কুরআন সংরক্ষণের পদ্ধতি ও ইতিহাস বর্ণনা করুন।

আল-কুরআন সংরক্ষণ
মহাগ্রন্থ আল-কুরআন আল্লাহ তাআলা নাযিল করেছেন এবং তিনিই স্বয়ং এ কিতাবের সংরক্ষণকারী বলে ঘোষণা
দিয়েছেন। আল্লাহ বলেন,
إ ِنَّ عَل َیْنَا جَمْع َھُ وَ ق ُرْ آنَھُ
“এটা সংরক্ষণ ও পাঠ করাবার দায়িত্ব আমারই।” (সূরা আল-কিয়ামাহ : ১৭)
إ ِنَّھُ ل َق ُرْ آنٌ كَرِ یمٌ - فِى كِتَابٍ مَّكْنُونٍ -لا َّ یَمَسُّھُ إ ِلا َّ ٱلْمُطَھَّرُ ونَ
“অবশ্যই এটা সম্মানিত কুরআন, যা লিখিত আছে সুরক্ষিত কিতাবে, যারা পূত:পবিত্র তারা ব্যতীত অন্য কেউ তা স্পর্শ
করতে পারবে না।” (সূরা আল-ওয়াকিয়া : ৭৭-৭৯)
অপরদিকে মহানবীর (স) আমলে-তথা কুরআন নাযিল হওয়ার সময় এবং সকল যুগেই এর সুসংরক্ষণের বিশ্বস্তও
নির্ভরযোগ্য ব্যবস্থা অবলম্বিত হয়ে আসছে। বর্তমানে আমাদের কাছে যে কুরআন শরীফ রয়েছে, তা হুবহু সেই গ্রন্থ, যা
আল্লাহ তা’আলা হযরত জিবরাঈল (আ)-এর মাধ্যমে রাসূলুল্লাহ্ (স.)-এর উপর নাযিল করেছেন। রাসূলুল্লাহ্ (স.)
যেভাবে একে নিজের সামনে অন্যদের দ্বারা লিখিয়েছিলেন, যেভাবে সাহাবীগণকে হিফয করিয়েছিলেন, তিনি নিজে
পাঠ করেছিলেন এবং সাহাবীগণকে পাঠের শিক্ষা দিয়েছিলেন, সেই অবস্থায় এবং সেই বিন্যাসেই এখনো তা বিদ্যমান
রয়েছে। এর বিন্যাসে কোনরূপ পরিবর্তন হয়নি, কোরূপ কমবেশি হয়নি। কোন বর্ণ বা বাক্যেও কোন প্রকার রদবদল
ঘটেনি। স্বয়ং পবিত্র কুরআনে এবং রাসূলের (স) হাদীসে এর সত্যতার প্রমাণ বিদ্যমান রয়েছে।
فَى صُحُفٍ مُّكَرَّ مَةٍ - مَّرْ ف ُوعَةٍ مُّ طَھَّرَ ةٍ -ب ِأ َیْدِى سَفَرَ ةٍ - كِرَ امٍ بَرَ رَ ةٍ
“এটা সংরক্ষিত আছে মর্যাদা সম্পন্ন লিপিসমূহে, যা উন্নত, পবিত্র, মহান, পূত-চরিত্র লিপিকরদের হাতে লিখিত।”
(সূরা আবাসা : ১৩-১৬)
আর তাই আল-কুরআনই একমাত্র গ্রন্থ যা সম্পূর্ণ অবিকৃত ও সংরক্ষিত আসমানীগ্রন্থ হিসেবে চির ভাস্বর ও দেদীপ্যমান
إ ِنَّا نَحْنُ نَزَّ لْنَا ٱلذ ِّكْرَ وَ إ ِنَّا ل َھُ ل َحَافِظُونَ ,লনবে আল্লাহ মহান। ছআে ায়স্থঅব
“আমিই কুরআনকে নাযিল করেছি এবং অবশ্য আমিই এর সংরক্ষণকারী।” (সূরা আল-হিজর : ৯)
কুরআন সংরক্ষণ পদ্ধতি
পবিত্র কুরআন মাজীদ প্রধানত দু’টি পদ্ধতিতে সংরক্ষণ করা হয়১. স্মৃতি ভান্ডারে তথা মুখস্থকরণের মাধ্যমে বক্ষে ধারণ করে সংরক্ষণ
অন্য আসমানী গ্রন্থাবলীর তুলনায় একমাত্র কুরআনই এ বৈশিষ্ট্যের অধিকারী। এর হিফাযত ও সংরক্ষণের জন্য কলম ও
কাগজের তুলনায় অধিক নির্ভর করা হয় স্মৃতিভান্ডার তথা হাফিযদের স্মরণ শক্তির উপর। হৃদয়ে ধারণের ব্যাপারে
আল্লাহ পাক বলেন,
بَلْ ھُوَ آیَاتٌ بَیِّنَاتٌ فِى صُدُورِ ٱل َّذِینَ أ ُوتُوا ْ ٱلْعِلْمَ
“বরং যাদের জ্ঞান দেয়া হয়েছে বস্তুত তাদের অন্তরে এটা স্পষ্ট নিদর্শন।” (সূরা আল-আনকাবুত : ৪৯)
হাদীসে কুদসীতে এ মর্মে বলা হয়েছে- الماء یغسلھ لا كتابا علیك ومنزل
“আপনার প্রতি আমি এমন একটি কিতাব নাযিল করেছি, যাকে পানিও মুছে ফেলতে পারবে না।” (সহীহ্ মুসলিম)
২. লিখন পদ্ধতির মাধ্যমে সংরক্ষণ
পবিত্র কুরআন নাযিল হওয়ার মুহূর্তেই ওহী লেখক দ্বারা তা লিপিবদ্ধ করা হতো। এ ধারা পরবর্তী যুগে লিপিবদ্ধ ও
মুদ্রণের মাধ্যমে পবিত্র কুরআন অবিকল লিপিবদ্ধ আকারে সুরক্ষিত হয়ে আসছে।
পবিত্র কুরআন লিখন ও সংগ্রহ সম্পর্কে কুরআন ও হাদীসে বিস্তারিত ও প্রামাণ্য বিবরণ আছে। মহানবী (স)-এর সময়ে
কাগজ ও মুদ্রণ শিল্প সহজ ছিল না। মানুষ বিভিন্ন জিনিসের উপর লিখে রাখত। কাগজ পাওয়া গেলে তখন তাতেই
লেখা হতো। তাছাড়া খেজুর পাতায়, বিভিন্ন কাঠের ফলক, উটের চেপটা হাড়, পাতলা চামড়া বা গাছের বাকলের
উপর লোখ হতো। এছাড়া পাথর বা কাপড়কেও লোখার কাজে ব্যবহার করা হতো। কুরআন লেখার কাজেও লোকেরা
এসব জিনিস ব্যবহার করতো। যখন যা সামনে পাওয়া যেত, কুরআন নাযিলের পর তাতেই তা লিকে রাখা হতো এবং
সাহাবীগণকে তা মুখস্থ করানো হতো। এ সম্পর্কে হাদীসে বিভিন্ন বর্ণনা আছে। পবিত্র কুরআনে এ সম্পর্কে ইঙ্গিত করা
হয়েছে-
وَ كِتَابٍ مُّسْطُورٍ - فِى رَ قّ ٍ مَّنْشُورٍ
“শপথ কিতাবের, যা লিখিত আছে উš§ুক্ত পত্রে।” (সূরা আত-তুর : ২-৩)
লিসানুল আরব ও কামুস অভিধানে আছে, رق এমন পাতলা চামড়াকে বলা হয়, যাতে লেখা যায়।
ফাতহুল বারী গ্রন্থে আছে-
انما كان فى اللادیم اولا قبل ان یجمع فى عھد ابى بكر . ثم جمع ابوبكر القران
فى قراطیس
“হযরত আবু বকর (রা)-এর খিলাফতকালের সংগ্রহের পূর্বে প্রথমত চামড়ার টুকরায় লিখে রাখা হতো। পরবর্তীতে
হযরত আবু বকরের (রা) সময় আরবে কাগজের প্রচলন হয় এবং তিনি সম্পূর্ণ কুরআন কাগজে লিপিবদ্ধ করেন।”
(মুআত্তা)
এ প্রসঙ্গে কুরআনের বাণী হলো-
رَ سُولٌ مِّنَ ٱلل َّھِ یَت ْل ُو صُحُفا ً مُّطَھَّرَ ةً - فِیھَا كُتُبٌ قَیِّمَة ٌ
“আল্লাহর নিকট হতে এক রাসূল, যে আবৃত্তি করে পবিত্র গ্রন্থ, যাতে আছে সঠিক বিধান।” (সূরা আল-বায়্যিনাহ : ২-৩)
এ থেকে বুঝা যায়, মহানবী (স) পবিত্র কুরআন তিলাওয়াত করেন এবং পবিত্র কুরআন পাক-পবিত্র ও উত্তম কাগজে
লিপিবদ্ধ রয়েছে। এ আয়াতের ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে ফাতহুল বারী গ্রন্থের বর্ণনাটি প্রণিধানযোগ্য। “আল্লাহ তা’আলা এ আয়াতে
বলেছেন, পবিত্র কুরআন যথারীতি গ্রন্থাকারে লিপিবদ্ধ ও সংরক্ষিত রয়েছে।”
নি¤েœর আয়াত থেকেও বুঝা যায় কুরআন লিখিত ছিল-
وَ قَال ُوۤ ا ْ أ َسَاطِ یرُ ٱلأ َوَّ لِینَ ٱكْتَتَبَھَا فَھِىَ تُمْل َىٰ عَل َیْھِ بُكْرَ ةً وَ أ َصِ یلا ً
“তারা বলে, এগুলো তো সেকালের উপকথা, যা সে লিখিয়ে নিয়েছে। এ গুলো সকাল-সন্ধ্যা তাঁর নিকট পাঠ করা
হয়।” (সূরা আল-ফুরকান : ৫)
এতে প্রমাণিত হয়, অবিশ্বাসীরাও এ ব্যাপারে জানত যে, কুরআন লিখিত আকারে সংরক্ষিত এবং গ্রন্থাকারে রয়েছে।
হযরত উমর (রা)-এর ইসলাম গ্রহণের ঘটনায় দেখা যায় তিনি তাঁর ভগ্নি ও ভগ্নিপতিকে কুরআনের লিখিত কপি
اعطونى الكتاب الذى عندكم اقرأه ,লনবে খ দেতেলেুকা
“তোমাদের কাছে লিখিত যে অংশটুকু আছে, তা আমাকে দাও আমি তা পাঠ করবো।”
আবু দাউদের একটি হাদীসে বর্ণিত আছে-
كان النبى صلى اللھ علیھ وسلم مما تنزل علیھ الایت فیدعو بعض من یكتب لھ
ویقول لھ - ضع ھذه الایة فى السورة التى یذكر فیھا كذا او كذا-
“মহানবী (স)-এর উপর যখন কোন আয়াত নাযিল হতো, তখন তিনি কোন ওহী লেখককে ডেকে পাঠাতেন এবং
আয়াতটি কোন সূরায় রাখা হবে, তিনি নিজে তা বলে দিতেন।”
হাদীসের আরো অনেক প্রামাণ্য বর্ণনা থেকে জানা যায় যে, রাসূলুল্লাহ্ (স)-এর কাছে যখন কুরআনের আয়াত নাযিল
হতো, তখনই তা লিখিয়ে নিতেন এবং কোন আয়াত কোন সূরায় কোথায় হবে তার বিন্যাস পদ্ধতিও বলে দিতেন। এ
কাজটি তিনি ওহীর মাধ্যমে জেনে করতেন। কাজেই কুরআন লিখন-বিন্যাস কারো গবেষণার ফসল নয়। ‘আলবুরহান’ গ্রন্থে বলা হয়েছেبكتابتھ یأمر كان وسلم علیھ اللھ صلى فانھ محدثة لیست القران كتابة
“কুরআন লিখন কোন নতুন ব্যাপার নয়, রাসূল (স) নিজে কুরআন লেখার নির্দেশ দিতেন।”
কুরআন সংরক্ষণের ইতিবৃত্ত
পবিত্র কুরআন সংরক্ষণের ইতিহাস বিভিন্ন সূত্র থেকে পাওয়া যায়। সর্বাপেক্ষা নির্ভরযোগ্য সূত্র থেকে মনীষী হাকিম স্বীয়
গ্রন্থ ‘মুস্তাদরাকে’ উল্লেখ করেছেন, কুরআন মাজীদ সংরক্ষণের তিনটি পর্যায় দেখা যায়প্রথম পর্যায় ঃ মহানবী (স)-এর যুগে কুরআন সংরক্ষণ
মহানবী (স)-এর যুগে কুরআন সংরক্ষণের ব্যবস্থাসমূহ ছিল নি¤œরূপকুরআন কণ্ঠস্থকরণ
কুরআন মাজীদ নাযিল হওয়ার সাথে মহানবী (স) কণ্ঠস্থ করে নিতেন এবং তা জিবরাঈল (আ)-কে হুবহু শুনাতেন।
সাথে সাথে সাহাবীদেরকেও কণ্ঠস্থ করে স্মৃতি ভান্ডারে সংরক্ষিত করে রাখার নির্দেশ দিতেন। কুরআনুল কারীম মুখস্থ
করাকে অশেষ সাওয়াবের ও ফযীলতের কাজ বলে বিশ্বাস করতেন। যার ফলে মুসলমানগণের মধ্যে কুরআন মুখস্থ
করার নীতি আবহমানকাল থেকেই চলে আসছে। মহানবীর (সা) সময়ে কুরআন সংরক্ষণের ব্যাপারে স্মরণ শক্তির উপর
নির্ভর করার কথা পবিত্র কুরআনেও আছে।
ওহী নাযিলের প্রথম পর্যায়ে নবী করীম (স) কুরআনের আয়াতগুলো সাথে সাথে দ্রæত পাঠ করতে থাকতেন, যাতে
সেগুলো অন্তরে বদ্ধমূল হয়ে যায়। প্রিয়নবী (স)-এর ব্যস্ততা দেখে আল্লাহ পাক বলেন,
لاَ تُحَرِّ كْ ب ِھِ لِسَانَكَ لِتَعْجَلَ ب ِھِ -إ ِنَّ عَل َیْنَا جَمْع َھُ وَ ق ُرْ آنَھُ - فَإ ِذَا قَرَ أ ْ نَاهُ فَٱتَّب ِعْ ق ُرْ آنَھُ
“তাড়াতাড়ি ওহী আয়ত্ত করার জন্য তুমি তোমার জিহবা তার সাথে সঞ্চালন করো না। এটার সংরক্ষণ ও পাঠ করাবার
দায়িত্ব আমারই। সুতরাং যখন আমি তা পাঠ করি, তুমি সেই পাঠের অনুসরণ করো।” (সূরা আল-কিয়ামা : ১৬-১৮)
উল্লেখ্য, সে সময়ে আরব জাতির স্মরণ শক্তি ছিল অসাধারণ ও বিস্ময়কর। এ স্মরণ শক্তি ছিল তাদের স্বভাবজাত ও
প্রকৃতিগত বিষয়। ইসলাম গ্রহণের পর সাহাবায়ে কিরামের মধ্যে আল্লাহ প্রদত্ত ও প্রতিভা ও স্মরণ শক্তি আরো প্রখর
হয়ে ওঠে। তাঁদের এ অসাধারণ গুণ ও বৈশিষ্ট্য বিপুলভাবে বেড়ে যায়। বিশেষত কল্যাণ ও মুক্তির সনদ কুরআন ও
হাদীস মুখস্থ রাখার অভূতপূর্ব ও বিস্ময়কর ক্ষমতা লাভ করেন তাঁরা। (মানাহিলুল ইরফান- ১ম খন্ড)
বস্তুত নবী যুগে কুরআন সংরক্ষণের ব্যাপারে আরবদের এ স্মরণ শক্তিকে বেশি কাজে লাগানো হয়েছে। এর ফলে
সাহাবীদের মধ্যে এক বিরাট সংখ্যক লোক কুরআনের হাফিয ছিলেন। ‘হাফিযে কুরআন’ সাহাবীদের কণ্ঠে কুরআনের
বাণী সর্বদা ধ্বনিত প্রতিধ্বনিত হতে থাকত। সে সময় থেকে আজ পর্যন্তসকল যুগে সকল দেশে পৃথিবীতে হাজার
হাজার কুরআনের হাফিয বিদ্যমান ছিলেন এবং এখনো আছেন।
পারস্পরিক পঠন-পাঠন ও শ্রবণ
অধিকতর সতর্কতার জন্য মহানবী (স) প্রতি বছর রমযান মাসে জিবরাঈলের (আ) সাথে ‘কুরআনের তাদারোছ’
পারস্পরিক পঠন-পাঠন ও শ্রবণ করতেন। তেমনিভাবে তিনি সাহাবীদেরকে শুনাতেন আর সাহাবীগণও তাঁকে
শুনাতেন। এ কারণে কুরআনে কোন ভুল-ভ্রান্তির অনুপ্রবেশ ঘটেনি।
ব্যাপক চর্চা ও শিক্ষাদান
সাহাবায়ে কিরামের মধ্যে কুরআন মুখস্থ করা, স্মরণ রাখা এবং শিক্ষাদানের অদম্য আগ্রহ ও উদ্দীপনা বিদ্যমান ছিল।
আর এ আগ্রহকে তাঁরা চরমভাবে বাস্তবে রূপায়িত করেছেন। প্রত্যেকেই এ নেক কাজের প্রতিযোগিতায় একে অপরকে
ছাড়িয়ে যেতে চেষ্টা করতেন। পবিত্র কুরআনকে স্বীয় স্মৃতির মণিকোঠায় সুরক্ষিত রাখার নিমিত্তে হাজার হাজার সাহাবী
সকল মগ্নতা ত্যাগ করে এ সাধনায় জীবন উৎসর্গ করে দিয়েছেন। নিয়মিত রাত জেগে তারা নফল নামাযে তিলাওয়াত
হূআয়াতসম আল্লাহর তরো “তারাیَت ْل ُونَ آیَاتِ ٱلل َّھِ آنَآءَ ٱلل َّیْلِ - ঘাষণা আেল্লাহর্র মমে এ। তনকের
তিলাওয়াত করে।” (সূরা আলে-ইমরান : ১১৩)
মহানবীর (স) জীবদ্দশায়ই মদীনায় নয়টি মসজিদ কায়েম হয়েছিল। সেগুলোতে কুরআন শিক্ষাদানের ব্যবস্থা ছিল।
তাছাড়াও বহু সাহাবী মানুষকে কুরআন শিক্ষাদানে ব্যস্তছিলেন। অনেক মহিলা বিয়ের মহরানা স্বরূপ স্বামীর নিকট
কুরআন শিক্ষা গ্রহণের দাবি জানাতেন। বস্তুত এভাবে পারস্পরিক ব্যাপক চর্চা, তালীম ও শিক্ষাদানের বিপুল আগ্রহ ও
তাৎপরতার দ্বারা কুরআনের বাণী ছিল সকলের মুখে মুখে।
সূরা মুয্যাম্মিলের আয়ত থেকে বুঝা যায়-
إ ِنَّ رَ بَّكَ یَعْل َمُ أ َنَّكَ تَق ُومُ أ َدْنَىٰ مِن ث ُل ُث َىِ ٱل ْل َّیْلِ وَ نِصْفَھُ وَ ث ُل ُث َھُ وَ طَآئِفَة ٌ مِّنَ ٱل َّذِینَ مَع َكَ
“তোমার প্রতিপালক তো জানেন যে, তুমি জাগরণ কর কখনো রাতের প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ, কখনো অর্ধাংশ এবং
কখনো এক তৃতীয়াংশ এবং জাগে তোমার সাথে যারা আছে তাদের একটি দলও।” (সূরা আল-মুয্যাম্মিল : ২০)
তাছাড়া সাহাবীগণের বিরাট অংশ কুরআনের চর্চায় ব্যস্তছিলেন। বিভিন্ন দাওয়াতী মিশন নিয়ে বিভিন্ন জনপদে গিয়ে
কুরআনের ব্যাপক শিক্ষা দান কার্যে ব্যাপৃত থাকতেন। ‘আসহাবে সুফ্ফা’ মসজিদে নববীর আবাসিক বিদ্যালয়ে
রাসূলুল্লাহ্ (স)-এর তত্ত¡াবধানে এবং বড় বড় সাহাবীদের নেতৃত্বে কুরআনের উচ্চতর চর্চা ও গবেষণা করতেন।
মসজিদে নববীতে সর্বক্ষণ কুরআন শিক্ষাদান ও তিলাওয়াতের আওয়াজ এমন বেড়ে গিয়েছিল যে, অবশেষে মহানবী
(স)-কে নির্দেশ প্রদান করতে হয়েছিল যে, সবাই যেন আরো আস্তেকুরআন পাঠ করেন, যাতে পরস্পরের
তিলাওয়াতের মধ্য থেকে কোন ভুল বুঝাবুঝির সৃষ্টি না হয়। (মানাহিলুল ইরফান, খ. ১, পৃ. ২৩৪)
আব্দুল কায়স গোত্রের প্রতিনিধি দলের বক্তব্যেও এর প্রমাণ পাওয়া যায়-
ان الا نصار یعلمو ننا كتاب ربنا وسنة نبینا
“আনসারগণ আমাদেরকে আল্লাহর কিতাব ও নবীর সুন্নাতের শিক্ষা দান করেন।” (উলূমুল হাদীস : ১৭)
কুরআনের বাস্তব আমল
মহানবী (স)-এর যুগ কুরআনকে মুখস্থকরণ, ব্যাপক চর্চা ও শিক্ষাদানের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না; বরং মহানবী (স) স্বয়ং
নিজে এবং সাহাবীগণ সঙ্গে সঙ্গে কুরআনের প্রতিটি আয়াতের মর্ম ভালভাবে হৃদয়ঙ্গম করে তদনুযায়ী আমল ও বাস্তব
জীবনে রূপায়িত করারও আন্তরিক চেষ্টা করতেন। ফলে কুরআনের প্রতিটি কথা, আদেশ ও ফরমান সাহাবীগণ কর্তৃক
কার্যকর ও বাস্তবে রূপায়িত হতো। আর নবীজীকে বলা হত জীবন্তকুরআন।
লেখার মাধ্যমে কুরআন সংরক্ষণ
মহানবী (স)-এর যুগেই রাজকীয় ব্যবস্থাপনায় অত্যন্তসুচারুরূপে “ওহী লিখন দফতর”-এর মাধ্যমে কুরআনের লিখন
কার্যটি সুসম্পন্ন হয়। ওহী লিখন দফতরের সদস্য সংখ্যা ছিল বিয়াল্লিশ জন। (তাদভীনে কুরআন)
ওহী লেখকগণ সর্বদা লেখার উপকরণসহ রাসূলুল্লাহ্ (স)-এর চারপাশে অবস্থান করতেন। কুরআনের কোন অংশ যখনই
নাযিল হত, মহানবী (স) তা তখনই লিপিবদ্ধ করে নেওয়ার ব্যবস্থা করতেন। কুরআন লিখনের কাজে যেন কোন প্রকার
শিথীলতা না আসে সে জন্য তিনি সাময়িকভাবে হাদীস লিখনের কাজ বন্ধ করে দিলেন। ওহী লিখন দফতরের প্রধান
সচিব ছিলেন সাহাবী যায়দ ইবনে সাবিত (রা)। তবে এ সময় পূর্ণ কুরআন একই নুসখা বা পান্ডুলিপিতে সন্নিবেশিত
করা হয়নি।
কুরআন লিখনের উপকরণ
মহানবী যুগে কুরআন লিখনের উপকরণ প্রধানত গাছের বাকল, হাড়, চামড়া, শ্বেত পাথর, কাপড়, মিশরীয় ফোম বস্ত্র,
তখনকার মতো আবিস্কৃত এক প্রকার কাগজ।
কুরআনের সুবিন্যস্ততা
যদিও কুরআনের বিভিন্ন অংশ বিভিন্ন সময় নাযিল হয় এবং তা বিভিন্নভাবে লিখিত হয়, তবুও তা ছিল সুবিন্যস্ত। কোন
সূরার নামকরণ, তারতীব, কোন আয়াত সূরার কোথায় বসবে সবকিছুই আল্লাহর নির্দেশ অনুযায়ী সুবিন্যস্তও সুনির্দিষ্ট
করে দেয়া হয়।
দ্বিতীয় পর্যায়
প্রথম খলীফার যুগে কুরআন সংরক্ষণ
মহানবী (স)-এর যুগে কুরআনের যেসব পান্ডুলিপি প্রস্তুত হয়েছিলন, তা একই গ্রন্থে ছিল না; বরং বিভিন্ন বস্তুর উপর
বিক্ষিপ্তভাবে ছিল।
এদিকে মহানবীর তিরোধানের ফলে হযরত আবূ বকর (রা)-এর খিলাফতের প্রাথমিক পর্বে ইসলাম বিরোধী চক্র ও ভন্ড
নবীর বিরুদ্ধে পরিচালিত যুদ্ধে কুরআনের বহু হাফিয শাহাদাতবরণ করেন। সুতরাং হযরত উমর (রা) কুরআন একত্রে
গ্রন্থাবদ্ধ করে সংরক্ষণের প্রতি গুরুত্বারোপ করলে হযরত আবূ বকর (রা) তা সংরক্ষণের সুব্যবস্থা করেন। ‘যায়দ ইবনে
সাবিত’-কে প্রধান সচিব করে ‘কুরআন গ্রন্থায়ন কমিশন’ গঠন করেন। এভাবে কুরআনের প্রামাণ্য পান্ডুলিপি পুস্তকাকারে
সংরক্ষণের সুব্যবস্থা করা হয়।
তৃতীয় পর্যায়
তৃতীয় খলীফার আমলে কুরআন সংরক্ষণ
তৃতীয় খলীফা হযরত উসমানের (রা) খিলাফত আমলে ইসলাম আরব সীমান্তপেরিয়ে পারস্য ও রোমের বি¯তৃর্ণ অঞ্চলে
ছড়িয়ে পড়ে। ফলে কুরআন পঠনে আঞ্চলিক ভাষা ও উচ্চারণের প্রভাবে কুরআনের বিশুদ্ধ পাঠে বিঘœ দেখা দেয় এবং
বিভিন্ন আরবী উপভাষায় কুরআন পড়ার অনুমতি থাকায় মুসলিম মিল্লাতের মধ্যে কুরআন পঠনে মতানৈক্য সৃষ্টি হয়। এ
অবস্থা অবলোকন করে হযরত উসমান (রা) উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন। তিনি নেতৃস্থানীয় সাহাবীদের সঙ্গে পরামর্শক্রমে যায়দ
ইবনে সাবিতের নেতৃত্বে একটি কমিটি গঠন করেন। এ কমিটি মূল পান্ডুলিপির অনুকরণে একই পঠন রীতিতে
কুরআনের “মাসহাফ” তৈরি করেন, যা মাসহাফে উসমানী নামে প্রসিদ্ধ। তার অনুলিপি সাম্রাজ্যের বিভিন্ন কেন্দ্রে
পাঠিয়ে দেন। আর সতর্কতার জন্য পূর্বের ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা বিভিন্ন আঞ্চলিক উচ্চারণের সমস্তঅংশ বা কপি যার
কাছে যা ছিল, তা তলব করে নেওয়া হয় এবং তা আগুনে পুড়িয়ে বিনষ্ট করে দেয়া হয়। এভাবেই কুরআন মাজীদ
সংরক্ষিত হয়।
চতুর্থ পর্যায়
পরবর্তীকালে কুরআনের সংরক্ষণ
পরবর্তীকালে কুরআনের পাঠ সহজতর করার জন্য হরকত সংযোজন করেন ‘হাজ্জাজ ইবনে ইউসুফ’। তারপর থেকে
কুরআনে আর কোন কিছু অনুপ্রবেশ ঘটানো হয়নি। সে থেকে আজ পর্যন্তকুরআন হাফিযদের স্মৃতি ভান্ডার এবং মুদ্রণ ও
লিপিবদ্ধ আকারে নির্ভুলভাবে সংরক্ষিত রয়েছে এবং কিয়ামত পর্যন্তথাকবে।
সারকথা
বিশ্ব মানবতার প্রতি মহান আল্লাহর সর্বশ্রেষ্ঠ ও অমূল্য অবদান হচ্ছে পবিত্র আল-কুরআন। মহান আল্লাহ স্বয়ং এর
হিফাজতকারী বলে ঘোষণা দিয়েছেন। অপরপক্ষে মহানবীর (সা) আমলে তথা কুরআন নাযিল হওয়ার সময় হতেই এর
লিপিবদ্ধ করণের কাজ চলতে থাকে। পরবর্তীতে খুলাফায়ে রাশিদীনের প্রথম খলীফা হযরত আবূ বকর সিদ্দিক (রা) ও
তৃতীয় খলীফা হযরত উসমান (রা)-এর শাসন আমলে কুরআনের গ্রন্থায়ন কর্মচূড়ান্তরূপ লাভ করে।
কুরআনের সংরক্ষণ মহানবীর (স) যুগ হতে আজ পর্যন্তঅত্যন্তনির্ভরযোগ্য, সুচারুরূপে ও নিয়মানুবর্তিতার মাধ্যমে চলে
আসছে। তাই আল-কুরআনই একমাত্র গ্রন্থ, যা সম্পূর্ণ অবিকৃত ও সংরক্ষিত ঐশীগ্রন্থ।
সঠিক উত্তরের পাশে টিক চিহ্ন দিন
১. আল-কুরআন সর্বপ্রথম কখন লেখা হয় ?
ক. সাহাবীগণের যুগে
খ. মহানবী (স)-এর যুগে
গ. হযরত উসমান (রা)-এর খিলাফতকালে
ঘ. ১০০ হিজরী সালে।
২. কুরআন সংরক্ষণের কয়টি পর্যায়ের কথা উল্লেখ আছে ?
ক. ৫ টি
খ. ৪ টি
গ. ৩ টি
ঘ. ২ টি
৩. বিশ্ব মানবের মুক্তির সনদ কি ?
ক. আল-কুরআন
খ. আল-হাদীস
গ. নবী-রাসূল
ঘ. জিবরাঈল (আ)
৪. জীবন্তকুরআন কে ছিলেন ?
ক. হযরত আবু বকর (রা)
খ. হযরত মুহাম্মদ (স)
গ. হযরত উসমান
ঘ. হযরত আয়েশা (রা)
৫. আল-কুরআনে হরকত সংযোজন করেনক. মহানবী (স)
খ. হযরত উমর (রা)
গ. ইমাম আবু হানীফা (র)
ঘ. হাজ্জাজ ইবনে ইউসুফ
নৈর্ব্যক্তিক প্রশ্নের উত্তর ঃ ১.খ, ২.খ, ৩.ক, ৪.খ, ৫.ঘ
সংক্ষিপ্ত উত্তর প্রশ্ন
১. وقرانھ جمعھ علینا ان ‘এটা সংরক্ষণ ও পাঠ করার দায়িত্ব আমারই’ ব্যাখ্যা করুন।
২. কুরআন সংরক্ষণের পদ্ধতিগুলো কী কী? বর্ণনা করুন।
৩. কুরআন সংরক্ষণের ইতিহাস সংক্ষেপে লিখুন।
বিশদ উত্তর-প্রশ্ন
১. কুরআন সংরক্ষণের পদ্ধতি ও ইতিহাস বর্ণনা করুন।
ইসলামিক স্টাডিজ-১ : উলূমুল-কুরআন ও উলূমুল-হাদীস বিএ/বিএসএস প্রোগ্রাম
ইউনিট-১ : আল-কুরআন: পরিচিতি ও বিষয়বস্তু পৃষ্ঠা-৪২

FOR MORE CLICK HERE
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস মাদার্স পাবলিকেশন্স
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস ১ম পর্ব
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস
আমেরিকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস
বাংলাদেশের ইতিহাস মধ্যযুগ
ভারতে মুসলমানদের ইতিহাস
মুঘল রাজবংশের ইতিহাস
সমাজবিজ্ঞান পরিচিতি
ভূগোল ও পরিবেশ পরিচিতি
অনার্স রাষ্ট্রবিজ্ঞান প্রথম বর্ষ
পৌরনীতি ও সুশাসন
অর্থনীতি
অনার্স ইসলামিক স্টাডিজ প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত
অনার্স দর্শন পরিচিতি প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত

Copyright © Quality Can Do Soft.
Designed and developed by Sohel Rana, Assistant Professor, Kumudini Government College, Tangail. Email: [email protected]