প্রাণবাদীদের যুক্তিগুলো উল্লেখ করুন এবং আলোচনা করে নিজের মতামত দিন।

আমরা পূর্ববর্তী পাঠে জীবনের যান্ত্রিক ব্যাখ্যা আলোচনা করেছি। বর্তমান পাঠে আমরা
জীবনের প্রাণবাদী ব্যাখ্যা নিয়ে আলোচনা করবো। প্রাণবাদের মতে, প্রাণ বা জীবন জড় থেকে
উদ্ভূত নয়। প্রাণ জড়শক্তি থেকে ভিন্নতর শক্তি।
প্রাণবাদ
প্রাণবাদীদের মতে, প্রাণ জড়শক্তি থেকে আলাদা শক্তি এবং এ দুটি শক্তির মধ্যে মৌলিক ও
গুণগত পার্থক্য রয়েছে। প্রাণ জড়শক্তি থেকে উদ্ভূত হয় না। প্রাণ জড় দেহকে আশ্রয় করেই
নিজকে বিকশিত করে; তাই বলে প্রাণ শক্তিকে জড় দেহের ভৌতিক বা রাসায়নিক ক্রিয়া বলা
চলে না। জীব অজৈব পদার্থ থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন। জীবের মধ্যে এমন কতগুলো বৈশিষ্ট্য আছে
যা অজৈব পদার্থে নেই। ‘প্রাণশক্তি' নামে এক নতুন ও স্বতন্ত্র জীবনীশক্তি দিয়ে জীবনের স্বরূপ
উদ্ঘাটন করা যায়। এই মতবাদের নাম প্রাণবাদ।
দর্শনের ইতিহাস আলোচনা করলে আমরা এই প্রাণ শক্তির প্রকৃতি সম্পর্কে দু'রকমের মতবাদ
পাই : প্রাচীন প্রাণবাদ ও নব্য প্রাণবাদ।
প্রাচীন প্রাণবাদ
প্রাচীন প্রাণবাদের প্রথম প্রকাশ ঘটে গ্রিক দার্শনিক অ্যারিস্টটলের লেখায়। তাঁর মতে, উদ্ভিদ,
প্রাণী ও মানুষের মধ্যে এক এক প্রকার শক্তির অস্তিত্ব রয়েছে। এ প্রাণ শক্তিকে তিনি
ঊহঃবষবপযু বা দেহের সংগঠন শক্তি বলে অভিহিত করেছেন। তিনি বলেন, গাছ-পালা,
উদ্ভিদের মধ্যে আছে জননশীল প্রাণশক্তি। প্রাণীর মধ্যে আছে জননশীল প্রাণ ও সংবেদনশীল
প্রাণ। আর মানুষের মধ্যে আছে আরও একটি শক্তি যার নাম বৌদ্ধিক প্রাণ। মধ্য যুগের অনেক
দার্শনিক অ্যারিস্টটলের মতবাদ সমর্থন করেন এবং বলেন যে, জীবনের আসল রূপ হলো
একটি আধ্যাত্মিক সত্তা এবং তা বস্তুথেকে আলাদা। দার্শনিক ডেকার্ট এ মতবাদের কিছু
বিরোধিতা করেন। তাঁর মতে, গাছ-পালা ও প্রাণীর দেহ যন্ত্রের মতই এবং মানুষের দেহও এ
নিয়মের ব্যতিক্রম নয়। কিন্তু মানুষের মধ্যে একটা চিন্তাশক্তি আছে। মোটকথা, প্রাচীন
প্রাণবাদের মতে, প্রাণ একটি মৌলিক শক্তি এবং প্রাণ থেকেই প্রাণের উৎপত্তি সম্ভব, রাসায়নিক
ক্রিয়ার ফলে নয়।
নব্য প্রাণবাদ
নব্য প্রাণবাদের জনক হলেন জার্মান দার্শনিক হ্যান্স ড্রিক। তিনি পরীক্ষামূলক বৈজ্ঞানিক
পদ্ধতির সাহায্যে প্রাণবাদকে নতুন করে প্রতিষ্ঠা করেন। তাঁর মতে, কোন ভৌতিক ও
রাসায়নিক প্রক্রিয়ার সাহায্যে জৈবিক প্রক্রিয়ার ব্যাখ্যা করা যায় না। জীবনের গঠনপ্রণালী ও
যন্ত্রের গঠনপ্রণালীর মধ্যে মৌলিক পার্থক্য রয়েছে। সুতরাং জীবদেহ যন্ত্রবিশেষ নয় এবং
জীবনের কোন যান্ত্রিক ব্যাখ্যাও সম্ভব নয়। একমাত্র প্রাণতত্ত¡ দিয়েই জীবনের ব্যাখ্যা সম্ভব।
ড্রিক কখনও কখনও এই প্রাণতত্ত¡কে মনস্তত্ত¡ বলেও পরিচয় দেন। তাঁর মতে, এই মনস্তত্ত¡ই
জীব দেহের বিশেষ গঠন ভঙ্গিমার জন্য দায়ী। এই মনস্তত্ত¡ জড় থেকে স্বতন্ত্র। প্রাণ থেকেই
প্রাণের উৎপত্তি। কিন্তুপ্রিঙ্গল পেটিসনের মতে, ড্রিক এ সংগঠন শক্তিকে নির্জড়ীয় মনে করেও
সাধারণ অপরিপক্ক জড়বাদের যাদুমন্ত্রের বেড়াজাল থেকে বের হতে পারেননি।
প্রাণবাদীদের যুক্তিসমূহ
প্রাণবাদীরা প্রাণবাদের সমর্থনে যেসব যুক্তি উপস্থাপন করেন তা আরও বিশদভাবে আমরা
এখন আলোচনা করবো :
১। জীবের গঠন ও ক্রিয়ার একটা স্বকীয় বৈশিষ্ট্য আছে, যা কোন যন্ত্রে লক্ষ্য করা যায় না।
সুতরাং জীবের কোন যান্ত্রিক ব্যাখ্যাও সম্ভব হয়ে ওঠে না। জীবের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের মধ্যে
কোন যান্ত্রিক সম্পর্ক নেই। এদের সম্পর্ক সম্পূর্ণ নিবিড় ও অবিচ্ছেদ্য। যন্ত্র হলো
কতগুলো বাহ্য সম্পর্কবিশিষ্ট কৃত্রিম অংশের সমষ্টি। এদিক থেকে যন্ত্রের অস্তিত্ব তার
অংশের উপর সম্পূর্ণ নির্ভরশীল। পক্ষান্তরে, জীবের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ হলো আন্তর
সম্পর্কবিশিষ্ট। ফলে অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের অস্তিত্ব জীবদেহের অস্তিত্বের উপর নির্ভরশীল।
সুতরাং দেখা যাচ্ছে যে, যন্ত্রের বেলায় সমগ্রের তুলনায় অংশের এবং জীব দেহের
ক্ষেত্রে অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের তুলনায় সমগ্রের প্রাধান্য বেশি। জীবদেহ রক্ষার্থে সমগ্রের এ
প্রাধান্য প্রাণশক্তির বিশিষ্টতাই প্রমাণ করে। তাছাড়া জীবের আত্মনিয়ন্ত্রণ, আত্মসংরক্ষণ
ও আত্মবিকাশের ক্ষমতা আছে। জীবের পরিবেশের সাথে সামঞ্জস্য, বংশবৃদ্ধি,
উদ্দেশ্যমূলক কাজ ইত্যাদি তার বৈশিষ্ট্যেরই প্রমাণ। যন্ত্রে এসব বৈশিষ্ট্য নেই। জীবদেহ
যন্ত্র নয়। কাজেই জীব দেহের যান্ত্রিক ব্যাখ্যা সম্ভব নয়।
২। জীবের কার্য সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী করা যায় না। কারণ জীবের কার্যের স্বাধীনতা আছে।
পক্ষান্তরে, জড়ের পরিবর্তন বা কার্যের ভবিষ্যদ্বাণী করা যায়। কারণ জড়ের কোন
স্বাধীনতা নেই। জড় বস্তুকে আমরা যখন যেমন করি তেমন হয়। প্রাণীর স্থান
পরিবর্তনের ক্ষমতা আছে। ছাদ থেকে একখানা পাথর ছুঁড়ে দিলে কোথায় গিয়ে পড়বে
তা অনেকটা আঁচ করা যায়, কিন্তুকোন পাখিকে ধরে এনে ছেড়ে দিলে সে কোথায়
গিয়ে বসবে তা বলা যায় না। কাজেই প্রাণীর কাজকে যান্ত্রিকভাবে ব্যাখ্যা করা যায় না।
৩। আধুনিক বৈজ্ঞানিক গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে যে, কোন কোন প্রক্রিয়ার কোন যান্ত্রিক
ব্যাখ্যা সম্ভব নয়। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, শ্বাস-প্রশ্বাসের কার্য, পুষ্টি, বংশবৃদ্ধি
ইত্যাদিকে যান্ত্রিক কার্যকারণ দ্বারা ব্যাখ্যা করা সম্ভব নয়। অবশ্য এগুলোকে
উদ্দেশ্যমূলক কার্যকারণ সম্পর্কের দ্বারা ব্যাখ্যা করা যায়। সুতরাং জীবনের সব প্রক্রিয়াই
যান্ত্রিকভাবে ব্যাখ্যা করা যায়, এমন কথা এখন আর বলা যায় না।
৪। প্রাণশক্তি ও জড়শক্তি স্বরূপত আলাদা। চঞ্চলতা বা গতি হলো প্রাণ শক্তির প্রধান ধর্ম।
জড় হলো নিশ্চল। চঞ্চলতা ও নিশ্চলতা সম্পূর্ণ বিপরীতধর্মী। সুতরাং জড়ের যান্ত্রিক
ব্যাখ্যা প্রাণের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হতে পারে না।
৫। প্রাণবাদী দার্শনিকদের মতে, জীব বিজ্ঞানের সাথে পদার্থবিদ্যা ও রসায়ন বিদ্যার
মৌলিক পার্থক্য আছে। কারণ পদার্থবিদ্যা ও রসায়ন বিদ্যার বিষয়বস্তুহলো জড়।
কাজেই যান্ত্রিক ব্যাখ্যা পদ্ধতিই এ বিজ্ঞানগুলোর একমাত্র পদ্ধতি। অপরপক্ষে,
প্রাণিবিজ্ঞান হচ্ছে প্রাণশক্তি সম্পর্কীয় বিজ্ঞান। কাজেই প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের যান্ত্রিক
পদ্ধতি এখানে খাটে না। জৈবিক কাজকে কেবল প্রাণ শক্তির সাহায্যে ব্যাখ্যা করা
সম্ভব, যন্ত্র শক্তির সাহায্যে নয়। জীবের জটিল প্রক্রিয়ার যান্ত্রিক ব্যাখ্যা কখনও সম্ভব হবে কিনা? তা নিশ্চিত করে বলা যায় না।
প্রাণবাদীদের যুক্তির সমালোচনা
প্রাণবাদীদের প্রথম মতটি যে বেশ জোরালো তাতে কোন সন্দেহ নেই। সত্যিই জীবের গঠন ও
ক্রিয়ার বৈশিষ্ট্য যন্ত্র থেকে পৃথক। সুতরাং জীবনের কোন যান্ত্রিক ব্যাখ্যা দেয়া সম্ভব নয়।
জীবের স্বাধীনতা আছে। কিন্তুজড়ের স্বাধীনতা নেই। জড়ের কাজের ভবিষ্যদ্বাণী করা যায়,
কিন্তুজীবের কাজের ভবিষ্যদ্বাণী করা যায় না। জড় ও জীব সম্পূর্ণ বিপরীত স্বভাবের। কাজেই
জড়ের যান্ত্রিক ব্যাখ্যা কখনও জীবনের বা প্রাণের ব্যাখ্যা হতে পারে একথা বলা চলে না।
প্রাণীবাদীদের তৃতীয় যুক্তিটি যন্ত্রবাদের বিরুদ্ধে এক চরম আঘাত হেনেছে। একথা সত্য যে,
শ্বাস-প্রশ্বাস এবং পুষ্টির মত কতগুলো জৈবিক প্রক্রিয়ার যান্ত্রিক ব্যাখ্যা করা যায় না।
প্রাণবাদীদের চতুর্থ যুক্তিটিও অত্যন্ত সঙ্গত বলে মনে হয়। সচল জীবের সাথে নিশ্চল জড়ের
কোন মৌলিক ঐক্যই সম্ভব নয়। সুতরাং জীবের কোন যান্ত্রিক ব্যাখ্যা সম্ভব নয়। তবে
প্রাণবাদীদের পঞ্চম যুক্তিটি খুব জোরালো বলে মনে হয় না। কারণ জৈবিক প্রক্রিয়ার ব্যাখ্যা
পদ্ধতি সম্পর্কে সকল জীববিজ্ঞানীও একমত নন।
পরিশেষে একথা বলা যায় যে, প্রাণবাদের পক্ষে যথেষ্ট জোরালো যুক্তি থাকলেও তা একেবারে
ত্রæটিমুক্ত নয়। প্রাণবাদীদের গোটা মতবাদটি ‘সাধন-গ্রহণ দোষ' (ঋধষষধপু ড়ভ চবঃরঃরড়
চৎরহপরঢ়রর) এ দুষ্ট। অর্থাৎ প্রাণবাদীরা যা প্রমাণ বা সাধন করতে চান তা তাঁরা আগেই ধরে বা
গ্রহণ করে নিয়েছেন। তাঁরা প্রমাণ করতে চান যে, প্রাণ জড় থেকে আলাদা। কিন্তুএকথা ধরে
নিয়েই তাঁরা তা প্রমাণে অগ্রসর হয়েছেন। তদুপরি, জীবদেহ ও যন্ত্রের মধ্যে যদি মৌলিক
পার্থক্য থেকে থাকে তবে জড়দেহে প্রাণ শক্তির অস্তিত্ব কিভাবে নির্ধারণ করা যেতে পারে?
প্রাণবাদ তার কোনরূপ ব্যাখ্যা দেয়নি। প্রাণশক্তি ও যন্ত্রশক্তি ভিন্ন হলে আমাদের জড়দেহে
প্রাণ শক্তির আসন কি করে ঠিক করা যায় তা বলা অসম্ভবই মনে হয়।
রচনামূলক প্রশ্ন
১। জীবনের প্রাণবাদী ব্যাখ্যা বর্ণনা করুন।
৪। প্রাণবাদীদের যুক্তিগুলো উল্লেখ করুন এবং আলোচনা করে নিজের মতামত দিন।
সংক্ষিপ্ত উত্তরমূলক প্রশ্ন
১। প্রাচীন ও নব্য প্রাণবাদ ব্যাখ্যা করুন।
২। প্রাণবাদের পক্ষের যুক্তিগুলো উল্লেখ করুন।
নৈর্ব্যক্তিক প্রশ্ন
সঠিক উত্তর লিখুন।
১। প্রাচীন প্রাণবাদের প্রতিষ্ঠাতা হলেন
(অ) প্লেটো (আ) প্রোটাগোরাস
(ই) এনাক্সাগোরাস (ঈ) অ্যারিস্টটল
২। আধুনিক প্রাণবাদের প্রবক্তা হলেন
(অ) হার্বার্ট স্পেন্সার (আ) হাক্সলি
(ই) হ্যান্স ড্রিক (ঈ) ডেকার্ট
৩। প্রাণ হলো বহিঃশক্তির সাথে আন্তর শক্তির ক্রমাগত সামঞ্জস্যবিধান -উক্তিটি করেন
(অ) হ্যালডেন (আ) নিউটন
(ই) হার্বাট স্পেন্সার (ঈ) অ্যারিস্টটল
৪। প্রাণ শক্তির প্রধান ধর্ম হলো
(অ) চঞ্চলতা বা গতি (আ) স্থিরতা
(ই) বাণী (ঈ) কোনটি নয়
সত্য হলে ‘স', মিথ্যা হলে ‘মি' লিখুন।
১। অ্যারিস্টটলের মতে, উদ্ভিদ, প্রাণী ও মানুষের প্রাণের মধ্যে কোন পার্থক্য নেই।
২। প্রাণবাদের মতে, জীবের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ হলো আন্তর সম্পর্কবিশিষ্ট।
সঠিক উত্তর
১। (ঈ) অ্যারিস্টটল ২। (ই) হ্যান্স ড্রিক ৩। (ই) হার্বাট স্পেন্সার ৪।(অ) চঞ্চলতা বা গতি
১। মি ২। স

FOR MORE CLICK HERE
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস মাদার্স পাবলিকেশন্স
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস ১ম পর্ব
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস
আমেরিকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস
বাংলাদেশের ইতিহাস মধ্যযুগ
ভারতে মুসলমানদের ইতিহাস
মুঘল রাজবংশের ইতিহাস
সমাজবিজ্ঞান পরিচিতি
ভূগোল ও পরিবেশ পরিচিতি
অনার্স রাষ্ট্রবিজ্ঞান প্রথম বর্ষ
পৌরনীতি ও সুশাসন
অর্থনীতি
অনার্স ইসলামিক স্টাডিজ প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত
অনার্স দর্শন পরিচিতি প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত

Copyright © Quality Can Do Soft.
Designed and developed by Sohel Rana, Assistant Professor, Kumudini Government College, Tangail. Email: [email protected]