খোলাফায়ে রাশেদূনের সামরিক ব্যবস্থাপনা ,যুদ্ধ কৌশল স¤পর্কে বর্ণনা করুন।

সামরিক বিভাগ
মহানবী (স) মদীনায় যে রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেন সাধারণভাবে সে রাষ্ট্রের সকল নাগরিক দেশরক্ষার দায়িত্ব পালন
করত। খোলাফায়ে রাশেদূনের যুগেও সে আদর্শ বলবৎ ছিল। প্রাপ্ত বয়স্ক সব মুসলমানকে দেশরক্ষা ও জিহাদে
অংশ গ্রহণ করতে হতো এবং প্রয়োজনের সময় সকল প্রাপ্ত বয়স্ক মুসলমানের জন্য সামরিক বাহিনীতে
যোগদান ছিল অবশ্য কর্তব্য।
সামরিক নীতি ঃ খলীফা আবু বকর (রা) বিদ্রোহী ও ধর্মদ্রোহীদের দমনের জন্য ১১টি বৃহৎ অভিযান প্রেরণ
করেন এবং প্রত্যেকটি অভিযানই সফলকাম হয়। তাঁর শাসনকালেই সমসাময়িক বিশ্বের বৃহত্তম দু’টি সাম্রাজ্যের
সাথে আরবদের সীমান্ত সংঘর্ষের সূত্রপাত হয়। সে কারণে সামরিক বাহিনীকে নিয়মিত ও শৃংখলাবদ্ধ ভাবে
সংগঠিত করা অপরিহার্য হয়ে পড়ে। খলীফা উমর আরবদের বিশুদ্ধ সামরিক জাতি হিসেবে গড়ে তুলার জন্য
বিজিত দেশের ভ‚মি সৈন্যদের মধ্যে বন্টন প্রথা রহিতো করেন এবং মুসলমানদের বিজিত দেশে ভ‚মি ক্রয় করতে
নিষেধ করেন। কেননা মুসলমানগণ ছিলেন সাধারণভাবে “আল্লাহর সৈনিক” এবং যুদ্ধের জন্য যে কোন মুহূর্তে
তাদের স্বল্পসময়ের মধ্যে স্থানান্তরিত হতে হতো।
খলীফা আবু বকরের (রা) শাসনকালে আরবগণকে যদিও সংকটজনক যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করতে হয় তবুও
সৈন্যবাহিনী সংগঠনের প্রাপ্ত কৃতিত্ব খলীফা উমরের। তিনি সৈন্যবাহিনীর জন্য নিয়মিত বেতন ও আনুষাঙ্গিক
রেশন প্রদানের ব্যবস্থা প্রবর্তন করেন। সৈনিকদের নিয়মিত বেতন ও রেশনসহ পারিবারিক ভাতা প্রদান প্রথা
চালু করে বিশ্বে নতুন রেকর্ড সৃষ্টি করেন।
সামরিক ঘাঁটি ঃ খলীফা উমর সমগ্র সাম্রাজ্যকে ৯টি জুনদ বা সামরিক জেলায় বিভক্ত
করেন। জুনদগুলো হচেছ মক্কা, মদীনা, কুফা, বসরা, মৌসুল, ফুসতাত, মিসর, দামেস্ক, হেমস এবং
প্যালেসটাইন। স্থানগুলোতে সামরিক ঘাটি প্রতিষ্ঠিত হয়ে ছিল এবং প্রত্যেক ঘাটিতে ৪০০০ করে অশ্বারোহী
বাহিনী সর্বদা মওজুদ থাকত। অশ্বগুলোর উরুতে “আল্লাহর পথের অশ্ব” এ বাক্যটি ছাপ দেয়া থাকত। এ সব
প্রধান প্রধান সামরিক কেন্দ্র ছাড়াও সাম্রাজ্যের সকল শহরে, সীমান্ত এলাকা এবং উপকূলবর্তী গুরুত্বপূর্ণ স্থানে
সামরিক চৌকী প্রতিষ্ঠিত ছিল। সেখানে পশুর জন্য পশুচারণ ক্ষেত্র, সৈনিকের জন্য খাদ্য এবং যুদ্ধের জন্য
যাবতীয় সরঞ্জাম মওজুদ থাকত। সৈনিকদের বেতন প্রদানের জন্য একজন কর্মকর্তা নিযুক্ত ছিলেন। তাকে বলা
হতো আল-আরীফ।
ইরাফা ঃ বেতন প্রদানের সুবিধার জন্য ঘাঁটিতে অবস্থানকারী সৈন্যদলকে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দলে বিভক্ত করা হতো।
এক একটি বিভাগকে ইরাফা বলা হতো। প্রথম দিকে প্রত্যেক ইরাফায় দশ দশজন করে সৈনিক ছিল। বর্ণিত
আছে যে, প্রত্যেক ইরাফা পরবর্তীকালে আয়তনে বৃদ্ধি পায় এবং খলীফা উমর কাদেসীয়ার যুদ্ধে ৪৩ জন সৈনিক
দ্বারা এক একটি ইরাফা গঠন করেন। প্রত্যেক ইরাফায় মহিলাও ছিল। এক একটি ইরাফার ব্যয় বরাদ্দ ছিল
১,০০,০০০ দিরহাম। পরবর্তীকালে ইরাফার সদস্য সংখ্যা আরও বৃদ্ধি পায়।
পাঠ ঃ ৬সৈন্যদের বিভিন্ন বিভাগ ঃ কার্যকারীতার দিক থেকে সৈন্য বাহিনী প্রধানত ছয়টি ভাগে বিভক্ত ছিল। সেগুলো
হচেছ পদাতিক, অশ্বারোহী, তীরন্দায, স্কাউট, রিয়ার স্কাউট (জবধৎ ঝপড়ঁঃ) এবং গিলমান (ঝবৎাপব পড়ৎঢ়ং।
খলীফা উমর ও উসমানের শাসনকালে সিরিয়ার আমীর মুয়াবীয়া (রা) সর্বপ্রথম দেহরক্ষী বাহিনী গঠন করেন।
সিফফীনের যুদ্ধক্ষেত্রে নিশ্চিত মৃত্যুর হাত হতে মুয়াবীয়ার (রা) দেহরক্ষী বাহিনীই তাঁকে রক্ষা করে।
সৈনিকদের শ্রেণী ঃ সৈনিকগণ নিয়মিত ও অনিয়মিত এই দুই শ্রেণীতে বিভক্ত ছিল। নিয়মিত সৈন্যগণ ব্যারাকে
অবস্থান করত এবং নিয়মিত বেতন পেত। অনিয়মিত সৈন্যগণকে স্বেচছাসেবক হিসেবে সামরিক শিক্ষা দেয়া
হতো এবং প্রয়োজনের সময় রাষ্ট্রের আহŸানে তারা যুদ্ধে গমন করত। তাদের সরকারী ভাতার পরিমাণ ছিল
অপেক্ষাকৃত কম।
প্রতি দশজন সৈনিকের উপর একজন করে আমীরুল আশরাহ, প্রতি দশজন “আমীরুল আশরাহ”-র উপর
একজন করে কায়েদ বা লেফটেন্যান্ট এবং প্রতি দশজন কায়েদের বা ১০০০ জন সৈনিকের উপর একজন করে
আমীর নিযুক্ত করে সৈন্যবাহিনীর শৃংখলা বিধান করা হতো। অধীনস্থ সৈনিকগণ নেতার আদেশ অক্ষরে অক্ষরে
পালন করত।
সৈনিকদের বেতন ভাতা ঃ নিয়মিত সৈন্যদের বেতন ছিল আকর্ষণীয়। প্রথম দিকে তাদেরকে বাৎসরিক ২০০
দিরহাম বেতন দেয়া হতো। তা ক্রমশঃ ৩০০০ দিরহামে উন্নীত হয়। বেতন ছাড়াও একজন সৈনিক গানীমতের
অংশ, খাদ্য, বস্ত্র ও পারিবারিক ভাতা পেত। একজন সৈন্য বৎসরে গড়ে ৬০০০ দিরহাম পেত। একজন
সামরিক অফিসার বেতন হিসেবে সর্বমোট ৭০০০ হতে ১০,০০০ দিরহাম পেতেন। অশ্বারোহী পদাতিকের
দ্বিগুণ বেতন পেত।
সৈনিকদের অন্যান্য সুবিধা
সৈন্যবাহিনীর স্বাস্থ্য ও চিকিৎসার উপর গুরুত্ব দেয়া হতো। সর্বাপেক্ষা স্বাস্থ্যকর স্থানে সেনানিবাস নির্মাণ করা
হতো। প্রথম অবস্থায় সৈন্যদের রসদ বিভাগ নিয়মিত সেবাদান করতে পারত না। সে কারণে ’আহরা‘ নামক
পৃথক একটি বিভাগ প্রতিষ্ঠা করা হয়। সেখানে সৈনিকদের রেশন দ্রব্য গচিছত থাকত এবং মাসের প্রথম
তারিখে ক্যা¤েপ প্রেরিত হতো। রেশন হিসেবে প্রতি মাসে একজন সৈন্য ১ মন ১০ সের শস্য, ১২ সের খাবার
তৈল এবং ১২ সের সিরকা পেত। তা ছাড়া সৈনিকদের প্রত্যেককে সুঁই, তুলা, কাঁচি, খাবার ব্যাগ, চালুন ইত্যাদি
দেয়া হতো। প্রত্যেক সেনাদলে থাকতেন একজন খাজাঞ্চি, একজন হিসাব নির্বাহী, একজন কাযী, কয়েকজন
দোভাষি, কয়েকজন ডাক্তার ও অস্ত্রপাচারে অভিজ্ঞ চিকিৎসক। রসদ বিভাগের প্রথম অফিসার ছিলেন আমর
ইবন উতবা।
সৈন্যসংখ্যা ঃ খলীফা আবুবকর (রা) সিরিয়া অভিযানে ৭০০০ সৈন্য প্রেরণ করেন। পরবর্তিতে উক্ত সংখ্যা
বৃদ্ধি পেয়ে খলীফা উমরের সময় ২৭০০০ উন্নীত হয়। ইয়ারমুকের যুদ্ধে খালিদ আরও ৯০০০ সৈন্য নিয়ে
সেখানে পৌঁছলে ইয়ারমুকের যুদ্ধে মুসলমানদের সৈন্যসংখ্যা ৩৬,০০০ হাজারে দাঁড়ায়। অপর পক্ষে বিজাতীয়
সৈন্যের সংখ্যা ছিল ২,৪০,০০০। কাদেসীয়ার যুদ্ধে প্রকৃত পক্ষে কত আরব সৈন্য অংশ গ্রহণ করে তা নিয়ে
মতান্তর রয়েছে। সেতুর যুদ্ধে সেনাপতি আবু উবায়েদ ইবন মাসুদের নেতৃত্বে ৫০০০ মুসলিম সৈন্য ছিল।
ঐতিহাসিক তাবারীর বর্ণনা অনুসারে কাদেসীয়ার যুদ্ধে অংশ গ্রহণকারী মুসলিম সৈন্যের সংখ্যা ৭০০০,
বালাযুরীর মতে কাদেসীয়ার যুদ্ধে অংশ গ্রহণকারী সৈন্যবাহিনীতে খাটি আরব সৈন্য ৫০০০ এবং অন্যান্য
মুসলমান সৈন্য ছিল ১০০০। আমর ইবনুল আস ৪০০০ সৈন্য নিয়ে মিসর বিজয়ে অগ্রসর হন। পরে আরও
অনুরূপ সংখ্যা তাঁর সেনাদলে ভর্তি হয়। ইবনে সাদ এর এক বিবরণ হতে জানা যায় যে, প্রতি বছর ৩০,০০০
সৈন্য ভর্তি করা হতো। এই সংখ্যা প্রতি বছর বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয় এবং বিভিন্ন জাতির লোক সৈন্য বিভাগে চাকুরী লাভ
করে। সিফফীনের যুদ্ধে মুয়াবীয়ার (রা) সৈন্যসংখ্যা ছিল ৮৫,০০০ এবং হযরত আলীর (রা) সৈন্যসংখ্যা ছিল
৯০,০০০। প্রতিটি সেনানিবাসে ৪০০০ করে অশ্বারোহী সৈন্য মওজুদ থাকত। সে হিসেবে ৯টি জুনদে ৩৬,০০০
অশ্বারোহী সর্বদা প্রস্তুত থাকত।
নৌবাহিনী ঃ মরুবাসী আরবগণ সাগর দেখে ভয় পেত। সে কারণে প্রথম দিকে তারা নৌপথে তেমন রণকৌশণ
দেখাতে পারে নি। বিশেষ ভাবে লোহিতো সাগর ও ভারতের পথে পারস্য উপসাগরে দু’টি নৌ অভিযান
স¤পূর্ণরূপে ব্যর্থ হলে খলীফা উমর (রা) সকল প্রকার নৌ-অভিযান নিষেধ করে দেন। বর্ণিত আছে যে,
রোমানদের বিরুদ্ধে নৌ-অভিযান পরিচালনার জন্য সিরিয়ার আমীর মুয়াবীয়া (রা) খলীফা উমরের নিকট
নৌবাহিনী গঠনের আবেদন করে বিফল মনোরথ হন। খলীফা উসমানের শাসনকালে মুয়াবীয়া (রা) নৌবাহিনী
গঠনের অনুমতি লাভ করেন। কিন্তু কেবল স্বেচছাসেবক দ্বারা নৌবাহিনী গঠনের অনুমতিই প্রদান করা হয় এবং
কাউকে নৌবাহিনীতে যোগদান করতে বাধ্য করতে নিষেধ করা হয়। মুয়াবীয়া (রা) আবু কায়িসের নেতৃত্বে
সর্বপ্রথম নৌবাহিনী গঠন করেন। বর্ণিত আছে যে, মুয়াবীয়া (রা) নৌপথে ৫০টি গ্রীষ্ম ও শীতকালীন অভিযান
প্রেরণ করেন। এসব অভিযানের উদ্দেশ্য সাইপ্রাস বিজয় বলে ঐতিহাসিকগণ মনে করেন। ৩০ হিজরী সালে
মুসলিম নৌবহর এত শক্তিশালী হয় যে, উহা রোড়স দ্বীপ দখল করে। মুসলিম নৌবাহিনীর সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ
কৃতিত্ব হচ্ছে ৩৪ হিঃ সালে বাইযানটাইন নৌবাহিনীকে পরাজিত করা। সে অভিযানে এ্যাডমিরাল ইবনে আবী
সারাহ ২০০ আরব রণতরীর সাহায্যে প্রায় ৬০০ রণতরীর বিশাল বাইযানটাইন বাহিনীকে পরাজিত করে।
মুয়াবিয়ার শাসনকালেই আরব নৌবহর ভূমধ্যসাগরে গ্রীক প্রাধান্য ধ্বংস করে আরব প্রাধান্য প্রতিষ্ঠা করে। উক্ত
আরব নৌবাহিনীতে মাঝি, মাল্লাগণ ছিল গ্রীক বা মিরসীয় কপট। অভিযানগুলো প্রায়ই প্রেরিত হতো আফ্রিকার
বিভিন্ন উপকূলবর্তী এলাকা হতে। নৌ-সৈন্যগণ বেতন ও ভাতা পেত। নাবিকগণ যুদ্ধে অংশগ্রহ করত না।
অস্ত্রশস্ত্র ঃ তরবারী, বর্শা, তীরধনুক, ক্ষেপনাস্ত্র ও ফিঙ্গা প্রভৃতি যুদ্ধাস্ত্র হিসেবে ব্যবহৃত হতো। আত্মরক্ষার জন্য
ঢাল এবং জেরা ও শিরস্ত্রাণ ব্যবহৃত হতো। জেরার মূল্য ছিল খুব বেশী। সে কারণে জেরা বা ধর্মধানী সৈন্যের
সংখ্যা ছিল খুব কম। আরবদের তরবারী ছিল দ্বিধারী। তাদের তীরের আকার ছিল ছোট এবং তীক্ষè। সে কারণে
পারসিকগণ তাকে আলপিন বলত। প্রাকার বেষ্ঠিত দুর্গ আক্রমণের জন্য প্রস্তর নিক্ষেপক ক্ষেপণাস্ত্র এবং
দাব্বাবাহ ব্যবহৃত হতো।
পতাকা ঃ জাতীয় পতাকা উত্তোলনের রীতি সব দেশের সকল যুগে বর্তমান ছিল ও আছে। আরবগণ যুদ্ধক্ষেত্রে
পতাকা বহন করত। তা সাধারণত সেনাপতির সঙ্গে থাকত। তা বহন করার জন্য উপযুক্ত লোক নিযুক্ত করা
হতো সে প্রাণ দিয়েও পতাকার মান রক্ষা করত। যুদ্ধ আরম্ভ হবার ইঙ্গিত হিসেবে পতাকা ব্যবহার করা হতো।
সেনাপতি প্রথমবার পতাকা হেলন করে সৈন্যদেরকে প্রস্তুতির আদেশ দিতেন। সৈনিকগণ উক্ত নিদর্শন দেখামাত্র
জরুরী কার্যাদি ও প্রাকৃতিক আহŸানের সাড়া দিয়ে অজু করে প্রস্তুত হতো। সেনাপতি দ্বিতীয়বার পতাকা নাড়ালে
প্রত্যেকে যুদ্ধসাজ পরে ও যুদ্ধাস্ত্র নিয়ে প্রস্তুত থাকত এবং তৃতীয়বার পতাকা নাড়ালে শৃঙ্খলার সাথে সৈনিকগণ
শত্রুর উপর আক্রমণ চালাত। আত্মসমর্পণের জন্যও পাতাকা দেখানোর রীতি প্রচলিত ছিল। তবে আত্মসমর্পণের
জন্য অস্ত্রত্যাগ করতঃ হাত তুলে দাঁড়িয়ে থাকলে যুদ্ধ বন্ধ হতো। সিফফীনের যুদ্ধে মুয়াবিয়া (রা)-এর সৈন্যগণ
পবিত্র কুরআনের কপি উত্তোলন করে দেখালে আলীর (রা) সৈন্যগণ অস্ত্র সংবরণ করে।
গোয়েন্দা বিভাগ
প্রথম হতে আরবদের গোয়েন্দা ব্যবস্থা দক্ষতার সাথে দায়িত্ব পালন করতো। বিশেষভাবে যুদ্ধের সময় গোয়েন্দা
বিভাগকে সতর্কতার সাথে কাজ করতে হতো। সিরিয়া ও ইরাকে বসবাসকারী আরবগণ- যারা ইসলাম গ্রহণ
করে, তারা আকৃতি ও প্রকৃতিতে খ্রীষ্টানদের অনুরূপ ছিল। সে কারণে গোয়েন্দাগিরিতে তারা অভূতপূর্ব সাফল্য
প্রদর্শন করে। অনেক সময় শাসকদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে অমুসলমান প্রজাগণও মুসলমানদের পক্ষে
গোয়েন্দাগিরি করত।
অগ্রাভিযান ঃ কোন অভিযানে অগ্রসর হওয়ার সময় প্রথমে স্কাউট বাহিনী অগ্রসর হতো। তারা পথের ও শত্রæ
বাহিনীর খোঁজ খবর নিত ও মূল বাহিনীকে তা অবগত করত। মুলবাহিনী অগ্রভাগ, মধ্যভাগে ও ডান বাহু এবং
পশ্চাদভগ ও বামবাহু এ কয়টি অংশে বিভক্ত হয়ে যুদ্ধসাজে ও সামরিক কায়দায় গমন করতো। একটি অংশ
পশ্চাতে প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি নিয়ে মূল বাহিনীর অনুসরণ করতো। সবার পশ্চাতে আবার স্কাউট বাহিনী
তত্ত¡াবধায়কের ন্যায় গমন করত। গমনপথে প্রতি শুক্রবারে পুর্ণ ২৪ ঘন্টা বিশ্রামের ব্যবস্থা করা হতো।
শিবির ঃ শত্রæ এলাকায় শিবির পাহারার ব্যবস্থা করা হতো। শিবিরের চতুর্দিকে অগ্নি খন্দক, ব্যারিকেড ও
প্রহরার ব্যবস্থা করা হতো। সৈনিকগণ ঘুমানোর সময় স্ব স্ব অস্ত্র সাথে নিয়ে ঘুমাত এবং যে কোন মুহূর্তে শত্রæর
মুকাবিলা করার জন্য প্রস্তুত থাকত। প্রহরীগণও খুব সতর্ক থাকত এবং তাদের কেবল সে কাজের জন্য নিযুক্ত
করা হতো। শিবির প্রহরীকে বলা হতো আল-রায়েদ।
যুদ্ধেকৌশল ঃ যুদ্ধকৌশলের দিক দিয়েও মুসলিমগণ যথেষ্ট কৌশলের পরিচয় দিয়েছিল। মহানবীর আমল
হতেই যুদ্ধক্ষেত্রে সারিবদ্ধভাবে সৈন্য সমাবেশ ও সুনিয়ন্ত্রিতভাবে অগ্রসর হওয়ার রীতি প্রচলিত ছিল। কিন্তু
পরবর্তীকালে পারসিক ও রোমানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে মুসলিম বাহিনী আরও রণকৌশলী ও যুদ্ধদক্ষ হয়ে উঠে।
আরব মুসলিমদের সৈন্য সংখ্যা ও রণসম্ভার কম ছিল বলে বৃহৎ শত্রæর মুকাবিলা করার জন্য তাদেরকে অবস্থা
বুঝে ব্যবস্থা করতে হতো এবং রণকৌশল উদ্ভাবন করতে হতো। আল-ওয়া-লাজার যুদ্ধে খালিদ ইবনে-ওয়ালিদ
কিছু সৈন্যকে শত্রæ সৈন্যের উভয় পার্শ্বে লুকিয়ে রাখেন। যুদ্ধ যখন ঘোরতর হয়ে উঠে তখন ওঁৎ পেতে
অপেক্ষমান সৈনিকগণ হঠাৎ শত্রæর উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে এবং তাদেরকে পরাজিত করে। কাদেসীয়ার ভয়াবহ
যুদ্ধে মুসলমান সৈন্যদের তিন সারিতে সাজানো হয়। অথচ শত্রæপক্ষের সৈন্যগণ ১৩টি সারিতে দাঁড়িয়ে যুদ্ধ
করে। পারসিক সৈনিকদের তীরের আঘাতে মুসলিম বাহিনী ভয়ানক ক্ষতি স্বীকার করেও সে অবস্থায় অপেক্ষা
করতে থাকে। তারা তীর ও বর্শা নিয়ে প্রাণপণে আক্রমণ চালায় এবং আরও নিকটবর্তী হয়ে বর্শা রেখে তরবারী
নিয়ে আক্রমণ চালায় ও বিজয় লাভ করে।
পারসিক হস্তীবাহিনীর সাথে যুদ্ধে আরব মুসলিমগণ ভয়ানক বিপদে পড়ে। কারণ ইতিপূর্বে তারা হস্তী বাহিনী
সঙ্গে যুদ্ধ করে নি। বিরাটাকার হস্তীবাহিনী বহু নামকরা সেনার প্রাণনাশ করে। আরব যুদ্ধাশ্বগুলোও বিরাটাকার
জন্তু দেখে ভীত হয়ে পড়ে। সেনাপতি সা’দ সে অবস্থা দেখে দাখাম ও সালাম নামক দু’জন পারসিক
মুসলমানকে হস্তী যুদ্ধের বিরুদ্ধে কিভাবে যুদ্ধ করা যায় সে বিষয়ে পরামর্শ চাইলেন। তারা হস্তীযুদ্ধ সম্বন্ধে জ্ঞান
রাখতেন। তাঁরা পরামর্শ দিলেন যে কোন ক্রমে যদি দলপতি হস্তীদ্বয়ের শুড়ে ও চক্ষে আঘাত করা যায় তবে
হস্তীবাহিনী দলবলসহ যুদ্ধক্ষেত্র হতে পলায়ন করবে। সেনাপতি সা’দ তৎক্ষণাৎ সুকৌশলী কা’কাকে উক্ত সংবাদ
জ্ঞাপন করলেন।
হস্তী দলপতিদ্বয়ের নাম ছিল আবিয়াদ ও আযরাদ। কা’কা একদল সৈনিককে হস্তীবাহিনীর গমন পথ অবরোধের
জন্য প্রেরণ করে স্বয়ং বর্শা হস্তে আবিয়াদ নামক শ্বেত হস্তীর দিকে অগ্রসর হলেন। আসিম নামক অপর এক
বীর, তরবারী ও বর্শা হস্তে তাঁর সঙ্গী হলেন। উভয়ে হস্তীর নিকটবর্তী হয়ে একসঙ্গে দু’ খানা বর্শা হস্তীর দু’ চক্ষু
লক্ষ্য করে ছুঁড়লেন। বর্শাদ্বয় লক্ষ্যস্থলে বিদ্ধ হওয়া মাত্র হস্তী বিকট চীৎকার করে উঠল এবং কা’কাও সাথে সাথে
তার শুড় আক্রমণ করে তরবারীর এক আঘাতে তা কর্তন করে ফেললেন। অপরদিকে হাম্মাল ও রাবীল নামক
দু’ আরব বীরও আযরাদ নামক দ্বিতীয় সরদার হস্তীকে অনুরূপভাবে ঘায়েল করেন। বিকট চীৎকার করে প্রকাণ্ড
জন্তুদ্বয় পশ্চাৎ ফিরে ছুটতে আরম্ভ করে। তাদের পশ্চাৎ হস্তীবাহিনীও ছুটতে শুরু করে। ফলে তাদের পায়ের
তলায় পড়ে হাজার হাজার পারসিক সৈন্য পিষ্ট হয়ে প্রাণ হারায়। মুসলমান সৈনিকগণ সুযোগ বুঝে শত্রæ পক্ষের
উপর আক্রমণ চালায় ও জয়লাভ করে।
ইয়ারমুকের যুদ্ধক্ষেত্রে মুসলমানদের সৈন্যসংখ্যা ছিল ৪০,০০০ এবং রোমানদের সৈন্য সংখ্যা ছিল ২৪০,০০০।
চল্লিশ হাজার সৈন্যকে মাত্র কয়েকটি সারিতে সাফবন্দী করে রণক্ষেত্রে দন্ডায়মান করা অসম্ভব ছিল বলে খালেদ
ইবনে ওয়ালীদ সৈন্যদেরকে ৩৮টি স্কোয়াড্রনে বিভক্ত করে সাজান। কেন্দ্রে ছিল ১৮টি স্কোয়ারড্রন বা কারদুস
(বহুবচন, কারাদিস) এবং দক্ষিণ ও বাম বাহুর প্রত্যেকটিতে ছিল দশ দশটি করে স্কোয়াড্রন বা কারদুস।
প্রত্যেক স্কোয়াড্রন ছিল গোত্রভিত্তিক এবং স্ব স্ব নেতার অধীন। প্রথমে উভয় বাহু শত্রæর মুকাবিলায় অগ্রসর হয়।
তারা যুদ্ধে রত হলে খালিদের নির্দেশে কেন্দ্র অগ্রসর হয়ে রোমানদের পদাতিক ও অশ্বারোহী বাহিনীর মধ্যস্থলে
প্রবেশ করে। ফলে রোমানদের অশ্বারোহী ও পদাতিক বাহিনীর মধ্যে যোগাযোগ বিচ্ছন্ন হয়ে পড়ে। এটা
মুসলমানদের পক্ষে শুভ হয়।
উপসংহারে আমরা এ বিষয়ে একমত যে মহানবী গোত্রবিভক্ত আরবদেরকে সাধারণ লক্ষ্যে উপস্থিত হওয়ার
জন্য যে শৃংখলাজ্ঞান দান করেন সে আদর্শ ধরে আরবগণ তাঁর তিরোধানের পর আরও সুসংঘবদ্ধ জাতিতে
পরিণত হয় এবং খোলাফায়ে রাশেদীনের আমলেই তারা বিশ্ববিজয়ী শক্তিতে পরিণত হয়। দু’টি বৃহৎ শক্তির
সাথে প্রতিদ্ব›িদ্বতায় তারা সামরিক শক্তি বৃদ্ধি করে এবং সমসাময়িক বিশ্বে প্রথম শ্রেণীর সামরিক শক্তি হিসেবে
মর্যাদা লাভ করে। উন্নত মানের যুদ্ধ কৌশল, সুষ্ঠু অবরোধ পরিকল্পনা, নানা প্রকার যুদ্ধাস্ত্রের ব্যবহার, যুদ্ধক্ষেত্রে
সৈন্য সমাবেশ, ক্ষেপণাস্ত্র ও অন্যান্য অস্ত্রের ব্যবহার প্রভৃতি সবদিক দিয়ে তারা প্রতিশ্রæতিবান সামরিক বাহিনী হিসেবে গড়ে উঠে।
১. হযরত আবু বকর (রা) ধর্মাদ্রোহী ও বিদ্রোহীদের দমন করার জন্য কয়টি অভিযান প্রেরণ করেন?
ক. ৭টি; খ. ৫টি;
গ. ৩টি; ঘ. ১১টি।
২. সমগ্র সাম্রাজ্যকে নয়টি সামরিক জেলায় বিভক্ত করা হয় কোন খলীফার আমলে?
ক. হযরত উসমান (রা); খ. হযরত আলী (রা);
গ. হযরত আবু বকর (রা); ঘ. হযরত উমর (রা)।
৩. খোলাফায়ে রাশেদূনের আমলে বেতন দেয়ার সুবিধার্থে বিভক্ত ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র সৈন্য দলকে কি বলা হতো?
ক. স্কাউট; খ. ইরাফা;
গ. পদাতিক; ঘ. বিয়ার স্কাউট।
৪. খোলাফায়ে রাশেদূনের আমলে কার্যকারীতার দিক থেকে সৈন্য বাহিনীকে কয়ভাগে বিভক্ত করা হতো?
ক. ছয় ভাগে; খ. নয় ভাগে;
গ. তিন ভাগে; ঘ. পাঁচ ভাগে।
৫. হযরত উমর (রা) সমগ্র আবর সাম্রাজ্যকে কয়টি সামরিক জেলায় বিভক্ত করেন?
ক. ৮টি; খ. ৯টি;
গ. ১৫টি; ঘ. ১০টি।
সংক্ষিপ্ত উত্তর-প্রশ্ন
১. খোলাফায়ে রাশেদূনের আমলে সামরিক ঘাটি ও ইরাফা স¤পর্কে লিখুন।
২. খোলাফায়ে রাশেদূনের আমলে সৈন্যদলের বিভিন্ন বিভাগ স¤পর্কে লিখুন।
৩. খোলাফায়ে রাশেদূন আমলে সাধারণত কি ধরনের অস্ত্র ব্যবহার করা হতো?
৪. খোলাফায়ে রাশেদূনের আমলে সৈনিকদের বেতন ভাতা ও স্বাস্থ্য সেবা স¤পর্কে আলোচনা করুন।
৫. খোলাফায়ে রাশেদূনের আমলে গোয়েন্দা বিভাগ ও অগ্রাভিযান স¤পর্কে বর্ণনা করুন।
বিশদ উত্তর-প্রশ্ন
১. খোলাফায়ে রাশেদূনের সামরিক ব্যবস্থাপনা স¤পর্কে আলোচনা করুন।
২. খোলাফায়ে রাশেদূনের আমলে যুদ্ধ কৌশল স¤পর্কে বর্ণনা করুন।

FOR MORE CLICK HERE
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস মাদার্স পাবলিকেশন্স
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস ১ম পর্ব
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস
আমেরিকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস
বাংলাদেশের ইতিহাস মধ্যযুগ
ভারতে মুসলমানদের ইতিহাস
মুঘল রাজবংশের ইতিহাস
সমাজবিজ্ঞান পরিচিতি
ভূগোল ও পরিবেশ পরিচিতি
অনার্স রাষ্ট্রবিজ্ঞান প্রথম বর্ষ
পৌরনীতি ও সুশাসন
অর্থনীতি
অনার্স ইসলামিক স্টাডিজ প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত
অনার্স দর্শন পরিচিতি প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত

Copyright © Quality Can Do Soft.
Designed and developed by Sohel Rana, Assistant Professor, Kumudini Government College, Tangail. Email: [email protected]