ্ধান্ত
অস্বীকার করা দূরে থাক, নবীর সিদ্ধান্তের ব্যাপারে সন্দেহ পোষণ করলেও সে মুমিন হতে পারে না।
বিচারকের পদ ঃ যে ব্যক্তি বিচারকার্য পরিচালনায় দক্ষ তাকে বিচারকের পদ প্রদান করা হলে তা গ্রহণ করা
তার কর্তব্য। কারণ তিনি অস্বীকৃতি জানালে এবং উক্ত পদে অযোগ্য লোক সমাসীন হলে বিচারকার্য বাধাগ্রস্ত ও
ইনসাফ প্রতিষ্ঠায় সমস্যার উদ্ভব হতে পারে। মহানবী (স) স্বয়ং বিচারকার্য পরিচালনা করেছেন এবং তাঁর
সাহাবীগণও বিচারকের পদ অলংকৃত করেছেন। মহানবী (স) বলেন,
إذا اجتهد الحاكم فأصاب فله أجران و ان اجتهد فأخطأ فله أجر .
“বিচারক ইজতিহাদ করে সত্যে উপনীত হলে তার জন্য দিগুণ সওয়াব এবং ইজতিহাদে ভুল করলে তার জন্য
একগুণ সওয়াব রয়েছে। অপর এক বর্ণনায় আছে, তার জন্য দশগুণ সওয়াব রয়েছে।”
বিচারক যখন বিচার নিষ্পত্তির জন্য বসেন তখন আল্লাহ তার নিকট দু’জন ফেরেশতা প্রেরণ করেন। তারা
তাঁকে সৎপথ দেখান এবং যথার্থ বিষয় নির্দেশ করেন। তিনি ন্যায়বিচার করলে তারা তাঁর সাথে অবস্থান করেন
এবং অবিচার করলে তার প্রতিবাদ করেন এবং তাঁকে ত্যাগ করেন।
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) বলেন-
لأن أجلس قاضيا بين اثنين أحب إلى من عبادة سبعين سنة .
“বিবদমান পক্ষদ্বয়ের মাঝে বিচারক হয়ে বসা আমার কাছে সত্তর বছরের ইবাদত অপেক্ষা প্রিয়।”
তবে অযোগ্য ব্যক্তির বিচারকের পদে আসীন হওয়া সমীচীন নয়। মহানবী (স) বলেছেন“বিচারক তিন ধরনের। একজন জান্নাতে এবং অপর দু’জন জাহান্নামে যাবে। যে ব্যক্তি সত্যকে উপলব্ধি করে
তদনুযায়ী রায় প্রদান করে সে জান্নাতে যাবে। যে ব্যক্তি সত্যকে উপলব্ধি করা সত্তে¡ও তা উপেক্ষা করে অন্যায়
রায় প্রদান করে সে জাহান্নামে যাবে। আর যে ব্যক্তি অজ্ঞতা প্রসূত রায় প্রদান করে সেও জাহান্নামে যাবে।
বিচারক নিয়োগের শর্তাবলী
বিচারক নিয়োগের শর্তাবলী দু’ভাগে বিভক্ত ঃ
ক. অপরিহার্য শর্তাবলী
খ. পরিপূরক শর্তাবলী
অপরিহার্য শর্তাবলী ঃ বিচারককে অবশ্যই মুসলিম, প্রাপ্তবয়স্ক, বুদ্ধিজ্ঞান সম্পন্ন, চক্ষুষ্মান, শ্রবণশক্তি সম্পন্ন,
বাকশক্তি সম্পন্ন এবং ব্যভিচারের মিথ্যা অপবাদ প্রদান-এর দন্ড থেকে মুক্ত হতে হবে। কাজেই কাফির,
অপ্রাপ্তবয়স্ক, পাগল, অন্ধ, মূক ও বধির ব্যক্তিকে বিচারক নিয়োগ করা বৈধ নয়। হানাফী মাযহাব মতে
ব্যভিচারের মিথ্যা অপবাদ-এর দন্ড ভোগকারীকে বিচারক নিয়োগ করা বৈধ নয়। তবে অন্যান্য মাযহাবের মতে,
দন্ড ভোগকারী তাওবা করে সংশোধন হলে তাকে বিচারক নিয়োগ করা যাবে। পক্ষান্তরে যার মধ্যে অপরিহার্য
শর্তাবলীসহ সহায়ক শর্তাবলীও পাওয়া যাবে সে বিচারক হিসেবে নিয়োগ লাভে প্রাধান্য পাবে। বিচারকের
ন্যায়পরায়ণ হওয়া একটি অপরিহার্য শর্ত। কাজেই যে ব্যক্তি ন্যায়পরায়ণ নয় তাকে বিচারক নিযুক্ত না করাই
সমীচীন। আর ন্যায়পরায়ণ ব্যক্তির উপস্থিতিতে তার নিয়োগ অবৈধ।
উল্লেখ্য যে, বিচারককে ইজতিহাদ করার যোগ্যতা সম্পন্ন জ্ঞানী হতে হবে। অন্যথায় তাকে নিয়োগ করা বৈধ
হবে না। এটা একটি পরিপূরক শর্ত বটে।
পরিপূরক শর্তাবলী ঃ অপরিহার্য শর্তাবলী ছাড়াও আরো কিছু শর্ত রয়েছে। যেমন- আইনের সাথে সম্পর্কিত
প্রচলিত প্রথা, ঐতিহ্য ও রসম-রেওয়াজ সম্পর্কে তাকে ওয়াকিফহাল হতে হবে। তার লোভ-লালসা মুক্ত ও
নিরপেক্ষ হওয়া একান্তভাবে বাঞ্ছনীয়।
বিচারকের গুণাবলী
একজন বিচারকের মধ্যে যেসব গুণ থাকা বাঞ্ছনীয় তার সংখ্যা অনেক। নিæে তার কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ গুণের
উল্লেখ করা হল১. বিচারক মোকদ্দমার বিবরণ গভীর মনোনিবেশ সহকারে শোনবেন এবং তা হৃদয়ঙ্গম করে সঠিক সিদ্ধান্তে
উপনীত হতে আপ্রাণ চেষ্টা চালাবেন। যেমন ওমর ফারুক (রা.) তাঁর এক পত্রে আবূ মূসা আল-আশআরী (র)
কে বলেছেন, আপনার নিকট কোন বিবাদ মীমাংসার জন্য পেশ করা হলে বিবদমান পক্ষদ্বয়ের বক্তব্যকে
গভীরভাবে অনুধাবন করতে হবে। তা না হলে আপনার পক্ষে সঠিক সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া সম্ভব নয়।
২. বিচারক বাদী ও বিবাদীর সাথে সমতাপূর্ণ আচরণ করবেন। তিনি উভয় পক্ষকে তার সামনে বসাবেন। এক
পক্ষকে ডান পার্শ্বে এবং অপর পক্ষকে বাম পার্শ্বে বসাবেন না। কারণ শরীআতে ডান ও বাম পার্শ্বের মর্যাদায়
তারতম্য আছে। একবার ওমর ফারুক (রা.) তাঁর খিলাফতকালে তিনি ও উবাই ইবনে কাব বাদী ও বিবাদী
হিসেবে যায়দ (রা.) এর আদালতে উপস্থিত হলে ওমর (রা) -কে বসার জন্য একটি চেয়ার এগিয়ে দেন। ওমর
(র) সাথে সাথে প্রতিবাদ করে যায়দকে বললেন, এ হচ্ছে আপনার প্রথম অন্যায়। অতঃপর তিনি বিচারকের
সামনে বসে পড়লেন।
৩. বিচারক সাক্ষীদের সাথে এমন আচরণ করবেন না যাতে তারা ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে পড়ে। এরূপ হলে তারা
যথাযথভাবে সাক্ষ্য প্রদানে অপারগ হয়ে যাবে। ফলে আদালতে সত্য অনুদঘাটিত থেকে যাবে। অনুরূপভাবে
তিনি বাদী বা বিবাদী কোন পক্ষের সাথে এমন আচরণ করবেন না, যার ফলে তার সততা ও নিরপেক্ষতা নিয়ে
প্রশ্ন উঠতে পারে।
৪. বিচারক উত্তম পোশাকে সজ্জিত হয়ে আদালতে উপস্থিত হবেন এবং আসন গ্রহণের শেষে বাদী ও বিবাদী
উভয় পক্ষকে সালাম দেবেন। তবে তিনি এক পক্ষকে বাদ দিয়ে অপর পক্ষকে সালাম দেবেন না।
৫. বিচারক কোন পক্ষ কর্তৃক প্রভাবিত কিংবা ভীত-সন্ত্রস্ত হতে পারবেন না; বরং তাকে নির্ভীক হতে হবে।
অনুরূপভাবে তিনি হবেন বিনয়ী, ভদ্র ও কোমলপ্রাণ। কর্কষভাষী, পাষাণ-হৃদয় ও নিষ্ঠুর হওয়া তার জন্য শোভন
নয়।
৬. বিচারক আদালতে এমন কোন কাজ করবেন না যা বিচার কার্যের সাথে সংশ্লিষ্ট নয়। তিনি মোকদ্দমার রায়
ঘোষণার পূবর্ পর্যন্ত তা গোপন রাখবেন, অন্যথায় তা কারো দ্বারা প্রভাবিত হওয়ার সম্ভাবনা থেকে যায়।
৭. বিচারক শান্ত মেজাজে মোকদ্দমা পরিচালনা করবেন এবং রায় দেবেন। তার মধ্যে ক্রোধ জাগ্রত হলে কিংবা
তার ভীষণ ক্ষুধা কিংবা নিদ্রা-আচ্ছন্ন করে ফেললে অথবা কোন কারণে তার মাঝে অস্থিরতা বিরাজ করলে তিনি
মোকদ্দমা পরিচালনা করা থেকে বিরত থাকবেন।
৮. রায় প্রদানের দিন তিনি এমন কোন নফল ইবাদতে লিপ্ত হবেন না যার ফলে বিচারকার্যে তার দৈহিক কিংবা
মানসিক চাপ বৃদ্ধি পেতে পারে।
৯. বিচারকের আত্মীয়-স্বজন পরস্পরের বিরুদ্ধে মোকদ্দমা দায়ের করলে তিনি তাড়াহুড়া না করে বরং তাদের
মাঝে সমঝোতা স্থাপনের যথাসাধ্য চেষ্টা করবেন। যদি সমঝোতায় উপনীত হওয়া সম্ভব না হয় তবে পূর্ণ
নিরপেক্ষতা বজায় রেখে মোকদ্দমা পরিচালনা করবেন। কারণ আল্লাহ বলেন, خير والصلح “সমঝোতা
স্থাপনই উত্তম।” (সূরা আন-নিসা :১২৮)
১০. বিচারক নিজ আত্মীয় অথবা অন্তরঙ্গ বন্ধু ব্যতীত অপর কারো নিকট হতে অর্থকড়ি বা অন্য কিছু গ্রহণ
করতে পারবেন না। অনুরূপভাবে তিনি নিজ আত্মীয় ব্যতীত অপর কারো নিকট হতে উপহার-হাদিয়া গ্রহণ
করতে পারবেন না। বিবদমান কোন পক্ষ থেকে উপঢৌকন গ্রহণ করলে তা ঘুষ হিসেবে গণ্য হবে। কেননা নবী
(স) বলেছেন ঃ
هدايا العمال سحت .
“সরকারী কর্মচারীদেরকে প্রদত্ত উপঢৌকন অবৈধ মাল হিসেবে গণ্য।”
১১. বিচারক বাদী অথবা বিবাদীর ভোজ সভায় অংশ গ্রহণ করতে পারবেন না। তবে কোন ভোজ সভায় বাদী ও
বিবাদী অংশগ্রহণ করলে তিনি সেখানে উপস্থিত থাকতে পারবেন।
১২. বিচারককে জ্ঞান-গরিমার দিক থেকেও প্রজ্ঞাবান হতে হবে। বিশেষত আইন সংক্রান্ত বিষয়ে প্রভূত জ্ঞানের
অধিকারী হতে হবে।
বিচারকার্য পরিচালনার ম‚লনীতি
বিচারকার্যে যথার্থ সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়ার জন্য বিচারককে সর্বপ্রথম আল্লাহর বিধান অনুযায়ী বিচারকার্য
পরিচালনা করতে হবে। এজন্য তাকে অবশ্যই কুরআনের বিধান সম্বলিত আয়াতসমূহ সম্পর্কে গভীর জ্ঞানের
অধিকারী হতে হবে। আল-কুরআনের পর প্রয়োজনবোধে সুন্নাহ মোতাবেক ফয়সালা করতে হবে। এ জন্য
বিধান সম্বলিত হাদীসসমূহ স¤পর্কে বিচারকের জ্ঞান থাকা আবশ্যক। কুরআন ও সুন্নায় কোন সমাধান পাওয়া
না গেলে বিচারককে মহানবী (স)-এর সাহাবীগণের ইজমা’র শরণাপন্ন হতে হবে। একই বিষয়ে সাহাবীগণের
বিভিন্ন মত থাকলে বিচারক তার প্রজ্ঞার ভিত্তিতে যে কোন একটি মতকে প্রাধান্য দিবেন। কিন্তু বিচারক সকলের
মতামত ত্যাগ করে তার নিজস্ব মত অনুযায়ী রায় প্রদান করলে তা বাতিল বলে গণ্য হবে। কারো কারো মতে,
এক্ষেত্রেও বিচারক দ্বিমত পোষণ করতে পারেন। কোন রায় কোন বিষয়ে সাহাবীগণের মধ্যে বিদ্যমান না
থাকলে এবং সে বিষয়ে তাবেয়ীগণের ইজমা প্রসূত সিদ্ধান্ত পাওয়া গেলে বিচারক তদনুযায়ী মীমাংসা করবেন।
তবে কোন বিষয়ে তাবেয়ীদের কোন অভিমত না থাকলে এবং বিচারক ইজতিহাদ করার যোগ্যতা সম্পন্ন হলে
একান্তই যথার্থ সত্যে উপনীত হওয়ার জন্য যথাসাধ্য ইজতিহাদ করে রায় প্রদান করবেন। তিনি যদি মুজতাহিদ
না হন, তবে মুজতাহিদ আলিমগণের সাথে পরামর্শ করে সঠিক সিদ্ধান্তে উপনীত হবেন এবং এ ব্যাপারে তাদের
সাথে পরামর্শ করতে আদৌ লজ্জাবোধ করবেন না।
উল্লেখ্য যে, বিচারকের রায় প্রদানের পর যদি দেখা যায় যে, তা সরাসরি কুরআন-সুন্নাহ বিরোধী তবে উক্ত রায়
বাতিল বলে গণ্য হবে।
মহিলা বিচারক নিয়োগ
হানাফী মাযহাব মতে দেওয়ানী বিষয়ে মহিলা বিচারক নিয়োগ করা যেতে পারে। কিন্তু দন্ডাদেশ বিষয়ে মহিলা
বিচারক নিয়োগ করা যাবে না। ইমাম ইবনে জারীর তাবারী (র) বলেন, সাধারণভাবে সর্বক্ষেত্রে মহিলা বিচারক
নিয়োগ করা বৈধ। তবে হানাফী মাযহাব ব্যতীত অন্যান্য মাযহাবে মহিলা বিচারক নিয়োগ করা বৈধ নয়।
পাপী ব্যক্তিকে বিচারক নিয়োগ
পাপী ব্যক্তিকে বিচারক নিয়োগ করা বৈধ। ইসলামী শরীআতের সীমা লংঘন না করলে তার রায় কার্যকর হবে।
তবে পাপীকে বিচারক নিয়োগ না করাই শ্রেয়। ইমাম শাফেঈ, মালিক ও আহমাদ (র)-এর মতে পাপী ব্যক্তিকে
বিচারক নিয়োগ করা বৈধ নয় এবং তার রায়ও কার্যকর হবে না। কোন ব্যক্তি বিচারক নিযুক্ত হওয়ার পর পাপ
কার্যে লিপ্ত হলে সে বরখাস্ত হবে এবং তাকে অপসারণ করানো সরকারের কর্তব্য।
বিচারকের বেতনভাতা
মহানবী (স) বলেছেন, “আমরা কোন ব্যক্তিকে সরকারী কাজে নিয়োগ দিলে এবং তার বাসস্থান না থাকলে
তার জন্য ব্যবস্থা করব, তার খাদেম না থাকলে আমরা তার ব্যবস্থা করব, তার স্ত্রী না থাকলে আমরা তার
বিবাহের ব্যবস্থা করব। মহানবী (স) তাঁর জীবদ্দশায় ইসলামী রাষ্ট্রের বিভিন্ন এলাকায় যাদেরকে নিয়োগ প্রদান
করেছেন তাদের বেতন-ভাতা নির্ধারণ করে দিয়েছেন। পরবর্তী চার খলীফার সময়ও এ প্রথা বহাল ছিল।
বিচারক যদি সচ্ছল হন এবং বায়তুলমাল থেকে কোন প্রকার বেতন-ভাতা গ্রহণ না করেও চলতে পারেন তবে
তা গ্রহণ না করাই উত্তম। তবে তার নিজের এবং তার কর্মচারীদের যে কোন অবস্থায় বেতন-ভাতা গ্রহণ করা
বৈধ, এমনকি ছুটির দিনের বেতন-ভাতা গ্রহণ করাও বৈধ। বিচারক তার পরিবার-পরিজনের ভরণপোষণও
বায়তুলমাল থেকে পাবেন।
বিচারকের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল
বিচারকের রায় যদি কুরআন, সুন্নাহ ও ইজমা ভিত্তিক হয়ে থাকে এবং উচ্চতর আদালতের পর্যালোচনায় যদি
দেখা যা যে, তা উপরিউক্ত উৎসসমূহের সাথে সংগতিপূর্ণ হয় তবে পূর্বোক্ত রায় বহাল থাকবে। কিন্তু এর
বিপরীত হলে উচ্চতর আদালত অবশ্যই উক্ত রায় বাতিল ঘোষণা করে সঠিক রায় প্রদান করবে।
বিচারকের রায় যদি ইজতিহাদী গবেষণাধর্মী বিষয়ের সাথে সংশ্লিষ্ট হয় এবং একই বিষয়ে একাধিক অভিমত
পাওয়া যায়, সে ক্ষেত্রে যে কোন মত অনুসরণ করার ব্যাপারে বিচারকের স্বাধীনতা থাকবে। মোটকথা
বিচারকের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করার সুযোগ ইসলাম সম্মত।
বিচারকের দায়িত্বের অবসান
নিæোক্ত কারণে বিচারকের দায়িত্বের অবসান ঘটবে১. বিচারকের চাকুরীর মেয়াদকাল শেষ হয়ে গেলে। তবে নিয়োগদাতা মেয়াদ বাড়ালে স্বতন্ত্র কথা।
২. বিচারক স্বপদে ইস্তফা দিলে এবং নিয়োগকর্তা কর্তৃক তার পদত্যাগপত্র গৃহীত হলে। পদত্যাগপত্র গৃহীত না
হওয়া পর্যন্ত তাকে দায়িত্ব পালন করে যেতে হবে এবং এ সময়ে প্রদত্ত তার রায় কার্যকর হবে।
৩. বিচারক উৎকোচ গ্রহণ করলে এবং তা প্রমাণিত হলে।
৪. বিচারক পাগল হয়ে গেলে। কারণ পাগলের পক্ষে বিচারকের দায়িত্ব পালন করা সম্ভব নয়।
৬. বিচারক দায়িত্ব পালনে অক্ষম হয়ে পড়লে।
৭. ইসলাম ধর্ম ত্যাগ করলে।
সাক্ষ্য প্রদান
বিচারকার্য সঠিকভাবে সম্পাদন করার ক্ষেত্রে সাক্ষীর ভ‚মিকা অনস্বীকার্য। সাক্ষ্য দেওয়ার জন্য সাক্ষ্যদাতার
নি¤œলিখিত গুণাবলী থাকা একান্ত প্রয়োজন১. সাক্ষ্যদাতাকে বোধশক্তিসম্পন্ন এবং প্রাপ্ত বয়স্ক হতে হবে।
৫. সাক্ষ্যদাতাকে ন্যায়পরায়ণ হতে হবে।
৬. সাক্ষ্যদাতাদের সংখ্যা কমপক্ষে দু’জন হতে হবে।
৭. সাক্ষ্যদাতাকে ‘আমি সাক্ষ্য প্রদান করছি’ শব্দযোগে সাক্ষ্য দিতে হবে।
৮. যে বিষয়ের সাক্ষ্য দেওয়া হবে সে বিষয়ে সাক্ষীগণের জ্ঞান থাকতে হবে।
৯. আদালতে উপস্থিত হয়ে সাক্ষ্য দিতে হবে।
১০. সাক্ষ্যদাতা প্রতিপক্ষের শত্রæ হতে পারবে না।
১১. সাক্ষ্যদান নিঃস্বার্থ ও প্রভাবমুক্ত হতে হবে।
যে সকল লোকের সাক্ষ্য অগ্রহণযোগ্য
১. পিতামাতার অনুক‚লে সন্তানের সাক্ষ্য
২. সন্তানের অনুক‚লে পিতামাতার সাক্ষ্য
৩. স্ত্রীর অনুক‚লে স্বামীর সাক্ষ্য
৪. স্বামীর অনুক‚লে স্ত্রীর সাক্ষ্য
৫. অপ্রাপ্ত বয়স্কের সাক্ষ্য
৬. পাগলের সাক্ষ্য
৭. মিথ্যুক হিসেবে পরিচিতি ব্যক্তির সাক্ষ্য
৮. সূদখোর ব্যক্তির সাক্ষ্য
৯. ফরয ত্যাগকারীর সাক্ষ্য
১০. যে বিষয় দেখার সঙ্গে সস্পর্কিত সেক্ষেত্রে অন্ধ ব্যক্তির সাক্ষ্য
১১. বোবা ও বধির ব্যক্তির সাক্ষ্য
মহিলার সাক্ষ্য
১. দন্ড ও হত্যার ক্ষেত্রে মহিলার সাক্ষ্য গ্রহণযোগ্য নয়।
২. দন্ড ও হত্যা ব্যতীত অন্যান্য ক্ষেত্রে পুরুষের সাথে মহিলার সাক্ষ্য গ্রহণযোগ্য।
৩. বংশ প্রমাণ, দুধপান সংক্রান্ত প্রমাণ এবং মহিলার সাথে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে একজন মহিলার সাক্ষ্যও গ্রহণযোগ্য।
সারকথাঃ ইসলামী বিচারব্যবস্থা একটি কল্যাণকর ইনসাফপূর্ণ ব্যবস্থা। অপরাধ ও দুর্নীতি মুক্ত সমাজ
বিনির্মাণে এ ব্যবস্থার প্রবর্তন অপরিহার্য। মহানবী (স) খুলাফায়ে রাশেদীন, উমাইয়া ও আব্বাসীয় শাসন কালের
বিচারব্যবস্থা তার জ্বলন্ত প্রমাণ। আমরা এখানে কুরআন-সুন্নাহর আলোকে বিচারব্যবস্থা, বিচারকের পদ,
বিচারক নিয়োগের শর্তাবলী, বিচারকের গুণাবলী, বিচারকার্য পরিচালনার মূলনীতি, মহিলা বিচারক নিয়োগ,
পাপী ব্যক্তিকে বিচারক নিয়োগ, বিচারকের বেতন-ভাতা, বিচারকের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল, বিচারকের
দায়িত্বের অবসান এবং সাক্ষ্যদান বিষয়ে জানতে পেরেছি।
১. ইসলামী রাষ্ট্রের বিচারক বিচার করেনক. আল্লাহর বিধান মোতাবেক; খ. প্রধান বিচারপতির মতানুযায়ী;
গ. কাজীর মতামত অনুসারে; ঘ. রাষ্ট্রপতির ইচ্ছা অনুযায়ী।
২. আল্লাহর বিধান অনুযায়ী বিচার না করাক. কুফরী; খ. মোনাফেকী;
গ. অন্যায়; ঘ. উপরের সবগুলো উত্তর সঠিক।
৩. বিচারকের শর্তাবলী দুই’ভাগে বিভক্ত-এর একটি হল
ক. সাধারণ শর্তাবলী; খ. পরিপূরক শর্তাবলী;
গ. কঠিন শর্তাবলী; ঘ. সহজ শর্তাবলী।
৪. ‘‘মহিলা বিচারক নিয়োগ বৈধ’’ এটি কার মাযহাব?
ক. ইমাম শাফেঈ (র)-এর; খ. ইমাম আযম আবু হানিফা (র)-এর
গ. হযরত উমর (রা)-এর; ঘ. হযরত ইমাম মালিক (র)-এর।
৫. পাপী ব্যক্তিকে বিচারক নিয়োগ করা ইমাম শাফেয়ীর মতেক. বৈধ; খ. অবৈধ;
গ. শ্রেয় নয়; ঘ. করা যাবে।
সংক্ষিপ্ত উত্তর-প্রশ্ন
১. ইসলামে বিচারব্যবস্থার গুরুত্ব স¤পর্কে সংক্ষেপে লিখুন।
২. প্রমান করুন ‘‘আল্লাহর বিধান অনুযায়ী বিচার কার্য না করা কুফরী’’।
৩. বিচারক নিয়োগের শর্তাবলী সংক্ষেপে লিখুন।
৪. বিচারকের গুণাবলীর মধ্য হতে ৫টি গুণাবলী লিখুন।
৫. বিচার কাজ পরিচালনার মূলনীতি আলোচনা করুন।
৬. সাক্ষ্যদাতার জন্য অপরিহার্য ৭টি গুণের উল্লেখ করুন।
বিশদ উত্তর প্রশ্ন
১. বিচারক নিয়োগের শর্ত এবং বিচারকের গুণাবলী বিস্তারিত আলোচনা করুন।
২. সাক্ষ্যদাতার গুরুত্ব আলোচনাসহ সাক্ষ্যদাতার গুণাবলী কি কি? লিখুন।
FOR MORE CLICK HERE
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস মাদার্স পাবলিকেশন্স
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস ১ম পর্ব
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস
আমেরিকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস
বাংলাদেশের ইতিহাস মধ্যযুগ
ভারতে মুসলমানদের ইতিহাস
মুঘল রাজবংশের ইতিহাস
সমাজবিজ্ঞান পরিচিতি
ভূগোল ও পরিবেশ পরিচিতি
অনার্স রাষ্ট্রবিজ্ঞান প্রথম বর্ষ
পৌরনীতি ও সুশাসন
অর্থনীতি
অনার্স ইসলামিক স্টাডিজ প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত
অনার্স দর্শন পরিচিতি প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত