দ্রব্য সম্পর্কে অভিজ্ঞতাবাদীদের মতামত দ্রব্য সম্পর্কে হেগেলের মতবাদ ব্যাখ্যা করুন।

এই বিশ্ব এবং বিশ্বের সকল বস্তুর পেছনে যে বস্তুরয়েছে বলে ধারণা করা হয় তাকে দ্রব্য
নামে অভিহিত করা হয়। এই দ্রব্য সম্পর্কে সাধারণ মানুষ এক ধরনের মতবাদ
পোষণ করেন', দার্শনিকরা আরেক ধরনের মতবাদ পোষণ করেন। আবার দার্শনিকদের মধ্যে
বুদ্ধিবাদীরা এক ধরনের মতবাদ, অভিজ্ঞতাবাদীরা আরেক ধরনের মতবাদ; কান্ট, হেগেল
প্রমুখ দার্শনিক আরেক ধরনের মতবাদ পোষণ করেন। আমরা এখন দ্রব্য সম্পর্কে এই বিভিন্ন মতবাদ আলোচনা করবো।
সাধারণের মতে দ্রব্য
সাধারণের মতে, যে কোন বস্তুই কতগুলি গুণের সমষ্টি, কিন্তুগুণগুলি একা একা অবস্থান
করতে পারে না; গুণ যাকে আশ্রয় করে থাকে তাকে দ্রব্য বলে। দ্রব্যকে গুণগুলি থেকে পৃথক
করে চিন্তা করা যায়। যেমন- লবণ, এই বস্তুর গুণগুলি হলো নোনতা, সাদা, কঠিন ইত্যাদি।
লবণের দ্রব্যত্ব হলো এই গুণগুলির আধারবিশেষ। সুতরাং বস্তুহলো দ্রব্য ও গুণের সমষ্টি। এই
দ্রব্যের স্বরূপ সম্পর্কে যে ধারণাগুলি পোষণ করা হয় তাহলো : (১) শত পরিবর্তনের মধ্যেও
দ্রব্য মোটামুটি অপরিবর্তিত থাকে (২) দ্রব্য হলো বস্তুর ক্রিয়া, শক্তি ও প্রচেষ্টার উৎস (৩)
বস্তুর গুণের মাধ্যমে দ্রব্য নিজেকে প্রকাশ করে। বুদ্ধিবাদীদের মতে দ্রব্য
বুদ্ধিবাদী ডেকার্ট ও স্পিনোজার মতে, যা স্বনির্ভর ও অন্যনিরপেক্ষ স্থিতিসম্পন্ন তাই দ্রব্য।
অন্যনিরপেক্ষতা দ্রব্যের স্বরূপ। গুণ দ্রব্যের উপরই নির্ভরশীল। দ্রব্য ছাড়া গুণ থাকতে পারে
না। সুতরাং গুণ দ্রব্য নয়। গুণ দ্রব্যে আশ্রিত এবং দ্রব্য গুণের আশ্রয়।
ডেকার্টের মতে, দ্রব্য তিনটি : ঈশ্বর, মন ও জড়। আর স্পিনোজার মতে, দ্রব্য একটি : ঈশ্বর।
ডেকার্টের মতে, মন ও জড় ঈশ্বরের উপর নির্ভরশীল। কারণ এরা ঈশ্বরের সৃষ্টি। ডেকার্টের
মতে, অন্যনিরপেক্ষতাই হলো দ্রব্যের স্বরূপ। ডেকার্টের দ্রব্যের লক্ষণ থেকে স্পিনোজা সিদ্ধান্ত
করেন, একমাত্র ঈশ্বরই হলো দ্রব্য। ঈশ্বরের অসংখ্য গুণের দুটি গুণ হলো মন ও জড় (চেতনা
ও বিস্তৃতি)। ঈশ্বরই একমাত্র সত্য ও সত্তা। অন্য সমস্ত কিছুই ঈশ্বরের উপর নির্ভরশীল।
বুদ্ধিবাদী লিবনিজের মতে, অন্যনিরপেক্ষভাবে থাকতে পারাই দ্রব্যের লক্ষণ নয়,
অন্যনিরপেক্ষভাবে কাজ করতে পারাই দ্রব্যের স্বরূপ। এই অর্থে দ্রব্য এক নয়, বহু। বহু দ্রব্যই
এক সাথে নিরপেক্ষভাবে কাজ করতে পারে। লিবনিজ এই দ্রব্যের নাম দিয়েছেন ‘চিৎ
পরমাণু'। চিৎ পরমাণুঅবিভাজ্য এবং চেতনধর্মী।
সুতরাং বুদ্ধিবাদীদের মতে, অন্যনিরপেক্ষতা হলো দ্রব্যের স্বরূপ। তবে এই অন্যনিরপেক্ষতা
কারো মতে অন্যনিরপেক্ষ অস্তিত্ব, কারো মতে অন্যনিরপেক্ষ কর্মক্ষমতা।
অভিজ্ঞতাবাদীদের মতে দ্রব্য
অভিজ্ঞতাবাদীদের মতে, জাগতিক বিষয় জানার একমাত্র মাধ্যম ইন্দ্রিয়জ প্রত্যক্ষ। প্রত্যক্ষ
দু'রকমের : (১) সংবেদন ও (২) অন্তর্দর্শন। সংবেদনের মাধ্যমে পাওয়া যায় বাইরের বস্তুর
জ্ঞান, আর অন্তর্দর্শনের মাধ্যমে পাওয়া যায় মানসিক অবস্থার জ্ঞান। সংবেদনের মাধ্যমে আমরা
বস্তুর গুণ জানতে পারি, কিন্তুগুণের অতিরিক্ত কোন অপরিবর্তিত সত্তার পরিচয় পাই না।
সুতরাং বস্তুর মধ্যে গুণাতিরিক্ত দ্রব্য বলে কিছুনেই।
অন্তর্দর্শনের মাধমে আমরা সুখ, দুঃখ, লজ্জা, ভয়, আনন্দ প্রভৃতি মানসিক অবস্থার পরিচয়
পাই; কিন্তুকোন অপরিবর্তিত সত্তার পরিচয় পাই না। সুতরাং মনের দিক থেকেও দ্রব্য বলে
কিছুনেই। ঈশ্বর নামে কোন অসীম দ্রব্যও নেই, কারণ সংবেদন ও অন্তর্দর্শনের মাধ্যমে
কোনভাবেই এমন দ্রব্য জানা যায় না। যে কোন যথার্থ অভিজ্ঞতাবাদীর পক্ষে এই সিদ্ধান্তই
স্বাভাবিক। অর্থাৎ কোন যথার্থ অভিজ্ঞতাবাদী দ্রব্যের অস্তিত্ব স্বীকার করতে পারেন না। কিন্তু
অভিজ্ঞতাবাদী জন লক গুণের আধাররূপে জড়, আত্মা ও ঈশ্বরের অস্তিত্ব স্বীকার করেন। তিনি
এই দ্রব্যের নাম দেন ‘অজ্ঞতা তত্ত¡
বার্কলি দ্রব্যরূপে আত্মা ও ঈশ্বরের অস্তিত্ব স্বীকার করেন। বার্কলি জড় দ্রব্যের অস্তিত্ব অস্বীকার
করলেও আত্মা ও ঈশ্বরের অস্তিত্ব স্বীকার করেন। আর অভিজ্ঞতাবাদী হিউম জড়দ্রব্য, আত্মা,
ঈশ্বরসহ কোন দ্রব্যের অস্তিত্বই স্বীকার করেননি।
হিউমের মতে, দ্রব্য মনের কল্পনামাত্র। তাঁর মতে, যা সংবেদন ও অন্তর্দর্শনের মাধ্যমে পাওয়া
যায় না তার অস্তিত্ব স্বীকার করা যায় না। সুতরাং দ্রব্য বলে কিছুর অস্তিত্ব নেই।
কান্টের মতে দ্রব্য হলো জ্ঞানের পূর্বতঃসিদ্ধ আকার
কান্টের মতে, দ্রব্যের কোন বস্তুগত সত্তা নেই, আবার দ্রব্য, সংবেদন বা ধারণা বা অনুভ‚তির
সমষ্টিও নয়। দ্রব্য হলো একটি ধারণা যা অভিজ্ঞতার পূর্বগামী। দ্রব্য হলো আমাদের জ্ঞানের
এক মৌলিক ও অপরিহার্য ধারণা। বারটি সার্বিক ও অনিবার্য ধারণার মধ্যে দ্রব্য অন্যতম। দ্রব্য
হলো বোধের আকার এর সাহায্যেই আমাদের
অভিজ্ঞতা সম্ভব হয় এবং বিভিন্ন পরিবর্তনের একটা যুক্তিসঙ্গত ব্যাখ্যা দেয়া সম্ভব হয়। তবে
দ্রব্যের ধারণা কেবলমাত্র পরিদৃশ্যমান জগৎ বা অবভাসিক জগৎ সম্পর্কেই প্রযোজ্য, অতীন্দ্রিয় জগৎ সম্পর্কে প্রযোজ্য নয়।
হেগেলের মতে দ্রব্য
হেগেলের মতে, দ্রব্য হলো গুণসমূহের অন্তর্নিহিত এক বাস্তব সত্তা যা গুণাবলীতে প্রকাশিত
হয়। তাঁর মতে, দ্রব্য ও গুণ উভয় মিলেই বস্তুর পূর্ণরূপ। দ্রব্য ছাড়া গুণের অস্তিত্ব সম্ভব নয়,
আবার গুণ ছাড়া দ্রব্য হয়ে ওঠে অর্থহীন। গুণগুলি শূন্যে ভাসমান অবস্থায় থাকতে পারে না,
আবার গুণহীন একটি আধারের অস্তিত্বও সম্ভব নয়। যে কোন সত্তারই দুটি দিক আছে : (১)
অস্তিত্বের দিক ও (২) প্রকাশের দিক। একটি ছাড়া আর একটি অর্থহীন। উভয় মিলেই দ্রব্যের
পূর্ণরূপ প্রকাশ করে। বিভিন্ন পরিবর্তনের মধ্য দিয়েই দ্রব্য নিজেকে প্রকাশ ও উপলব্ধি করে।
গুণ বা অবস্থার বিভিন্ন পরিবর্তনের মধ্যে এই দ্রব্য ঐক্যের যোগসূত্র রক্ষা করে।
সমালোচনা
(১) দ্রব্য সম্পর্কে সাধারণের মতবাদ নানাভাবে সমালোচিত হয়েছে। যেমন- সাধারণের
মতে, দ্রব্য হলো তাই যা শত পরিবর্তনের মধ্যেও অপরিবর্তিত থাকে। কিন্তুসেটি কী?
দ্রব্যের সাথে গুণের সম্পর্ক কী? এসব প্রশ্নের উত্তর এই মতবাদে পাওয়া যায় না।
(২) বুদ্ধিবাদীরা নিজেরাই দ্রব্য সম্পর্কে এক মত হতে পারেননি। কারো মতে দ্রব্য তিনটি,
কারো মতে একটি, কারো মতে বহু।
(৩) অভিজ্ঞতাবাদীদের মতবাদের বিরুদ্ধেও নানা অভিযোগ করা হয়েছে। অভিজ্ঞতাবাদীদের
মতে, বাস্তব জীবনে ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে আমাদের গুণের অনুভব হয়। কিন্তুআসলে
বাস্তবে আমাদের ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে গুণবিশিষ্ট দ্রব্যের জ্ঞান হয়। যেমন- আমরা বলি,
এই গাঁদা ফুলটি হয় হলুদ। তাই দ্রব্য নিছক গুণের সমষ্টি -এই অভিমত স্বীকার করা চলে না।
(৪) হেগেল কান্টের মতবাদের সমালোচনা করে বলেন, অবভাস ও বস্তুস্বরূপের মধ্যে কোন
আত্যন্তিক পার্থক্য নেই। মানবমন ও বস্তুস্বরূপ উভয়ই একই পরম সত্তার ভিন্ন
প্রকাশমাত্র। সুতরাং মনের বা জ্ঞানের আকার বস্তুস্বরূপের আকারও বটে।
সারাংশ
এই জগতের যাবতীয় জিনিসের পেছনে যে জিনিসের অস্তিত্ব ধারণা করা হয় তাকে দ্রব্য বলা
হয়। দ্রব্য সম্পর্কে বিভিন্ন জন বিভিন্ন মতবাদ প্রদান করেন। সাধারণ মানুষের মতে, দ্রব্য হলো
তাই, যা শত পরিবর্তনের মাঝেও অপরিবর্তিত থাকে।
বুদ্ধিবাদীদের মতে, অন্যনিরপেক্ষতা হলো দ্রব্যের স্বরূপ। এই অন্যনিরপেক্ষতা কারো মতে
অন্যনিরপেক্ষ অস্তিত্ব, কারো মতে অন্যনিরপেক্ষ কর্মক্ষমতা। যথার্থ অভিজ্ঞতাবাদীদের মতে,
দ্রব্য বলে কিছুনেই, আছে শুধুগুণ। কিন্তুলক ও বার্কলি দ্রব্যের অস্তিত্ব স্বীকার করেন। লক
দ্রব্যের আধাররূপে জড়, আত্মা ও ঈশ্বরের; আর বার্কলি আত্মা ও ঈশ্বরের অস্তিত্ব স্বীকার
করেন। কিন্তুহিউমের মতে, দ্রব্য মনের কল্পনামাত্র। কান্টের মতে, দ্রব্য হলো অভিজ্ঞতাপূর্ব
জ্ঞানের আকার। আর হেগেলের মতে, দ্রব্য হলো গুণসমূহের অন্তর্নিহিত এক বাস্তব সত্তা যা গুণগুলিতে প্রকাশিত হয়। তাঁর মতে, দ্রব্য ও গুণ মিলেই বস্তুর পূর্ণরূপ প্রকাশিত হয়।
রচনামূলক প্রশ্ন
১। দ্রব্যের স্বরূপ সম্পর্কে বিভিন্ন মতবাদ সংক্ষেপে ব্যাখ্যা করুন।
সংক্ষিপ্ত উত্তরমূলক প্রশ্ন
১। দ্রব্য সম্পর্কে অভিজ্ঞতাবাদীদের মতামত ব্যাখ্যা করুন।
২। দ্রব্য সম্পর্কে হেগেলের মতবাদ ব্যাখ্যা করুন।
নৈর্ব্যক্তিক প্রশ্ন
সঠিক উত্তর লিখুন।
১। দ্রব্য হলো তাই যা শত পরিবর্তনের মাঝেও অপরিবর্তিত থাকে -এটি
(অ) সাধারণের মতবাদ (আ) বুদ্ধিবাদীদের মতবাদ
(ই) অভিজ্ঞতাবাদীদের মতবাদ (ঈ) কান্টের মতবাদ
২। বুদ্ধিবাদী দার্শনিক লিবনিজের মতে দ্রব্য হলো
(অ) একটি (আ) দুটি
(ই) তিনটি (ঈ) বহু
৩। জগতে দ্রব্য বলে আসলে কিছুনেই, দ্রব্য মনের কল্পনা মাত্র-এটি
(অ) লকের অভিমত (আ) বার্কলির অভিমত
(ই) কান্টের অভিমত (ঈ) হিউমের অভিমত
৪। হেগেলের মতে দ্রব্য হলো
(অ) অজ্ঞাত তত্ত¡ (আ) অন্যনিরপেক্ষ অস্তিত্ব
(ই) জ্ঞানের আকার (ঈ) গুণসমূহের অন্তর্নিহিত এক বাস্তব সত্তা
সত্য হলে ‘স', মিথ্যা হলে ‘মি' লিখুন।
১। দ্রব্য সম্পর্কে সাধারণের মতবাদই সর্বজনস্বীকৃত মতবাদ।
২। দ্রব্য সম্পর্কে সব বুদ্ধিবাদীই একমত পোষণ করেন।
৩। কান্টের মতে, দ্রব্য হলো জ্ঞানের আকার।
৪। একজন যথার্থ অভিজ্ঞতাবাদী হিসেবে বার্কলি দ্রব্যের অস্তিত্ব অস্বীকার করেন।
সঠিক উত্তর
১। (অ) সাধারণের মতবাদ ২। (ঈ) বহু ৩। (ঈ) হিউমের অভিমত
৪। (ঈ) গুণসমূহের অন্তর্নিহিত এক বাস্তব সত্তা
১। মি ২। মি ৩। স ৪। মি

FOR MORE CLICK HERE
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস মাদার্স পাবলিকেশন্স
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস ১ম পর্ব
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস
আমেরিকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস
বাংলাদেশের ইতিহাস মধ্যযুগ
ভারতে মুসলমানদের ইতিহাস
মুঘল রাজবংশের ইতিহাস
সমাজবিজ্ঞান পরিচিতি
ভূগোল ও পরিবেশ পরিচিতি
অনার্স রাষ্ট্রবিজ্ঞান প্রথম বর্ষ
পৌরনীতি ও সুশাসন
অর্থনীতি
অনার্স ইসলামিক স্টাডিজ প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত
অনার্স দর্শন পরিচিতি প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত

Copyright © Quality Can Do Soft.
Designed and developed by Sohel Rana, Assistant Professor, Kumudini Government College, Tangail. Email: [email protected]