অবভাসিক ভাববাদের মূল বক্তব্য সংক্ষেপে বর্ণনা করুন। কান্টের ভাববাদের দুটি সমালোচনা উল্লেখ করুন।

জার্মান দার্শনিক ইমানুয়েল কান্ট জ্ঞানতাত্তি¡ক মতবাদ হিসেবে বস্তু ও জ্ঞান সম্পর্কীয় যে
মতবাদ প্রদান করেছেন তা আধুনিক দর্শনের ইতিহাসে এক বিপ্লব সৃষ্টি করেছে। আর এই
বিপ্লবকে কোপারনিকাসের বিপ্লবের সাথে তুলনা করা হয়। কারণ কোপারনিকাসের আগে
টলেমির মতবাদ প্রচলিত ছিল। টলেমি মনে করতেন, পৃথিবী স্থির, আর সূর্য পৃথিবীর চারদিকে
ঘোরে। পরবর্তীতে কোপারনিকাস মত দিলেন, সূর্য পৃথিবীর চারদিকে নয়, পৃথিবীই সূর্যের
চারিদিকে ঘোরে, আর সূর্য স্থির। জ্যোতির্বিজ্ঞানে এই নতুন চিন্তাধারা যেমন বিপ্লব সৃষ্টি করে,
জ্ঞানতত্তে¡র ক্ষেত্রেও কান্টের চিন্তাধারা তেমনি বিপ্লব সৃষ্টি করে। কান্টের পূর্বে দার্শনিকদের
ধারণা ছিল জ্ঞান বস্তুর উপর নির্ভরশীল, বস্তুআছে বলেই জ্ঞান হয়। কিন্তুপরবর্তীতে কান্ট
বলেন, জ্ঞানের বিষয় জ্ঞানের উপরই নির্ভরশীল। কান্টের এই মতবাদ তাঁর পূর্ববর্তী
দার্শনিকদের মতবাদকে পাল্টে দেয় এবং ভাববাদের প্রবলতাকে আরো বৃদ্ধি করে।
অবভাসিক বা পরিদৃশ্যমান ভাববাদ
কান্ট বলেন, আমাদের মন-নিরপেক্ষ এক জগতের অস্তিত্ব আছে। এই জগতই হলো অতীন্দ্রিয়
জগৎ। লকের দ্রব্যের মতই একে কখনও জানা যায় না। আমরা বস্তুর অবভাসিক রূপকেই
জানতে পারি অর্থাৎ এই জগতকে আমরা যেভাবে দেখি সেভাবেই জানতে পারি। এই
পরিদৃশ্যমান জগতের আড়ালে যে এক অতীন্দ্রিয় জগৎ আছে তা আমরা জানতে পারি না।
কিন্তুএই অতীন্দ্রিয় জগতই পরিদৃশ্যমান জগতের সব সংবেদনের উৎস। এই সংবেদনগুলি
দেশ ও কালের মাধ্যমে মনের কাছে উপস্থিত হয়, তখন মন এই সংবেদনের উপর বারটি
বোধজাত আকার যেমন, দ্রব্যত্ব, একত্ব, বস্তুত্ব, কার্য,
কারণ ইত্যাদি ধারণা প্রয়োগ করে এগুলিকে সুসংবদ্ধ করে জাগতিক বস্তুর অভিজ্ঞতা সৃষ্টি
করে। সুতরাং জ্ঞানের বিষয় জ্ঞানের উপর নির্ভরশীল। দেশ, কাল, দ্রব্যত্ব, বহুত্ব, কার্য, কারণ ইত্যাদি যা মন নিজেই আরোপ করে, তা অবভাসিক জগতের
ক্ষেত্রেই প্রযুক্ত হতে পারে, অতীন্দ্রিয় জগতের ক্ষেত্রে প্রযুক্ত হতে পারে না। সংবেদন
আত্মগত, বিষয়গত নয়। অতত্রব, জ্ঞানের বিষয়রূপে আমরা যে জগতকে জানি তা এক
হিসেবে আমাদের মনের সৃষ্টি।
অতীন্দ্রিয় ভাববাদ
এ জগৎ অবভাসমাত্র। অতীন্দ্রিয় জগৎ আমাদের অভিজ্ঞতার মধ্যে ধরা পড়ে না। প্রকৃতপক্ষে,
জগতকে জানা যায় না। অবভাসিক জগতের কোন কিছুঅতীন্দ্রিয় জগতের উপর আরোপ করা
যায় না। কান্ট মন-নিরপেক্ষ অতীন্দ্রিয় জগতের অস্তিত্ব স্বীকার করেন। কিন্তুতাঁর মতে, এ
জগতের অস্তিত্ব জ্ঞানের উপর নির্ভরশীল নয়। এদিক থেকে বিচার করে এ মতবাদকে
অতীন্দ্রিয় ভাববাদ বলা হয়।
অবভাসিক ভাববাদ
জগতকে প্রকৃতরূপে না জেনে আমরা কেবল সেভাবেই জগতকে জানি যেভাবে আমরা একে
দেখি। ফলে বস্তুঅবভাসই জ্ঞানের একমাত্র বিষয়। অর্থাৎ অবভাস জ্ঞানের উপর নির্ভরশীল।
এদিক থেকে তাঁর মতবাদকে অবভাসিক বা পরিদৃশ্যমান ভাববাদ ) বলা হয়।
জগৎ অবভাসিক, অলীক নয়
কান্ট বলেন, যদিও পরিদৃশ্যমান জগতকে আমাদের মনগড়া এবং অবভাস বলা হয়, তথাপি এ
জগৎ অলীক নয়। এ জগৎ বাস্তব। এ জগতকে আমরা দেশ, কাল, দ্রব্য, কার্য, কারণ
ইত্যাদির সাহায্যে গড়ে তুলেছি, আর এগুলি অনস্বীকার্য সার্বভৌম জ্ঞানের আকার।
চিন্তার আকারগুলি নিরপেক্ষ ও সার্বভৌম
কান্টের অবভাসিক মন ও অতীন্দ্রিয় মনের তুলনা করলে দেখা যায় যে, অবভাসিক মন হলো
মানসিক প্রক্রিয়ার সমষ্টিমাত্র। আর অতীন্দ্রিয় মন হলো ‘অহং' বা ‘আমি'। কান্টের মতে, একে
জানা যায় না, এ হলো জ্ঞাতা। একে জানার চেষ্টা করলে অবভাসিক মনকেই জানতে পারি।
তাই দার্শনিক হিউমও অবভাসিক মনের অস্তিত্বকেই স্বীকার করেছেন। কান্টের মতে, জ্ঞানের
পক্ষে অবশ্য স্বীকার্য চিন্তার আকারগুলি অতীন্দ্রিয় মনেরই ক্রিয়া এবং যেহেতুএ সকল আকার
ব্যক্তি-নিরপেক্ষ ও সার্বভৌম সেহেতুআমরা সকলে একই জগতকে প্রত্যক্ষ করি।
সমালোচনা
যদিও কান্টের মতবাদ জ্ঞানের ক্ষেত্রে বিপ্লবের সৃষ্টি করেছে, তথাপি তাঁর মতবাদে নানা রকম ত্রæটি রয়েছে :
(১) কান্টের মতে, বস্তুর আসল সত্তা বা অতীন্দ্রিয় সত্তাকে জানা সম্ভব নয়। আমরা কেবল
অবভাসিক জগতকে জানতে পারি। কিন্তুঅতীন্দ্রিয় জগৎ যে আছে তাতে কোন সন্দেহ
নেই। এখন প্রশ্ন হলো, যে জগতকে জানা যায় না সে জগৎ যে আছে তা আমরা জানব
কী করে? আর যা জানা যায় না তার অস্তিত্ব স্বীকারের পেছনে কোন যুক্তিই নেই।
তাছাড়া এই অতীন্দ্রিয় জগতই যে সংবেদন সৃষ্টি করে তা জানব কী করে?
(২) কান্টের মতে, জ্ঞান অবভাসিক জগতেই সীমাবদ্ধ, প্রকৃত বস্তুকে আমরা জানতে পারি
না। কিন্তুপরিবেশের উপর মন ক্রিয়া করার জন্যই জ্ঞানের উদ্ভব। পরিবেশের যথার্থ
ব্যাখ্যাই হলো জ্ঞান। সুতরাং যথার্থ জ্ঞানকে যদি স্বীকার করতে হয়, তাহলে আমাদের
পরিবেশ বা জগৎ যে অবভাসিক নয়, বরং আসল তা স্বীকার করতে হয়।
বস্তুত কান্ট হিউমের সংশয়বাদকে অস্বীকার করে বস্তুজগতের অস্তিত্ব প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা
করেন। তাঁর সিদ্ধান্ত ভাববাদের পক্ষে সমর্থন বৃদ্ধি করে। ভাববাদের মতে, বিষয় জ্ঞান-নির্ভর।
পরবর্তীকালে ভাববাদের চরম পরিণতি হেগেলের বস্তুগত ভাববাদ কান্টের সিদ্ধান্তকে ভিত্তি
করেই গড়ে ওঠে। ভাববাদের এই চরম পরিণতির জন্য কান্টই দায়ী, অনেক বাস্তববাদী তাই
কান্টের উপর বিরক্ত। বার্ট্র্যান্ড রাসেল কান্টের মতকে আধুনিক দর্শনের ‘দুর্ভাগ্য' বলে অভিহিত
করেন। তবে কান্টের মতবাদে অনেক দোষ থাকলেও সমস্ত জ্ঞান ব্যাখ্যার বিশ্লেষণ করতে
তিনি যে বুদ্ধি, ধৈর্য্য ও সূক্ষè বিশ্লেষণ শক্তির পরিচয় দিয়েছেন, সমস্ত দর্শনের ইতিহাসে তার
তুলনা মেলা ভার। তাই সকল দেশের সকল কালের দার্শনিকদের মধ্যে কান্ট এক বিশিষ্ট স্থান অধিকার করে আছেন।
সারাংশ
কান্টের মতে, জ্ঞানের বিষয় জ্ঞানের উপরই নির্ভরশীল। তাঁর মতে, পরিদৃশ্যমান জগতের
আড়ালে আর এক অতীন্দ্রিয় জগৎ আছে যা আমরা জানতে পারি না। কিন্তুপরিদৃশ্যমান
জগতের সকল সংবেদনের উৎস সেই অতীন্দ্রিয় জগৎ। এই সংবেদনগুলি দেশ ও কালের
মাধ্যমে যখন মনের কাছে উপস্থিত হয় তখন মন এই সংবেদনের উপর কতগুলি বোধজাত
আকার প্রয়োগ করে সেগুলিকে সংবদ্ধ করে জাগতিক বস্তুর অভিজ্ঞতা সৃষ্টি করে। সুতরাং
জ্ঞানের বিষয় জ্ঞানের উপরই নির্ভর করে। জ্ঞানের বিষয়রূপে আমরা যে জগতকে জানি তা অবভাসমাত্র।
রচনামূলক প্রশ্ন
১। অবভাসিক ভাববাদ সমালোচনাসহ ব্যাখ্যা করুন।
সংক্ষিপ্ত উত্তরমূলক প্রশ্ন
১। অবভাসিক ভাববাদের মূল বক্তব্য সংক্ষেপে বর্ণনা করুন।
২। কান্টের ভাববাদের দুটি সমালোচনা উল্লেখ করুন।
নৈর্ব্যক্তিক প্রশ্ন
সঠিক উত্তর লিখুন
১। অবভাসিক ভাববাদ অনুযায়ী
(অ) অতীন্দ্রিয় জগতকে জানা যায় না (আ) অতীন্দ্রিয় জগতকে জানা যায়
(ই) পরিদৃশ্যমান জগতকে জানা যায় (ঈ) পরিদৃশ্যমান জগতকে জানা যায় না।
২। অবভাসিক ভাববাদ অনুসারে, সংবেদনের উৎস হলো
(অ) পরিদৃশ্যমান জগৎ (আ) মন
(ই) অতীন্দ্রিয় জগৎ (ঈ) অভিজ্ঞতা
৩। কান্ট বোধজাত আকারের কথা বলেছেনÑ
(অ) ৮ টি (আ) ১০ টি
(ই) ১২ টি (ঈ) ১৪ টি
৪। অবভাসিক ভাববাদ অনুযায়ী পরিদৃশ্যমান জগৎÑ
(অ) অলীক (আ) অবভাস
(ই) প্রকৃত (ঈ) সব কয়টি
সত্য হলে ‘স', মিথ্যা হলে ‘মি' লিখুন।
১। অবভাসিক ভাববাদের প্রবক্তা হিউম।
২। কান্টের ভাববাদকে কোপারনিকাসের মতবাদের সাথে তুলনা করা হয়।
৩। কান্টের ভাববাদের অনিবার্য পরিণতি হেগেলের বস্তুগত ভাববাদ।
৪। বার্ট্র্যান্ড রাসেলের মতে, কান্টের মতবাদ আধুনিক দর্শনের ইতিহাসে এক গৌরবোজ্জ্বল
অধ্যায়।
সঠিক উত্তর
১। (অ) অতীন্দ্রিয় জগতকে জানা যায় না ২। (ই) অতীন্দ্রিয় জগৎ
৩। (ই) ১২ টি ৪। (আ) অবভাস
১। মি ২। স ৩। স ৪। মি

FOR MORE CLICK HERE
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস মাদার্স পাবলিকেশন্স
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস ১ম পর্ব
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস
আমেরিকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস
বাংলাদেশের ইতিহাস মধ্যযুগ
ভারতে মুসলমানদের ইতিহাস
মুঘল রাজবংশের ইতিহাস
সমাজবিজ্ঞান পরিচিতি
ভূগোল ও পরিবেশ পরিচিতি
অনার্স রাষ্ট্রবিজ্ঞান প্রথম বর্ষ
পৌরনীতি ও সুশাসন
অর্থনীতি
অনার্স ইসলামিক স্টাডিজ প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত
অনার্স দর্শন পরিচিতি প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত

Copyright © Quality Can Do Soft.
Designed and developed by Sohel Rana, Assistant Professor, Kumudini Government College, Tangail. Email: [email protected]