মূল্য ও সত্তার তুলনামূলক আলোচনা করুন। এ প্রসঙ্গে হেগেলের মত ব্যাখ্যা করুন।

মূল্যের সাথে সত্তার সম্পর্ক নিয়ে দার্শনিকদের মধ্যে মতভেদ রয়েছে। কারো কারো বক্তব্য
থেকে প্রতীয়মান হয়েছে যে মূল্য সত্তানির্ভর, আবার কারো কারো মতে, সত্তা মূল্য নির্ভর।
আমরা এবার বিভিন্ন দার্শনিকের অভিমতগুলো আলোচনার মাধ্যমে মূল্য ও সত্তার সম্পর্ক
নিরূপণ করার চেষ্টা করবো।
মূল্য ও সত্তা : জড়বাদী মত
জড়বাদী দার্শনিকরা পরম তত্তে¡র সাথে মূল্যের সম্পর্ক সম্পূর্ণরূপে অস্বীকার করেন। তাদের
মতে, পরমাণুই এই জগতের মূল এবং জড়শক্তির দ্বারাই এই জগৎ নিয়ন্ত্রিত হয়। জগতের
সৃষ্টি, স্থিতি ও ধ্বংস যান্ত্রিকভাবে ঘটে থাকে। এজন্য কোনো সচেতন সত্তার হস্তক্ষেপের
প্রয়োজন হয় না।
পরমতত্ত¡ ও মূল্য সম্পর্কে জড়বাদী মতের সমালোচনায় বলা যায় যে, এটি একটি ত্রæটিপূর্ণ
মতবাদ, তাই এটি সর্বজনগ্রাহ্য নয়। জড়ের পক্ষে জগতের শৃংখলা, সুনির্দিষ্টতা , সামঞ্জস্য ও
ঐক্যের কোন ব্যাখ্যা দেয়া সম্ভব নয়। চূড়ান্ত পর্যবেক্ষণে মূল্যকে যেখানে বস্তুগত ও মনোগত
বলে স্বীকার করা হয়, সেখানে জড়বাদীদের মতে সত্য, সুন্দর ও মঙ্গলের আদর্শ শুধুমাত্র
মনোগত।
মূল্য সত্তার চেয়ে উচ্চতর
অনেক দার্শনিকেরই ধারণা, মূল্য কোনো উচ্চতর উৎস থেকে আসে। যেমন- ঈশ্বর, পরম শুভ,
মঙ্গল ইত্যাদি। দার্শনিক প্লেটো এই মতবাদের অন্যতম প্রবক্তা। প্লেটো জগতকে দুটি ভাগে
ভাগ করেছেন: অতীন্দ্রিয় জগৎ ও দৃশ্যমান জগৎ। অতীন্দ্রিয় জগৎ মূলত ধারণার জগত
(ডড়ৎষফ ড়ভ ওফবধং), দৃশ্যমান জগৎ ধারণারই ছায়ামাত্র। প্লেটোর মতে, ধারণাগুলোর মধ্যে
মঙ্গলের ধারণা (ঞযব রফবধ ড়ভ এড়ড়ফ) সবচেয়ে উচ্চ স্তরের। মঙ্গল হলো কৃতির আদর্শ।
কাজেই প্লেটোর দর্শনে আদর্শ বা মূল্যকে সত্তার চেয়ে উচ্চতর বলা হয়েছে। সমসাময়িক
দার্শনিক রিকার্ট(জরপশবৎঃ)-ও প্লেটোর এই মতটিকে সমর্থন করেন। তাঁর মতে, মূল্য আদর্শ
হিসেবে সত্তার চেয়ে উচ্চতর ও মহত্তর এবং সত্তার চেয়ে মূল্য বড়। মূল্য উচ্চতর উৎস থেকে
আসে-একথার অর্থই হলো, মূল্য একটি ব্যক্তিনিরপেক্ষ ব্যাপার। অর্থাৎ যদি পৃথিবীতে কোনো
মানুষ বা প্রাণী নাও থাকে তবুও মূল্যের অস্তিত্ব থাকবে। সত্তার অস্তিত্ব মূল্যের ওপর নির্ভর
করে আছে।
প্লেটোকে অনুসরণ করে হার্টম্যান (ঐধৎঃসধহ)-ও বলেন, মূল্যের কেবলমাত্র আদর্শগত
অস্তিত্ব আছে। আদর্শের পরিপ্রেক্ষিতে যাবতীয় পার্থিব বস্তুর মূল্যায়ন সম্ভব। মূল্যের
অভিজ্ঞতাপূর্ব বস্তুগত সত্তা আছে এবং তারা বাস্তব জগতের অতীত। মূল্যের কোনো সংবেদন
লাভ সম্ভব নয়, কেননা কেবলমাত্র আদর্শিক হিসেবে এর আর্বিভাব।
উপর্যুক্ত মতের সমালোচনায় বলা যায়, মূল্যের বা আদর্শের কোনো অস্তিত্ব সম্ভব নয়, যদি না
তা ব্যক্তিমনের সাথে সংযুক্ত থাকে। আদর্শের প্রকাশ কেবলমাত্র বাস্তবের মধ্যে দিয়ে সম্ভব,
কাজেই আদর্শের স্থান বাস্তবের উপরে একথা বলা অর্থহীন। মানুষ তার চেতনার বিকাশের
মাধ্যমে সত্য, সুন্দর ও মঙ্গলের আদর্শকে উপলব্ধি করতে সচেষ্ট হয়। আদর্শ বা মূল্য
একেবারে বাইরে থেকে সত্তা বা তত্ত¡কে নিয়ন্ত্রিত করবে, একথা ভাবা যায় না। যে মূল্য
মানুষের বুদ্ধিগ্রাহ্য নয় তা অযৌক্তিক ও অসমর্থনীয়। এ প্রসঙ্গে আরও বলা যায়, প্লেটোর
ধারণা কিছুটা বুদ্ধিগ্রাহ্য হলেও রিকার্টের মূল্য প্রকৃতপক্ষে অবাস্তব এবং দর্শন শা¯ে র কোনো
নীতি দিয়ে তা ব্যাখ্যাত নয়, বরং দুর্বোধ্যতার অভিযোগে অভিযুক্ত। কেননা আমরা যাকে মূল্য
হিসেবে অভিহিত করি তা আমাদের আশা-আকাক্সক্ষার সাথে সম্পৃক্ত না হলে এবং জ্ঞানবুদ্ধির
অতীত হলে, সেগুলো মূল্য হিসেবে দাবি করতে পারে না। আবার প্লেটোর বাস্তববিবর্জিত ও কল্পনাপ্রসূত ধারণাগুলোর ন্যায় হার্টম্যানের মূল্যগুলোও কিভাবে আদর্শরূপে কাজ করতে পারে, তা বুদ্ধির দ্বারা নির্ণয় করা সহজ নয়। মূল্য সত্তার উপর নির্ভরশীল
কতিপয় পাশ্চাত্য দার্শনিক স্পিনোজা , ব্রাডলি ও বোসাঙ্কয়েট
এবং ভারতীয় দার্শনিক শংকরের মতাদর্শ অনুযায়ী, পরম সত্তা বা পরমতত্ত¡
মূল্যের চেয়ে উচ্চতর স্থানে আসীন। ব্যক্তি যদিও সত্য, সুন্দর ও মঙ্গলকে তাৎপর্যমন্ডিত ও
গুরুত্বপূর্ণ মনে করে তথাপিও পরম সত্তার কাছে এগুলো একেবারে গুরুত্বহীন।
ব্রাডলির মতে,পরম সত্তা সর্বদা সমস্ত মানবিক মূল্যেও উপরেও অবস্থান করে। আবার
স্পিনোজা বলেন, এক পরম সত্তার কাছে জাগতিক বিষয়ের মূল্যায়ন নিতান্তই অর্থহীন একটি
ব্যাপার। ব্রাডলি আরও বলেন, পরম সত্তার মধ্যে কোনো আত্মবিরোধ নেই, কিন্তু মূল্যবোধ
সম্পর্কিত ধারণা আত্ম-বিরোধে পরিপূর্ণ। ব্রাডলির মতে, মূল্য কল্পনামাত্র নয়, তাই মূল্যকে
অস্তিত্বহীন বলা সঙ্গত নয়। আবার জগতের বিভিন্ন বস্তুর যেমন- বই, খাতা, কলম, গাছ-পালা
ইত্যাদির অবস্থানের মত মূল্যের অস্তিত্বকে স্বীকার করা যায় না। কিন্তু ব্রাডলির মতে, মূল্য
অস্তিত্বশীল ও অস্তিত্বহীন এটা হয় না। কারণ একই সঙ্গে আছে এবং নেই- এটা বিরোধপূর্ণ।
কাজেই মূল্যের তাত্তি¡ক সত্তা স্বীকার করা যায় না। তাঁর মতে, মূল্য আভাস মাত্র। কাজেই
বলা যায়, সত্তার আসন মূল্যের আসনের চেয়ে অনেক উপরে।
আবার পারমার্থিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে ভারতীয় দার্শনিক শংকর সত্য, সুন্দর ও মঙ্গলের সত্যতা
অস্বীকার করেন, তবে তাদের ব্যবহারিক সত্যতা আছে। তাঁর মতে, সত্য, সুন্দর ও মঙ্গলের
প্রকৃত অর্থে কোনো বাস্তবতা নেই বরং এগুলো অলীক, মায়া ও ভ্রান্ত। পরম তত্তে¡র মধ্যে কোনো ভেদ নেই, তা ভেদের অতীত। পরম সত্তা এক সামগ্রিক ঐক্য। সত্তা হিসেবে তিনি নির্বিকার, নির্বিশেষ ও নির্গুণ।
উপর্যুক্ত মতটির সমালোচনায় বলা যায়, মানুষ নৈতিক ও আধ্যাত্মিক চেতনাসম্পন্ন জীব।
নৈতিক ও আধ্যাত্মিক চেতনাকে প্রতিষ্ঠিত করতে হলে আমদের এই মতবাদটি বর্জন করতে
হয়। কেননা যে সত্তায় সত্য, সুন্দর ও মঙ্গলের স্থান নেই তার বাস্তব অস্তিত্ব নেই- এ কথা
অনস্বীকার্য। এ ধরনের পরম সত্তার ধারণার অর্থই কল্পনার সাগরে অবগাহন করা যা বাস্তবতার সাথে সঙ্গতিহীনও বটে।
মূল্য ও সত্তা : দার্শনিক হেগেলের মত
সত্তা ও মূল্যের বিষয়ে দার্শনিক হেগেলের মত প্রণিধানযোগ্য। তাঁর মতে, পরম সত্তা এক
প র্ণসত্তা। জীবন ও জগতের সব কিছুই পরম সত্তায় বিধৃত। মূল্য শুধু মনের উপর নির্ভর করে
না। এগুলোর বস্তগত সত্যতাও আছে। তিনি বলেন, মানুষের কাছে উচ্চতর আদর্শগুলো,
যেমন- সত্য, সুন্দর, মঙ্গল কখনো বাস্তবে রূপায়িত হয় না। তবে মানুষ এসব আদর্শ
নিজেদের জীবনে সার্থক করে তুলতে অভিপ্রায় প্রকাশ করে। কিন্তু অসীম গন্ডী ও অসীম
ক্ষমতার অভাবে মানুষ তা কখনই পুরোপুরিভাবে সার্থক করে তুলতে পারে না। সত্য, সুন্দর,
মঙ্গল- মানুষের কাছে আদর্শ হলেও এগুলো এক পরম পুরুষ অর্থাৎ ঈশ্বরের মধ্যে বাস্তব রূপ
ধারণ করে। আর সে ঈশ্বরই হলো পরম সত্তা। তাই হেগেলের বক্তব্যকে সমর্থন করে দার্শনিক
ও যুক্তিবিদ রয়েস বলেন, চরম তত্তে¡ই মানুষের সব আদর্শ ও মূল্য পরিপ র্ণতা লাভ করেছে।
উপসংহার
“সত্তা মূল্যনির্ভর না কি মূল্য সত্তানির্ভর ”- এ নিয়ে এ পর্বের আলোচনায় দার্শনিকগণের বিভিন্ন
বিরোধপূর্ণ মতবাদ সম্পর্কে আমরা অবগত হয়েছি। ব্যাপারটি যেন, ঘোড়া আগে না গাড়ি
আগে- তর্কের মত। এর সমাধানও জটিল। এই আলোচনা থেকে এ কথা স্পষ্টতঃ প্রতীয়মান
হয়েছে যে, একটি আদর্শকে পরিপূর্ণভাবে কোনো মানুষের পক্ষে লাভ করা সম্ভব নয়।
পরিপূর্ণভাবে আদর্শ লাভ করার অর্থই হচ্ছে জীবনের গতি শেষ হয়ে যাওয়া এবং স্তব্ধতায়
পর্যবসিত হওয়া। মূলত সত্য, সুন্দর ও মঙ্গল- এই আদর্শসমূহ পরম সত্তার সম্মিলনে বাস্তবতা
লাভ করে এবং এগুলো লাভে পার্থিব মানুষ সর্বদা সচেষ্ট থাকে যা তার জীবনকে সাফল্যমন্ডিত
করতে অগ্রণী ভ‚মিকা পালন করে।
এ পর্বে আলোচিত বিভিন্ন দার্শনিকগণের, বিশেষভাবে হেগেল ও রয়েসের মতের আলোচনা
থেকে আরও সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা যায় যে, মূল্য বা আদর্শ ও সত্তা একে অপরের সাথে
ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কিত। এরা যেন মুদ্রার এপিঠ ও ওপিঠ সম্পর্কে সম্পর্কিত।
রচনামূলক প্রশ্ন
১। মূল্য ও সত্তার তুলনামূলক আলোচনা করুন। এ প্রসঙ্গে হেগেলের মত ব্যাখ্যা করুন।
সংক্ষিপ্ত রচনামূলক প্রশ্ন
১। মূল্য সম্পর্কে প্লেটোর ধারণা সংক্ষেপে ব্যাখ্যা করুন।
২। “মূল্য সত্তার উপর নির্ভরশীল”- বিষয়টি সংক্ষেপে বর্ণনা করুন।
৩। সত্তা ও মূল্য সম্পর্কে হেগেলের ধারণা কেন অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ- এর পক্ষে যুক্তি দেখান।
ক) বহু নির্বাচনী প্রশ্ন
সঠিক উত্তর লিখুন।
১। সত্তা ও মূল্যের ক্ষেত্রে কোনোটি সঠিক
র) সত্তা মূল্যের চেয়ে বড়
রর) মূল্য সত্তার চেয়ে বড়
ররর) মূল্য ও সত্তা সমানে সমান
রা) উপরের সবগুলোই
২। দার্শনিক রিকার্টের মতে
র) সত্তা মূল্য নির্ভর
রর) মূল্য সত্তা নির্ভর
ররর) এরা কেউ কারো উপর নির্ভরশীল নয়
রা) এরা উভয়ে উভয়ের উপর নির্ভরশীল
৩। সত্তা হিসেবে পরমতত্ত¡ নির্বিকার, নির্বিশেষ ও নির্গুণ- উক্তিটি করেন
র) শংকর
রর) ব্রাডলি
ররর) স্পিনোজা
রা) কান্ট
৪। পরমসত্তা এক পরিপূর্ণ সত্তা- বলেন
র) শংকর
রর) কান্ট
ররর) হেগেল
রা) ব্রাডলি
সঠিক উত্তর
ক)
১। রর) মূল্য সত্তার চেয়ে বড়
২। র) সত্তা মূল্য নির্ভর
৩। র) শংকর
৪। ররর) হেগেল

FOR MORE CLICK HERE
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস মাদার্স পাবলিকেশন্স
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস ১ম পর্ব
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস
আমেরিকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস
বাংলাদেশের ইতিহাস মধ্যযুগ
ভারতে মুসলমানদের ইতিহাস
মুঘল রাজবংশের ইতিহাস
সমাজবিজ্ঞান পরিচিতি
ভূগোল ও পরিবেশ পরিচিতি
অনার্স রাষ্ট্রবিজ্ঞান প্রথম বর্ষ
পৌরনীতি ও সুশাসন
অর্থনীতি
অনার্স ইসলামিক স্টাডিজ প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত
অনার্স দর্শন পরিচিতি প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত

Copyright © Quality Can Do Soft.
Designed and developed by Sohel Rana, Assistant Professor, Kumudini Government College, Tangail. Email: [email protected]