আব্বাসীয়দের প্রাদেশিক শাসনব্যবস্থা আব্বাসীয়দের প্রাদেশিক আমীরের বিভিন্ন দিক বিস্তারিত বর্ণনা দিন।

বিভিন্ন প্রদেশঃ শাসন কাজের সুবিধার্থে উমাইয়া যুগের মত আব্বাসীয় যুগেও সাম্রাজ্যকে বিভিন্ন প্রশাসনিক
ইউনিট অর্থাৎ প্রদেশে ভাগ করা হয়। সাম্রাজ্য ভাগ করণের ব্যাপারে উমাইয়া এবং আব্বাসীয়রা প্রকৃতপক্ষে
প‚র্ববর্তী বাইজেন্টিয় এবং সাসানীয় প্রদেশগুলোর ভৌগলিক সীমারেখাকে অনেকাংশেই আদর্শ হিসেবে গ্রহণ
করেন। উমাইয়া যুগে সাম্রাজ্য ১৪টি প্রদেশে বিভক্ত ছিল। কিন্তু আব্বাসীয় যুগে সাম্রাজ্যের আয়তন বৃদ্ধি না
হলেও প্রদেশের সংখ্যা অনেক বৃদ্ধি পায়। আব্বাসীয় যুগে উমাইয়াদের প্রায় প্রতিটি বৃহদাকার এবং স¤পদশালী
প্রদেশকে শাসনের সুবিধার্থে একাধিক প্রদেশে ভাগ করা হয়। ইবনে খালদুনের মতে হারুন-অর-রশীদ এবং
মামুনের খিলাফত কালে আব্বাসীয় সাম্রাজ্য ৩৬টি প্রদেশে বিভক্ত ছিল। প্রফেসর হিট্টি অবশ্য ঐ সময়ে
সাম্রাজ্যের ২৪টি প্রধান প্রদেশের কথা উল্লেখ করেন। ইবনে খালদুন বর্ণিত ৩৬টি প্রদেশ নিæরূপ ঃÑ (১) আসসাওয়াদ (২) কাসকার (৩) দিজ্লা (৪) হালওয়ান (৫) আল-আহওয়ায্ (৬) ফারস্ (৭) কিরমান (৮) মুকরান
(৯) সিন্দ্ (১০) সিজিস্তান (১১) খোরাসান (১২) গুরগান (১৩) কুর্মিস (১৪) তাবারিস্থান (১৫) আর-রাই (১৬)
ইস্পাহান (১৭) হামাদান (১৮) বসরা ও কুফা (১৯) সাহারজুর (২০) মোসুল (২১) আল-জাযিরাহ (২২)
আযারবাইহান (২৩) মুকান ও কার্ক (২৪) জিলান (২৫) আর্মেনীয়া (২৬) কিনাসিরিন ও আওয়াসীম (২৭)
হিম্স (২৮) দামেস্ক (২৯) জর্দান (৩০) ফিলিস্তিন (৩১) মিসর (৩২) বারকা (৩৩) ইফ্রিকিয়া (৩৪) ইয়ামেন
(৩৫) মক্কা ও মদিনা (৩৬) মাসাবাদন।
আয়তনের দিক দিয়ে আব্বাসীয় প্রদেশসমূহের মধ্যে সামঞ্জস্য খুবই কম। কোন কোন প্রদেশ খুবই বড় এবং
কোনটি আবার খুবই ছোট। ছোট প্রদেশগুলো প্রধানত রাজস্ব ইউনিট হিসেবে গণ্য ছিল এবং এগুলোতে পূর্ণাঙ্গ
শাসনব্যবস্থা ছিল না। কিন্তু বৃহদাকার ও গুরুত্বপূর্ণ প্রদেশসমূহে পূর্ণাঙ্গ শাসনব্যবস্থা বলবৎ ছিল। কোন কোন
সময় প্রাদেশিক শাসনকর্তার যোগ্যতা অনুসারে প্রদেশের সীমারেখা নির্ধারণ করা হতো কম দক্ষ ও কম ক্ষমতা
প্রাপ্ত প্রাদেশিক শাসনকর্তার অধীনে একটি বৃহৎ প্রদেশকে একাধিক ছোট প্রদেশে ভাগ করা হতো আবার খলীফা
কর্তৃক বিশেষ ক্ষমতাপ্রাপ্ত প্রাদেশিক শাসনকর্তার অধীনে একাধিক প্রদেশের শাসনভারও ন্যস্ত করা হতো।
উমাইয়া যুগের মত আব্বাসীয় যুগেও সাম্রাজ্যকে আল-মাগরেব (পশ্চিমাঞ্চল) এবং আল-মাশরেক (পূর্বাঞ্চল)-এ
ভাগ করার রীতি প্রচলিত ছিল। খলীফা হারুন-অর-রশীদ জাফর বার্মাকীকে আল-মাগরেব অর্থাৎ আল-আনবর
হতে সাম্রাজ্যের সমুদয় পশ্চিমাঞ্চলীয় প্রদেশের এবং জাফরের ভ্রাতা ফযল বার্মাকীকে আল-মাশরেক অর্থাৎ
সাম্রাজ্যের সমূদয় পূর্বাঞ্চলীয় প্রদেশের রাজ প্রতিনিধি নিয়োগ করেন। বার্মাকী বংশের পতনের পর হারুন-অররশীদ ফযল ইবনে সাহলকে একই সময়ে খুরাসান, কুরগান, তাবারিস্তান ও আর রাই, এ চারটি প্রদেশের
শাসনকর্তার দায়িত্ব প্রদান করেন। পিতার দৃষ্টান্ত অনুসরণ করে খলীফা মামুন ফযল ইবনে-সহলকে সাম্রাজ্যের
সমুদয় পূর্বাঞ্চলীয় প্রদেশগুলোর রাজ প্রতিনিধি নিয়োগ করেন এবং তাকে যুররিয়াস্াতায়িন উপাধিতে ভূষিত
করেন। এ উপাধির অর্থ-তিনি সামরিক ও রাজনৈতিক এ উভয় ক্ষেত্রেরই প্রধান।
আমীর নিয়োগঃ উযীরের পরামর্শক্রমে খলীফা আমীর নিয়োগ করতেন। খলীফার বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়স্বজন,
খলীফার প্রতি বিশেষভাবে অনুগত ব্যক্তি কিংবা খিলাফতের প্রতি গুরুত্বপূর্ণ অবদানের জন্য বিখ্যাত কোন
ব্যক্তিকেই আমীর নিয়োগ করা হতো। বস্তুত রাজনৈতিক কারণ এবং খলীফার সাথে আত্মীয়তার বন্ধন আমীর
পদে নিয়োগের স্বাভাবিক দাবিদার হিসেবে বিবেচিত হতো। রাজনৈতিক কারণে অর্থাৎ উমাইয়াদের বিরুদ্ধে
আব্বাসীয় আন্দোলনে নেতৃত্বদানের স্বীকৃতি স্বরূপ খলীফা আস-স্ফাফাহ্ আবু মুসলিম খোরাসানীকে
খোরাসানের এবং আবু আইয়নকে মিসরের আমীর নিয়োগ করেন। খলীফা মামুন তাঁর ভ্রাতা আমীনের বিরুদ্ধে
খোরাসানের অধিবাসীদের সক্রিয় সমর্থনের জন্য সে প্রদেশের আমীর কিংবা অন্য কোন সরকারী পদে
খোরাসানীদের দাবির অগ্রাধিকার দিতেন। হারুন-অর-রশীদ পুত্র মামুনকে খোরাসানের এবং খলীফা মুতামিদ
পাঠ ঃ ৫৮৭৫ খ্রীষ্টাব্দে তার দু’পুত্র জাফর এবং আবু আহমেদকে যথাক্রমে সাম্রাজ্যের পশ্চিম ও পূর্ব অঞ্চলের আমীর
নিয়োগ করেন। যখন কোন যুবরাজকে আমীর নিয়োগ করা হত তখন তার উপদেষ্টা ও সাহায্যকারী হিসেবে
একজন উচ্চ পদাধিকারী সামরিক অধিনায়ককে তার সাথে সংযুক্ত করা হতো।
প্রাদেশিক আমীরের দায়িত্বঃ আব্বাসীয় যুগেও প্রাদেশিক শাসনব্যবস্থা ছিল কেন্দ্রীয় শাসনব্যবস্থার প্রতিচ্ছবি
স্বরূপ। প্রাদেশিক শাসন কেন্দ্রীয় শাসনব্যবস্থার ঘনিষ্ট অনুকরণে গঠন করা হয়। কেন্দ্রীয় শাসনব্যবস্থায় যে সব
প্রশাসনিক কাঠামো প্রতিষ্ঠিত ছিল প্রাদেশিক শাসনব্যবস্থায়ও যথাসম্ভব সেগুলো প্রতিষ্ঠা করা হয়। তবে ব্যয়
সঙ্কোচনের জন্য কেন্দ্রীয় সরকারের একাধিক প্রশাসনিক দফতরের কার্যভার প্রাদেশিক সরকারের একটি মাত্র
প্রশাসনিক দফতরের উপরও ন্যস্ত করা হতো সর্বোপরি, প্রাদেশিক শাসনব্যবস্থায় প্রাদেশিক সরকার প্রধান
আমীরের ক্ষমতা, দায়িত্ব ও কার্যাবলী অনেকাংশেই ছিল কেন্দ্রীয় সরকার প্রধান খলীফার ক্ষমতা, দায়িত্ব ও
কার্যাবলীর অনুরূপ। আমীর ছিলেন প্রকৃত পক্ষে প্রদেশে খলীফার প্রতিনিধি। তিনি কেন্দ্র ও প্রদেশের মধ্যে
যোগসূত্রস্থাপনকারী।
আমীর প্রাদেশিক শাসনব্যবস্থায় সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ কর্মকর্তা। তিনি প্রাদেশিক শাসনের কেন্দ্র বিন্দু। তিনি
একই সঙ্গে প্রদেশের সামরিক ও বেসামিরিক শাসনের প্রধান। প্রদেশে ধর্মীয় ব্যবস্থাপনারও দায়িত্বশীল ছিলেন
তিনি। প্রদেশে শান্তি-শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা, প্রদেশের অন্য কর্মচারীদের কার্যাবলী তত্ত¡াবধান, বিধর্মী ও বিদেশী
আক্রমণের বিরুদ্ধে প্রদেশের ভৌগোলিক অখন্ডতা রক্ষা করা এবং নাগরিকদের জীবন, স¤পত্তি ও ধর্মীয়
নিরাপত্তা বিধান আমীরের অন্যতম প্রধান দায়িত্ব হিসেবে গণ্য ছিল।
আমীরের ক্ষমতা ও পদচ্যুতিঃ আমীরকে সামরিক এবং শাসন ব্যাপারে যথেষ্ট পারদর্শিতার অধিকারী হতে
হতো আমীর খলীফা, কিংবা উযীরের নির্দেশ অনুসারে প্রাদেশিক শাসনকার্য পরিচালনা করতেন। দুর্নীতি,
ক্ষমতার অপব্যবহার, কর্তব্যে অবহেলা এবং অসৎ উপায়ে ধন স¤পদ অর্জনের মত গুরুতর অপরাধের
অভিযোগে আমীর খলীফা, অথবা উযীর কর্তৃক পদচ্যুত হতেন। পদচ্যূত আমীরের স¤পত্তিও প্রায়ই বাজেয়াপ্ত
করা হতো রাষ্ট্রীয় শাসনে অত্যন্ত তৎপর এবং মনোযোগী খলীফা উযীরের সুপারিশ ব্যতীত নিজেই আমীর
নিয়োগ করতেন এবং আমীরের পদচ্যুতিও স¤পূর্ণরূপে তার খেয়াল খুশীর উপর নির্ভর করত। আব্বাসীয়
শাসনের প্রারম্ভিক যুগে বিশেষ করে খলীফা মনসুরের আমলে আমীর নিয়োগ, বদলী ও পদচ্যুতি স¤পূর্ণরূপে
খলীফার ইচ্ছাধীন ছিল। মনসুর অসদুপায়ে ধনস¤পদ অর্জনের অভিযোগে পদচ্যুত আমীরের স¤পত্তি বাজেয়াপ্ত
করণের ব্যাপারে অত্যন্ত তৎপর ছিলেন। এভাবে বাজেয়াপ্তকৃত ধনস¤পদ জমা রাখার জন্য তিনি বায়তুল মাল
আল-মাযালিম (অন্যায়ভাবে অর্জিত স¤পদের কোষাগার) নামে বিশেষ রাষ্ট্রীয় কোষাগার স্থাপন করেন।
প্রাদেশিক আমীরদের প্রকারভেদ ও তাঁদের ক্ষমতা
আল-মাওয়ার্দী আব্বাসীয় শাসন আমলে প্রাদেশিক আমীরদের ক্ষমতা, দায়িত্ব এবং কার্যাবলীর পর্যালোচনা করে
তাদেরকে তিন শ্রেণীতে ভাগ করেন। যথাÑ অসীম ক্ষমতার অধিকারী প্রাদেশিক আমীর, সীমাবদ্ধ ক্ষমতার
অধিকারী প্রাদেশিক আমীর এবং জোর পূর্বক ক্ষমতা দখলকারী প্রাদেশিক স্বাধীন আমীর।
খলীফার কোন বিশেষ প্রিয়ভাজন ব্যক্তিকে কোন কোন সময় অত্যধিক ক্ষমতা দিয়ে প্রাদেশিক আমীর নিয়োগ
করা হতো তবে সাধারণত দুর্বল ও অযোগ্য খলীফা কিংবা শাসন ব্যাপারে অমনোযোগী খলীফার আমলে
প্রাদেশিক আমীরগণ অসীম ক্ষমতা ভোগ করতেন। অসীম ক্ষমতার অধিকারী প্রাদেশিক আমীর প্রদেশ শাসনের
প্রতিটি ক্ষেত্রে তার কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতেন। তিনি ছিলেন একাধারে প্রদেশের সামরিক, বেসামরিক, রাজস্ব,
বিচার ও ধর্মীয় শাসনের প্রধান। তিনি প্রাদেশিক সামরিক বাহিনী পরিচালনায় সর্বময় দায়িত্ব পালন করতেন।
তিনি প্রাদেশিক বিচারক নিয়োগ ও বিচারকদের কার্যাবলী তত্ত¡াবধান করতেন। প্রাদেশিক সরকারের রাজস্ব ধার্য,
রাজস্ব আদায় ও রাজস্ব ব্যয়ের দায়িত্বও তার উপর ন্যস্ত ছিল। প্রদেশে শান্তি শৃংখলা প্রতিষ্ঠার জন্য তিনি পুলিশ
বাহিনী নিয়োগ এবং পুলিশের কার্যাবলী তত্ত¡াবধান করতেন। কোন নতুন মতবাদের বিরুদ্ধে ইসলাম ধর্মের
পবিত্রতা রক্ষা, বিধর্মীদের বিরুদ্ধে ধর্মযুদ্ধ ঘোষণা, শুক্রবারের জুমুআর নামায এবং বাৎসরিক ঈদের নামায
পরিচালনা এবং প্রতি বছর পবিত্র শহর মক্কা ও মদীনাতে হজ্জ কাফেলা প্রেরণের ব্যবস্থা গ্রহণ আমীরের ধর্মীয়
কর্তব্যের মধ্যে অন্যতম ছিল। কোন কোন সময় আমীর নিজে আবার কোন কোন সময় তাঁর মনোনীত কোন
ব্যক্তি হজ্জ কাফেলার নেতৃত্ব দিতেন। বেদুঈন আক্রমণ হতে হজ্জ কাফেলার নিরাপত্তার জন্য হজ্জ কাফেলার
অধিনায়ক (আমীর আল-হজ্জ) প্রয়োজনীয় সৈন্যবাহিনী সঙ্গে নিতেন। অসীম ক্ষমতার অধিকারী আমীরের
কার্যাবলীতে কেন্দ্রীয় সরকার খুব কমই হস্তক্ষেপ করতেন। তাঁকে ঘন ঘন বদলী করা হতো না। অনেক সময়
তিনি মৃত্যু পর্যন্ত তাঁর পদে বহাল থাকতেন।
অত্যন্ত দক্ষ এবং শাসনকার্যে খুবই মনোযোগী খলীফার আমলে প্রাদেশিক আমীরগণ সীমিত ক্ষমতা ভোগ
করতেন। সীমিত ক্ষমতার অধিকারী প্রাদেশিক আমীরের কার্যাবলীতে কেন্দ্রীয় সরকার অহরহ হস্তক্ষেপ
করতেন। তাদেরকে ঘন ঘন এক প্রদেশ হতে অন্য প্রদেশে বদলী করা হতো এবং সামান্য অপরাধের অজুহাতে
তাদেরকে ক্ষমতাচ্যুত ও তাদের স¤পত্তি বাজেয়াপ্ত করা হতো। সীমাবদ্ধ ক্ষমতার প্রাদেশিক আমীর প্রাদেশিক
রাজস্ব ও বিচার ব্যবস্থায় কোন কর্তৃত্ব করতে পারতেন না।
আব্বাসীয় শাসনকালে সাম্রাজ্যের দূরবর্তী প্রদেশের প্রাদেশিক আমীরগণ সুযোগ পেলেই খলীফার ক্ষমতা
উপেক্ষা করে স্বাধীনতা ঘোষণা করতো। সে যুগে যাতায়াত ব্যবস্থার অসুবিধার দরুণ এবং অন্যান্য কারণে
খলীফার পক্ষে অনেক সময় এ সব জোরপূর্বক ক্ষমতা দখলকারী প্রাদেশিক আমীরগণকে দমন করা সম্ভব হত
না। ফলে তাঁরা প্রদেশে স্থায়ীভাবে স্বাধীন বংশানুক্রমিক শাসন প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হতেন। খলীফা মামুনের
শাসনকালে আব্বাসীয় সামরিক শক্তি যখন অক্ষুণœ ছিল তখনও ইয়ামেনের আমীর মুহাম্মদ ইবনে ইব্রাহিম
ইয়ামেনের এবং খোরাসানের আমীর তাহির ইবনে-হুসেন খোরাসানে স্বাধীন রাজবংশ প্রতিষ্ঠা করেন। নবম
শতাব্দীর মধ্যভাগ হতে আব্বাসীয় খিলাফতের ক্রমবর্ধমান দুর্বলতার সুযোগে সাম্রাজ্যের দূরবর্তী অঞ্চলের
প্রাদেশিক আমীরদের স্বাধীনতা ¯পৃহা খুবই প্রবল হয়ে উঠে। ফলে বহু স্বাধীন আমীরাতের উৎপত্তি হয়। এ সব
জোর পূর্বক ক্ষমতা দখলকারী স্বাধীন আমীরগণ যদিও প্রকৃত পক্ষে ছিলেন স্বাধীন নরপতি তবু নিজেদের স্বার্থে
তারা খিলাফতের সাথে নাম মাত্র স¤পর্ক বজায় রাখতেন। তারা খলীফাকে মুসলিম জগতের রাজনৈতিক ও
ধর্মীয় প্রধান হিসেবে সম্মান দেখাতেন। শুক্রবারের নামাযের খুতবায় তাদের নিজের নামের সাথে খলীফার নাম
পাঠ করতেন এবং খলীফাকে নামমাত্র বাৎসরিক কর প্রেরণ করতেন। আর দুর্বল খলীফাগণ তাদের শক্তিশালী
স্বাধীন আমীরদের এ আনুগত্য প্রদর্শনে মুগ্ধ হয়ে তাদেরকে তাদের ক্ষমতার স্বীকৃতি প্রদান করতেন এবং বিভিন্ন
উপাধিতে ভূষিত করতেন।
জোর পূর্বক ক্ষমতা দখলকারী স্বাধীন আমীরকে প্রাদেশিক আমীর না বলে খিলাফতের আওতাধীন স্বাধীন
মুসলিম নরপতি বলাই যুক্তিযুক্ত। অসীম ক্ষমতার প্রাদেশিক আমীর এবং সীমিত ক্ষমতার প্রাদেশিক আমীরের
মধ্যে ক্ষমতার ব্যাপারে যতই পার্থক্য থাকুক না কেন তারা ছিলেন প্রত্যেকে প্রাদেশিক শাসনব্যবস্থার প্রধান
তত্ত¡াবধায়ক। প্রাদেশিক সরকারের প্রশাসনিক বিভাগ কোন আমীরের পক্ষে একা পরিচালনা করা সম্ভব ছিল না।
প্রত্যেক প্রদেশে প্রাদেশিক সরকারের প্রশাসনিক দায়িত্ব কতিপয় প্রশাসনিক বিভাগের উপর ন্যস্ত ছিল।
আব্বাসীয় শাসনকালে প্রত্যেক পূর্ণাঙ্গ প্রদেশে নিæলিখিত নয়টি প্রশাসনিক দফতর কার্যকর ছিল। বলাবাহুল্য
প্রাদেশিক সরকারের প্রশাসনিক বিভাগগুলো কেন্দ্রীয় সরকারের প্রশাসনিক বিভাগের শাখা স্বরূপ ছিল।
প্রাদেশিক দপ্তরগুলো নিæরূপ-
দীওয়ান আল-খারাজ (রাজস্ব বিভাগ) ঃ প্রাদেশিক সরকারের রাজস্ব ধার্য, রাজস্ব আদায়, রাজস্বের
আয়ব্যয়ের হিসাব রক্ষণ এবং প্রাদেশিক সরকারের যাবতীয় ব্যয় নির্বাহ প্রাদেশিক রাজস্ব বিভাগের প্রধান
দায়িত্ব। এ বিভাগ হতেই প্রাদেশিক সৈন্য বাহিনী ও প্রাদেশিক সরকারে নিয়োগ সকল কর্মচারীদের বেতন ভাতা
ও অন্যান্য আর্থিক সুযোগ সুবিধা বন্টন করা হতো সরকারের সমুদয় উন্নয়ন ও জনকল্যাণমূলক কাজেও এই
বিভাগ হতে অর্থ ব্যয় করা হতো সরকারের সমুদয় ব্যয় নির্বাহের পর প্রাদেশিক উদ্ধৃত্ত¡ রাজস্ব কেন্দ্রীয় রাজস্ব
বিভাগের নিকট প্রেরণ করা হতো প্রাদেশিক রাজস্ব যদি প্রাদেশিক সরকারের ব্যয় নির্বাহের জন্য যথেষ্ট না হত
তা হলে কেন্দ্রীয় রাজস্ব বিভাগের নিকট হতে অর্থ প্রেরণ করা হতো প্রাদেশিক সরকার কেন্দ্রীয় সরকারের নিকট
হতে অনুদান হিসেবে তা গ্রহণ করত।
রাজস্ব বিভাগের প্রধান (আমিল) ঃ প্রাদেশিক রাজস্ব বিভাগের প্রধান (আমিল) প্রাদেশিক আমীরের পর
প্রাদেশিক শাসনব্যবস্থায় দ্বিতীয় গুরুত্বপ‚র্ণ কর্মকর্তা। আমিল কেন্দ্রীয় সরকার কর্তৃক নিয়োগ হতেন এবং তিনি
তাঁর কার্যাবলীর জন্য কেন্দ্রীয় রাজস্ব বিভাগের নিকট প্রধানত দায়ী থাকতেন। সীমিত ক্ষমতার অধিকারী আমীর
প্রাদেশিক আমিলের কার্যাবলীতে কোনরূপ হস্তক্ষেপ করতে পারতেন না। তবে অসীম ক্ষমতার অধিকারী আমীর
আমিলসহ প্রদেশের সকল কর্মকর্তার কার্যাবলীতে হস্তক্ষেপ করতেন। কোন কোন সময় আমিল প্রদেশের
নিয়মিত বেতন ভোগী কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগ হতেন না। তিনি প্রদেশের রাজস্ব হিসাবে নির্দিষ্ট অঙ্কের টাকা
আদায় করে দিবার প্রতিশ্রæতিবদ্ধ হয়ে অথবা কোষাগারে জমা দিয়ে প্রাদেশিক আমিল নিয়োগ হতেন। এভাবে
চুক্তির মাধ্যমে আমিল নিয়োগ হলে প্রাদেশিক রাজস্ব ব্যবস্থায় দুর্নীতি ও অরাজকতা দেখা দিত। আমিল নির্দিষ্ট
রাজস্ব অপেক্ষা অনেক বেশী রাজস্ব বলপ্রয়োগে জনসাধারণের নিকট হতে আদায় করে আত্মসাৎ করতেন।
কোন কোন সময় কোন বিশেষ প্রদেশে আমিল নামে কোন রাজস্ব কর্মকর্তা নিয়োগ হতেন না। প্রাদেশিক আমীর
একই সঙ্গে প্রাদেশিক রাজস্ব ও যাবতীয় শাসন কার্য পরিচালনা করতেন। অনেক সময় কেন্দ্রীয় সরকারের
দুর্বলতার সুযোগে আমীর ও আমিল নিজেদের মধ্যে যোগসাজসে প্রদেশে নিজেদের ইচ্ছামত শাসন পরিচালনা
করতেন এবং কেন্দ্রীয় সরকারের নিকট প্রাদেশিক রাজস্ব প্রেরণ বন্ধ করে দিতেন। ৯৩১ খ্রীষ্টাব্দে কিরমান ও
ফারসের আমীর ও আমিল একতাবদ্ধ হয়ে কেন্দ্রীয় সরকারের নিকট প্রাদেশিক রাজস্ব প্রেরণ বন্ধ করে দেয়।
দীওয়ান আল-বারীদ (ডাক বিভাগ) ঃ প্রত্যেক প্রাদেশিক রাজধানীতে প্রাদেশিক ডাক বিভাগ এবং
প্রদেশের প্রত্যেক শহরে এর শাখা অফিস ছিল। প্রাদেশিক ডাক বিভাগের প্রধান কেন্দ্রীয় ডাক বিভাগের
প্রধানের মত সাহিব আল-বারীদ নামে অভিহিত ছিলেন। প্রাদেশিক ডাক প্রধান ছিলেন প্রদেশে কেন্দ্রীয়
সরকারের বিশ্বস্ত প্রতিনিধি ও অনুচর। তিনি প্রদেশের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা সম্বন্ধে কেন্দ্রীয় সরকারকে অবহিত
করতেন এবং প্রাদেশিক আমীরসহ প্রদেশের সকল কর্মচারীর আচরণ সম্বন্ধে কেন্দ্রীয় ডাক বিভাগের নিকট
অথবা সরাসরি খলীফার নিকট গোপন রিপোর্ট প্রেরণ করতেন। ৮২২ খ্রীষ্টাব্দে খলীফা মামুনের শাসনকালে
খোরাসানের আমীর তাহের ইবন-হুসেন যখন শুক্রবারের নামাযের খুতবায় খলীফার নাম বাদ দিয়ে নিজ নাম
প্রবর্তনের মাধ্যমে স্বাধীনতা ঘোষণা করেন তখন খোরাসানের সাহিব আল-বারীদ এ ব্যাপারে কেন্দ্রীয় ডাক
বিভাগের নিকট মাঝে মাঝে প্রদেশের সার্বিক অবস্থা সম্বন্ধে রিপোর্ট প্রদান করতেন। আরও যে সব বিষয়
কেন্দ্রকে অবহিত করা হত তা হল প্রদেশের প্রশাসনিক ব্যবস্থার অগ্রগতি, কেন্দ্রীয় সরকারের প্রতি প্রাদেশিক
সরকারী কর্মচারীদের জীবনযাত্রার মনোভাব, প্রদেশে কৃষি ও কৃষকের অবস্থা, বিচার বিভাগীয় কর্মচারীদের
জীবনযাত্রার মান, রাজস্ব আদায়কারীদের আদায়কৃত অর্থ, মূদ্রণ প্রভৃতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বিশেষভাবে স্থান পেত।
সাহিব আল-বারীদের গুরুত্বপূর্ণ রিপোর্টের অংশ বিশেষ কেন্দ্রীয় ডাক বিভাগে সংরক্ষিত রাখা হতো।
ডাক চলাচলের জন্য সাম্রাজ্যের সকল রাস্তার পার্শ্বে মাইল-চিহ্ন এবং ডাকঘর স্থাপন করা হয়। প্রত্যেক
ডাকঘরেই ডাক বহনের জন্য ঘোড়া, গাধা, উট ও খচ্চর মোতায়েন রাখা হতো সাধারণ ঘোড়া হতে ডাক
বিভাগের ঘোড়াকে পৃথকভাবে চিহ্নিত করার জন্য ডাক- ঘোড়ার লেজ বিশেষভাবে ছাটা হতো। জরুরি অবস্থায়
গোপণীয় খবর দ্রæত আদানপ্রদানের জন্য প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত কবুতর ব্যবহার করা হতো।
উত্তর আফ্রিকায় গ্রীক ও রোমান রীতি অনুসারে অগ্নি সঙ্কেতের মাধ্যমে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা, বিশেষ করে শ্রত্রæ
আক্রমণ স¤পর্কে অবহিত করা হতো। পাহাড়ের উপর অগ্নি প্রজ্বলনের মাধ্যমে অগ্নি সংকেত প্রদান করা হতো।
উমাইয়া যুগের মত আব্বাসীয় যুগেও সাম্রাজ্যের বিভিন্ন প্রদেশে ডাক ব্যবস্থায় বিপুল পরিমান রাজস্ব ব্যয় হতো
উমাইয়া খলীফা হিশামের শাসনকালে একমাত্র ইরাক প্রদেশে ডাক বিভাগের বার্ষিক খরচ ছিল প্রতিদিন চার
লক্ষ দিরহাম। আব্বাসীয় যুগে খলীফা মুক্তাদিরের শাসনামলে উক্ত প্রদেশের ডাক বিভাগের বার্ষিক খরচ ছিল
এক লক্ষ চুয়ান্ন হাজার দীনার। ডাক-ঘোড়া পোষণ, নতুন ঘোড়া ক্রয়, ডাক কর্মচারী ও ডাক বহনকারীর বেতন
প্রদান এবং ডাক বিভাগের যাবতীয় চাহিদা প‚রণ এই ব্যয়ের অন্তর্ভুক্ত ছিল।
দীওয়ান আল-জুন্দ (সামরিক বিভাগ) ঃ প্রাদেশিক সরকারের সৈন্য নিয়োগ, প্রশিক্ষণ, সৈন্যদের বেতন
ও ভাতা বন্টন, প্রাদেশিক সামরিক বিভাগের উপর ন্যস্ত ছিল। প্রাদেশিক সামরিক বিভাগের রীতিনীতি কেন্দ্রীয়
সামরিক বিভাগের রীতিনীতির অনুরূপ ছিল। সামরিক বিভাগের গুরুত্বপূর্ণ নীতি নির্ধারণের ব্যাপারে যথা
সৈন্যদের বেতন বাড়ানো ও কমানোর ব্যাপারে প্রাদেশিক সরকারের অধিকার ছিল অত্যন্ত সীমিত। খলীফাই এ
ধরনের গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারে সিদ্ধাস্ত গ্রহণের অধিকারী ছিলেন। তবে দুর্ভিক্ষ কিংবা অন্য কোন মারাত্মক
পরিস্থিতিতে প্রাদেশিক আমীর খলীফার অনুমতি ব্যতীত অস্থায়ী ভিত্তিতে সৈন্যদের বেতন বৃদ্ধি করতে পারতেন।
১. আব্বাসীয় যুগে সাম্রাজ্যকে কয়টি প্রদেশে বিভক্ত করা হয়?
ক. ১৪টি; খ. ২৪টি;
গ. ৩৪টি; ঘ. ৯টি ।
২. আমীর ছিলেনক. কেন্দ্রীয় সরকার প্রধান; খ. প্রাদেশিক সরকার প্রধান;
গ. আঞ্চলিক সরকার প্রধান; ঘ. ধর্মীয় বিভাগের প্রধান।
৩. বাজেয়াপ্তকৃত ধনস¤পদ যে কোষাগারে জমা রাখা হত তার নাম ছিলক. বায়তুলমাল; খ. বায়তুলমাল আল-মাযাালিম;
গ. বায়তুল খাযানা; ঘ. রাষ্ট্রীয় কোষাগার।
৪. দীওয়ান আল-খারায বলা হয়ক. রাষ্ট্রীয় কোষাগারকে; খ. রাজস্ব বিভাগাকে;
গ. সামরিক বিভাগকে; ঘ. সৈন্য বিভাগকে।
৫. আব্বাসীয় যুগে আমিল কে ছিলেন?
ক. রাজ কর্মচারী; খ. কোষাগার সংরক্ষণকারী;
গ. প্রাদেশিক সরকারের ২য় গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি; ঘ. প্রাদেশিক রাজস্ব বিভাগের প্রধান।
৬. আব্বাসীয় যুগে ডাক বিভাগকে বলা হতক. দীওয়ান আল-বারীদ; খ. দীওয়ান;
গ. দীওয়ান আল-জুনদ; ঘ. দীওয়ান আল-মাকাতিব।
সংক্ষিপ্ত উত্তর-প্রশ্ন
১. আব্বাসীয় শাসনামলে সাম্রাজ্যকে কয়টি প্রদেশে বিভক্ত করা হয়েছিল তা লিখুন।
২. আব্বাসীয় যুগে আমীর কীভাবে নিয়োগ হতেন ? লিখুন।
৩. আব্বাসীয় যুগে আমীরের কার্যাবলী সংক্ষেপে বর্ণনা করুন।
৪. আব্বাসীয় যুগে দীওয়ান আল খারায় এর গুরূত্ব তুলে ধরুন।
৫. আব্বাসীয় যুগে দীওয়ান আল-বারীদ স¤পর্কে সংক্ষেপে আলোচনা করুন।
বিশদ উত্তর-প্রশ্ন
১. আব্বাসীয়দের প্রাদেশিক শাসনব্যবস্থা স¤পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করুন।
২. আব্বাসীয়দের প্রাদেশিক আমীরের বিভিন্ন দিক বিস্তারিত বর্ণনা দিন।

FOR MORE CLICK HERE
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস মাদার্স পাবলিকেশন্স
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস ১ম পর্ব
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস
আমেরিকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস
বাংলাদেশের ইতিহাস মধ্যযুগ
ভারতে মুসলমানদের ইতিহাস
মুঘল রাজবংশের ইতিহাস
সমাজবিজ্ঞান পরিচিতি
ভূগোল ও পরিবেশ পরিচিতি
অনার্স রাষ্ট্রবিজ্ঞান প্রথম বর্ষ
পৌরনীতি ও সুশাসন
অর্থনীতি
অনার্স ইসলামিক স্টাডিজ প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত
অনার্স দর্শন পরিচিতি প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত

Copyright © Quality Can Do Soft.
Designed and developed by Sohel Rana, Assistant Professor, Kumudini Government College, Tangail. Email: [email protected]