মন বা আত্মা
স্মৃতি (সবসড়ৎু)-র সম্ভবপরতা, ইচ্ছার স্বাধীনতা, দেহ-মনের সম্বন্ধ, মন বা আত্মার
অমরত্ব প্রভৃতি গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা সম্বন্ধে স্পষ্ট ধারণা পেতে হলে স্বয়ং মন বা আতœা-র
স্বরূপ জানা আবশ্যক। যদিও আমরা হরহামেশা মন বা আত্মা শব্দটি ব্যবহার করি,
তথাপি এর সঠিক অর্থ আমাদের কাছে পরিষ্কার নয়। মন বা আত্মা কী? তাই এক সঙ্গত
দার্শনিক প্রশ্ন বা সমস্যা।
ভারতীয় দর্শনে মন ও আত্মার মধ্যে পার্থক্য করা হয়। মন হলো যষ্ঠ ইন্দ্রিয় যার মাধ্যমে
আমরা অন্তর্দর্শন করি। অর্থাৎ বিভিন্ন মানসিক অবস্থাগুলোকে জানি।
পক্ষান্তরে, আত্মা হলো কর্তা, জ্ঞাতা ও ভোক্তা; যিনি কর্ম করেন, বিষয় জানেন এবং সুখ-
দুঃখ ভোগ করেন।
পাশ্চাত্য দর্শনে মন ও আত্মার মধ্যে সর্বদা পার্থক্য স্বীকার করা হয়নি। প্রভৃতি শব্দগুলো প্রায়শঃ সমার্থক হিসেবে ব্যবহৃত হয়।
বর্তমান ইউনিটে আমরা মন বা আত্মা সংক্রান্ত মতবাদগুলো জানার চেষ্টা করব।
দৈনন্দিন জীবনে আমরা মন বা আত্মা সম্পর্কে নানারকম কথা বলি। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে মন
আসলে কি, তা আমরা জানি না। প্রাচীনকাল থেকেই দার্শনিকগণ মন সম্পর্কে আলোচনাপর্যালোচনা করেছেন। কারো মতে, মন একটি আধ্যাত্মিক দ্রব্য; কারো মতে, মন সতত
পরিবর্তনশীল প্রক্রিয়ার ধারা; কারো মতে, মন একটা অতীন্দ্রিয় ও সক্রিয় সত্তা; কারো মতে,
মন অবিনশ্বর; কারো মতে, নশ্বর। প্রকৃতপক্ষে মনের সঠিক সংজ্ঞা দেয়া সম্ভব নয়। তবে মন
সম্পর্কে এটুকু বলা যায় যে, মন হলো এমন কিছু যা নিজের অবস্থা ও ক্রিয়াগুলো সম্পর্কে
সচেতন। মন সম্পর্কে আমরা যে সমস্ত মতবাদ পাই তার প্রধান প্রধান মতবাদগুলো এখানে
আলোচনা করা হলো।
দ্রব্য মতবাদ
এ মতবাদ অনুসারে, মন হচ্ছে একটা আধ্যাত্মিক দ্রব্য। জড় দ্রব্যকে যেমন প্রাকৃতিক বা
ভৌতিক গুণাবলীর আধার বলে ধরা যায়, তেমনি মনকেও মনোবৃত্তির বা মানসিক
প্রক্রিয়াগুলোর আধার বলে ধরা যায়। মন যেহেতু একটি আধ্যাত্মিক দ্রব্য, সেহেতু আধ্যাত্মিক
এই দ্রব্যের সাথে জড় সত্তার মৌলিক পার্থক্য বিদ্যমান। মন বা আত্মা দেহনির্ভর সত্তা নয়,
মৃত্যুর পর বিদেহী অবস্থায় এই মনের অস্তিত্ব থাকে। প্লেটো, অ্যারিস্টটল, ডেকার্ট, লক,
বার্কলি প্রমুখ এই মতবাদের অনুসারী।
প্রত্যক্ষবাদী মতবাদ
দার্শনিক হিউম এই মতবাদের একজন বলিষ্ঠ প্রবক্তা। প্রত্যক্ষবাদীদের মতে, মানব মনের
ক্ষেত্রে পরস্পর সম্বন্ধযুক্ত মানসিক অবস্থার পারম্পর্য লক্ষ্য করা যায়। স্মৃতি অতীত মানসিক
অবস্থার প্রতিরূপের সাহায্যে আমাদের মানসিক অবস্থাগুলোর মধ্যে একটি সাদৃশ্যের সম্বন্ধ
স্থাপন করে। কল্পনা এই পথে অগ্রসর হয়ে সাদৃশ্যকে স্থায়িত্ব দেয়। অর্থাৎ স্মৃতিতে যাকে
সদৃশ বলে জানা যায়, কল্পনায় তাকে স্থায়ী বা এক বলে মনে হয়। তদুপরি আমাদের মানসিক
অবস্থাগুলো কার্যকারণ সম্বন্ধের দ্বারা পরস্পর সম্বন্ধযুক্ত। আমাদের মুদ্রণগুলো
তদনুসারী ধারণার (রফবধং) সৃষ্টি করে। এই ধারণাগুলো আবার অন্য
মুদ্রণের সৃষ্টি করে। একটি চিন্তা অন্য চিন্তাকে অনুসরণ করে, তা আবার অন্য চিন্তাকে অনুসরণ
করে। এক্ষেত্রেও স্মৃতিই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। স্মৃতির ভিত্তিতে আমাদের মানসিক
অবস্থাগুলো কল্পনায় অনুষঙ্গের নিয়ম দ্বারা আবদ্ধ হয়। বস্তত
আমরা যেখানে পরস্পর সম্বন্ধযুক্ত মানসিক অবস্থার পারম্পর্য বর্তমান সেখানে তাদের মধ্যে
স্থায়িত্ব বা তাদাÍ্য সম্বন্ধ আরোপ করি। মনের তাদাÍ্য বা অভিন্নতা
আমাদের কল্পনা, এর কোনো তাত্তি¡ক ভিত্তি নেই।
আঙ্গিক মতবাদ
কান্ট এই মতবাদের প্রবক্তা । এই মতানুসারে, মনই বিচ্ছিন্ন সংবেদন -এর
মধ্যে যোগস ত্র স্থাপন করে তাদের ঐক্যবদ্ধ করে তোলে। তবে মন কোনো আধ্যাত্মিক দ্রব্য
নয় বা বিচ্ছিন্ন পরিবর্তনশীল সংবেদনের সমষ্টিও নয়। মনকে নিষ্ক্রিয় দ্রব্য বলা যায় না, কারণ
মন মানসিক বৃত্তিগুলোর নিষ্ক্রিয় আধারমাত্র নয়। জ্ঞান, অনুভ‚তি ও ইচ্ছা কেবলমাত্র মনকে
আশ্রয় করে থাকে না। মন বা আত্মা হলো চিন্তা, অনুভ‚তি ও ইচ্ছা প্রভৃতি মানসিক প্রক্রিয়ার
অতিরিক্ত এক সংশ্লেষণমূলক ঐক্যবিধায়ক প্রক্রিয়া, যা বিছিন্ন সংবেদনগুলোকে ঐক্যবদ্ধ করে
অভিজ্ঞতাকে সম্ভব করে তোলে। অর্থাৎ মনের ক্রিয়াশক্তির জন্যই জ্ঞান, ইচ্ছা প্রভৃতির উদ্ভব
ঘটে।
কান্টের মতে, এই মতবাদের দুটি দিক রয়েছে। একটি সদর্থক এবং অপরটি নঞর্থক। সদর্থক
দিক থেকে তিনি বলেন যে, মন এসব মানসিক প্রক্রিয়ার অতিরিক্ত এমন এক অতীন্দ্রিয় সত্তা,
যা আধ্যাত্মিক দ্রব্যের মতো নিষ্ক্রিয় নয়, বরং যা সক্রিয় এবং যার কাজ হলো বিভিন্ন সংবেদন
বা মানসিক প্রক্রিয়ার মধ্যে ঐক্য স্থাপন করা। নঞর্থক দিক থেকে তিনি বলেন যে, মন একটি
আধ্যাত্মিক দ্রব্য বা কতকগুলো প্রত্যক্ষণ বা সংবেদনের সমষ্টি নয়। কান্টের মতে, মন যদি
নিষ্ক্রিয় সত্তা হয়, তাহলে সে মনের পক্ষে বিভিন্ন অভিজ্ঞতা বা সংবেদনের মধ্যে যোগস ত্র
স্থাপন করা সম্ভব নয়। আবার মন যদি শুধু বিচ্ছিন্ন সংবেদনের সমষ্টি হয়, তাহলে বিছিন্ন
সংবেদনের মাধ্যমে পুরোপুরি জ্ঞান লাভের পথ সুগম হয়ে ওঠে না। তাঁর মতে, জ্ঞাতা কখনও
জ্ঞেয় হতে পারে না।
জড়বাদী মতবাদ
জড়বাদীরা অধ্যাÍ দ্রব্যরূপে মনের অস্তিত্ব স্বীকার করেন না। তবে চেতনার সত্তা স্বীকার করেন।
মন বা চেতনা জড় থেকেই উদ্ভ‚ত।
গ্রিক জড়বাদী ডেমোক্রিটাস এর মতে, মন সূ² জড় পরমাণুর দ্বারা গঠিত।
হাক্সলি (ঐীঁষবু)-র মতে, মন হলো মস্তিষ্কের উপবস্তু । দুটি কঠিন
বস্তুর ঘর্ষণের ফলে যেমন আলোর রেখা বেরিয়ে আসে তেমনি মস্তিষ্কের কোষের অনবরত
ঘর্ষণের ফলে চেতনার উৎপত্তি। চেতনা মস্তিষ্ক থেকে উৎপন্ন হলেও মস্তিষ্ক বা দেহকে নিয়ন্ত্রিত
করতে পারে না। চেতনা জ্যোতির্মন্ডলের মত মস্তিষ্ককে ঘিরে রয়েছে। চেতনা উপবস্তু, কেননা
জড়ের চেতনার কোনো বস্তুসত্তা নেই, জড়ই প্রকৃত বস্ত, জড়েরই সত্তা আছে। জড়ই চৈতন্যের
কারণ। হব্স (ঐড়ননবং)-এর মতে, মন হলো মস্তিষ্কের গতি।
জড়বাদীদের মতে, জড় আর মনের পার্থক্য হলো মাত্রাগত, আসলে জড় আর মন একই। মন
জড়ের গুণবিশেষ।
উন্মেষবাদ
এই মতবাদ অনুসারে, প্রাণ ও চৈতন্য একটি উন্মেষিত গুণ । জড় থেকেই জীবের উদ্ভব হয়।
কিন্তু জীবে প্রাণরূপ নতুন গুণ পাওয়া যায়। এই নতুন গুণ জড়ে নেই, মন প্রাণ থেকেই
আসে। কিন্তু মনের স্তরে চৈতন্যরূপ এক নতুন গুণের উদ্ভব হয়। এই গুণ মনের উপাদান,
প্রাণের নয়। এই মতবাদ অনুসারে, মন মস্তিষ্ক্রের সংগঠনের শেষ পরিণাম নয়, মন উন্মেষিত
হয়। এ মতানুসারে, বিবর্তনের প্রত্যেক স্তরে এমন একটি নতুন গুণের আবির্ভাব ঘটে যা
প র্বের স্তরে ছিল না। জীবদেহকে আশ্রয় করে মনের প্রকাশ ঘটলেও মন জৈবিক অবস্থার
পুনর্বিন্যাসের জটিল রূপ মাত্র নয়। মন হলো এক নতুন সত্তা যার মধ্যে নতুন গুণ ও শক্তির
আবির্ভাব ঘটে, যা পূর্ববর্তী জৈবিক অবস্থার মধ্যে ছিল অনুপস্থিত। তাদের মতে, মন হলো
নতুন স্তরের এক নতুন সত্তা, যার নিজস্ব বৈশিষ্ট্য আছে।
উপসংহার
মন আসলে কী? তার সন্তোষজনক উত্তর কোনো মতবাদই দিতে পারেনি। বিভিন্ন দার্শনিক বা
দার্শনিক সম্প্রদায় মনের ভিন্ন ভিন্ন ধারণা বা মতবাদ প্রদান করেছেন। তাদের এই ধারণা বা
মতবাদ নানাভাবে সমালোচিত হয়েছে। আধুনিক দার্শনিকগণ আবার মন সম্পর্কে নতুন নতুন
মত প্রদান করেছেন।
রচনামূলক প্রশ্ন
১। মন সম্পর্কীয় মতবাদগুলো বর্ণনা করুন।
সংক্ষিপ্ত উত্তরমূলক প্রশ্ন
১। মন সম্পর্কীয় দ্রব্য মতবাদ বর্ণনা করুন।
২। মনের স্বরূপ সম্পর্কীয় মতবাদ হিসেবে প্রত্যক্ষবাদী মতবাদ ব্যাখ্যা করুন।
৩। মনের স্বরূপ সম্পর্কীয় মতবাদ হিসেবে উন্মেষবাদ ব্যাখ্যা করুন।
৪। মন সম্পর্কীয় জড়বাদী মতবাদ বর্ণনা করুন।
ক) বহু নির্বাচনী প্রশ্ন
সঠিক উত্তর লিখুন
১। দ্রব্য মতবাদ অনুসারে মন হলো
র) একটি আধ্যাত্মিক দ্রব্য
রর) বিভিন্ন সংবেদনের সমষ্টি
ররর) জড় বস্তু
রা) একটি উন্মেষিত গুণ
২। প্লেটো, অ্যারিস্টটল, ডেকার্ট প্রমুখ
দার্শনিক মন সম্পর্কে
র) উন্মেষবাদের অনুসারী
রর) আঙ্গিক মতবাদের অনুসারী
ররর) জড়বাদী মতবাদের অনুসারী
রা) দ্রব্য মতবাদের অনুসারী
৩। আঙ্গিক মতবাদের প্রবক্তা
র) লক
রর) হিউম
ররর) কান্ট
রা) হবস্
৪। ‘‘মন জড় গুণবিশেষ’’ -বক্তব্যটি
র) জড়বাদীদের
রর) আঙ্গিকবাদীদের
ররর) প্রত্যক্ষবাদীদের
রা) উন্মেষবাদীদের
খ) সত্য হলে ‘স’ এবং মিথ্যা হলে ‘মি’ লিখুন।
১। মন হলো এমন কিছু যা নিজের অবস্থা ও ক্রিয়া সম্পর্কে সচেতন।
২। হিউম প্রত্যক্ষবাদী মতবাদের একজন প্রবক্তা।
৩। হবস্রে মতে ‘মন হলো জীবনের গতি’।
৪। উন্মেষবাদ অনুসারে মন হলো আধ্যাত্মিক দ্রব্য।
সঠিক উত্তর
ক)
১। র) একটি আধ্যাত্মিক দ্রব্য ২। রা) দ্রব্য মতবাদের অনুসারী
৩। ররর) কান্ট ৪। র) জড়বাদীদের
খ) ১। স ২। স ৩। মি ৪। মি
FOR MORE CLICK HERE
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস মাদার্স পাবলিকেশন্স
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস ১ম পর্ব
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস
আমেরিকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস
বাংলাদেশের ইতিহাস মধ্যযুগ
ভারতে মুসলমানদের ইতিহাস
মুঘল রাজবংশের ইতিহাস
সমাজবিজ্ঞান পরিচিতি
ভূগোল ও পরিবেশ পরিচিতি
অনার্স রাষ্ট্রবিজ্ঞান প্রথম বর্ষ
পৌরনীতি ও সুশাসন
অর্থনীতি
অনার্স ইসলামিক স্টাডিজ প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত
অনার্স দর্শন পরিচিতি প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত