ভাববাদের সংজ্ঞা দিন এবং এ মতবাদের পক্ষে দুটি যুক্তি দিন।

জ্ঞেয় বস্তুর প্রকৃতি সম্পর্কীয় মতবাদ হিসেবে আমরা যে দুটি মতবাদ পাই তার মধ্যে ভাববাদ
একটি। এ মতানুসারে, বস্তুর অস্তিত্ব মনের উপর নির্ভরশীল। আমরা বর্তমান পাঠে আত্মগত
ভাববাদ নিয়ে আলোচনা করবো। আত্মগত ভাববাদের মূল বক্তব্য হলো, বস্তুর অস্তিত্ব
প্রত্যক্ষণের উপর নির্ভরশীল। এই মতবাদটি ভাববাদেরই একটি প্রকার, তাই ভাববাদ সম্বন্ধে
প্রথমে আলোচনা করা প্রয়োজন।
ভাববাদ
যে দার্শনিক মতবাদ ভাব, চৈতন্য বা আত্মাকে একমাত্র প্রকৃত সত্তা বলে মনে করে তাকে
ভাববাদ বলে। এ মতানুসারে, বাইরের বস্তুপ্রকৃত সত্তা নয়, ভাবের প্রতিচ্ছবিমাত্র। তাঁদের
মতে, চিন্তা, অনুভ‚তি, ইচ্ছা প্রভৃতির যেমন মন-নিরপেক্ষ কোন সত্তা নেই, তেমনি বাইরের
বস্তুরও কোন মন-নিরপেক্ষ অস্তিত্ব নেই। ভাববাদীদের মতে, বাইরের বস্তুযখন জ্ঞানের জন্য
জানা বিষয় বা বস্তুহয়,তখন এই বাইরের বস্তুহয় মানুষের উপর, না হয় স্রষ্টার উপর জ্ঞানের
বিষয়বস্তুহিসেবে নির্ভর করে। তাই বস্তুর জ্ঞান-নিরপেক্ষ বা মন-নিরপেক্ষ কোন স্বতন্ত্র সত্তা নেই।
ভাববাদের পক্ষে প্রধান যুক্তিসমূহ
ভাববাদীরা তাঁদের এ বক্তব্যের পক্ষে নানা রকম যুক্তি প্রদান করেন। কিছুপ্রধান যুক্তি নিচে
তুলে ধরা হলো :
(১) জ্ঞানের উপর নির্ভর না করে বস্তুথাকতে পারে না, কারণ যে বস্তুকেই জানি না কেন
তাকে জ্ঞাত বস্তুরূপেই জানতে হয়। সুতরাং বস্তুর অস্তিত্ব প্রত্যক্ষনির্ভর।
(২) কখনও কখনও বস্তুছাড়াও আমরা বস্তুদেখতে পাই, আবার এক বস্তুকে অন্য বস্তুরূপেও
দেখতে পাই। যেমন ভ‚ত দেখা বা দড়িকে সাপ দেখা, এগুলি মনের ধারণামাত্র। যদি এই
বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে মনের ধারণাকে বাইরের বস্তুবলে মনে হয়, তবে বাইরের সমস্ত বস্তুই যে মনের ধারণা নয়, তা নিশ্চিত করে বলা যায় না।
(৩) সব কিছুতে সংশয় করা গেলেও, যে মন সংশয় করছে তাকে সন্দেহ করা যায় না। তাই
ভাববাদীরা মন ও জ্ঞানকেই পরম তত্ত¡ মনে করেন।
(৪) দার্শনিক বার্কলির মতে, দ্রব্য গুণের সমষ্টিমাত্র। গুণ ছাড়া এ গুণের আধাররূপে
গুণাতিরিক্ত কোন অজ্ঞাত দ্রব্যের অস্তিত্ব নেই। আর এই গুণগুলি ব্যক্তি মনের ধারণা ছাড়া
কিছুই নয়। সুতরাং মন-নিরপেক্ষ বস্তুর অস্তিত্ব নেই।
(৫) বিজ্ঞানীদের মতে, ‘অনেক নক্ষত্র আছে যাদের আলো পৃথিবীতে পৌঁছাতে কোটি কোটি
বছর লাগে। এ আলো পৃথিবীতে পৌঁছাতে পৌঁছাতে আবার নক্ষত্রটি ধ্বংসও হয়ে যায়, সুতরাং
যখন নক্ষত্র আমরা দেখি তখন নক্ষত্র নাও থাকতে পারে। অর্থাৎ বস্তুনা থাকলেও বস্তুর জ্ঞান হতে পারে।
ভাববাদের বিভিন্ন রূপ
আধুনিক পাশ্চাত্য দর্শনে ভাববাদের যেসব রূপ দেখা যায় তাকে প্রধানত তিন ভাগে ভাগ করা
যায় : (১) বার্কলির আত্মগত ভাববাদ (২) হেগেলের বস্তুগত ভাববাদ ও (৩) কান্টের
ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বা পরিদৃশ্যমান ভাববাদ। আমরা এই পাঠে বার্কলির আত্মগত ভাববাদ নিয়ে আলোচনা করবো।
বার্কলির আত্মগত ভাববাদ
বস্তুর অস্তিত্ব প্রত্যক্ষণের উপর নির্ভরশীল
জর্জ বার্কলি (১৬৮৫-১৭৫৩) একজন অভিজ্ঞতাবাদী দার্শনিক। লকের চিন্তাধারার সূত্র ধরেই
গড়ে উঠেছে বার্কলির আত্মগত ভাববাদ। লকের মতে, বস্তুর দুই ধরনের গুণ আছে : (১)
প্রাথমিক বা মুখ্য গুণ ও (২) গৌণ গুণ। বিস্তৃতি, সংখ্যা, আকার ইত্যাদি হলো প্রাথমিক বা
মুখ্য গুণ। আর স্বাদ, বর্ণ, গন্ধ ইত্যাদি হলো গৌণ গুণ। মুখ্য গুণসমূহ বস্তুনিষ্ঠ এবং গৌণ
গুণসমূহ আত্মনিষ্ঠ। কিন্তুবার্কলি বস্তুর গুণগত পার্থক্য অস্বীকার করে বলেন, বস্তুর সমস্ত গুণই
আত্মনিষ্ঠ বা প্রত্যক্ষনির্ভর। তাঁর মতে, মন-নিরপেক্ষ কোন গুণ বা বস্তুর অস্তিত্ব স্বীকার করা
যায় না। তিনি বলেন, বস্তুমন-নির্ভর কতগুলি গুণের সমষ্টি ছাড়া আর কিছুই নয়। এ থেকেই
তিনি সিদ্ধান্ত নেন, ‘যা কিছুঅস্তিত্বশীল, তা প্রত্যক্ষ-নির্ভর (ঊংংব বংঃ চবৎপরঢ়র)। অর্থাৎ যেসব
বস্তুআমরা প্রত্যক্ষ করি, তার অস্তিত্ব জ্ঞাতার মনের উপর নির্ভর করে। এ মতানুসারে, প্রত্যক্ষ
জ্ঞানের একমাত্র বিষয় হলো জ্ঞাতা বা আমাদের ধারণা।
জগতের অস্তিত্ব স্রষ্টার প্রত্যক্ষণের উপর নির্ভরশীল
বার্কলির মতবাদ মেনে নিলে কিছুসমস্যার সৃষ্টি হয়। এ মতানুসারে, অপ্রত্যক্ষগোচর বস্তুর
অস্তিত্ব কিভাবে স্বীকার করা যাবে? চুলোয় চায়ের হাড়ি বসিয়ে দিয়ে ফিরে এসে দেখলাম পানি
ফুটছে। কিন্তুবার্কলির মতানুসারে প্রশ্ন আসে, আমি যতক্ষণ প্রত্যক্ষ করিনি এবং সেই সময়
অন্য কেউ যদি সেগুলিকে প্রত্যক্ষ না করে থাকে, তাহলে ততক্ষণ চুলো, চায়ের হাড়ি এসবের
অস্তিত্ব ছিল না। আমি ঘরে ঢোকার সাথে সাথে সেগুলি অস্তিত্ববান হলো। কিন্তুচায়ের পানি
ফুটল কী করে? অর্থাৎ বস্তুর অস্তিত্বের ধারাবাহিকতা কিভাবে প্রমাণ করা যাবে? এককথায়,
বার্কলির মতবাদ মেনে নিলে এই জগতের আপাত প্রতীয়মান বাস্তবতা, স্বাতন্ত্র্য, স্থিতি ও ঐক্য
নষ্ট হয়ে যায়। তাই বার্কলি তাঁর পরবর্তী রচনায় স্রষ্টা বা ঈশ্বরের সাহায্যে বস্তুর অস্তিত্বের
ধারাবাহিকতা বা স্থায়িত্বকে প্রতিষ্ঠিত করেন। তাঁর মতে, বস্তুর অস্তিত্ব আসলে স্রষ্টার প্রত্যক্ষের
উপর নির্ভর করে। অর্থাৎ আমরা যখন কোন বস্তুপ্রত্যক্ষ করি না, তখনও সেই বস্তুস্রষ্টার
প্রত্যক্ষের বিষয় হয়ে থাকে। অতএব বার্কলির মতে, সমস্ত জগতটাই স্রষ্টার ধারণারূপে রয়েছে
এবং আমাদের প্রত্যক্ষ হলো স্রষ্টার মনের ধারণাকেই একটি সীমিত দৃষ্টিভঙ্গি থেকে প্রত্যক্ষ
করা। তাঁর মতে, আমরা যখন তাকাই তখন কিছুদেখা বা না দেখা আমাদের ইচ্ছার উপর
নির্ভর করে না। আমি কি দেখব তা নির্ধারণ করা আমার অধীন নয়। সুতরাং কোন পরম চেতন
সত্তা, যিনি অসীম ক্ষমতা ও ইচ্ছার অধিকারী, ধারাবাহিকভাবে সংবেদনের ধারণাগুলি আমাদের
মনে সৃষ্টি করেন। এই পরম চেতন সত্তাই স্রষ্টা। যে অপরিবর্তনীয় নিয়মাবলী অনুসারে স্রষ্টা
আমাদের মনে সংবেদনের ধারণাগুলিকে সৃষ্টি করেন সেগুলিই প্রাকৃতিক নিয়ম (খধংি ড়ভ
ঘধঃঁৎব)।
এভাবে বার্কলি স্রষ্টাকে টেনে এনে বস্তুর স্থায়িত্ব প্রমাণ করেন। আর তিনি যদি তা না করতেন
তাহলে সমস্ত জগতই ব্যক্তি মনের মানসিক প্রক্রিয়ায় পরিণত হত এবং তার ফলে আমি ও
আমার ধারণাই একমাত্র অস্তিত্বশীল-এই আত্মকেন্দ্রিকতাবাদের সৃষ্টি হতো।
সমালোচনা
বার্কলির আত্মগত ভাববাদ যদিও দর্শনের ইতিহাসে আলোড়ন সৃষ্টি করে, তবুও বিভিন্ন ত্রæটিবিচ্যুতি থাকার কারণে নিæোক্তভাবে এ মতবাদ সমালোচিত হয়েছে:
(১) দার্শনিক ম্যূর (গড়ড়ৎব) তাঁর ‘ভাববাদ খন্ডন' নামক বিখ্যাত প্রবন্ধে আত্মগত ভাববাদের
তীব্র সমালোচনা করে বলেন, বার্কলির আত্মগত ভাববাদ যে মূল তত্তে¡র উপর দাঁড়িয়ে
আছে তা হলো, কোন কিছুর অস্তিত্ব প্রত্যক্ষণনির্ভর। কিন্তু বস্তু আছে বলেই তা
প্রত্যক্ষের বিষয় হতে পারে, বস্তুর অস্তিত্ব প্রত্যক্ষণের উপর নির্ভর করে না। বার্কলির
মতে, বিষয় ও তার সংবেদন যেমন, নীল বর্ণ ও নীল বর্ণের সংবেদন অভিন্ন, যেহেতু
উভয়কে স্বতন্ত্রভাবে প্রত্যক্ষ করা যায় না। ম্যূরের মতে, দুটি বস্তুকে প্রত্যক্ষণের সময়
বিচ্ছিন্ন করা যায় না বলেই প্রমাণিত হয় না যে, বস্তুদুটি অভিন্ন। অবিচ্ছিন্নতা অভিন্নতা
প্রমাণ করে না। নীল বর্ণ ও নীল বর্ণের সংবেদন এ দুটি ভিন্ন জিনিস।
(২) বস্তুও বস্তুর জ্ঞান এ দুটির ভিন্নতা স্বীকার না করলে বিভিন্ন জ্ঞানের পার্থক্য প্রমাণ করা
যায় না। সাদা, সবুজ, বেগুণী, হলদে এই ভিন্ন ভিন্ন বর্ণের জ্ঞান সম্ভব হয় এ কারণে যে,
এগুলির ভিন্ন ভিন্ন অস্তিত্ব আছে, যদি তা না হতো তবে সব জ্ঞান এক রকম হত।
বিষয়ের ভিন্নতার জন্যই জ্ঞান ভিন্ন হয়।
(৩) হিউম বার্কলির আত্মগত ভাববাদের সমালোচনা করে বলেন, বস্তুর অস্তিত্বের
ধারাবাহিকতা বজায় রাখার জন্য বার্কলি স্রষ্টাকে টেনে এনেছেন। কিন্তুতাঁর মতানুসারেই
স্রষ্টার অস্তিত্ব সম্ভব নয়। কারণ তাঁর মতে, কোন কিছুৃর অস্তিত্ব প্রত্যক্ষনির্ভর। আমরা
জানি, স্রষ্টার অস্তিত্ব প্রত্যক্ষ করা যায় না। অতএব, বস্তুর অস্তিত্বের ধারাবাহিকতা বজায়
রাখতে তিনি নিজেই তাঁর মতবাদের মূলে কুঠারাঘাত করেন।
উপরোক্ত আলোচনা থেকে এটা সুস্পষ্ট যে, বার্কলির আত্মগত ভাববাদের অনিবার্য পরিণতি
হলো হিউমের সংশয়বাদ বা সংবেদনবাদ। যেহেতুবার্কলি একজন ধর্মযাজক সেহেতুতাঁর
মতবাদের লক্ষ্য ছিল, স্রষ্টার অস্তিত্বকে প্রমাণ করা। আর তা করতে গিয়ে তিনি নিজের
অজান্তেই তাঁর মূল মতবাদ থেকে দূরে সরে গেছেন।
রচনামূলক প্রশ্ন
১। আত্মগত ভাববাদ সমালোচনাসহ ব্যাখ্যা করুন।
সংক্ষিপ্ত উত্তরমূলক প্রশ্ন
১। ভাববাদের সংজ্ঞা দিন এবং এ মতবাদের পক্ষে দুটি যুক্তি দিন।
২। আত্মগত ভাববাদের দুটি সমালোচনা লিখুন।
৩। ‘অস্তিত্ব প্রত্যক্ষ নির্ভর'- সংক্ষেপে ব্যাখ্যা করুন।
নৈর্ব্যক্তিক প্রশ্ন
সঠিক উত্তর লিখুন।
১। আত্মগত ভাববাদের প্রবক্তাÑ
(অ) লক (আ) ডেকার্ট
(ই) বার্কলি (ঈ) হিউম
২। ভাববাদের মূল বক্তব্যÑ
(অ) বস্তুর মন-নিরপেক্ষ কোন স্বতন্ত্র সত্তা নেই।
(আ) বস্তুর অস্তিত্ব জানার উপর নির্ভর করে না।
(ই) বস্তুআছে বলেই তাকে আমরা জানতে পারি।
(ঈ) উপরের কোনটিই সঠিক নয়।
৩। ভাববাদের প্রধান শ্রেণীÑ
(অ) ৪টি (আ) ৩টি
(ই) ৬টি (ঈ) ৫টি
৪। আত্মগত ভাববাদে বার্কলির মূল লক্ষ্য ছিলÑ
(অ) বিবর্তনবাদকে প্রতিষ্ঠা করা (আ) বস্তুবাদকে প্রতিষ্ঠা করা
(ই) স্রষ্টার অস্তিত্বকে প্রমাণ করা। (ঈ) ভাববাদকে প্রতিষ্ঠা করা।
সত্য হলে ‘স', মিথ্যা হলে ‘মি' লিখুন।
১। আত্মগত ভাববাদের একজন অনুসারী হলেন লক।
২। আত্মগত ভাববাদের মূল বক্তব্য হলো বস্তুর অস্তিত্ব প্রত্যক্ষণের উপর নির্ভরশীল।
৩। ম্যূর-এর চিন্তাধারার সূত্র ধরেই গড়ে উঠেছে আত্মগত ভাববাদ।
৪। বস্তুর অস্তিত্বের ধারাবাহিকতা বজায় রাখার জন্যই বার্কলি স্রষ্টাকে তাঁর মতবাদে টেনে
আনেন।
সঠিক উত্তর
১। (অ) লক ২। (অ) বস্তুর মন-নিরপেক্ষ কোন স্বতন্ত্র সত্তা নেই। ৩। (আ) ৩টি ৪।
(ই) স্রষ্টার অস্তিত্বকে প্রমাণ করা।
বাংলাদেশ উš§ুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়
জ্ঞানতত্ত¡ পৃষ্ঠা ি ৫৩
১। মি ২। স ৩। মি ৪। স

FOR MORE CLICK HERE
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস মাদার্স পাবলিকেশন্স
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস ১ম পর্ব
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস
আমেরিকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস
বাংলাদেশের ইতিহাস মধ্যযুগ
ভারতে মুসলমানদের ইতিহাস
মুঘল রাজবংশের ইতিহাস
সমাজবিজ্ঞান পরিচিতি
ভূগোল ও পরিবেশ পরিচিতি
অনার্স রাষ্ট্রবিজ্ঞান প্রথম বর্ষ
পৌরনীতি ও সুশাসন
অর্থনীতি
অনার্স ইসলামিক স্টাডিজ প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত
অনার্স দর্শন পরিচিতি প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত

Copyright © Quality Can Do Soft.
Designed and developed by Sohel Rana, Assistant Professor, Kumudini Government College, Tangail. Email: [email protected]