জার্মান দার্শনিক ইমানুয়েল কান্ট জ্ঞানের উৎপত্তিবিষয়ক মতবাদ- বুদ্ধিবাদ ও অভিজ্ঞতাবাদের
দীর্ঘদিনের দ্বন্দ¡ দূর করে বিচারবাদ নামক একটি নতুন মতবাদ প্রদান করেন। এখানে তিনি
প্রথমে এই দুই মতবাদের সমালোচনা করেন এবং পরে দেখান দুই মতবাদের সমন¦য়ে প্রকৃত
জ্ঞান পাওয়া যায়।
বিচারবাদ
কান্ট প্রথম জীবনে ‘বুদ্ধিই সত্য জ্ঞান দিতে পারে'- এ মতবাদে বিশ্বাসী ছিলেন। কিন্তু
অভিজ্ঞতাবাদী দার্শনিক হিউমের বই পড়ে তাঁর ধারণা বদলে যায়। তিনি বুঝতে পারেন বস্তু
ছাড়া শুধুধারণা হতে পারে না। সুতরাং জ্ঞান হতে গেলে ধারণা এবং বস্তুউভয়ই দরকার।
বস্তুপেতে হলে প্রত্যক্ষণ বা সংবেদন প্রয়োজন।
বিচারবাদ : অভিজ্ঞতাবাদ ও বুদ্ধিবাদের সমম্বয়
অভিজ্ঞতাবাদীদের মতে, শুধুঅভিজ্ঞতা থেকেই জ্ঞান হয়। বুদ্ধিবাদীদের মতে, শুধুবুদ্ধিজাত
ধারণা থেকেই জ্ঞান হয়। কান্ট এই দুই মতবাদের সমালোচনা করে দেখান যে, এই দুই
মতবাদের সমন¦য়েই কেবল প্রকৃত জ্ঞানলাভ করা সম্ভব। কান্ট বলেন, বুদ্ধি জ্ঞানের আকার
দিতে পারে, তাতে নিশ্চয়তাও পাওয়া যায়। কিন্তুতা জ্ঞানের বিষয় দিতে পারে না এবং
নতুনত্ব দিতে পারে না। সংবেদন থেকে নতুনত্ব আসে, নিশ্চয়তা আসে না। অথচ জ্ঞানের
বিষয় ও আকার, নতুনত্ব ও নিশ্চয়তা প্রকৃত জ্ঞানের জন্য সবই প্রয়োজন। কান্ট এভাবে
অভিজ্ঞতাবাদ ও বুদ্ধিবাদের মধ্যকার সত্য গ্রহণ করে এক সমনি¦ত মতবাদ (ঝুহঃযবঃরপ
ঞযবড়ৎু) গঠন করেন। তাঁর মতে, প্রকৃত জ্ঞানের জন্য অভিজ্ঞতা ও বুদ্ধি দুই-ই প্রয়োজন।
বুদ্ধি থেকে আমরা জ্ঞানের আকার পাই, আর অভিজ্ঞতা থেকে জ্ঞানের বিষয় বা বস্তুপাই।
কান্ট অভিজ্ঞতাবাদ ও বুদ্ধিবাদ বিচার বিশ্লেষণ করে এ সিদ্ধান্তে পৌঁছেন বলে এ মতবাদকে
বিচারবাদ বলা হয়।
জ্ঞানের বৈশিষ্ট্য : বুদ্ধিবাদ ও অভিজ্ঞতাবাদ
বুদ্ধিবাদীদের মতে, জ্ঞানের বৈশিষ্ট্য হলো নিশ্চয়তা ও সর্বজনীনত্ব এবং
অভিজ্ঞতাপূর্ব বিশ্লেষণাত্মক বচনই জ্ঞান পদবাচ্য। অভিজ্ঞতাবাদীদের মতে, জ্ঞানের বৈশিষ্ট্য
নতুনত্ব এবং সংশ্লেষণাত্মক বচনই জ্ঞান পদবাচ্য।
তিনি দুই মতবাদের সমন¦য় করে বলেন, জ্ঞানের বৈশিষ্ট্য নিশ্চয়তা, সর্বজনীনত্ব ও নতুনত্ব।
বিজ্ঞানের বচনের এই গুণগুলি আছে। তাই তাঁর মতে, বিজ্ঞান আদর্শ জ্ঞান দেয়। কান্ট বলেন,
জ্ঞানের নিশ্চয়তা আসে বুদ্ধির আকার প্রাপ্ত অনুভব
থেকে।
দেশ ও কাল : জ্ঞানের পূর্বতঃসিদ্ধ আকার
সংবেদন বৃত্তির সাহায্যে জ্ঞানের বিষয়ের যে পরিচয় আমরা পাই তাই অনুভব
সংবেদনবৃত্তি নিষ্ক্রিয়। দেশ ও কাল অনুভবের দুটি পূর্বতঃসিদ্ধ আকার। এদের পূর্বতঃসিদ্ধ
আকার এই অর্থে বলা যায় যে, এই আকার ছাড়া কোন অনুভব সম্ভব নয়। দেশ ও কালের
মধ্যে সংবেদন বৃত্তি যে অনুভব ধারণ করে বুদ্ধি সক্রিয়ভাবে তার উপর বুদ্ধির আকার লাগিয়ে
দেয়। বুদ্ধির আকারে আকারিত হয়ে দেশ-কালে প্রাপ্ত অনুভব জ্ঞান পদবাচ্য হয়। বাইরে থেকে
প্রাপ্ত শুধুঅনুভব জ্ঞান দিতে পারে না। অনুভব বুদ্ধির আকারের সাথে সংযুক্ত হয়েই জ্ঞান সম্ভব
করে তোলে। এগুলি হলো সাধারণ বুদ্ধির আকার। সুতরাং এই অনুভব সবার কাছেই এক
রকম হয়। কিন্তুএই জ্ঞান বস্তুস্বরূপের জ্ঞান দিতে পারে না। কারণ সমস্ত জ্ঞানেই আমাদের
বুদ্ধির আকার থাকে। সুতরাং অবিমিশ্র বস্তুস্বরূপ আমরা কখনই জানতে পারি না। বুদ্ধির
আকার বিমিশ্র বস্তস্বরূপই আমরা জানি। কান্ট জ্ঞানের এই বিষয়ের নাম দিয়েছেন অবভাস।
অবভাসের জ্ঞানই আমাদের পক্ষে সম্ভব। বস্তুস্বরূপের জ্ঞান আমরা কখনই পাই না। কিন্তু
বস্তুস্বরূপের অস্তিত্ব আমাদের মেনে নিতে হয়। কারণ সংবেদনবৃত্তি নিষ্ক্রিয়ভাবে বাইরের থেকে
আসা অনুভব গ্রহণ করে। অনুভব সংবেদন সৃষ্ট নয়। সুতরাং এই অনুভবের উৎস হিসেবে
বস্তুস্বরূপের অস্তিত্ব স্বীকার করতেই হবে।
সমালোচনা
কান্ট অভিজ্ঞতাবাদ ও বুদ্ধিবাদের সমালোচনা করে এই দুই মতবাদের সমন¦য়ে বিচারবাদ
নামক যে মতবাদ প্রদান করেছেন তা-ও দোষমুক্ত নয়।
(১) জ্ঞান উৎপত্তির ক্ষেত্রে তাঁর এই মতবাদ এক অসমনি¦ত দ্বৈত ধারণার সৃষ্টি করেছে। তাঁর
মতে, সংবেদনবৃত্তি ও বুদ্ধিবৃত্তি উভয়ের সমন¦য়েই জ্ঞান উৎপন্ন হয়। সংবেদনবৃত্তি
সম্পূর্ণভাবে নিষ্ক্রিয়, আর বুদ্ধিবৃত্তি একান্তভাবেই সক্রিয়। কিন্তুএ দুই বিপরীতধর্মী বৃত্তি
কি করে একত্রে জ্ঞান উৎপন্ন করে তার কোন যুক্তিযুক্ত ব্যাখ্যা কান্ট দিতে পারেননি।
সুতরাং তাঁর মতে, এই দুই বৃত্তির মধ্যে একটা দ্বৈতভাব আছে। কান্ট এই দ্বৈতভাব
সমন¦য়ের কোন চেষ্টা করেননি।
(২) বস্তুসত্তার দিক থেকেও কান্ট এক দ্বৈত ধারণার সৃষ্টি করেছেন। তিনি বলেন, আমরা
কেবল অবভাসের জ্ঞান লাভ করি, বস্তুস্বরূপের জ্ঞানলাভ করতে পারি না। তিনি এখানে
বস্তু-অবভাস ও বস্তুস্বরূপের এক দ্বৈত বোধ সৃষ্টি করেছেন, কিন্তুপরিষ্কারভাবে সমনি¦ত
করার চেষ্টা করেননি।
(৩) তিনি একটি জটিল সমস্যার সৃষ্টি করেছেন এই বলে যে, বস্তুস্বরূপ আছে, কিন্তুতা জানা
যায় না। বস্তুস্বরূপ যদি না জানা যায়, তবে তা যে আছে তা কি করে বলা যায়? আর
এই সমস্যা পরবর্তীকালে দার্শনিকদের দু'ভাগে বিভক্ত করে। যেমন (ক) বস্তুস্বরূপের
জ্ঞান হয় ও (খ) বস্তুস্বরূপ বলে কিছুনেই।
এই মতবাদের নানা রকম দোষ-ত্রæটি থাকা সত্তে¡ও আমরা এ কথা বলতে পারি যে, বুদ্ধিবাদ ও
অভিজ্ঞতাবাদ উভয়ই জ্ঞানের উৎপত্তিবিষয়ক মতবাদ হিসেবে একপেশে ও চরমপন্থী মতবাদ।
কান্ট যখন এই চরমপন্থী মতবাদ দুটির সমালোচনা করে দেখালেন যে, কোন একটির পক্ষেও
একা প্রকৃত জ্ঞানদান করা সম্ভব নয়, উভয়ের সমন¦য়েই কেবল প্রকৃত জ্ঞান পাওয়া সম্ভব, তখন
জ্ঞানের ক্ষেত্রে একটি বিরাট আলোড়ন সৃষ্টি হলো এবং অভিজ্ঞতাবাদ ও বুদ্ধিবাদের দীর্ঘদিনের
দ্বন্দ¡ দূর হলো।
রচনামূলক প্রশ্ন
১। বিচারবাদ সমালোচনাসহ ব্যাখ্যা করুন।
সংক্ষিপ্ত উত্তরমূলক প্রশ্ন
১। কান্টের মতবাদের নাম বিচারবাদ হল কেন?
২। কান্টের মতে জ্ঞানের বৈশিষ্ট্য কি হওয়া উচিত?
নৈর্ব্যক্তিক প্রশ্ন
সঠিক উত্তর লিখুন।
১। কান্ট প্রবর্তিত মতবাদÑ
(অ) বুদ্ধিবাদ (আ) অভিজ্ঞতাবাদ
(ই) বিচারবাদ (ঈ) উপরের সবগুলো।
২। ‘বুদ্ধিই সত্য জ্ঞান দিতে পারে’Ñ কান্টের এই ধারণা ভেঙ্গে যায়- কার বই পড়ে
(অ) ডেকার্টের (আ) হিউমের
(ই) লকের (ঈ) মিলের।
৩। প্রকৃত জ্ঞানের জন্য অভিজ্ঞতা ও বুদ্ধি দুই-ই প্রয়োজন, এ কথা বলেন
(অ) লক (আ) বার্কলি
(ই) কান্ট (ঈ) হিউম।
৪। বস্তু-স্বরূপ আছে কিন্তুতা জানা যায় না বলে কান্ট যে সমস্যার সৃষ্টি করেছেন তা পরবর্তী
দার্শনিকদেরÑ
(অ) দুই ভাগে বিভক্ত করেছে (আ) তিন ভাগে বিভক্ত করেছে
(ই) চার ভাগে বিভক্ত করেছে (ঈ) উপরের কোনটিই সঠিক নয়।
সঠিক উত্তর ঃ (১) ই। (২) আ। (৩) ই। (৪) অ।
FOR MORE CLICK HERE
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস মাদার্স পাবলিকেশন্স
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস ১ম পর্ব
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস
আমেরিকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস
বাংলাদেশের ইতিহাস মধ্যযুগ
ভারতে মুসলমানদের ইতিহাস
মুঘল রাজবংশের ইতিহাস
সমাজবিজ্ঞান পরিচিতি
ভূগোল ও পরিবেশ পরিচিতি
অনার্স রাষ্ট্রবিজ্ঞান প্রথম বর্ষ
পৌরনীতি ও সুশাসন
অর্থনীতি
অনার্স ইসলামিক স্টাডিজ প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত
অনার্স দর্শন পরিচিতি প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত