দেশের বস্তুগত ধারণা দেশের আত্মগত ধারণা কালের বস্তুগত ধারণা কালের আত্মগত ধারণা উল্লেখ করুন।

দেশ ও কাল আত্মগত না বস্তুগত-এ নিয়ে দার্শনিকদের মধ্যে মতভেদ রয়েছে। কারো কারো
মতে, দেশ ও কালের বস্তুগত সত্তা আছে। কারো কারো মতে, দেশ ও কাল ব্যক্তি-মনের
ধারণা ছাড়া আর কিছুই নয়। আবার কারো কারো মতে, দেশ ও কাল আত্মগত ও বস্তুগত
উভয়ই। আমরা এখন দেশ-কাল কী? তা নিয়ে আলোচনা করবো।
দেশ ও কাল : বস্তুগত
দেশ ও কাল : সাধারণ ধারণা
সাধারণত মনে করা হয়, দেশ ও কালের মন-নিরপেক্ষ বস্তুগত সত্তা আছে। এরা যেন দুটি
আধারের মত সমস্ত বস্তুও ঘটনাকে ধারণ করে আছে। এই মতে, দেশ ও কালের সাথে বস্তুও
ঘটনার এক আধার-আধেয় সম্পর্ক রয়েছে। দেশ ও কাল
সম্পর্কে সাধারণ লোকের এই ধারণা নিউটন ও গ্যালিলিও-র মত বিজ্ঞানীরাও সমর্থন
করেছেন। তাঁদের মতে, দেশ ও কাল যেন দুটি বিষয়গত আধার, সমস্ত বস্তুই দেশে থাকে এবং সমস্ত ঘটনাই কালে ঘটে।
ডেকার্টের মতে দেশ জড়ের স্বরূপ
ডেকার্টের মতে, জড় একটি দ্রব্য। বিস্তৃতি জড়ের স্বরূপ। বিস্তৃতি ছাড়া জড় থাকতে পারে না,
আবার জড় ছাড়াও বিস্তৃতি থাকতে পারে না। বিস্তৃতি ও দেশ সমার্থক। সুতরাং দেশ জড়ের স্বরূপ। অর্থাৎ দেশ বিষয়গত সত্তাসম্পন্ন।
স্পিনোজার মতে দেশ স্রষ্টা বা প্রকৃতির গুণ
স্পিনোজার মতে, স্রষ্টাই পরম তত্ত¡ ও সত্য। স্রষ্টার রয়েছে অনন্ত গুণ। বিস্তৃতি বা দেশ এই
অনন্ত গুণের অন্যতম গুণ। অর্থাৎ দেশ বা বিস্তৃতি স্রষ্টাতে বর্তমান। স্পিনোজার দর্শনে যা স্রষ্টা
তাই প্রকৃতি। সুতরাং স্রষ্টা বা প্রকৃতির গুণ হলো দেশ। কাজেই দেশ বিষয়গত বা বস্তুগত।
আলেকজান্ডারের মতে দেশ-কাল
আধুনিককালে, আলেকজান্ডার দেশ ও কালকে পরম জাগতিক সত্তা বলে মনে করেন। তাঁর মতে, দেশ-কালই জগতের সমস্ত বস্তুর মৌলিক উপাদান।
নিউটনের মত তিনি দেশ ও কালকে পরস্পর-নিরপেক্ষ বলে মানতে রাজী নন। তাঁর মতে,
দেশ ও কালের পরস্পর-নিরপেক্ষ কোন সত্তা নেই। দেশ বলতে আমরা কতগুলি বিন্দুর একত্র
সমাবেশই বুঝি। কিন্তুবিন্দুগুলি যদি পর পর না থাকে, তবে কোন দেশ সৃষ্টি হয় না। পর পর
বা পরম্পরা কাল সূচনা করে। সুতরাং দেশের ধারণার মধ্যেই কালের ধারণা নিহিত।
অন্যদিকে, কালের ধারণার মধ্যেও দেশের ধারণা আছে। কাল বলতে আমরা পারম্পর্য বুঝি।
কিন্তুশুধুপারম্পর্য বোধগম্য নয়। একটি বিন্দুযদি আর একটি বিন্দুর পরে হয়, তবে তাদের
মধ্যে দেশের দিক দিয়ে যেমন থাকে পূর্বাপর সম্পর্ক তেমনি থাকে কালিক পারম্পর্য। বস্তুত
দেশগত পূর্বাপর সম্পর্কই কালগত পারম্পর্য নির্দেশ করে। সুতরাং পরম্পরা বুঝতে গেলে
দেশের ধারণা আপনি এসে যায়। কাজেই কাল কখনই দেশ ছাড়া হয় না। সুতরাং দেশ-কাল
একান্তভাবেই পরস্পরসাপেক্ষ। তাঁর মতে, দেশ-কাল বিশ্বের আদি উপাদান। জড়, প্রাণ, মন
সব কিছুই দেশ-কাল থেকে এসেছে।
বার্গসোঁর মতে কাল হলো সত্য ও পরম সত্তা
বার্গসোঁর মতে, অনাদি-অনন্ত কাল প্রবাহই হলো পরম সত্তা। কাল এক ও অবিভাজ্য। কাল
এক অনন্ত প্রবাহ -একমাত্র স্বজ্ঞার (রহঃঁরঃরড়হ) সাহায্যেই এই পরম সত্তাকে জানা যায়। বুদ্ধি
দিয়ে এর যথার্থ স্বরূপ উপলব্ধি করা যায় না। বুদ্ধির সাহায্যে কালকে উপলব্ধি করতে গেলেই
কালকে খন্ড খন্ডভাবে প্রত্যক্ষ করতে হয় এবং তার ফলে স্থিরতার ভ্রান্তি জন্মায়। দেশের কোন
বস্তুসত্তা নেই, এ হলো মনের সৃষ্টি। কালই হলো সত্য ও পরম সত্তা।
দেশ ও কাল : আত্মগত
দেশ ও কাল : লিবনিজের মত
লিবনিজ দেশ ও কালের বস্তুগত সত্তার কথা স্বীকার করেন না। তাঁর মতে, চিৎ পরমাণু
(সড়হধফ) হলো এমন এক ধরনের সত্তা, যার বৈশিষ্ট্য হচ্ছে গতিশীলতা। নিয়ত গতিশীল চিৎ
পরমাণুজড়বস্তুনয় বলে এর কোন দেশ বা বিস্তৃতি নেই। দেশ হচ্ছে চিৎ পরমাণুসম্বন্ধে
আমাদের ভ্রান্ত ধারণার ফলে উদ্ভূত অভিজ্ঞতাজাত ধারণামাত্র। অনুরূপভাবে, কালও চিৎপরমাণু
সম্বন্ধে আমাদের বিশৃঙ্খল ধারণার ফলে উদ্ভূত অভিজ্ঞতাজাত ধারণা ছাড়া আর কিছুই নয়।
সংক্ষেপে বলা যায়, লিবনিজের মতে, দেশ হচ্ছে বিশৃঙ্খল প্রত্যক্ষণ-উদ্ভূত ফল এবং বস্তুর
অবভাসিক রূপ বা দিক। শূন্য দেশ বা শূন্য কাল বলে কিছুনেই। সুতরাং লিবনিজের মতে,
দেশ ও কাল সম্পর্কিত ধারণা আত্মগত।
দেশ ও কাল : অভিজ্ঞতাবাদীদের মত
অভিজ্ঞতাবাদীদের মতে, দেশ ও কাল হলো সামান্য ধারণা। লক, বার্কলি, হিউম, মিল প্রমুখ
অভিজ্ঞতাবাদী দার্শনিকরা মনে করেন, দেশ ও কাল হলো সামান্য ধারণা। অভিজ্ঞতার সাহায্যে
বিশেষ বিশেষ দেশ ও বিশেষ বিশেষ কালের প্রত্যক্ষণ থেকেই আমরা দেশ ও কালের সামান্য ধারণা গঠন করি।
দেশ ও কাল : কান্টের মত
কান্টের মতে, দেশ ও কাল হলো জ্ঞানের পূর্বতঃসিদ্ধ আকার। কান্ট (কধহঃ) পূর্বোক্ত মতের
সমালোচনা করে বলেন যে, দেশ ও কাল যদি অভিজ্ঞতাপ্রসূত ধারণা হয়, তা হলে জ্যামিতি ও
গণিতে যে দেশ ও কালের সার্বিক ও অনস্বীকার্য ধারণাগুলি দেখি, সেগুলি কখনও পাওয়া যেত
না। অথচ জ্যামিতি ও গণিতের সত্য সর্বজন স্বীকৃত সত্য; এই সত্য সংশয়াত্মক নয়,
সুনিশ্চিত। কান্টের মতে, দেশ ও কাল অভিজ্ঞতাপ্রসূত নয়, কারণ দেশ ও কালের ধারণাই
অভিজ্ঞতাকে সম্ভব করে তোলে। দেশ ও কাল অভিজ্ঞতার পূর্বগামী। এ হলো জ্ঞানের
পূর্বতঃসিদ্ধ আকার, বস্তু ও ঘটনার পারম্পরিক সম্পর্ক প্রত্যক্ষ করার উপায়স্বরূপ। বস্তুর
অতীন্দ্রিয় সত্তা যে সংবেদন উৎপন্ন করে তাকে দেশ ও কালের মধ্যে প্রত্যক্ষ করাই মনের ধর্ম।
তবে কান্টের মতে, দেশ ও কাল এই পরিদৃশ্যমান অবভাসিক জগৎ সম্পর্কেই সত্য; অতীন্দ্রিয় জগৎ সম্পর্কে সত্য নয়।
দেশ ও কাল : কার্ল পিয়ার্সনের মত
কার্ল পিয়ার্সন )-এর মতে, দেশ ও কাল হলো বিচ্ছিন্ন বস্তুকে প্রতক্ষ করার
মাধ্যম। কার্ল পিয়ার্সনও কান্টের মত সমর্থন করে বলেন, দেশ ও কাল পরিদৃশ্যমান জগতের
কোন বস্তুনয়, বিচ্ছিন্ন বস্তুকে প্রত্যক্ষ করার উপায় বা মাধ্যম স্বরূপমাত্র।
দেশ ও কাল : বস্তুগত ও আত্মগত উভয়ই (ঝঢ়ধপব ধহফ ঞরসব: ইড়ঃয ঙনলবপঃরাব ্
ঝঁনলবপঃরাব)
কান্টের মতবাদ গ্রহণযোগ্য নয়। কারণ কান্ট পরিদৃশ্যমান জগৎ ও অতীন্দ্রিয় জগৎ উভয়ের
মধ্যে এক অনাবশ্যক বিরোধ সৃষ্টি করেছেন। বস্তুর অতীন্দ্রিয় সত্তা যদি তার পরিদৃশ্যমান সত্তার
মাধ্যমে নিজেকে প্রকাশ না করে তাহলে সেই অতীন্দ্রিয় সত্তা আছে এমন কথা বলা যায় না।
হেগেল উভয়ের মধ্যের এই বিরোধকে দূরীভ‚ত করেন। তাঁর মতে, পরিদৃশ্যমান জগৎ প্রকৃত
জগৎ, যার সত্তা আছে, তাই বুদ্ধিগ্রাহ্য। আমরা দেশে ও কালে বস্তুও ঘটনা প্রত্যক্ষ করি,
কারণ দেশ ও কালের বাস্তব সত্তা আছে। কিন্তুদেশ ও কাল কেবলমাত্র ব্যক্তি মনেরই
পূর্বতঃসিদ্ধ আকার নয়, এরা পরমাত্মার বা পরম সত্তার (অনংড়ষঁঃব) মনের আকার। এই জগৎ
পরমাত্মার মনেরই বস্তুগত প্রকাশ এবং ব্যক্তি মন বা ব্যক্তি চেতনা পরমাত্মা বা বিশ্ব চেতনারই
প্রতিরূপ। সুতরাং দেশ ও কালের অস্তিত্ব যে কেবলমাত্র ব্যক্তি মনের তা নয়, প্রকৃতিতে তাদের
বস্তুগত অস্তিত্ব আছে। সুতরাং দেশ ও কাল বস্তুগত ও আত্মগত উভয়ই।
সারাংশ
কারো কারো মতে, দেশ ও কাল বস্তুগত; কারো কারো মতে, দেশ ও কাল আত্মগত; আবার
কারো মতে, আত্মগত ও বস্তুগত উভয়ই। যাদের মতে দেশ ও কাল বস্তুগত, তাদের ধারণা
হলো বস্তুও ঘটনা দেশ ও কালের মধ্যে অবস্থান করে, তাই দেশ ও কাল বস্তুগত। যাদের
মতে দেশ ও কাল আত্মগত, তাদের কারো কারো ধারণা হলো বিশেষ বিশেষ দেশ ও বিশেষ
বিশেষ কালের প্রত্যক্ষণ থেকেই দেশ ও কালের সামান্য ধারণার সৃষ্টি হয়েছে। কারো কারো
মতে, দেশ ও কাল হলো জ্ঞানের পূর্বতঃসিদ্ধ আকার, বস্তুও ঘটনার পারম্পরিক সম্পর্ক
প্রত্যক্ষ করার উপায়। যাদের মতে দেশ ও কাল বস্তুগত ও ধারণাগত, তাদের ধারণা হলো
যেহেতুদেশ ও কালে আমরা বস্তুপ্রত্যক্ষ করি সেহেতুএদের বস্তুসত্তা আছে। কিন্তুদেশ ও
কাল কেবলমাত্র ব্যক্তি-মনেরই পূর্বতঃসিদ্ধ আকার নয়, এরা পরমাত্মার মনেরও আকার।
সুতরাং দেশ ও কাল বস্তুগত ও আত্মগত উভয়ই।
রচনামূলক প্রশ্ন
১। দেশ ও কাল আত্মগত না বস্তুগত? আপনার মতামত ব্যক্ত করুন।
সংক্ষিপ্ত উত্তরমূলক প্রশ্ন
১। দেশের বস্তুগত ধারণা ব্যাখ্যা করুন।
২। দেশের আত্মগত ধারণা তুলে ধরুন।
৩। কালের বস্তুগত ধারণা ব্যাখ্যা করুন।
৪। কালের আত্মগত ধারণা উল্লেখ করুন।
নৈর্ব্যক্তিক প্রশ্ন
সঠিক উত্তর লিখুন।
১। দেশ ও কাল বস্তুগত -এ মতবাদের অনুসারী হলেন
(অ) ডেকার্ট (আ) লিবনিজ
(ই) কার্ল পিয়ার্সন (ঈ) হেগেল
২। কাণ্টের মতে, দেশ ও কাল হলো
(অ) জ্ঞানের পূর্বতঃসিদ্ধ আকার (আ) বস্তুও ঘটনার আধার
(ই) প্রত্যক্ষলব্ধ ধারণা (ঈ) কোনটিই নয়।
৩। কার্ল পিয়ার্সন সমর্থন করেন
(অ) লকের মতবাদ (আ) হিউমের মতবাদ
(ই) কান্টের মতবাদ (ঈ) হেগেলের মতবাদ
৪। হেগেলের মতে, দেশ ও কাল হলো
(অ) বস্তুগত (আ) আত্মগত
(ই) বস্তুগত ও আত্মগত উভয়ই (ঈ) কোনটিই নয়।
সত্য হলে ‘স', মিথ্যা হলে ‘মি' লিখুন।
১। সাধারণ লোকের মতে, দেশ ও কালের সাথে বস্তুও ঘটনার সম্পর্ক হলো আধার ও
আধেয়ের।
২। দেশ ও কালের বস্তুগত ধারণা সর্বজনস্বীকৃত।
৩। বার্গসোঁর মতে, দেশ হলো সত্য ও পরম সত্তা।
৪। লিবনিজের মতে, কাল হলো বিশৃ´খল ধারণার ফল।
সঠিক উত্তর
১। (অ) ডেকার্ট ২। (অ) জ্ঞানের পূর্বতঃসিদ্ধ আকার
৩। (ই) কান্টের মতবাদ ৪। (ই) বস্তুগত ও আত্মগত উভয়ই

FOR MORE CLICK HERE
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস মাদার্স পাবলিকেশন্স
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস ১ম পর্ব
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস
আমেরিকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস
বাংলাদেশের ইতিহাস মধ্যযুগ
ভারতে মুসলমানদের ইতিহাস
মুঘল রাজবংশের ইতিহাস
সমাজবিজ্ঞান পরিচিতি
ভূগোল ও পরিবেশ পরিচিতি
অনার্স রাষ্ট্রবিজ্ঞান প্রথম বর্ষ
পৌরনীতি ও সুশাসন
অর্থনীতি
অনার্স ইসলামিক স্টাডিজ প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত
অনার্স দর্শন পরিচিতি প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত

Copyright © Quality Can Do Soft.
Designed and developed by Sohel Rana, Assistant Professor, Kumudini Government College, Tangail. Email: [email protected]