ঈমানের গুরুত্বও তাৎপর্য স¤পর্কে ঈমান ও ইসলামের মধ্যে স¤পর্ক ও পার্থক্য নিরূপণ করুন।

 ঈমানের গুরুত্বও তাৎপর্য বর্ণনা করতে পারবেন।
عن عمربن الخطاب رضى اللھ عنھ قال: بینما نحن عند رسول اللھ صلى اللھ
علیھ و سلم ذات یوم اذ طلع علینا رجل شدید بیاض الثیاب شدید سواد الشعر
لایرى علیھ اثر السفر ولا یعرفھ منا احد حتى جلس الى النبى صلى اللھ علیھ
وسلم فاسند ركبتیھ الى ركبتیھ و وضع كفیھ على فخذیھ .
و قال: یا محمد! اخبرنى عن الاسلام. قال: الاسلام ان تشھد ان لا الھ الا اللھ
و ان محمدا رسول اللھ و تقیم الصلوة و تؤتى الزكوة و تصوم رمضان و
تحج البیت ان استطعت الیھ سبیلا. قال : صدقت فعجبنا لھ یسألھ و یصدقھ.
قال: فاخبرنى عن الایمان. قال ان تؤمن باللھ و ملائكتھ و كتبھ و رسلھ و
الیوم الآخر و تؤمن بالقدر خیره و شره قال صدقت .
قال: فأخبرنى عن الاحسان قال: ان تعبد اللھ كأنك تراه فان لم تكن تراه فانھ
یراك قال: فاخبرنى عن الساعة. قال: ما المسئول عنھا بأعلم من السائل. قال:
فاخبرنى عن امارتھا. قال: ان تلد الامة ربتھا و ان تراى الحفاة العراة العالة
رعاء الشاء یتطاولون فى البنیان قال ثم انطلق فلبثت ملیا ثم قال لي: یا عمر
أتدري من السائل؟ قلت: اللھ ورسولھ أعلم. قال: فانھ جبرائیل اتاكم یعلمكم
دینكم. رواه مسلم و رواه ابو ھریرة مع اختلاف و فیھ: و اذا رایت الحفاة
العراة الصم البكم ملوك الارض: فى خمس لا یعلمھن الا اللھ. ثم قرأ: ان اللھ
عنده علم الساعة و ینزل الغیث (الایة). (متفق علیھ)
হযরত উমর ইবনুল খাত্তাব (রা) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন- একদা আমরা রাসূলুল্লাহ (সা)-এর কাছে উপস্থিত
ছিলাম। এমন সময় এক আগন্তুক এসে উপস্থিত হলেন। তাঁর পোশাক-পরিচ্ছদ ছিল ধবধবে সাদা, মাথার চুল কুচকুচে
কালো, তাঁর মধ্যে ভ্রমণের কোন আলামত দেখা যায়নি। আর আমাদের মধ্যে কেউ তাঁকে চিনতেও পারছিল না।
অবশেষে, আগন্তুক রাসূল (সা)-এর অত্যন্তনিকটে এসে বসলেন এবং রাসূল (সা)-এর হাঁটুদ্বয়ের সাথে স্বীয় হাঁটুদ্বয়
মিলিয়ে স্বীয় হস্তদ্বয় রাসূল (সা)-এর দু’রানের উপর বা আপন রানের উপর রাখলেন।
অতঃপর তিনি বললেন- হে মুহাম্মদ (সা)! আমাকে ইসলাম সম্পর্কে অবহিত করুন। তখন রাসূল (সা) বললেনইসলাম হলো, তুমি একথার সাক্ষ্য প্রদান করবে যে, আল্লাহ ব্যতীত কোন উপাস্য নেই এবং হযরত মুহাম্মাদ (সা)
তাঁরই প্রেরিত রাসূল। আর সালাত প্রতিষ্ঠা করবে, যাকাত আদায় করবে, রামাদানে সিয়াম সাধনা করবে, সামর্থ্য
থাকলে হজ্জ পালন করবে।
প্রশ্নকারী রাসূল (সা)-এর উত্তর শ্রবণান্তেবললেন- আপনি সত্যিই বলেছেন। বর্ণনাকারী উমর ইবনুল খাত্তাব বলেনআমরা প্রশ্নকারীর প্রশ্নোত্তরের ধরন দেখে বিস্মিত হলাম যে, তিনি নিজেই প্রশ্নকারী এবং নিজেই উত্তরের
সত্যায়নকারী। লোকটি পূনরায় জিজ্ঞেস করলেন, আমাকে ঈমান সম্পর্কে অবহিত করুন। তখন রাসূল (সা) বললেনঈমান হচ্ছে- আল্লাহ, তাঁর ফেরেশতাকুল, কিতাবসমূহ, রাসূলগণ ও পরকালের প্রতি বিশ্বাস। ভাগ্যের প্রতি এভাবে
বিশ্বাস স্থাপন যে, ভাল-মন্দ আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকেই হয়। রাসূল (সা)-এর উত্তর শ্রবণান্তেপ্রশ্নকারী বললেনআপনি সত্যিই বলেছেন।
অতঃপর তিনি বললেন- আমাকে ইহসান সম্পর্কে অবহিত করুন। রাসূল (সা) বললেন- ইহসান হচ্ছে- আল্লাহ
তাআলার ইবাদত এমনভাবে করা যে, যেন তুমি আল্লাহকে দেখছ। আর যদি তুমি দেখতে না পাও, তবে ধারণা
করবে আল্লাহ তোমাকে দেখছেন। অতঃপর তিনি বললেন- আমাকে কিয়ামত সম্পর্কে অবহিত করুন। তখন রাসূল
(সা) বললেন- যাকে প্রশ্ন করা হচ্ছে তিনি প্রশ্নকারীর চেয়ে বেশি অবগত নন।
অতঃপর তিনি বললেন- আমাকে কিয়ামতের নিদর্শন সম্পর্কে অবহিত করুন। তখন রাসূল (সা) বললেন- প্রথম
নিদর্শন হচ্ছে- দাসীগণ স্বীয় মনিবকে প্রসব করবে, আর তুমি দেখতে পাবে যে, যাদের পায়ে জুতা নেই, গায়ে বস্ত্র
নেই, যারা শূন্যহাত ও মেষ চালক তারা পরবর্তীকালে বড় বড় প্রাসাদ রচনা করছে এবং এ কাজে তারা পরস্পর
প্রতিযোগিতা করছে।
অতঃপর লোকটি প্রস্থান করলেন। আমরা বেশ কিছু সময় নিশ্চুপ হয়ে থাকলাম। অতঃপর রাসূল (সা) আমাকে লক্ষ্য
করে বললেন- হে উমর ! প্রশ্নকারী কে জান ? আমি বললাম, আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (সা)-ই ভাল জানেন। তখন
রাসূল (সা) বললেন- ইনি হযরত জিবরীল (আঃ), যিনি তোমাদেরকে দ্বীনের শিক্ষা প্রদানের জন্য আগমন
করেছিলেন। এ হাদীসখানা ইমাম মুসলিম (রঃ) বর্ণনা করেছেন।
এ হাদীসখানাই কিছু কম-বেশিসহ হযরত আবূ হুরাইরা (রা) বর্ণনা করেছেন। তাতে এ কথাগুলো রয়েছে- যখন
তোমরা খালি পা ও উলঙ্গ দেহবিশিষ্ট বধির ও বোবাদেরকে পৃথিবীর শাসক হিসেবে দেখবে। (আর একথাও রয়েছে)-
পাঁচটি বিষয়ের জ্ঞান আল্লাহ ছাড়া আর কারো কাছে নেই। অতঃপর নবী করীম (সা) কুরআনের আয়াত পাঠ করলেন-
ان اللھ عنده علم الساعة ......
কিয়ামত কখন হবে, সে জ্ঞান একমাত্র আল্লাহরই রয়েছে .....। (বুখারী ও মুসলিম হাদীসখানি বর্ণনা করেন)
ইসলামের মূল ভিত্তি
عن ابن عمر رضى اللھ عنھما قѧال : قѧال رسѧول اللѧھ صѧلى اللѧھ علیѧھ و سѧلم:
بنى الاسلام على خمس شھادة ان لا الѧھ الا اللѧھ و ان محمѧدا عبѧده و رسѧولھ و
اقام الصلوة و ایتاء الزكوة والحج و صوم رمضان. (متفق علیھ)
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উমর (রা) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলে করীম (সা) বলেছেন: ইসলাম পাঁচটি ভিত্তির
ওপর প্রতিষ্ঠিত। এ সাক্ষ্য দেয়া যে, আল্লাহ ছাড়া কোন মাবুদ নেই এবং হযরত মুহাম্মদ (সা) তাঁর বান্দা ও রাসূল;
সালাত কায়েম করা; যাকাত প্রদান করা; হজ্জ করা এবং রমযান মাসের সিয়াম পালন করা। [বুখারী ও মুসলিম এ
হাদীস বর্ণনায় ঐকমত্য পোষণ করেন]
ব্যাখ্যা
এ হাদীসে কোন ব্যক্তির ঈমান আনয়ন করার পর, সে যে সকল সমস্যার সম্মুখীন হয়, তার মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ হলো,
ইসলাম নামক প্রাসাদের ভিত্তি কিসের ওপর স্থাপিত হবে তার বর্ণনা পরিস্কারভাবে রয়েছে। যাতে কেউ বিভ্রান্তিথেকে
না পারে। হাদীসটিতে বলা হয়েছে যে, ইসলাম নামক প্রাসাদের ভিত্তি পাঁচটি স্তম্ভের ওপর প্রতিষ্ঠিত। স্তম্ভ পাঁচটি হচ্ছে১. কালেমা, ২. সালাত, ৩. যাকাত, ৪. সাওম ও ৫. হজ্জ।
অতএব কোন মুসলমানই এ পাঁচটি মৌলিক কাজ যথাযথরূপে সম্পন্ন করা সম্পর্কে বিন্দুমাত্র অবজ্ঞা বা অবহেলা করতে
পারে না। যদি করে, তবে সে ইসলামের মূলকেই অস্বীকার করে।
ইসলামের প্রথম কথা, আল্লাহর প্রভূত্ব ও সার্বভৌমত্ব জীবনের সর্বক্ষেত্রের জন্য স্বীকার করা এবং সে সাথে হযরত
মুহাম্মদ (সা)-এর সর্বশেষ নবুওয়াতের প্রতি ঈমান আনা ও তাঁর নিকট থেকে যে বিধি-বিধান পাওয়া গিয়েছে তা
সর্বতোভাবে স্বীকার করা এবং বাস্তব জীবনে প্রয়োগ করা।
একজন মানুষ যখন আল্লাহর প্রভুত্ব, সার্বভৌমত্ব ও হযরত মুহাম্মদ (সা)-এর নবুওয়াতকে স্বীকার করে নেয় তখন
সর্বপ্রথম দিনরাত ২৪ ঘণ্টার মধ্যে তার ওপর পাঁচটি নির্দিষ্ট সময়ে পাঁচবার সালাত প্রতিষ্ঠা করার কর্তব্য আরোপিত
হয়।
হাদীসে সালাতের পরই যাকাতের উল্লেখ করা হয়েছে। এ থেকে সুস্পষ্টরূপে বুঝতে পারা যায় যে, ইসলামে সালাতের
পরই যাকাতের স্থান ও গুরুত্ব। বস্তুত আল-কুরআনে যে সকল স্থানে সালাতের উল্লেখ করা হয়েছে, প্রায় সেসব স্থানেই
সালাতের পরই যাকাতের উল্লেখ করা হয়েছে। কুরআনে স্পষ্ট ভাষায় বলা হয়েছে যে, যাকাত ফরয হওয়ার পর যে
ব্যক্তি তা সঠিকরূপে আদায় না করবে, সে আল্লাহর কাছে দোষী সাব্যস্থ হবে এবং মুসলিম সমাজে পূর্ণাঙ্গ ‘মুসলিম’
বলে গণ্য থেকে পারে না। যাকাত সম্পর্কে এ কথাও মনে রাখা আবশ্যক যে, ইসলামী রাষ্ট্রে যাকাত প্রদান করা কোন
ব্যক্তিগত ব্যাপার নয়, ব্যক্তিগতভাবে তা আদায় করলে চলবে না বরং ইসলামী রাষ্ট্রে যাকাত আদায় করতে হবে
বাইতুল মাল বা ইসলামী রাষ্ট্রের মাধ্যমে। ইসলামী সমাজে কোন মুসলিম যাকাত দিতে অস্বীকার করলে ইসলামী রাষ্ট্র
তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে বাধ্য।
বলাবাহুল্য, ইসলাম ব্যাপক অর্থবোধক শব্দ, তবে এর প্রধান অর্থ আনুগত্য ও আত্মসমর্পণ করা। আর একজন মানুষ
সাধারণত পাঁচটি প্রক্রিয়ায় এর বহিঃপ্রকাশ ঘটাতে পারে। যেমন১. মানুষ আল্লাহর আনুগত্যের বহিঃপ্রকাশ হয়তো মৌখিকভাবে করবে। আর তারই প্রতীক হলো কালেমা বা
তাওহীদ ও রিসালাতের সাক্ষ্য প্রদান করা।
২. অথবা সে তার আনুগত্যের বহিঃপ্রকাশ কাজের মাধ্যমে পেশ করবে। আর সে কাজ দৈহিক পরিশ্রমে সম্পন্ন
করতে পারে। এরই প্রতীক হল সালাত। অর্থাৎ সালাত হচ্ছে শারীরিক ইবাদত।
৩. কিংবা তা সে অর্থব্যয়ের মাধ্যমে সম্পন্ন করবে, আর এরই প্রতীক হচ্ছে যাকাত। তথা যাকাত হচ্ছে আর্থিক
ইবাদত।
৪. অথবা দৈহিক পরিশ্রম ও অর্থ ব্যয়ের সমন্বয়ে সম্পাদন করবে, আর এরই প্রতীক হল হজ্জ।
৫. কিংবা বান্দা তার আনুগত্য প্রকাশ করার জন্য কোন কাজ করা থেকে বিরত থাকবে। আর তারই প্রতীক হল
সাওম।
যেহেতু মানুষ আল্লাহর আনুগত্য এ পাঁচটি প্রধান উপায়েই কেবল পেশ করতে পারে, তাই এ পাঁচটি কাজকে আরকানে
ইসলাম হিসেবে নির্ধারণ করা হয়েছে। আর এর অর্থ এই নয় যে, ইসলাম শাব্দিক অর্থে এ পাঁচটি আরকানেই সীমিত।
বরং জীবনের সর্বক্ষেত্রে আল্লাহর আনুগত্যের নাম ইসলাম। এ পাঁচটি কাজ সম্পন্ন করলেই ইসলামের সমগ্র দায়িত্ব
পালন হয়ে গেল এমনটি ধারণা করা ভুল হবে। সূতরাং আমাদের জন্য অপরিহার্য বিষয় হল আল্লাহর একত্ববাদ ও
সার্বভৌমত্ব এবং নবী মুহাম্মাদ (সা)-এর রিসালাতকে মেনে নিয়ে সালাত, যাকাত, হজ্জ, সাওম ইত্যাদি ইসলামের
আনুষ্ঠানিক ইবাদাতকে যথাযথভাবে সম্পাদন করার মাধ্যমে ইসলামের ভিত্তিকে সুদৃঢ় করা এবং এর ওপর ইসলামের
পূর্ণাঙ্গ জীবন-প্রাসাদ প্রতিষ্ঠা করার জন্য অবিশ্রান্তচেষ্টা সাধনা চালানো। তা হলে এ পাঁচটি ভিত্তি স্থায়ী হয়ে থাকবে
এবং ধীরে ধীরে ইসলামী সমাজ প্রতিষ্ঠায় সহায়ক হবে।
ঈমানের সর্বোচ্চ ও সর্বনি¤œশাখা
عن ابى ھریرة رضى اللھ عنھ قال: قال رسول اللھ صلى اللھ علیھ و سلم: الایمان
بضع و سبعون شعبة. فافضلھا قول لا الھ الا اللھ و ادناھا اماطة الاذى عن الطریق.
والحیاء شعبة من الایمان. (متفق علیھ)
হযরত আবূ হুরাইরা (রা) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলে করীম (সা) বলেছেন: ঈমানের সত্তরটিরও বেশি শাখাপ্রশাখা রয়েছে। তার মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ শাখা হচ্ছে, এ ঘোষণা দেয়া ھѧالل الا ھѧال لا) অর্থাৎ আল্লাহর একত্ববাদে
বিশ্বাসের সাক্ষ্য দান করা)। আর এর নি¤œতম শাখা হচ্ছে, পথের মধ্য থেকে কষ্টদায়ক জিনিসসমূহ দূর করা। আর
হায়া বা লজ্জা ঈমানেরই একটি গুরুত্বপূর্ণ শাখা বিশেষ। (বুখারী ও মুসলিম)
ব্যাখ্যা
হাদীসে মহানবী (সা) ঈমানের শাখা সত্তরটিরও বেশি বলে উল্লেখ করেছেন। এর অর্থ নির্দিষ্টভাবে এর সংখ্যা সত্তরটি
নয় যে, এর বেশি থেকে পারবে না ; বরং সত্তর কথাটি রূপক অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে, এর অর্থ অনেক। আরবি ভাষায়
অনেক ও বহু বোঝাবার জন্য সাধারণভাবেই ‘সত্তর’ সংখ্যাটি ব্যবহৃত হয়ে থাকে। আলোচ্য হাদীসে সত্তরটিরও বেশি
বলা হয়েছে আরো অধিক আরো বিপুল সংখ্যা বোঝাবার উদ্দেশে অর্থাৎ ঈমানের বহু ও অসংখ্য শাখা-প্রশাখা রয়েছে।
ঈমানের শাখা বলতে বোঝানো হয়েছে যে সকল কাজ-কর্ম, নৈতিক চরিত্র এবং বাহ্যিক ও অভ্যন্তরীণ অবস্থাকে, যা
কারো মনে ঈমান আসলে এর পরিণতি ও ফল হিসেবে তার মধ্যে সৃষ্টি হওয়া একান্তই আবশ্যক হয়ে পড়ে। যেমনশ্যামল-সবুজ-সতেজ বৃক্ষে ফুল ও ফল স্বাভাবিকভাবেই ধরে থাকে। এর অর্থ এই যে, সকল প্রকার ভাল কাজ, সৎ
চরিত্র ও পুণ্যময় পবিত্র ভাবধারা সবই ঈমানের শাখা-প্রশাখা বিশেষ। অবশ্য শ্রেণী-মর্যাদার দিক দিয়ে এর মধ্যে
পার্থক্য রয়েছে।
আলোচ্য হাদীসে কালেমা ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ অর্থাৎ আল্লাহর একত্বের সাক্ষ্যদানকে ঈমানের সর্বোচ্চ ও সর্বোন্নত
শাখা বলা হয়েছে এবং এর বিপরীতে নিæতম শ্রেণীর ঈমান হচ্ছে রাস্তাঘাট থেকে কষ্টদায়ক জিনিস দূরীভূত করা।
অর্থাৎ কেবল আল্লাহকে এক বলে স্বীকার করার নামই ঈমান নয়, বরং রাস্তাঘাট থেকে কষ্টদায়ক জিনিস দূর করাও
ঈমানের অংশ। এখানে ঈমানের দুটো প্রান্তিক অবস্থার উল্লেখ করা হয়েছে। এজন্যই দুই সীমান্তের মাঝখানে যত কিছু
ভাল কাজ ধারণ করা সম্ভব তা সবই ঈমানের বিভিন্ন বিভাগ ও শাখা-প্রশাখা মাত্র, তা আল্লাহর ‘হক’ সম্পর্কীয় কাজ
হোক আর বান্দাহর হক সম্পর্কীয় কাজ হোক ; এর কোন একটিও ঈমানের বাইরে নয়। আর এর সংখ্যা যে বহু ও
বিপুল হবে, তাতে আর সন্দেহ নেই।
হাদীসের শেষাংশে ‘হায়া’ বা লজ্জা সম্পর্কে বিশেষভাবে বলা হয়েছে- এটা ঈমানের একটি বিশেষ ও গুরুত্বপূর্ণ
বিভাগ। লজ্জাকে এতদূর গুরুত্ব দানের একটি কারণ এ থেকে পারে যে, মহানবী (সা) যখন এ হাদীস বলেছিলেন,
তখন কারো নির্লজ্জতা কিংবা লজ্জার অভাব পরিলক্ষিত হয়েছিল এবং মহানবী (সা) তাকে সে সম্পর্কে সতর্ক করতে
চেয়েছিলেন। কিংবা মূলত ঈমানের সাথে লজ্জার যে গভীর সম্পর্ক রয়েছে, নবী করীম (সা) এখানে সে তত্তে¡র দিকেই
ইঙ্গিত করেছেন। বস্তুত মানব চরিত্রে লজ্জার স্থান সর্বাধিক, আর লজ্জা একটি এমন গুণ, যা মানুষকে আল্লাহর
নাফরমানী থেকে এবং অসংখ্য পাপ থেকে বিরত রাখতে পারে। এজন্য ঈমান ও লজ্জার মধ্যে অতীব গভীর ও নিকট
সম্পর্ক বিদ্যমান।
আমাদের মনে রাখা দরকার যে, কেবল নিজেদের সমশ্রেণীর লোকদের কাছে লজ্জা করাই ঈমানের দাবি নয়, বরং
সবচেয়ে বেশি লজ্জাবোধ করা উচিত আমাদের সৃষ্টিকর্তা এবং পালনকর্তা আল্লাহ তাআলার প্রতি। সাধারণভাবে
কেবল বড়দের সামনে কিছুটা বেয়াদবী ও নির্লজ্জতা দেখালেই লোকেরা তাকে বেহায়া বা নির্লজ্জ বলে অভিহিত করে।
কিন্তু প্রকৃতপক্ষে বড় নির্লজ্জ-বেহায়া হচ্ছে সে ব্যক্তি, যে তার সৃষ্টিকর্তা আল্লাহর সামনে লজ্জা করে না এবং আল্লাহ
সবকিছু দেখেন এ কথা বিশ্বাস করেও গোপনে এবং প্রকাশ্যে সর্বোতভাবে সে আল্লাহর না-ফরমানী থেকে বিরত থাকে
না।
তিরমিযী শরীফে বর্ণিত হয়েছে, মহানবী (সা) একদা সাহাবীদের সম্বোধন করে বলেন- “আল্লাহ সম্পর্কে তোমরা
এতদূর লজ্জাবোধ কর, যেমন করা উচিত।” উপস্থিত লোকেরা বলল, আল্লাহর শোকর, আমরা আল্লাহ সম্পর্কে লজ্জা
করে থাকি। তিনি বললেন- এরূপ নয়। আল্লাহ সম্পর্কে লজ্জা করার নিয়ম হল এই যে, মস্তক ও মস্তকের মধ্যে যত
চিন্তাধারা ও মতবাদ রয়েছে সেসব কিছুর পূর্ণনিয়ন্ত্রণ ও রক্ষণাবেক্ষণ করতে হবে। অর্থাৎ সকল প্রকার খারাপ চিন্তা ও
মতবাদ থেকে মস্তিস্ককে এবং হারাম ও না জায়িয খাদ্য থেকে পেটকে রক্ষা করতে হবে। আর মৃত্যু ও মৃত্যুর পর
কবরে তোমাদের যে অবস্থা হবে তা স্মরণ করবে। বস্তুত, যে ব্যক্তি এসব কাজ ঠিক ঠিকভাবে করতে পারল; সে
আল্লাহ সম্পর্কে লজ্জা করার পূর্ণ ‘হক’ আদায় করতে পারল। (তিরমিযী)
প্রকৃত মুসলমানের পরিচয়
عن عبد اللھ بن عمرو قال. قال رسول اللھ صلى اللھ علیھ و سѧلم: المسѧلم مѧن سѧلم
المسلمون من لسانھ و یده: والمھاجر من ھجر ما نھى اللھ عنھ. ھذا لفظ البخѧارى و
لمسلم قال ان رجلا سأل النبى صلى اللھ علیھ و سلم اى المسلمین خیر قال من سلم
المسلمون من لسانھ و یده.
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আমর (রা) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন: সে প্রকৃত মুসলিম যার
জিহŸা ও হাত থেকে অন্য মুসলিম নিরাপদ রয়েছে। আর প্রকৃত মুহাজির হলো সে ব্যক্তি, যে আল্লাহ তাআলা যা
নিষেধ করেছেন তা পরিত্যাগ করেছে। এটা ইমাম বুখারীর বর্ণনা। ইমাম মুসলিম বর্ণনা করেন, আবদুল্লাহ ইবনে
আমর (রা) বলেন, এক ব্যক্তি মহানবী (সা)-কে জিজ্ঞেস করল- হে আল্লাহর রাসূল ! মুসলিমদের মধ্যে উত্তম ব্যক্তি
কে ? রাসূল (সা) বলেন, যার জিহŸা ও হাত থেকে অন্য মুসলিমগণ থেকে নিরাপদ থাকে।
ব্যাখ্যা
আলোচ্য হাদীসে খাঁটি মুসলিম এবং মুহাজিরের স্বরূপ ও পরিচয় প্রসঙ্গে বলা হয়েছে যে, যাদের মুখের কথা এবং
হাতের কোন কাজ দ্বারা অন্যান্য লোক বিন্দুমাত্র আহত ও ক্ষতিগ্রস্তনা হয়, সে-ই প্রকৃত মুসলিম। আর সে ব্যক্তিই
প্রকৃত মুহাজির যে আল্লাহর নিষিদ্ধ জিনিস পরিত্যাগ করে। এখানে মুখ ও হাতের কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করার
কারণ এই যে, মানুষ মানুষকে যত প্রকারে কষ্ট দিয়ে থাকে ও যত উপায়ে কষ্ট দিতে পারে তা সবই প্রধানত এ হাত ও
মুখের মাধ্যমেই হয়ে থাকে। হাদীসে ‘লিসান’ শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে। এর অর্থ জিহŸা ও ভাষা দু’-ই। আবার ভাষা
বলতে কেবল উচ্চারিত শব্দই বোঝায় না, হাতের লেখা বা ইশারা-ইংগিতও এর মধ্যে শামিল। অর্থাৎ খাঁটি মুসলিম
সেই ব্যক্তি, যার দ্বারা অপর মুসলিম কোন প্রকার মুখের ভাষা, ইংগিত কিংবা হাত প্রভৃতি কোন কিছু দ্বারাই কষ্ট না
পায়।
‘মুসলিমগণ নিরাপদ রয়েছে’ বাক্যাংশ থেকে এ কথা চিন্তা করা উচিত নয় যে, অমুসলিমকে কষ্ট দেয়া বোধ হয় কোন
অন্যায় কাজ নয়। এখানে মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে এ কথা বলা যে, খাঁটি মুসলিম সে, যার দ্বারা কোন লোকই বিন্দুমাত্র
ক্ষতিগ্রস্তবা কষ্টপ্রাপ্ত হয় না। ইবনে আব্বাস (রা) থেকে বর্ণিত হাদীসটিতে المسلمون سلم من-এর পরিবর্তে
الناس سلم من উল্লেখিত হয়েছে অর্থাৎ সকল মানুষই তার নিকট নিরাপদ থাকবে।
আলোচ্য হাদীসে যে কষ্টদানকে মুসলিম হওয়ার পরিপন্থী বলে ঘোষণা করা হয়েছে, তা হচ্ছে বিনা কারণে ও
বেআইনীভাবে মুসলিম ব্যক্তি কোন মানুষকেই বিন্দুমাত্র কষ্ট দিতে পারে না। কিন্তু অপরাধীকে আইন মোতাবিক
শাস্তিদান, যালিমদের যুল্ম -ফাসাদ রোধ করার জন্য কঠোরতা অবলম্বন, প্রয়োজন হলে দৈহিক আঘাত হানা এবং
ইসলামকে প্রতিষ্ঠা করার পথে কোন প্রকার বাধা আসলে তা দূর করার জন্য সশস্ত্র জিহাদ ঘোষণা করা একান্তই
অপরিহার্য।
ঈমানের স্বাদ গ্রহণকারী ব্যক্তি
عن انس (رض) قال قال رسول اللھ صلى اللھ علیھ و سلم: ثلاث من كن فیھ وجد
بھن حلاوة الایمان من كان اللھ و رسولھ احب الیھ مما سواھما و من احب عبدا لا
یحبھ الا للھ و من یكره ان یعود فى الكفر بعد ان انقذه اللھ منھ كما یكره ان یلقى فى
النار. (متفق علیھ)
হযরত আনাস (রা) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন: যার মধ্যে তিনটি জিনিস পাওয়া যাবে সে
ঈমানের প্রকৃত স্বাদ লাভ করবে। আর তা হচ্ছে- ১. যার মধ্যে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের ভালবাসা তাঁদের উভয় ব্যতীত
অন্য সকল কিছু থেকে অধিক পরিমাণে রয়েছে এবং রাসূল (সা) তার নিকট অপর সকলের চেয়ে অনেক বেশি প্রিয়
হবে, ২. যে ব্যক্তি কোন বান্দাকে কেবল আল্লাহর জন্যই ভালবাসবে এবং ৩, যে ব্যক্তি আল্লাহর অনুগ্রহে কুফর থেকে
মুক্তি পাওয়ার পর কুফরির মধ্যে পুনরায় ফিরে যেতে তেমন অপছন্দ করে, যেমন অপছন্দ করে আগুনে নিক্ষিপ্ত থেকে।
(বুখারী ও মুসলিম)
ব্যাখ্যা
বর্ণিত হাদীসটি মিশকাতুল মাসাবীহ-এর ‘কিতাবুল ঈমান’ থেকে গ্রহণ করা হয়েছে, যা গ্রন্থকার বুখারী ও মুসলিম থেকে
সংকলন করেছেন। বিশিষ্ট সাহাবী হযরত আনাস (রা) হাদীসটি বর্ণনা করেন।
হাদীসে প্রকৃত ঈমানদারের তিনটি গুণের বর্ণনা উপস্থাপিত হয়েছে।
ঈমান ও ইসলাম সম্পর্কিত আলোচনায় এ হাদীসটি অত্যন্তগুরুত্বপূর্ণ। হাদীসটি ইসলামের এক মৌলিক নীতিমালা
বিশেষ। এতে তিনটি মৌলিক বিষয়ের কথা উল্লেখ রয়েছে।
প্রথমতঃ, আল্লাহ ও রাসূলের প্রতি ভালবাসা পোষণ করা দ্বীন ও ঈমানের মূল কথা, সর্বোপরি এটাই প্রকৃত ঈমান।
আর প্রকৃতপক্ষে আল্লাহ ও রাসূলের প্রতি ভালবাসা পোষণ এবং কুফরিতে ফিরে যাওয়াকে অপছন্দ করা, তাতে
বিন্দুমাত্র রাযী না হওয়ার কাজ কেবল তার দ্বারাই সম্ভব, যার মধ্যে ঈমান-দৃঢ়মূল হয়ে আসন গেড়েছে আর যার অন্তর
এজন্য প্রশস্তহয়েছে, যার রক্ত মাংশ এর সঙ্গে মিলে-মিশে আছে। অন্তর দিয়ে কেবল সে-ই দুনিয়ার সবার চেয়ে
আল্লাহ ও তাঁর রাসূলকে অধিকতর ভালবাসতে পারে এবং কেবল সে-ই কুফরিতে ফিরে যাওয়া বা ঈমানের পর পূনরায়
কুফরি কবুল করাকে ঘৃণা ও অপছন্দ করতে পারে। সব কিছুর বিনিময়ে ঈমানের ওপর অটল হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা,
কুফরির সকল আক্রমণ প্রতিরোধ করা কেবল তার পক্ষেই সম্ভব। এজন্যই হাদীসে সর্বপ্রথম এর উল্লেখ করা হয়েছে।
আল্লাহর হুকুম পালনের জন্য সকল প্রকার কষ্ট ও কুরবানী অকাতরে সহ্য করা, দুনিয়ার সকল প্রকার স্বার্থ ও সুখের
বিনিময়ে দ্বীন পালন করতে পারা সে ব্যক্তির পক্ষেই সম্ভব, যে ব্যক্তির মধ্যে আলোচ্য হাদীসে বর্ণিত তিনটি বৈশিষ্ট্য
বিদ্যমান। ‘স্বাদ’ কথাটি খাদ্য ও পানীয় সম্পর্কে ব্যবহৃত হলেও এখানে রূপকভাবে ঈমান সম্পর্কে ব্যবহৃত হয়েছে।
আল্লাহর প্রতি বান্দার ভালবাসার অর্থ আল্লাহর হুকুম পালন করা ও আল্লাহর হুকুমের বিপরীত যা কিছু আছে তা
পরিত্যাগ ও পরিহার করা;। রাসূলের প্রতি ভালবাসার অর্থও তাই।
মনীষী ইবনে বাত্তাল এ হাদীসের ব্যাখ্যায় বলেছেন- আল্লাহর জন্য বান্দার ভালবাসা হচ্ছে স্থায়ীভাবে তাঁর আনুগত্য
করা, যাবতীয় হুকুম পালন করা এবং তিনি যা নিষেধ করেছেন তা থেকে বিরত থাকা। রাসূলের (সা) প্রতি ভালবাসাও
অনুরূপ তাঁর উপস্থাপিত শরীআতকে স্থায়ীভাবে পালন করে চলা। (উমদাতুল কারী)
দ্বিতীয়ত, আল্লাহর জন্য কাউকে ভালবাসা। এখানে কেবল আল্লাহর সন্তোষ লাভের উদ্দেশ্যে অপর মানুষকে
ভালবাসার জন্য উৎসাহ দান করা হয়েছে। কেননা, আল্লাহ মু’মিনদেরকে পরস্পরের ভাই বানিয়ে দিয়েছেন।
বলেছেন- তোমরা আল্লাহর অনুগ্রহে পরস্পর ভাই হয়ে গিয়েছ। (আল-ইমরান ঃ ১০৩)
তৃতীয়ত, ঈমান হচেছ মানব জীবনে আল্লাহ তায়ালার সবচেয়ে বড় নিয়ামত। যারা ঈমান গ্রহণ করে তার উপর
প্রতিষ্ঠিত থেকেছে, তারাই সফলকাম। আর যারা ঈমান গ্রহণ করেনি তারা আল্লাহর নিয়ামতের না শোকর করেছে।
তারা কুফরিতে লিপ্ত থেকে ধ্বংসের দিকে এগিয়ে যাচেছ। সুতরাং কোন ব্যক্তি ঈমান গ্রহণ করার পর সে আর কুফরির
দিকে ধাবিত হবে না। এটাই হচেছ ঈমানের দাবি। যে ব্যক্তি এ দাবি পূরণে সমর্থ হয়েছে সে ঈমানের স্বাদ গ্রহণ করেছে।
ঈমানের গুরুত্ব ও তাৎপর্য
যারা ঈমানদার নয় তারা মুসলমান নয়। তাই মুসলিম জীবনে ঈমানের গুরুত্ব ও তাৎপর্য অপরিসীম। নি¤েœঈমানের
গুরুত্বও তাৎপর্য স¤পর্কে আলোচনা করা হলঈমান মানুষকে সৎপথে পরিচালিত করে
ঈমান বা বিশ্বাস অন্ধকারে নিমজ্জিত মানুষকে আলোর পথ দেখায়। কোন মানুষ যখন কালেমা পাঠ করে ঈমানদারদের
দলভুক্ত হয় তখন তার মন ও ধ্যান-ধারণায় আমূল পরিবর্তন সাধিত হয়, যার দরুন সে কুচিন্তা কুফরি এবং ফাসেকী
পরিহার করে সৎকর্ম সম্পাদন করতে বাধ্য হয়। এদিক থেকে বিচার করলে ঈমানকে এমন এক পরশ পাথর বলা
যায়, যার ছোঁয়ায় মুানুষের অসৎ চিন্তাধারা ধূলিসাৎ হয়ে যায়। তাই একজন ঈমানদার ব্যক্তির পক্ষে কিছুতেই চুরি,
ডাকাতি, খুন ও রাহাজানি করা সম্ভব হয় না।
ঈমান মনে ও কর্মে বিপ্লব সৃষ্টি করে
মন-মানুষের দেহকে পরিচালিত করে। দেহ যদি ক¤পনা করা হয় একটি রেল গাড়ির ওয়াগণের সাথে তাহলে মন হল
তার ইঞ্জিন। মনের চিন্তাধারা, অনুভূতি ও ইচ্ছাই ব্যক্তির কর্মে প্রতিফলিত হয়। অর্থাৎ মানুষের মনোজগতই তার
সকল কর্ম ও সকল প্রচেষ্টার ভিত্তিভূমি। তাই মনে যখন কোন পরিবর্তন দেখা দেয় তখন তা অবশ্যই কর্মে প্রতিফলিত
হয়। ভাল কর্ম সম্পাদন করতে হলে ভাল চিন্তা-ভাবনার দরকার। তাই শুভকাজ সম্পাদনের জন্য ঈমান বিপ্লবের সৃষ্টি
করে কর্মে আকৃষ্ট করে।
ঈমান মনোবল ও সাহস সঞ্চার করে
আল্লাহর প্রতি অবিচল আস্থা ও বিশ্বাস মানুষের মধ্যে অপরিসীম মনোবল ও অফুরন্তসাহস সঞ্চার করে। ঈমানদার
মানুষ যখন কোন বিপদাপদ ও উত্থান-পতনের সম্মুখীন হয় তখন সে শুধু সর্বশক্তিমান আল্লাহর কাছেই আত্মসমর্পণ
করে এবং তাঁরই নিকট সাহায্য কামনা করে। কেননা তাঁর সাহস ও মনোবল এত মজবুত যে, সে পার্থিব কোন লোভ
লালসায় আকৃষ্ট হয় না। বিপদে সে সাহায্য কামনা না করে দুঃখ সইবার শক্তি কামনা করে। জীবনের সর্ব অবস্থায় সে
এক পরম শক্তির অস্তিত্ব অনুভব করে, যা তাকে সুখের আতিশয্যে দিশেহারা না থেকে এবং দুঃখের দিনে হতাশ না
থেকে সহায়ক হয়।
ঈমান মানব চরিত্রকে নম্র ও বিনয়ী করে
যারা প্রকৃত ঈমানদার তাদের ধন-সম্পদ ও বিদ্যা-বুদ্ধির গর্ব থাকতে পারে না। কেননা সে মনে করে, তার যা কিছু
আছে সবই মহান আল্লাহর দান। তিনি ইচ্ছা করলে যে কোন মুহূর্তেই এগুলো কেড়ে নিতে পারেন। ঈমানদার
ব্যক্তিমাত্রই জানে যে, পৃথিবীর সকল মানুষ আল্লাহর সৃষ্টি। তাই ধনী- দরিদ্র ছোট-বড় সকলকেই সে সমান চোখে
দেখে। তার মনে কখনো অহংকারের ছায়াপাতে কালিমা লিপ্ত থেকে পারে না। সে বিনয় ও নম্রতার সাথে সকলের
সঙ্গে দিনাতিপাত করে এবং আল্লাহর দানে শুকরিয়া আদায় করে।
ঈমান ধৈর্য় ধারণের প্রেরণা যোগায়
মহান আল্লাহর প্রতি অবিচল বিশ্বাসই মানুষকে দৈর্য্যধারণ করার শক্তি প্রদান করে। জীবনের ঝুঁকিপূর্ণ বিপদাপদ, দুঃখ
বঞ্চনা এমনকি মুত্যুর বিভীষিকাও তার মনে ভীতির সঞ্চার করতে পারে না। আল্লাহপ্রেম তার মন থেকে সকল ভয়ভীতি অপসারণ করে তাকে এক দুর্দমনীয় মনোবলের অধিকারী করে তোলে। শত শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন
চালিয়েও আল্লাহর প্রতি আস্থা থেকে তাকে ফিরানো যায় না।
ঈমান মানুষকে নির্ভুল জীবন পথের সন্ধান দেয়
ঈমানদার ব্যক্তি শুধু আল্লাহর একত্বেই বিশ্বাস করে না, সে বিশ্বাস স্থাপন করে নবী-রাসূলদের প্রতি, আসমানী
কিতাবের প্রতি এবং পরকাল বা শেষ বিচারের প্রতি। তাই সে নবীদের প্রদর্শিত পথেই জীবন যাপনের চেষ্টা করে।
ঈমানী শক্তির বলেই সে নিজেকে আল্লাহর; আদর্শ বান্দা ও রাসূলের প্রকৃত উম্মত হিসেবে গড়ে তোলে।
ঈমান মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি প্রসারিত করে
ঈমানদার ব্যক্তি বিশ্বাস করে যে, বিশ্বের সকল কিছুই আল্লাহর নিয়ন্ত্রণাধীন, সবকিছুই আল্লাহর সাম্রাজ্য। কেননা ঈমান
তাঁর অন্তর্দৃষ্টিকে প্রসারিত করে দিয়েছে। দেখার দু’টি চোখ ছাড়াও তাঁর এমন দু’টি ঈমানী চোখ থাকে যা দ্বারা সে
সমস্তবিশ্বের সবকিছুই দর্শন করতে পারে।
ঈমান আত্মসম্ভ্রম ও আত্মমর্যাদাবোধ সৃষ্টি করে
পবিত্র কুরআন ও হাদীসের অমিয়বাণী ঈমানদার ব্যক্তির অন্তরকে স্বচ্ছ করে দিয়েছে। তাই সে অনুভব করতে পারে
পৃথিবীর সৃষ্টি বস্তুর মধ্যে মানুষই সর্বশ্রেষ্ঠ। এ বিশ্বাসবোধ তার আত্মশক্তিকে মজবুত করে দেয়। সে বিশ্বাস করে যে,
বিশ্বের সর্বময় কর্তৃত্ব একমাত্র আল্লাহর তাই সকল গুণাগুণ বা প্রশংসা তাঁর প্রাপ্য। এ বিশ্বাসই একজন মানুষের মনে
আত্মমর্যাদাবোধ সৃষ্টি করে এবং মহৎ জীবন গড়ে তুলতে উদ্ভূদ্ধ করে।
ইসলামের মৌল ভিত্তি
ঈমান হচ্ছে ইসলামের মূলভিত্তি। ঈমান মুসলিম জাতির প্রাণশক্তির মূল উৎস হিসেবে বিবেচিত। জীবন-মরণে, সুদিন-
দুর্দিনে বিশ্বের একমাত্র সৃষ্টিকর্তা ও পালনকর্তা আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের ওপরই নির্ভরতা ঈমানের মূলকথা।
অনবদ্য চেতনা
ঈমান এক অনবদ্য চেতনা। আল্লাহর একত্ববাদ মু’মিনের প্রাণের অফুরন্তপ্রেরণা, আত্মার পরম পুলক। জীবনের
দুর্যোগময় মুহূর্তে অথবা আনন্দমুখর হাস্যোজ্জ্বল দিনে কোন অবস্থায়ই মু’মিনকে একত্ববাদের পথ থেকে একবিন্দুও
বিচ্যুৎ করা যায় না।
বহুত্ববাদের প্রতি অনাস্থা
এক ভিন্ন বহুর কোন স্থান ইসলামে নেই। মু’মিনের অন্তরে আল্লাহ একক অধিকারে সমাসীন। তাই বহুত্ববাদ, দ্বিত্ববাদ,
ত্রিত্ববাদ, না খোদাবাদ ও পৌত্তলিকতাবাদের বিরুদ্ধে ইসলাম আপোষহীন। আল্লাহর সাথে অন্য কোন প্রাণী, বস্তু বা
শক্তিকে ইসলাম আল্লাহর সমত‚ল্য বলে বিশ্বাস করে না। বরং আল্লাহর সাথে তুলনা করাকে শিরক বলে মনে করে।
মাথা অবনত না করা
ঈমানদার আল্লাহর পর আর কাউকে বড় মনে করে না। তারা বিশ্বাস করে যে মানুষ তাঁরই প্রতিনিধি। এ বিশ্বাসের
ফলে তারা কোন সৃষ্টজীবের কাছে মাথা নত করে না এবং কোন সৃষ্ট জীবকে ভয় ও পায় না।
চির উন্নত ও বলীয়ান করে
ঈমানদার কখনো অপমানিত, বিজিত ও অপরের হুকুমের তাবেদার হয় না। সদা-সর্বদাই সে চির বিজয়ী ও মর্যাদাবান
নেতা। আর এ বিশ্বাসের ফলে সে চির উন্নত ও চির বলীয়ান থাকে। ঈমান মানবতাত্মাকে করে চির উন্নত, হৃদয়কে
করে বিমল-পুণ্যালোকে সমুদ্ভাসিত। তার চির উন্নত শির আল্লাহ ছাড়া কারো কাছে অবনত হয় না।
আত্মমর্যাদাবোধে উজ্জীবিত হয়
বিশ্বাস মানুষের মধ্যে আত্মসচেতনতা ও আত্মমর্যাদাবোধ জাগিয়ে তোলে। এর ফলে ঈমানদারের মাঝে উদার
দৃষ্টিভঙ্গির সৃষ্টি হয়, সংকল্প হয় সুদৃঢ়।
ইন্দ্রীয় পুঁজারী হয় না
ঈমানদার কখনো অতি আরামপুঁজারী ইন্দ্রিয়পরতার দাস ও বলগাহারা লোভাতুর হয় না। সৎ ও পরিশ্রমলব্ধ
জীবনবোধে উজ্জীবিত হয়, তাই তার চেয়ে ধনী ও ঐশ্বর্যশালী আর কেউ নয়। ঈমানদার ব্যক্তি সব সময় আল্লাহকে
ভয় করে, তাই তার অন্তর থেকে লোভ-লালসা ও গায়রূল্লাহর ভয় দূর করার চেষ্টা করে।
সৃষ্টিলোকের আপনজন
ঈমানদার সকলের অধিকার পূরণ করে, সৃষ্টির কল্যাণে সদা ব্যস্তথাকে। সে সৃষ্টির কোন ক্ষতি করে না। মহান
আল্লাহর সৃষ্টিকে সে লালন করে। ফলে গোটা সৃষ্টি তার বন্ধু বা প্রিয়জন হয়ে ওঠে।
কর্ম চেতনার মূল উৎস
ঈমানের ফলে মানুষের সকল কাজ চলে একটি অপরিমেয় চেতনায় ও বিশ্বাসের ভিত্তিমূলে। তার কোন কাজ বিফলে
যায় না। তার সব কাজ আল্লাহ দেখছেন। এ ঈমানের ফলে মানুষের মনোজগতে সৃষ্টি হয় এক অপারগতি ও চেতনা।
যা সমগ্র কর্ম চাঞ্চল্যের মূল উৎস।
স্বার্থপরতার গøানি থেকে মুক্ত করে
ঈমানের ফলশ্রæতিতে মানুষ সংকীর্ণ স্বার্থপরতার গদ্বানি থেকে মুক্ত হয়ে সকল সৃষ্টিলোকের কল্যাণ ও মঙ্গল কামনায়
সকল কাজ করে থাকে। সে সকলকে আপন বলে ভাবে এবং নিজের স্বার্থের দিকে না তাকিয়ে অপরের সুবিধার কথা
চিন্তা করে। তাই তার মধ্যে লোভ-লালসা, কামনা-বাসনা, হীনস্বার্থপরতা জন্ম নিতে পারে না।
ইসলামের পথে সুদৃঢ় ঐক্য গড়ে তুলে
ঈমানদার মানুষ সকলেই এক পরিবারের এবং একই জাতির বলে নিজেকে মনে করে। দেশ, কাল, ভাষা, বর্ণ, গোত্রে
কোন বিভেদই তাদের মধ্যে অনৈক্য বা বৈষম্য সৃষ্টি করতে পারে না। সবাই মিলে হয় এক অখন্ড জাতি এবং তারা
সব সময় ঐক্য কামনা করে। আল্লাহর পথে তারা ঐক্যবদ্ধ হয়ে থাকতে চায়। যেমন- আল্লাহ বলেন- مواѧواعتص
واѧتفرق ولا اѧجمیع اللھ بحبل “তোমরা আল্লাহর রজ্জুকে ঐক্যবদ্ধভাবে ধারণ কর এবং পরস্পর বিচ্ছিন্ন হয়ো
না।”
ঈমান ইসলামের কেন্দ্রবিন্দু, ইসলামের মূল ভিত্তি, এর ওপর মানুষের জীবনের যাবতীয় কর্মের ফল নির্ভরশীল।
মানুষের জীবনের প্রকৃতি নির্ভর করে তাঁর বিশ্বাসের ওপর। ঈমানের ওপরই ইসলামের গোটা প্রাসাদ গড়ে উঠেছে। এর
অভাবে ইসলামের গোটা ব্যবস্থাপনা ভেঙ্গে চুরমার হয়ে যায়। ইসলামের অস্তিত্বই থাকে না। মোটকথা, মানুষ যা বিশ্বাস
করে সেভাবেই জীবন পরিচালনায় প্রবৃত্ত হয়। এক কথায় বলা যায়, ঈমান প্রত্যেক মানুষের জন্য অবশ্য প্রয়োজনীয়
এবং সকল সৎকর্মের মূলভিত্তি। তাই মানব জীবনে এর গুরুত্ব ও তাৎপর্য অপরিসীম।
ইসলাম ও ঈমানের সম্পর্ক ও পার্থক্য
পবিত্র কুরআন ও হাদীসের ভাষ্যানুযায়ী দেখা যায়, ‘ঈমান ও ইসলাম’ উভয় শব্দ কখনো এক ও অভিন্ন অর্থে ব্যবহৃত
হয়েছে। আবার কখনো ভিন্নার্থে এবং কখনো উভয়কে সম্পূরক অর্থেও ব্যবহৃত থেকে দেখা যায়। তাই মনীষীগণ
উভয় শব্দের সম্পর্ক-পার্থক্য নির্ণয়ে যে ভিন্নমত পোষণ করেছেন প্রকৃতপক্ষে তা শাব্দিক বিশ্লেষণ ও পার্থক্য মাত্র।
নচেৎ উভয় শব্দই এক অভিন্ন বা একে অপরের পরিপূরক, একটি আরেকটির সাথে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত।
ঈমান ও ইসলামের মধ্যে পার্থক্য
ঈমান ও ইসলামের সংজ্ঞা থেকে প্রতীয়মান হয় যে, ঈমান ও ইসলামের মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। অর্থাৎ বাহ্যিক
কার্যাবলীর নাম ইসলাম, আর অন্তনির্হিত বিশ্বাসের নাম ঈমান। হযরত উমর ইবনুল খাত্তাব (রা) থেকে বর্ণিত হাদীসে
জিবরাইল থেকে বোঝা যায় যে, ঈমান ও ইসলাম উভয়টি ভিন্ন ভিন্ন জিনিস। কেননা, জিবরীল (আ)-এর প্রশ্নের
জবাবে রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন- “আল্লাহর তাওহীদ ও মুহাম্মদ (সা)-এর রিসালাতে বিশ্বাস করা, নামায প্রতিষ্ঠা
করা, যাকাত প্রদান করা, রমযান মাসের রোযা রাখা এবং হজ্জ পালন করার নাম ইসলাম।” আর ঈমান সম্পর্কিত
প্রশ্নের জবাবে রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন- “আল্লাহ, তাঁর ফেরেশতা, সকল কিতাব, সকল রাসূল, পরকাল এবং
তাকদীরে বিশ্বাস করার নাম ঈমান।”
উল্লেখযোগ্য যে, আভিধানিক অর্থে ঈমান ও ইসলামের মধ্যে পার্থক্য থাকলেও এবং উপরোক্ত হাদীসে ঈমান ও
ইসলামকে ভিন্ন ভিন্নভাবে বিবৃত করলেও শরীআতের দিক থেকে উভয় এক ও অভিন্ন। কাজেই যে ব্যক্তি মু’মিন সে-ই
মুসলিম, আবার যে ব্যক্তি মুসলিম সে-ই মু’মিন। এটা বলার কোন অবকাশ নেই যে, অমুক ব্যক্তি মু’মিন, মুসলিম নয়,
অথবা অমুক ব্যক্তি মুসলিম, মু’মিন নয়।
ঈমান ও ইসলামের সম্পর্ক
ঈমানের মূল অর্থ আন্তরিক প্রত্যয়ন। আর ইসলাম বলতে বোঝায় মহান স্রষ্টার সার্বভৌমত্বের কাছে বান্দার দাসত্বের
আত্মসমর্পণ। বাস্তব ক্ষেত্রে এ দু’শব্দের পারস্পরিক সংযোগ অত্যন্তগভীর। নি¤েœঈমান ও ইসলামের স¤পর্ক তুলে ধরা
হলএক ও অভিন্ন অর্থবহ
إ ِن كُنѧتُمْ آمَنѧتُمْ ب ِٱلل َّѧھِ فَع َل َیْѧھِ -লনবে তাআলা আল্লাহ যমন। রেকে বহনর্থ অ একই ইসলাম ও ঈমান সাধারণত
َینِمِلѧْمُّس مُتѧنُك ن ِإ ْ اۤ وѧُ كَّلَ وَت“যদি তোমরা আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করে থাক, তা হলে তাঁর ওপরই ভরসা
কর, যদি তোমরা আত্মসমর্পণকারী হয়ে থাক।” (সূরা ইউনুস ঃ ৮৪)
এখানে ঈমান ও ইসলামকে একই অর্থে ব্যবহার করা হয়েছে। মু’মিন ও মুসলিম যেমন একে অন্যের সঙ্গে নিবিড়
স¤পর্কে আবদ্ধ, ঈমান ও ইসলাম শব্দ দুটোও তেমনি পারস্পরিক ভাববিনিময়ে সুপরিস্ফুট। কাজেই একথা বলার
যেমন অবকাশ নেই যে, অমুক ব্যক্তি মুসলিম কিন্তু মু’মিন নয়। অর্থাৎ ঈমান ও ইসলাম মূলত একই বিষয়। মুসলিম
ধর্মতত্ত¡বিদ ও দার্শনিকদের অধিকাংশের মতই এটা যে, ঈমান ও ইসলাম এক ও অভিন্ন জিনিস। উভয়ের মাঝে তেমন
কোন মৌলিক পার্থক্য নেই।
ইসলামের সর্বোচ্চ সোপান ঈমান
ঈমানের আভিধানিক অর্থ বিশ্বাস ও প্রত্যয়। পারিভাষিক দৃষ্টিতে ইসলামের মূল বিষয়গুলোকে অন্তরে বিশ্বাস করা, মুখে
স্বীকার করা এবং সে অনুসারে আমল করাকে ঈমান বলে। তাই ঈমান ইসলামের সর্বোচ্চ সোপান।
অবিচ্ছেদ্য ও ঘনিষ্ঠ স¤পর্ক
ঈমানের সাথে ইসলামের ঘনিষ্ঠ ও অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক বিদ্যমান, তাই ইসলাম ঈমানেরই বহিঃপ্রকাশ। ঈমান ছাড়া
ইসলাম কল্পনা করা যায় না ; আবার ইসলাম ব্যতীত ঈমানের অস্তিত্ব বোঝা যায় না।
শিকড় ও কান্ডের সম্পর্ক
শিকড়ের সাথে গাছের কান্ড, শাখা-প্রশাখা এবং পত্র-পল্লব ও ফুল-ফলের যে সম্পর্ক, ঈমানের সাথে ইসলামেরও
সেরূপ সম্পর্ক।
ঈমান অন্তনির্হিত চেতনা আর ইসলাম তার রূপায়ণ
গাছের শিকড় মাটির ভেতর থেকে খাদ্যরস যোগায়, তাতেই গাছের কান্ড, শাখা-প্রশাখা, পত্র-পল্লব ও ফুল-ফল সজীব
ও সতেজ হয় ; তেমনি ঈমানও মানুষের অন্তরের অন্তঃস্থলে আল্লাহর প্রতি অনুরাগ এবং তাঁর ভালবাসা লাভের বাসনা
সৃষ্টি করে, তাতেই ইসলাম সজীব ও সতেজ হয়ে পরিপূর্ণ সৌন্দর্যে বিকশিত হয়।
ভিত্তি ও ইমারত সদৃশ
ঈমান হচ্ছে ইসলামী জীবন ব্যবস্থার ভিত্তিপ্রস্তর। এর ওপরই ইসলামী জীবন ও সমাজ ব্যবস্থার গোটা ইমারত গড়ে
উঠেছে। কাজেই ঈমান ও ইসলামের সম্পর্ক যে ওতপ্রোত ও সুনিবিড় তা নির্দ্বিধায় বলা যায়।
ঈমান অন্তরের আর ইসলাম বাইরের রূপ
কুরআনের কোন কোন আয়াতের বক্তব্য থেকে বোঝা যায়, ঈমান ও ইসলাম এক বিষয় নয়, এদের মধ্যে পার্থক্য
আমরা, লবে ুঈনরাদব“ে قَال َѧتِ ٱلأ َعْѧرَ ابُ آمَنَّѧا ق ُѧل ل َّѧمْ تُؤْ مِنُѧوا ْ وَ ل َѧـٰكِن ق ُول ُѧوۤ ا ْ أ َسْѧل َمْنَا -যমন। ছেআে
ঈমান এনেছি। বল, তোমরা ঈমান আননি, বরং তোমরা বল, আমরা আত্মসমর্পণ করেছি।” (সূরা আল-হুজুরাত ঃ
১৪)
এ আয়াত থেকে বোঝা যায়, ইসলাম হচ্ছে বাহ্যিক কর্ম ও আচার অনুষ্ঠানের নাম, আর ঈমান হচ্ছে আন্তরিক স্বীকৃতি বা প্রত্যয়নের নাম।
একটি আরেকটির পরিপূরক
কুরআনের কোন কোন আয়াত এবং মহানবী (সা)-এর কোন কোন হাদীস থেকে বোঝা যায় যে ঈমান ও ইসলাম
শব্দদ্বয় একটি অপরটির মধ্যে প্রবিষ্ট এবং একটি অপরটির পরিপূরক। যেমন-
سئل رسول اللھ اى الاعمال افضل قال: الاسلام. فقال اى الاسلام افعل؟ فقال
الایمان .
“একবার রাসূলুল্লাহ (সা)-কে জিজ্ঞেস করা হল যে, কোন্ আমল শ্রেষ্ঠ ? তিনি বলেন, ইসলাম। আবার জিজ্ঞাসা করা
হল কোন্ ইসলাম শ্রেষ্ঠ ? তিনি বলেন, ঈমান।” (আল-হাদীস)
এর দ্বারা বোঝা যায়- ঈমান ও ইসলাম একই জিনিস। একটি আরেকটির পরিপূরক।
ঈমান ইসলামের প্রবেশদ্বার
ইসলাম হল আল্লাহ প্রদত্ত পরিপূর্ণ জীবন বিধান। আর এ বিধানকে বিশ্বাস ও মেনে নেয়ার স্বীকৃতি এবং তদনুযায়ী
আমল করার ঘোষণা হল ঈমান। ঈমানের ঘোষণা দিয়েই ইসলাম নামক প্রাসাদে প্রবেশ করতে হয়। কাজেই ঈমান ও
ইসলামের সম্পর্ক প্রাসাদ ও তার প্রবেশদ্বার স্বরূপ। যে ব্যক্তি ইসলাম গ্রহণ করতে চায়, তাকে ইসলামের মূল কালিমাاللھ رسول محمد اللھ الا الھ لا পাঠ করে ইসলামে প্রবেশ করতে হয়।
ঈমান এবং ইসলামের বিষয়সমূহ
ইসলামের বিষয় ব্যাপক। আর ঈমানের বিষয় হল- আল্লাহ, রাসূল, ফেরেশতা, কিতাব, তাকদীর, আখিরাত,
পুনরুত্থান দিবস ইত্যাদি।
এ থেকে বোঝা যায়, ইসলামের প্রধান ও প্রথম মূল বিষয় হচ্ছে ঈমান। ইসলাম হল- অনির্দিষ্ট আর ঈমান নির্দিষ্ট
কতিপয় বিষয় এর প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করা। কাজেই উভয়ের মধ্যে সম্পর্ক অতীব গভীর।
উপরিউক্ত আলোচনা থেকে একথা সুস্পষ্টরূপে বোঝা যায় যে, ঈমান হল প্রত্যয়নের নাম। আর ইসলাম হচ্ছে গোটা
জীবন ব্যবস্থার নাম। বাস্তব কার্যকরণের দৃষ্টিতে উভয়ের মধ্যে কোন পার্থক্য নেই। কাজেই যে ব্যক্তি মু’মিন সেই
মুসলিম। আবার যে মুসলিম সেই মু’মিন। কেননা, ঈমান ও ইসলাম পরস্পর অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। ফলে একটি ব্যতীত
অপরটির কথা কল্পনাও করা যায় না।
সারকথা
ঈমান ইসলামের কেন্দ্রবিন্দু, ইসলামের মূল ভিত্তি। ঈমান বা বিশ্বাস হল ইসলামের মূল বিষয়, এর ওপর মানুষের
জীবনের যাবতীয় কর্মের ফল নির্ভরশীল। মানুষের জীবনের প্রকৃতি নির্ভর করে তাঁর বিশ্বাসের ওপর। ঈমানের ওপরই
ইসলামের গোটা প্রাসাদ গড়ে উঠেছে। এর অভাবে ইসলামের গোটা ব্যবস্থাপনা ভেঙ্গে চুরমার হয়ে যায়। ইসলামের
অস্তিত্বই থাকে না। মোটকথা, মানুষ যা বিশ্বাস করে সেভাবেই জীবন পরিচালনায় প্রবৃত্ত হয়। এক কথায় বলা যায়,
ঈমান প্রত্যেক মানুষের জন্য অবশ্য প্রয়োজনীয় এবং সকল সৎকর্মের মূলভিত্তি। তাই মানব জীবনে এর গুরুত্ব ও
তাৎপর্য অপরিসীম।
পবিত্র কুরআন ও হাদীসের ভাষ্যানুযায়ী দেখা যায়, ঈমান ও ইসলাম উভয় শব্দ এক ও অভিন্ন অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে।
আবার কখনো ভিন্নার্থে এবং কখনো উভয়কে সম্পূরক অর্থেও ব্যবহৃত থেকে দেখা যায়। তাই মনীষীগণ উভয় শব্দের
সম্পর্ক-পার্থক্য নির্ণয়ে যে ভিন্নমত পোষণ করেছেন প্রকৃতপক্ষে তা শাব্দিক বিশ্লেষণ ও পার্থক্য মাত্র। নচেৎ উভয় শব্দই
এক অভিন্ন বা একে অপরের পরিপূরক, উভয়ই ওতপ্রোতভাবে জড়িত।
ঈমান ও ইসলামের সংজ্ঞা থেকে প্রতীয়মান হয় যে, ঈমান ও ইসলামের মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। অর্থাৎ বাহ্যিক
কার্যাবলীর নাম ইসলাম, আর অন্তনির্হিত বিশ্বাসের নাম ঈমান। হযরত উমর ইবনুল খাত্তাব (রা) থেকে বর্ণিত হাদীসে
জিবরাইল থেকে বোঝা যায় যে, ঈমান ও ইসলাম উভয়টি ভিন্ন ভিন্ন জিনিস। কেননা, জিবরীল (আঃ)-এর প্রশ্নের
জবাবে রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন- “ আল্লাহর তাওহীদ ও মুহাম্মদ (সা)-এর রিসালাতে বিশ্বাস করা, নামায প্রতিষ্ঠা
করা, যাকাত প্রদান করা, রমযান মাসের রোযা রাখা এবং হজ্জ পালন করার নাম ইসলাম।” আর ঈমান সম্পর্কিত
প্রশ্নের জবাবে রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন- “আল্লাহ, তাঁর ফেরেশতা, সকল কিতাব, সকল রাসূল, পরকাল এবং
তাকদীরে বিশ্বাস করার নাম ঈমান।”
উল্লেখযোগ্য যে, আভিধানিক অর্থে ঈমান ও ইসলামের মধ্যে পার্থক্য থাকলেও এবং উপরোক্ত হাদীসে ঈমান ও
ইসলামকে ভিন্ন ভিন্নভাবে বিবৃত করলেও শরীআতের দিক থেকে উভয় এক ও অভিন্ন। কাজেই যে ব্যক্তি মু’মিন সে-ই
মুসলিম, আবার যে ব্যক্তি মুসলিম সে-ই মু’মিন। এটা বলার কোন অবকাশ নেই যে, অমুক ব্যক্তি মু’মিন, মুসলিম নয়,
অথবা অমুক ব্যক্তি মুসলিম, মু’মিন নয়।
ঈমানের মূল অর্থ আন্তরিক প্রত্যয়ন। আর ইসলাম বলতে বোঝায় মহান স্রষ্টার সার্বভৌমত্বের কাছে বান্দার দাসত্বের
আত্মসমর্পণ। বাস্তব ক্ষেত্রে এ দু’শব্দের পারস্পরিক সংযোগ অত্যন্তগভীর।
পাঠোত্তর মূল্যায়ন
নৈর্ব্যক্তিক উত্তর প্রশ্ন
এক কথায় উত্তর দিন
ক. রাসূল (সা)- এর নিকট প্রশ্নকারী ব্যক্তি কে ছিলেন?
খ. ‘যাকে প্রশ্ন করা হচেছ তিনি প্রশ্নকারীর চেয়ে বেশী অবগত নন’- এ উক্তি কার?
গ. দিন-রাত ২৪ ঘণ্টার মধ্যে কয়বার সালাত কায়েম করতে হয়?
ঘ. হাদীসে ঈমানের কয়টি শাখার কথা বর্ণিত হয়েছে?
ঙ. হিজরত কয় প্রকার?
চ. হাদীসে প্রকৃত ঈমানদারের কয়টি গুণের কথা বলা হয়েছে?
সঠিক উত্তরে টিক্ দিন
১. আগন্তুক ব্যক্তি ছিলেনক. মহানবী (সা) খ. হযরত জিবরীল (আ.) গ. হযরত আবু বকর (রা.) ঘ. হযরত আলী (রা.)।
২. ইসলাম কয়টি ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত?
ক. ৫টি খ. ৪টি গ. ৩টি ঘ. ৭টি।
৩. ঈমানের সর্বোচ্চ শাখা হচেছক. রিসালাতের উপর বিশ্বাস করা খ. আল্লাহর একত্ববাদে বিশ্বাস করা
গ. আল্লাহর একত্ববাদ ও রিসালাতে বিশ্বাস করা ঘ. সব ক’টি উত্তরই সঠিক।
৪. ‘হায়া’ শব্দের অর্থ হলক. হায়াত খ. লজ্জা গ. হারাম ঘ. হাইউন।
৫. “প্রবৃত্তির সাথে লড়াই করাই বড় জিহাদ”- এ উক্তি কার?
ক. মহানবী (সা)-এর খ. ইমাম বুখারী (র.) –এর গ. আল্লাহ তায়ালার ঘ. ইমাম আবু হানিফা (র)-এর।
৬. ঈমান মানব চরিত্রকেক. সন্ত্রাসী করে তুলে খ. নম্র ও বিনয়ী করে গ. আত্মমর্যাদাসম্পন্নকরে ঘ. খ ও গ-এর উত্তর সঠিক।
সংক্ষিপ্ত উত্তর প্রশ্ন
১. ইসলামের ৫টি বুনিয়াদী বিষয় সংক্ষেপে লিখুন।
২. ঈমানের উচ্চ ও নি¤œশাখার বর্ণনা দিন।
৩. হাদীসের আলোকে ‘হায়া’ বা লজ্জা স¤পর্কে লিখুন।
৪. হিজরত শব্দের অর্থ লিখুন। হিজরত কত প্রকার ও কী কী?
৫. প্রকৃত মুমিনের তিনটি বৈশিষ্ট্যের কথা হাদীসের আলোকে উল্লেখ করুন।
৬. ব্যাখ্যা করুন, ‘ঈমান মনোবল ও সাহস সঞ্চার করে’।
৭. ঈমান ও ইসলামের স¤পর্কের কয়েকটি দিক তুলে ধরুন।
রচনামূলক উত্তর প্রশ্ন
১. হযরত উমর (রা) থেকে বর্ণিত হাদীসের অনুবাদ করুন।
২. আবদুল্লাহ ইবনে আমর (রা) থেকে বর্ণিত হাদীসের অনুবাদ ও ব্যাখ্যা করুন।
৩. হযরত আনাস (রা) থেকে বর্ণিত হাদীসের অনুবাদ ও ব্যাখ্যা করুন।
৪. ঈমানের গুরুত্বও তাৎপর্য স¤পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করুন।
৫. ঈমান ও ইসলামের মধ্যে স¤পর্ক ও পার্থক্য নিরূপণ করুন।

FOR MORE CLICK HERE
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস মাদার্স পাবলিকেশন্স
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস ১ম পর্ব
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস
আমেরিকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস
বাংলাদেশের ইতিহাস মধ্যযুগ
ভারতে মুসলমানদের ইতিহাস
মুঘল রাজবংশের ইতিহাস
সমাজবিজ্ঞান পরিচিতি
ভূগোল ও পরিবেশ পরিচিতি
অনার্স রাষ্ট্রবিজ্ঞান প্রথম বর্ষ
পৌরনীতি ও সুশাসন
অর্থনীতি
অনার্স ইসলামিক স্টাডিজ প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত
অনার্স দর্শন পরিচিতি প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত

Copyright © Quality Can Do Soft.
Designed and developed by Sohel Rana, Assistant Professor, Kumudini Government College, Tangail. Email: [email protected]