দেহ ও মনের সম্বন্ধ সম্পর্কীয় মতবাদ হিসেবে ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়াবাদ ও সমান্তরালবাদ

আমরা সহজে বুঝতে পারি, দেহ ও মনের মধ্যে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে। দেহ বা শরীর সুস্থ
থাকলে মন প্রফুল্ল থাকে; দেহ অসুস্থ হলে মন দুর্বল বা বিষণœ হয়ে পড়ে। একইভাবে মন
প্রফুল্ল থাকলে দেহের কর্মক্ষমতা বাড়ে; মন বিষণœ বা দুঃখে ভারাক্রান্ত হলে দেহের
কর্মক্ষমতা কমে বা ব্যাহত হয়। মস্তিষ্কে গুরুতর আঘাত পেলে মানুষের চেতনাশক্তি লোপ
পায়; আবার দুঃখ-বেদনায় মানুষের চোখ দিয়ে পানি ঝরে। বস্তুতঃ সাধারণ অভিজ্ঞতা,
ব্যাধিবিজ্ঞান (চধঃযড়ষড়মু), ব্যবচ্ছেদবিদ্যা (অহধঃড়সু) ও শারীরবিদ্যা
(চযুংরড়ষড়মু)-র সহায়তায় দেহ-মনের নিবিড় সম্পর্কের কথা সহজে জানা যায়। কিন্তু
প্রশ্ন হলো, এই সম্পর্কের স্বরূপ বা প্রকৃতি কি? কিভাবে দেহ-মনের এই সম্পর্ক ঘটে?
বিভিন্ন দার্শনিক বিভিন্নভাবে এই সম্পর্কের স্বরূপ ব্যাখ্যা করেন। আমরা বর্তমান ইউনিটে
দেহ-মনের সম্পর্ক সংক্রান্ত দার্শনিক মতবাদগুলো সংক্ষেপে আলোচনা করবো। দেহ ও মনের মধ্যে কী সম্পর্ক? দেহ হলো জড় পদার্থ, আর মন হলো চেতনধর্মী। কিন্তু
প্রাত্যহিক জীবনে আমরা দেহ ও মনের নিবিড় সম্পর্ক দেখতে পাই। শরীর অসুস্থ হলে মন
খারাপ থাকে, আবার মনে আনন্দ থাকলে দৈহিকভাবে তার প্রকাশ ঘটে। আবার ক্রুদ্ধ হলেও
কতকগুলো দৈহিক পরিবর্তনে তার প্রকাশ ঘটে। সুতরাং সাধারণভাবে আমরা দেখতে পাই যে,
দেহ ও মনের মধ্যে একটা নিবিড় সম্পর্ক বিদ্যমান। এই সম্পর্ক কেমন এ নিয়ে দার্শনিকগণ
ভিন্ন ভিন্ন মতবাদ পোষণ করেন। আমরা এ পাঠে দেহ ও মন সম্পর্কীয় এই মতবাদগুলো
আলোচনা করব।
ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়াবাদ
এই মতবাদের মূল বক্তব্য হলো, দেহ ও মনের মধ্যে কার্যকারণ সম্পর্ক বর্তমান। সময় সময়
দৈহিক প্রক্রিয়া মানসিক প্রক্রিয়ার কারণ। আবার অনেক সময় মানসিক প্রক্রিয়া দৈহিক
প্রক্রিয়ার কারণ। মন ও দেহ কার্যকারণরূপে পরস্পরের উপর ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া করে থাকে।
ডেকার্ট এই মতবাদের সমর্থক। তাঁর মতে, দেহ ও মন পরস্পর বিরোধী দ্রব্য। দেহ অচেতন
জড়, যার সারধর্ম হলো বিস্তৃতি; মন সচেতন দ্রব্য, যার সারধর্ম হলো চেতনা। দেহ নিষ্ক্রিয়, মন
সক্রিয়। দেহ যান্ত্রিক নিয়মের অধীন, মন উদ্দেশ্য দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। কোনো বিষয়ে এই দুই
দ্রব্যের মিল নেই। দেহ ও মন স্রষ্টার সৃষ্ট, কিন্তু এই দুই দ্রব্য পরস্পর নিরপেক্ষ।
ডেকার্টের মতে, জ্ঞানের ক্ষেত্রে দেহ মনের উপর এবং কর্মের ক্ষেত্রে মন দেহের উপর প্রভাব
বিস্তার করে। মস্তিষ্কের কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত পাইনিয়াল গ্রন্থি দেহ ও মনের
সংযোগস্থল। এই গ্রন্থির মাধ্যমে দেহ ও মনের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া সাধিত হয়।
প্রয়োজনে হস্তক্ষেপবাদ/উপলক্ষবাদ
গুঁয়েলি ও মালেব্রাঞ্চ প্রয়োজনে হস্তক্ষেপবাদের প্রবর্তক।
এই মতানুসারে, দেহ ও মন সম্পূর্ণ ভিন্ন হওয়ায় তাদের মধ্যে কোনো ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া হতে
পারে না। যখনই দেহ বা মনে পরিবর্তন দেখা যায়, তখনই মন বা দেহে অনুরূপ পরিবর্তন সাধনের জন্য স্রষ্টার হস্তক্ষেপের প্রয়োজন দেখা দেয়। হস্তক্ষেপের প্রয়োজন দেখা দিলেই স্রষ্টা
মানসিক পরিবর্তনের অনুরূপ দৈহিক পরিবর্তন বা দৈহিক পরিবর্তনের অনুরূপ মানসিক
পরিবর্তন সাধন করেন। সুতরাং প্রয়োজন অনুসারে স্রষ্টার হস্তক্ষেপের ফলেই দৈহিক ও
মানসিক প্রক্রিয়ার নিবিড় সম্পর্ক দেখতে পাওয়া যায়।
সমান্তরালবাদ
এ মতবাদ অনুসারে, দেহ ও মন দুটি পৃথক সত্তা হলেও তারা সমান্তরালভাবে উভয়েই সক্রিয়।
তাদের মধ্যে কোনোরূপ কার্যকারণ সম্পর্ক নেই। দেহ ও মন একে অপরের উপর প্রভাব
বিস্তার করে না। তবে কোনো মানসিক ক্রিয়া সংঘটিত হলে তার অনুষঙ্গী হিসেবে দৈহিক
ক্রিয়াও ঘটে থাকে। এ মতবাদ অনুসারে, দুটি সমান্তরাল সরলরেখার ন্যায় দেহ ও মন
পরস্পর সমান দ রত্বে থেকে সমান গতিতে পরিবর্তিত হতে পারে।
দার্শনিক স্পিনোজা ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়াবাদ ও উপলক্ষবাদের দোষ-ত্রæটি দ র করার জন্য
সমান্তরালবাদ প্রবর্তন করেন। এ মতানুসারে, দেহ ও মন দুটি স্বতন্ত্র দ্রব্য নয়, এরা একই
দ্রব্যকে বোঝার দুটি ভিন্ন উপায়, একই দ্রব্যের দুটি ভিন্নপ্রকাশ। স্রষ্টা একমাত্র দ্রব্য। তিনি
অনন্ত গুণসম্পন্ন। এই অনন্ত গুণের মধ্যে মানুষের মন মাত্র দুটিকে জানতে পারে, একটি দেহ
বা বিস্তৃতি, অপরটি মন বা চিন্তন। এই দুটি গুণের মধ্যে কোনো সাধারণ লক্ষণ নেই। যদিও
এ দুটি গুণ একই দ্রব্যের, তবুও এদের মধ্যে পারস্পরিক প্রভাব নেই। কারণ চৈতন্য জড়ের
উপর এবং জড় চৈতন্যের উপর কোনো প্রভাব বিস্তার করতে পারে না।
উপবস্তুবাদ
জড়বাদীদের মধ্যে বিশেষ এক গোষ্ঠী এই মতবাদের সমর্থক। এই জড়বাদী দার্শনিকবৃন্দ
মনকে দেহ থেকে পৃথক বলে মনে করেন এবং দেহ ও মনের মধ্যে কার্যকারণ সম্পর্ক আছে
বলে মনে করেন। কিন্তু তাদের মতে, এই কার্যকারণ সম্পর্ক একাভিমুখী। তাদের মতে, মন
বা চৈতন্য মস্তিষ্কের ক্রিয়ার পরিণতি, যেহেতু দেহই মনের কারণ । কিন্তু মানসিক প্রক্রিয়া
মস্তিষ্কের প্রক্রিয়া অর্থাৎ দৈহিক প্রক্রিয়া উৎপন্ন করতে পারে না।
এসব জড়বাদীদের মতে, জড়ই হলো পরমতত্ত¡। তাদের মতে, জড়ের যেমন সত্তা আছে, মনের
তেমন কোনো বস্তুসত্তা নেই। তাদের মতে, মন বা চৈতন্য হলো উপবস্তু, জড়ই হলো প্রকৃত
বস্তু। মন বা চৈতন্য মস্তিষ্কের ক্রিয়াকে প্রভাবিত করে না, মন হলো কয়েক ধরনের মস্তিষ্কের
ক্রিয়ার এক ধরনের নিষ্ক্রিয় সহগামী। মন বা চৈতন্য হলো, শরীরের বা মস্তিষ্কের ক্রিয়ার ছায়া।
মানুষকে বাদ দিয়ে যেমন মানুষের ছায়ার কোনো নিজস্ব সত্তা নেই, মানুষের জন্যই মানুষের
ছায়া, তেমনি মস্তিষ্কের ক্রিয়ার জন্যই মন বা চৈতন্যের অস্তিত্ব। মানুষের গতিই ছায়ার গতির
কারণ, ছায়ার গতি মানুষের গতির কারণ হতে পারে না।
উন্মেষবাদ
এই মতবাদীরা দেহ ও মনকে সম্পূর্ণ বিপরীত বলে মনে করেন না। উন্মেষবাদীদের মতে,
অভিব্যক্তি (বাড়ষঁঃরড়হ) প্রক্রিয়ায় দেহ থেকে প্রাণ, আর প্রাণ থেকে মনের উদ্ভব হয়।
হাইড্রোজেন আর অক্সিজেন মিলিয়ে যে পানি হয় তার পিপাসা মিটানোর ক্ষমতা থাকে। এই
ক্ষমতা হাইড্রোজেন বা অক্সিজেন কারো নেই। তেমনি দেহ থেকেই প্রাণ, আর প্রাণ থেকেই মন। কিন্তু প্রাণের স্তরে ‘জীবন’ আর মনের স্তরে ‘চৈতন্য’ বলে এমন দুটি গুণ উন্মেষিত হয় যা
যথাক্রমে দেহ ও প্রাণের থাকে না। দেহ থেকেই প্রাণ আর প্রাণ থেকেই চৈতন্যের উন্মেষ
হয়েছে বলে দেহের সঙ্গে মনের সম্পর্ক অত্যন্ত নিবিড়।
পূর্ব-প্রতিষ্ঠিত শৃঙ্খলাবাদ
এই মতবাদের প্রবক্তা হলেন জার্মান দার্শনিক লাইবনিজ। তাঁর মতে, দেহ ও মন উভয়ই
চিৎপরমাণু বা মনাড -এর সৃষ্টি। পূর্ব-প্রতিষ্ঠিত শৃঙ্খলাবাদ অনুযায়ী, সৃষ্টির সময়ে
মনাডের মনাড তথা স্রষ্টা দেহ ও মনের মনাডের মধ্যে এমন এক শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠিত করেছেন
যে, কোনো রকম মানসিক বা দৈহিক পরিবর্তন ঘটলে অনুরূপ দৈহিক বা মানসিক পরিবর্তন স্বতঃস্ফূর্তভাবেই ঘটে।
উপলক্ষবাদ অনুসারে, যখন দেহের কোনো পরিবর্তন ঘটে তখন মনে এবং মনে যখন কোনো
পরিবর্তন ঘটে তখন দেহে অনুরূপ পরিবর্তন স্রষ্টা সংঘটিত করেন। কিন্তু লাইবনিজের পূর্ব-
প্রতিষ্ঠিত শৃঙ্খলাবাদ অনুসারে, স্রষ্টার অবিরত হস্তক্ষেপের কোনো প্রয়োজন নেই। দেহ ও
মনকে দুটি ঘড়ির সাথে তুলনা করা যেতে পারে। ঘড়ি দুটি তৈরী হবার সময় এদের কাঁটাগুলো
এমনভাবে মিলিয়ে দেয়া হয়েছে যে, পারস্পরিক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া ছাড়াও উভয়ের কাঁটা সর্বদা
একই সময় নির্দেশ করে। অনুরূপভাবে, দৈহিক প্রক্রিয়া ও মানসিক প্রক্রিয়া পরস্পরের উপর কোনো প্রভাব বিস্তার না করেও সঙ্গতি রক্ষা করে চলেছে।
রচনামূলক প্রশ্ন
১। দেহ ও মনের সম্বন্ধ সম্পর্কীয় মতবাদ হিসেবে ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়াবাদ ও সমান্তরালবাদ ব্যাখ্যা করুন।
সংক্ষিপ্ত উত্তরমূলক প্রশ্ন
১। দেহ ও মনের সম্বন্ধ সম্পর্কীয় মতবাদ হিসেবে উপলক্ষবাদ ব্যাখ্যা করুন।
২। দেহ ও মনের সম্বন্ধ সম্পর্কীয় মতবাদ হিসেবে উন্মেষবাদ ব্যাখ্যা করুন।
ক) বহু নির্বাচনী প্রশ্ন
সঠিক উত্তর লিখুন
১। ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়াবাদের প্রবক্তা
র) লক
রর) বার্কলি
ররর) হিউম
রা) ডেকার্ট
২। ‘‘যখনই মন বা দেহে পরিবর্তন দেখা
দেয় তখনই অনুরূপ পরিবর্তনের জন্য
স্রষ্টার হস্তক্ষেপের প্রয়োজন হয়’’- এটি
কোন্ োমতবাদের মূল বক্তব্য
র) ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়াবাদ
রর) উপলক্ষবাদ
ররর) সমান্তরালবাদ
রা) উন্মেষবাদ
৩। সমান্তরালবাদের মূল বক্তব্য হলো
র) দেহ ও মনের মধ্যে কার্যকারণ সম্পর্ক
বর্তমান
রর) প্রয়োজনে স্রষ্টা হস্তক্ষেপ করেন
ররর) কোনো মানসিক ক্রিয়া সংঘটিত হলে তার
অনুষঙ্গী হিসেবে দৈহিক ক্রিয়াও ঘটে
রা) মন বা চৈতন্য মস্তিষ্কের ক্রিয়ার
পরিণতি
৪। লাইবনিজ কোন্ মতবাদের প্রবক্তা
র) ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়াবাদ
রর) সমান্তরালবাদ
ররর) উন্মেষবাদ
রা) পূর্ব-প্রতিষ্ঠিত শৃঙ্খলাবাদ
খ) সত্য হলে ‘স’ এবং মিথ্যা হলে ‘মি’ লিখুন।
১। ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়াবাদের মূল বক্তব্য হলো, ‘‘দুটি ঘড়ি যেমন পারস্পরিক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া
ছাড়াও সর্বদা একই সময় নির্দেশ করে, তেমনি দেহ ও মন পরস্পরের উপর প্রভাব বিস্তার না করেও সঙ্গতি রক্ষা করে চলে।’’
২। সমান্তরালবাদের প্রবক্তা মিল।
৩। উন্মেষবাদ অনুসারে দেহ থেকে প্রাণ, আর প্রাণ থেকে মনের উদ্ভব হয়েছে বলে এদের
সম্পর্ক অত্যন্ত নিবিড়।
৪। উপবস্তুবাদ অনুসারে, স্রষ্টার হস্তক্ষেপেই দেহ ও মনের পরিবর্তন ঘটে।
সঠিক উত্তর
ক)
১। রা) ডেকার্ট ২। রর) উপলক্ষবাদ ৩। ররর) কোনো মানসিক ক্রিয়া সংঘটিত হলে
তার অনুষঙ্গী হিসেবে দৈহিক ক্রিয়াও ঘটে ৪। রা) পূর্ব-প্রতিষ্ঠিত শৃঙ্খলাবাদ
খ) ১। মি ২। মি ৩। স ৪। মি

FOR MORE CLICK HERE
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস মাদার্স পাবলিকেশন্স
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস ১ম পর্ব
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস
আমেরিকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস
বাংলাদেশের ইতিহাস মধ্যযুগ
ভারতে মুসলমানদের ইতিহাস
মুঘল রাজবংশের ইতিহাস
সমাজবিজ্ঞান পরিচিতি
ভূগোল ও পরিবেশ পরিচিতি
অনার্স রাষ্ট্রবিজ্ঞান প্রথম বর্ষ
পৌরনীতি ও সুশাসন
অর্থনীতি
অনার্স ইসলামিক স্টাডিজ প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত
অনার্স দর্শন পরিচিতি প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত

Copyright © Quality Can Do Soft.
Designed and developed by Sohel Rana, Assistant Professor, Kumudini Government College, Tangail. Email: [email protected]