সত্যের প্রকৃতি ও পরীক্ষার রূপ নিয়ে দার্শনিকদের মধ্যে মতভেদ আছে। তাঁরা সবাই এক
মতে বিশ্বাস করেন না। দর্শনের ইতিহাস আলোচনা করলে আমরা তাই মোটামুটি চারটি
মতবাদ পাই। এদের নাম স্বতঃ প্রতীতিবাদ, সঙ্গতিবাদ, অনুরূপতাবাদ ও প্রয়োগবাদ। আমরা
এই পাঠে সত্যতা সম্পর্কীয় এই মতবাদগুলি নিয়ে আলোচনা করবো।
স্বতঃপ্রতীতিবাদ
সত্যতা সম্পর্কীয় মতবাদ হিসেবে স্বতঃপ্রতীতিবাদ একটি উল্লেখযোগ্য মতবাদ। এই মতবাদ
অনুসারে, একটি বাক্যের সত্যতা স্বতঃই প্রতীত হয়, কারণ এর সত্যতা স্পষ্ট ও স্বতঃসিদ্ধ।
বাক্যের সত্যতা বাক্যের উপরই নির্ভরশীল, অন্য কোন কিছুর উপর নয়। তাই এই মতানুসারে,
স্বতঃপ্রতীতিই সত্যতা নির্ণয়ের এ্রকমাত্র মানদন্ড। চিন্তার মৌলিক নিয়ম ও জ্যামিতির এমন
কতগুলো স্বতঃসিদ্ধ সত্য রয়েছে, যেগুলি কোন প্রমাণের প্রয়োজন হয় না। এই ধরনের বাক্য
সন্দেহপূর্ণ নয়, বরং সন্দেহাতীত এবং এ ধরনের সন্দেহাতীত বাক্য সত্য। আর এ ধরনের
সন্দেহাতীত বাক্য হতে অনিবার্যভাবে যে সকল বাক্য পাওয়া যায়, সেগুলিও সত্য।
স্বতঃপ্রতীতি : যুক্তিবিদ্যা ও গণিত
যুক্তিবিদ্যা ও গণিতের মত অভিজ্ঞতা-নিরপেক্ষ আকারগত বিদ্যা এমন কতগুলি মৌলিক
নিয়মের উপর প্রতিষ্ঠিত যেগুলিকে স্বতঃসিদ্ধ সত্য বলে স্বীকার করা হয়। আর এই দিক থেকে
স্বতঃপ্রতীতিবাদের সত্যের মানদন্ড এই সব বিদ্যার ক্ষেত্রে সর্বজনগ্রাহ্য ও সর্বজনস্বীকৃত। কিন্তু
দার্শনিক সান্তায়ানা (ঝধহঃধুধহধ) এই নিয়মের ক্ষেত্র ছাড়াও সত্য বিষয় বা ঘটনা সম্পর্কীয়
বাক্যের ক্ষেত্রে এ মানদন্ড প্রয়োগ করেন। তিনি সংবেদনসমূহকে স্বতঃসিদ্ধ সত্য এবং
সংবেদনগ্রাহ্য জগতকে বাস্তব বলে মনে করেন।
স্পষ্টতা ও প্রাঞ্জলতা : ডেকার্ট ও স্পিনোজা
ডেকার্ট ( ও স্পিনোজা স্পষ্টতা ও প্রাঞ্জলতাকে সত্যতার মানদন্ড
হিসেবে গণ্য করেন। দৃষ্টান্তস্বরূপ ডেকার্ট মনে করেন, “আমি চিন্তা করি, তাই আমি আছি'',
এই সত্য আমার কাছে স্পষ্ট ও প্রাঞ্জল। এই বাক্যের সত্যতা স্বতঃপ্রতীত, তাই এর সত্যতা
সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া যায়।
সঙ্গতিবাদ (
এ মতবাদ অনুসারে, যে কোন বাক্যের সত্যতা সেই বাক্যের সাথে অন্যান্য বাক্যের সঙ্গতির
উপর নির্ভর করে। এ মতবাদ অনুসারে, সঙ্গতিই সত্যের প্রকৃতি এবং সংগতির মাধ্যমেই
সত্যের পরীক্ষা হয়। হেগেল (ঐবমবষ) ও হেগেলপন্থী ভাববাদী দর্শনে সঙ্গতিবাদ এক বিশেষ
স্থান দখল করে আছে। বস্তুস্বাতন্ত্র্যবাদী দার্শনিক আলেকজান্ডারও একটি ভিন্ন অর্থে এই
মতবাদ সমর্থন করেন। অনুরূপতাবাদী রাসেলও অনিশ্চিত মতের ব্যাপারে সংগতিবাদের
ব্যাখ্যাকে গ্রহণযোগ্য বলে মনে করেন। হেগেল, ব্রাডলি (ইৎধফষবু), বোসাঙ্কো (ইড়ংধহয়ঁবঃ)
প্রমুূখ ভাববাদীরা মনে করেন যে, সত্তা হলো পরম সমগ্র। পরম সমগ্র হতে বিচ্ছিন্ন অংশ
কেবল অবভাস। পরম সত্তাই একমাত্র সত্য। যেহেতুসমগ্র হলো সত্য, সেহেতুযে অবধারণ
এই সমগ্রের সাথে সঙ্গতি রক্ষা করে চলে তা সত্য।
সত্যতা সঙ্গতির পরিমাণের উপর নির্ভর করে
সঙ্গতিবাদীদের মতে, সব বাক্যের সত্যতা সমান নয়, কোন বাক্যের সত্যতা বেশি, আবার
কোন বাক্যের কম। সমগ্রের সাথে যে বাক্যের সঙ্গতি যত বেশি সে বাক্যের সত্যতাও তত
বেশি। অর্থাৎ সমগ্রের সাথে সঙ্গতির পরিমাণের উপর বাক্যের সত্যতার পরিমাণ নির্ভর করে।
তাঁদের বিশ্বাস, বাক্যের সঙ্গতির পরিমাণ চরম বিস্তৃতি লাভ করলেই স্বয়ংসম্পূর্ণ, সুসংবদ্ধ পরম
অভিজ্ঞতা লাভ করা যায়। এই পরম অভিজ্ঞতাই চরম সত্য ও পরমতত্ত¡। কিন্তুমানুষের পক্ষে
এই অভিজ্ঞতা লাভ করা সম্ভব নয়। কারণ সাধারণ অভিজ্ঞতায় এই চরম সঙ্গতি পাওয়া যায়
না। আবার সাধারণ অভিজ্ঞতায় চরম অসঙ্গতিও পাওয়া যায় না। সুতরাং মানব অভিজ্ঞতার
দিক থেকে কোন বাক্যই চরম সত্য বা চরম মিথ্যা নয়। সত্যতা একটা আপেক্ষিক ব্যাপার।
চরম অভিজ্ঞতার দিক থেকে সব বচনই আপেক্ষিক সত্য, আবার আপেক্ষিক মিথ্যা।
সঙ্গতির মাধ্যমেই বাক্যের সত্যতা গুণ জানা যায়
আলেকজান্ডার (ঝধসঁবষ অষবীধহফবৎ) সত্যের প্রকৃতির জন্য নয় বরং সত্যের পরীক্ষার জন্য
সঙ্গতির সমর্থন করেন। তাঁর মতে, ‘‘কোন বাক্যের সত্যতা অন্য বাক্যের সাথে তার সঙ্গতির
উপর নির্ভর না করে বস্তুস্বরূপের সাথে অনুরূপতার উপর নির্ভর করে। কিন্তুবাক্যের এই
সত্যতা গুণ জানার জন্য সঙ্গতিই ব্যবহার করতে হয়। সবাই যদি দুধ লাল নয়, সাদা বলে,
তাহলেই সাদা হয় না, দুধ বস্তুত সাদা বলেই তা সাদা।” কিন্তুসবাই যখন দুধকে সাদা বলবে
তখনই জানা যাবে দুধ সাদা। রাসেল সত্যের প্রকৃতি নির্ণয়ে অনুরূপতাবাদ স্বীকার করেন।
তিনি অবশ্য স্বীকার করেন যে, কোন কোন ক্ষেত্রে সঙ্গতি সত্যের পরীক্ষা হিসেবে গৃহীত হতে
পারে। তাঁর মতে, সঙ্গতি যদিও অনিশ্চয়তা হ্রাস করে, তবুও সম্পূর্ণ নিশ্চয়তা প্রদান করতে
পারে না।
অনুরূপতাবাদ
এ মতানুসারে, বাক্য বা অবধারণের সত্যতা বা মিথ্যাত্ব অবধারণটির সাথে ঘটনা বা বস্তু,
অর্থাৎ বাস্তব ঘটনা বা সত্য বিষয় এর মিল বা অনুরূপতার উপর নির্ভর করে। আর তাই
অবধারণটির সাথে ঘটনা বা বস্তুর অনুরূপতা বা মিল থাকলে অবধারণটি সত্য এবং মিল না
থাকলে মিথ্যা বলা হয়। অনুরূপতাবাদীরা মনে করেন যে, অনুরূপতা হচ্ছে একদিকে সত্যের
স্বরূপ এবং অপরদিকে সত্যের মানদন্ড।
সাধারণ লোক, অভিজ্ঞতাবাদী ও বাস্তববাদীরা সাধারণত অনুরূপতাকেই সত্যের মানদন্ড বলে
মনে করেন। তাঁদের মতে, জ্ঞাতা ও জ্ঞেয়বস্তুবা মন ও জড়বস্তুহচ্ছে স্বতন্ত্র ও স্পষ্ট এবং
উভয়ই মৌলভাবে বাস্তব। জ্ঞান হচ্ছে এই দুই এর মধ্যে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সম্পর্ক
স্থাপন, যার ফলে জ্ঞেয়বস্তুযে কোন উপায়ে হোক জ্ঞাতাকে দিয়ে অনুলিপিত হয়ে থাকে।
কোন অবধারণ বাস্তবের অনুরূপ হলেই তা সত্য
অনুরূপতাবাদ অনুসারে, যেহেতুসত্যতা বা মিথ্যাত্ব স্বীকার বা অস্বীকার করা শর্তাবলীর উপর
নির্ভর করে, সেহেতু সত্যতা বা মিথ্যাত্বের বিষয়াবলীর উপর বিশ্বাসের উপস্থিতি বা
অনুপস্থিতির কোন সরাসরি সম্বন্ধ নেই। যদি কোন অবধারণ কোন ঘটনা বা বাস্তব বিষয়ের
অনুরূপ হয়, তা হলেই সেই অবধারণটি সত্য এবং যদি কোন অবধারণ কোন ঘটনা বা বাস্তব
বিষয়ের অনুরূপ না হয় তবে সেই অবধারণটি মিথ্যা।
প্রয়োগবাদ
এই মতবাদ অনুসারে, মানবিক প্রয়োজনই হলো সত্যতা নির্ণয়ের একমাত্র মাপকাঠি। এটাই
প্রয়োগবাদের মূলকথা। প্রয়োগবাদের মতে, ধারণা বা বাক্য বা অবধারণের ফলপ্রসূতা,
উপযোগিতা, সন্তোষজনক ফল, ব্যবহারিক ফল বা মূল্য ইত্যাদি হচ্ছে সত্যতা নিরূপণের
মাপকাঠি। মোটকথা, যে ধারণা বা অবধারণের ব্যবহারিক মূল্য বা প্রয়োজনীয়তা রয়েছে তাই
সত্য এবং যে ধারণা বা অবধারণের ব্যবহারিক প্রয়োজনীয়তা নেই তা মিথ্যা। প্রখ্যাত দার্শনিক
সি.এস. পার্স উইলিয়াম জেমস , এফ.সি.এস. শীলার
ও জন ডিউঈ (ঔড়যহ উববিু) সত্যের প্রকৃতি ও পরীক্ষা হিসেবে
প্রয়োগবাদের কথা প্রচার করেন। তাঁরা সবাই একবাক্যে এই কথা স্বীকার করেন যে,
উপযোগিতা বা প্রয়োজনই হচ্ছে সত্যতা নিরূপণের একমাত্র উপায়। যা জীবনের প্রয়োজনে
আসে তাই সত্য, যা প্রয়োজনে আসে না তা মিথ্যা।
সত্যতা ব্যবহারিক ফলের দ্বারা নির্ণীত হয়
পার্সের মতে, কোন বিশ্বাসের সত্যতা অবশ্যই তার ব্যবহারিক ফলের মাধ্যমে পরীক্ষিত হতে
হবে। তাই তাঁর মতে, সত্য ব্যবহারিক ফল দিয়ে পরীক্ষিত হয়ে থাকে। জেমসের মতে,
ধারণার কোন স্বতঃপ্রমাণ্যতা নেই। সত্যতা হচ্ছে ধারণার আগন্তুক গুণবিশেষ। আমাদের
আচরণের ক্ষেত্রে যে ধরনের আচরণ সুবিধাজনক বা হিতকর তা যেমন ন্যায় বা ঠিক তেমনি
আমাদের চিন্তার ক্ষেত্রে যে ধরনের চিন্তা সুবিধাজনক তাই সত্য। তাঁর মতে, সত্য হচ্ছে
আপেক্ষিক।
সত্যতা অনুসন্ধানের ফল
ডিউঈ-এর মতে, সত্যতা হচ্ছে সুনির্দিষ্ট ও সুনিয়ন্ত্রিত অনুসন্ধানের ফলমাত্র। অর্থাৎ অনুসন্ধান
ও পরীক্ষার সাফল্যের উপর সত্যতা নির্ভরশীল। কোন ধারণার ফলপ্রসূকার্যকারিতা ও তার
সাফল্যই হচ্ছে তার সত্যতা।
ভবিষ্যদ্বাণী করার ক্ষমতা থাকলেই ধারণা সত্য হয়
শীলারের মতে, একমাত্র ভবিষ্যদ্বাণী করার ক্ষমতা থাকলেই ধারণা সত্য হবার দাবি রাখে।
তবে ধারণার এই সত্যতার দাবি পূর্ণ হয় যখন ভবিষ্যদ্বাণী সফল হয়।
রচনামূলক প্রশ্ন
১। সত্যতা সম্পর্কীয় মতবাদসমূহের মূল বক্তব্য বর্ণনা করুন।
সংক্ষিপ্ত উত্তরমূলক প্রশ্ন
১। স্বতঃপ্রতীতিবাদের মূল বক্তব্য বর্ণনা করুন।
২। সত্য সম্পর্কীয় মতবাদ হিসেবে অনুরূপতাবাদ আলোচনা করুন।
৩। সঙ্গতিবাদের মূল বক্তব্য বর্ণনা করুন।
৪। প্রয়োগবাদী দার্শনিকদের নামসহ প্রয়োগবাদের মূল বক্তব্য আলোচনা করুন।
নৈর্ব্যক্তিক প্রশ্ন লিখুন।
সঠিক উত্তর লিখুন।
১। স্বতঃপ্রতীতিই সত্যতা নির্ণয়ের মানদন্ডÑএ কথাটি
(অ) সঙ্গতিবাদের (আ) স্বতঃপ্রতীতিবাদের
(ই) অনুরূপতাবাদের (ঈ) প্রয়োগবাদের।
২। বাক্যের সত্যতা ঐ বাক্যের সাথে অন্যান্য বাক্যের সঙ্গতির উপর নির্ভর করেÑএ বক্তব্য
প্রদান করে
(অ) স্বতঃপ্রতীতিবাদ (আ) সঙ্গতিবাদ
(ই) অনুরূপতাবাদ (ঈ) প্রয়োগবাদ।
৩। বাক্য বা অবধারণের সাথে বাস্তব ঘটনার মিল থাকলে বাক্য বা অবধারণ সত্য হয়Ñএ
বক্তব্য প্রদান করে
(অ) স্বতঃপ্রতীতিবাদ (আ) সঙ্গতিবাদ
(ই) অনুরূপতাবাদ (ঈ) প্রয়োগবাদ।
৪। বাক্য বা অবধারণের উপযোগিতা বা ব্যবহারিক মূল্য সত্যতা নিরূপণের মাপকাঠি-এ
বক্তব্য প্রদান করে
(অ) স্বতঃপ্রতীতিবাদ (আ) সঙ্গতিবাদ
(ই) অনুরূপতাবাদ (ঈ) প্রয়োগবাদ।
সঠিক উত্তর
১। (আ) স্বতঃপ্রতীতিবাদের ২। (আ) সঙ্গতিবাদ ৩। (ই) অনুরূপতাবাদ
৪। (ঈ) প্রয়োগবাদ
FOR MORE CLICK HERE
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস মাদার্স পাবলিকেশন্স
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস ১ম পর্ব
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস
আমেরিকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস
বাংলাদেশের ইতিহাস মধ্যযুগ
ভারতে মুসলমানদের ইতিহাস
মুঘল রাজবংশের ইতিহাস
সমাজবিজ্ঞান পরিচিতি
ভূগোল ও পরিবেশ পরিচিতি
অনার্স রাষ্ট্রবিজ্ঞান প্রথম বর্ষ
পৌরনীতি ও সুশাসন
অর্থনীতি
অনার্স ইসলামিক স্টাডিজ প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত
অনার্স দর্শন পরিচিতি প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত