উমাইয়া সরকারের প্রাদেশিক শাসনব্যবস্থা
উমাইয়া শাসনকালে মুসলিম সাম্রাজ্যের ব্যাপক বিস্তৃতি ঘটে। এতবড় বিশাল সাম্রাজ্য রাজধানী দামেস্ক হতে
সাফল্যজনকভাবে শাসন করা সহজসাধ্য ব্যাপার ছিল না। এ কারণে উমাইয়া খলীফাগণ সাম্রাজ্যকে প্রশাসনের
জন্য ১৪টি বড় বড় প্রদেশে (ইক্লীম) এবং প্রদেশগুলোকে সর্বমোট ৭৯টি জেলায় বিভক্ত করেন। প্রতিটি
প্রদেশকে উপযুক্ত পরিমাণ স্বায়ত্তশাসন সহ প্রদেশ শাসনের জন্য ওয়ালী বা আমীর এবং জেলা শাসনের জন্য
আমিল নিয়োগ করা হতো। খলীফা মুআবিয়া (রা) প্রাদেশিক শাসনকর্তাদেরকে নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য সাধারণ
প্রশাসন হতে রাজস্ব বিভাগকে পৃথক করেন এবং রাজস্ব আদায়ের নিমিত্ত প্রদেশে সাহিব আল্-খারাজ (রাজস্ব
অফিসার) উপাধিধারী অফিসার নিয়োগ করেন। উমাইয়া শাসনকালে প্রদেশের আদায়কৃত রাজস্ব হতে প্রাদেশিক
খরচ বাদে অবশিষ্ট অর্থ কেন্দ্রীয় ধনাগারে (বায়তুল মাল) জমা দেয়া হতো। কেন্দ্রে প্রদানের পরও প্রাদেশিক
ধনাগারে প্রচুর অর্থ জমা থাকত।
উমাইয়া আমলে দুই শ্রেণীর ওয়ালী ছিল বলে জানা যায়। বিশাল সাম্রাজ্য শাসনের সুবিধার জন্য উমাইয়া
সাম্রাজ্য ৫টি অঞ্চলে বিভক্ত ছিল। এ সকল অঞ্চলে স্বীয় প্রতিনিধি হিসেবে খলীফা পূর্ণ ক্ষমতা দিয়ে যে সকল
ওয়ালী নিয়োগ করতেন, তাঁরাই ছিলেন ভাইসরয়। এ অঞ্চলগুলো রাজধানীর নামসহ নি¤েœ উল্লেখ করা হল-
নাম রাজধানী
১। ইরাক কুফা
২। আল-হিজায মদীনা
৩। আল-জাযীরা মৌসুল
৪। মিসর ফুস্তাত্
৫। ইফরিকীয়া কায়রোয়ান
বিভক্ত প্রদেশ ও রাজধানী
ভাইসরয়গণ খলীফার ক্ষমতায় ক্ষমতাবান হয়ে প্রাদেশিক শাসনকর্তা নিয়োগ বা পদচ্যুতকরণ, উপহার প্রদান বা
শাস্তি প্রদান ইত্যাদি সকল কার্জ করতে পারতেন। নি¤েœ বিভক্ত প্রদেশগুলোর নাম ও রাজধানী উল্লেখ করা হল।
প্রদেশ রাজধানী
১। আরব মক্কা
২। আল-ইরাক কুফা
৩। আল-জাযীরা মৌসুল
৪। সিরিয়া দামেস্ক
৫। মিসর ফুস্তাত্
৬। আল-মাগরিব্ কায়রোয়ান
৭। পূর্ব প্রদেশ (পূর্ব প্রদেশ দুই ভাগে বিভক্ত ছিল।
(ক) মাওয়ারা আল-নাহর সমরকান্দ
(খ) খুরাসান মার্ভ
৮। আল-দাইলাম্ দাইলাম
৯। আল-রিহাব্ আযারবাইযান
পাঠ ঃ ২১০। আল-জিবাল্ হামাযান্
১১। খুজিস্তান (আহোয়ায্) জুনদেসাপুর
১২। ফারস্ শিরাজ
১৩। কারমান সীরজান
১৪। সিন্ধু প্রদেশ মানসূরা
প্রাদেশিক দীওয়ান
কেন্দ্রের ন্যায় প্রাদেশিক শাসনব্যবস্থা প্রধানত ৩টি দীওয়ান দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হতো। দীওয়ানগুলো ছিল যথাক্রমে১। দীওয়ান আল-জুন্দ বা সামরিক দপ্তর ঃ এটি প্রাদেশিক সামরিক বাহিনীর কার্যাবলী নিয়ন্ত্রণ ও পরিচালনা
করতো।
২। দীওয়ান আল-রাসায়িল বা যোগাযোগ ও সমন্বয় সাধন দপ্তর ঃ বস্তুত প্রদেশে এই দপ্তরই ছিল প্রধান দপ্তর।
সকল দপ্তরের সাথে যোগাযোগ ও সমন্বয় সাধনের জন্য এই দীওয়ানের দায়িত্ব ছিল অপরিসীম ও
গুরুত্বপূর্ণ। এই দপ্তরের ভাষা প্রথম হতেই আরবী ছিল।
৩। দীওয়ান আল-মুস্তাগিল্লাহ বা রাজস্ব বিভাগ ঃ প্রদেশের সকল রাজস্বের আয়-ব্যয়ের হিসেব এই বিভাগে
সংরক্ষিত হতো।
কেন্দ্রের সাথে যোগাযোগের সকল নথীপত্রই প্রাদেশিক গভর্ণরের দপ্তরে সংরক্ষিত থাকত। প্রদেশে প্রদেশে
দীওয়ান আল-বারীদের কাজ সুচারুরূপেই প্রচলিত ছিল। কিন্তু তা কেন্দ্রীয় দীওয়ান আল-বারীদ কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত
হতো।
উমাইয়া যুগে প্রাদেশিক আমীর বা ওয়ালীর কার্যাবলী ঃ উমাইয়া যুগে প্রাদেশিক প্রশাসককে আমীর বা ওয়ালী
বলা হতো। খলীফা সাধারণত প্রদেশের স্বায়ত্ত শাসন এবং প্রশাসন বিষয়ে সকল ক্ষমতা দিয়ে প্রদেশ শাসনের
জন্য আমীর বা ওয়ালী নিয়োগ করতেন। কেন্দ্রে খলীফা যেমন স্বয়ং সেনাবাহিনীর প্রধান সেনাপতি, রাজস্ব
বিভাগের প্রধান কর্মকর্তা, প্রধান মসজিদের ইমাম, বেসামরিক প্রশাসনের প্রধান এবং বিচার বিভাগের প্রধান
বিচারক, তেমনি প্রদেশে আমীর ছিলেন প্রদেশের প্রধান সেনাপতি, প্রধান বেসামরিক প্রশাসক, প্রধান রাজস্ব
অফিসার, প্রধান বিচারক ও প্রধান মসজিদের ইমাম। ওয়ালী প্রদেশের সকল উচ্চপদস্থ অফিসার নিয়োগ
করতেন। তিনি রাজস্ব অফিসার বা ভূমি রাজস্ব অফিসার বা সাহিব্ আল-খারাজ, দীওয়ান-সচিব, পুলিশ
অফিসার বা সাহিব আল-আহদাস, বিচারক বা কাযী, প্রাদেশিক অফিসার ও জেলা প্রশাসক নিয়োগ করতেন।
তাঁর কার্যাবলীর জন্য তিনি সরাসরি খলীফার কাছে দায়ী থাকতেন। কোন কোন ক্ষেত্রে খলীফা কোন গুরুত্বপূর্ণ
পদে প্রাদেশিক অফিসার নিয়োগ করতেন। আবার কোন কোন ক্ষেত্রে ওয়ালী খলীফার অনুমোদনক্রমে
প্রাদেশিক অফিসারদের নিয়োগ করতেন।
সাহিব আল-খারাজঃ ভূমি রাজস্ব অফিসার বা সাহিব্ আল-খারাজ একটি গুরুত্বপূর্ণ পদ। প্রথম দিকে সাহিবআল খারাজ নামক কোন অফিসারের পদ ছিল না। কারণ তখন খারাজী ভূমি খুব স্বল্প পরিমাণ ছিল। পরবর্তীতে
বৃদ্ধি প্রাপ্ত হলে দীওয়ান আল-খারাজ প্রতিষ্ঠা করা হয় এবং উক্ত বিভাগ সাহিবুল খারাজ উপাধিধারী অফিসারের
দায়িত্বে ন্যস্ত করা হয়। আমিল ও সাহিবুল খারাজ এর মধ্যে কর্তৃত্বে তারতম্য ছিল। আমিল ছিলেন
সাধারণভাবে আমিলুস সাদ্কা- যিনি সাদকা, যাকাত, স্বেচ্ছামূলক দান ও অর্থ সংগ্রহ করতেন।
কাতিব (সচিব) ঃ প্রদেশের আর একটি গুরুত্বপূর্ণ পদ ছিল সেক্রেটারীর (কাতিব)। দীওয়ানের তত্ত¡াবধায়ক
হিসেবে একজন ওয়ালীর উপর বহুবিধ দায়িত্ব ন্যস্ত থাকত। এসব দায়িত্বের কিছু কিছু তিনি কাতিব বা
সেক্রেটারীর উপর ন্যস্ত করতেন। সাম্রাজ্য বিস্তৃতির সঙ্গে সঙ্গে ওয়ালীর কার্যাবলী ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পায়। ফলে
সকল কাজ একজন ওয়ালীর পক্ষে করা সম্ভবপর ছিল না। সেই জন্য বিভিন্ন বিভাগের কাজে সহায়তার জন্য
ওয়ালী কয়েকজন কাতিব নিয়োগ করতেন। কাতিবগণ ওয়ালীকে প্রশাসনিক ব্যাপারে সর্বতোভাবে সাহায্য
করতেন। যেমন প্রাদেশিক অর্থনীতির ব্যাপারে কাতিব সকল প্রকার রাজস্ব আদায় ও ব্যয়ের হিসাব সংরক্ষণ
করে আমীর বা ওয়ালীকে সহযোগিতা করতেন।
সাহিব আল-আহদাস ঃ প্রদেশের উর্ধ্বতন অফিসার ছিলেন সাহিব আল-আহদাস্ বা পুলিশ প্রধান। প্রদেশ
কিংবা জেলার পুলিশ অফিসারকে সাহিব আল-আহদাস বলা হতো। তিনি ছিলেন আধাসামরিক অফিসার।
প্রয়োজনবোধে তাঁকে বিদ্রোহীর বিরুদ্ধে সংগ্রাম পরিচালনা করতে হতো। তবে তার প্রধান দায়িত্ব ছিল নাগরিক
শান্তি-শৃংখলা রক্ষা করা, অপরাধীকে শাস্তি প্রদান করা এবং অপরাধের কারণ অনুসন্ধান করা। গ্রামের আইন
শৃংখলা রক্ষার দায়িত্ব দেয়া থাকত গ্রাম প্রধানের উপর। অপরাধীকে ধরিয়ে দেয়া বা শায়েস্তা করার জন্য গ্রাম
প্রধানের উপর চাপ প্রয়োগ করা হতো।
উমাইয়া শাসনকালে পুলিশ এত তৎপর ছিল যে, কোথাও নাগরিক শান্তি বিঘিœত হতে পারত না। মুআবিয়ার
(রা) শাসনকালে ইরাকের শাসক যিয়াদ কুফায় ৪০,০০০ পুলিশ নিয়োগ করেন। তিনি বলতেন, কারো বাসায়
চুরি হলে তিনি দায়ী থাকবেন। খলীফা মুআবিয়া দামেস্কের সন্ত্রাসীদের তালিকা প্রস্তুত করেন ও তাদের
গতিবিধির উপর সতর্ক দৃষ্টি রাখেন। সন্দেহজনক ব্যক্তিদের গতিবিধি লক্ষ্য করার জন্য দায়িত্বশীল নিয়োগ
করেন।
কাযী বা বিচারক ঃ প্রদেশের কাযী ছিলেন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি। কাযীকে মামলার শুনানী করা ছাড়াও কতগুলো
অতিরিক্ত দায়িত্ব পালন করতে হতো।
তাঁকেই অসমর্থ, নাবালক বা উন্মাদ হওয়ার কারণে যারা নিজ স¤পত্তির কর্তৃত্ব লাভে অসমর্থ তাদের নিয়ন্ত্রণ ও
তত্ত¡াবধান করতে হতো ও তাদের স¤পত্তিতে তাদের অধিকার ও মালিকানা প্রতিষ্ঠা করতে হতো। তাকে
ওয়াক্ফ স¤পত্তির তত্ত¡াবধান করতে হতো। আইনানুগ ওসিয়ত কার্যকর করতে হতো ; অবিবাহিত মহিলাদের
সম্মতি নিয়ে যোগ্যপাত্রে পাত্রস্থ করার ব্যবস্থা করতে হতো ; আইনগতভাবে নির্ধারিত শাস্তি প্রদানের ব্যবস্থা
করতে হতো; প্রয়োজনবোধে তাকে সদকা ও যাকাত আদায় করতে হতো; জনসাধারণের মঙ্গলের নিরাপত্তা
বিধান করতে এবং জনসাধারণের ব্যবহার্য পথঘাট যেন কেউ দখল না করে বা গৃহাদি নির্মাণ না করে সেই
ব্যাপারে লক্ষ্য রাখতে হতো।
ইসলামের প্রারম্ভ হতেই বিচারকের স্বাধীনতা ছিল। সরকারের প্রশাসনিক কর্মকর্তাগণ বিচারকের কাজে হস্তক্ষেপ
করতেন না। প্রাদেশিক ওয়ালীগণ সাধারণত কাযী নিয়োগ করতেন। বিশেষ ক্ষেত্রে খলীফাগণ কাযী নিয়োগ
করতেন। যেভাবেই নিয়োগ হোক না কেন কাযী ন্যায়বিচার করতেন।
সঠিক উত্তরের পাশে টিক দিন
১. উমাইয়া শাসনামলে মুসলিম সাম্রাজ্যের রাজধানী ছিলক. বাগদাদে; খ. হিযাযে;
গ. মদীনায়; ঘ. দামেস্কে।
২. উমাইয়া সাম্রাজ্য কয়টি অঞ্চলে বিভক্ত ছিল?
ক. ৭টি; খ. ৪টি;
গ. ৫টি; ঘ. ৬টি।
৩. ভাইসরয় কার উপাধি ছিল?
ক. ওয়ালীর; খ. খলীফার;
গ. খলীফা কর্তৃক পূর্ণ ক্ষমতা প্রাপ্ত ওয়ালীর;
ঘ. জেলার কর্মকর্তার।
৪. দীওয়ান আল-মুসতাগিল্লাহ এর অর্থ হচেছ১. সমন্বয় সাধন দপ্তর খ. রাজস্ব দপ্তর;
গ. ভ‚মি দপ্তর; ৪. যোগাযোগ দপ্তর।
৫. সাহিব আল-আহদাস কার উপাধি ছিল?
ক. সামরিক প্রধানের; খ. পুলিশ প্রধানের;
গ. ডাক বিভাগীয় প্রধানের; ঘ. সব ক’টি উত্তরই সঠিক।
সংক্ষিপ্ত উত্তর-প্রশ্ন
১. উমাইয়া শাসকদের প্রাদেশিক সরকার পদ্ধতি স¤পর্কে সংক্ষেপে আলোচনা করুন।
২. টিকা লিখুনক. সাহিব আল-খারাজ, খ. কাতিব, গ. সাহিব আল- আহদাস, ঘ. কাযী।
রচনামূলক উত্তর-প্রশ্ন
১. উমাইয়া শাসকদের প্রাদেশিক শাসনব্যবস্থার একটি বিশদ বিবরণ দিন।
FOR MORE CLICK HERE
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস মাদার্স পাবলিকেশন্স
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস ১ম পর্ব
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস
আমেরিকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস
বাংলাদেশের ইতিহাস মধ্যযুগ
ভারতে মুসলমানদের ইতিহাস
মুঘল রাজবংশের ইতিহাস
সমাজবিজ্ঞান পরিচিতি
ভূগোল ও পরিবেশ পরিচিতি
অনার্স রাষ্ট্রবিজ্ঞান প্রথম বর্ষ
পৌরনীতি ও সুশাসন
অর্থনীতি
অনার্স ইসলামিক স্টাডিজ প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত
অনার্স দর্শন পরিচিতি প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত