একত্ববাদ কাকে বলে? একত্ববাদ ব্যাখ্যা ও মূল্যায়ন মূর্ত একত্ববাদ ও অমূর্ত একত্ববাদের মধ্যে পার্থক্য নির্ণয় “বহুত্ববাদ ও দ্বৈতবাদের অসারতা থেকে একত্ববাদের উদ্ভব”Ñ ব্যাখ্যা করুন।

আমরা পূর্বের দুটি পাঠে আদি উপাদান বা পরম সত্তা সম্পর্কে দ্বৈতবাদ ও বহুত্ববাদ এবং
এদের প্রকারভেদ নিয়ে আলোচনা করেছি। কিন্তুমতবাদগুলোর সমালোচনায় দেখেছি একটিও
যুক্তিসঙ্গত নয়। এবার আমরা এ দুটির বিপরীত মতবাদ একত্ববাদ এবং তার নানা প্রকার নিয়ে আলোচনা করবো।
একত্ববাদ বা অদ্বৈতবাদ
একত্ববাদের সংজ্ঞা
যে মতবাদ পরম সত্তা বা আদি উপাদানকে এক বা অদ্বৈত (ঙহব) বলে ব্যাখ্যা করে তাকে
একত্ববাদ বলা হয়। এ মতের অনুগামীদের মতে, জগৎ কেবল একটি মৌলিক উপাদান বা
সত্তা নিয়ে গঠিত। এ মতবাদের নঞর্থক ও সদর্থক দুটি দিক আছে। প্রথমত একত্ববাদ
বহুত্ববাদ ও দ্বৈতবাদের অসারতা প্রমাণ করতে সচেষ্ট। দ্বিতীয়ত একত্ববাদ বিশৃ´খল জগতের
ভেতর ঐক্য প্রতিষ্ঠা করতে চায়।
বহুত্ববাদ ও দ্বৈতবাদ প্রসঙ্গে একত্ববাদ
বহুত্ববাদ ও দ্বৈতবাদের অসারতা প্রমাণ করতে গিয়ে একত্ববাদ উল্লেখ করে যে, বহুত্ববাদ
বিচিত্র সত্তার অস্তিত্বের মধ্যে জাগতিক বৈচিত্র্য ব্যাখ্যা করে বটে; কিন্তুবিভিন্ন সত্তার অনিবার্য
ঐক্য প্রতিষ্ঠা করতে পারে না। কাজেই বহুত্ববাদ ঐক্যপূর্ণ জগতের ব্যাখ্যা হিসেবে সার্থক
মতবাদ নয়। আবার দ্বৈতবাদ দুটি বিপরীতধর্মী সত্তার প্রকল্পের মাঝে জগতকে দ্বিখন্ডিত ও
পরস্পর সম্পর্কবিযুক্ত করে তোলে। সুতরাং এ মতবাদ পরম সত্তার সঠিক প্রকৃতি নির্ণয় করতে
পারে না। জগতের বিভিন্ন বস্তুযদি বিচ্ছিন্ন হয় তবে তাদের স্বরূপ কখনো জানা যাবে না।
একত্ববাদের পক্ষে যুক্তি
দ্বৈতবাদ ও বহুত্ববাদের অসারতার উপর যে মতবাদ উৎপত্তি লাভ করে তা হলো একত্ববাদ।
একত্ববাদীরা তাঁদের বক্তব্যের সমর্থনে নিæোক্ত দুটি যুক্তির অবতারণা করেন:
এক. যদি জগতের সকল বস্তুকে অন্য সকল বস্তুর সাথে আমরা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে কম-
বেশি অনিবার্য ও আন্তর সম্বন্ধে সংবদ্ধ বলে মনে করি তাহলে একত্ববাদকে অস্বীকার করা যায়
না। কারণ ও কার্যের মধ্যবর্তী সম্বন্ধকে অনিবার্য সম্বন্ধ বলা যায়। এই কারণ ও কার্যের
অনিবার্য সম্বন্ধই একত্ববাদের স্বীকৃতি ঘোষণা করে।
দুই. এ যুক্তিটি মৌলিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেয়া হয়েছে। বস্তুত মানুষ স্বাভাবিকভাবেই ‘বহুর
মধ্যে এক', ‘বিভেদের মধ্যে ঐক্য' সন্ধান করতে চায়। মানুষ প্রথমে জগতকে ঐক্যহীন
দেখলেও জ্ঞান বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে এর ভেতরে অনিবার্য ঐক্য খুঁজে পায়। এ সম্পর্ক বা ঐক্য
কেবল বাহ্য সম্পর্ক নয়। জগতে আন্তর সম্পর্কের অস্তিত্ব অস্বীকার করা যায় না। মন ও জড়
একই ঐক্যের বিভিন্ন প্রকাশ। বিচিত্র এ জগৎ সে একই ঐক্যের অবভাসমাত্র।
একত্ববাদের প্রকারভেদ
পরম সত্তার সংখ্যা সম্পর্কিত একত্ববাদী ব্যাখ্যা বা সিদ্ধান্তকে দু'ভাগে ভাগ করা যায় : অমূর্ত একত্ববাদ ও মূর্ত একত্ববাদ
অমূর্ত একত্ববাদ
শংকরের অমূর্ত একত্ববাদ : ভারতীয় মহাবৈদান্তিক আচার্য শংকর ও পাশ্চাত্য দার্শনিক
স্পিনোজা অমূর্ত (ধনংঃৎধপঃ) একত্ববাদের নেতৃস্থানীয় প্রতিনিধি। শংকরের মতে, একমাত্র
ব্রহ্মই সত্য, জগৎ মিথ্যা ছাড়া আর কিছুনয়। একমাত্র ব্রহ্মেরই সত্তা আছে। জীব ও ব্রহ্ম এক
এবং অভিন্ন। বহুত্বের ধারণা সম্পূর্ণ অলীক। কিন্তু অবিদ্যা বা অজ্ঞতার কারণে দৃশ্যময়
জগতকে সত্য বলে মনে হয়। পারমার্থিক দৃষ্টিতে জগৎ মিথ্যা প্রতিভাস ছাড়া আর কিছুনয়।
তিনি উদাহরণস্বরূপ বলেন, অন্ধকারে আকাঁ-বাঁকা রশিকে যেমন আমরা সর্প বলে ভাবি,
তেমনি অবিদ্যার কারণে প্রতিভাসিক জগতকেও আমরা সত্য বলে ভাবি। আসলে ব্রহ্মই
একমাত্র সত্য, আর বাকি সবই তার অসার বা মায়ার বিলাসমাত্র।
স্পিনোজার অমূর্ত একত্ববাদ : পাশ্চাত্য দর্শনে স্পিনোজা হচ্ছেন অমূর্ত একত্ববাদের একজন
সফল প্রতিনিধি। স্পিনোজার মতে, যা সাশ্রয়ী, স্বনির্ভর, যা নিজের অস্তিত্বের জন্য অন্য কোন
সত্তার উপর নির্ভরশীল নয় তাকেই বলে দ্রব্য। তাঁর মতে, ঈশ্বরই একমাত্র অস্তিত্বের জন্য
কোন সত্তার উপর নির্ভরশীল নয়। তাই ঈশ্বরই একমাত্র দ্রব্য। তিনিই একমাত্র চরম ও পরম
সত্য। তাঁর বাইরে কোন সত্তার স্বতন্ত্র অস্তিত্ব নেই, ঈশ্বরই সব, সবই ঈশ্বর। এ কারণে
স্পিনোজার এ মতবাদকে সর্বেশ্বরবাদ (চধহঃযবরংস) বলা হয়। এ ঈশ্বরকে একমাত্র ধারণার মাধ্যমেই জানা যায়, ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে নয়।
সমালোচনা
অমূর্ত একত্ববাদ বিভিন্ন মহল থেকে তীব্রভাবে সমালোচিত হয়েছে :
এক. সমালোচকদের মতে, অমূর্ত একত্ববাদ এক ধরনের চরম মতবাদ। অমূর্ত একত্ববাদীরা
ঐক্য ও অনৈক্য, একত্ব ও বহুত্ব যে পরস্পরসাপেক্ষ, এদের একটাকে বাদ দিলে যে অপরটি
অর্থহীন হয়ে পড়ে একথা উপলব্ধি করতে পারেননি।
দুই. অমূর্ত একত্ববাদ সাদা-কালো, শুভ-অশুভ, সত্য-মিথ্যা ও আলো-আধারের মধ্যে পার্থক্য
দেখাতে ব্যর্থ হয়েছে। এ মতবাদ যাবতীয় ভেদাভেদ অস্বীকার করে বসেছে। এতে করে
আমাদের নৈতিক জীবন বাধাগ্রস্থ হয়, কর্ম-জীবনে আমাদের দায়িত্ববোধ অস্বীকৃত হয়ে পড়ে।
তিন. অমূর্ত একত্ববাদ ধর্মের প্রভাবে প্রভাবিত। তাই দার্শনিক বিচারে এ মতবাদ কতটুকু
যুক্তিনির্ভর তা অবশ্যই মূল্যায়নের অপেক্ষা রাখে।
চার. অমূর্ত একত্ববাদীরা অভিজ্ঞতার জগতকে অলীক ও মিথ্যা বলে অভিহিত করে থাকেন।
কিন্তুচোখ খুললেই আমরা যে জগৎ দেখি এবং যে জগতে বিচরণ করি তাকে আমরা অস্বীকার করি কিভাবে?
মূর্ত একত্ববাদ
রামানুজের মূর্ত একত্ববাদ : ভারতীয় দার্শনিক রামানুজ ও পাশ্চাত্য দার্শনিক হেগেল মূর্ত
একত্ববাদের নেতৃস্থানীয় প্রতিনিধি। তাছাড়া জন কেয়ার্ড ও যোসিয়া রয়েস প্রমুখ ভাববাদী
দার্শনিকরাও এ মতবাদের সমর্থক। রামানুজের মতে, ব্রহ্ম হচ্ছে এক আদি ও সগুণ সত্তা।
তিনি নির্গুণ নন। তিনি অনেক গুণের অধিকারী। সৎ, চিৎ ও আনন্দ হচ্ছে ব্রহ্মের তিনটি প্রধান
গুণ। ব্রহ্ম সত্য বলে তাঁর সৃষ্টি জগতও সত্য। তিনি জগতের সৃষ্টিকর্তা ও নিয়ন্ত্রক।
হেগেলের মূর্ত একত্ববাদ : হেগেলের মতে, এ পদার্থিক জগৎ (ঢ়যুংরপধষ ড়িৎষফ) অলীক বা
কল্পনাপ্রসূত নয়। এ জগৎ অনপেক্ষ পরম সত্তারই এক পরিপূর্ণ প্রকাশ। তিনি সম্পূর্ণ একক
সত্তা। এই বৈচিত্র্যপূর্ণ জগতের মধ্য দিয়েই অহরহ তিনি নিজেকে প্রকাশ করে চলেছেন।
পরমসত্তা ও তার সৃষ্টিজগৎ পরস্পরসাপেক্ষ। পরম সত্তা ব্যতিত পার্থিব জগৎ যেমন অর্থহীন,
তেমনি পার্থিব জগৎ ব্যতিত পরম সত্তাও অর্থহীন। একক ছাড়া যেমন বৈচিত্র্য অর্থহীন তেমনি
বৈচিত্র্য ছাড়াও একক অর্থহীন। বৈচিত্র্যের মাধ্যমেই আমরা এককের স্বরূপ ও তাৎপর্যকে
পরিপূর্ণভাবে উপলব্ধি করতে পারি। ঐক্য ও বৈচিত্র্য, একক ও অনন্ত আসলে পরম সত্তারই
দুটি অবিচ্ছেদ্য দিকমাত্র।
হেগেল পরম সত্তাকে পরম সত্য বলে অভিহিত করেন। এ পরম সত্তাই বিভেদের মধ্যে ঐক্য,
বৈচিত্র্যের মধ্যে সামঞ্জস্য এবং অনন্তের মধ্যে একক সত্তা হিসেবে সদা বিরাজিত। তিনি
জগতের মধ্যে এবং বাইরে সর্বত্রই পরিব্যাপ্ত। আর এ কারণেই এ মতবাদ সর্বধরেশ্বরবাদ
(চধহবঃযবরংস) নামে সমধিক পরিচিত। স্পিনোজার সর্বেশ্বরবাদের সাথে এ মতবাদের প্রধান
পার্থক্য হলো এই যে, স্পিনোজা যেখানে পরম সত্তাকে সম্পূর্ণ অমূর্ত এবং বহুত্ব ও জাগতিক
বৈচিত্র্যের সম্পর্কবর্জিত বলে মনে করেন; হেগেল সেখানে পরম সত্তাকে সম্পূর্ণ মূর্ত এবং বহুত্ব
ও জাগতিক বস্তুর সাথে সম্পর্কযুক্ত বলে মনে করেন। স্পিনোজার মতে এ জগৎ সম্পূর্ণ মিথ্যা, কিন্তুহেগেলের মতে জগৎ সত্য।
সমালোচনা
পরম সত্তার স্বরূপ সংক্রান্ত মতবাদ হিসেবে অনেকেই মূর্ত একত্ববাদকে একটি গ্রহণযোগ্য
মতবাদ বলে মনে করেন। এ মতবাদ জগতের ঐক্য স্বীকার করে নিয়েও মানুষের স্বাধীনতা ও
কৃতকর্মের দায়িত্বকে অস্বীকার করে না। তাই নৈতিক ও ধর্মীয় জীবনের দাবিতে এ মত
সমর্থনযোগ্য। এ মতবাদের উপর ভিত্তি করেই একেশ্বরবাদ (গড়হড়ঃযবরংস) এর উদ্ভব
হয়েছে। মূর্ত একত্ববাদের ন্যায় একেশ্বরবাদ বহু ঈশ্বরবাদ ও দ্বীশ্বরবাদের দোষ-ত্রæটিকে দূর করে মানব মনে এক অসীম, অনন্ত, পরিপূর্ণ ঈশ্বরের ধারণার জন্ম দিতে সক্ষম হয়েছে।
রচনামূলক প্রশ্ন
১। একত্ববাদ কাকে বলে? একত্ববাদ ব্যাখ্যা ও মূল্যায়ন করুন।
২। মূর্ত একত্ববাদ ও অমূর্ত একত্ববাদের মধ্যে পার্থক্য নির্ণয় করুন।
৩। “বহুত্ববাদ ও দ্বৈতবাদের অসারতা থেকে একত্ববাদের উদ্ভব”Ñ ব্যাখ্যা করুন।
সংক্ষিপ্ত উত্তরমূলক প্রশ্ন
১। শংকরের অমূর্ত একত্ববাদ বর্ণনা করুন।
২। স্পিনোজার সর্বেশ্বরবাদ ব্যাখ্যা করুন।
৩। মূর্ত একত্ববাদ ব্যাখ্যা করুন।
৪। অমূর্ত একত্ববাদ ব্যাখ্যা করুন।
৫। হেগেলের সর্বধরেশ্বরবাদ ব্যাখ্যা করুন।
নৈর্ব্যক্তিক প্রশ্ন
সঠিক উত্তর দিন।
১। একত্ববাদের মতে জগতের আদি উপাদান
(অ) দুই (আ) বহু
(ই) এক (ঈ) অসংখ্য
২। অমূর্ত একত্ববাদের প্রধান ভারতীয় প্রতিনিধি হলেন
(অ) রামানুজ (আ) শংকর
(ই) স্পিনোজা (ঈ) কেউ নয়
৩। পাশ্চাত্য জগতে অমূর্ত একত্ববাদের সমর্থক
(অ) স্পিনোজা (আ) হেগেল
(ই) হিউম (ঈ) প্লেটো
৪। হেগেলের মতবাদকে বলা হয়
(অ) অমূর্ত একত্ববাদ (আ) দ্বৈতবাদ
(ই) বহুত্ববাদ (ঈ) মূর্ত একত্ববাদ
৫। হেগেলের মতবাদের নাম
(অ) সর্বেশ্বরবাদ (আ) একেশ্বরবাদ
(ই) সর্বধরেশ্বরবাদ (ঈ) বহুত্ববাদ
সত্য হলে স, মিথ্যা হলে ‘মি' লিখুন।
১। যে মতবাদ পরম সত্তাকে এক বা অদ্বৈত বলে মনে করে তাকে একত্ববাদ বলা
হয়।
২। বহুত্ববাদ ঐক্যপূর্ণ জগতের ব্যাখ্যা হিসেবে সার্থক মতবাদ।
৩। শংকরের মতে, বহুত্বের ধারণা সম্পূর্ণ অলীক।
৪। অমূর্ত একত্ববাদ ধর্মের প্রভাবে প্রভাবিত।
৫। স্পিনোজা ও হেগেলের পরম সত্তার ধারণার মধ্যে কোন পার্থক্য নেই।
সঠিক উত্তর
১। (ই) এক ২। (আ) শংকর ৩। (অ) স্পিনোজা
৪। (ঈ) মূর্ত একত্ববাদ ৫। (ই) সর্বধরেশ্বরবাদ
১। স ২। মি ৩। স ৪। স ৫। মি

FOR MORE CLICK HERE
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস মাদার্স পাবলিকেশন্স
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস ১ম পর্ব
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস
আমেরিকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস
বাংলাদেশের ইতিহাস মধ্যযুগ
ভারতে মুসলমানদের ইতিহাস
মুঘল রাজবংশের ইতিহাস
সমাজবিজ্ঞান পরিচিতি
ভূগোল ও পরিবেশ পরিচিতি
অনার্স রাষ্ট্রবিজ্ঞান প্রথম বর্ষ
পৌরনীতি ও সুশাসন
অর্থনীতি
অনার্স ইসলামিক স্টাডিজ প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত
অনার্স দর্শন পরিচিতি প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত

Copyright © Quality Can Do Soft.
Designed and developed by Sohel Rana, Assistant Professor, Kumudini Government College, Tangail. Email: [email protected]