ইহুদী জাতির করুণ পরিণতি

আল্লাহর সাথে করা অনেক অঙ্গীকার ইহুদী জাতি ভঙ্গ করেছে। পরিণামে আল্লাহ তাদেরকে কঠিন শাস্তি দিয়েছেন। নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া
সাল্লামের আগমনের আগে ইহুদী জাতির লোকেরা উদ্বিগ্ন হয়ে তার আগমন অপেক্ষায় ছিলো । কারণ তাদের নবী রাসূলগণ এ শেষ নবীর আগমন সম্পর্কে আগামবাণী দিয়েছিলেন। তারা তাড়াতাড়ি এ নবীর আগমনের জন্য দোয়াও করতো। তাহলে কাফেরদের শক্তি নিঃশেষ হয়ে যাবে। তাদের উত্থান শুরু হবে। মদীনাবাসী তাদের এসব কথার সাক্ষী। তারা জানতো তাদের প্রতিবেশী ইহুদীরা আগত নবীর আগমনের আশায় বেঁচে ছিলো। তারা বলতো — এখন তোমাদের যার যা খুশী আমাদের উপর যুলম করতে থাকো। যখন ঐ নবী আগমন করবেন তখন আমরা যালিমদেরকে দেখে নিবো । মদীনাবাসীরা এসব কথা শুনেছে। তাই যখন তারা শেষ নবীর কথা শুনলো পরস্পর বলতে লাগলো
দেখো এ ইহুদীরা যেনো আমাদের আগে বাজিমাত করতে না পারে । চলো আমরাই আগে গিয়ে এ নবীর উপর ঈমান আনি। কিন্তু তাদের কাছে এটা বড় আশ্চর্যজনক ঘটনা হিসাবে দেখা দিলো যখন এ ইহুদীরা যারা শেষ নবীর আগমনে অধিকর আগ্রহে অপেক্ষা করছিলো। তারাই তাঁর আগমনের পর তাঁর বিরোধিতায় সকলের চেয়ে অগ্রগামী ছিলো।
কুরআনে বলা হয়েছে, শেষ নবীকে তারা চিনেও গেছে—এ কথার অনেক প্রমাণ আছে । সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য সাক্ষ হলো উম্মুল মু'মিনীন হযরত সাফিয়া রাদিয়াল্লাহু আনহার। তিনি একজন ইহুদী আলেমের কন্যা ছিলেন। তাঁর চাচাও একজন ইয়াহুদী আলেম ছিলেন। হযরত সাফিয়া বলেছেন, নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মদীনায় আগমনের পর আমার বাবা ও চাচা উভয়েই তাঁর সাথে দেখা করলেন । অনেকক্ষণ পর্যন্ত তাঁর সাথে কথা বললেন । এরপর বাড়ী ফিরে এলে আমি আমার নিজ কানে তাদের উভয়ের কথাবার্তা শুনলাম ।
চাচা বললেন, তাহলে ইনিই কি সেই নবী যার আগমনের কথা আমাদের আসমানী কিতাবে দেয়া হয়েছে। আমার বাবা উত্তরে বললেন, আল্লাহর কসম ইনিই সেই নবী। চাচা বললেন, এতে আপনার পূর্ণ বিশ্বাস আছে ? আমার পিতা বললেন, হাঁ, অবশ্যই আছে। চাচা বললেন, তাহলে এখন আপনার ইচ্ছা কি ? উত্তরে আমার পিতা বললেন, যতদিন এ দেহে জীবন থাকবে ততদিন এ নবীর বিরোধিতা করে যাবো। এ নবীর দাওয়াত মানুষের কাছে পৌঁছাতে দেবো না।—ইবনে হিশাম ২য় খণ্ড
তাদের এসব বিভিন্ন কর্মকাণ্ড ও ওয়াদা সম্পর্কে কুরআনে পাকে আল্লাহ পাক বলেছেন ঃ

فَبِمَا نَقْضِهِم مِّيثَاقَهُمْ لَعَنْهُمْ وَجَعَلْنَا قُلُوبَهُمْ قَسيَةٌ : - المائدة : ۱۳
“অতপর তাদের নিজেদেরই ওয়াদা ভংগ করাই ছিলো তাদের বড় অপরাধ । এ অঙ্গীকার ভঙ্গের দরুন আমি তাদেরকে আমার রহমত থেকে দূরে নিক্ষেপ করেছি। তাদের অন্তরকে কঠোর করে দিয়েছি।”
-সূরা আল মায়েদা : ১৩
ط
فَنَبَنُوهُ وَرَاءَ ظُهُورِهِمْ وَاشْتَرَوْا بِهِ ثَمَنًا قَلِيلاً - - ال عمران : ۱۸۷
“কিন্তু তারা কিতাবের প্রতি পৃষ্ঠ প্রদর্শন করেছে। খুব সামান্য মূল্যে একে বিক্রি করে দিয়েছে।”-সূরা আলে ইমরান : ১৮৭
أَفَتُؤْمِنُونَ بِبَعْضِ الْكِتَبِ وَتَكْفُرُونَ بِبَعْضٍ ، فَمَا جَزَاءُ مَنْ يَفْعَلُ ذلِكَ مِنْكُمْ
الأخرى فِي الْحَيَوةِ الدُّنْيَا ، وَيَومَ الْقِيمَةِ يُرَدُّونَ إِلَى أَشَدِ الْعَذَابِ ط
“তোমরা কি কিতাবের এক অংশের উপর ঈমান আনছো । অপর অংশের সাথে কুফরী করছো। তোমাদের যারা এরূপ করে তাদের শাস্তি এছাড়া আর কি হতে পারে যে, দুনিয়ায় তারা লাঞ্ছিত এবং অপমানিত হবে। আর পরকালে দগ্ধিভূত আযাবে ফিরিয়ে দেয়া হবে।”-সূরা আল বাকারা : ৮৫
وَلَقَدْ أَتَيْنَا مُوسَى الكتب وقَفَّيْنَا مِنْ بَعْدِهِ بِالرُّسُلِ : وَآتَيْنَا عِيسَى ابْنَ مَريم ز
الْبَيِّنْتِ وَأَيَّدنهُ بِرُوحِ الْقُدُسِ افَكُلَّمَا جَاءَكُمْ رَسُولُ بِمَا لا تَهْوَى أَنْفُسُكُمُ
اسْتَكْبَرْتُمْ : فَفَرِيقًا كَذَّبْتُمْ وَفَرِيقًا تَقْتُلُونَ ٥ - البقرة : ۸۷ ج ز
“আমি মূসাকে কিতাব দান করেছি। অতপর একের পর এক রাসূল পাঠিয়েছি। সর্বশেষ ঈসাকে স্পষ্ট দলিল সহকারে পাঠিয়েছি এবং পবিত্র ‘রূহ’ দিয়ে তাকে সাহায্য করেছি। এরপর এটা তোমাদের কি আচরণ যে, যখনই কোনো নবী তোমাদের প্রবৃত্তির ইচ্ছার বাইরে কোনো জিনিস নিয়ে এসেছে তখনই তোমরা তাঁর মুকাবিলায় বিদ্রোহ করে বসেছো। কাউকে মিথ্যাবাদী বলেছো কাউকে হত্যা করেছো।”-সূরা আল বাকারা : ৮৭
وَقَالُوا قُلُوبُنَا غُلْفٌ ، بَل لَّعَنَهُمُ اللهُ بِكُفْرِهِم - البقرة : ٨٨
“তারা বলে আমাদের মন সুরক্ষিত আছে। প্রকৃত কথা হলো কুফরীর কারণে তাদের উপর আল্লাহর অভিসম্পাত বর্ষিত হয়েছে।”

ولَمَّا جَاءَهُمْ كِتَبُ مَنْ عِنْدِ اللهِ مُصَدِّقُ لِمَا مَعَهُمْ * وَكَانُوا مِنْ قَبْلُ يَسْتَفْتِحُونَ عَلَى الَّذِينَ كَفَرُوا ، فَلَمَّا جَاءَ هُمْ مَّا عَرَفُوا كَفَرُوا به ن فَلَعْنَةُ
“এবং এখন একটি কিতাব আল্লাহর কাছ থেকে তাদের কাছে এসেছে। এ কিতাবের সাথে তারা কি ব্যবহার করলো ? অথচ তাদের কাছে আগ থেকে বিদ্যমান কিতাব এ কিতাবের সত্যতা প্রমাণ করে। অথচ তার আগমনের আগে তারা কাফেরদের মুকাবিলায় বিজয় ও সাহায্যের জন্য দোয়া চাইতো। কিন্তু যখনই ঐ জিনিস এসে গেলো যা তারা বিলক্ষণ চিনে গেছে । তখন তারা একে মেনে নিতে অস্বীকার করলো । তাই এসব কাফেরদের উপর আল্লাহর অভিসম্পাত বর্ষিত হয়েছে।”
-সূরা আল বাকারা : ৮৯
بِئْسَمَا اشْتَرُوا بِهِ أَنْفُسَهُمْ أَنْ يَكْفُرُوا بِمَا أَنْزَلَ اللهُ بَغْيًا أَنْ يُنَزَلَ اللهُ مِنْ
فَضْلِهِ عَلَى مَنْ يَشَاءُ مِنْ عِبَادِهِ ، فَبَاءُ وَ بِغَضَبٍ عَلَى غَضَبٍ ، وَلِلْكَفِرِينَ
“তারা যে জিনিসের সাহায্যে মনের সান্ত্বনা লাভ করে তা কতই না নিকৃষ্ট। আর তাহলো, আল্লাহ যে বিধান নাযিল করেছেন, তারা শুধু এ জিদের বশবর্তী হয়ে তা মেনে নিতেই অস্বীকার করছে যে, আল্লাহ তাঁর বান্দাহদের মধ্যে নিজেদের মনোনিত একজনকে তার অনুগ্রহ (ওহী ও নবুয়াত) দান করেছেন। অতএব তারা গজবের পর গজবের উপযুক্ত হয়ে গেলো। তাই এ ধরনের কাফেরদের জন্য লাঞ্ছনা ও বঞ্চনার কঠিন অপমানকর শাস্তি নির্দিষ্ট রয়েছে।”-সূরা আল বাকারা : ৯০
এসবের কারণ হলো—ইহুদীদের মনের কামনা বাসনা ছিলো ভবিষ্যতে যে নবী আগমন করবেন তিনি তাদের বনী ইসরাঈল বংশে জন্মগ্রহণ করবেন। কিন্তু তাদের কামনা বাসনার উল্টো সেই নবী যখন অন্য আর এক বংশে জন্মগ্রহণ করলেন, যে বংশকে তারা তাদের নিজেদের তুলনায় হীন ও ছোট মনে করতো । তখন তারা তাকে মানতে অস্বীকার করলো। তাদের মনোভাবটা এমন ছিলো যে, আল্লাহ তাদের কাছে জিজ্ঞেস ও পরামর্শ করে তাদের মতামত অনুযায়ী নবী পাঠালে তবেই তা ঠিক হতো। তারাও তা মেনে নিতে পারতো ।
فَبِمَا نَقْضِهِمْ مِّيْثَاقَهُمْ وَكُفْرِهِمْ بِأَيْتِ اللَّهِ وَقَتْلِهِمُ الْأَنْبِيَاء بِغَيْرِ حَقٍّ وَقَوْلِهِمْ قُلُوبُنَا غُلفُ ، بَلْ طَبَعَ اللهُ عَلَيْهَا بِكُفْرِهِمْ فَلَا يُؤْمِنُونَ إِلا قَلِيلاً وَبِكُفْرِهِمْ ط وَقَوْلِهِمْ عَلَى مَرْيَمَ بُهْتَانًا عَظِيمًا ، وَقَوْلِهِمْ إِنَّا قَتَلْنَا الْمَسِيحَ عِيسَى ابْنَ مَرْيَمَ رَسُولَ اللَّهِ ، وَمَا قَتَلُوهُ وَمَا صَلَبُوهُ وَلكِنْ شُبِّهَ لَهُمْ ، وَإِنَّ الَّذِينَ اخْتَلَفُوا فِيهِ لَفِي شَكٍّ مِّنْهُ ، مَا لَهُمْ بِهِ مِنْ عِلم إلا اتِّبَاعَ الظَّنِّ ، وَمَا قَتَلُوهُ يقينًا بَلْ رَفَعَهُ اللهُ إِلَيْهِ ، وَكَانَ اللهُ عَزِيزًا حَكِيمًا 0 النساء : ١٥٨١٥٥
“অবশেষে তাদের ওয়াদা ভঙ্গের কারণে, আর এ কারণে যে, তারা আল্লাহর আয়াতকে মিথ্যা বলেছে নবী-রাসূলগণকে অকারণে হত্যা করেছে এবং এতদূর পর্যন্ত বলেছে যে, আমাদের মন আবরণের মধ্যে সুরক্ষিত। প্রকৃত ঘটনা তাদের কুফরী নীতির কারণে আল্লাহ তাদের মনের উপর মোহর মেরে দিয়েছেন। তাই তাদের খুব কম লোকই ঈমান আনে । এরপর তারা নিজেদের কুফরীকাজে এতবেশী বেড়ে গেলো যে তারা মারইয়ামের উপর কঠিন অপবাদ আরোপ করলো এবং নিজেরা বললো, “আমরা মসিহ ঈসা ইবনে মারইয়াম আল্লাহর রাসূলকে কতল করে দিয়েছি!” অথচ প্রকৃতপক্ষে ইহুদীরা না তাঁকে কতল করতে পেরেছে আর না শূলে চড়াতে পেরেছে। বরং গোটা ব্যাপারটাই তাদের নিকট গোলক- ধাঁধায় পরিণত করে দেয়া হয়েছে। যারা এ ব্যাপারে মতভেদ করেছে তারাও সন্দেহে লিপ্ত আছে। এ ব্যাপারে তাদের কাছে কোনো জ্ঞান নেই । শুধু আন্দাজ অনুমানের ভিত্তিতেই কথা বলছে। তারা মসিহকে কতল করেছে, নিশ্চয়তা দিয়ে বলতে পারছে না। বরং আল্লাহ তাঁকে নিজের নিকট উঠিয়ে নিয়ে গেছেন । আল্লাহ খুবই শক্তিশালী ও বড় কৌশলী।”
-সূরা আন নিসা : ১৫৫-১৫৮
ইহুদী জাতি প্রকৃতপক্ষে দুনিয়ার সকল বাতিল পূজারী জাহিলদের মতো তাদের বাপ-দাদা হতে প্রাপ্ত রেওয়াজ-রসম, ধারণা, জাতীয়তা ইত্যাদি নিয়ে গৌরববোধ করতো । তারা বলতো আমাদের বাপ দাদা হতে পাওয়া আকীদা- বিশ্বাস এত মজবুত যে, এসব হতে আমাদেরকে সরানো সম্ভব নয় । আল্লাহর তরফ থেকে আগত নবী-রাসূলগণ যখনই তাদেরকে তাদের ভুল বুঝাবার চেষ্টা করেছেন তখনই তারা একই জবাব দিয়েছে। তারা বলেছে, তোমরা যতো দলিল প্রমাণই নিয়ে এসো না কেন, যত আয়াতই পেশ করো না কেন আমরা
তোমাদের কোনো কথায় কান দেবো না। যাকিছু আমরা মানতাম ও করে আসছিলাম তা-ই আমরা মানবো ও করতে থাকবো। অর্থাৎ আমরা আমাদের আকীদায় ও খেয়াল খুশিতে এত মজবুত যে, তোমরা যা-ই বলো এতে আমাদের উপর কোনো প্রভাব পড়বে না। সকল যুগের হঠধর্মী ও হঠকারী লোকরাই এ ধরনের জাহেলী ধারণা অন্ধ জাতীয়তার শিকারে পরিণত হতো । তারা একে তাদের আকীদার মযবুতী নাম দিয়ে তাদের গুণ-বৈশিষ্ট্য হিসাবে গণ্য করতো । অথচ মানুষের জন্য এর চেয়ে বড় দোষ আর কিছু হতে পারে না। নিজেদের উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া আকীদা ও চিন্তাধারার উপর দৃঢ় থাকার সিদ্ধান্তের চেয়ে আর কোনো দোষ বড় হতে পারে না। তা চাই যত বড় ও শক্তিশালী দলিল দিয়ে প্রমাণ করা হোক না কেন ।
হযরত ঈসা আলাইহিস সালামের জন্মের ব্যাপারে ইহুদী জাতির ভিতরে বিন্দুমাত্রও সন্দেহ সংশয় ছিলো না। যেদিন হযরত ঈসা আলাইহিস সালাম জন্মগ্রহণ করেছিলেন, ঐদিনই আল্লাহ তাআলা গোটা ইহুদী জাতিকে এ ঘটনার সাক্ষী বানিয়ে রেখেছিলেন। আল্লাহ বলেছিলেন, এ একটা স্বাভাবিক নিয়মের বিপরিত নিয়মের ব্যক্তিত্বের সন্তান। যার জন্ম মোজেযা বা অলৌকিক ঘটনার ফল । এটা কোনো নৈতিক অপরাধের ফসল নয়।
বনী ইসরাঈলের সর্বশ্রেষ্ঠ শরীফ ও বিখ্যাত ধর্মীয় পরিবারের একজন অবিবাহিতা কুমারী কন্যা কোলে বাচ্চা নিয়ে যখন ঘরে ফিরে আসলো । জাতির ছোট বড় হাজার হাজার মানুষ মনে প্রশ্ন নিয়ে তার ঘরে এসে ভীড় জমালো । তখন ঐ কুমারী মাতা তাদের কোনো প্রশ্নের জবাব না দিয়ে চুপচাপ সদ্যপ্রসূত কোলের বাচ্চার দিকে ইঙ্গিত দিয়ে বললেন। এ নবজাত সন্তান তোমাদের প্রশ্নের জবাব দিবে। গোটা সমাবেশ স্তম্ভিত হয়ে গেলো। তারা বললো—কোলের শিশুর কাছে আমরা জিজ্ঞেস করবো কি ?
কোলের শিশু আর কাউকে কোনো কথা বলার সুযোগ না দিয়ে অকস্মাৎ মুখ ফুটে অত্যন্ত স্পষ্ট বলিষ্ঠ ও সাবলীল মিষ্টি ভাষায় আগত জনসমাবেশকে উদ্দেশ করে বলে উঠলো, “ইন্নি আবদুল্লাহ। আতানিয়াল কিতাবা ওয়া যায়ালানী নাবীয়্যা”—“আমি আল্লাহর বান্দা। আল্লাহ আমাকে কিতাব দান করেছেন। তিনি আমাকে বানিয়েছেন নবী । ”
এভাবে আল্লাহ তাআলা হযরত ঈসা আলাইহিস সালামের জন্মের ব্যাপারে সন্দেহ সংশয়ের মূল শিকড় চিরদিনের জন্য কেটে দিলেন। এ কারণেই হযরত ঈসা আলাইহিস সালামের যৌবন বয়সে পৌঁছা পর্যন্ত কখনো কেউ হজরত
মারইয়ামের ব্যাপারে ব্যাভিচারের অভিযোগ আনেনি। হযরত ঈসা আলাইহিস সালামকেও কেউ কখনো অবৈধ জন্মের অপবাদ দেয়নি।
কিন্তু হযরত ঈসা আলাইহিস সালামের বয়স ত্রিশ বছরে পৌঁছলে তিনি যখন নবুয়াতের কাজের সূচনা করলেন, তিনি যখন ইহুদী জাতিকে তাদের খারাপ কাজে বাধা দিতে শুরু করলেন। ইহুদী ওলামা ফোকাহাদের রিয়া অহমিকা-অহংকার সংশোধন করার জন্য বললেন। যখন তাদের সাধারণ ও বিশেষ বিশেষ লোকজনকে তাদের ডুবে থাকা চারিত্রিক অধঃপতনের খবর দিলেন । যখন এ বিপজ্জনক পথে নিজের জাতিকে আহবান জানাতে লাগলেন, যে পথে আল্লাহর দ্বীনকে বাস্তবে কায়েম করার জন্য হরেক রকমের দুঃখ-কষ্ট সহ্য করতে হয়েছিলো। হতে হয়েছিলো প্রতি দিক ও বিভাগে শয়তানী শক্তির সাথে লড়াই করার সম্মুখীন। ঠিক তখনি এ নির্বাক অপরাধীর সত্যতার আওয়াজকে দাবীয়ে দেবার জন্য সকল প্রকার ষড়যন্ত্রের অস্ত্র ব্যবহার ও ষড়যন্ত্র করার জন্য ইহুদী জাতি মাঠে অবতীর্ণ হয়েছিলো। এ সময় তারা এমন সব কথা বলতে শুরু করলো যা ত্রিশ বছর পর্যন্ত বলেনি। তারা আগে কখনো বলেনি, বিবি মারইয়াম, আল্লাহ মাফ করুক, ব্যভিচারীণী ছিলেন । অথবা হযরত ঈসা আলাইহিস সালাম ব্যভিচারীর সন্তান। অথচ এ আলেমরা পূর্ণ আস্থার সাথে জানতেন, এই মা-ছেলে এসব কালিমা থেকে সর্বোতভাবে ছিলেন পবিত্র ।
তাই ইহুদী জাতির মনে বিদ্যমান এ অপবাদ কোনো সন্দেহ সংশয় সৃষ্টির ফল নয় । বরং তা ছিলো একটি খাস অপবাদ। জেনে বুঝে সুচিন্তিতভাবে তারা সত্যের বিরোধিতা করার জন্য এ কৌশল গড়ে নিয়েছিলো। এজন্যই আল্লাহ তাদের এ কর্মকাণ্ডকে যুল্ম ও মিথ্যা না বলে কুফরী কাজ বলে আখ্যায়িত করেছেন। কারণ এ অভিযোগের আসল উদ্দেশ্য ছিলো আল্লাহর দ্বীনের পথ রুদ্ধ করা- -একজন নিষ্পাপ নারীর উপর অভিযোগ উত্থাপন করা মূলতঃ
উদ্দেশ্য ছিলো না ।
তাদের ইচ্ছাকৃত অপরাধের দুঃসাহস এতদূর বেড়ে গিয়েছিলো যে, রাসূলকে তারা রাসূল জানতো। এরপর তাকে হত্যা করার পদক্ষেপ গ্রহণ করতো। এরপর আবার গৌরবের সাথে আস্ফালন করতো—আমরা আল্লাহর রাসূলকে হত্যা করেছি। হযরত ঈসা মসিহ আলাইহিস সালামের নবুয়াতের ব্যাপারে ইহুদী জাতির মধ্যে আসলেই কোনো সন্দেহ ছিলো না। তাঁর নবুয়াতের ব্যাপারে তারা যে স্পষ্ট দলিল পেয়েছে ও দেখেছে, তাতে হযরত ঈসা আলাইহিস সালাম যে আল্লাহর প্রেরিত রাসূল, এ ঘটনা একবারেই সন্দেহমুক্ত হয়ে গিয়েছিলো। তাই ইহুদীরা যা তাঁর সাথে করেছে, ভুল বুঝাবুঝির কারণে করেনি। বরং তারা ভালভাবেই জানতো যে, তারা এ অপরাধ ঐ ব্যক্তির সাথে করছে যিনি আল্লাহ তাআলার তরফ থেকে নবী হয়ে এসেছেন।
কোনো জাতি কোনো ব্যক্তিকে নবী হিসাবে জেনে মেনে আবার তাকে হত্যা করে ফেলা তো দৃশ্যত খুবই আশ্চর্য ব্যাপার। কিন্তু যে জাতি অবনতি ও ধ্বংসের শেষ সীমায় পৌঁছে যায় তাদের কাজ ও আচার আচরণের কোনো যুক্তিসঙ্গত কারণ থাকে না। তারা এমন কোনো লোককে সহ্য করতে পারে না যারা তাদের অপরাধের চিত্র তুলে ধরে। তাদেরকে অবৈধ কাজ থেকে ফিরিয়ে রাখে। এ ধরনের লোক নবী হলেও সবসময় ভ্রষ্ট জাতির লোকেরা এদেরকে জেলে পুরে ও হত্যার শাস্তি দেয় ।
তালমুদে বর্ণিত হয়েছে। বাদশা বুখতে নসর বায়তুল মোকাদ্দাস জয় করার পর হায়কেলে সুলাইমানীর মধ্যে প্রবেশ করে চারিদিক দেখতে লাগলেন । সেখানে ভ্রমণের সময় তিনি কোরবানী গাহের একেবারেই সামনে একটি জায়গায় দেয়ালের মধ্যে একটি তীরের নিশান দেখতে পেলেন। তিনি ইহুদীদেরকে এটা কিসের নিশান জিজ্ঞেস করলে তারা বললো – “এখানে জাকারিয়া নবীকে আমরা হত্যা করেছি। খারাপ কাজের ব্যাপারে আমাদেরকে জাকারিয়া ভর্ৎসনা করতো। অবশেষে আমরা অতীষ্ট হয়ে তাকে মেরে ফেলেছি।'
ইহুদী জাতির বেঈমানী ও বিশ্বাসঘাতকতার এসব রেকর্ড দেখার পর এটা কোনো বিস্ময়ের ব্যাপার নয় যে, তারা তাদের ধারণায় হযরত ঈসা মসিহকে শূলে চড়াবার পর বুকে হাত রেখে বলেছিলো – 'আমরা আল্লাহর রাসূলকে হত্যা করেছি।'
প্রকৃতপক্ষে তারা হযরত ঈসা মসিহকে হত্যা করতে পারেনি। এখানে আল্লাহর কুরআন বলছে, হযরত মসিহকে শূলে চড়াবার আগেই উঠিয়ে নেয়া হয়েছে। ইহুদী ও খৃস্টান উভয় জাতিই বিশ্বাস করছে যে, হযরত ঈসা মসিহ শূলে নিজের জীবন দিয়েছেন। কিন্তু এ বিশ্বাস তাদের ভুল ধারণার উপর ভিত্তি করে স্থাপিত হয়েছে। কুরআন ও বাইবেলের তুলনামূলক আলোচনা করলে একথা বুঝা যায়, “পিলাতুসের” আদালতে তো হযরত ঈসাকেই পেশ করা হয়েছিলো। কিন্তু যখন তাকে মৃত্যুদণ্ডের রায় শুনানো হলো এবং ইহুদীরা মসিহর মতো একজন মহাসম্মানী ও পবিত্র লোকের তুলনায় একজন ডাকুর জীবনকে বেশী মূল্যবান মনে করলো। তারা সত্যের সাথে শত্রুতা ও বাতিলকে ভালবাসার উপর তাদের সীল-মোহর লাগিয়ে দিলো তখন কোনো সময়ে সম্ভবত আল্লাহ তাআলা হযরত মসিহকে নিজের কাছে উঠিয়ে নিয়েছেন। পরে ইহুদীরা যে ব্যক্তিকে শূলে চড়িয়েছিলো তিনি হযরত ঈসা আলাইহিস সালাম ছিলেন না । বরং অন্য কেউ ছিলেন । যাকে কোনো অজানা কারণে ইহুদীরা ঈসা ইবনে মারইয়াম মনে করে নিয়েছিলো। এরপরও তাদের অপরাধ ওর চেয়ে কম ছিলো না। কারণ যাকে তারা কাঁটার তাজ পরিয়েছিলো। যার মুখে থু থু মেরেছে। যাকে লাঞ্ছনার সাথে শূলে চড়িয়েছে। তাকে তারা ঈসা ইবনে মারইয়ামই মনে করেছিলো। এখন আমাদের পক্ষে একথা জানার কোনো উপায় উপকরণ নেই যে, ব্যাপারটি কিভাবে সংশয়যুক্ত হয়ে গেলো । তাই শুধু আন্দাজ অনুমান ও ধারণার উপর ভিত্তি করে বলা যায় না যে, সন্দেহ সংশয় কেমন ছিলো যার ভিত্তিতে ইহুদীরা বুঝেছিলো তারা ঈসা ইবনে মারইয়ামকে শূলে দিয়েছিলো অথচ ঈসা ইবনে মারইয়াম তাদের হাত থেকে বের হয়ে গিয়েছিলেন ।
‘মতভেদকারী’ অর্থ হলো খৃস্টান। ঈসা আলাইহিস সালামের শূলে চড়ার ব্যাপারে তাদের মধ্যে ঐক্যবদ্ধ কোনো একক মত নেই। বরং বিশটি মত আছে। মতের এত আধিক্যই প্রমাণ করে, প্রকৃত ব্যাপারটি তাদের নিকট সন্দেহযুক্ত। এদের মধ্যে কেউ বলে শূলে যাকে চড়ানো হয়েছে তিনি মসিহ ছিলেন না। বরং মসিহ রূপে অন্য কেউ ছিলো। যাকে ইহুদী ও রোমক সৈনিকরা লাঞ্ছনার সাথে শূলে দিয়েছিলো। আর মসিহ আলাইহিস সালাম
ওখানেই কোনো জায়গায় দাঁড়িয়ে তাদের মূর্খতা ও আহম্মকী দেখে হাসছিলেন । কেউ বলে, শূলে মসিহকেই চড়ানো হয়েছিলো। কিন্তু তার মৃত্যু শূলে হয়নি। শূল থেকে নামাবার পরও তার দেহে জীবন ছিলো। আবার কেউ বলে তাঁর মৃত্যু শূলেই হয়েছিলো কিন্তু তারপর জীবিত হয়ে উঠেছিলেন। এরপর কম বেশ প্রায় দশবার তার বিভিন্ন সাথীর সাথে তিনি দেখা করেছেন ও কথাবার্তা বলেছেন। কেউ বলে, মসিহর দৈহিক মৃত্যু শূলেই হয়েছিলো । তাকে দাফনও করা হয়েছিলো কিন্তু আল্লাহ প্রদত্ত রূহ যা তার মধ্যে বাকী ছিলো তা উঠিয়ে নেয়া হয়েছে। আবার কেউ বলে, মৃত্যুর পরে মসিহ স্বশরীরে জীবিত হয়ে উঠেন এবং স্বশরীরেই তাকে উঠিয়ে নেয়া হয়। একথা স্পষ্ট যে, যদি তাদের কাছে প্রকৃত ঘটনা জানা থাকতো তাহলে এতো মতামত গজিয়ে উঠতো না ।
হযরত ঈসা আলাইহিস সালামের শূলে মৃত্যুর ব্যাপারে ওটাই সবচেয়ে প্রকৃত ও সত্য কথা যা আল্লাহ পাক বলেছেন । এতে মজবুত ও বিস্তৃতভাবে যে কথা বলা হয়েছে তাহলো, হযরত ঈসা আলাইহিস সালামকে হত্যা করার ব্যাপারে ইহুদীরা সফল হতে পারেনি। আর আল্লাহ তায়ালা তাঁকে নিজের কাছে উঠিয়ে নিয়ে গেছেন। এখন কিভাবে উঠিয়ে নিয়ে গেছেন, এ নিয়েই শুধু প্রশ্ন। এ বিষয় কুরআনে কোনো বিশদ আলোচনা নেই। কুরআন একথাও বলছেনা আল্লাহ তাকে স্বশরীরে রূহ সহ জমিন থেকে উঠিয়ে আসমানে কোথাও নিয়ে গেছেন। একথাও স্পষ্ট বলছে না যে, তিনি জমিনেই প্রাকৃতিক মৃত্যুবরণ করেছেন । শুধু রূহ আকাশে উঠিয়ে নিয়ে গেছেন। এ কারণে কুরআনের বুনিয়াদের উপর এসবের কোনো একটা দিক সম্পর্কে অকাট্যভাবে ‘হাঁ’ও বলা যায় না আবার 'না'ও বলা যায় না। কিন্তু কুরআনের বর্ণনা ভঙ্গি হতে স্পষ্টভাবে অনুভূত হয় যে, আকাশে উঠিয়ে নিবার ধরন ও প্রকৃতি যা-ই হোক সর্বাবস্থায় আল্লাহ পাক মসিহ আলাইহিস সালামের ব্যাপারে এ ধরনের কোনো একটা ঘটনা অবশ্যই ঘটিয়েছেন, যে ঘটনা অস্বাভাবিক ধরনেরই হবে। এ অস্বাভাবিকভাবে প্রকাশ তিনটি জিনিস দিয়ে হয় ।
এক ঃ খৃস্টানদের মধ্যে আগ থেকেই ঈসা মসিহ আলাইহিস সালামের দেহ রূহ সহ উঠিয়ে নিয়ে যাবার আকীদা বিদ্যমান ছিলো। অনেকেই ঈসা আলাইহিস সালামকে 'ইলাহ' মানতো তার অন্যান্য কারণের মধ্যে এটাও একটা কারণ ছিলো । কিন্তু এরপরও কুরআন সুস্পষ্টভাবে যে শুধু এর প্রতিবাদ করে তা নয় বরং অবিকল ওই উঠিয়ে নেয়া 'রফয়ে' (Ascension) শব্দ ব্যবহার করেছে যা খৃস্টানরা এ ঘটনা বুঝাবার জন্য ব্যবহার করে থাকে । কুরআনের মতো কিতাবে মবিনের শান এটা হতে পারে না যে, কুরআন কোন্ ধারণা বা মতের প্রতিবাদ করতে চায় এদিকে আবার তার জন্য এমন শব্দ ব্যবহার করবে যা ওই মত বা ধারণাকে আরো শক্তিশালী করবে।
দুই : হযরত ঈসা আলাইহিস সালামকে ‘উঠিয়ে নিয়ে’ যাবার ব্যাপারটি যদি প্রত্যেক মৃত ব্যক্তিকে উঠিয়ে নিয়ে যাবার মতো হতো অথবা এর অর্থ যদি কেবল সম্মান ও মর্যাদার ক্ষেত্রেই উন্নতি বিধান হতো—যেমন হযরত ইদ্রিস আলাইহিস সালাম সম্পর্কে বলা হয়েছে, “রাফানাহু মাকানান আলীয়্যা—তাকে উচ্চস্থানে তুলে নিয়েছি।” তাহলে কথাটি বলার ধরন কখনই এরূপ হতো না । বরং বলা যেতে পারতো, নিশ্চয় তারা হযরত ঈসা আলাইহিস সাল্লামকে হত্যা করেনি। বরং তাঁকে জীবন্ত উঠিয়ে নেয়া হয়েছে। তারপর তিনি স্বাভাবিক মৃত্যুবরণ করেছেন । ইহুদীগণ তাঁকে লাঞ্ছিত করতে চেয়েছিলো। কিন্তু আল্লাহ তাকে উচ্চ মর্যাদা দান করেছেন ।
তিন ঃ এ ‘উঠিয়ে নিয়ে যাওয়া' যদি সাধারণ উঠিয়ে নিয়ে যাওয়া হতো। যেমন আমরা প্রচলিত ভাষায় প্রত্যেক মৃত্যু ব্যক্তিকে বলে থাকি, ‘আল্লাহ অমুককে উঠিয়ে নিয়েছেন, তাহলে এরপর ‘আল্লাহ বড় শক্তিশালী ও বড় কৌশলী' একথা বলা একেবারেই বেমানান হয়ে যায়। একথা তো শুধু এমন কোনো ঘটনার পরই বলা মাননসই ও সমীচীন হয় যে, ঘটনার মধ্যে আল্লাহ তাআলার যবরদস্ত কুদরাতের অস্বাভাবিক বিকাশ ঘটে ।
এর উত্তরে কুরআন থেকে কোনো দলিল প্রমাণ পেশ করতে বেশী হলে শুধু সূরায়ে আলে ইমরানে ৬ রুকূ'র ৫৫ আয়াতে আল্লাহর ব্যবহৃত ‘মুতাওয়াফফিকা' শব্দটি পেশ করা যেতে পারে ৷
কিন্তু এ শব্দটি স্বাভাবিক মৃত্যুর ব্যাপারে ব্যবহৃত হয় না। এর দ্বারা ‘রূহকবজ দেহ ও প্রাণ, উভয়ই কবজ করা বুঝায়। কাজেই উপরে বর্ণিত কারণগুলোর বেকার ঘোষণা করার জন্য এটা যথেষ্ট নয়। কেউ কেউ হযরত ঈসা আলাইহিস সালামের স্বাভাবিক মৃত্যু ঘটেছে প্রমাণ করার জন্য বাড়াবাড়ি ও জেদ ধরতে গিয়ে প্রশ্ন করে, “তাওয়াফ্ফা' শব্দটি স্বশরীরে উঠিয়ে নিয়ে যাবার অর্থে ব্যবহৃত হবার আর কোনো দৃষ্টান্ত আছে কি ? কিন্তু ভেবে দেখার ব্যাপার হলো স্বশরীরে উঠিয়ে নেবার ঘটনাটি গোটা মানব জাতির ইতিহাসে যখন একবার মাত্র ঘটেছে, তখন এর আরো দৃষ্টান্ত খোঁজা একেবারেই অর্থহীন। লক্ষ করার ব্যাপার হলো মূল অভিধানের দৃষ্টিতে ওই অর্থে মুতাওয়াফফিকা শব্দ ব্যবহার করার সুযোগ আছে কিনা। যদি থাকে তাহলে বলতে হবে কুরআন পাক স্বশরীরে ‘উঠিয়ে নেবার' আকীদার বিরোধিতা না করে এ শব্দ ব্যবহার করে যেসব কারণে এ আকীদার সাহায্য হয় তার মধ্যে একটি কারণ যোগ করেছে। নতুবা মৃত্যুর জন্য ব্যবহৃত প্রচলিত শব্দ ব্যবহার না করে ‘ওফাতের' মতো দ্ব্যর্থবোধক শব্দ এখানে ব্যবহার কিছুতেই করা হতো না, যেখানে ‘স্বশরীরে উঠিয়ে নিয়ে যাবার আকীদা আগ থেকেই বিদ্যমান রয়েছে । যার কারণে হযরত ঈসার ‘ইলাহ' হবার ভ্রান্ত আকীদা জন্মেছিলো ।
এদিকে হযরত ঈসা বিন মারইয়াম আলাইহিস সালামের আবার দুনিয়ায় আগমন ও দাজ্জালের সাথে যুদ্ধ করা সম্পর্কে বহুসংখ্যক হাদীস স্পষ্টভাবে বর্ণনা করে । সেসব হাদীস তাঁর ‘স্বশরীরে উঠিয়ে নেবার, এ আকীদাকে আরো বেশী শক্তিশালী ও মজবুত করে তোলো। এসব হাদীস থেকে হযরত ঈসা আলাইহিস সালামের দ্বিতীয় আগমনের ব্যাপারটি অকাট্যভাবে প্রমাণিত হয় ।
এখন হযরত ঈসা বিন মারইয়াম আলাইহিস সালামের মৃত্যুর পর এ দুনিয়ায় আবার ফিরে আসা বেশী যুক্তিসংগত, না আল্লাহর জগতে কোথাও জীবিত থেকে ওখান হতে দ্বিতীয়বার দুনিয়ায় ফিরে আসা বেশী যুক্তিসঙ্গত তা প্রত্যেকেই চিন্তা করে দেখতে পারেন।
ইহুদী জাতি এভাবে কেবল নিজেরা আল্লাহর পথ থেকে বিরত থেকে ক্ষান্ত হয়নি বরং অন্যান্যদেরকেও আল্লাহর পথ থেকে বিরত রাখার চেষ্টা চালাচ্ছে। দুনিয়ার মানুষকে পথভ্রষ্ট ও গুমরাহ করার জন্য আজ পর্যন্ত যত আন্দোলন ও সংগ্রামই মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে তার প্রত্যেকটির পেছনেই এ অভিশপ্ত ইহুদী জাতির প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ মদদ কাজ করে আসছে। তারা মাথা খাটিয়ে, বুদ্ধি দিয়ে অর্থ লগ্নি করে, সুচিন্তিতভাবে পরিকল্পনা তৈরী করে ইসলাম ও মুসলিম দুশমনির পুঁজি জুগিয়ে যাচ্ছে ।
অপরদিকে সত্য পথের দিকে আহবান জানাবার তথা ইসলাম ও মুসলিম মিল্লাত প্রতিষ্ঠার যত আন্দোলন গড়ে উঠেছে তার প্রত্যেকটির সামনেই ইয়াহুদী জাতি বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। অথচ এ হতভাগ্য ও অভিশপ্ত ইহুদী জাতি আল্লাহর কিতাব ও নবীগণের উত্তরাধিকার ছিলো। এ জাতির প্রত্যক্ষ মদদেই দুনিয়ায় ইসলামকে নিঃশেষ করে ফেলার ও বিপর্যয় সৃষ্টি করার জন্য কমিউনিষ্ট বা সমাজতান্ত্রিক আন্দোলন গড়ে তুলেছিলো। তাদের নেতৃত্বেই এ আন্দোলন চারিদিকে ছড়িয়ে পড়েছিলো। দুনিয়ার ইতিহাসে সর্বপ্রথম আল্লাহকে অস্বীকার করা, আল্লাহর সাথে প্রকাশ্য শত্রুতা করা, আল্লাহর উপর ঈমান ভিত্তিক আদর্শ ইসলামকে ধ্বংস করার প্রকাশ্য সংকল্প নিয়ে যে আদর্শ ও রাষ্ট্র কায়েম হয়েছে তার উদ্যোক্তা ও প্রতিষ্ঠাতা হলো হযরত মূসা আলাইহিস সালামেরই উম্মতের একজন। কমিউনিজমের পরে আধুনিক বিশ্বের গোমরহীর সর্বশ্রেষ্ঠ স্তম্ভ ফ্ৰয়েডিয় দর্শন। আর এ দর্শনের প্রতিষ্ঠাতা ইহুদী বনী ইসরাঈল জাতিরই এক ব্যক্তি।-তাফহীমুল কুরআন
ইহুদীদের দূরভিসন্ধি বানচাল করে তাদের কবল থেকে হযরত ঈসা আলাইহিস সালামকে রক্ষা করা প্রসঙ্গে তফসীরে মাআরেফুল কুরআনে আছে :
আল্লাহ তাআলা হযরত ঈসা আলাইহিস সালামকে হিফাজত করা প্রসঙ্গে পাঁচটি প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। এর মধ্যে অন্যতম ওয়াদা ছিলো তাঁকে হত্যা করার কোনো সুযোগ ইহুদীদেরকে না দেয়া। বরং আল্লাহ তাঁকে নিজের কাছে তুলে নিবেন ।
সূরা নিসায় এ সংক্রান্ত এক আয়াতের ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে—আল্লাহর ওয়াদা বাস্তবায়নের কথা উল্লেখ করে হযরত ঈসা আলাইহিস সালামের হত্যা সংক্রান্ত ইহুদীদের মিথ্যা দাবী খণ্ডন করা হয়েছে। এখানে স্পষ্ট ঘোষণা করা হয়েছে যে, “ওয়ামা কাতালুহু' ওয়ামা সালাবুহু ওয়ালাকিন শুব্বিহা লাহুম” —ওরা হযরত ঈসাকে হত্যাও করতে পারেনি। শূলেও চড়াতে পারেনি। মূলত তারা সন্দেহে পতিত হয়েছিলো।
এখন প্রশ্ন হলো, সন্দেহ সৃষ্টি হলো কিভাবে ? কুরআনে বলা হয়েছে “ওয়ালাকিন শুব্বিহালাহুম”-তাদেরকে এক্ষেত্রে সন্দেহের মাঝে ফেলে দেয়া হয়েছিলো। এ ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে ইমাম যাহ্হাক রাহমাতুল্লাহ আলাইহি বলেন ইহুদীরা যখন হযরত ঈসা আলাইহিস সালামকে হত্যা করতে বদ্ধপরিকর হলো। তখন তাঁর ভক্তবৃন্দ একস্থানে সমবেত হলেন। হযরত ঈসাও তখন সেখানে উপস্থিত হলেন। শয়তান ইবলিস রক্ত পিপাসু ইহুদী ঘাতকদেরকে হযরত ঈসার অবস্থানের ঠিকানা জানিয়ে দিলো। চার হাজার ইহুদী দুরাচার একযোগে সেই অবস্থানের জায়গা অবরোধ করলো। হযরত ঈসা আলাইহিস সালাম তখন ভক্তবৃন্দকে বললেন, তোমাদের কেউ এ ঘর হতে বের হয়ে নিহত হওয়া এবং পরকালে বেহেশতে আমার সাথী হতে প্রস্তুত আছো কি ? জনৈক ভক্ত আত্মোৎসর্গের জন্য উঠে দাঁড়ালেন। হযরত ঈসা আলাইহিস সালাম নিজের জামা ও পাগড়ী তাঁকে পরিধান করালেন। অতপর তাঁকে ঈসা আলাইহিস সালামের সাদৃশ্য করে দেয়া হলো। যখন তিনি গৃহ থেকে বের হলেন। তখন ইহুদীরা তাকে ঈসা আলাইহিস সালাম মনে করে বন্দী করে নিয়ে শূলে চড়িয়ে হত্যা করলো। অপরদিকে হযরত ঈসা আলাইহিস সালামকে আল্লাহ তাআলা আসমানে তুলে নিলেন।-তাফসীরে কুরতবী
অন্য বর্ণনায় পাওয়া যায়, ইহুদীরা ‘তায়তালানুস' নামক জনৈক নরাধমকে সর্বপ্রথম হযরত ঈসা আলাইহিস সালামকে হত্যা করার জন্য পাঠিয়েছিলো। কিন্তু ইতিপূর্বে আল্লাহ তাআলা তাকে আসমানে তুলে নেয়ায় সে তাঁর নাগাল পেলো না। বরং ইতিমধ্যে তাঁর নিজের চেহারা হযরত ঈসা আলাইহিস সালামের মতো হয়ে গেলো। ব্যর্থ মনোরথ হয়ে সে যখন গৃহ থেকে বেরিয়ে এলো তখন অন্যান্য ইহুদীরা তাকেই ঈসা আলাইহিস সালাম মনে করে পাকড়াও করলো । শূলে চড়িয়ে তাকে হত্যা করলো ।-তাফসীর মাযহারী
এ দুটি বর্ণনার মধ্যে যে কোনোটিই সঠিক হতে পারে। কুরআনে করীম এ ব্যাপারে স্পষ্ট কিছু বলেনি। অতপর প্রকৃত ঘটনা কেবল আল্লাহই জানেন । অবশ্য এ বিষয়ে বিভিন্ন রেওয়ায়েতের সমন্বয় বুঝা যায় । প্রকৃত ঘটনা ইহুদী খৃস্টানদের অজ্ঞাত ছিলো। তারা চরম বিভ্রান্তির আবর্তে নিক্ষিপ্ত হয়ে শুধু অনুমান করে বিভিন্ন উক্তি ও দাবী করছিলো। ফলে উপস্থিত লোকদের মধ্যেই চরম মতভেদ ও বিভ্রান্তির সৃষ্টি হয়েছিলো। তাই কুরআনে ইরশাদ হয়েছে : "যারা ঈসা সম্পর্কে নানা মতভেদ করে নিশ্চয়ই এ ব্যাপারে তারা সন্দেহে পতিত হয়েছে। তাদের কাছে এ সম্পর্কে কোনো সত্য নির্ভর জ্ঞান নেই। তারা শুধু অনুমান করে কথা বলে। তারা যে হযরত ঈসাকে হত্যা করেনি একথা সুনিশ্চিত । বরং আল্লাহ তাআলা তাকে নিরাপদে নিজের কাছে তুলে নিয়েছেন।”
কোনো কোনো বর্ণনায় আছে, সম্বিত ফিরে পাবার পর কিছু লোক বললো, আমরা তো নিজেদের লোককেই হত্যা করে ফেলেছি। কারণ নিহত ব্যক্তির মুখমণ্ডল হযরত ঈসা আলাইহিস সালামের মতো হলেও তার অন্যান্য অঙ্গ প্রতঙ্গ ছিল অন্য রকম। তাছাড়া এ ব্যক্তি যদি ঈসা আলাইহিস সালাম হয় তবে আমাদের প্রেরিত লোকটি গেলো কোথায় ? আর এ ব্যক্তি আমাদের লোক হলে হযরত ঈসা আলাইহিস সালামই বা গেলো কোথায়
আল্লাহ পরাক্রমশালী ও বড় কৌশলী। ইহুদীরা হযরত ঈসা আলাইহিস সালামকে হত্যা করার যতো ষড়যন্ত্র ও চক্রান্তই করুক না কেনো। সর্ব শক্তিমান আল্লাহ তাআলা যখন তার হিফাজতের নিশ্চয়তা দিয়েছেন তখন তার অসীম কুদরাত ও অপার হিকমাতের সামনে ওদের চক্রান্তের কি মূল্য ? আল্লাহ তাআলা বড় প্রাজ্ঞ । তার প্রতিটি কাজের নিগূঢ় রহস্য বিদ্যমান রয়েছে। জড় পূজারী বস্তুবাদীরা যদি হযরত ঈসা আলাইহিস সালামকে স্বশরীরে আসমানে উঠিয়ে নিবার সত্যটুকু উপলব্ধি করতে না পারে তবে তা তাদের দুর্বলতার কারণ ।
এদের ব্যাপারেই আল্লাহ পাক বলেছেন :
قُلْ هَلْ أُنَبِّئُكُم بِشَرِ مَنْ ذلِكَ مَثْوبَةً عِنْدَ اللهِ ، مَن لَّعَنَهُ اللهُ وَغَضِبَ عَلَيْهِ وَجَعَلَ مِنْهُمُ القردَةَ وَالْخَنَازِيرَ وَعَبَدَ الطَّاغُوتَ ، أُولَئِكَ شَرٌّ مَّكَانًا وَأَضَلُّ عَنْ
:
“বলো আমি কি ওই লোকদেরকে চিহ্নিত করবো যাদের পরিণতি আল্লাহর কাছে এ ফাসিকদের পরিণতির চেয়ে নিকৃষ্ট। তারা, যাদের উপর আল্লাহ লা'নত করেছেন। যাদের উপর আল্লাহর গজব ভেঙ্গে পড়েছে। যাদের মধ্য হতে বানর আর শূকর বানানো হয়েছে। যারা তাগুতের বন্দেগী করেছে তাদের অবস্থা আরো বেশী খারাপ । তারা সত্যের রাজপথ থেকে বহুদূরে সরে পড়েছে।”-সূরা আল মায়েদা : ৬০
এখানে স্বয়ং ইহুদী জাতির দিকে সূক্ষ্ম ইঙ্গিত করা হয়েছে। তাদের ইতিহাস বলছে বারবার আল্লাহর গজব ও লা'নতের শিকার হয়েছে তারা। শনিবারে মাছ না ধরার আইন ভঙ্গ করার কারণে তাদের কাওমের বহু লোকের চেহারা বিকৃত হয়ে গেছে। এমন কি তারা অধঃপতনের এমন নীচ পর্যায়ে নেমে গেছে যে, তাদেরকে তাগুতের দাসত্ব পর্যন্ত করতে হয়েছে। মোটকথা তোমাদের নির্লজ্জতার ও অপরাধমূলক কাজকর্মের কি কোনো শেষ আছে ?
তোমরা নিজেরা ফাসেকী, শরীয়াত বিরোধী কার্যকলাপ ও চরম নৈতিক অধঃপতনের মধ্যে নিমজ্জিত আছো। আর যদি অন্য কোনো দল আল্লাহর উপর ঈমান এনে স্পষ্ট দ্বীনদারীর পথ অবলম্বন করে তাহলে তোমরা তার বিরোধিতায় উঠে পড়ে লেগে যাও ৷
এ ইহুদীদের ব্যাপারে কুরআনে আরো বলা হয়েছে :
وَستَلهُمْ عَنِ الْقَرْيَةِ الَّتِي كَانَتْ حَاضِرَةَ الْبَحْرِ إِذْ يَعِدُونَ فِي السَّبْتِ إِذْ
C
تَأْتِيهِمْ حِيتَانُهم يوم سَبْتِهِم سُرَّعًا ويوم لا يَسْبِتُونَ * لَا تَأْتِيهِمْ ، كَذلِكَ : نَبلُوهُم بِمَا كَانُوا يَفْسُقُونَ ٥ - الاعراف : ١٦٣
“তাদের কাছ থেকে ওই বস্তিবাসীদের অবস্থাও কিছু জিজ্ঞেস করো, যারা সমুদ্র তীরে বাস করতো। তাদের ঐ ঘটনা স্মরণ করিয়ে দাও যে, ওখানকার লোকেরা সাতের দিনে (শনিবার) আল্লাহর হুকুমের বিরোধিতা করছিলো। সাতের দিনেই সমুদ্রের মাছ লাফিয়ে লাফিয়ে পাড়ে তাদের সামনে এসে পড়তো। সাতের দিন ছাড়া অন্য কোনোদিন আসতো না । এটা হতো এজন্য যে, আমি এদের নাফরমানীর জন্য এদেরকে পরীক্ষায় ফেলেছিলাম।”-সূরা আল আরাফ : ১৬৩
বিশেষজ্ঞদের অধিকাংশের মতে বস্তিবাসীদের ওই স্থানটি ছিলো 'আয়লা’ ‘আয়লাত' বা ‘আয়লুত'। ইসরাঈলের ইহুদী রাষ্ট্র বর্তমানে এখানে এ নামে একটি বন্দর নির্মাণ করেছে। জর্দানের বিখ্যাত নদী বন্দর ‘আকাবা’ এর কাছেই রয়েছে। লোহিত সাগরের যে শাখাটি সিনাই উপদ্বীপের পূর্ব উপকূল ও আরবের পশ্চিম উপকূলের মাঝখানে একটি লম্বা উপসাগরের মতো দেখায় তার ঠিক শেষ মাথায় স্থানটি অবস্থিত। বনী ইসরাঈলের উত্থান যুগে এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ শাসন কেন্দ্র ছিলো। হযরত সুলাইমান আলাইহিস সালাম এ শহরেই তাঁর লোহিত সাগরের সামরিক বাণিজ্যিক নৌবহরের কেন্দ্র স্থাপন করেছিলেন ।
এখানে যে কথাটির দিকে ইঙ্গিত করা হয়েছে, ইহুদীদের পবিত্র গ্রন্থসমূহে তার কোনো উল্লেখ পাওয়া যায় না। এ প্রসঙ্গে তাদের ইতিহাসও খামুশ । কিন্তু কুরআন মজীদে যেভাবে এ ঘটনাটিকে এখানে ও সূরা আল বাকারায় বর্ণনা করা হয়েছে তা থেকে পরিষ্কার বুঝা যায়, কুরআন নাযিলের সময় বনী ইসরাঈলীরা সাধারণভাবে এ ঘটনাটি সম্পর্কে ভালোভাবেই অবগত ছিলো । এটি একটি প্রমাণিত সত্য যে, নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বিরোধিতার প্রশ্নে যেখানে মদীনার ইহুদীরা কোনো একটি সুযোগও হাতছাড়া
হতে দিতো না । সেখানে কুরআনের এ বর্ণনার বিরুদ্ধে তখন আদৌ কোনো আপত্তিই তোলেনি ।
‘সাবৃত্ত' অর্থ শনিবার। বনী ইসরাঈলদের জন্য এ সাতের দিনকে পবিত্র দিন গণ্য করা হয়েছিলো। মহান আল্লাহ এ দিনটিকে নিজের ও বনী ইসরাঈলীদের সন্তান সন্ততিদের মধ্যে সম্পাদিত একটি স্থায়ী অঙ্গীকার গণ্য করে জোর দিয়েছিলেন যে, এদিন কোনো জাগতিক কাজ করা যাবে না । ঘরে আগুন পর্যন্ত জ্বালানো যাবে না। গৃহপালিত পশু এমন কি চাকর-বাকর, দাস- দাসীদের সেবাও গ্রহণ করা যাবে না। যে ব্যক্তি এসব নিয়ম লংঘন করবে তাকে হত্যা করা হবে। কিন্তু কিছুদিন পরই ইহুদীরা এ আইন লংঘন করতে থাকে। ইয়ারমিয়াহ নবীর' যুগে লোকেরা খাস জেরুসালেমের প্রধান দরজাগুলো দিয়ে এ দিনে আসবাবপত্র নিয়ে চলাফেরা করতো। তাই ইয়ারমিয়াহ নবী ইহুদীদেরকে সতর্ক করে দিলেন। তিনি বললেন, তোমরা যদি এভাবে প্রকাশ্যে শরীয়াতের বরখেলাপ কাজ করো তাহলে জেরুসালেম আগুনে জ্বলে যাবে। এ নবীর কাল ছিলো খৃস্টপূর্ব ৬২৮ ও ৫৮৬ সালের মাঝামাঝি সময়। হযরত যিহিষ্কেল নবীও ইহুদীদের বিরুদ্ধে এই অভিযোগ করেছিলেন । শনিবারের হুকুম অমান্য করাকে ইহুদীদের একটি জঘন্য জাতীয় অপরাধ হিসাবে যিহিষ্কেল নবীর গ্রন্থে উল্লেখ করা হয়েছে। হযরত যিহিষ্কেল নবীর আমল ছিলো খৃস্টপূর্ব ৫৯৫ হতে ৫৩৬ সাল। এ ঘটনা থেকে বলা যেতে পরে যে, কুরআনেও যে “ইয়াওমুস সাবৃতের’ ব্যাপারে যে ঘটনাটির কথা বলা হয়েছে সম্ভবতঃ এটাও ওই একই কালের ঘটনা।
কোনো ব্যক্তি বা দলের মধ্যে পথভ্রষ্টতা ও নাফরমানী বাড়তে থাকলে তাকে আরো বেশী করে ভ্রান্ত পথে চলা ও নাফরমানী করার সুযোগ দিয়ে আল্লাহ তাআলা মানুষকে পরীক্ষা করে থাকেন। মানুষকে পরীক্ষা করার এটাও আল্লাহর একটা পদ্ধতি। এতে মানুষের মধ্যে যেসব কাজ করার ঝোঁকপ্রবণতা থাকে তা যেনো পরিপূর্ণভাবে বেরিয়ে যায়। যেসব অপরাধে মানুষ নিজেকে কলুষিত করতে চায় তা করার সুযোগ না পাবার জন্য যেনো তা হতে বিরত থেকে না যায়। ইহুদী জাতিকেও আল্লাহ তাআলা সকল প্রকার অপরাধ করার সুযোগ দিয়ে তাদের কালিমা লিপ্ত জীবনের সকল মুখোশ উন্মোচন করে দেন । আল্লাহ তাআলা ইহুদীদের ব্যাপারে আরো বলেছেন :
وَإِذْ قَالَتْ أُمَّةٌ مِّنْهُمْ لِمَ تَعِظُونَ قَوْمَا لان اللهُ مُهْلِكُهُمْ أَوْ مُعَذِّبُهُمْ عَذَابًا شَدِيدًا ، قَالُوا مَعْذِرَةٌ إِلى رَبِّكُمْ وَلَعَلَّهُمْ يَتَّقُونَه فَلَمَّا نَسُوا مَا ذَكَرُوا بِه
انْجَيْنَا الَّذِينَ يَنْهَونَ عَنِ السُّوءِ وَأَخَذْنَا الَّذِينَ ظَلَمُوا بِعَذَابٍ بَئِيسِ بِمَا كَانُوا
“তাদের একথাও স্মরণ করিয়ে দাও, যখন এক শ্রেণী অপর শ্রেণীকে বলছিলো, তোমরা এমন লোকদেরকে কেনো নসিহত করছো যাদেরকে আল্লাহ ধ্বংস করবেন অথবা কঠিন শাস্তি দেবেন। তখন তারা বললো, আমরা এসব করছি তোমার রবের দরবারে নিজেদের ওজর পেশ করার জন্য এবং করছি এ আশায় যে, সম্ভবত তারা নাফরমানী হতে বিরত থাকবে। পরিশেষে তারা যখনই এ হিদায়াতকে ভুলে গেলো যা তাদেরকে স্মরণ করিয়ে দেয়া হয়েছিলো, তখন আমি ওই লোকদেরকে বাঁচিয়ে দিলাম, যারা খারাপ কাজ হতে ফিরিয়ে রাখতো। বাকী সব লোক যারা দোষী তাদের নাফরমানীর জন্য আমি তাদেরকে কঠিন শাস্তি দিলাম ।”
-সূরা আল আরাফ : ১৬৪-১৬৫
এখানে ইহুদী জাতির দুষ্কৃতকারী অসৎ লোকদের শাস্তি ও অশুভ পরিণাম সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। তাদের উপর পৃথিবীতে আরোপিত দু'রকম শাস্তির বর্ণনা দেয়া হয়েছে। প্রথমত, কিয়ামত পর্যন্ত আল্লাহ তাআলা তাদের উপর এমন কোনো ব্যক্তিকে চাপিয়ে দেবেন, যে তাদেরকে কঠিন শাস্তি দিতে থাকবে। অপমান ও লাঞ্ছনায় ডুবিয়ে রাখবে। প্রথম থেকে আজ পর্যন্ত ইহুদীরা সবসময়ই সব জায়াগায় ঘৃণিত, পরাজিত ও পরাধীন হয়ে রয়েছে।
সাম্প্রতিক কালে ইহুদীরা ইসরাঈলে একটি রাষ্ট্র গঠন করে একটি নিজস্ব ভূখণ্ড বানিয়ে নিয়েছে। এতে তাদের আজন্ম ইতিহাসের শ্রেষ্ঠ অভাব একটি দেশ পেয়ে গেছে বলে অনেকের ধারণা। কিন্তু এ ধারণা ঠিক নয়। প্রকৃতপক্ষে আজও ইহুদীদের না আছে কোনো ক্ষমতা, আর না আছে কোনো রাষ্ট্র। ইসরাঈলী রাষ্ট্রের সৃষ্টি হলো আমেরিকা, রাশিয়া, গ্রেট বৃটেন সহ মুসলমানদের অন্যান্য শত্রুদের ইসলাম বৈরিতার ফলমাত্র। ইসরাঈল রাষ্ট্র তাদের রাজনৈতিক ও আধিপত্য বিস্তারের একটি ঘাঁটি মাত্র। ইসরাঈলী রাষ্ট্রের এরচেয়ে বেশী কোনো গুরুত্ব নেই । ইহুদীরা এখনো তাদেরই অধীন ও আজ্ঞাবহ দাস। এসব শক্তি চিরদিন এত শক্তিশালী থাকবে না। তাদের মদদ যোগান শেষ হলেই ইসরাইলী রাষ্ট্রের অস্তিত্ব বিশ্বের পাতা থেকে মুছে যেতে বাধ্য। এটা তাদের বিধিলিপি । আল্লাহর তরফ থেকে তাদের কপালের লিখন ।
অভিশপ্ত ইহুদী জাতির দ্বিতীয় শাস্তি হলো, তাদেরকে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বিক্ষিপ্ত বিচ্ছিন্ন করে দেয়া। তাদের ছড়িয়ে ছিটিয়ে রাখা। কোনো
সময়েই কোনো একটি দেশে, কোনো নির্দিষ্ট স্থানে সমবেত হয়ে বসবাস করার সুযোগ তাদের কোনোদিন হয়নি। কোনো এক স্থানে সমবেতভাবে জীবন যাপন ও সংখ্যা গরিষ্ঠতা লাভ করা একটি জাতির জন্য আল্লাহ তাআলার বড়ো নিয়ামাত । আর কোনো জাতির বিভিন্ন স্থানে বিক্ষিপ্তভাবে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা আল্লাহ তাআলার তরফ থেকে দেয়া একটি আযাব ও গযব। এ নিয়ামাত মুসলমানদের প্রতি সবসময়ই ছিলো। থাকবেও কিয়ামত পর্যন্ত ইনশাআল্লাহ । মুসলমানরা যেখানেই গেছে সেখানেই আল্লাহর রহমতে তাদের একটা পূর্ণ জনবসতি গড়ে উঠেছে। রাষ্ট্র ব্যবস্থা কায়েম হয়েছে। তাদের সমবেত শক্তি সৃষ্টি হয়েছে ।
সর্বশেষ রাসূল মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাল থেকে যদি ধরা হয় তাহলেও মুসলমানদের ইতিহাসে এ বৈশিষ্ট্য নিখুঁতভাবে দেখতে পাওয়া যাবে। হিজরাতের মাধ্যমে মদীনা থেকে এ ধারা শুরু হয় । প্রাচ্যে ও পাশ্চাত্যে মুসলিমবসতি ধীরে ধীরে মজবুত রাষ্ট্রীয় শক্তিতে পরিণত হয়। পাকিস্তান, আফগানিস্তান ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, বাংলাদেশ আজকের সুপরিচিতি বসনিয়া হার্জেগোভিনা, চেচনিয়া সহ অসংখ্য মুসলিম অধ্যুষিত এলাকা এক সংঘবদ্ধ জনবসতি হিসাবে গড়ে উঠে শক্তিশালী রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে। এভাবে আরো হতে থাকবে। কিন্তু ইহুদী জাতি এ মধুর স্বাদ আস্বাদন থেকে চিরদিনের জন্য বঞ্চিত। যতো ধনী ও সম্পদশালীই তারা হোক না কেনো, সবসময়ই তারা বিভিন্ন দেশে বিক্ষিপ্ত হয়ে রয়েছে। কখনো কোনো দেশে তারা শাসন ক্ষমতা হাতে পায়নি। পরগাছা পরজীবী হয়েই তাদেরকে থাকতে হয়েছে ৷
ফিলিস্তিনের একটি অংশে কয়েক বছর থেকে তাদের সমবেত হওয়া ও কৃত্রিম ক্ষমতা পাওয়া এবং একটি রাষ্ট্র গঠন করা স্থায়ী কোনো জিনিস নয় । শেষ দিকে ফিলিস্তিনে তাদের সমবেত হওয়াটি ছিলো অপরিহার্য। কারণ শেষ নবীর আগাম বাণী অনুযায়ী কিয়ামতের কাছাকাছি সময়ে তাই হবে। শেষ যামানায় হযরত ঈসা আলাইহিস সালাম সর্বকালের অভিশপ্ত ইহুদী জাতির সাথে লড়াই করবেন। তাদেরকে পরাজিত ও নিঃশেষ করে দেবেন। ইহুদীদেরকে আল্লাহ তাআলা প্রাকৃতিকভাবে এক জায়াগায় সমবেত করাবেন । তারা পায়ে হেঁটে হেঁটে বধ্যভূমিতে গিয়ে হাজির হবে ।
হযরত ঈসা আলাইহিস সালামের আগমন ঘটবে সিরিয়ার দামেশকে। ইহুদীদের সাথে ঈসা আলাইহিস সালামের যুদ্ধও সংঘটিত হবে সেখানে । হযরত ঈসার জন্য এ লড়াই সহজ সাধ্য করার জন্যই তাদেরকে ফিলিস্তিনের এ অংশে তাদের বধ্যভূমিতে এনে সমবেত করেছেন। কাজেই তাদের এ এক জায়গায় একত্রিত হওয়াটাও বর্ণিত ও উল্লেখিত আযাবের বিপরিত কিছু নয় । সুখের তো কিছু নয়ই। আল্লাহ তার পরিকল্পনা অনুযায়ীই কাজ করে যাচ্ছেন । সসীম জ্ঞানের মানুষ অসীমের কি বুঝবে ?
দৃশ্যতঃ এখন ইসরাঈলী রাষ্ট্র ও এর বর্তমান ক্ষমতা নিয়ে মানুষের মনে প্রশ্ন উঠে । বিশ্ব রাজনীতির উপরে যাদের ধারণা আছে তারা এতে ধোঁকা খাবে না। যে এলাকাটি এখন ইহুদী রাষ্ট্র – ‘ইসরাঈল' নামক এ স্থানটি- প্রকৃতপক্ষে রাশিয়া, আমেরিকা ও গ্রেট বৃটেনের একটা যৌথ সামরিক ছাউনির বেশী কিছু নয়। তাদের সাহয্যে বেঁচে আছে ইসরাঈলী রাষ্ট্রের জীবন। এ অবস্থা স্থায়ী থাকবে না। রাশিয়া শেষ। বাকীগুলোও ধ্বংস হবে আল্লাহর পরিকল্পনা অনুযায়ী। কুরআন কিয়ামাত পর্যন্ত তাদের যে লাঞ্ছনা গঞ্জনা ও শাস্তির কথা বলছে তা আজও অব্যাহত গতিতে চলছে। তাদেরকে কিয়ামত পর্যন্ত নিকৃষ্ট আযাবের স্বাদ আস্বাদন করাবেন আল্লাহ তাআলা । এ স্বাদ প্রথম আস্বাদন করেছে তারা হযরত সুলাইমান আলাইহিস সালামের হাতে। তারপর বুতে নসরের হাতে । অতপর শেষ নবী মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহর হাতে । ফারুকে আযম হযরত ওমর বেঈমান ও অভিশপ্ত জাতি ইহুদীদেরকে এক এক করে সব জায়গা থেকে চরম লাঞ্ছনা ও অবমাননার সাথে বহিষ্কার করেছেন।
অভিশপ্ত ইহুদী জাতির কর্মফলের কারণে তাদের লাঞ্ছনার আরো ইতিহাস বর্ণনা করতে গিয়ে কুরআন আবার বলছে :
فَلَمَّا عَتَوْا عَن مَّا نُهُوا عَنْهُ قُلْنَا لَهُمْ كُونُوا قِرَدَةً خَاسِئِينَ ٥
“তারপর যখন তারা পরিপূর্ণ বিদ্রোহের সাথে সেই কাজই করতে লাগলো যে কাজ করতে তাদেরকে নিষেধ করা হয়েছিলো। তখন আমি বললাম, তোমরা চরম লাঞ্ছিত ও ঘৃণিত বানর হয়ে যাও।”-সূরা আরাফ : ১৬৬
বনী ইসরাঈলদের জন্য শনিবার ছিলো পবিত্র দিন। এটাকেই সাত বলা হয়। এদিন ছিলো তাদের সাপ্তাহিক উপাসনার জন্য নির্দিষ্ট দিন। এদিন মাছ শিকার করা সহ সব ছিলো নিষিদ্ধ। ইহুদীরা সাগর উপকূলের অধিবাসী ছিলো। তাই মাছ শিকার ছিলো তদের সখের কাজ। তারা নিষেধ অমান্য করেই শনিবারে বিভিন্ন কৌশলে মাছ শিকার করে। আল্লাহর সাথে নাফরমানী করার জন্য আযাব হিসাবে আল্লাহর হুকুমে তাদের ‘চেহারা বিকৃতি' ঘটে। তিনদিন পর তাদের সবাই মৃত্যুমুখে পতিত হয় ।
তাফসীরে কুরতুবীতে এ ঘটনাটি এভাবে বর্ণিত হয়েছে। ইহুদীরা প্রথম বিভিন্ন কলা-কৌশলের মাধ্যমে শনিবারে মাছ না ধরার হুকুম লংঘন করে।
পরে প্রকাশ্যভাবেই এ আইন অমান্য করে মাছ ধরা শুরু করে। এতে তারা দুই দলে ভাগ হয়ে যায়। একদল ছিলো নেক ও বিজ্ঞ। তারা এ অপকর্মে বাধা দিলো। দ্বিতীয় দল তা মানলো না। অবশেষে প্রথম দল দ্বিতীয় দলের সাথে সব সম্পর্ক ছিন্ন করলো। এমন কি বাসস্থানও পৃথক করে নিলো। একদিন প্রথম দল দ্বিতীয় দলের আবাস স্থলে খুব নিরবতা লক্ষ্য করলো। ব্যাপারটি বুঝার জন্য ওখানে গিয়ে দেখলো দ্বিতীয় দলের সকলে বিকৃত হয়ে গেছে। হযরত কাতাদাহ বলেন, তাদের যুবকরা বানরে ও বৃদ্ধরা শূকরে পরিণত হয়ে গিয়েছিলো। রূপান্তরিত বানররা নিজ নিজ আত্মীয় স্বজনকে চিনতো। তাদের কাছে এসে অঝোরে চোখের পানি ফেলতো ।
ইহুদী জাতির বানর হয়ে যাবার ব্যাপারে মতভেদ আছে। কেউ বলেন, তাদের শারীরিক গঠনই বদলিয়ে গিয়ে তারা বানর হয়ে গিয়েছিলো। আবার কেউ বলেন, তাদের স্বভাব-প্রকৃতি বানরের মতো হয়ে গিয়েছিলো । কিন্তু কুরআনের শব্দ ও বর্ণনা ভঙ্গি হতে বুঝা যাচ্ছে তাদের শারীরিক পরিবর্তন সংঘটিত হয়েছিলো। তাদের দুঃখ সুখবোধ ও জ্ঞান আগের মতোই ছিলো। শুধু পরিবর্তন ঘটেছিলো শরীরে।-তাফহীমুল কুরআন
لُعِنَ الَّذِينَ كَفَرُوا مِنْ بَنِي إِسْرَاءِ يْلَ عَلَى لِسَانِ دَاوُدَ وَعِيسَى ابْنِ مَرْيَمَ -
ذلِكَ بِمَا عَصَوْا وَكَانُوا يَعْتَدُونَ - كَانُوا لاَيَتَنَاهَوْنَ عَنْ مُّنْكَرٍ فَعَلُوهُ ، لَبِئْسَ مَا
L
“বনী ইসরাঈলদের যেসব লোক কুফরীর পথ অবলম্বন করেছিলো তাদের উপর দাউদ ও ঈসা ইবনে মারইয়ামের ভাষায় অভিসম্পাত করা হয়েছে। কেনোনা তারা বিদ্রোহী হয়ে গিয়েছিলো এবং বেশী বাড়াবাড়ী শুরু করে দিয়েছিলো। তারা একে অপরকে খারাপ কাজ হতে বিরত থাকার কথা বলা ছেড়ে দিয়েছিলো । তাদের অবলম্বিত কর্মপন্থা ছিলো খুবই খারাপ । ”
-সূরা আল মায়েদা : ৭৮-৭৯
প্রত্যেক জাতির বিকৃতি শুরু হয় প্রথম গুটি কয়েক ব্যক্তি থেকে । জাতির সামগ্রিক বিবেক সজাগ থাকলে বিপথগামী গুটি কয়েক মানুষকে তারা দমিয়ে রাখে। জাতি বিকৃতির হাত থেকে রক্ষা পায়। জাতি যদি ওই বিপথগামী গুটি কয়েক ব্যক্তির প্রতি উদাসিন থাকে, তাদেরকে বিপথে চলার ব্যাপারে নিষেধ না করে ও বাধা না দেয় । স্বাধীনভাবে কাজ করার জন্য ছেড়ে দেয় তাহলে এ বিপথগামী লোকের সংখ্যা ধীরে ধীরে বাড়তে শুরু করে। একদিন এ বিকৃতি সমগ্র জাতির মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে। এ বিকৃতির পথ রোধ করা অবশেষে অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায় ৷
বনী ইসরাঈল জাতির বিকৃতি ও দুষ্কৃতি এভাবেই বিস্তৃতি লাভ করেছে। নবী-রাসূলদের কথা তারা শুনেনি, মানেনি। জাতির জাগ্রত বিবেকরাও তাদেরকে বাধা দিয়ে রুখতে পারেনি। তাই হযরত দাউদ আলাইহিস সালাম ও হযরত ঈসা আলাইহিস সালাম ইহুদী বনী ইসরাঈলদের উপর অভিসম্পাত ও লা'নত বর্ষণ করেছেন। কুরআনে এখানে একথারই উল্লেখ করা হয়েছে।
তাফসীরে মাআরেফুল কুরআনে বাড়াবাড়ি ও ত্রুটিজনিত পথ ভ্রষ্টতায় লিপ্ত বনী ইসরাঈলের খারাপ পরিণতি সম্পর্কে বর্ণনা করে বলা হয়েছে যে, তাদের উপর আল্লাহর অভিসম্পাত বর্ষিত হয়েছে। প্রথমত : হযরত দাউদ আলাইহিস সালাম ইহুদী গোষ্ঠীর উপর অভিসম্পাত বর্ষণ করেন। ফলে বনী ইসরাঈলীদের আকার-আকৃতি বিকৃত হয়ে শূকরে পরিণত হয়ে যায়। এরপর দ্বিতীয়বার হযরত ঈসা আলাইহিস সালাম ইহুদী গোষ্ঠীর উপর অভিসম্পাত বর্ষণ করেন । এ অভিসম্পাতে তারা বিকৃত হয়ে বানরে রূপান্তরিত হয়। তবে বনী ইসরাঈলীদের উপর অভিসম্পাত বর্ষণের পালা শুরু হয়েছে তারও আগে হযরত মূসা আলাইহিস সালাম থেকে। শেষ হয়েছে শেষ নবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মুখে। তবে তাওহীদ বাদী মুসলিম জাতির উপর তাদের যে নির্যাতন এবং মুসলিম জাতি সত্তার বিরুদ্ধে ইহুদীদের যে হীন চক্রান্ত, বিদ্বেষ ও ষড়যন্ত্র তা ভাষায় লিখা যায় না। মুসলিম বিশ্ব বিশেষ করে ফিলিস্তিনে তাদের নির্যাতনে নারী পুরুষ, আবালবৃদ্ধবণিতা ও অবোধ শিশুর চোখের পানি ও মনের আহাজারীতে তাদের উপর আল্লাহর লা'নত ও অভিসম্পাত বর্ষিত হবেই ।
اهْبِطُوا مِصْرًا فَإِنَّ لَكُمْ ما سَأَلْتُمْ ، وَضُرِبَتْ عَلَيْهِمُ الذِلَّةُ وَالْمَسْكَنَةُ ، وَبَاءو ق بِغَضَبٍ مِّنَ اللهِ ، ذَلِكَ بِأَنَّهُمْ كَانُوا يَكْفُرُونَ بِايْتِ اللَّهِ وَيَقْتُلُونَ النَّبِيِّنَ بِغَيرِ الْحَقِّ ، ذلِكَ بِمَا عَصَوْا وَكَانُوا يَعْتَدُونَ ٥ - البقرة : ٦١
“অবশেষে অবস্থা এমন পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছলো যে, লাঞ্ছনা-গঞ্জনা, অপমান-অধঃপতন ও দুরবস্থা তাদেরকে পেয়ে বসলো এবং আল্লাহর গজব তাদেরকে ঘিরে ফেললো । আল্লাহর সাথে তাদের কুফরী করার, নবীদেরকে অন্যায়ভাবে হত্যা করার ফলেই এসব ঘটেছে। এসব ছিলো তাদের

FOR MORE CLICK HERE
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস মাদার্স পাবলিকেশন্স
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস ১ম পর্ব
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস
আমেরিকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস
বাংলাদেশের ইতিহাস মধ্যযুগ
ভারতে মুসলমানদের ইতিহাস
মুঘল রাজবংশের ইতিহাস
সমাজবিজ্ঞান পরিচিতি
ভূগোল ও পরিবেশ পরিচিতি
অনার্স রাষ্ট্রবিজ্ঞান প্রথম বর্ষ
পৌরনীতি ও সুশাসন
অর্থনীতি
অনার্স ইসলামিক স্টাডিজ প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত
অনার্স দর্শন পরিচিতি প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত

Copyright © Quality Can Do Soft.
Designed and developed by Sohel Rana, Assistant Professor, Kumudini Government College, Tangail. Email: [email protected]