বর্তমানে আমাদের জীবন ব্যবস্থার ক্ষেত্রে আমরা এমন কিছু মৌলিক পরিবর্তন আনতে সক্ষম
হয়েছি যার মাধ্যমে আমাদের সামগ্রিক উন্নয়নকে ধারণ করা সম্ভব হচ্ছে। কিন্তু এত অগ্রগতি
সত্তে¡ও বিংশ শতাব্দীর শেষে আমাদের জীবন ব্যবস্থার ক্ষেত্রে মূল্যবোধগত সংকট খুব বেশি
প্রকট হয়ে উঠেছে। উনবিংশ শতাব্দীতে এই সংকট এতটা প্রকট ছিল না। এই সময়কার
আবিষ্কারগুলো বিশেষ করে টেলিস্কোপ, বাষ্পচালিত ইঞ্জিন এবং রেডিও বিশ্বসমাজে যতটা
প্রভাব ফেলতে পেরেছে, বর্তমানের (বিংশ শতাব্দীর) আবিষ্কারসমূহ তার চেয়ে বেশি প্রভাব
ফেলতে সক্ষম হচ্ছে। কিন্তু পূর্ববর্তী আবিষ্কারসমূহ, প্রযুক্তিগত উন্নয়ন ও বৈজ্ঞানিক
কলাকৌশলের ব্যবহার নিয়ে মানুষকে খুব একটা ভাবতে হতো না। কিংবা এসব বৈজ্ঞানিক
ব্যবহারের প্রশ্নে নৈতিক বিতর্কেরও অবকাশ ছিল না। কিন্তু সমসাময়িক জীবনে বিজ্ঞানের
ইচ্ছেমত অপব্যবহারের ফলে নৈতিক বিতর্কের সৃষ্টি হচ্ছে।
প্রযুক্তিগত উন্নয়ন ও মূল্যবোধ
এ প্রসঙ্গে পারমাণবিক শক্তির উন্নয়নের কথা বলা যায়। পারমাণবিক শক্তির উন্নয়ন আমাদের
জীবনযাপনকে মহাধ্বংসের দিকে ধাবিত করছে। বিশেষ করে যুদ্ধাস্ত্র পারমাণবিক বোমা
মানবতার ইতিহাসে যে অবক্ষয়িত মূল্যবোধের সৃষ্টি করেছে তার প্রথম স্বাক্ষর পাওয়া যায়
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে। তাছাড়া বর্তমানেও যে পরিমাণ মারণাস্ত্রের মজুদ রয়েছে তা দিয়ে পৃথিবীকে
দশবারের অধিক ধ্বংস করা সম্ভব। আমেরিকা তথা বৃহৎ শক্তিধর রাষ্ট্রসমূহের কথা ধরা যাক,
তারাও তাদের সামাজিক অগ্রগতি প্রযুক্তিগত উন্নয়নকে ধরে রাখার জন্য এবং বাজার
প্রতিযোগিতায় নিজেদের প্রাধান্য বজায় রাখার জন্য মারণাস্ত্রের যথেচ্ছা উৎপাদন ও ব্যবহার
করে চলেছে। পাশাপাশি সম্ভাব্য যুদ্ধ থেকে নিজেদের মুক্ত রাখতে, পরিবেশ দূষণ এবং
পারমাণবিক শক্তির ধ্বংসাত্বক অপব্যবহার রোধ এবং পারমাণবিক নিরস্ত্রীকরণের জন্য তেমন
কোনো মহতী উদ্যোগ নিচ্ছে না। অথচ এগুলো সমগ্র মানব সভ্যতার জন্য হুমকিস্বরূপ।
অর্থনৈতিকভাবে অগ্রসর রাষ্ট্রসমূহ বিস্ফোরক ও বিস্ফোরকজাত দ্রব্য তৈরি করতেই শুধু উদ্যমী
নন, বরং এসব ধ্বংসাত্বক মারণাস্ত্রসমূহের বাজার তৈরি করার জন্যও প্রচন্ড আগ্রহী। ফলে
প্রযুক্তির ক্ষেত্রে ক্রমবর্ধিত উন্নয়ন, অগ্রগতি আমদেরকে আশ্বস্ত না করে বরং শংকিত ও সন্ত্রস্ত
করে তুলছে। যেমন- প্রযুক্তিগত উন্নয়নের ফলে উৎপাদন ক্ষেত্রে যস্ত্রাংশের উন্নতি সাধিত
হয়েছে, উৎপাদনে সহায়ক কৌশলগত উন্নতি সাধিত হয়েছে, প্রক্রিয়াগত কারণে অনেক
দুঃসাধ্য কাজ অনায়াসে এবং অধিক সংখ্যক শ্রমিকের স্থলে অল্প সংখ্যক শ্রমিক দিয়ে সম্পন্ন
করা সম্ভব হচ্ছে। আর এভাবে মানুষ কর্মহীন হয়ে পড়ছে। আর তাই প্রযুক্তিগত উন্নয়নের
নেতিবাচক দিকগুলোর উপর গুরুত্ব প্রদান করার পাশাপাশি দূরদর্শী হতে হবে। অন্যথায়
প্রযুক্তিগত উন্নয়ন আমাদের কল্যাণ না করে বরং সংকটে নিপতিত করবে। সুতরাং প্রযুক্তিগত
উন্নয়ন মানুষকে শংকিত, ভীতসস্ত্রস্ত করার পাশাপাশি তার মূল্যবোধজনিত চেতনায়ও
প্রতিক্রিয়া ফেলে থাকে।
বাস্তুসংস্থান ও মূল্যবোধ
প্রযুক্তিগত উন্নয়ন আমাদের বাস্তুসংস্থানগত (পরিবেশগত) সমস্যাও সৃষ্টি করছে। অথচ ধর্ম,
সামাজিক প্রথা ও নৈতিক আলোচনায় বাস্তুসংস্থানের উপর যথেষ্ট গুরুত্ব দেয়া হয়ে থাকে।
কিন্তু বিংশ শতাব্দীতে প্রযুক্তিগত অগ্রগতি ও তার অপব্যবহারের ফলে বাস্তুসংস্থান মারাÍকভাবে
বিপর্যয়ের মুখোমুখি। যেমন- পারমাণবিক বর্জ্য, কলকারখানা, গাড়ি ইত্যাদি থেকে উদগ্ত
ধোঁয়া, রাসায়নিক উপাদানের বিভিন্ন ব্যবহার পরিবেশের উপর মারাÍক প্রভাব ফেলছে। অথচ
পরিবেশ তথা বাস্তুসংস্থানগত সমস্যা মানব প্রজাতিকে ধীরে ধীরে বিলুপ্ত করে দিতে পারে- এ
সম্ভাবনা একেবারে উড়িয়ে দেবার নয়।
বাস্তুসংস্থানগত তাৎপর্য প্রসঙ্গে এজন্য বিভিন্ন ধর্ম ও নৈতিক নীতিসমূহের আলোচনার দিকে
দৃষ্টিপাত করা উচিত। বাস্তুসংস্থান প্রসঙ্গে ওল্ড টেস্টামেন্ট (ঙষফ ঞবংঃধসবহঃ) অনুসারে
মনে করা হয়, সমগ্র বিশ্বব্রহ্মান্ড হলো বসবসকারী মানুষের রাজত্ব অর্থাৎ মানব রাজ্য। এজন্য
মানুষকে তার আগামী সুন্দর ভবিষ্যৎ বিনির্মাণের জন্যই তার বসবাসকারী পরিবেশের
সৌকুমার্য চর্চার প্রয়োজন। আর তাই বাইবেলীয় বিশ্বভ্রাতৃত্ববোধ প্রতিষ্ঠায় বাস্তুসংস্থানের
অনুক‚ল অবস্থাও বিবেচনা করা হয়। আবার প্লেটোনিক দর্শনেও বাস্তুসংস্থানের উপর গুরুত্ব
দেয়া হয়েছে। এখানে বলা হয়, মানুষের মনোজাগতিক ও অন্তর্নিহিত বৌদ্ধিক জগতের সাথে
পরাতাত্তি¡ক জগতের এক ধরনের সম্পর্ক রয়েছে। এই সম্পর্কের ভিত্তিতেই ব্যক্তি তাঁর
আত্মাকে নিয়ন্ত্রিত ও বর্ধিত করতে পারে। পাশাপাশি জগতের সৌন্দর্য চর্চার গুরুত্বকে
অনুধাবন করতে পারে- এই অর্থে যেন প্রকৃতিতে বিদ্যমান অসীম সম্পদকে পুঞ্জিভ‚ত করে
রাখতে পারে। প্লেটো মানবাত্মার চরম উৎকর্ষের জন্য যে পরাতত্তে¡র কথা বলেছেন তা
অর্জনের জন্য ব্যক্তিকে প্রকৃতির সংস্পর্শ নিয়েই করতে হবে। অর্থাৎ প্লেটোর দর্শনে প্রকৃতি
হলো অসীম ও নিত্য। এই অসীম ও নিত্য প্রকৃতিকে সংরক্ষণ করার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে।
প্লেটোনিক দর্শনে সম্পদের যথাযথ ব্যবহারকে নিশ্চিত করার প্রতিও গুরুত্ব দেয়া হয়েছে।
অর্থাৎ কোনো সম্পদ পুরোপুরি নিঃশেষ না হওয়া পর্যন্ত পরবর্তী সম্পদের উপর হস্তক্ষেপ
করাকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে। তাছাড়া প্রাণী, উদ্ভিদ ও গাছপালার যথেচ্ছা ব্যবহার করার
ক্ষেত্রেও সাবধান হবার কথা বলা হয়েছে। অন্যথায় এসব প্রাকৃতিক সম্পদের ঘাটতি আমাদের
ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে সংকটের মুখোমুখি করতে পারে। এভাবে প্লেটো তাঁর দর্শনে মানুষের আবাস
ও প্রাকৃতিক পরিবেশকে গুরুত্ববহ করে তুলেছেন।
প্রাকৃতিক সম্পদ ও মূল্যবোধ
কিন্তু বর্তমান সময়ে মানবসমাজ প্রকৃতির গুরুত্বকে যথাযথভাবে বিবেচনায় আনছে না বলে
আমাদের মনে হয়। প্রাকৃতিক সম্পদ যদিও মানুষের জন্য, তথাপি এসব সংরক্ষণ ব্যবহারের
ক্ষেত্রে মিতচারী এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কথা চিন্তায় রাখা উচিত। তাছাড়া, প্রাকৃতিক সম্পদের
ঘাটতি মানব সমাজকে সংকটের মুখোমুখি নিপতিত করতে পারে। তবে এজন্যই শুধু এদেরকে
সংরক্ষণ করবো, তা নয়। প্রাকৃতিক সম্পদ ও ইতর প্রাণীসমূহের একটা নিজস্ব মূল্যও রয়েছে।
এই মূল্য প্রাচীন সমাজে, প্রাচীন ভারতে ও ধর্মগ্রন্থসমূহে যথেষ্ট বিবেচনায় রাখা হয়েছে।
যেমন- প্রাচীন সমাজে ও প্রাচীন ভারতের আদিম আদিবাসীরা মনে করতো প্রকৃতির প্রতি যত
বেশি সদয় হওয়া যাবে তাদের কাছ থেকে তত বেশী প্রতিফল পাওয়া যাবে। তাদের মতে, যে
সমাজ প্রাণী ও প্রকৃতির প্রতি বেশি সদয় হবে তারা তত বেশি সভ্য জাতি হিসেবে বিবেচিত
হবে। এভাবে তারা মূল্যবোধের মাধ্যমে পরিবেশ সংরক্ষণে তৎপর ছিল। এথেকে বুঝা যায়,
আমাদের ভবিষ্যৎ অগ্রগতি, উন্নয়ন এবং অস্তিত্বকে সুরক্ষার জন্যই বাস্তুসংস্থান এর উপর
গুরুত্ব দেয়া অত্যাবশ্যক।
চিকিৎসা বিজ্ঞানের উন্নতি ও মূল্যবোধ
চিকিৎসা বিজ্ঞান আমাদের মূল্যবোধজনিত চেতনাকে যতটা প্রভাবিত করতে পারে অন্য
কোনো কিছু তা করতে পারে না। যেমন- প্রতিরোধমূলক টিকা, ঔষধ, স্বাস্থ্যবর্ধন কৌশল,
সার্জিক্যাল ব্যবস্থা অধিকাংশ মানুষের জীবনকে দীর্ঘায়ু দিয়েছে। আবার জন্মনিয়ন্ত্রণ,
গর্ভপাতজনিত ব্যবস্থার উন্নয়ন করে জনসংখ্যাকে আমাদের ইচ্ছেমত বিস্তার ও নিয়ন্ত্রণ করতে
পারছি। এটা সত্য যে, চিকিৎসা বিজ্ঞানের অনুরূপ অগ্রগতি বিংশ শতাব্দীতে স্বাধীনতা ও
সংস্কৃতিবোধে ইতিবাচক মূল্যবোধ সৃষ্টি করেছে। চিকিৎসা বিজ্ঞান মানুষকে দীর্ঘায়ুদেবার
পাশাপাশি স্বেচ্ছামৃত্যু গ্রহণের নৈতিক স্বীকৃতিও দিয়েছে। এভাবে চিকিৎসা বিজ্ঞান মানুষের
পুরনো মূল্যবোধের স্থলে নতুন মূল্যবোধের সৃষ্টি করছে। পুরনো ধ্যান-ধারণাকে বদলিয়ে নতুন
ধ্যান-ধারণার উদ্ভব ঘটাচ্ছে।
অর্থনীতি, ব্যবসায় ও মূল্যবোধ
আধুনিক সমাজের প্রকৃতি, শ্রমব্যবস্থা, অর্থনৈতিক চাহিদা আমাদের জীবনে নতুন কিছু
মূল্যবোধের জন্ম দিচ্ছে। ফলে কর্মজীবীর সাথে মহাজনের, শ্রমিকের সাথে মালিকের, ব্যবসা
ব্যবস্থাপনার সাথে জনগণের এবং ব্যবসার সাথে পরিবেশের ভিন্নমাত্রিক সম্পর্ক স্থাপিত
হয়েছে। যেমন- উৎপাদন ব্যবস্থায় আধুনিকায়ন, কৃষিক্ষেত্রে যান্ত্রিকীকরণ, বন্টন ব্যবস্থায়
পুরনো ধরনের স্থলে নতুন ধরন ইত্যাদি শ্রম ও শ্রমিকের সম্পর্ককে পরিবর্তিত করে দিয়েছে।
এই উদ্ভ‚ত সম্পর্কের ফলে সমাজে সৃষ্টি হয়েছে নতুন নৈতিক মাত্রা, নতুন মূল্যবোধের।
রচনামূলক প্রশ্ন
১। প্রযুক্তিগত উন্নয়ন, বাস্তুসংস্থান ও চিকিৎসা বিজ্ঞানের পরিবর্তন কিভাবে সামাজিক
মূল্যবোধকে প্রভাবিত করেছে? বিস্তারিত বর্ণনা দিন।
সংক্ষিপ্ত রচনামূলক প্রশ্ন
১। প্রযুক্তিগত উন্নয়ন কিভাবে আমাদের মূল্যবোধকে প্রভাবিত করে? আলোচনা করুন।
২। “বাস্তুসংস্থানের প্রতি যতœশীল হওয়া উচিত”।- এই উক্তিটির পক্ষে যুক্তি দেখান।
৩। অর্থনীতি ও ব্যবসায়-এর ক্ষেত্রে পরিবর্তন কিভাবে সামাজিক মূল্যবোধকে প্রভাবিত করে
তার সংক্ষিপ্ত আলোচনা করুন।
ক) বহু নির্বাচনী প্রশ্ন
সঠিক উত্তর লিখুন।
১। “প্রাকৃতিক জীবন ও পরাতাত্তি¡ক জীবন সম্পর্কিত’’- উক্তিটি করেন
র) প্লেটো
রর) অ্যারিস্টটল
ররর) রুশো
রা) ডিউই
২। “প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের ভিতর দিয়ে বিশ্বভ্রাতৃত্বকে প্রতিষ্ঠা করা যায়’’- এই উক্তিটি রয়েছে
র) কোরআনে
রর) বাইবেলে
ররর) ওল্ড টেস্টামেন্ট
রা) নিউ টেস্টামেন্ট
৩। “বাস্তুসংস্থানের প্রতি যতœশীল না হলে পরিবেশ বিপর্যয় ঠেকানো যাবে না’’
র) উক্তিটি সত্য
রর) উক্তিটি মিথ্যা
ররর) উক্তিটি আংশিক মিথ্যা
রা) উক্তিটি আংশিক সত্য
৪। চিকিৎসা বিজ্ঞানে মানুষের অগ্রগতি
র) মূল্যবোধে পরিবর্তন ঘটাতে পারে
রর) সাংস্কৃতিক জীবনে প্রভাব ফেলতে পারে
ররর) মানুষকে বিপথগামী করতে পারে
রা) উপরের সব কয়টি ঘটাতে পারে
সঠিক উত্তর
ক)
১। র) প্লেটো
২। ররর) মন্ট
৩। র) উক্তিটি মিথ্যা
৪। র) বোধে পরিবর্তন ঘটাতে পারে
FOR MORE CLICK HERE
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস মাদার্স পাবলিকেশন্স
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস ১ম পর্ব
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস
আমেরিকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস
বাংলাদেশের ইতিহাস মধ্যযুগ
ভারতে মুসলমানদের ইতিহাস
মুঘল রাজবংশের ইতিহাস
সমাজবিজ্ঞান পরিচিতি
ভূগোল ও পরিবেশ পরিচিতি
অনার্স রাষ্ট্রবিজ্ঞান প্রথম বর্ষ
পৌরনীতি ও সুশাসন
অর্থনীতি
অনার্স ইসলামিক স্টাডিজ প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত
অনার্স দর্শন পরিচিতি প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত