‘জামিউল কুরআন’ কে ছিলেন ? হযরত উসমান (রা) কর্তৃক কুরআন গ্রন্থায়ন সংস্থার মূলনীতি কী ছিল?

আল-কুরআনের গ্রন্থায়ন
পবিত্র কুরআন সংরক্ষণ ও গ্রন্থায়নের ব্যাপারে বিভিন্ন সূত্র থেকে যে তথ্য পাওয়া যায় তা থেকে বুঝা যায় যে, কুরআন
মাজীদ তিনবার সংকলিত হয়েছে। যেমন১. প্রথমবার হযরত মুহাম্মদ (স)-এর নবুওয়াতের আমলে
২. দ্বিতীয়বার প্রথম খলীফা হযরত আবু বকরের (রা) সময়ে
৩. তৃতীয়বার তৃতীয় খলীফা হযরত উসমানের (রা) খিলাফতকালে।
মহানবী (স)-এর আমলে
মহানবী (স)-এর আমলে তথা কুরআনের ওহী নাযিল হওয়াকালীন সময়ে পবিত্র কুরআনকে একখানি পূর্ণাঙ্গ গ্রন্থে
রূপদান করা সম্ভব হয়নি। কেননা তখনও ক্রমাগতভাবে কুরআন নাযিল হচ্ছিল। এ সময় কুরআন নাযিল হওয়ার সাথে
সাথে তা লিখে রাখা হতো। ওহী লেখকদের সংখ্যা ছিল ৪২ জন। তাঁরা পালাক্রমে রাসূলের (স) কাছে থাকতেন এবং
যখন যা নাযিল হতো, তা লিখে রাখতেন।
কুরআন ও হাদীসের অগণিত বর্ণনা থেকে এর প্রমাণ মেলে। হযরত আলী (রা) বলেন,
ان القران كان مجموعا مؤلفا على عھد النبى صلى اللھ علیھ وسلم
“রাসূলুল্লাহ্র (স) সময়েও কুরআনের সংগৃহীত, সংকলিত ও লিখিত পান্ডুলিপি বিদ্যমান ছিল।”
ইমাম মালিক (র) বর্ণনা করেন-
انما الف القران على ما كانوا یسمعونھ من النبى صلى اللھ علیھ وسلم.
“সাহাবীগণ যেভাবে রাসূলুল্লাহ্র (স) নিকট হতে কুরআন শ্রবণ করতেন, সেভাবেই কুরআন লিপিবদ্ধ করা হতো।”
ইমাম নববী (র) বলেন,
ان القران كان مؤلفا فى زمن النبى صلى اللھ علیھ وسلم على ما ھوفى
المصاحف الیوم -
“রাসূলের (স) সময়ে যে কুরআন লিপিবদ্ধ হয়েছিল বর্তমান কুরআন শরীফ সেভাবেই বিদ্যমান আছে।”
ইমাম আহমদের মুসনাদে একটি বর্ণনা রয়েছে। সাহাবীগণ বলেন,
بین اظھرنا المصاحف وقد تعلمنا ما فیھا وعلمناھا نساءنا وذرارینا وخدمنا
“আমাদের নিকট যথারীতি কুরআন লিখিত ছিল। এর সাহায্যে আমরা নিজেরা কুরআন শিক্ষা করতাম, আমাদের স্ত্রীপুত্র ও খাদেমদেরকে শিক্ষা দিতাম।”
তাফসীরে মাজমাউল কুরআনে আছে - “পবিত্র কুরআন বর্তমানে যেভাবে আছে রাসূলের (স) সময়েও ঠিক সেভাবেই
ছিল।”
তিনি আরো বহু প্রমাণ দিয়ে মন্তব্য করেন, “এর দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, রাসূলের (স) সময়ও কুরআনের গ্রন্থায়ন কর্ম
বিদ্যমান ছিল।”
স্বয়ং রাসূলের নিকটও কুরআনের পান্ডুলিপি সংরক্ষিত ছিল। ইমাম বুখারী এ ব্যাপারে সুস্পষ্ট প্রমাণ তুলে ধরেছেন।
যেমন, ইবনে আব্বাস ও ইবনুল হানফিয়া বর্ণনা করেন-
ماترك النبى صلى اللھ علیھ وسلم الا ما بین الدفتین
“রাসূলুল্লাহ্ (স) মলাটের মধ্যে গ্রন্থায়িত পুরো কুরআনের পান্ডুলিপি ছাড়া অন্য কিছু রেখে যাননি।” (বুখারী)
আল্লামা আইনী (র) বলেছেন, “সাহাবীগণ চামড়ায় কুরআন লিখতেন এবং তা কাঠের দু’টি মলাটের মধ্যে রেখে
দিতেন।” (ফাতহুল বারী) এভাবে সকলের কাছে ঐ কুরআন লিখিত ছিল। জনগণ তা দেখে দেখে পাঠ করতেন,
শিক্ষা দিতেন এবং গবেষণা করতেন। রাসূলুল্লাহ্ (স)-এর সময়ে কারা কুরআন লিপিবদ্ধ করতেন এবং ওহী লিখন
বিভাগের সদস্য ছিলেন এর বিস্তারিত বর্ণনা বিভিন্ন সীরাত ও হাদীসের বর্ণনায় দেখা যায়।
‘তাদভীনে কুরআন’ নামক গ্রন্থে প্রামাণ্য দলীলসহ কুরআন গ্রন্থায়নের দায়িত্ব প্রাপ্ত সাহাবীদের সংখ্যা বিয়াল্লিশ জন বলে
উল্লেখ রয়েছে। আল্লামা ইরাকী (র) এ ৪২ জনের নামও উল্লেখ করেছেন। তাঁদের মধ্যে প্রসিদ্ধ কয়েকজন হলেন- (১)
হযরত আবূ বকর (রা); (২) হযরত উমর (রা); (৩) উসমান (রা); (৪) আলী (রা); (৫) উবাই ইবনে কা’ব (রা);
(৬) আব্দুল্লাহ ইবনে আবী সারাহ; (৭) যুবাইর ইবনে আওয়াম; (৮) খালিদ ইবনে সাঈদ (রা); (৯) আবান ইবনে
সাঈদ; (১০) হানযালা ইবনে রাবী; (১১) মুআইকিব ইবনে আবি ফাতিমা; (১২) আব্দুল্লাহ ইবনে আরকাম; (১৩)
শুরাহবীল ইবনে হাসানা; (১৪) আব্দুল্লাহ ইবনে রাওয়াহা; (১৫) আমের ইবনে যুবাইর; (১৬) আমর ইবনে আস; (১৭)
সাবিত ইবনে কায়স; (১৮) মুগীরা ইবনে শু’বা; (১৯) খালিদ ইবনে ওয়ালীদ; (২০) মুআবিয়া ইবনে আবি সুফিয়ান;
(২১) যায়িদ ইবনে সাবিত (রা.)।
উপরের বর্ণনা হতে সুস্পষ্টভাবে বুঝা যায় যে, নবী কারীম (স)-এর আমলে কুরআন নাযিলের সাথে সাথে
নিয়মতান্ত্রিকভাবে তা লিপিবদ্ধ করা হয়েছে। সাহাবীগণ কুরআন মুখস্থ করার সাথে সাথে এ লিপিবদ্ধকরণের মহতী
কাজে গুরুত্বপূর্ণভূমিকা পালন করেছেন।
প্রথম খলীফা হযরত আবূ বকর (রা)-এর আমলে লিপিবদ্ধকরণ
মহানবীর (স) ইনতিকালের পর প্রথম খলীফা হযরত আবূ বকর (রা)-এর খিলাফত আমলে ইসলাম বিরোধী চক্র মাথা
চাড়া দিয়ে উঠে। এ সময়ে ভন্ড নবীদের বিরুদ্ধে পরিচালিত জিহাদে কুরআনের বহু হাফিয সাহাবী শাহাদত বরণ
করেন। ১১ হিজরী সালের যিলহাজ্জ মাসে ইয়ামামা নামক স্থানে ধর্মত্যাগী ভন্ড নবীদের সঙ্গে মুসলমানদের এক ভয়াবহ
রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল। এ যুদ্ধে মুসলিম বাহিনীর সেনাপতি ছিলেন খালিদ ইবনে ওয়ালীদ (রা)।
ধর্মত্যাগীদের দলপতি ছিল মুসাইলিমা কাযযাব। এ যুদ্ধে এত বেশি হাফিয়ে কুরআন শহীদ হয়েছিলেন যে, মক্কা ও
মদীনার হাফিযের সংখ্যা অনেক হ্রাস পায়। এভাবে হাফিযগণ শাহাদাত বরণ করতে থাকলে কুরআন মাজীদ সংরক্ষণ
করা দুরূহ হয়ে পড়বে। তদুপরি কুরআনের অংশ বিশেষ চিরতরে হারিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা দেখা দিতে পারে। এ
অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে দূরদর্শীসাহাবী হযরত উমর (রা) খলীফা হযরত আবূ বকর (রা)-কে কুরআন সংগ্রহ করে একটা
গ্রন্থাকারে গ্রন্থায়নের সরকারি ব্যবস্থা গ্রহণের প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরেন।
হযরত আবূ বকর (রা) হযরত উমরের (রা) পরামর্শকে গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করে প্রবীণ সাহাবীদের সাথে পরামর্শ
করেন। মহানবী (স) যে কাজটি করে যেতে পারেননি, তা করার সীমাহীন গুরুত্ব ও কল্যাণের দিক বিবেচনা করে এ
প্রস্তাবে সম্মত হন। তিনি কুরআন সংকলনের মহতী কাজে হাত দেন।
হযরত আবূ বকর (রা) মহানবী (স) -এর “ওহী লিখন দফতরের” প্রধান সচিব হযরত যায়দ ইবনে সাবিত (রা)-কে
প্রধান করে একটি “কুরআন গ্রন্থায়ন কমিশন” গঠন করেন। তাঁদের উপর কুরআন গ্রন্থায়নের দায়িত্বভার অর্পণ করেন।
তিনি মুসলিম জাহানের সর্বত্র ফরমান জারি করেন যে, যার কাছে কুরআনের যে অংশই রয়েছে, তা এ কমিশনের নিকট
জমা দান করতে। ‘কমিশন’ মহানবীর (স) জীবদ্দশায় লিখিত পান্ডুলিপি অনুসরণে কুরআনের সূরা ও আয়াতসমূহ
সংগ্রহ করে একখানি প্রামাণ্য পান্ডুলিপি পুস্তকাকারে প্রস্তুত করেন। এব্যাপারে এত বেশি সতর্কতা অবলম্বন করা হয় যে,
এক একটি আয়াতের ব্যাপারে বহু হাফিযের সাক্ষাৎকার ও সাহাবীদের লিখিত পান্ডুলিপির সাথে বার বার মিলিয়ে নিতে
বহু সময় ব্যয় করতে হয়। সর্বদিক দিয়ে সকল সাহাবীর ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর তা লিখিত হয়। আল্লামা সূয়ূতী
(র) বর্ণনা করেন“রাসূল (স)-এর সময় বিক্ষিপ্ত আকারে কুরআনের পান্ডুলিপি মওজুদ ছিল। তারপর হযরত আবূ বকর (রা)-এর হুকুমে
হযরত যায়দ ইবনে সাবিত (রা) সেগুলোকে একত্রে গ্রন্থাবদ্ধ করে এক সূতায় গেঁথে দেন।” (আল-ইতকান খ. ১,পৃ. ৮৩)
তারপর একে রাষ্ট্রীয়ভাবে হিফাযত করা হয়। পরে দ্বিতীয় খলীফা হযরত উমরের (রা) ইনতিকালের পর নবীপতœী উম্মুল
মু’মিনীন হযরত হাফসার (রা) নিকট তা সংরক্ষিত থাকে।
হযরত আবু বকরের (রা) সময়কার পান্ডুলিপিটির বৈশিষ্ট্য ছিল নি¤œরূপ১. প্রতিটি সূরা পৃথক পৃথক করে লিখা হয়েছিল। তাই তা অনেকগুলো সহীফায় বিভক্ত ছিল। এগুলোকে ‘উম্ম’ বা মূল
পান্ডুলিপি বলা হতো।
২. মহানবীর (স) নির্দেশিত ও বিন্যাস পদ্ধতি মোতাবেক আয়াতগুলো সূরাসমূহের মধ্যে ধারাবহিকভাবে বিন্যাস করা
হয়েছিল। সূরাগুলো ধারাবাহিক করা হয়নি; বরং প্রতি সূরা আলাদা আলাদা লেখা হয়েছিল।
৩. এ পান্ডুলিপিতে ‘কুরআনের সাতটি’ পঠনরীতিই সন্নিবেশিত করা হয়েছিল।
৪. এ পান্ডুলিপি ‘হিরী’ লিখন প্রণালীতে লেখা হয়েছিল।
৫. যে সব আয়াতের তিলাওয়াত মানসুখ হয়নি, কেবল সে আয়াতগুলোই ধারাবাহিকভাবে লেখা হয়েছিল।
৬. এ পান্ডুলিপিটি এমন নির্ভুল ও বিশুদ্ধভাবে সর্বসম্মত ঐকমত্যের ভিত্তিতে তৈরি করা হয়, যাতে প্রয়োজনে সবাই এ
মূল কপি থেকে নিজ নিজ নুসখা শুদ্ধ করে নিতে পারেন।
পরবর্তীতে হযরত উসমান (রা)-এর আমলে এ মূল নুসখা থেকে এই পাঠন রীতির নুসখা প্রস্তুত করা হয়েছিল।
কুরআন গ্রন্থায়নে তৃতীয় খলীফা হযরত উসমানের (রা) অবদান
তৃতীয় ফলীফা হযরত উসমান (রা)-এর খিলাফতকালে ইসলাম আরব সীমান্তপেরিয়ে পারস্য ও রোমের বি¯তৃর্ণ
এলাকায় বিস্তার লাভ করে। ব্যাপকাকারে ইসলামের প্রচার ও প্রসারের ফলে বিভিন্ন জাতি ও ভাষা-ভাষীর লোক
ইসলামের পতাকাতলে সমবেত হয়। স্বভাবতই অনারব লোকেরা আরব-কুরায়শদের ভঙ্গিতে আরবী ভাষায় কোন কোন
শব্দ উচ্চরণ করতে পারত না। ফলে আঞ্চলিক উচ্চরণের প্রভাবে কুরআনের বিশুদ্ধ পাঠে পার্থক্য দেখা দেয়। তাছাড়া
কুরআন শরীফ সাত হরফ বা সাতটি আঞ্চলিক নাযিল হয়েছিল। সাহাবীগণ রাসূলুল্লাহ্র (স) কাছ থেকে উক্ত সাত
পঠনরীতিতে কুরআন তিলাওয়াত শিখেছিলেন। আর যে সাহাবী যেভাবে শিখেছেন, তিনি সেভাবেই অন্যদের
শিখাতেন। এভাবে বিভিন্ন পঠন পদ্ধতি বহু দূর দেশ পর্যন্তছড়িয়ে পড়েছিল। কোথাও কোথাও বিভিন্ন পদ্ধতির গঠন
নিয়ে বিভ্রান্তিও মতভেদ সৃষ্টি হতেও দেখা যায়।
হযরত উসমানের (রা) সময় কারী ও হাফিয সাহাবীদের সংখ্যা দ্রæত কমতে থাকে। অনেকেই ইনতিকাল করেন। এ
সময় হযরত হুযাইফা ইবনুল ইয়ামান (রা) যুদ্ধ উপলক্ষে আযারবাইজান ও আরমেনিয়া গমন করেন। সেখানে তিনি
ইরাক ও সিরিয়াবাসীদের মধ্যে কুরআন পাঠে পার্থক্য লক্ষ্য করেন। পরে তিনি মদীনায় ফিরে এসে খলীফা উসমান
(রা)-এর নিকট কুরআন পাঠের পার্থক্য ও বিভিন্ন অঞ্চলে কুরআনের পান্ডুলিপির স্বল্পতা ও দু¯প্রাপ্যতা সম্পর্কে দৃষ্টি
আকর্ষণ করেন। তিনি খলীফাকে বলেন, “পূর্ববর্তী আসমানী কিতাবসমূহের ন্যায় কুরআনেও রদবদল দেখা দিতে
পারে। ইয়াহূদী-খ্রিস্টাানদের ন্যায় মুসলমানগণও বিভ্রান্তিও মতভেদের শিকার হতে পারে। তাই কুরআনের অনুলিপি
তৈরির ব্যাপারে খুবই সতর্কতা অবলম্বন করা উচিত। তাহলে সকল মুসলিম দেশে একই পান্ডুলিপি ও একই পঠনরীতি
অনুসৃত হবে। কেননা ইসলামের বিজয় ব্যাপক বি¯তৃতি লাভ করেছে। মুসলমানগণের সংখ্যাও দিন দিন বেড়েই
চলেছে। রাসূলুল্লাহ্ (স) ও প্রথম খলীফা হযরত আবু বকর (রা)-এর সময় যাদের কাছে কয়েকটি সূরার খন্ড খন্ড
পান্ডুলিপি ছিল- তাঁদের ব্যাপারেও ভয় ছিল যে, অদূর ভবিষ্যতে তাঁদের ঐ খন্ড খন্ড অংশকেই হয়ত তাঁরা সম্পূর্ণ
কুরআন বলে মনে করবে অথবা প্রত্যেকেই আলাদা আলাদা পঠনরীতি অনুসরণ করবে। এ সব অবস্থায় ইয়াহূদী ও
খ্রিস্টানদের ধর্মগ্রন্থের ন্যায় কুরআনেরও নানা পার্থক্য দেখা দিতে পারে। উল্লিখিত অবস্থা সামনে রেখে মুসলমানদের
সংখ্যা বৃদ্ধির দিক বিবেচনা করে কুরআনের আরো অধিক সংখ্যক পান্ডুলিপি সরকারি তত্ত¡াবধানে প্রস্তুত করা,
সেগুলোকে সরকারি উদ্যোগে বিভিন্ন মুসলিম দেশ ও অঞ্চলে প্রেরণ করা উচিত। সর্বোপরি লিখন পদ্ধতি ও পঠনরীতির
পার্থক্যের জন্য মতানৈক্য দেখা দেয়ার যে ভয় রয়েছে, তাও দূর করা অপরিহার্য।”
খলীফা হযরত উসমান (রা) হুযাইফা ইবনুল ইয়ামানের উপরোক্ত প্রস্তাবের গুরুত্ব বিবেচনা করে বিশিষ্ট সাহাবীগণের
সাথে পরামর্শ করার জন্য সভা আহবান করেন। তিনি তাঁদের উদ্দেশ্যে বলেন, “আমি শুনতে পেয়েছি যে, এক শ্রেণীর
লোক অন্যদেরকে শুনিয়ে বলে, আমাদের কিরাআত তোমাদের চেয়ে উত্তম এবং সবচেয়ে শুদ্ধ। অথচ এ ধরনের কথা
কুফরির দিকে ধাবিত করতে পারে। সুতরাং এ সমস্যা সমাধানের ব্যাপারে আপনারা কী মতামত দেন?”
সাহাবীগণ বলেন, আপনি এ ব্যাপারে কী চিন্তা করেছেন? হযরত উসমান (রা) বলেন, “আমার প্রস্তাব হচ্ছে, সকল শুদ্ধ
বর্ণনা একত্র করে একটি সর্বসম্মত মাসহাফ প্রস্তুত করা অপরিহার্য, যাতে কিরাআত পদ্ধতির মধ্যে কোন মতভেদের
সম্ভাবনা না থাকে।” সাহাবীগণ সর্বসম্মতভাবে হযরত উসমানের ঐ অভিমত সমর্থন করেন। এ ব্যাপারে সামগ্রিকভাবে
সহযোগিতা প্রদানের জন্য তারা অংগীকার করেন। তারপর খলীফা হযরত উসমান (রা) সর্বশ্রেণীর মুসলমানদের
উদ্দেশ্যে এক জরুরি ভাষণ দেন। ভাষণে তিনি বলেন, “আপনারা মদীনাতে আমার কাছে যাঁরা আছেন- তাঁরাও
কুরআন শরীফের পাঠের ব্যাপারে একে অপরকে দোষারোপ এবং মত বিরোধ করেন। এতেই বোঝা যায়, যারা আমার
নিকট থেকে বহু দূর-দূরান্তেবসবাস করছেন, তারা এ ব্যাপারে আরো বেশি বিভ্রান্তিতে রয়েছেন। কাজেই আসুন,
আমরা সকলে মিলে কুরআন শরীফের এমন একটি মাসহাফ প্রস্তুত করি, যাতে কারো পক্ষে মতভেদ করার কোনই
অবকাশ থাকবে না এবং সকলের পক্ষে তা অনুসরণ করা অপরিহার্য কর্তব্য বলে বিবেচিত হবে।”
সমগ্র মুসলিম উম্মাহ খলীফা হযরত উসমানের (রা) এ মহতী উদ্যোগকে স্বাগত জানান এবং সর্বতোভাবে সহযোগিতা
করেন।
হযরত উসমান (রা) কয়েকজন বিশিষ্ট সাহাবী- যারা রাসূলের (স) এবং প্রথম খলীফার সময়ে ওহী লিখন ও গ্রন্থায়ন
কমিশনের সদস্য ছিলেন- তাঁদের সমন্বয়ে যায়দ ইবনে সাবিতের (রা) তত্ত¡াবধানে একটি সংস্থা গঠন করেন। এ
সংস্থাকে কতগুলো মূলনীতির ভিত্তিতে কুরআনের অভিন্ন ও বিশুদ্ধ নুসখা তৈরি করতে বলা হয়।
প্রাথমিকভাবে এ সংস্থার চারজন সদস্য ছিলেন। তাঁরা হলেন১. যায়দ ইবনে সাবিত (রা)
২. আবদুল্লাহ ইবনে যুবাইর (রা)
৩. সাঈদ ইবনুল আস (রা) এবং
৪. আবদুর রহমান ইবনে হারিস ইবনে হিশাম (রা)
দায়িত্ব প্রাপ্ত এ চারজনের মধ্যে যায়দ ইবনে সাবিত ছিলেন মদীনাবাসী। অন্যরা ছিলেন কুরায়শ বংশের। পরে এ
সংস্থার সাথে আরো বহু সাহাবীকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল। ইমাম আবূ দাউদের বর্ণনা অনুযায়ী তাঁদের সদস্য সংখ্যা
ছিল ১২ জন। এঁদের মধ্যে উবাই ইবনে কা’ব, কাসীর ইবনে আফলাহ, মালিক ইবনে আবি আমের, আনাস ইবনে
মালিক, আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা) প্রমুখও অন্তর্ভুক্ত ছিলেন।
খলীফা হযরত উসমান (রা) উম্মুল মু’মিনীন হযরত হাফসা (রা)-এর কাছে রক্ষিত আবু বকরের (রা) সময়কার
‘কুরআনের মূল পান্ডুলিপিটি’ চেয়ে আনেন। এ পান্ডুলিপি অনুসরণ করে নতুন পান্ডুলিপি তৈরির জন্য নির্দেশ দান
করেন। আর কুরআনের লিখন ও পঠন পদ্ধতিতে মতপার্থক্য দৃষ্টি হলে কুরায়শী রীতিতে লেখার পরামর্শ দেন। কেননা
পবিত্র কুরআন কুরায়শী ভাষায়ই নাযিল হয়েছিল।
কুরআন গ্রন্থায়নে এ সংস্থার মূলনীতি ছিল নি¤œরূপ
ক. প্রথম খলীফা হযরত আবু বকরের (রা) আমলের মূল পান্ডলিপির অনুকরণে সূরার ক্রমানুসারে একই মাসহাফে
সন্নিবেশন। কেননা ঐ পান্ডুলিপিতে প্রত্যেকটি সুরা আলাদা নুসখায় লিখিত ছিল।
খ. কেবল একই পঠন পদ্ধতিতে কুরআনের ‘মাসহাফ’ প্রস্তুত করতে হবে।
গ. কুরআনের সর্বসম্মত ও প্রামাণ্য মূল পান্ডুলিপির অনুলিপি তৈরি করে প্রাদেশিক গভর্নরদের কাছে প্রেরণ করা হয়।
আর তারই অনুসরণ করার জন্য সরকারিভাবে নির্দেশ জারি করেন।
ঘ. আবু বকরের (রা) সময়ের মূল পান্ডুলিপিখানিও পুনঃপরীক্ষা-নিরীক্ষা এবং যাচাই-বাছাই করে দেখা হয়।
ঙ. মূল পান্ডুলিপি রেখে বাকি যার কাছেই কুরআনের যে অংশ বা পান্ডুলিপি ছিল, তা তলব করে নেওয়া হয়।
অধিকতর সতর্কতার জন্য তা আগুনে পুড়িয়ে বিনষ্ট করে দেয়া হয়।
এভাবেই কুরআন মাজীদ তৃতীয় খলীফা হযরত উসমানের (রা) প্রত্যক্ষ তত্ত¡াবধানে গ্রন্থবদ্ধ হয়। তাঁর এ গুরুত্বপূর্ণ
আবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ ইসলামী জাহান তাঁকে ‘জামিউল কুরআন’ বা ‘কুরআন সংকলনকারী’ উপাধিতে ভূষিত করেন।
হাফিয ইবনে কাসীর এ ব্যাপারে তাঁর “ফাদাইলুল কুরআন’ গ্রন্থে বিস্তারিত আলোচনার পর লেখেন-
ھو جمع الناس على قراءة واحدة لئلا یختلفوا فى القران
কুরআন পঠনে যাতে পার্থক্য দেখা না দেয়, সে জন্য “হযরত উসমান (রা) লোকজনকে একই কিরাআতে ঐক্যবদ্ধ
করেছেন।”
উপরোক্ত আলোচনা হতে এটা প্রমাণিত হয় যে, হযরত উসমান (রা)-এ পান্ডুলিপি হযরত আবু বকর (রা)-এর
পান্ডুলিপির অবিকল অনুলিপি ছিল। হযরত আবু বকরের (রা) পান্ডুলিপিটি রাসূলুল্লাহ্ (স)-এর পান্ডুলিপির অবকিল
অনুলিপি ছিল। আল-কুরআনের এ পান্ডুলিপির বিশুদ্ধতার ব্যাপারে সকল সাহাবী একমত ছিলেন। সুতরাং খলীফা
উসমানের (রা) এ মহৎ কাজটি সমগ্র উম্মাহ প্রশংসার দৃষ্টিতে দেখেছেন। সাহাবীগণ সর্বসম্মতভাবে এ কাজে সার্বিক
সহযোগিতা দান করেছেন।
আমাদের নিকট যে কুরআন মাজীদ বর্তমান, তা সেটারই অবিকল অনুলিপি। এভাবেই আল্লাহ তা’আলা কুরআনকে চির
অবিকৃত রাখার ব্যবস্থা করলেন।
সারকথা
বিশ্ব মানবতার প্রতি মহান আল্লাহর সর্বশ্রেষ্ঠ ও অমূল্য অবদান হচ্ছে আল-কুরআন। মহান আল্লাহ স্বয়ং এর সংরক্ষক
বলে ঘোষণা দিয়েছেন। অপরপক্ষে মহানবীর (স) আমলে তথা কুরআন নাযিল হওয়ার সময় হতেই এবং পরবর্তীতে
খুলাফায়ে রাশিদীনের প্রথম খলীফা হযরত আবূ বকর সিদ্দীক (রা) ও তৃতীয় খলীফা হযরত উসমান (রা) এর শাসন
আমলে কুরআনের গ্রন্থায়ন কাজ চূড়ান্তরূপ লাভ করে।
পবিত্র কুরআন সংরক্ষণ ও গ্রন্থায়নের ব্যাপারে ভিন্ন সূত্র থেকে মনীষী হাকিম ‘মুস্তাদরাক’ গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন যে,
কুরআন মাজীদ তিনবার গ্রন্থবদ্ধ হয়েছে। রাসূল (স)-এর আমলে, প্রথম খলীফা হযরত আবু বকর (রা) এর সময়ে
এবং তৃতীয় খলীফা হযরত উসমান (রা) এর আমলে। কুরআনের এ গ্রন্থায়ন আল্লাহর হুকুম অনুসারে মহানবী (স)
কর্তৃক সাজানো আয়াত ও সূরাসমূহের ধারাবাহিকতায় কোন পরিবর্তন করা হয়নি। বর্তমানে কুরআন মাজীদের
সূরাগুলো ঠিক ঐভাবেই সজ্জিত রয়েছে, যেভাবে লাওহে মাহফুযে কুরআন সংরক্ষিত আছে। তাই কুরআনই একমাত্র গ্রন্থ যা সম্পূর্ণ অবিকৃত ও সংরক্ষিত ঐশী গ্রন্থ।
সঠিক উত্তরের পাশে টিক চিহ্ন দিন
১. আল-কুরআন কতবার গ্রন্থবদ্ধ হয়েছে ?
ক. ৭ বার
খ. ৩ বার
গ. ১ বার
ঘ. ৬ বার।
২. কুরআন গ্রন্থায়নকারী সাহাবীগণে সংখ্যা ছিল ?
ক. ১০ জন
খ. ৪০ জন
গ. ৪২ জন
ঘ. ৩৯ জন।
৩. ইয়ামামার যুদ্ধ সংঘটিত হয়ক. মহানবী (স)-এর যুগে
খ. হযরত উমর (রা)-এর যুগে
গ. হযরত আবু বকর (রা)-এর যুগে
ঘ. হযরত উসমান (রা)-এর যুগে
৪. প্রাথমিকভাবে হযরত উসমান (রা) কুরআন গ্রন্থায়নের জন্য নিয়োগ দেনক. ৫ জন
খ. ৪ জন
গ. ১০ জন
ঘ. ১২ জন।
নৈর্ব্যক্তিক প্রশ্নের উত্তর ঃ ১.খ, ২.গ, ৩.গ, ৪. খ
সংক্ষিপ্ত উত্তর প্রশ্ন
১. মহানবী (স)-এর আমলে কুরআন গ্রন্থায়ন ব্যবস্থা কেমন ছিল ?
২. কুরআন গ্রন্থায়নকারী সাহাবীদের সংখ্যা কত জন ? তাঁদের মধ্যে প্রসিদ্ধ কয়েকজনের তালিকা প্রস্তুত করুন।
৩. প্রথম খলীফা হযরত আবু বকর (রা)-এর আমলে কুরআন গ্রন্থায়নের জন্য কী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছিল এবং
কেন ? বর্ণনা করুন।
৪. হযরত আবু বকর (রা) কর্তৃক গ্রন্থায়নকৃত পান্ডুলিপির বৈশিষ্ট্য বর্ণনা করুন।
৫. এক ও অভিন্ন ভাষায় কুরআন গ্রন্থায়নে হযরত উসমান (রা)-এর ভূমিকা বিশ্লেষণ করুন।
৬. ‘জামিউল কুরআন’ কে ছিলেন ? তাঁর সম্পর্কে লিখুন।
৭. হযরত উসমান (রা) কর্তৃক কুরআন গ্রন্থায়ন সংস্থার মূলনীতি কী ছিল? আলোচনা করুন।
বিশদ উত্তর-প্রশ্ন
১. কুরআন গ্রন্থায়নের ইতিহাস লিখুন।

FOR MORE CLICK HERE
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস মাদার্স পাবলিকেশন্স
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস ১ম পর্ব
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস
আমেরিকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস
বাংলাদেশের ইতিহাস মধ্যযুগ
ভারতে মুসলমানদের ইতিহাস
মুঘল রাজবংশের ইতিহাস
সমাজবিজ্ঞান পরিচিতি
ভূগোল ও পরিবেশ পরিচিতি
অনার্স রাষ্ট্রবিজ্ঞান প্রথম বর্ষ
পৌরনীতি ও সুশাসন
অর্থনীতি
অনার্স ইসলামিক স্টাডিজ প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত
অনার্স দর্শন পরিচিতি প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত

Copyright © Quality Can Do Soft.
Designed and developed by Sohel Rana, Assistant Professor, Kumudini Government College, Tangail. Email: [email protected]