সার্বিক ধারণা কী? সার্বিক ধারণার প্রকৃতি সম্পর্কে প্লেটো ও অ্যারিস্টটলের মতবাদ ব্যাখ্যা করুন।

যে সাধারণ ধর্ম বা বৈশিষ্ট্য কোন শ্রেণীর অন্তর্গত প্রতিটি বস্তুবা প্রাণীর মধ্যে সমভাবে বর্তমান
থাকে তাকে সার্বিক ধারণা বলে। এই ধারণা বিষয়গত ধর্ম অর্থাৎ এই ধর্ম বা বৈশিষ্ট্য বিষয়ের
মধ্যেই বর্তমান থাকে। এই সার্বিক ধারণার স্বরূপকে কেন্দ্র করে দার্শনিকদের মধ্যে মতভেদের
সৃষ্টি হয়েছে। এই সার্বিক ধারণা সম্পর্কে তিনটি মতবাদ উল্লেখযোগ্য :
(১) বস্তুবাদ
(২) ধারণা বা প্রত্যয়বাদ ও
(৩) নামবাদ
আমরা এখানে বস্তুবাদ নিয়ে আলোচনা করবো।
বস্তুবাদ (জবধষরংস)
বস্তুবাদ অনুসারে, সার্বিক ধারণা হলো বস্তুনিষ্ঠ। অর্থাৎ সার্বিকের বস্তুসত্তা আছে, সার্বিক নিছক
নাম বা মনোগত ধারণা বা প্রত্যয় নয়। গ্রিক দার্শনিক প্লেটো ও অ্যারিস্টটল হলেন বস্তুবাদের
সমর্থক।
প্লেটোর মতে বস্তুবাদ
প্লেটোর মতে, ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বস্তুর কোন প্রকৃত সত্তা নেই, সার্বিকেরই সত্তা আছে। যেমন
ইন্দ্রিয়ের সাহায্যে আমরা বিশেষ বিশেষ মানুষ প্রত্যক্ষ করি। এই সব বিশেষ মানুষের যথার্থ
কোন সত্তা নেই, কিন্তুমনুষ্যত্ব হলো সার্বিক ধারণা, যার যথার্থ সত্তা আছে। প্লেটোর মতে,
সার্বিকের কোন না কোন অর্থে সত্তা আছে, এজন্য তাঁর মতবাদের নাম বস্তুবাদ। বিশেষের
যেমন সত্তা আছে, সার্বিকেরও তেমন সত্তা আছে। লাল রঙের বিশেষ বিশেষ মাত্রা (ংযধফব)
আছে। কিন্তুসেই সাথে লালত্ব (ৎবফহবংং) এই সার্বিকেরও অস্তিত্ব বা সত্তা আছে, বিভিন্ন
বিশেষ লাল রঙের মাত্রা যার দৃষ্টান্তস্বরূপ। প্লেটো নৈতিক ধর্ম ও গাণিতিক পদার্থ নিয়ে তার
সার্বিক ধারণায় বিশেষ আলোচনা করেছেন। তাঁর মতে, নিখুঁত সততা, নিখুঁত নিরপেক্ষতা
পৃথিবীর কোথাও নেই। এ জগতে নিখুঁত বলে কিছুনেই। কিন্তুনিখুঁতের ধারণা আমাদের
আছে। প্লেটোর মতে, বিশেষ সার্বিকের ত্রæটিপূর্ণ উদাহরণ।
সার্বিকের সাথে বিশেষের সম্পর্ক
সার্বিকের সাথে বিশেষের সম্পর্ক নিয়ে প্লেটো সুসংগত কিছুবলেননি। তবে তিনি দুটি অভিমত
দিয়েছেন :
(১) উভয়ের মধ্যে সম্পর্ক হলো মূল (ড়ৎরমরহধষ) এর সাথে অনুকরণের বা অনুলিপির (পড়ঢ়ু)
সম্পর্ক। এই পৃথিবীর সব ছাগলই ত্রæটিপূর্ণ। কিন্তুকোথাও না কোথাও বাস্তবে নিখুঁত ছাগল
আছে, এই পৃথিবীর সব ছাগল যার ত্রæটিপূর্ণ অনুলিপি।
(২) বিশেষ সার্বিকে অংশগ্রহণ করে (ঞযব চধৎঃরপঁষধৎ ঢ়ধৎঃরপরঢ়ধঃবং রহ ঃযব টহরাবৎংধষ)।
প্লেটোর মতে, বিশেষ নিছক ছায়া বা অর্ধবাস্তব। বিশেষ বস্তুর সাথে ধারণার সাদৃশ্যের কারণ বিশেষ বস্তুর ধারণায় অংশগ্রহণ।
সার্বিকের প্রকৃতি
প্লেটো সার্বিকের নাম দিয়েছেন অঢণট বা ধারণা। প্লেটোর মতে, সার্বিক একই শ্রেণীভুক্ত বহু
বস্তুবা ব্যক্তির সাধারণ ধর্ম নয়। সার্বিক হলো এক আদর্শ সত্তা, যা বুদ্ধিগ্রাহ্য এবং বিশেষ
বিশেষ বস্তুবা ব্যক্তি ঐ আদর্শের কম-বেশি অনুকরণ। যেমন ‘মানুষ' এই ধারণার একটা
আদর্শ সত্তা আছে। বিভিন্ন মানুষ এই আদর্শের কম-বেশি অনুকরণ। আবার ‘মানুষ' এই শ্রেণীর
সাধারণ ধর্ম হচ্ছে ‘মনুষ্যত্ব', যা হলো সার্বিক, যা না থাকলে কোন বিশেষ ব্যক্তি মানুষ হবে
না। বাস্তব জগতের কোন মানুষ মনুষ্যত্বের ঐ আদর্শে পুরোপুরি পৌঁছাতে পারে না। কিন্তু
কম-বেশি অনুকরণ করে।
সার্বিকের বৈশিষ্ট্য
প্লেটো সার্বিক ধারণার কতগুলি বৈশিষ্ট্য উল্লেখ করেছেন :
(১) এরা দ্রব্য অর্থাৎ স্বনির্ভর
(২) এরা সার্বিক
(৩) এরা বস্তুনয়, ধারণা
(৪) এরা বহুর মধ্যে এক। যেমন, মানুষের সংখ্যা অনেক, কিন্তু‘মানুষ' এই সার্বিক একটি
মাত্র।
(৫) এরা হলো নিত্য পদার্থ, এরা অপরিবর্তনীয় ও অবিনশ্বর। কত মানুষ জন্ম নিচ্ছে এবং
মৃত্যুবরণ করছে; কিন্তু‘মানুষ' এই সার্বিক ধারণার পরিবর্তন নেই, বিনাশ নেই।
(৬) এই ধারণাগুলি বুদ্ধিগ্রাহ্য।
প্লেটোর মতে, সার্বিকই সৎ। আর বিশেষ বিশেষ দৃষ্টান্ত, যা ঐ সার্বিকের কম-বেশি অনুকরণ,
তা অসৎ। প্লেটোর মতে, বিশেষ বস্তুও ব্যক্তিকে নিয়ে ইন্দ্রিয়ের জগৎ, আর ধারণাকে নিয়ে
এক পৃথক ভাবের জগত (ডড়ৎষফ ড়ভ ওফবধ) এর অস্তিত্ব আছে। ইন্দ্রিয়ের জগৎ হলো ভাবের জগতের প্রতিচ্ছবি।
অ্যারিস্টটলের মতে বস্তুবাদ
গ্রিক দার্শনিক অ্যারিস্টটলও বস্তুবাদে বিশ্বাসী। তবে তিনি প্লেটো থেকে ভিন্নমত পোষণ
করেন। তাঁর মতে, সার্বিক ও বিশেষ উভয়ের সত্তা আছে। সার্বিক হলো পরম তত্ত¡ কিন্তুবিশেষে সার্বিকের অস্তিত্ব। সার্বিক স্বনির্ভর নয়। কোন শ্রেণীর অন্তর্গত বিভিন্ন
বস্তুবা ব্যক্তির যে সাধারণ ধর্ম তা-ই হলো সার্বিক। যেমন, জীববৃত্তি ও বুদ্ধিবৃত্তি হলো সকল
মানুষের সাধারণ ধর্ম। বিশিষ্ট ব্যক্তিকে বাদ দিয়ে এই সাধারণ ধর্ম বা বৈশিষ্ট্যের কোন স্বতন্ত্র
সত্তা নেই। ‘মানুষ' এই শ্রেণীর প্রতিটি মানুষের মধ্যে জীববৃত্তি ও বুদ্ধিবৃত্তি আছে। প্রতিটি
মানুষের মধ্যে এই দুটি গুণ থাকায় আমরা সকল মানুষকে মানুষ শ্রেণীভুক্ত করেছি, ‘যদিও
অন্যান্য গুণের দিক থেকে মানুষে মানুষে পার্থক্য অনেক। সুতরাং কোন শ্রেণীর যেটা সাধারণ বৈশিষ্ট্য তাই হলো সার্বিক ধারণাএই
সাধারণ বৈশিষ্ট্য সরল বা জটিল উভয় রকমেরই হতে পারে। শ্রেণীর বিভিন্ন দৃষ্টান্তের মধ্য
দিয়েই সার্বিকের অস্তিত্ব।
প্লেটো ও অ্যারিস্টটলের মতামতের পার্থক্য
(১) প্লেটোর মতে, সামান্য আগে, আর বিশেষ পরে। কিন্তুঅ্যারিস্টটলের মতে, বিশেষ
বিশেষ দৃষ্টান্তের বাইরে সার্বিকের কোন অস্তিত্ব নেই।
(২) প্লেটোর মতে, সার্বিকের এক আদর্শগত সত্তা আছে। কিন্তুঅ্যারিস্টটলের মতে, সার্বিক
নিছক ধারণা নয়, বস্তুগত সাধারণ ধর্ম। যেমন, ঘোড়ার ডিমের কোন বস্তুগত সাধারণ
ধর্ম নেই। কেননা কোন বিশেষ দৃষ্টান্ত নেই যাতে তার অস্তিত্ব আছে।
(৩) প্লেটো সার্বিকের অস্তিত্ব ব্যাখ্যা করতে গিয়ে এক অতীন্দ্রিয় জগতের কল্পনা করেছেন। কিন্তুঅ্যারিস্টটল এরূপ জগতের অস্তিত্ব অস্বীকার করেন।
সমালোচনা
(১) প্লেটোর ধারণার জগৎ এক দুর্বোধ্য জগৎ। প্লেটো যে ভাবের জগতে ধারণাগুলির
অস্তিত্বের কথা বলেন সেই ভাবের জগৎ এক নিছক কল্পনামাত্র। তাছাড়া প্লেটো ধারণার
সাথে বিশেষের সম্পর্ক স্পষ্ট করে ব্যাখ্যা করতে পারেননি। তাঁর মতে, বিশেষ বিশেষ
বস্তুধারণার অংশীদার। কিন্তুকিভাবে? তা তিনি স্পষ্টভাবে ব্যাখ্যা করেননি।
(২) অ্যারিস্টটলের মতবাদের ত্রæটি হলোÑসামান্য যদি বিশেষ বিশেষ দৃষ্টান্তে অস্তিত্বশীল হয়,
তাহলে তা এক বা অভিন্ন হয় কিভাবে? বিভিন্ন ব্যক্তি বা বস্তুর সাধারণ ধর্ম যদি কিছু
থাকে তা ভিন্ন ভিন্ন দৃষ্টান্তে ভিন্ন ভিন্ন হতে বাধ্য। জীববৃত্তি ও বুদ্ধিবৃত্তি কি সবার মধ্যে
এক ও অভিন্ন? লাল, সবুজ, হলদে, নীল প্রভৃতি গুণ বললেও এদের মধ্যে কোন সাধারণ বর্ণের উপস্থিতি নেই।
সারাংশ
যে সাধারণ বৈশিষ্ট্য কোন শ্রেণীর অন্তর্গত প্রতিটি বস্তুবা ব্যক্তির মধ্যে সমভাবে বর্তমান থাকে
তাকে সার্বিক বলে। সার্বিকের প্রকৃতি সম্বন্ধে আমরা তিনটি মতবাদ পাই : (১) বস্তুবাদ (২)
ধারণাবাদ বা প্রত্যয়বাদ ও (৩) নামবাদ।
বস্তুবাদ অনুসারে, সার্বিক হলো বস্তুনিষ্ঠ অর্থাৎ সার্বিকের বস্তুসত্তা আছে। সার্বিক নিছক নাম বা
মনোগত ধারণা বা প্রত্যয় নয়। বস্তুবাদের আমরা দু'জন প্রবক্তা পাই : (১) প্লেটো ও (২)
অ্যারিস্টটল।
প্লেটোর মতে, সার্বিক হলো এক আদর্শ সত্তা, যা বুদ্ধিগ্রাহ্য এবং বিশেষ বিশেষ ব্যক্তি বা বস্তু
ঐ আদর্শের কম-বেশি অনুকরণ। বিশেষের প্রকৃত সত্তা নেই, সার্বিকেরই সত্তা আছে। প্লেটোর
মতে, বিশেষ হলো সার্বিকের অনুলিপি। প্লেটো সার্বিকের নাম দিয়েছেন ওফবধ বা ধারণা। তিনি
ধারণার ছয়টি বৈশিষ্ট্য উল্লেখ করেছেন।
অ্যারিস্টটল প্লেটো থেকে ভিন্নমত পোষণ করেন। অ্যারিস্টটলের মতে, সার্বিক পরম তত্ত¡ কিন্তু
কেবলমাত্র বিশেষেই সার্বিকের অস্তিত্ব। সার্বিক স্বনির্ভর নয়। তাঁর মতে, কোন শ্রেণীর অন্তর্গত
বিভিন্ন বস্তুবা ব্যক্তির যে সাধারণ বৈশিষ্ট্য তা-ই হলো সার্বিক। এই সাধারণ বৈশিষ্ট্য সরলও
হতে পারে, আবার জটিলও হতে পারে।
রচনামূলক প্রশ্ন
১। সার্বিক ধারণা কী? সার্বিক ধারণার প্রকৃতি সম্পর্কে প্লেটো ও অ্যারিস্টটলের মতবাদ ব্যাখ্যা করুন।
সংক্ষিপ্ত উত্তরমূলক প্রশ্ন
১। সার্বিক ধারণার প্রকৃতি সম্পর্কীয় মতবাদ কয়টি ও কি কি?
২। সার্বিক ধারণার সংজ্ঞা দিন এবং এর পাঁচটি বৈশিষ্ট্য উল্লেখ করুন।
নৈর্ব্যক্তিক প্রশ্ন
সঠিক উত্তর লিখুন।
১। সার্বিক ধারণার প্রকৃতি সম্পর্কীয় মতবাদ
(অ) একটি (আ) দুটি
(ই) তিনটি (ঈ) চারটি
২। সার্বিক ধারণার প্রকৃতি সম্পর্কে প্লেটো ও অ্যারিস্টটল
(অ) বস্তুবাদে বিশ্বাসী (আ) প্রত্যয়বাদে বিশ্বাসী
(ই) নামবাদে বিশ্বাসী (ঈ) সাধারণ ধারণাবাদে বিশ্বাসী
৩। বিশেষ হলো সার্বিকের কমবেশি অনুকরণ -উক্তিটি
(অ) প্লেটোর (আ) অ্যারিস্টটলের
(ই) ডেকার্টের (ঈ) লকের
৪। কোন শ্রেণীর সাধারণ বৈশিষ্ট্যই সার্বিক ধারণা -উক্তিটি
(অ) প্লেটোর (আ) অ্যারিস্টটলের
(ই) কান্টের (ঈ) হিউমের
সত্য হলে ‘স', মিথ্যা হলে ‘মি' লিখুন।
১। বস্তুবাদ অনুসারে, সার্বিক হলো বস্তুনিষ্ঠ।
২। প্লেটো সার্বিকের নাম দিয়েছেন ‘কল্পনা'।
৩। সার্বিকের প্রকৃতি সম্পর্কে প্লেটো ও অ্যারিস্টটল এক মত পোষণ করেন।
৪। অ্যারিস্টটলের মতে, সার্বিক হলো পরমতত্ত¡।
সঠিক উত্তর
১। (ই) তিনটি ২। (আ) প্রত্যয়বাদে বিশ্বাসী ৩। (অ) প্লেটোর ৪। (আ) অ্যারিস্টটলের
১। স ২। মি ৩। মি ৪। স

FOR MORE CLICK HERE
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস মাদার্স পাবলিকেশন্স
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস ১ম পর্ব
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস
আমেরিকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস
বাংলাদেশের ইতিহাস মধ্যযুগ
ভারতে মুসলমানদের ইতিহাস
মুঘল রাজবংশের ইতিহাস
সমাজবিজ্ঞান পরিচিতি
ভূগোল ও পরিবেশ পরিচিতি
অনার্স রাষ্ট্রবিজ্ঞান প্রথম বর্ষ
পৌরনীতি ও সুশাসন
অর্থনীতি
অনার্স ইসলামিক স্টাডিজ প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত
অনার্স দর্শন পরিচিতি প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত

Copyright © Quality Can Do Soft.
Designed and developed by Sohel Rana, Assistant Professor, Kumudini Government College, Tangail. Email: [email protected]