হেগেলকে (১৭৭০-১৮৩১) জার্মান ভাববাদের রাজকুমার বলা হয়। কান্টের অসামঞ্জস্যপূর্ণ
অতীন্দ্রিয় ভাববাদ এবং ফিকটে ও শেলিং-এর একপেশে মতবাদ (ফিকটের মতে আত্মা বাস্তব,
আর শেলিং-এর মতে প্রকৃতি বাস্তব) এর চরম পরিণতিই হেগেলের বস্তুগত ভাববাদ। এ
মতবাদে তিনি কান্ট, ফিকটে ও শেলিং-এর মতবাদের সমন¦য়ের মাধ্যমে জ্ঞাতা ও জ্ঞেয়বস্তু
সম্পর্কে নিজস্ব মতবাদ ব্যক্ত করেছেন। তিনি কান্টের পরিদৃশ্যমান জগৎ ও অতীন্দ্রিয় জগতের
পার্থক্য অস্বীকার করেন। তাঁর মতে, পরিদৃশ্যমান জগতই প্রকৃত জগৎ। কারণ পরম সত্তা
চেতনার মাধ্যমেই পরিদৃশ্যমান সত্তারূপে নিজেকে প্রকাশ করেন। এ পরম সত্তা বা পরমাত্মা
এমন এক চেতন সত্তা যা একাধারে জ্ঞাতা ও জ্ঞেয়।
বস্তুগত ভাববাদ বা পরম ভাববাদ (ঙনলবপঃরাব ড়ৎ অনংড়ষঁঃব ওফবধষরংস)
জীবাত্মা ও জড়বস্তুউভয়ই পরমাত্মার প্রকাশ
হেগেলের মতে, মন ও বাহ্যবস্তুউভয়ই পরম আত্মার প্রকাশ। তাই মন বা জ্ঞানের বিষয়রূপে
বাহ্য জগতের স্বতন্ত্র সত্তা আছে। মন ও বাহ্যবস্তুএকই পরমাত্মার প্রকাশ বলেই আমাদের
পক্ষে বাহ্যবস্তুসর্ম্পকে জ্ঞানলাভ করা সম্ভব হয়। জ্ঞানের অপরিহার্য বিষয় হিসেবে পরিদৃশ্যমান
বস্তুর জ্ঞানাতিরিক্ত সত্তা স্বীকার করা হয় বলে হেগেলের ভাববাদকে বস্তুগত ভাববাদ বলা হয়।
কান্টের মতে, পরিদৃশ্যমান আত্মা ও অতীন্দ্রিয় আত্মা পরস্পর পৃথক। ব্যক্তিভেদে পরিদৃশ্যমান
আত্মার ভিন্ন ভিন্ন রূপ হয়। কিন্তুঅতীন্দ্রিয় আত্মা সকলের মধ্যেই এক। কিন্তুকান্ট অতীন্দ্রিয়
আত্মা এবং পরিদৃশ্যমান আত্মার যে যোগসূত্র তাকে যথার্থভাবে ব্যাখ্যা করতে পারেননি।
হেগেল এই যোগসূত্র প্রতিষ্ঠা করেন। হেগেলের মতে, পরমাত্মাই হলো পরম সত্তা এবং
জীবাত্মা পরমাত্মারই খন্ড প্রকাশ। জীবাত্মা পরমাত্মা থেকেই উদ্ভূত এবং জীবাত্মার মধ্য দিয়েই
পরমাত্মা নিজেকে প্রকাশ করেছে। জীবাত্মা ও জড়বস্তুউভয়ই পরমাত্মার প্রকাশ এবং সেজন্য
তারা মূলত এক।
পরমাত্মা : সত্য, সুন্দর ও মঙ্গলের আধার
হেগেলের মতে, পরমাত্মা বিশ্বের অন্তর্নিহিত সত্য। এ সত্য, সুন্দর ও মঙ্গলের আধার।
পরমাত্মা হলো এক সর্বব্যাপী আধ্যাত্মিক সত্তা। পরমাত্মা নিজ সত্তাকে জগতের আকারে
প্রকাশ করে। এ একাধারে জ্ঞাতা ও জ্ঞেয়। পরমাত্মা জীবন্ত ও গতিশীল। তার গতি দ্বান্দি¡ক
পদ্ধতিতে চলে। পরমাত্মাতেই এই গতির শুরু এবং সেখানেই এর শেষ।
দ্বান্দি¡ক গতি : পক্ষ, বিপক্ষ ও সমন¦য়
দ্বান্দি¡ক গতি পক্ষ , বিপক্ষ () ও সমন¦য় এর মাধ্যমেই সম্পন্ন
হয়। পক্ষে যা প্রতিষ্ঠিত হয় বিপক্ষে তার বিরুদ্ধ ধারণার মধ্য দিয়ে সমন¦য়ে তা এক উচ্চ
ধারণায় সমনি¦ত হয়। কিন্তুএখানেই সমন¦য়ের কাজ শেষ হয় না। অন্তর্দ্বন্দ¡ই এই কাজের প্রাণ।
সমন¦য় চরম প্রশান্তিরূপে স্থায়ী না হয়ে আবার সে নিজের বিরোধ সৃষ্টি করে, ফলে নতুন
সমন¦য়ের প্রয়োজন হয়। এ রকম নানা পক্ষ, বিপক্ষ ও সমন¦য়ের মধ্য দিয়েই পরমাত্মা আপনার
কাজ চালিয়ে যান। এই কাজে নতুন পুরাতনকে পরিত্যাগ না করে নিজের মধ্যে গ্রহণ করে
নেয়। নতুনের মধ্যে পুরাতনের পুনর্জন্ম ও পূর্ণতর প্রকাশ ঘটে। এখানে কিছুই হারায় না, সবই
পরমাত্মার সংস্পর্শে নতুন জীবন লাভ করে। এভাবে বিরোধ ও সমন¦য়ের মাধ্যমে পরমাত্মা
তার কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন এবং সীমার মধ্যে অসীমের প্রকাশ সুন্দর ও মধুরভাবে ফুটে
উঠেছে।
পরমাত্মা জ্ঞান বা বুদ্ধিস্বরূপ
হেগেলের মতে, সাধারণত পরমাত্মার তিনটি অবস্থা আমরা দেখতে পাই। প্রথমত বিশুদ্ধ বুদ্ধির
মাধ্যমে পরমাত্মা নিজেকে প্রকাশ করেন। যাকে আমরা বিশুদ্ধ বুদ্ধিরূপে পক্ষ বলতে পারি।
দ্বিতীয়ত বিপক্ষরূপে সৃষ্ট হয় জড় জগৎ। তৃতীয়ত সমন¦য়রূপে সৃষ্টি হয় আত্মচেতনায় উপলব্ধ
ধর্ম, শিল্প ও দর্শনের। দর্শনের মাধ্যমেই পরমাত্মার পরম পরিচয় পাওয়া যায়।
হেগেল বলেন, বৈচিত্র্য ও বহুর মধ্যেই পরমাত্মার প্রকাশ ঘটে। আর একেই বিবর্তন বলে।
তবে এ কালিক বিবর্তন নয়। আধ্যাত্মিক বিবর্তন। এক বহুর মধ্যে প্রকাশিত হয়, অসীম
সীমার মধ্যে পরিবর্তিত হয়, এসবই পরমাত্মার কাজ। সব কিছুর মধ্য দিয়েই পরমাত্মার প্রকাশ
ঘটে বলে হেগেল সব কিছুকেই জ্ঞানময় বলেন। পরমাত্মা জ্ঞান বা বুদ্ধিস্বরূপ। যা কিছুসৎ
সবই পরমাত্মার প্রকাশ বলে যা কিছুসৎ সবই বুদ্ধি বা জ্ঞানস্বরূপ। তবে পরমাত্মার চেতনার
প্রকাশ সর্বত্র সমান হয় না।
পরমাত্মা আত্মসচেতন
হেগেল বলেন, পরমাত্মা এই বিশ্বে যেমন বর্তমান তেমনি বিশ্বের বাইরেও বর্তমান। মানুষের
মনে ও বহির্জগতে এই পরমাত্মা নিজেকে প্রকাশ করেন। কিন্তুনিজে এদের মধ্যে বিলীন হয়ে
যাননি। পরমাত্মা আত্ম-সচেতন, চেতনা বা জ্ঞান তার কোন গুণ নয়। আত্ম-সচেতন বলতে
নিজের চেতনা সম্পর্কে সচেতনতা বোঝায়। জ্ঞানের ক্ষেত্রে যেমন জ্ঞাতা ও জ্ঞানের বিষয়
আবশ্যক এবং আত্ম-সচেতন মন যেমন জ্ঞাতা ও জ্ঞানের বিষয়ের সমন¦য় করে তেমনি
পরমাত্মা জ্ঞাতা ও জ্ঞানের বিষয়ের মধ্যে সমন¦য় সাধন করে।
হেগেল বলেন, আমরা যখন নিজেকে সসীম বলে মনে করি তখন ভাবি নিশ্চয়ই অসীম কেউ
আছেন। না হয় আমার চেতনা সসীম হবে কেন? সসীম চেতনাই অসীম চেতনার অস্তিত্ব প্রমাণ
করে।
সমালোচনা
হেগেলের মতবাদ যেমন ব্যাপক প্রশংসা কুড়ায় তেমন ব্যাপকভাবে সমালোচিত হয়। দার্শনিক
বার্ট্র্যান্ড রাসেল হেগেলের পরমাত্মা বা ঈশ্বরকে ‘সত্যিকারের অধ্যাপকের ঈশ্বর' (ঃৎঁষু ধ
ঢ়ৎড়ভবংংড়ৎ'ং এড়ফ) বলে ঠাট্টা করেন। বস্তুত বুদ্ধি বা চিন্তা কিভাবে সকল কিছুর মধ্য দিয়ে
নিজেকে প্রকাশ করে? তা দুর্বোধ্য। অপরদিকে বলা হয়, হেগেলের বস্তুগত ভাববাদ বিজ্ঞান,
দর্শন ও ধর্মের মধ্যে সমন¦য় সাধন করে। বুদ্ধি ও ইন্দ্রিয়; বস্তুস্বরূপ ও বস্তুঅবভাস; এক ও
বহু; বিজ্ঞান, দর্শন ও ধর্ম এসবের মধ্যে দীর্ঘদিন যাবৎ যে তাত্তি¡ক বিরোধ চলে আসছে,
হেগেলের ভাববাদ তা দূর করে চমৎকার সমন¦য় সাধন করে।
ক) রচনামূলক প্রশ্ন
১। বস্তুগত ভাববাদ সমালোচনাসহ ব্যাখ্যা করুন।
খ) সংক্ষিপ্ত উত্তরমূলক প্রশ্ন
১। হেগেল কিভাবে জীবাত্মা ও জড়বস্তুর ব্যবধান দূর করেন?
২। হেগেলের দ্বান্দি¡ক গতি ব্যাখ্যা করুন।
গ) নৈর্ব্যক্তিক প্রশ্ন
সঠিক উত্তর লিখুন
১। জার্মান ভাববাদের রাজকুমার-
(অ) কান্ট (আ) হেগেল
(ই) মার্কস (ঈ) শোফেন হাওয়ার
২। হেগেলের বস্তুগত ভাববাদে কাদের মতবাদের সমন¦য় ঘটে-
(অ) মূর, রাসেল, ভিটগেনস্টাইন (আ) সক্রেটিস, প্লেটো, এরিস্টোটল
(ই) কান্ট, ফিকটে, শেলিং (ঈ) জেমস, ডিউই, শিলার
৩। জীবাত্মা ও জড়বস্তুউভয়ই পরমাত্মার প্রকাশ- এ কথা বলেন
(অ) কান্ট (আ) হেগেল
(ই) শোফেন হাওয়ার (ঈ) বার্কলি
৪। দ্বান্দি¡ক গতি পক্ষ, বিপক্ষ ও সমন¦য়ের মাধ্যমে সম্পন্ন হয়- বলেন
(অ) রাসেল (আ) হিরাক্লিটাস
(ই) হেগেল (ঈ) সার্ত
সঠিক উত্তর
১। (আ) হেগেল ২। (ই) কান্ট, ফিকটে, শেলিং ৩। (আ) হেগেল ৪। (ই) হেগেল
FOR MORE CLICK HERE
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস মাদার্স পাবলিকেশন্স
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস ১ম পর্ব
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস
আমেরিকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস
বাংলাদেশের ইতিহাস মধ্যযুগ
ভারতে মুসলমানদের ইতিহাস
মুঘল রাজবংশের ইতিহাস
সমাজবিজ্ঞান পরিচিতি
ভূগোল ও পরিবেশ পরিচিতি
অনার্স রাষ্ট্রবিজ্ঞান প্রথম বর্ষ
পৌরনীতি ও সুশাসন
অর্থনীতি
অনার্স ইসলামিক স্টাডিজ প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত
অনার্স দর্শন পরিচিতি প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত