পূর্ববর্তী পাঠ-এর আলোচনায় মূল্যের স্বরূপবস্তুনির্ভর না ব্যক্তিনির্ভর তা নিয়ে আলোচনা করা
হয়েছে এবং আমরা দেখেছি, এই বিষয়ে দুটি ভিন্ন মতের উদ্ভব হয়েছে। উল্লিখিত মত দুটোর
মধ্যে মূল্যের স্বরূপ সম্পর্কীয় কোন্ োমতটি গ্রহণযোগ্য তা প্রশ্নসাপেক্ষ। তবে একচেটিয়াভাবে
একথা বলা যুক্তিসঙ্গত নয় যে, মূল্য কেবল বস্তুনির্ভর বা কেবল ব্যক্তিনির্ভর। এই অংশে আমরা
বিষয়টিকে ঘিরে বিস্তারিত আলোচনা করবো।
মূল্য বস্তুগত : সমালোচনা
এই মতানুসারে মূল্য বস্তুর মধ্যেই নিহিত আছে এবং মানুষের মূল্য নির্ধারণ বস্তটির দ্বারাই হয়ে
থাকে। মূল্য কখনই বস্তুনিরপেক্ষ নয়। যেমন, আমরা যখন বলি ‘পাখিটি কি সুন্দর’ বা
‘অমুকের কাজটি ভাল’ তখন এই মূল্য নির্ধারণ আমাদের খেয়াল-খূশির উপর নির্ভর করে না।
পাখির মধ্যে এমন কিছু আছে যার জন্য আমরা পাখিটিকে সুন্দর বলতে বাধ্য হই এবং কোনো
ব্যক্তির কাজের মধ্যে এমন কোনো গুণ নিহিত আছে যার কারণে তার কাজকে আমরা ভাল
বলে থাকি। সুতরাং মূল্য ব্যক্তি সাপেক্ষ ব্যাপার নয়। যদিও মূল্য বিচারের জন্য ব্যক্তির
প্রয়োজন, তবুও ব্যক্তির প্রশংসা বা নিন্দা যা একটি বিশেষ মনোভাব প্রকাশ করে, তা বাস্তব
পরিস্থিতির দ্বারাই নির্ধারিত হয়। তাই মূল্য বস্তুগত।
এই মতবাদের কিছু দোষ-ত্রæটি পরিলক্ষিত হয়। আমরা মনে করি, কেউ প্রত্যক্ষ করুক বা নাই
করুক ঘর-বাড়ী, পাহাড়-পর্বত এগুলো অস্তিত্বশীল থাকবেই। মূল্যের ক্ষেত্রে অনুরূপ সিদ্ধান্ত
সঠিক নয়, কেননা পাহাড়-পর্বতের মত মূল্য কোনো বস্তু নয়। যে মূল্য মানুষের কাম্য, সেই
মূল্য মননিরপেক্ষ হতে পারে না।
তাছাড়া, উক্ত বস্তুগত মতের বিরুদ্ধে আরও বলা যায়, মূল্য যদি বস্তুগত হয় তাহলে মূল্য
নির্ধারণে ব্যক্তিতে ব্যক্তিতে এত পার্থক্য দেখা যায় কেন? যেমন- কোনো ধনী ব্যক্তির কাছে
৫০০ টাকার যে মূল্য, দিনমজুরের কাছে তার মূল্য ভিন্ন হওয়াই স্বাভাবিক। তাই বলা যায়,
মূল্য যদি বস্তুনির্ভরই হতো তাহলে কোনো কিছুর সৌন্দর্য বা কোন কাজের গুণাগুণ বিচারের
ক্ষেত্রে সকলেই ঐক্যমতে পৌঁঁছাতো। কিন্তু তা প্রায় ক্ষেত্রেই সম্ভব হয় না।
মূল্য আত্মগত : সমালোচনা
এই মতবাদ অনুসারে, মূল্য সম্পূর্ণভাবে ব্যক্তির উপর নির্ভর করে। কেবলমাত্র ব্যক্তির
অনুভ‚তি, ইচ্ছা ও চিন্তার জগতেই মূল্যের আবির্ভাব ঘটা সম্ভব। মূল্য যেহেতু ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বস্তু
তাই সৌন্দর্য, ভালত্ব, মন্দত্ব এগুলো মানব জীবনের সাথে সম্পর্কযুক্ত না হলে তা অর্থহীন হয়ে
পড়ে। মূল্য যেহেতু ব্যক্তির অনুভ‚তি, ইচ্ছা ও চিন্তা থেকে সৃষ্টি হয় এবং এগুলো বস্তু নিরপেক্ষ
ও পরিবর্তনশীল, তাই মূল্যও ব্যক্তিভেদে পরিবর্তিত হয় এবং একই ব্যক্তির কাছেও সময়ভেদে
তা ভিন্ন ভিন্ন হতে পারে। যেমন, একজন কিশোর খেলাধুলা এবং বিশেষ কিছু কাজে বয়সের
কারণে আনন্দ পেতে পারে, কিন্তু তা একটি নির্দিষ্ট বয়সে সময়ের অপচয় বা অর্থহীন কাজ
বলে মনে হতে পারে। তাই মূল্য নিছক মনোগত একটি ব্যাপার। দার্শনিক লোট্জা
(খড়ঃুধ)‘র মতে, মূল্য হলো সন্তোষের অনুভ‚তি বা একটি বস্তু থেকে আমাদের মনে যে
আনন্দের উদ্ভব হয় সেটাই মূল্য। যেহেতু সন্তোষ বা পরিতৃপ্তি ব্যক্তি মনের অনুভ‚তির ব্যাপার,
সেজন্য মূল্য সম্পূর্ণভাবে বস্তুনিরপেক্ষ।
উক্ত মতবাদেরও বেশ কিছু দোষ-ত্রæটি পরিলক্ষিত হয়। কেউ দেখুক বা না দেখুক, একটি
ফুলের যে সৌন্দর্য তা থাকবেই। কোনো ব্যক্তি লোক চক্ষুর অন্তরালে হয়তো এমন অনেক
কাজ করেন যা জনসমক্ষে এবং সমাজে প্রশংসা পাবার যোগ্য। কিন্তু অনেক সময় তা প্রকাশিত
হয় না। তাই বলে কি সেসব ভালো কাজের কোন মূল্য নেই? অবশ্যই আছে। তাই মূল্য
মনোগত নয়, বস্তুগত।
আবার মূল্য যদি হয় বস্তুর গুণের বিচার তাহলে বস্তু হলো গুণের সমষ্টি একথা স্বীকার করতে
হয়। মানুষ বস্তুর গুণগুলোকে প্রত্যক্ষ করে তার বিচার করে। বস্তুর গুণ যদি মানুষ প্রত্যক্ষ
করতে না পারতো তাহলে মূল্য বিচার করাও সম্ভব হতো না। যেমন, কোনো লাল গোলাপকে
কেউ কালো বা সাদা গোলাপ বলতে পারে না। কারণ ঐ গোলাপটি লাল রঙ ধারণ করে
আছে। তাই মূল্য মনোগত নয়। তাছাড়া, উক্ত মতটি ব্যক্তিমনকে অস্তিত্বশীল জগৎ থেকে
পৃথক করে দেখে। কিন্তু ব্যক্তিমন ও অস্তিত্বশীল জগৎ এই নিয়ে এক অখন্ড সত্তা বা
সুসামঞ্জস্যপূর্ণ সমগ্রতা, সেই কারণে ব্যক্তিমনকে অস্তিত্বশীল জগৎ থেকে পৃথক করে দেখা
যুক্তিযুক্ত নয়। কারণ বস্তুই যদি না থাকে তবে কিসের মূল্য বিচার করা হবে, সে প্রশ্নটি এসে
যায়।
উক্ত মতের আরেকটি ত্রæটি হলো, এই মতের অনুসারীরা অনুভ‚তি, ইচ্ছা, কামনা-বাসনাকে
মূল্যের উৎস মনে করে। কিন্তু তা ঠিক নয়, কারণ কামনা, বাসনা, অনুভ‚তি বস্তুর দ্বারাই
নির্ধারিত হয় এবং তারা মূল্যের ফলস্বরূপ। যেমন, বহুদিন ধরে সুসম্পর্ক নেই এরকম কোনো
দম্পত্তি যদি কোনো রোমান্টিক যাত্রানুষ্ঠান একই সাথে উপভোগ করে তাহলে তাদের মধ্যে
পুনরায় ভালোবাসার অনুভ‚তি জন্মাতে পারে। তাই মূল্যকে কেবল মনোগত বলা চলে না।
মূল্য আত্মগত ও বস্তুগত উভয়ই (ঠধষঁব ধং ঝঁনলবপঃরাব-ঙনলবপঃরাব)
উপরোক্ত দুটি মতবাদই চরমপন্থী। আত্মগত মতবাদীরা শুধুমাত্র ব্যক্তিমনকে প্রাধান্য দেয়;
যেমন, আমি বলছি তাই গোলাপ লাল। আবার বস্তুগত মতবাদ শুধুমাত্র বস্তুর গুণকে প্রাধান্য
দেয়; যেমন, গোলাপ লাল বলেই গোলাপটিকে আমার লাল বলতে হচ্ছে। এ দুটি মতবাদই
চরমপন্থী। মূল্যের অবস্থান শুধুমাত্র বস্তুতে নয়, আবার শুধুমাত্র মনে নয়। আমরা এই দুই
চরম মতবাদের সমন্বয় সাধন করে বলতে পারি যে, মূল্য বস্তুগত ও আত্মগত উভয়ই। যে
কোনো মূল্যের ই দুটি দিক আছে, তাহলো মূল্য নির্ধারণের কর্তা এবং যে বিষয়ের মূল্য
নির্ধারণ করা হয় তার অস্তিত্ব। এই দুয়ের মধ্যে যখনই সমন্বয় ঘটবে কেবল তখনই মূল্য
নির্ধারিত হতে পারে। এদের কোনো একটিকে বাদ দিয়ে মূল্য বিচার সম্ভব নয়। যেমনতাজমহলের সৌন্দর্য যদি বিশ্বের মানুষ কখনই অবলোকন না করতো তাহলে তার বর্তমান
মূল্য অনুধাবন করা সম্ভব হতো না। আবার আদৌ যদি তাজমহলো না থাকতো তাহলে তার
মূল্য নির্ধারণেরও প্রশ্নই উঠতো না। আসলে মূল্য বস্তুর গুণ, যেটি ব্যক্তির অনুভ‚তি, ইচ্ছা ও
চিন্তনের দ্বারা নির্ধারিত হয়। মূল্য সম্পূর্ণভাবে মনের সৃষ্টি নয়। আবার ব্যক্তিমনের উপলব্ধি ও
অনুভ‚তিকে বাদ দিলে মূল্য বিচার হয়ে উঠে অর্থহীন ব্যাপার।
আমরা আগেই দেখেছি, দার্শনিক আলেকজান্ডার (অষবীধহফবৎ)-এর মতে, মূল্য আত্মগত ও
বস্তুগত উভয়ই। মূল্য বস্তুনিরপেক্ষ বা আত্মগত এই কারণে যে, ব্যক্তিমনই মূল্য নির্ধারণ করে
থাকে। আবার মূল্য বস্তুগত এই কারণে যে, কোনো বস্তুর সেই গুণ বা মূল্য থাকে বলেই
আমরা বস্তুটির সেভাবে গুণ বিচার করতে পারি।
কোনো বিষয়ের মূল্য মানুষের কামনা-বাসনার দ্বারা নির্ধারিত হয়, কিন্তু মানুষ কোন বস্তুকে
কাম্য বা কাম্য নয় মনে করে কিনা তা নির্ভর করে সেই বস্তুর গুণের উপর। যেখানে ব্যক্তি-
মনের অস্তিত্ব নেই, সেখানে মূল্য বাস্তবরূপে নয়, সম্ভাবনারূপে বিদ্যমান থাকবে। কোনো
বিষয়ের জ্ঞান হতে হলে যেমন জ্ঞাতা ও জ্ঞেয় উভয়েরই প্রয়োজন, তেমনি বস্তুর মূল্য বিচারের
ক্ষেত্রেও বিচার্য বস্তু এবং মূল্যায়নকারী ব্যক্তি বা ব্যক্তিমনের উপস্থিতি আবশ্যক। তাই বলা
যায়, মূল্য আত্মগত ও বস্তুগত উভয়ই।
রচনামূলক প্রশ্ন
১। মূল্য কি? “মূল্য বস্তুগত ও আত্মগত উভয়ই”- এই বিষয়টির বিস্তারিত ব্যাখ্যা দিন।
সংক্ষিপ্ত উত্তরমূলক প্রশ্ন
১। “মূল্য শুধুই বস্তুগত”- এই মতের বিপক্ষে সংক্ষিপ্ত আলোচনা করুন।
২। “ মূল্য শুধুই আত্মগত”- এর বিরুদ্ধে যুক্তি দেখান।
ক) বহু নির্বাচনী প্রশ্ন
সঠিক উত্তর লিখুন।
১। নিচের কোনো বাক্যটি সঠিক নয়
র) বস্তুর স্বরূপ পরিবর্তিত হলে মূল্য পরিবর্তিত হয়
রর) ব্যক্তির মূল্যায়ভেদে বস্তুর মূল্য পরিবর্তিত হয়
ররর) ব্যক্তির মূল্যায়ন এবং বস্তুর স্বরূপ উভয়ের পরিবর্তনে বস্তুর মূল্য পরিবর্তিত হয়
রা) বস্তুর মূল্য সব সময় অপরিবর্তিত থাকে
২। বস্তুর মূল্য নির্ধারণের জন্য গুরুত্বপূর্ণ হলো
র) বস্তুর নিজস্ব বৈশিষ্ট্য
রর) বস্তুর চাহিদা
ররর) বস্তুর পারিপার্শি¦ক অবস্থা
রা) উপরের সবগুলোই
৩। স্বর্ণ মূল্যবান কারণ
র) স্বর্ণের মূল্যবান হবার যোগ্যতা আছে
রর) স্বর্ণ মূল্যবান হিসেবে সবার কাছে স্বীকৃত
ররর) স্বর্ণকে মানুষ মূল্যবান বলে মনে করে
রা) স্বর্ণের মূল্যবান হবার মত গুণগত বৈশিষ্ট্য এবং মানুষের কাছে সেরকম গ্রহণযোগ্যতা
আছে
৪। মূল্যের ব্যাপারটি
র) পুরোপুরিভাবে ব্যক্তিগত
রর) সম্পূর্ণভাবে বস্তুনির্ভর
ররর) সম্পূর্ণ দৈব নির্ধারিত
রা) ব্যক্তিনির্ভর ও বস্তুগত উভয়ই
সঠিক উত্তর
ক)
১। রা) বস্তুর মূল্য সব সময় অপরিবর্তিত থাকে
২। রা) উপরের সবগুলোই
৩। রা) স্বর্ণের মূল্যবান হবার মত গুণগত বৈশিষ্ট্য এবং মানুষের কাছে সেরকম গ্রহণযোগ্যতা
আছে
৪। ব্যক্তিনির্ভর ও বস্তুগত উভয়ই
FOR MORE CLICK HERE
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস মাদার্স পাবলিকেশন্স
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস ১ম পর্ব
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস
আমেরিকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস
বাংলাদেশের ইতিহাস মধ্যযুগ
ভারতে মুসলমানদের ইতিহাস
মুঘল রাজবংশের ইতিহাস
সমাজবিজ্ঞান পরিচিতি
ভূগোল ও পরিবেশ পরিচিতি
অনার্স রাষ্ট্রবিজ্ঞান প্রথম বর্ষ
পৌরনীতি ও সুশাসন
অর্থনীতি
অনার্স ইসলামিক স্টাডিজ প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত
অনার্স দর্শন পরিচিতি প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত