ইহুদী জাতির অপরাধের ইতিহাস

আল্লাহ যখনই বনী ইসরাঈল জাতির সংশোধন ও পরিমার্জনার জন্য কোনো নবী পাঠিয়েছেন, যালিম জাতি সেই নবীর কথা শুনেনি, তার নির্দেশ মেনে চলেনি, বরং উল্টো তাঁকে অমান্য করেছে। তার সাথে বিদ্রোহ করেছে। বিদ্রোহের নতুন নতুন রূপ আবিষ্কার করেছে। এদের কিছু ঘটনা উপরে বর্ণিত হয়েছে। এদের অপরাধের ধারাবাহিক একটি সংক্ষিপ্ত ইতিহাস নিচে বর্ণিত হচ্ছে :
হযরত মূসা আলাইহিস সালাম বনী ইসরাঈল জাতিকে ফিরাউনের গোলামীর জিঞ্জির থেকে মুক্ত করার জন্য আল্লাহর নির্দেশে মিসরে এসে পৌঁছলেন। বনী ইসরাঈলরা তার কাছে প্রথম অভিযোগ করলো, হে মূসা, আপনার আগমনের পূর্বেও আমাদেরকে উত্যক্ত ও কষ্ট দেয়া হয়েছে ৷ আর এখন আপনার আগমনের পরেও আমাদেরকে উত্যক্ত ও কষ্ট দেয়া হচ্ছে।
আল্লাহ এদেরকে ফিরাউনি অত্যাচার ও গোলামীর জিঞ্জির থেকে বাঁচালেন। তাদেরকে সাগর ফেড়ে রাস্তা বানিয়ে দিয়ে নিরাপদে সাগরের ঐ পাড়ে পৌঁছে দিলেন। ফিরাউন বাহিনীকে সাগরে ডুবিয়ে মারলেন। এসব কিছু তারা নিজ চোখের সামনে ঘটতে দেখেছে। এতসবের পরও এ জাতি হযরত মূসা আলাইহিস সালামের নিকট অন্যান্য মূর্তিপূজারী জাতির মতো তাদের জন্যও মূর্তি বানিয়ে দেবার দাবী করে বসলো ।
হযরত মূসা আলাইহিস সালামকে তাঁর রব, শরীয়াত, কিতাব ও হিদায়াত দান করার জন্য তাঁর কাছে ডেকে নিলেন। এসব ছিলো বনী ইসরাঈলকে দান করা আল্লাহ তাআলার সবচেয়ে বড় নিয়ামাত। ঠিক এ সময়েই এ যালিম ও মূর্খ জাতি আল্লাহর সাথে বিদ্রোহ করে গো-বাছুরকে পূজা করার কাজে লিপ্ত হয়ে গেলো ।
হযরত মূসা আলাইহিস সালামের ফিরে আসার পর এ বনী ইসরাঈলরা মূর্তিপূজা হতে তো বিরত হলো। কিন্তু এরপরও তাদের হৃদয় হতে শিরকের প্রভাব দূর হয়নি। তাই তারা গাভী যবাইর হুকুম শুনার পর অনাবিল মনে তা মেনে নিতে পারেনি। বরং গাভীর ব্যাপারে বিভিন্ন ধরনের অবান্তর প্রশ্ন করে তারা মূর্তিপূজার প্রতি তাদের দুর্বলতার প্রমাণ দিলো ।
‘সায়না' উপদ্বীপে ইহুদী জাতি অসীম দুর্বলতা ও অকৃতজ্ঞতার পরিচয় দিয়েছে। সহায় সম্বলহীন অবস্থায় তাদেরকে 'মান্না ও সালওয়ার' মতো সুস্বাদু খাদ্য দান করা হয়েছে। কিন্তু তারা এ নিয়ামাত প্রত্যাখ্যান করে পিঁয়াজ, রসূন, ডাল, আদার মতো তুচ্ছ জিনিস পাবার জন্য দাবী জানাতে লাগলো । এতসব ঘটনার পরও তাদেরকে ভৎর্সনা করা হয়নি। বরং দাবী অনুযায়ী সাথে সাথে তাদেরকে তা দেয়া হয়েছে। এরপর বনী ইসরাঈলের অতীত গৌরবের প্রতি ইঙ্গিত করে বলা হয়েছে :
وَإِذْ قَالَ مُوسَى لِقَوْمِهِ يَقَوْمِ اذْكُرُوا نِعْمَةَ اللهِ عَلَيْكُمْ إِذْ جَعَلَ فِيكُمْ أَنْبِيَاء وَجَعَلَكُمْ مُلُوكًا، وأتكُم مَّا لَمْ يُؤْتِ أَحَدًا مِّنَ الْعَلَمِينَ ٥ المائدة : ٢٠ ق
“স্মরণ করো! যখন মূসা তার জাতিকে বলেছিলো, হে আমার জাতি ! তোমরা আল্লাহর সেইসব নিয়ামাতের কথা মনে করো, যা তিনি তোমাদেরকে দান করেছিলেন। তিনি তোমাদের মধ্যে বহু নবী পাঠিয়েছেন । তোমাদেরকে শাসকে পরিণত করেছেন । তোমাদেরকে এমন সব জিনিস দিয়েছেন, দুনিয়ায় যা আর কাউকে দেয়া হয়নি।” > -সূরা আল মায়েদা : ২০
এখানে বনী ইসরাঈলের অতীত গৌরবের কথা উল্লেখ করে বলা হয়েছে যে, হযরত মূসা আলাইহিস সালামের বহু আগে এক সময়ে তারা এ গৌরবের অধিকারী ছিলো। একদিকে তাদের মধ্যে জন্ম নিয়েছিলেন হযরত ইবরাহীম, হযরত ইসহাক, হযরত ইয়াকুব ও হযরত ইউসুফের মতো মহাননবী ও রাসূলগণ। অন্যদিকে তারা হযরত ইউসুফ আলাইহিস সালামের সময়ে ও তারপরে মিসরে দীর্ঘসময় শাসন ক্ষমতার অধিকারী ছিলেন। দীর্ঘকাল পর্যন্ত তারাই ছিলো সেই সময়ের সভ্য জগতের সবচেয়ে প্রতাপশালী শাসক । মিসর ও তার চারিদিকের দেশে তাদেরই প্রতাপ ছিলো বিপুলভাবে। মুদ্রাও চালু ছিলো সর্বত্র তাদেরই ।
ঐতিহাসিকগণ বনী ইসরাঈলের উত্থান ইতিহাসের সূচনা করেন হযরত মূসার কাল থেকে। কিন্তু কুরআন এখানে সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করছে যে, বনী ইসরাঈলের উত্থানের আসল সময় ছিলো হযরত মূসার পূর্বেও। হযরত মূসা নিজেই তার জাতির সামনে তাদের এ গৌরবোজ্জল ইতিহাস তুলে ধরেছিলেন।
তারপর আল্লাহ তাআলা বনী ইসরাঈল জাতিকে একটি দেশ দান করতে চাইলেন । হযরত মূসা আলাইহিস সালামকে নির্দেশ দিলেন তাদেরকে নিয়ে ঐ ভূখণ্ড আক্রমণ করার জন্য । আল্লাহ তাদেরকে বিজয় দান করবেন। ঘটনাটি কুরআনের ভাষায় শুনুন :
يُقَوْم ادْخُلُوا الْأَرْضِ الْمُقَدَّسَةَ الَّتِي كَتَبَ اللهُ لَكُمْ وَلَا تَرْتَدُّوا عَلَى أَدْبَارِكُمْ فَتَنْقَلِبُوا خَسِرِينَ ٥ - المائدة : ۲۱
“হে আমার জাতির লোকেরা! সেই পবিত্র ভূখণ্ডে প্রবেশ করো, যা আল্লাহ তোমাদের জন্য লিখে দিয়েছেন । তোমরা পেছনে হটো না । পিছনে হটলে তোমরা বিফল ও ক্ষতিগ্রস্ত হবে।”-সূরা আল মায়েদা : ২১
এখানে ফিলিস্তিনের কথা বলা হয়েছে। এ দেশটি ছিলো হযরত ইবরাহীম, হযরত ইসহাক ও হযরত ইয়াকুবের আবাস ভূমি। বনী ইসরাঈলরা মিসর থেকে বের হয়ে এলে আল্লাহ তাদের জন্য এদেশটি নির্দিষ্ট করে দেন। সামনে অগ্রসর হয়ে এ দেশটি জয় করার নির্দেশ দান করেন। হযরত মূসা তাঁর জাতিকে নিয়ে মিসর থেকে বের হয়ে আসার প্রায় দু'বছর পর যখন তাদের সাথে ‘ফারানে’‘মরু অঞ্চলে’ তাবু খাটিয়ে অবস্থান করছিলেন তখনই এ ভাষণটি দেন। এ মরু অঞ্চলটি আরবের উত্তরে ও ফিলিস্তিনের দক্ষিণ সীমান্তে ‘সায়না’ উপদ্বীপে অবস্থিত ।
এরপর এ ক্ষেত্রে বনী ইসরাঈলের দুর্বলতা, কাপুরুষতা ও বেঈমানী তাদের সামনে বাধা হয়ে দাঁড়ালো। শুধু কাপুরুষতাই নয় বরং তাদের নবীর কথা মানতেও তারা অস্বীকৃতি জানালো । এ ঘটনাটি কুরআনের ভাষায় ঃ
قَالُوا يَمُوسى إِنَّ فِيهَا قَوْمًا جَبَّارِينَ ، وَإِنَّا لَنْ نَّدْخُلَهَا حَتَّى يَخْرُجُوا مِنْهَا ق فَإِنْ يُخْرُجُوا مِنْهَا فَانَّا دُخلُونَ ٥ - المائدة : ۲۲
“তারা বললো, হে মূসা ! ওখানে তো একটা খুব শক্তিশালী দুর্ধর্ষ জাতি বাস করে । তারা সেখান থেকে যতক্ষণ পর্যন্ত বেরিয়ে না আসবে, আমরা কখনো ওখানে প্রবেশ করবো না। হ্যাঁ! তারা বের হয়ে যাবার পর আমরা ওখানে প্রবেশ করতে রাজী ।”-সূরা আল মায়েদা : ২২
قَالَ رَجُلْنِ مِنَ الَّذِينَ يَخَافُونَ أَنْعَمَ اللهُ عَلَيْهِمَا ادْخُلُوا عَلَيْهِمُ الْبَابَ : فَاذَا دَخَلْتُمُوهُ فَإِنَّكُمْ غَلِبُونَ : وَعَلَى اللهِ فَتَوَكَّلُوا إِنْ كُنتُمْ مُؤْمِنِينَ ٥
“ঐ ভীরু বেঈমান লোকদের মধ্যে দু'জন এমন লোকও ছিলেন, যাদের প্রতি আল্লাহ তাঁর নিয়ামাত বর্ষণ করেছিলেন । তারা বললেন, এ শক্তিশালী লোকদের মোকাবিলা করে ঐ শহরের দরজার মধ্যে ঢুকে পড়ো । ভেতরে প্রবেশ করলে তোমরাই জয়ী হবে। তোমরা যদি মু'মিন হয়ে থাকো তাহলে আল্লাহর উপর নির্ভর করো।”-সূরা আল মায়েদা : ২৩
একথা শুনার পর ভীরু কাপুরুষ বেঈমান বনী ইসরাঈলের মনের সব গোপন কালিমা জেগে উঠলো। তারা আবার সেই একই কথা বলতে লাগলো । তারা বললো কুরআনের ভাষায় :
قَالُوا يَمُوسَى إِنَّا لَنْ نَّدْخُلَهَا أَبَدًا مَّا دَامُوا فِيهَا فَاذْهَبْ أَنْتَ وَرَبُّكَ فَقَاتِلاً إِنَّا هُهُنَّا قَاعِدُونَ ٥ - المائدة : ٢٤
“তরা বললো, হে মূসা ! যতক্ষণ তারা সেই জায়গায় অবস্থান করবে ততক্ষণ কোনো অবস্থাতেই আমরা সেখানে প্রবেশ করবো না । কাজেই তুমি ও তোমার রব, তোমরা দু'জনই সেখানে যাও এবং লড়াই করো আমরা বসে রইলাম এখানেই।”-সূরা আল মায়েদা : ২৪
বনী ইসরাঈলদের এ অবাক কাণ্ড দেখে হযরত মূসা আলাইহিস সালামের মতো তেজস্বী দৃঢ়চেতা নবীও চিৎকার দিয়ে বলে উঠলেন :
قَالَ رَبِّ إِنِّي لَا أَمْلِكُ إِلا نَفْسِي وَأَخِي فَافْرُقْ بَيْنَنَا وَبَيْنَ الْقَوْمِ الْفَسِقِينَ .
“মূসা বললো, হে আমার রব! আমি ও আমার ভাই (হারুন) ছাড়া আর কারো উপর আমার কোনো ইখতিয়ার নেই । তাই এ নাফরমান লোকদের থেকে আমাদেরকে পৃথক করে দাও।”-সূরা আল মায়েদা : ২৫
হযরত মূসা আলাইহিস সালামের এ ডাকে সাড়া দিয়ে আল্লাহ তাআলা চল্লিশ বছর পর্যন্ত দেশটিকে বনী ইসরাঈলের জন্য হারাম করে দিলেন। এ গোটা সময় তারা জঙ্গলে জঙ্গলে পথহারা উদ্ভ্রান্তের মতো ঘুরতে লাগলো । একথার প্রতি ইঙ্গিত করেই আল্লাহ বলছেন :
قَالَ فَإِنَّهَا مُحَرَّمَةٌ عَلَيْهِم أربعينَ سَنَةً ، يَتِيهُونَ فِي الْأَرْضِ ، فَلَا تَأْسَ عَلَى
“আল্লাহ বললেন, ঠিক আছে। তাহলে এ দেশটি চল্লিশ বছর পর্যন্ত তাদের জন্য হারাম করে দেয়া হলো। এরা পৃথিবীতে নিরুদ্দেশ ঘুরে ফিরে হাড়িয়ে মরবে। অতএব এ নাফরমানদের প্রতি কখনো সহানুভূতি ও সমবেদনা প্রকাশ করো না।”-সূরা আল মায়েদা : ২৬
হযরত মূসা ও নাফরমান ইয়াহুদীদের এ দীর্ঘ ঘটনার বিস্তারিত বিবরণ বাইবেলের ‘গণনাপুস্তকে পাওয়া যাবে। এ ঘটনার সার সংক্ষেপ হলো :
"হযরত মূসা ফিলিস্তিনের অবস্থা জানার জন্য 'ফারান' থেকে বনী ইসরাঈলের ১২জন সরদারকে ফিলিস্তিন সফরে পাঠান। তারা ৪০ দিন সফর করার পর সেখান থেকে ফিরে আসেন। জাতির এক সাধারণ সমাবেশে তারা জানান। ফিলিস্তিন তো খাদ্য সম্ভার ও অন্যান্য ভোগ্য সামগ্রীর প্রাচুর্যে ভরা এক সুখী, সমৃদ্ধশালী দেশ। এতে কোনো সন্দেহ নেই । কিন্তু সেখানকার অধিবাসীরা অত্যন্ত শক্তিশালী ।...তাদের উপর আক্রমণ করার ক্ষমতা নেই আমাদের ।.............সেখানে আমরা যতো লোক দেখেছি তারা সবাই বেশ দীর্ঘ দেহী। সেখানে আমরা ‘বনী ইনাফকেও' দেখেছি। তারা মহা পরাক্রমশালী ও দুর্ধর্ষ জাতি। বংশানুক্রমেই তারা পরাক্রমশালী। আর আমরা তো নিজেদের দৃষ্টিতে ফড়িংয়ের মতো। তাদের দৃষ্টিতেও তাই।
এ বর্ণনা শুনে সকলেই এক সাথে বলে উঠলো ।
হায়! আমরা যদি মিসরেই মরে যেতাম, হায়! যদি এ মরুর বুকেই আমাদের মৃত্যু হতো। আল্লাহ আমাদেরকে কেনো ঐ দেশে নিয়ে তরবারির আঘাতে হত্যা করাতে চান। এরপর আমাদের পরিবার পরিজন তো লুটের মালে পরিণত হবে। মিসরে ফিরে যাওয়াই কি আমাদের জন্য কল্যাণজনক হবে না ?............... তারপর তারা পরস্পর বলাবলি করতে লাগলো । এসো আমরা আমাদের কাউকে নিজেদের নেতা বানিয়ে নেই ও তার নেতৃত্বে মিসরে ফিরে যাই। তাদের একথা শুনে ফিলিস্তিনে পাঠানো বারো জন সরদারের দু'জন ইউশা ও কালেব উঠে দাঁড়ালেন। এ দুর্বলতা ও কাপুরুষতা প্রকাশের জন্য তাদের ভর্ৎসনা করলেন । কালেব বললেন, “চলো আমরা হঠাৎ আক্রমণ করে সে দেশটি দখল করে নিই। সে দেশটি চালাবার যোগ্যতা আমাদের আছে।”
.........এরপর তারা দু'জন এক স্বরে বলে উঠলেন, “যদি আল্লাহ আমাদের প্রতি রাজি থাকেন তাহলে নিশ্চয়ই তিনি আমাদেরকে সে দেশে পাঠাবেন।...... তবে তোমরা আল্লাহর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করো না। সে দেশের লোকদের ভয়ে ভীত হয়ো না । আমাদের সাথে আল্লাহ আছেন । কাজেই ওদেরকে ভয় পেয়ো না । কিন্তু এ বেঈমান জাতি এর জবাবে বললো—ওদেরকে পাথর মেরে হত্যা করো। অবশেষে আল্লাহর ক্রোধের আগুন জ্বলে উঠলো। তিনি ফায়সালা করলেন, তখন ইউশা ও কালেব ছাড়া বনী ইসরাঈলের বয়স্ক পুরুষদের মধ্যে আর কেউ সে ভূখণ্ডে প্রবেশ করতে পারবে না । অতপর বনী ইসরাঈলরা চল্লিশ বছর পর্যন্ত গৃহহীন অবস্থায় উদ্বাস্তুর মতো ঘুরে বেড়াতে থাকবে। এরপর এদের
বিশ বছরের বেশী বয়সের সব লোক মরে যাবে এবং নবীন বংশধরেরা যৌবনে প্রবেশ করবে তখনই এদেরকে ফিলিস্তিন জয় করার সুযোগ দেয়া হবে। আল্লাহর এ সিদ্ধান্ত অনুযায়ী বনী ইসরাঈলের ফারান মরুভূমি থেকে পূর্ব জর্দানে পৌছতে ৩৮ বছর লেগে যায়। যেসব লোক যুবক বয়সে মিসর থেকে বের হয়েছিলো তারা সকলেই এ সময়ে মারা যায়। পূর্ব জর্দান জয় করার পর হযরত মূসা আলাইহিস সালামের ইনতেকাল হয় । এরপর হযরত ইউশা ইবনে নূনের খিলাফাত কালে বনী ইসরাঈলরা ফিলিস্তিন জয় করতে সমর্থ হয়।
এখানে বর্ণনার ধারার প্রতি দৃষ্টি দিলে বুঝা যায়, কথাচ্ছলে একথা বর্ণনা করে বনী ইসরাঈলকে আসলে একথা বুঝানো হচ্ছে, মূসার সময় অবাধ্যতা, বিদ্রোহ, সত্য থেকে দূরে থাকা কাপুরুষতার কাজ করে তোমরা যে শাস্তি পেয়েছিলে এখন মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের দাওয়াতের বিরুদ্ধে বিদ্রোহাত্মক নীতি অবলম্বন করলে তার চেয়ে অনেক বেশী শাস্তি ভোগ করতে হবে।”
বনী ইসরাঈলের ব্যাপারে হযরত মূসা আলাইহিস সালামের যে তিক্ত অভিজ্ঞতা সঞ্চিত হয়েছে তার অভিব্যক্তি কুরআন মজিদে হযরত মূসার ভাষায় এভাবে ব্যক্ত করা হয়েছে :
وَإِذْ قَالَ مُوسَى لِقَوْمِهِ يُقَوْمٍ لِمَ تُؤْتُونَنِي وَقَدْ تَعْلَمُونَ أَنَّى رَسُولُ اللهِ إِلَيْكُمْ
“এবং সেই সময়ের কথা স্মরণ করো। যখন মূসা তার নিজের জাতিকে বলেছিলেন। হে আমার জাতির লোকজন ! তোমরা কেনো আমাকে দুঃখ কষ্ট দিচ্ছো। অথচ তোমরা ভালো করেই জানো, আমি আল্লাহর তরফ থেকে তোমাদের নিকট রাসূল হিসাবে প্রেরিত হয়েছি।”-সূরা সফ : ৫
অভিশপ্ত জাতি বনী ইসরাঈলের এ ঘৃণ্য আচরণ শুধু হযরত মূসা আলাইহিস সালামের সাথে সীমাবদ্ধ ছিলো না বরং সকল নবী রাসূলের সাথেই তারা এ আচরণ করেছে। তাদের অতীত ইতিহাস স্মরণ করিয়ে কুরআন বলছে :
وَإِذْ قَالَ عِيسَى ابْنُ مريمَ يُبَنِي إِسْرَاء يُلَ إِنِّي رَسُولُ اللهِ إِلَيْكُمْ مُصَدِّقًا لِمَا بَينَ يَدَيَّ مِنَ التَّورةِ وَمُبَشِّرًا بِرَسُولِ يَأْتِي مِنْ بَعْدِي اسْمُهُ أَحْمَدُ ، فَلَمَّا جَاءَهُمْ بِالْبَيِّنت قَالُوا هذَا سِحْرٌ مُّبِينٌ ٥ - الصف : ٦
“আর স্মরণ করো ঈসা ইবনে মারইয়ামের কথা যা তিনি বলেছিলেন : হে বনী ইসরাঈল ! আমি তোমাদের কাছে আল্লাহর পাঠানো রাসূল। আমি সেই তাওরাতের সত্যতা প্রমাণকারী যা আমার পূর্বে নাযিল হয়েছে এবং একজন রাসূলের সুসংবাদদাতা যিনি আমার পরে আসবেন। যার নাম আহমাদ। কিন্তু যখন তিনি তাদের কাছে সুস্পষ্ট প্রমাণ নিয়ে আসলেন । তখন তারা বললো এটাতো স্পষ্ট প্রতারণা।”-সূরা আস সফ : ৬
এটা বনী ইসরাঈল জাতির দ্বিতীয়বারের নাফরমানীর কথা। তারা একটি নাফরমানী করেছিলো তাদের উন্নতি ও উত্থান যুগের শুরুতে। আর এটি হলো তাদের দ্বিতীয় নাফরমানী ও বেঈমানী যা তারা এ যুগেরই শেষ দিকে সর্বশেষ করেছিলো। এরপর চিরদিনের জন্য তাদের উপর আল্লাহর গযব নাযিল হলো । মুসলমানদেরকে আল্লাহর রাসূলের সাথে বনী ইসরাঈলের মতো আচরণ করার পরিণাম পরিণতি সম্পর্কে সতর্ক করে দেয়াই হলো এ দু'টি ঘটনা বর্ণনা করার উদ্দেশ্য ।
به كُلَّمَا جَاءَ هُمْ رَسُولُ بِمَا لاَتَهْوَى أَنْفُسُهُمْ * فَرِيقًا كَذَّبُوا وَفَرِيقًا يَقْتُلُونَ ٥
“যখনই কোনো নবী তাদের কাছে এসেছে তাদের ইচ্ছার বিরূদ্ধে কোনো কিছু নিয়ে। তখন তারা কাউকে মিথ্যাবাদী বলে প্রত্যাখ্যান করেছে । আর কাউকে হত্যা করে দিয়েছে।”-সূরা আল মায়েদা : ৭০
বনী ইসরাঈলরা তাদের এ অপরাধের ইতিহাস নিজেদের ইতিহাসে নিজেরাই বিস্তারিতভাবে বর্ণনা করেছে। নমুনা হিসাবে বাইবেলের সংক্ষিপ্ত বিবরণ মাওলানা মওদূদী মরহুমের ভাষায় শুনুন ঃ
এক : হযরত সুলাইমানের পর ইসরাঈলী সাম্রাজ্য দু'টি রাষ্ট্রে (জেরুযালেমের ইহুদিয়া রাষ্ট্র এবং সামারিয়ার ইসরাঈল রাষ্ট্র) বিভক্ত হয়ে যায়। তাদের মধ্যে যুদ্ধ-বিগ্রহ চলতে থাকে। অবশেষে ইহুদিয়া রাষ্ট্র নিজের ভাইদের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য দামেস্কের আরামী রাষ্ট্রের সাহায্য প্রার্থনা করে। এতে আল্লাহর হুকুমে হানানী নবী ইহুদিয়া রাষ্ট্রের শাসক ‘আস’-কে কঠোরভাবে সতর্ক করে দেন। কিন্তু ‘আসা' এ সতর্কবাণী গ্রহণ করার পরিবর্তে আল্লাহর নবীকে কারারুদ্ধ করে।-২ বংশাবলী, ১৭ অধ্যায়, ৭-১০ শ্লোক ৷
দুই : হযরত ইলিয়াস (ইলিয়াহ - ELLIAH) আলাইহিস সালাম যখন বা'ল দেবতার পূজার জন্য ইহুদিদের তিরস্কার করেন এবং নতুন করে আবার তাওহীদের দাওয়াত দিতে থাকেন তখন সামারিয়ার ইসরাঈলী রাজা ‘আকিআব’ নিজের মুশরিক স্ত্রীর প্ররোচনায় তাঁর প্রাণনাশের সর্বাত্মক প্রচেষ্টায় মেতে ওঠেন। ফলে তাঁকে সিনাই উপদ্বীপের পর্বতাঞ্চলে আশ্রয় নিতে হয়। এ সময় হযরত ইলিয়াস যে দোয়া করেন তার শব্দাবলী ছিল নিম্নরূপ :
“বনী ইসরাঈল তোমার সাথে কৃত অংগীকার ভংগ করেছে
তোমার নবীদের হত্যা করেছে তলোয়ারের সাহায্যে এবং একমাত্র আমিই বেঁচে আছি। তাই তারা আমার প্রাণনাশের চেষ্টা করছে।-১ রাজাবলী, ১৭ অধ্যায়, ১-১০ শ্লোক ।
তিন : সত্য ভাষণের অপরাধে হযরত ‘মিকাইয়াহ' নামে আর একজন নবীকেও এই ইসরাঈলী শাসক আখিআব কারারুদ্ধ করে। সে হুকুম দেয়, এই ব্যক্তিকে বিপদের খাদ্য খাওয়াও এবং বিপদের পানি পান করাও।-১ রাজাবলী, ২২ অধ্যায়, ২৬-২৭ শ্লোক ।
চার : আবার যখন ইহুদিয়া রাষ্ট্রে প্রকাশ্যে মূর্তিপূজা ও ব্যভিচার চলতে থাকে এবং হযরত যাকারিয়া আলাইহিস সালাম এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদে সোচ্চার হন তখন ইহুদি রাজা ইউআস-এর নির্দেশে তাকে মূল হাইকেলে সুলাইমানীতে 'মাকদিস' (পবিত্র স্থান) ও 'যবেহ ক্ষেত্র'-এর মাঝখানে প্রস্তরাঘাতে হত্যা করা হয়।-২ বংশাবলী, ২৪ অধ্যায়, ২১ শ্লোক ।
পাঁচ ঃ অতপর আশুরিয়াদের হাতে যখন সামারিয়াদের ইসরাঈলী রাষ্ট্রের পতন হয় এবং জেরুসালেমের ইহুদি রাষ্ট্র মহাধ্বংসের সম্মুখীন হয় তখন ‘ইয়ারমিয়াহ’ নবী নিজের জাতির পতনে আর্তনাদ করে ওঠেন। তিনি পথে- ঘাটে, অলিতে-গলিতে নিজের জাতিকে সম্বোধন করে বলতে থাকেন, “সতর্ক হও, নিজেদেরকে সংশোধন করো, অন্যথায় তোমাদের পরিণাম সামারিয়া জাতির চেয়েও ভয়াবহ হবে।” কিন্তু জাতির পক্ষ থেকে এ সাবধান বাণীর বিরূপ জবাব আসে। চারদিক থেকে তাঁর ওপর প্রবল বৃষ্টিধারার মতো অভিশাপ ও গালি-গালাজ বর্ষিত হতে থাকে। তাঁকে মারধর করা হয়। কারারুদ্ধ করা হয। ক্ষুধা ও পিপাসায় শুকিয়ে মেরে ফেলার জন্য রশি দিয়ে বেঁধে তাকে কর্দমাক্ত কূয়ার মধ্যে ঝুলিয়ে রাখা হয়। তাঁর বিরুদ্ধে জাতির সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করার এবং বিদেশী শত্রুর সাথে আতাত করার অভিযোগ আনা হয়।—যিরমিয়, ১৫ অধ্যায়, ১০ শ্লোক ; ১৮ অধ্যায়, ২০-২৩ শ্লোক ; ২০ অধ্যায়, ১-১৮ শ্লোক ; ৩৬-৪০ অধ্যায় ৷
ছয় : ‘আমুস' নামক আর একজন নবী সম্পর্কে বলা হয়েছে : যখন তিনি সামারিয়ার ইসরাঈলী রাষ্ট্রের ভ্রষ্টতা ও ব্যভিচারের সমালোচনা করেন এবং এ অসৎকাজের পরিণাম সম্পর্কে তাদেরকে সতর্ক করে দেন তখন তাঁকে চরমপত্র দিয়ে বলে দেয়া হয়, এদেশ থেকে বের হয়ে যাও এবং বাইরে গিয়ে নিজের নবুওয়াত প্রচার করো। আমুস, ৭ অধ্যায়, ১০-১৩ শ্লোক ।
সাত ঃ হযরত ইয়াহইয়া (John the Baptist) আলাইহিস সালাম যখন ইহুদি শাসক হিরোডিয়াসের দরবারে প্রকাশ্যে অনুষ্ঠিত ব্যভিচার ও নৈতিকতা বিরোধী কার্যকলাপের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানান তখন প্রথমে তাঁকে কারারুদ্ধ করা হয়। তারপর বাদশাহ নিজের প্রেমিকার নির্দেশানুসারে জাতির এই সবচেয়ে সৎ ও ন্যায়নিষ্ঠ ব্যক্তিটির শিরচ্ছেদ করে । কর্তিত মস্তক একটি থালায় করে নিয়ে বাদশাহ তার প্রেমিকাকে উপহার দেয়। মার্ক, ৬ অধ্যায়, ১৭-২৯ শ্লোক ।
আট : সবশেষে হযরত ঈসা আলাইহিস সালামের বিরুদ্ধে বনী ইসরাঈলের আলেম সমাজ ও জাতীয় নেতৃবৃন্দের ক্রোধ উদ্দীপিত হয়। কারণ তিনি তাদের পাপ কাজ ও লোক দেখানো সৎকাজের সমালোচনা করতেন। তাদেরকে ঈমান ও সৎকাজের দিকে আহ্বান জানাতেন। এসব অপরাধে তাঁর বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা তৈরি করা হয় । রোমান আদালত তাঁকে প্রাণদণ্ড দানের সিদ্ধান্ত করে। রোমান শাসক পীলাতীস যখন ইহুদিদের বললো, আজ ঈদের দিন, আমি তোমাদের স্বার্থে ঈসা ও বারাব্বা (Barabbas) ডাকাতের মধ্য থেকে একজনকে মুক্তি দিতে চাই। আমি কাকে মুক্তি দেবো ? ইহুদিরা সমস্বরে বললো, আপনি বারাব্বাকে মুক্তি দিন এবং ঈসাকে ফাঁসি দিন। মথি,
২৭ অধ্যায়, ২০-২৬ শ্লোক ।
এই হচ্ছে ইহুদি জাতির অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের একটি কলংকজনক অধ্যায়। কুরআনের উল্লেখিত আয়াতগুলোতে সংক্ষেপে এদিকেই ইংগিত করা হয়েছে। বলা বাহুল্য যে জাতি নিজের ফাসেক ও দুশ্চরিত্র সম্পন্ন লোকদেরকে নেতৃত্বের আসনে বসাতে এবং সৎ ও উন্নত চরিত্রের অধিকারী লোকদেরকে কারাগারে স্থান দিতে চায় আল্লাহ তাদের ওপর অভিশাপ বর্ষণ না করলে আর কাদের ওপর অভিশাপ বর্ষণ করবেন ?
-তাফহীমুল কুরআন ১ম খণ্ড, পৃষ্ঠা-৮৪-৮৬।

FOR MORE CLICK HERE
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস মাদার্স পাবলিকেশন্স
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস ১ম পর্ব
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস
আমেরিকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস
বাংলাদেশের ইতিহাস মধ্যযুগ
ভারতে মুসলমানদের ইতিহাস
মুঘল রাজবংশের ইতিহাস
সমাজবিজ্ঞান পরিচিতি
ভূগোল ও পরিবেশ পরিচিতি
অনার্স রাষ্ট্রবিজ্ঞান প্রথম বর্ষ
পৌরনীতি ও সুশাসন
অর্থনীতি
অনার্স ইসলামিক স্টাডিজ প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত
অনার্স দর্শন পরিচিতি প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত

Copyright © Quality Can Do Soft.
Designed and developed by Sohel Rana, Assistant Professor, Kumudini Government College, Tangail. Email: [email protected]