ঈমানের পরিচয় দিন। ঈমানের গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে আপনার মতামত যুক্তিসহ

ঈমানের পরিচয়
ঈমান শব্দের আভিধানিক অর্থ-বিশ্বাস, কারো প্রতি আস্থা পোষণ করে তার কথাকে সত্য বলে মেনে
নেওয়া। ইসলামি পরিভাষায় আল্লাহর রাসূল (স) আমাদের ইন্দ্রিয়াতীত নিগূঢ় সত্য সম্পর্কে যা কিছু
বর্ণনা করেছেন এবং আল্লাহর নিকট থেকে যে জ্ঞান ও হিদায়াতের বাণী বিশ্ববাসীর নিকট পেশ
করেছেন, তা সবই সত্য বলে বিশ্বাস করা ও সর্বতোভাবে কবুল করাকে ঈমান বলা হয়। ইসলামি
শরীআত অনুযায়ী ঈমানের আসল সম্পর্ক হচ্ছে, সে সকল অদৃশ্য বিষয়ের সাথে যা আমাদের ইন্দ্রিয় বা
অন্য কোন যন্ত্র দ্বারা প্রত্যক্ষ করা সম্ভব নয়।
মুসলিম পÐিতগণ ঈমানের সংজ্ঞার ব্যাপারে ভিন্ন মত প্রকাশ করেছেন। নিম্নে কয়েকটি সংজ্ঞা উল্লেখ
করা হলঅধিকাংশ মুহাদ্দিস, যেমন ইমাম মালিক, ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল, ইমাম শাফেঈ (র) প্রমুখের
মতে, আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের প্রতি আন্তরিক বিশ্বাস, মৌখিক স্বীকৃতি এবং রাসূল (স) আনিত জীবন
বিধানকে কার্যে পরিণত করার নাম ঈমান। মুতাযিলা ও খারিজী সম্প্রদায়ের অভিমতও অনুরূপ।
ইমাম আবু হানীফা (র)-এর মতে, আন্তরিক বিশ্বাসের নাম ঈমান, মৌখিক স্বীকৃতি ঈমান এর জন্য শর্ত
এবং আমল হল ঈমানের পরিপূর্ণতা দানকারী।
কাররামিয়া স¤প্রদায়ের মতে, ‘ঈমান’ কেবল মৌখিক স্বীকারোক্তির নাম।
ঈমান অর্থ হল, শরীআতের যাবতীয় Ðকুম-আহকাম অন্তর দিয়ে বিশ্বাস করা এবং এগুলোকে নিজের
দীন হিসেবে বরণ করে নেওয়া। পরিপূর্ণ মুমিন সেই ব্যক্তি যিনি শরীআতের বিষয়গুলোকে গভীরভাবে
বিশ্বাস করেন এবং এগুলোর মৌখিক স্বীকৃতিসহ বাস্তব জীবনে পূর্ণাঙ্গভাবে আমল করে চলেন।
ঈমানের মৌলিক বিষয়সমূহ
ঈমানের মৌলিক বিষয়গুলো পবিত্র কুরআন ও হাদীসের বিভিন্ন স্থানে বর্ণিত আছে। ঈমানে মুফাসসাল
শীর্ষক বাক্যে সেই বিষয়গুলোর সহজ বর্ণনা পাওয়া যায়। যেমন:
امنت باللھ وملئكتھ وكتبھ ورسلھ والیوم الاخر والقدر خیره وشره من
اللھ تعا لى والبعث بعد الموت
“আমি ঈমান আনলাম আল্লাহর উপর, তাঁর ফিরিশতাগণের উপর, তাঁর কিতাবসমূহের উপর, তাঁর
রাসূলগণের উপর, আখিরাতের উপর, তাকদীরের ভাল-মন্দ সব কিছু আল্লাহর ইচ্ছায় হয়-এর উপর
এবং মৃত্যুর পর পুনরুত্থিত হওয়ার উপর।”
উল্লিখিত ঈমানের মৌলিক বিষগুলোর উপর দৃঢ় বিশ্বাস, মুখে স্বীকৃতি এবং সে অনুযায়ী কাজে পরিণত
পাঠ-৪
আল্লাহর রাসূল আমাইেন্দ্রিয়াতীত নিগূঢ় সতসম্পর্কে যা কিছু বর্ণনকরেছেন এবং আল্লাহনিকট থেকে যে জ্ঞানহিদায়াতের বাণী বিশ্বনিকট পেশ করেছেনসবই সত্য বলে বিশ্বাসও সর্বতোভাবে কবুল করাকে ঈমান বলা হ
করা ব্যতীত কস্মিনকালেও ঈমান পরিপূর্ণ হবে না। যিনি এগুলোতে আন্তরিক বিশ্বাস রাখবেন, মুখে
স্বীকার করবেন এবং কর্মে পরিণত করবেন তাকেই মুমিন বলা হবে।
পবিত্র কুরআনের বিভিন্ন আয়াত এবং অসংখ্য হাদীসের মাধ্যমে ঈমানের মৌলিক সাতটি বিষয়ের
বিবরণ পাওয়া যায়। পবিত্র কুরআনে এসেছে-
آم َنَ الرَّ سُولُ ب ِمَا أ ُنزِ لَ إ ِل َیْھِ مِن رَّ بِّھِ وَ الْمُؤْ مِنُونَ كُلٌّ آمَنَ ب ِالل ّھِ وَ مَلآئِكَتِھِ
وَ كُتُب ِھِ وَ رُ سُلِھِ
“রাসূল, তার প্রতি তার প্রতিপালকের পক্ষ থেকে যা অবতীর্ণ হয়েছে তাতে ঈমান এনেছে এবং
মুমিনগণও তাদের সকলে আল্লাহে, তাঁর ফেরেশতাগণে, তাঁর কিতাবসমূহে এবং রাসূলগণে ঈমান
এনেছে।” (সূরা আল-বাকারা : ২৮৫)
সূরা বাকারার ১৭৭ আয়াতে বর্ণিত হয়েছে-
وَ ل َـٰكِنَّ ٱلْب ِرَّ مَنْ آمَنَ ب ِٱلل َّھِ وَ ٱلْیَوْ مِ ٱلآخِ رِ وَ ٱلْمَلا◌ۤ ئِكَةِ وَ ٱلْكِتَابِ وَ ٱلنَّب ِیِّینَ
“পুণ্য আছে কেবল আল্লাহ, পরকাল, ফেরেশতাগণ, সমস্ত কিতাব এবং নবীগণে ঈমান আনয়ন
করলে।” (সূরা আল-বাকারা : ১৭৭)
ঈমানের গুরুত্ব ও তাৎপর্য
যারা ঈমানদার নয় তারা মুসলমান নয়। তাই মুসলিম জীবনে ঈমানের গুরুত্ব ও তাৎপর্য অপরিসীম।
নিম্নে এ সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হলঈমান মানুষকে সৎপথে পরিচালিত করে
ঈমান বা বিশ্বাস অন্ধকারে নিমজ্জিত মানুষকে আলোর পথ দেখায়। কোন মানুষ যখন কালেমা পাঠ করে
ঈমানদারদের দলভুক্ত হয়, তখন মন ও ধ্যান-ধারণায় আমুল পরিবর্তন সাধিত হয়, যার দরুন সে
কুচিন্তা পরিহার করে সৎকর্ম সম্পাদন করতে বাধ্য হয়। এদিক থেকে বিচার করলে ঈমানকে এমন এক
পরশ পাথর বলা যায়, যার ছোঁয়ায় মানুষের অসৎ চিন্তাধারা ধূলিসাৎ হয়ে যায়। তাই একজন ঈমানদার
ব্যক্তির পক্ষে কিছুতেই চুরি, ডাকাতি, খুন ও রাহাজানিসহ কোন প্রকার কবীরা গুনাহে লিপ্ত হওয়া সম্ভব
হয় না।
ঈমান মনে ও কর্মে বিপ্লব সৃষ্টি করে
মন মানুষের দেহকে পরিচলিত করে। দেহ যদি হয় একটি গাড়ির বগি, তাহলে মন হল সে গাড়ির
ইঞ্জিন। মনের চিন্তাধারা, অনুভ‚তি ও ইচ্ছাই ব্যক্তির কর্মে প্রতিফলিত হয়। অর্থাৎ মানুষের মনোজগতই
তার সকল কর্ম ও সকল প্রচেষ্টার ভিত্তিভ‚মি। তাই মনে যখন কোন পরিবর্তন দেখা দেয়, তখন তা
অবশ্যই কর্মে প্রতিফলিত হয়। ভাল কর্ম সম্পাদন করতে হলে ভাল চিন্তা ভাবনার দরকার হয়। তাই
শুভ কাজ সম্পাদনের জন্য ঈমান বিপ্লবের সৃষ্টি করে।
ঈমান মনোবল ও সাহস সঞ্চার করে
আল্লাহর প্রতি অবিচল আস্থা ও বিশ্বাস মানুষের মধ্যে অপরিসীম মনোবল ও অফুরন্ত সাহস সঞ্চার করে।
ঈমানদার মানুষ যখন কোন বিপদাপদ ও উত্থান-পতনের সম্মুখীন হয়, তখন সে শুধু সর্বশক্তিমান
আল্লাহর কাছেই আত্মসমর্পণ করে এবং তাঁরই নিকট সাহায্য কামনা করে। কেননা তার সাহস ও
মনোবল এত মজবুত যে, সে পার্থিব কোন লোভ-লালসায় আকৃষ্ট হয় না। জীবনের সর্বাবস্থায় সে এক
পরম শক্তির অস্তিত্ব অনুভব করে যা তাকে সুখের আতিশয্যে দিশেহারা না হতে এবং দুঃখের দিনে
হতাশ না হতে সাহায্য করে।
ঈমান মানুষকে নম্র ও বিনয়ী করে
যারা প্রকৃত ঈমানদার তাদের ধন-সম্পদ ও বিদ্যা বুদ্ধির দর্প থাকতে পারে না। কেননা তারা মনে
করে, তাদের যা কিছু আছে সবই মহান আল্লাহর দান। তিনি ইচ্ছা করলে যে কোন মুহ‚র্তেই এগুলো
কেড়ে নিতে পারেন। ঈমানদার ব্যক্তি মাত্রই জানে যে, পৃথিবীর সকল মানুষ আল্লাহর সৃষ্টি। তাই ধনী-
দরিদ্র, ছোট-বড় সকলকেই সে সমান চোখে দেখে। তার মনে কখনো অহংকারের ছায়াপাতে কালিমা
লিপ্ত হতে পারে না। সে বিনয় ও নম্রতার সাথে সকলের সঙ্গে দিনাতিপাত করে এবং আল্লাহর দানের
শুকরিয়া আদায় করে।
ঈমান ধৈর্য ধারণের প্রেরণা যোগায়
মহান প্রভুর প্রতি অবিচল বিশ্বাসই মানুষকে ধৈর্যধারণ করার শক্তি যোগায়। জীবনের ঝুঁকিপূর্ণ
বিপদাপদ, দুঃখ-বঞ্চনা এমনকি মৃত্যুর বিভীষিকাও তার মনে ভীতির সঞ্চার করতে পারে না। আল্লাহর
প্রেম তার মন হতে সকল ভয়-ভীতি অপসারণ করে তাকে এক দুর্দমনীয় মনোবলের অধিকারী করে
তোলে। শত শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন চালিয়েও আল্লাহর প্রতি আস্থা থেকে তাকে ফিরানো যায়
না।
ঈমান মানুষকে নির্ভুল জীবন পথের সন্ধান দেয়
ঈমানদার ব্যক্তি শুধু আল্লাহর একত্বেই বিশ্বাস করে না, সে বিশ্বাস স্থাপন করে নবী-রাসূলগণের প্রতি,
আসমানী কিতাবের প্রতি এবং পরকাল বা শেষ বিচারের প্রতি। তাই সে নবীগণের প্রদর্শিত পথেই জীবন
যাপনের চেষ্টা করে। ঈমানী শক্তির বলেই সে নিজেকে আল্লাহর আদর্শ বান্দা ও রাসূলের প্রকৃত উম্মাত
হিসেবে গড়ে তোলে।
ঈমান মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি প্রসারিত করে
ঈমানদার ব্যক্তি বিশ্বাস করে যে, বিশ্বের সকল কিছুই আল্লাহর নিয়ন্ত্রণাধীন, সব কিছুই একমাত্র আল্লাহর
করুণার ওপর নির্ভরশীল। এ দৃষ্টিভঙ্গি একজন ঈমানদারকে স্মরণ করিয়ে দেয় যে, সারা বিশ্বই আল্লাহর
সাম্রাজ্য। কেননা ঈমান তার অন্তর্দৃষ্টিকে প্রসারিত করে দিয়েছে। দেখার দুটি চোখ ছাড়াও তার এমন
দুটি ঈমানী চোখ থাকে যা দ্বারা সে সমস্ত বিশ্বের সব কিছুই দেখে নিতে পারে।
ঈমান আত্মসম্ভ্রম ও আত্মমর্যাদাবোধ সৃষ্টি করে
পবিত্র কুরআন ও হাদীসের অমিয় বাণী ঈমানদার ব্যক্তির অন্তরকে স্বচ্ছ করে দিয়েছে। তাই সে অনুভব
করতে পারে, পৃথিবীর সৃষ্ট বস্তুর মধ্যে মানুষই সর্বশ্রেষ্ঠ। এ বিশ্বাসবোধ তার আত্মশক্তিকে মজবুত করে
দেয়। সে বিশ্বাস করে যে, বিশ্বের সর্বময় কর্তৃত্ব একমাত্র আল্লাহর। তাই সকল গুণগান বা প্রশংসা তাঁর
প্রাপ্য। এ বিশ্বাসই একজন মানুষের মনে আত্মমর্যাদাবোধ সৃষ্টি করে এবং মহৎ জীবন গড়ে তুলতে উদ্বুূদ্ধ করে।
ঈমান ইসলামের মৌল ভিত্তি
ঈমান হচ্ছে ইসলামের মূলভিত্তি। ঈমান মুসলিম জাতির প্রাণশক্তির মূল উৎস হিসেবে বিবেচিত। জীবনমরণে, সুদিন-দুর্দিনে বিশ্বের একমাত্র সৃষ্টিকর্তা ও পালনকর্তা আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের ওপরই
নির্ভরতা একত্ববাদের মূলকথা।
ঈমান অনবদ্য চেতনা
ঈমান এক অনবদ্য চেতনা। আল্লাহর একত্ববাদ মুমিনের অফুরন্ত প্রেরণা আত্মার পরম পুলক। জীবনের
দুর্যোগময় মুহ‚র্তে অথবা আনন্দমুখর হাস্যোজ্জ্বল দিনে কোন অবস্থায়ই মুমিনকে একত্ববাদের পথ থেকে
একবিন্দুও বিচ্যুত করা যায় না।
ঈমান জীবন চলার দিশারী
ঈমান মুমিনের জন্য জীবন চলার পথের একমাত্র দিশারী।
বÐত্ববাদের নাকচ : এক ভিন্ন একাধিকের কোন স্থান এখানে নেই। মুমিনের অন্তরে আল্লাহ একক
অধিকারে সমাসীন। তাই বÐত্ববাদ, দ্বিত্ববাদ, ত্রিত্ববাদ, না খোদাবাদ ও পৌত্তলিকতাবাদের বিরুদ্ধে
ইসলাম আপোসহীন।
ইসলামীক স্টাডিজ-২ : আল-কালাম ও আল-ফিক্হ বিএ/বিএসএস প্রোগ্রাম
ইউনিট-২ : তাওহীদ বা আল্লাহর একত্ববাদ পৃষ্ঠা # ৪৩
অন্যের সামনে মুমিনের মাথা অবনত হয় না
ঈমানদার আল্লাহর পর আর কাউকে বড় মনে করে না। তারা আল্লাহর প্রতিনিধি। এ বিশ্বাসের ফলে
তারা কোন সৃষ্টিজীবের কাছে মাথা নত করে না। বিশ্বাসী কখনো অপমাণিত, বিজিত ও অপরের
Ðকুমের তাবেদার হয় না। সদা সর্বদাই সে চির বিজয়ী ও মর্যাদাবান নেতা, আর তাই বিশ্বাসের ফলে
সে চির বলীয়ান থাকে।
ঈমান মানবাত্মাকে করে চির উন্নত, হৃদয়কে করে বিমল পুণ্যালোকে সমুদ্ভাসিত। তার চির উন্নত শির
আল্লাহ ছাড়া কারে কাছে অবনত হয় না। তার হাত কারো সামনে প্রসারিত হয় না।
বিশ্বাস মানুষের মধ্যে আত্মসচেতনতা ও আত্মমর্যাদাবোধ জাগিয়ে তোলে। এর ফলে উদার দৃষ্টিভঙ্গির
সৃষ্টি হয় এবং সংকল্প হয় সুদৃঢ়।
মুমিন ইন্দ্রীয় পুঁজারী হয় না
ঈমানদার কখনো অতি আরামপুজারী ইন্দ্রীয়পরতার দাস বলগাহারা ও লোভাতুর হয় না। সৎ ও
পরিশ্রমলব্ধ জীবনবোধে উজ্জীবিত হয়, তাই তার চেয়ে ধনী ও ঐশ্বর্যশালী আর কেউ নয়। ঈমানদার
সকলের অধিকার পূরণ করে, সৃষ্টির কল্যাণে সদা ব্যস্ত থাকে; ফলে গোটা সৃষ্টি তার বন্ধু ও প্রিয়জন হয়ে
ওঠে।
ঈমান কর্ম চেতনার মূল উৎস
ঈমানের ফলে মানুষের সকল কাজ চলে একটি অপরিমেয় চেতনায় ও বিশ্বাসের ভিত্তিমূলে। তার কোন
কাজ বিফলে যায় না। তার সব কাজ আল্লাহ দেখছেন। এ ঈমানের ফলে মানুষের মনোজগতে সৃষ্টি হয়
এক অপার ও দুর্বারগতি ও চেতনা, যা সমগ্র কর্মচাঞ্চল্যের মূল উৎস।
ঈমান মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি প্রসারিত করে
বিশ্বাস মানুষের দৃষ্টিভঙ্গিকে প্রসারিত করে। সমগ্র বিশ্বকে আল্লাহর রাজ্য বলে মনে করার ফলে সমগ্র
বিশ্বকেই বিশ্বাসীগণ আপন মনে করে। আল্লাহর একত্বের ধারণা মুমিনকে সংকীর্ণতার বেষ্টনী হতে মুক্ত
করে উদারতা ও আন্তর্জাতিকতার বলয়ে নিয়ে আসে। ফলে সে হয়ে ওঠে উদার ও আন্তর্জাতিক।
স্বার্থপরতার গøানি থেকে মুক্ত করে
ঈমানের ফলশ্রæতিতে মানুষ সংকীর্ণ স্বার্থপরতার গøানি থেকে মুক্ত হয়ে সকল সৃষ্টিলোকের কল্যাণ ও
মঙ্গল কামনায় সে সকল কাজ করে থাকে। সে সকলকে আপন বলে ভাবে এবং নিজের স্বার্থের দিকে না
তাকিয়ে অপরের সুবিধার কথা চিন্তা করে। তাই তার মধ্যে লোভ- লালসা, কামনা-বাসনা ও
হীনস্বার্থপরতা জন্ম নিতে পারে না।
ইসলামের পরিচয়
ইসলাম হচ্ছে বিশ্বস্রষ্টা মহান আল্লাহর মনোনীত একমাত্র শাশ্বত জীবন দর্শন ও পূর্ণাঙ্গ জীবন ব্যবস্থা।
আর ইসলামের মূল বিষয়গুলোকে অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে দৃঢ় প্রত্যয়ের সাথে বিশ্বাস, মৌখিক স্বীকৃতি
এবং জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে বাস্তবায়নের নাম হল ঈমান। ইসলামের মূল বিষয়গুলোর মাঝে ঈমানের
অবস্থান সবার উপরে। ঈমানের সােেথ ইসলামের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বিদ্যমান। একটি আরেকটির অবিচ্ছেদ্য
অংগ। একটি আরেকটির পরিপূরক। ইসলাম ব্যতীত ঈমানের যেমন কোন ভিত্তি নেই, তেমনি ঈমান
ছাড়া ইসলামের কোন অস্তিত্ব পাওয়া যায় না। তাই ঈমান ও ইসলাম শব্দের অর্থের মধ্যে পার্থক্য
থাকলেও উভয়ের মধ্যে রয়েছে নিবিড় সম্পর্ক।
আভিধানিক অর্থ
আভিধানিক দৃষ্টিকোণ থেকে ইসলাম শব্দটি সিলমুন (سلم (ও সালামুন (سلام (শব্দ হতে এসেছে। এর
শাব্দিক অর্থ-আনুগত্য ও আত্মসমর্পণ করা, শান্তির পথে চলা, নিরাপদ থাকা, নিরাপত্তা দেওয়া ও লাভ
করা। যেমন মহানবী (স) বলেন, تسلم اسلم- “যদি তুমি ইসলাম গ্রহণ কর (আত্মসমর্পণ কর) তাহলে নিরাপত্তা লাভ করবে।” (বুখারী)
পারিভাষিক অর্থ
ইসলাম হচ্ছে, বিশ্বস্রষ্টা মহান আল্লাহর প্রতি আত্মরিকভাবে বিশ্বাস স্থাপন করে তাঁর কাছে পূর্ণ আনুগত্য
ও আত্মসমর্পণ করা। বিনা দ্বিধায় তাঁর বিধানাবলী ও আদেশ-নিষেধ মেনে চলা।
মুসলিম ধর্মতত্ত¡বিদগণ এর সংজ্ঞায় বলেন, মনেপ্রাণে আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (স)-এর নিকট আত্মসমর্পণ
করা এবং আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের প্রতি মৌখিক স্বীকৃতি দান করে ইসলামের অনুশাসনগুলো পালন করা
ও নিষিদ্ধ কাজ থেকে বিরত থাকার নাম ইসলাম।
ইমাম আবু হানীফা (র) বলেছেন-
الاسلام : التسلیم والانقیاد لاوامر اللھ تعا لى .
“ইসলাম হচ্ছে, আল্লাহ তা’আলার সকল আদেশকে মেনে নেওয়া ও আত্মসমর্পণ করা।”
শরীআতের পরিভাষায়- আল্লাহর অনুগত হওয়া, আনুগত্য করা ও তাঁর নিকট পূর্ণ আত্মসমর্পণ করা,
বিনা দ্বিধায় তাঁর আদেশ নিষেধ মেনে চলা এবং তাঁর দেওয়া বিধান অনুসারে জীবন যাপন করা। আর
যিনি ইসলামের বিধান অনুসারে জীবন যাপন করেন, তিনি হলেন মুসলিম বা মুসলমান।
ইসলাম আল্লাহর মনোনীত একমাত্র ‘দীন’ -একটি পূর্ণাঙ্গ ও পরিপূর্ণজীবন ব্যবস্থা। দোলনা থেকে কবর
পর্যন্তএ ব্যবস্থার আলোকে একজন মুসলমানকে জীবন যাপন করতে হয়। ইসলামে রয়েছে সুষ্ঠু সমাজ,
রাষ্ট্রও অর্থব্যবস্থা। রয়েছে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক নীতিমালা। মানব চরিত্রের উৎকর্ষসাধন, ন্যায়নীতি
ও সুবিচারের ভিত্তিতে শান্তি-শৃঙ্খলাপূর্ণগতিশীল সুন্দর সমাজ গঠন ও সংরক্ষণে ইসলামের কোন বিকল্প
নেই, হতেও পারে না। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তা’আলা ইরশাদ করেন :
إ ِنَّ الدِّینَ عِندَ ٱلل َّھِ ٱلإِ سْلاَمُ
“নিঃসন্দেহে ইসলামই আল্লাহর নিকট একমাত্র দীন।” (সূরা আলে-ইমরান : ১৯)।
অন্যত্র ইরশাদ হয়েছে :
وَ مَن یَبْتَغ ِ غَیْرَ ٱلإِ سْلاَمِ دِینا ً فَل َنْ یُقْبَلَ مِنْھُ
“কেউ ইসলাম ব্যতীত অন্য কোন দীন গ্রহণ করতে চাইলে তা কখনো কবুল করা হবে না।” (সূরা
আলে-ইমরান : ৮৫)
ইসলামের একটি সংজ্ঞা ও পরিচিতি হাদীস শরীফে সুন্দরভাবে বিবৃত হয়েছে। রাসূলুল্লাহ (স) ইরশাদ
করেন :
الاسلام أن تشھد أن لا إلھ الا اللھ وأن محمدا رسول اللھ و تقیم
الصلوة و تؤتى الز كوة و تصوم رمضان وتحج البیت إن استطعت
إلیھ سبیلا .
“ইসলাম হল একথার সাক্ষ্য দেওয়া যে, আল্লাহ ব্যতীত কোন ইলাহ নেই এবং মুহাম্মদ (স) আল্লাহর
রাসূল, সালাত আদায় করা, যাকাত প্রদান করা, রমযানের রোযা পালন করা এবং যাতায়াতের সামর্থ্য
থাকলে বায়তুল্লাহ শরীফের হজ্জ আদায় করা।” (বুখারী ও মুসলিম)
বস্তুত ইসলামই সকল নবী-রাসূলের অভিন্ন ধর্ম। হযরত আদম (আ) থেকে শুরু করে শেষ নবী হযরত
মুহাম্মদ (স) পর্যন্তআগমনকারী সকল নবী-রাসূল মানুষকে ইসলামের দিকে আহবান করেছেন এবং
এরই ভিত্তিতে নিজ নিজ উম্মাতকে গড়ে তুলেছেন।
ইসলাম ধর্মের মর্ম হল, আল্লাহর পরিপূর্ণ আনুগত্য করা। আর প্রত্যেক পয়গাম্বরই যেহেতু নিজে
আল্লাহর পূর্ণ অনুগত থাকার সাথে সাথে উম্মাতকেও এর দিকে দাওয়াত দিয়েছেন, তাই সকল নবীর
দীনই ইসলাম।
ইসলাম হচ্ছে, বিশ্বস্রমহান আল্লাহর প্রতি আন্তরিকভাবে বিশ্বাসকরে তাঁর কাছে পূর্ণ আনুগত্য ও আত্মসমকরা। বিনা দ্বিধায় তঁবিধানাবলী ও আদেশনিষেধ মেনে চলা।
হযরত ইব্রাহীম (আ)-ই সর্বপ্রথম নিজ ধর্মের নাম ইসলাম ও তার উম্মতকে উম্মতে মুসলিমা বলে
অভিহিত করেছেন। ইরশাদ হয়েছে :
رَ بَّنَا وَ ٱجْع َلْنَا مُسْلِمَیْنِ ل َكَ وَ مِن ذ ُرِّ یَّتِنَآ أ ُ مَّة ً مُّسْلِمَة ً ل َّكَ
“হে আমাদের প্রতিপালক! আমাদের উভয়কে তোমার একান্তঅনুগত বানাও এবং আমাদের বংশধর
হতেও তোমার এক অনুগত উম্মত বানাও।” (সূরা আল-বাকারা : ১২৮)
হযরত ইবরাহীম (আ) তাঁর সন্তানদের উপদেশ দিয়ে বলেন :
فَلاَ تَمُوتُنَّ إَلا َّ وَ أ َنْتُم مُّسْلِمُ ونَ
“তোমরা মুসলিম না হওয়া পর্যন্তমৃত্যুবরণ করো না।” (সূরা আল-বাকারা : ১৩২)
হযরত ইবরাহীম (আ) উম্মতে মুহাম্মদীকে এ নামে অভিহিত করেছেন। আল-কুরআনে ইরশাদ হয়েছে:
مِّل َّة َ أ َب ِیكُمْ إ ِبْرَ اھِیمَ ھُوَ سَمَّاكُمُ ٱلْمُسْلِمِینَ مِن قَبْلُ وَ فِى ھَـٰذَا
“এটা তোমাদের পিতা ইবরাহীমের মিল্লাত। তিনি ইত:পূর্বেতোমাদের নামকরণ করেছেন ‘মুসলিম’ এবং
এ কিতাবেও।”(সূরা আল-হজ্জ : ৭৮)
মোটকথা নবী ও রাসূলগণের প্রচারিত ধর্মে মৌলিক কোন পার্থক্য ছিল না। কিন্তুপ্রত্যেকের শরীআত
ছিল ভিন্ন। আল-কুরআনে ইরশাদ হয়েছে :
لِكُلٍّ جَع َلْنَا مِنكُمْ شِرْ عَة ً وَ مِنْھَاجا ً
“আমি তোমাদের প্রত্যেকের জন্য শরীআত ও স্পষ্টপথ নির্ধারণ করেছি।” (সূরা আল-মায়িদা: ৪৮)
হযরত আদম (আঃ) থেকে আরম্ভকরে নবী-রাসূলগণের যে ধারবাহিকতা শুরু হয়েছিল তার পরিসমাপ্তি
ঘটেছে হযরত মুহাম্মদ (স)-এর মাধ্যমে। তিনি আখেরী নবী। তাঁর পরে আর কোন নবী-রাসূল
আসবেন না। তাঁর আগমনে পুর্ববর্তী সমস্তশরীআত রহিত হয়ে গেছে। তাই এখন ‘ইসলাম’ বলতে
হযরত মুহাম্মদ (স)-এর আনীত শরীআতকে এবং মুসলিম বলতে উম্মতে মুহাম্মদীকেই বুঝায়। এ
হিসেবে ইসলামের সংজ্ঞা নিম্নরূপ :
ھو تصدیق سیدنا محمد صلى اللھ علیھ وسلم فى جمیع ما جاء بھ عن
اللھ تعالى مما علم مجیئھ ضرورة.
“আল্লাহ তা’আলার পক্ষ থেকে হযরত মুহাম্মদ (স) যে আদর্শ ও বিধি-বিধান নিয়ে এসেছেন এবং যা
অকাট্যভাবে প্রমাণিত, তা মনে-প্রাণে বিশ্বাস করাকে ইসলাম বলা হয়।”
প্রকৃতপক্ষে রাসূলুল্লাহ (স)-এর নির্দেশনা মুতাবেক নিজেকে আল্লাহর নিকট সঁপে দেওয়া এবং
পরিপূর্ণভাবে আত্মসমর্পণ করার নামই হল ইসলাম। যে আত্মসমর্পণ করে তাকে বলা হয় মুসলিম।
ইসলাম গ্রহণ করার পর কোন ব্যক্তির ইসলাম পরিপন্থী নিজস্ব খেয়াল-খুশি এবং ধ্যান-ধারণার আলোকে
অনুসরণের কোন সুযোগ থাকে না। সে তো আল্লাহর গোলাম। তার জীবন-মরণ সব কিছুই এক আল্লাহর
উদ্দেশ্যে নিবেদিত। আল-কুরআনে ইরশাদ হয়েছে :
وَ مَا كَانَ لِمُؤْ مِنٍ وَ لاَ مُؤْ مِنَةٍ إ ِذَا قَضَى ٱلل َّھُ وَ رَ سُول ُھُ أ َمْرا ً أ َن یَكُونَ ل َھُمُ
ٱلْخِ یَرَ ةُ مِنْ أ َمْرِ ھِمْ وَ مَن یَعْصِ ٱلل َّھَ وَ رَ سُول َھُ فَقَدْ ضَلَّ ضَلاَلا ً مُّب ِینا ً
“আল্লাহ ও তাঁর রাসূল কোন বিষয়ে নির্দেশ দিলে কোন মুমিন পুরুষ কিংবা মুমিন নারীর সে বিষয়ে ভিন্ন
সিদ্ধান্তের অধিকার থাকবে না। কেউ আল্লাহ ও তাঁর রাসূলকে অমান্য করলে সে তো স্পষ্টই পথভ্রষ্ট
হবে।” (সূরা আল-আহযাব : ৩৬)
এ আত্মসমর্পণের মূর্তপ্রতীক ছিলেন রাসূলুল্লাহ (স)। তিনি জীবনের কোন ক্ষেত্রে এক বিন্দু পরিমাণও
এ থেকে বিচ্যুত হননি। সাহাবায়ে কিরামকে একইভাবে গড়ে তুলেছিলেন তিনি তাঁর প্রত্যক্ষ
লাম’ বলতে হযরত হাম্মদ (স) আনীত াতকে এবং মুসলিম বলতে উম্মতে হাম্মদীকেই বুঝায়। আল্লাহ তা’আলার পক্ষ হযরত মুহাম্মদ (স) আদর্শ ও বিধি-বিধান য়ে এসেছেন এবং যা াট্যভাবে প্রমাণিত তা প্রাণে বিশ্বাস করাকে ইসলাম বলা হয়। সলাম হচ্ছে, বিশ্বস্রষ্টা মহান আল্লাহর প্রতি রকভাবে বিশ্বাস স্থাপন
করে তাঁর কাছে পূর্ণ নুগত্য ও আত্মসমর্পণ রা। বিনা দ্বিধায় তাঁর
বধানাবলী ও আদেশনিষেধ মেনে চলা।
তত্ত¡াবধানে।”
ইসলাম মানুষের স্বভাবজাত ধর্ম
ইসলাম মানুষের স্বভাবজাত ধর্ম-দীনে ফিতরাত। আল্লাহ তা’আলা মানুষকে যে সহজাত প্রকৃতি দিয়ে
সৃষ্টি করেছেন, তাই হল ‘ফিতরাত’। হাদীস শরীফে বর্ণিত রয়েছে :
كل مولود یولد على الفطرة
“প্রতিটি শিশুই সহজাত প্রকৃতি তথা ইসলামের উপর জন্মগ্রহণ করে।”
মহান আল্লাহ বলেন-
فَأ َقِمْ وَ جْھَكَ لِلدِّینِ حَنِیفا ً فِطْرَ ةَ ٱلل َّھِ ٱل َّتِى فَط َرَ ٱلنَّاسَ عَل َیْھَا لاَ تَبْدِیلَ
لِخَلْقِ ٱلل َّھِ ذٰ لِكَ ٱلدِّینُ ٱل ْقَیِّمُ وَ ل َـٰكِنَّ أ َكْث َرَ ٱلنَّاسِ لاَ یَعْل َمُونَ
“তুমি একনিষ্ঠ হয়ে নিজেকে দীনে ফিরিয়ে নাও। আল্লাহর প্রকৃতির অনুসরণ কর, যে প্রকৃতি অনুযায়ী
তিনি মানুষ সৃষ্টি করেছেন। আল্লাহর সৃষ্টিতে কোন পরিবর্তন নেই। এটাই সরল দীন; কিন্তুঅধিকাংশ
মানুষ তা জানে না।” (সূরা আর-রুম : ৩০)
ইসলাম আল্লাহর মনোনীত একমাত্র দীন ও পূর্ণাঙ্গ জীবনব্যবস্থা
হযরত মুহাম্মদ (স) আল্লাহ তা’আলার আখেরি নবী। কুরআন তাঁর প্রতি নাযিলকৃত আখেরী কিতাব।
মহানবী (স)-এর আগমনের পর পূর্ববর্তী শরীআত ও কিতাব সবই রহিত হয়ে গেছে। এরপর আর কোন
নবী আসবেন না এবং কোন কিতাবও নাযিল হবে না। যাঁরা এ আকীদা পোষণ করবেন তারা মুসলিম।
আর যারা এ আকীদা পোষণ করবে না, তারা অমুসলিম-কাফির।
ইসলাম পূর্ণাঙ্গ জীবনব্যবস্থা। এতে কোন খুঁত নেই, নেই কোন অপূর্ণতা। আল-কুরআনে ইরশাদ হয়েছে
:
ٱلْیَوْ مَ أ َكْمَل ْتُ ل َكُمْ دِینَكُمْ وَ أ َت ْمَمْتُ عَل َیْكُمْ نِعْمَتِى وَ رَ ضِ یتُ ل َكُمُ ٱلأِسْلاَمَ
دِینا ً
“আজ আমি তোমাদের জন্য তোমাদের দীন পূর্ণাঙ্গ করলাম ও তোমাদের প্রতি আমার অনুগ্রহ স¤পূর্ণ
করলাম এবং ইসলামকে তোমাদের দীন মনোনীত করলাম।” (সূরা আল-মায়িদা : ৩)
কুরআন মজীদে আরও ইরশাদ হয়েছে :
وَ نَزَّ لْنَا عَل َیْكَ ٱلْكِتَابَ تِبْیَانا ً ل ِّكُلِّ شَيْءٍ
“আমি তোমার প্রতি এমন কিতাব অবতীর্ণ করেছি যার মধ্যে প্রতিটি বস্তুর স্পষ্ট বর্ণনা বিদ্যমান।” (সূরা
আন-নাহল : ৮৯)
এতে এ কথা বোঝা যায় যে, মানব জীবনে যা কিছু প্রয়োজন তার সব কিছুর নীতি নির্ধারণী বিবরণ
আল-কুরআনে আছে। প্রয়োজনীয় জ্ঞানানুশীলনের মাধ্যমে রাসূলুল্লাহ (স)-এর পবিত্র জীবনাদর্শের
ভিত্তিতে সবকিছুই নির্ধারণ করতে হবে।
ইসলাম আল্লাহ প্রদত্ত এমন এক জীবনব্যবস্থা যা ভারসাম্যপূর্ণ, স্বভাবসম্মত এবং মানবিক সামর্থ্যরে
উপযোগী। আল-কুরআনে ঘোষণা করা হয়েছে :
لاَ یُكَل ِّفُ ٱلل َّھُ نَف ْسا ً إ ِلا َّ وُ سْع َھَا
“আল্লাহ কারো উপর এমন কোন দায়িত্ব অর্পণ করেন না যা তার সাধ্যাতীত।” (সূরা আল-বাকারা :
২৮৬)
ইসলাম শান্তিপূর্ণ, নির্ভেজাল এবং ভারসাম্যপূর্ণ জীবনাদর্শের বাস্তবায়ন ঘটাতে চায়। মানব জীবনের
কোন একটি বিষয় অথবা কোন একটি দিকের উপর অধিক গুরুত্ব আরোপ করা এবং স্বাভাবিক ভারসাম্য
বিনষ্ট করাকে ইসলাম কোনক্রমেই সমর্থন করে না। ইবাদাত- বন্দেগী, ব্যবসা-বাণিজ্য, লেনদেন,
আচার-আচরণ ও আমল-আখলাক তথা জীবনের কোন স্তরে এমন কিছু করা আদৌ ইসলাম সম্মত নয়,
যা ঈমান ও মানবতার ক্ষতি সাধন করে।
ইসলাম শান্তিও স¤প্রীতির ধর্ম
ইসলাম শান্তিও সম্প্রীতির ধর্ম। ইসলাম নিজেদের মত অন্যদেরকেও ভালবাসতে উদ্বুদ্ধ করে। ইসলাম
মানুষকে নিজের, স্বজনের, সমাজের, স্বদেশের তথা বিশ্ববাসীর কল্যাণের জন্য সক্রিয় ভূমিকা পালনে ও
ত্যাগ স্বীকারে প্রেরণা যোগায়। আর তাতেই বিশ্ববাসীর জীবন ধারায় নেমে আসে প্রশান্তিএবং বিদূরিত
হয় অশান্তি, হিংসা-বিদ্বেষ এবং হানাহানি। ইসলামের শিক্ষা হল, মানুষে মানুষে কোন ভেদাভেদ নেই।
সাদা-কালো সকল মানুষই আল্লাহর বান্দা। সমগ্র মানবজাতি একই পরিবারভুক্ত। রাসূলুল্লাহ (স) বলেন :
الخلق عیال اللھ
“সকল সৃষ্টি আল্লাহর পরিবারের ন্যায়।” (মিশকাত)
বস্তুত, সমগ্র মানবজাতি একটি দেহের মত। কেননা আমরা সকলেই আদম ও হাওয়া (আ)-এর
সন্তান। আল-কুরআনে বর্ণিত হয়েছে :
یٰأ َیُّھَا ٱلنَّاسُ إ ِنَّا خَل َقْنَاكُم مِّن ذَكَرٍ وَ أ ُنْث َىٰ وَ جَع َلْنَاكُمْ شُعُوبا ً وَ قَبَآئِلَ
لِتَع َارَ ف ُوۤ ا ْ إ ِ نَّ أ َكْرَ مَكُمْ عِ ندَ ٱلل َّھِ أ َت ْقَاكُمْ إ ِ نَّ ٱلل َّھَ عَلِیمٌ خَب ِیرٌ
“হে মানুষ! আমি তোমাদেরকে সৃষ্টি করেছি এক পুরুষ ও এক নারী হতে, পরে তোমাদেরকে বিভক্ত
করেছি বিভিন্ন জাতি ও গোত্রে, যাতে তোমরা একে অপরের সাথে পরিচিত হতে পার। তোমাদের মধ্যে
আল্লাহর নিকট সেই ব্যক্তি অধিক মর্যাদাসম্পন্ন যে অধিক মুত্তাকী। নিশ্চয় আল্লাহ্ সব কিছুজানেন,
সমস্তখবর রাখেন।” (সূরা আল-Ðজুরাত : ১৩)
মানুষের দৈনন্দিন জীবন যাপনে প্রাণী ও প্রাকৃতিক সম্পদ আবশ্যক। তাই পৃথিবীতে শান্তিও সমৃদ্ধির
লক্ষ্যে ইসলাম শুধু মানুষের প্রতিই সদয় ব্যবহারের নির্দেশ দেয়নি, উপরন্তু প্রাণীর পরিচর্যা, প্রাকৃতিক
সম্পদ ও উদ্ভিদের যথার্থ ব্যবহার সম্পর্কেও ইসলাম গুরুত্ব আরোপ করেছে। রাসূলুল্লাহ (স) বলেছেন:
الراحمون یرحمھم الرحمن ارحموا من فى الأرض یرحمكم من فى
السماء.
“যারা দয়া করে, দয়াময় আল্লাহ তাদের প্রতি দয়া করেন। তোমরা পৃথিবীবাসীদের প্রতি দয়া কর
তাহলে আকাশবাসী (আল্লাহ) তোমাদের প্রতি দয়া করবেন।” (তিরমিযি ও আবু দাউদ)
“হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা) থেকে বর্ণিত। একদা তিনি রাসূলুল্লাহ (স)-এর সংগে আরাফাত
হতে মুযদালিফার দিকে যাচ্ছিলেন। তখন নবী করীম (স) তাঁর পিছনে উট হাকানো এবং প্রহারের
আওয়াজ শুনতে পেলেন। তিনি তাদের দিকে ফিরে চাবুক দিয়ে ইশারা করে বললেন, হে লোকসকল!
তোমরা ধীর-স্থিরভাবে চল। কেননা উট দৌঁড়িয়ে নিয়ে যাওয়া কোন নেকীর কাজ নয়।” (মিশকাত,
হজ্জ অধ্যায়)
মোটকথা সমস্তসৃষ্টি-জড়, অজড়, প্রাণি ও প্রকৃতি সকলেই ইসলামের উদারতায় উদ্ভাসিত। ইসলাম শুধু
বিশ্বাসভিত্তিক ধর্ম নয়। বরং তা বিশ্বাস ও কর্মের এক সুষম সমন্বয়ের বাস্তব অভিব্যক্তি। সে জন্যই
বৈরাগ্যবাদ ইসলামে নিষিদ্ধ। রাসূলুল্লাহ (স) ইরশাদ করেছেনঃ
لا رھبا نیة فى الإسلام
“ইসলামে বৈরাগ্যবাদের স্থান নেই।”
এই হাদীসের এ বাণী প্রতিটি মানুষকে নিজের জন্য, আত্মীয়-স্বজনের জন্য, পরের জন্য, দেশের জন্য,
জাতির জন্য তথা বিশ্বের জন্য কর্মে উদ্বুদ্ধ করে। কর্মই মূলত মানুষের মানবীয় পরিচয় বিকাশের এবং
মনুষ্যত্ব প্রকাশের সুযোগ এনে দেয়। কাজেই প্রত্যেক মুসলমানকে তার নিত্যদিনের চিন্তা-কর্মে এ কথা
প্রমাণ করতে হবে যে, সে আল্লাহর বান্দা এবং নবী (স)-এর উম্মত।
আল-কুরআনে ইরশাদ হয়েছে :
وَ مَا خَل َقْتُ ٱل ْجِ نَّ وَ ٱلإِ نسَ إ ِلا َّ لِیَعْبُدُونِ
“আমি জিন ও মানুষকে শুধু আমার ইবাদতের জন্যই সৃষ্টি করেছি।” (সূরা আয-যারিয়াত : ৫৬)
উল্লিখিত আয়াতে যে ইবাদতের কথা ব্যক্ত হয়েছে, সে ইবাদাত শুধু নামায, রোযা, হজ্জ, যাকাত
ইত্যাদিতে সীমাবদ্ধ নয় বরং উপরোক্ত আমলের আগে পরে কর্মমুখর মুহূর্তগুলোতেও আল্লাহ
তা’আলাকে বেশি বেশি স্মরণ করতে হবে যেন বৈষয়িক লোভ-লালসায় পড়ে কেউ পথভ্রষ্ট ও বিপথগামী
না হয়ে যায়। প্রতিদিনের সকল কাজ-কর্মে আল্লাহর নির্দেশ পালন ও রাসূলুল্লাহ (স)-এর আদর্শের
অনুসরণই হল উল্লিখিত আয়াতে ইবাদতের মূল তাৎপর্য।
ইসলামের পথে সুদৃঢ় ঐক্য গড়ে
বিশ্বাসী মানুষ সকলেই এক পরিবারের, একই জাতির বলে নিজেদের মনে করে। দেশ, কাল, ভাষা,
বর্ণ, গোত্র কোন বিভেদই তাদের মধ্যে অনৈক্য বা বৈষম্য সৃষ্টি করতে পারে না। সবাই মিলে হয় এক
অখÐ জাতি। তারা সব সময় ঐক্য কামনা করে। আল্লাহর পথে তারা ঐক্যবদ্ধ হয়ে থাকতে পারে।
যেমন-আল্লাহর বাণী:
وَ ٱعْتَصِ مُوا ْ ب ِحَبْلِ ٱلل َّھِ جَمِیعا ً وَ لاَ تَفَرَّ ق ُوا ْ
“তোমরা সকলে আল্লাহর রজ্জুকে দৃঢ়ভাবে ধারণ কর এবং পরস্পর বিচ্ছিন্ন হয়ো না।” (সূরা আলেইমরান : ১০৩)
পরিশেষে বলা যায়, ঈমান ইসলামের কেন্দ্রবিন্দুও ইসলামের মূল ভিত্তি। এর ওপর মানুষের জীবনের
যাবতীয় কর্মফল নির্ভরশীল। মানুষের জীবনের প্রকৃতি নির্ভর করে তার বিশ্বাসের ওপর। ঈমানের
ওপরই ইসলামের গোটা প্রাসাদ গড়ে উঠেছে। এর অভাবে ইসলামের গোটা ব্যবস্থাপনা ভেঙ্গে চুরমার
হয়ে যায়। মোটকথা, মানুষ যা বিশ্বাস করে সেভাবেই জীবন পরিচালনায় প্রবৃত্ত হয়। এক কথায় বলা
হয়, ঈমান প্রত্যেক মানুষের জন্য অবশ্য প্রয়োজনীয় এবং সকল সৎকর্মের মূলভিত্তি। তাই মানব জীবনে এর গুরুত্ব ও তাৎপর্যঅপরিসীম।
 সঠিক উত্তরের পাশে টিক ( চিহ্ন দিন১. ইসলাম-এর শাব্দিক অর্থ-
ক) শান্তি;
খ) সুখ;
গ) আত্মসমর্পণ করা;
ঘ) কোনটিই সঠিক নয়।
২. ইসলাম হচ্ছে আল্লাহ তা’আলার সকল আদেশকে মেনে নেওয়া ও আত্মসমর্পণ করা- এটি কার
উক্তি?
ক) হযরত আবু বকর (রা)-এর;
খ) হযরত আয়িশা (রা)-এর;
গ) হযরত ইবরাহীম (আ)-এর;
ঘ) ইমাম আবু হানীফা (র)-এর।
৩. ঈমান কেবল মৌখিক স্বীকারোক্তির নাম-এটি কার কথা?
ক) কাররামিয়াদের;
খ) শিয়াদের;
গ) মুতাযিলাদের;
ঘ) খারেজীদের।
৪. ইমাম আবু হানীফার মতে মুখে স্বীকৃতি প্রদানক) ঈমানের শর্ত;
খ) ঈমানের পূর্ণতা দানকারী;
গ) ইসলামের শর্ত;
গ) প্রয়োজন নেই।
সংক্ষিপ্ত উত্তর-প্রশ্ন
১. ইসলামের পারিভাষিক অর্থ লিখুন।
২. ইসলামের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে ইমাম আবু হানীফা কী বলেছেন? লিখুন।
৩. ইসলাম মানুষের স্বভাবজাত ধর্ম-বুঝিয়ে লিখুন।
৪. ইসলাম একটি পূর্ণাঙ্গ জীবন ব্যবস্থা-ব্যাখ্যা করুন।
৫. ‘ইসলামে বৈরাগ্যবাদের অবকাশ নেই’ বুঝিয়ে লিখুন।
৬. ঈমানের পরিচয় দিন।
৭. ঈমানের মৌলিক বিষয়গুলো কয়টি এবং কী কী? লিখুন।
৮. ঈমানের গুরুত্ব লিখুন।
বিশদ উত্তর-প্রশ্ন
১. ইসলাম আল্লাহর মনোনীত একমাত্র পূর্ণাঙ্গ জীবন ব্যবস্থা-এ ব্যাপারে আপনার মতামত যুক্তিসহ উপস্থাপন করুন।
২. ঈমানের পরিচয় দিন। ঈমানের গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে আপনার মতামত যুক্তিসহ উপস্থাপন করুন।

FOR MORE CLICK HERE
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস মাদার্স পাবলিকেশন্স
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস ১ম পর্ব
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস
আমেরিকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস
বাংলাদেশের ইতিহাস মধ্যযুগ
ভারতে মুসলমানদের ইতিহাস
মুঘল রাজবংশের ইতিহাস
সমাজবিজ্ঞান পরিচিতি
ভূগোল ও পরিবেশ পরিচিতি
অনার্স রাষ্ট্রবিজ্ঞান প্রথম বর্ষ
পৌরনীতি ও সুশাসন
অর্থনীতি
অনার্স ইসলামিক স্টাডিজ প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত
অনার্স দর্শন পরিচিতি প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত

Copyright © Quality Can Do Soft.
Designed and developed by Sohel Rana, Assistant Professor, Kumudini Government College, Tangail. Email: [email protected]