ডেকার্টের মতে জড় কী? জড় ও মনের পার্থক্য লক, বার্কলি ও হিউমের জড় সম্পর্কীয় মতবাদ আলোচনা করুন।

আমরা এতক্ষণ জড় বা মৌল উপাদান সম্পর্কে প্রাচীন যুগের দার্শনিকদের মত বা মতবাদ
সম্বন্ধে অবগত হলাম। প্রাচীন যুগের পরবর্তী এবং ডেকার্টের পূর্বের যুগকে পাশ্চাত্য দর্শনে মধ্য
যুগ বলা হয়। এ মধ্য যুগে এ বিষয়ের আলোচনায় তেমন উন্নতি হয়নি। প্লেটো, অ্যারিস্টটল
ও সেন্ট অগাস্টিনের দর্শনই মধ্য যুগে প্রভাব বিস্তার করে রাখে। মধ্য যুগ সম্পর্কে আপনি
দর্শনের ইতিহাস পড়লে জানতে পারবেন। মধ্য যুগের পরবর্তী যুগকে আধুনিক যুগ বলা হয়।
আধুনিক যুগে বিজ্ঞানের উন্নতির সাথে সাথে দার্শনিক চিন্তাধারারও উন্নতি সাধিত হয়। এখন
আমরা জড় সম্পর্কে আধুনিক দার্শনিকদের মতামত নিয়ে আলোচনা করবো। পরবর্তী পাঠে
আমরা জড় সংক্রান্ত বৈজ্ঞানিক মতবাদ নিয়ে আলোচনা করবো।
আধুনিক মতবাদসমূহ
ডেকার্ট (১৫৯৬-১৬৫০)-এর মতবাদ
জড়ের প্রকৃতি সম্পর্কে আধুনিক বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গির সাথে সঙ্গতি রেখে যেসব আধুনিক
দার্শনিক জড় সম্পর্কে মতবাদ দিয়েছেন, তাঁদের মধ্যে প্রথমেই নাম করতে হয় আধুনিক
দর্শনের জনক ফরাসি দার্শনিক ডেকার্ট-এর। ডেকার্টের মতে, জড় ও বিস্তৃতি হলো সমার্থক
শব্দ। তাঁর মতে, এ বিশ্ব জগতের মূলে মাত্র দুটি সত্তা আছে। এ দুটি সত্তা হলো জড় ও মন।
জড় মনের বিপরীত। জড়ের প্রধান ধর্ম বিস্তৃতি এবং মনের প্রধান ধর্ম চেতনা। জড় যান্ত্রিক
নিয়ম দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয় এবং মন উদ্দেশ্যের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। জড় হচ্ছে নিষ্ক্রিয় ও মন হচ্ছে
সক্রিয়। এই জড় ও মন দুটি পরস্পর নিরপেক্ষ পৃথক সত্তা। ডেকার্টের মতে, শূন্য দেশের
কোন অস্তিত্ব নেই। তাঁর এ মতবাদ দ্বৈতবাদে পরিণত হয়। কেননা তিনি দুটি সত্তাকেই সমান
গুরুত্ব দিয়ে গ্রহণ করেছেন। পরবর্তীকালে এ দ্বৈতবাদের সূত্র ধরে দর্শনের ইতিহাসে এক
বিরাট আলোড়নের সৃষ্টি হয়।
লিবনিজ (১৬৪৬-১৭১৬)-এর মতবাদ
লিবনিজ, যাকে প্যাট্রিক একজন ‘ইনটেলেকচ্যুয়াল জাইয়্যান্ট' বা অস্বাভাবিক বুদ্ধিমান বলে
অভিহিত করেছেন, জড় সম্পর্কে একটি বিপ্লবী মতবাদ প্রদান করেন। তিনি বলেন, বিশ্ব
কতগুলো কণার দ্বারা সৃষ্ট, যার নাম দিয়েছেন তিনি চিৎ পরমাণু(গড়হধফং)। মোনাড বা চিৎ
পরমাণুকোন জড় বস্তুনয়, বরং এগুলো হলো গতি ও শক্তির কেন্দ্রবিন্দু। এগুলো জড়াত্মক
নয়, এগুলো মানসিক। জড় বস্তুর চিৎ পরমাণুগুলো ঘুমন্ত ও অনুন্নত, আর মনের চিৎ
পরমাণুগুলো উন্নত ও পূর্ণ চেতনাযুক্ত।
লক (১৬৩২-১৭০৪)-এর মতবাদ
লকের মতে, জড় বা বস্তুকতগুলো গুণের আধার তাঁর মতে, আমরা বস্তুকে
প্রত্যক্ষ করতে পারি না, বরং বস্তুর গুণাবলীকেই শুধু প্রত্যক্ষ করতে পারি। লকের বস্তু
সম্পর্কীয় ধারণাকে জানতে হলে বস্তুর গুণ সম্পর্কে আমাদের কিছুজানা দরকার। লকের মতে,
বস্তুর মধ্যে দু'প্রকারের গুণ আছে মুখ্য ও গৌণ। মুখ্য গুণ হলো বস্তুনির্ভর। গৌণ গুণ হলো
রূপ, রস, গন্ধ, শব্দ ইত্যাদি এবং এগুলো মননির্ভর। বস্তুর এ গুণগুলো শূন্যে ভাসমান অবস্থায়
থাকে না। গুণগুলোর অস্তিত্বের জন্য একটি আধারের প্রয়োজন। এই আধারই জড় বা বস্তু।
যেমন আপনার হাতে একটি গøাস আছে। গøাসটি উঁচু, গোলাকার, শক্ত, স্বচ্ছ ইত্যাদি। এ
গুণগুলোকে যে ধরে রেখেছে তাই হলো গøাসটির জড়ত্ব। এ গুণগুলো না থাকলে গøাস বলে
কোন কিছুই থাকবে না। তাই এই আধার যদিও অজ্ঞাত, তথাপি একে অস্বীকার করা যায় না।
বার্কলি (১৬৮৫-১৭৫৩) এর মতবাদ
বার্কলি লকের মতবাদের সমালোচনা করে বলেন যে, জড় বা বস্তুযদি অজ্ঞাত হয় তাহলে তার
অস্তিত্বকে বিশ্বাস করা যায় না। বার্কলির মতে, প্রত্যেকটি বস্তুযা আমরা দেখি বিভিন্ন গুণের
সমষ্টি ছাড়া আর কিছুই নয়। তাঁর মতে, বস্তুর সব গুণই মনের উপর নির্ভরশীল এবং এ
হিসেবে লকের দেয়া গৌণ গুণের মত মুখ্য গুণও মননির্ভর। কাজেই সব বস্তুর সব গুণই একই
ধরনের এবং এ গুণ মনের ধারণা ছাড়া আর কিছ্ইু নয়। এদিক থেকে যাকে আমরা জড় বলে
সচরাচর মনে করি, তা আসলে মনের কতগুলো ধারণার সমষ্টি ব্যতিত আর কিছুই নয়। বার্কলি
এভাবেই জড়ের অস্তিত্বকে খন্ডন করেন এবং সব বস্তুকেই প্রত্যক্ষণনির্ভর বলে মনে করেন।
তাঁর মতে, বস্তুবা জড় ব্যক্তি ও ঈশ্বরের মনের ধারণামাত্র।
মিল ও হিউম (গরষষ ধহফ ঐঁসব)-এর মত
মিল ও হিউম দুজনই অভিজ্ঞতাবাদী দার্শনিক, তাঁরা জড়ের অস্তিত্বকেই স্বীকার করেন না,
কারণ জড়ের অস্তিত্বকে প্রত্যক্ষ করা যায় না। অভিজ্ঞতায় যে বস্তুকে পাওয়া যায় শুধুতারই
অস্তিত্বকে স্বীকার করা যায়। আর যা পাওয়া যায় না তার অস্তিত্বকে স্বীকার করা অযৌক্তিক।
তাই জড় বলে কোন পৃথক দ্রব্যের অস্তিত্বকে কল্পনা করা যায় না। বরং যা পাওয়া যায় তা হলো সংবেদনের সমষ্টিমাত্র।
আমরা দেখতে পাই যে, জড়কে প্রকৃতি থেকে নিশ্চিহ্ন করেছিলেন বার্কলি। আর মিল ও হিউম
তাঁর কথাকে সম্পূর্ণরূপে গ্রহণ করেন। মনের রাজ্যেও তাঁরা জড়ের কোন অস্তিত্ব স্বীকার না
করে কেবল সংবেদন ও মুদ্রণের অস্তিত্বকে স্বীকার করেন।
হোয়াইটহেডের মত
অত্যাধুনিককালে জড়ের প্রকৃতির সবচেয়ে সুন্দর ব্যাখ্যা দেন প্রফেসর হোয়াইটহেড। তাঁর
মতে, জড় হলো যাকে আমরা আমাদের ইন্দ্রিয়ের দ্বারা প্রত্যক্ষ করি। জড়কে আমাদের
অভিজ্ঞতার অদৃশ্য কারণ বললে আমরা সেই পুরনো প্রত্যাখ্যাত প্রকৃতি দ্বিখন্ডক তত্ত¡কেই মেনে
নেই। তিনি বলেন, পদার্থবিদ্যা হলো প্রাকৃতিক বিজ্ঞানসমূহের মধ্যে শ্রেষ্ঠ। এ বিদ্যা জড়ের
ব্যাখ্যা না করলেও আমাদের ইন্দ্রিয়লব্ধ প্রকৃতির ব্যাখ্যা অবশ্যই করবে। বিজ্ঞানের উন্নতি মানে
উন্নততর ও অধিকতর গ্রহণযোগ্য ব্যাখ্যার মাধ্যমে আমাদের অভিজ্ঞতার উন্নতি। আমরা
জগতকে প্রথমত জানি সংবেদনের মাধ্যমে, তারপর ব্যাখ্যার ক্রমোন্নতির সাথে সাথে আমরা
সে জগতকেই প্রত্যক্ষণযোগ্য বস্তুর মাধ্যমে ভালভাবে জানি। প্রত্যক্ষগত বস্তুর মাঝেও কেবল
সংবেদনের ব্যাখ্যার উন্নতিই দেখি, সংবেদনের উন্নতি নয়। বস্তুগুলোকে প্রত্যক্ষ করা যায় না।
বিজ্ঞান এগুলোকে অনুমান করে নেয়। সুতরাং বিজ্ঞানের উন্নতি অর্থ ব্যাখ্যার উন্নতি এবং
অর্থের সঙ্গতি।
অতএব, আমরা জড়কে পদার্থবিদ্যার আলোচ্য বিষয়রূপে অবশ্যই চিন্তা করবো না। জড়
শব্দটির পরিবর্তে প্রকৃতি শব্দের ব্যবহার করা উচিত হবে। প্রকৃতি শব্দের অর্থ হলো যা আমরা ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে প্রত্যক্ষ করি।
জি. ই. ম্যূরের মত
অতি সাম্প্রতিক কালের অন্যতম দার্শনিক জি. ই. ম্যূরের বক্তব্য দিয়ে আমরা এ পাঠের ইতি
টানতে চাই। ম্যূর বলেন, আমি বস্তুকে তিনটি গুণের মাধ্যমে সংজ্ঞায়িত করতে চাই : একটি
সদর্থক এবং দুটি নঞর্থক । সদর্থক গুণটি হলো (১) জড়বস্তুএমন
কিছূযা অবশ্যই দেশ দখল করে থাকে; নঞর্থক গুণগুলো হলো: (২) জড়বস্তুকোন প্রকারের
ইন্দ্রিয় উপাত্ত নয় এবং (৩) কোন মন নয় বা কোন চেতনার ক্রিয়াও নয়। তিনি
বলেন, আমরা কখনও জড় বস্তুর স্বগতঃরূপ কী? তা জানতে পারি না, তবে
এর কি কি গুণ আছে, কিংবা এটা কিভাবে অন্যান্য জিনিসের সাথে সম্পর্কযুক্ত তাই কেবল জানতে পারি।
রচনামূলক প্রশ্ন
১। ডেকার্টের মতে জড় কী? জড় ও মনের পার্থক্য আলোচনা করুন।
২। লক, বার্কলি ও হিউমের জড় সম্পর্কীয় মতবাদ আলোচনা করুন।
সংক্ষিপ্ত উত্তরমূলক প্রশ্ন
১। হোয়াইটহেডের জড় সম্পর্কীয় মত ব্যাখ্যা করুন।
২। ম্যূরের বস্তুবা জড় সম্পর্কীয় ধারণা ব্যাখ্যা করুন।
নৈর্ব্যক্তিক প্রশ্ন
সঠিক উত্তর লিখুন।
১। প্রফেসর হোয়াইটহেডের মতে জড় হলো
(অ) সংবেদন (আ) অভিজ্ঞতার সমষ্টি
(ই) প্রকৃতি (ঈ) ইন্দ্রিয় অনুভ‚তি
২। লকের মতে জড়Ñ
(অ) চিৎপরমাণু (আ) গুণের আধার
(ই) পানি (ঈ) বায়ু
৩। জড়কে প্রকৃতি থেকে নিশ্চিহ্ন করেনÑ
(অ) লক (আ) বার্কলি
(ই) ডেকার্ট (ঈ) লিবনিজ
৪। একটি সদর্থক ও দুটি নঞর্থক গুণের মাধ্যমে জড়কে সংজ্ঞায়িত করেনÑ
(অ) মিল (আ) হিউম
(ই) বার্কলি (ঈ) ম্যূর
সত্য হলে ‘স', এবং মিথ্যা হলে ‘মি' লিখুন।
১। দার্শনিক লিবনিজের মতে, জড়ের নাম চিৎ পরমাণু।
২। দার্শনিক লকের মতে, জড়ের মুখ্য গুণ মননির্ভর।
৩। দার্শনিক বার্কলি জড়ের অস্তিত্ব স্বীকার করেন না।
সঠিক উত্তর
১। (ই) ২। (আ) ৩। (আ) ৪। (ঈ)
১। স ২। মি ৩। স

FOR MORE CLICK HERE
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস মাদার্স পাবলিকেশন্স
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস ১ম পর্ব
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস
আমেরিকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস
বাংলাদেশের ইতিহাস মধ্যযুগ
ভারতে মুসলমানদের ইতিহাস
মুঘল রাজবংশের ইতিহাস
সমাজবিজ্ঞান পরিচিতি
ভূগোল ও পরিবেশ পরিচিতি
অনার্স রাষ্ট্রবিজ্ঞান প্রথম বর্ষ
পৌরনীতি ও সুশাসন
অর্থনীতি
অনার্স ইসলামিক স্টাডিজ প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত
অনার্স দর্শন পরিচিতি প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত

Copyright © Quality Can Do Soft.
Designed and developed by Sohel Rana, Assistant Professor, Kumudini Government College, Tangail. Email: [email protected]