ইবনে সিনার মতে অধিবিদ্যা কি? অধিবিদ্যার বিষয়বস্তু কি?

নৈর্ব্যক্তিক প্রশ্ন
১। ইবনে সিনার মতে যুক্তিবিদ্যা হচ্ছে দর্শনের
(ক) অংশ (খ) বিভাগ
(গ) হাতিয়ার (ঘ) কোনটিই নয়।
২। ইবনে সিনার মতে জ্ঞানের দ্বিতীয় উৎস হল
(ক) ধারণা (খ) সংজ্ঞা
(গ) সম্মতি (ঘ) অবধারণ।
৩। ইবনে সিনার উদ্ভাবিত নূতন বাক্যের নাম
(ক) প্রাকল্পিক (খ) বৈকল্পিক
(গ) উজুদিয়া (ঘ) কোনটিই নয়।
৪। ইবনে সিনার উদ্ভাবিত দু'প্রকার ন্যায় অনুমানের প্রথমটি হল
(ক) ইকতিরানী (খ) হাসলী
(গ) সারতী (ঘ) কোনটিই নয়।
৫। ইবনে সিনার মতে শব্দের অর্থ প্রকাশিত হয়
(ক) বৈকল্পিক উপায়ে (খ) কাল্পনিক উপায়ে
(গ) তিনটি উপায়ে (ঘ) একটি উপায়ে।
রচনামূলক প্রশ্ন
১। ইবনে সিনার মতানুসারে যুক্তিবিদ্যার সংজ্ঞা দিন।
২। সংজ্ঞা সম্পর্কে ইবনে সিনার বক্তব্য আলোচনা করুন।
৩। ইবনে সিনার মতে বাক্য কি? এ ব্যাপারে তাঁর অভিমত আলোচনা করুন।
উত্তরমালা
সত্য/মিথ্যা
১। মিথ্যা ২। মিথ্যা ৩। সত্য ৪। সত্য ৫। মিথ্যা
নৈর্ব্যক্তিক প্রশ্ন
১। গ ২। গ ৩। গ ৪। ক ৫। গ মুসলিম জগতের চিন্তাবিদগণ গ্রীক দর্শনের আরবীতে অনূদিত গ্রন্থসমূহ অধ্যয়ন করার পর দার্শনিক
যুক্তি ও প্রত্যাদেশের মধ্যে বিরোধ দেখতে পান। এ বিরোধের মীমাংসার পথ অনেকেই অনে¦ষণ করেন
আবার ধর্ম বিরোধী বলে অনেকে গ্রীক দর্শনকে পরিহার করেন। যারা যুক্তির সঙ্গে অবতীর্ণ গ্রন্থের
চিন্তাধারার সমন¦য় সাধনে ব্রতী হন তাঁদের মধ্যে অনেকেই মনে করেন যে, কেবলমাত্র অধিবিদ্যার
মধ্যেই এই দুটির সম্পর্ক স্থাপন করা সম্ভব। কারণ ধর্মের মূলনীতি সমূহের যৌক্তিক প্রমাণ ও এর
যথার্থতা এখানে আছে। এখওয়ানুস সাফার চিন্তাবিদগণ মনে করেন এই দু'বিরোধী বিষয়ের সমন¦য়
সম্ভব এবং তা করা উচিত। দার্শনিকবৃন্দের মধ্যে আল-কিন্দি ও আল-ফারাবীসহ ইবনে সিনার পূর্ববর্তী
দার্শনিকগণ মনে করেন যে, ধর্মের মূলনীতিসমূহ যুক্তিভিত্তিক দর্শন থেকে পৃথক, কিন্তু এ দুটি একে
অন্যের পরিপূরক। ইবনে সিনা অধিবিদ্যা সম্পর্কে বলেন যে, ধর্মীয় আইন বা শরীয়াহ্ এবং যুক্তির
মধ্যে কোন বিরোধ নেই, কারণ যুক্তির মধ্যে এমন কিছু নেই যা বিরোধ সৃষ্টি করে। যারা বিরোধিতা
অনে¦ষণ করেন তারা নিজেরাই বিপথগামী। ইবনে সিনা এভাবে এ ধরনের বিরোধ দূর করে দর্শনকে
তিন ভাগে বিভক্ত করেনÑ (১) উচ্চতর বিজ্ঞান বা অধিবিদ্যা, (২) মধ্যবর্তী বিজ্ঞান বা গণিতশাস্ত্র এবং
(৩) নি¤œতর বিজ্ঞান বা প্রকৃতির অবভাস। তিনি বিভ্রান্তি দূর করার জন্য অধিবিদ্যার মূল কেন্দ্রবিন্দু
হিসেবে ঝপরবহপব ড়ভ ঃযব উরারহব বা পবিত্রতমের বিজ্ঞানকে অত্যধিক গুরুত্ব দেন। তিনি খোদার
অস্তিত্বের প্রমাণের জন্য পদার্থবিদ্যা এবং অধিবিদ্যাকে ভিত্তি হিসেবে গ্রহণ করেন যা অন্য কোন
মুসলিম দার্শনিক করেননি। ইবনে সিনা রাসেলের বহুপূর্বে অধিবিদ্যাকে ”ঘড় সধহ'ং খধহফ”-এ মনে
করে বিজ্ঞানকে ধর্মতত্ত¡ থেকে পৃথক করেন এবং মনে করেন এ দুয়ের মধ্যে আছে একটি
আল-কিন্দির মতে অধিবিদ্যা হল ঐ সত্তার বিজ্ঞান যা অচালিত এবং এ বিজ্ঞান প্রথম সত্য এর বিজ্ঞান। আল-ফারাবী অধিবিদ্যাকে তিনটি অংশে বিভক্ত করে পরিশেষে বলেন যে, এ
বিজ্ঞান ঐ পরম সত্তার বিজ্ঞান যে সত্তা অন্য কোন সত্তা থেকে তাঁর অস্তিত্ব অর্জন করেনি; বরং এ সত্তা
ঐ সত্য যে সত্য থেকে সব কিছুই সত্যতা লাভ করে এবং এ মহাসত্য হচ্ছে খোদা। ইবনে সিনার
মতে আত্মা যে ‘প্রথম ইন্দ্রিয়জ' ও কতিপয় জ্ঞানের প্রথম স্তর অর্জন করে তা হল সত্তার ধারণা এবং এ
ধারণাই অধিবিদ্যার প্রথম এবং সত্য বিষয়। এ সত্তা পরিপূর্ণ সত্তাÑকারণ এ সত্তা আদতেই পরিপূর্ণ
সত্তা তাঁর এ ধারণার সূত্র ধরে বলা যায় যে, প্লেটোর অধিবিদ্যার মূল কেন্দ্রবিন্দু
যদি ধারণাতত্ত¡ হয় এবং এ্যারিস্টটলের অধিবিদ্যার মূল উপাদান যদি সম্ভাবনা থেকে বাস্তবতায় উত্তরণ
হয় তবে ইবনে সিনার অধিবিদ্যার মূল উপাদান হল সত্তার ধারণার অনুসন্ধান এবং তাঁর অধিবিদ্যা হল
সত্তাকে সত্তা হিসেবে অধ্যয়ন
অধিবিদ্যার সংজ্ঞা দেওয়ার পর ইবনে সিনা অধিবিদ্যার বিষয়বস্তু সম্পর্কে কি আলোচনা করেন সে
সম্পর্কে আমরা এখন ধারণা লাভ করব। ইবনে সিনার অধিবিদ্যার আলোচনা বিস্তারিত। তাঁর
অধিবিদ্যার মূল বিষয়বস্তু আলোচনার পূর্বে তিনি এ্যারিস্টটলের মত ভ‚মিকা হিসেবে কতকগুলো
বিষয়ের ওপর আলোচনা করেন। এ বিষয়গুলো হলÑ সত্যতা এবং ‘সত্য' (ঞৎঁঃয ধহফ ঃযব ঃৎঁব),
সারধর্ম এবং অস্তিত্ব কারণের বিভাজন , দ্রব্য-
আকস্মিক সম্পর্ক, জড় ও আকার , জড় ও আকারের
সঙ্গে যুক্ত সম্ভাব্যতা ও বাস্তবতা সম্ভাব্যতা ও বাস্তবতার পূর্বাপর
অবস্থান ) এবং সংজ্ঞা ও সংজ্ঞায়িত পরোক্ত
বিষয়গুলোর আলোচনা মূলত এ্যারিস্টটলের আলোচনাকে অনুসরণ করেই করা হয়েছে। কিন্তু ইবনে
সিনা এ্যারিস্টটল, স্টয়িক দার্শনিক বা ফারাবীর মতবাদ গ্রহণ করেছেন এমন কথা বলা যাবে না। তবে
উপরোক্ত দার্শনিকদের চিন্তাধারার ছাপ তাঁর অধিবিদ্যায় লক্ষ্য করা যায়।
ইবনে সিনা তাঁর অধিবিদ্যার মূল উপাদান সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়ে বলেন- সত্তার ধারণা হল
মানব মনের প্রথম ‘অর্জন' সত্তার ধারণার জ্ঞান বিষয়গত এবং বিষয়ীগতভাবে অর্জন
করা হয়। তিনি বলেন যে, আমরা আমাদের দেহ সম্পর্কে সম্পূর্ণ অচেতন থাকলেও আমরা এ বিষয়ে
ওয়াকিফহাল যে আমরা ‘আছি' এবং আমরা ‘অস্তিত্ববান'। বস্তুগতভাবে সত্তার ধারণা লাভ করা
যায়Ñসংবেদীয় প্রত্যক্ষণ এবং চতুরপার্শ্বের বস্তুর সঙ্গে দেহজ সংস্পর্শের মাধ্যমে। ইবনে সিনা বলেন
সত্তা কোন জাতি নয় এবং একে উপজাতিতে ভাগ করা যায় না। কিন্তু সত্তার মধ্যে দুটি উপাদান
আছে। এদের একটি ‘সারসত্তা' এবং অন্যটি ‘অস্তিত্ব' (সত্তাকে বিশ্লেষণ
করার সময় এরূপ মনে হয়। কিন্তু সত্তাকে পর্যবেক্ষণ করলে প্রশ্ন ওঠে এ সত্তা কি আবশ্যক না সম্ভব।
যদি আবশ্যক হয় তবে সত্তা নিজ গুণে আবশ্যক নাকি বাহ্যিক কোন ধমবহপবু প্রতিনিধিত্বের ফলে
আবশ্যক? তিনি বলেন আমরা এ প্রশ্ন থেকে তিন ধরনের সত্তা পেতে পারি। এগুলো হল ‘আবশ্যিক',
‘সম্ভব' এবং ‘অসম্ভব'। কিন্তু স্বয়ং আবশ্যক, স্বয়ং সম্ভব এবং পৃথক কোন এজেন্টের কর্মের ফলে
আবশ্যক-এর মধ্যে হস্তক্ষেপকারী প্রক্রিয়া আছে এবং এ প্রক্রিয়াকে ‘সৃষ্টি' বা পৎবধঃরড়হ বলা হয়।
ইবনে সিনা প্রশ্ন করেন এ প্রক্রিয়া কি সচেতন না প্রত্যক্ষ (ফরৎবপঃ)? তাঁর মতে এ প্রক্রিয়া প্রত্যক্ষ ও
আবশ্যক কারণ সর্বোচ্চ আবশ্যক সত্তা যাকে স্বয়ং খোদা বলা হয়Ñ তাঁর নিকট থেকে নির্গমনের
পর্যায়ক্রমিক স্তরের মাধ্যমেই এ সৃষ্টি প্রক্রিয়া আরম্ভ হয়। ইবনে সিনা এখানে তাঁর অধিবিদ্যার মৌলিক তিনটি বিষয় সম্বন্ধে ইঙ্গিত করেছেন।
সত্তার ধারণা
সারধর্ম এবং অস্তিত্বের সমন¦য়ে সত্তার ধারণা গঠিত। কোন বস্তুর বাস্তবতা যা
সত্য তা এর মধ্যে আছে এবং এখানেই তার প্রকৃত অস্তিত্ব আছে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, একটি
ত্রিভুজের বাস্তবতা হল যে ত্রিভুজটি আছে এবং শ্বেতবর্ণের বাস্তবতা হল এটি শ্বেতবর্ণ
ইবনে সিনা একে বিশেষ অস্তিত্ব বলেন কারণ বস্তু বলতে যা বুঝায় তাঁর সঙ্গে ‘অস্তিত্বের ধারণা'
সংযুক্ত, যদিও বস্তু এবং বস্তুর অস্তিত্বের ধারণা দুটি সম্পূর্ণ আলাদা।
অস্তিত্বশীল সত্তার ধারণা বস্তুর সঙ্গে সহযোগী। কারণ বস্তুটি যদি বাস্তবে অস্তিত্বশীল না হয় কল্পনা
এবং মনের মধ্যে অস্তিত্ববান। যদি তা না হয় তবে এটি কোন বস্তু নয়। ইবনে সিনা বলেন এমন কোন
বস্তু আছে কি যা সম্পূর্ণরূপে অনস্তিত্বশীল কোন বস্তু সম্পর্কে মনের মধ্যে ধারণা
থাকতে পারে কিন্তু বস্তুটি আসলেই বহির্জগতে অস্তিত্বশীল নয়। কেবলমাত্র ঐ বস্তুরই তথ্য পাওয়া
সম্ভব যা মানসিকভাবে বোধগম্য । আর যে বস্তু সম্পূর্ণরূপে অস্তিত্বশীল, তার
সম্পর্কে কোন তথ্য দেওয়া যায় না। এ অবস্থায় যদি মনে করা হয় যে কোন অস্তিত্বশীল বস্তুর তথ্য
দেওয়া যায় তাহলে ঐ বস্তুর গুণ থাকবে এবং যদি তা থাকে, তবে ঐ অনস্তিত্বশীল বস্তুর সঙ্গে ঐ গুণ
সংযুক্ত হবে। এর অর্থ হল ঐ অনস্তিত্বশীল বস্তুর অস্তিত্ব আছে যা আসলে অসম্ভব (ধনংঁৎফ)। ইবনে
সিনা বলেন যে প্রত্যেক বস্তুর বিশেষ বাস্তবতা আছে এবং এটি এর সারধর্ম। এটি জানা কথা যে,
প্রত্যেক বস্তুর বাস্তবতা এর অস্তিত্ব (ঁিলঁফ) থেকে আলাদা বা এটি অন্য কিছু। এখানে ইবনে সিনা
বস্তুর অস্তিত্ব থেকে বস্তুর সারধর্মকে পৃথক করে দেখান এবং এ ব্যাপারে তাঁর পৃথকীকরণ পদ্ধতি
তত্ত¡মূলক যা এ্যারিস্টটলের পদ্ধতি থেকে পৃথক। এটি ইবনে সিনার একটি অসাধারণ অবদান।
উপরোক্ত আলোচনার পর ইবনে সিনা সারধর্ম এবং অস্তিত্বের প্রকৃত পরিচয় দেওয়ার চেষ্টা করেন।
তাঁর মতে সারধর্ম হল বাস্তবতা। সারধর্ম কি এর উত্তরে বলা যাবে এটি যা তাই (রঃ রং যিধঃ রঃ রং)।
কোন বস্তুর সাধারণ গুণাবলীর সঙ্গে একে মিশিয়ে ফেলা যাবে না। কারণ একটি বস্তুর অনেক গুণ
থাকতে পারে যা ঐ বস্তুর জন্য অপরিহার্য। কিন্তু এই বস্তু কোন একটি নয় বরং সারধর্ম হচ্ছে ঐ বস্তুর
সমস্ত অপরিহার্য গুণের সমষ্টি (ংঁস-ঃড়ঃধষ)। ইবনে সিনা বলেন কেউ যদি প্রশ্ন করেন সারধর্ম কি
(যিধঃ রঃ রং)? এর উত্তর তিনটি আকারে দেওয়া যায়। প্রথমটি হচ্ছে পুরোপুরি বিশেষ প্রথায়; যেমনÑ
যৌক্তিক প্রাণী (‘মানুষ'কে ব্যক্ত করে , উত্তরের দ্বিতীয় প্রকার হচ্ছে
বিভিন্ন বস্তুর মধ্যে প্রাপ্ত সাধারণ উপাদান যাকে সারধর্ম বলা হয়। উত্তরের তৃতীয় আকারটি হচ্ছে
‘সারধর্ম', যা বিশেষ এবং সাধারণ উপাদানের সমনি¦ত একক।
সারধর্ম সম্পর্কে ইবনে সিনার উপরোক্ত ধারণা এ্যারিস্টটলের অনুরূপ। কিন্তু ইবনে সিনার সাথে
এ্যারিস্টটলের পার্থক্য হল ইবনে সিনা সারধর্ম এবং অস্তিত্বের পার্থক্যের ওপর গুরুত্ব আরোপ করেন
যা এ্যারিস্টটল করেননি। আধুনিক দার্শনিকদের মতে কোন শব্দের সারধর্ম থাকতে পারে কোন বস্তুর
নয়। কিন্তু এতদ্সত্বেও একথা বলা যায় যে, তাঁর যুগে এ ধরনের ধারণা বাস্তব ও দর্শনের জন্য
সহায়ক ছিল।
সারধর্মের সংজ্ঞা দেওয়ার পর ইবনে সিনা অস্তিত্ব কি সে সম্পর্কে প্রশ্ন উত্থাপন করেন। তাঁর মতে,
অস্তিত্বশীল তাই যাকে সংবেদনসমূহ প্রত্যক্ষ করে তিনি বলেন এমন কোন কিছুর
অস্তিত্ব গ্রহণযোগ্য নয় যাকে তার দ্রব্যের মধ্যে প্রত্যক্ষ করা যাবে না। কোন দেহের স্থান বা অবস্থান
চিহ্নিত করা না গেলে এর অস্তিত্ব আছে বলে ধরা যাবে না। মানুষের অনন্য বাস্তবতা বা মূল বাস্তবতা
সংখ্যার সঙ্গে পরিবর্তনশীল নয়, কারণ এ বাস্তবতা পূর্ণরূপে বোধজাত। সকল সর্বজনীনের
ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। সকল যথার্থ সত্তা কেবলমাত্র এর অপরিহার্য বাস্তবতা অনুযায়ী সত্য।
ইবনে সিনা বলেন যে, এ কথা অনুযায়ী সকলেই একমত যে কেবলমাত্র ‘তিনিই এক' (আল্লাহ এক)
এবং তাঁর ব্যাপারে কোন কিছু নির্দেশ করা যাবে না। তা যদি হয় তবে কোন কিছু কিভাবে তাঁর নিকট
থেকে তার অস্তিত্বের সত্যতা অর্জন করে বা অস্তিত্ব লাভ করে?
ছঁধষরঃু এবং বাস্তবতার সঙ্গে সম্পর্কের প্রেক্ষিতে কোন বস্তুর উদ্ভব হতে পারে। উদাহরণস্বরূপ বলা
যায় একটি ত্রিভুজের বাস্তবতা সমতল ভ‚মি ও লাইনের সঙ্গে জড়িত এবং এগুলোই ত্রিভুজ গঠন করে।
এ ত্রিভুজতত্তে¡র বাস্তবতা আছে। এ দু'টির একটিকে উপাদান এবং অন্যটিকে আকারগত কারণ বলা
যায়। কিন্তু এর অস্তিত্ব আরও কিছু কারণের ওপর নির্ভরশীল। কিন্তু এগুলো ত্রিভুজত্বের জন্ম দেয় না
এবং এর সংজ্ঞারও অংশ নয়। এটিই হল সীমিত কারণ বা পরিণতি কারণ এবং পরিণত কারণ নিমিত্ত
কারণের জন্যই নিমিত্ত কারণ।
কোন বস্তু বাস্তবে অস্তিত্বশীল কিনা তা জানতে হলে, ইবনে সিনার মতে, এটা লক্ষ্য রাখা উচিত যে,
যে জন্মদানকারী উপাদান কোন বস্তুর অস্তিত্ব আনয়ন করে, তার গঠনমূলক কারণ আছে। এ ব্যাপারে
কারণগুলোর কোন কোনটি থাকতে পারে, যেমনÑ আকারের কথা বলা যায় অথবা অস্তিত্ব প্রদানকারী
সবগুলো কারণও হতে পারে। পরিণতি কারণের প্রয়োজনেই বস্তুর অস্তিত্ব এবং ঐ পরিণতি কারণ মূল
বা সারধর্মের জন্যই কারণ। তিনি বলেন সীমিত কারণই পরিণতি কারণের অস্তিত্বের কারণ যা মূলত
মুখ্য কারণ। ইবনে সিনার মতে, তাহলে দেখা যাচ্ছে যে, নিমিত্ত কারণই সর্বাপেক্ষা শক্তিশালী এবং
সিদ্ধান্তই নিয়ামক কারণ। আকার, উপাদান এবং পরিণতি কারণকে নিমিত্ত কারণ বা এজেন্টের ঊর্ধ্বে
স্থান দেওয়া হয় না। ইবনে সিনা এখানে জোর দিয়ে বলেন যে, এই নিমিত্ত কারণই হচ্ছে ‘প্রথম
কারণ' (ঋরৎংঃ পধঁংব)। এ কারণই সকল অস্তিত্বের কারণ এবং সমুদয় অস্তিত্বশীল বস্তুর বাস্তবতার
কারণ। ইবনে সিনা এ কারণকেই খোদা বলেন।
সত্তার প্রকারভেদ
সত্তার সারধর্ম এবং অস্তিত্ব নিয়ে আলোচনার পর ইবনে সিনা সত্তার প্রকার নিয়ে আলোচনা করেন।
তাঁর মতে সত্তা ‘আবশ্যিক', ‘সম্ভব' অথবা ‘অসম্ভব' হতে পারে। সত্তা জাতি নয় বিধায় এগুলো তার
উপজাতি নয়। বিষয়ীগতভাবে এগুলো সত্তার বিভিন্ন আকার যা মানসিকভাবে ধারণামাত্র। বস্তুগতভাবে
এগুলো বিভিন্ন উপায় যার মধ্যে ঐগুলো একে অপরের সঙ্গে সম্পর্কিত।
‘আবশ্যিক সত্তা' হচ্ছে সেই সত্তা যাকে অস্তিত্বশীল ভাবা অসম্ভব ব্যাপার। সম্ভাব্য সত্তা হচ্ছে সেই সত্তা
যাকে অস্তিত্বশীল বা অস্তিত্বহীন ভাবা কোন প্রকার অসম্ভব ব্যাপার নয়। ‘অসম্ভব সত্তা' বলতে এমন
কিছুকে বুঝায় যার কোন অস্তিত্ব নেই এবং অস্তিত্বময়কে সবসময় অস্তিত্বহীনের চেয়ে স্পষ্টভাবে এবং
ভালভাবে জানা যায়।
আবশ্যিক সত্তা সম্পর্কে ইবনে সিনা বলেন যে এই প্রকার সত্তা স্বয়ং আবশ্যিক হতেও পারে, আবার
নাও হতে পারে। সারধর্মের মধ্যে এ সত্তা আবশ্যিক হলে এ সত্তাকে কখনও অসম্ভব ভাবা যাবে না।
কিন্তু সারধর্মের মধ্যে এ সত্তা আবশ্যিক না হলে এ সত্তাকে অন্য কিছুর সঙ্গে যুক্ত করলে তা আবশ্যিক
হয়। উদাহরণস্বরূপ ‘চার' সংখ্যাটি সারধর্মের মাধ্যমে নয় বলে আবশ্যিক নয়। কিন্তু দুই-এর সঙ্গে দুই
যোগ করলে যখন ‘চার' হয় তখন এ সংখ্যাটি আবশ্যিক হয়। একইভাবে একটি সম্ভাব্য সত্তা তখনই
সম্ভাব্য সত্তা হবে যখন এর অস্তিত্ব বা অস্তিত্বহীনতার মধ্যে অসম্ভবের কোন উপাদান থাকবে না।
অন্যকথায় এটি সম্ভাবনাময় এবং কোন প্রকার সত্তায় উন্নীত হতে পারে। অধিকন্তু একটি বস্তু সারসত্তার
মধ্যে এবং একই সঙ্গে অন্য কিছুর সাথে আবশ্যিক সত্তা হতে পারে না। কারণ পরবর্তীতে এ ‘অন্য
কিছু' যদি দূরীভ‚ত হয়, তবে এ সত্তা আর আবশ্যিক সত্তা থাকে না। ইবনে সিনার মতে, প্রত্যেক বস্তু
যা অন্য কিছুর সংযোগে আবশ্যিক সত্তা, তা আবার সারসত্তায় সম্ভাব্য সত্তা। এটি এ কারণে যে
আবশ্যিকতার অস্তিত্ব অন্য বস্তুর সংযোগ বা সম্পর্কের সাথে যুক্ত এবং ‘স্বয়ং কোন বস্তুর সারসত্তার'
মত সংযোগ এবং সম্পর্কের একই রকম বিবেচনা থাকতে পারে না।
উপরোক্ত কথার মাধ্যমে ইবনে সিনা বলতে চান যে, সারসত্তার যে আবশ্যিক সত্তা তা অবশ্যই
আবশ্যিক। কিন্তু এ আবশ্যিক সত্তা অন্য কোন বস্তুর সঙ্গে সংযুক্ত বা সম্পর্কিত হয়ে সারসত্তায় তা
সম্ভাব্য সত্তায় পরিণত হয়। আবশ্যিক সত্তার অস্তিত্বের প্রকাশ অবশ্যই প্রয়োজনীয় বলে এটি আদিতেই
ঐ অবস্থায় ছিল এবং এটি অস্তিত্ববান হয়েছে। সারধর্মের মধ্যে সম্ভাব্য সত্তা অস্তিত্ববান হলে তা
আবশ্যিক সত্তায় রূপান্তরিত হয়। আর সম্ভাব্য সত্তা অস্তিত্ব বা অনস্তিত্বের সম্ভাবনার মধ্যে বিরাজমান।
ইবনে সিনা এই আবশ্যিক এবং সম্ভাব্য সত্তাকে এ্যারিস্টটলীয় ধাঁচে বাস্তবতা এবং সম্ভাব্যতার
সঙ্গে সংযুক্ত করেছেন। কিন্তু পরিশেষে আবশ্যিক সত্তাকে প্রকৃতভাবেই
আবশ্যিক বলে প্রমাণ করেন এবং এ সত্তাকে প্রথম কারণ হিসেবে খোদা বলে অভিহিত করেন। আর
অস্তিত্বশীল সমস্ত সৃষ্টিকে সম্ভাব্য সত্তা বলে অভিহিত করেন। বাস্তবতা হিসেবে আবশ্যিক সত্তাকে তিনি
‘বিশুদ্ধ মঙ্গল' বলেন এবং তাঁর মতে সম্ভাব্য সত্তার মত এ সত্তার কোন কারণ নেই; এর অস্তিত্ব
শর্তসাপেক্ষ নয়, আবার এ সত্তা অন্য কোন কিছুর সঙ্গে সম্পর্কিত হয়েও সত্তা নয় বলে পরিবর্তনশীলও নয়। আবার বহুও নয় বরং এক।
ইবনে সিনার মতে আবশ্যিক সত্তা বা প্রথম কারণ এবং সম্ভাব্য সত্তার মধ্যে একটি স্তর ও একটি
প্রক্রিয়া জড়িত। উভয়ের মধ্যস্থিত এই স্তর ও প্রক্রিয়ার নাম হল সৃষ্টি। সৃষ্টি (পৎবধঃরড়হ) অনস্তিত্ব থেকে
অস্তিত্ব ছাড়া আর কিছু নয়। প্রশ্ন হল কেমন করে কোন কিছুর অস্তিত্ব আনয়ন করা যাবে? তাঁর মতে,
সৃষ্টির জন্য উপাদানের বা জড় প্রয়োজন। এই জড় তাঁর মতে চিরন্তন। ইবনে সিনা প্লেটো
এবং এ্যারিস্টটলের মতই মনে করেন যে, সৃষ্টির অর্থ শূন্য থেকে সৃষ্টি নয় বরং পূর্বে অবস্থিত জড়ীয়
উপাদান থেকেই কোন সময়ে সৃষ্টি বলতে যা বোঝায় তা হয়েছে। তিনি এখানে সময়ের ব্যাপারেও
চিন্তাভাবনা করেন এবং এ্যারিস্টটলীয় ধাঁচে তাঁর তত্ত¡ দেন। যাহোক, তিনি সৃষ্টি বলতে মূলত পূর্বে
অস্তিত্বশীল জড়কে আকার প্রদান করা অর্থে বুঝিয়েছেন। এ আকার প্রদান করেন নিমিত্ত কারণ বা
খোদা। খোদা এখানে একজন তিনি শূন্য (ঊী-হরযরষড়) থেকে সৃষ্টিকর্তা নন। তিনি তাঁর
তত্তে¡ অভিনবত্ব বজায় রাখার জন্য খোদাকে একই সাথে নিমিত্ত কারণ এবং আবশ্যিক সত্তা বলে
অভিহিত করেন। কারণ এ দুটি পরস্পরের সঙ্গে সম্পর্কিত।
এ্যারিস্টটলের মত তিনিও মনে করেন যে, সৃষ্টির জন্য কারণের প্রয়োজন। কিন্তু কারণের আবার কারণ
থাকতে পারে। সেজন্য প্রথম কারণের প্রয়োজন এবং এ প্রথম কারণের কোন কারণ নেই। তাই প্রথম
কারণই চূড়ান্ত কারণ। যিনি সব কারণেরই কারণ এবং তিনিই খোদা। এই খোদা একই সাথে নিমিত্ত
কারণ এবং পরিণতি কারণও বটে। সে হিসেবে খোদা সব কারণের কারণ এবং সব পরিণতির পরিণতি
এজন্য যে তিনি চিরস্থায়ী।
সৃষ্টি প্রক্রিয়ায় খোদা বা চালক শক্তির মাধ্যমে পূর্বে অস্তিত্বশীল জড়ের আকার
প্রদান করেন। তাঁর এই অপঃরাব বা চালক শক্তি হচ্ছেন আকার প্রদানকারী।
ধর্মতত্ত¡বিদগণ খোদাকে নিমিত্ত কারণ হিসেবে চিন্তা করে বলেন যে তিনি শূন্য থেকে নিরবচ্ছিন্নভাবে
সব কিছু সৃষ্টি করেন। ইবনে সিনা কিছুটা ভিন্নভাবে বলেন যে খোদা পুরাতন আকারকে সরিয়ে
অপঃরাব ওহঃবষষরমবহপব বা চালক শক্তির মাধ্যমে নূতন আকার দান করেন। এ থেকে বুঝা যায় ইবনে
সিনা খোদাকে সর্বক্ষমতাবান মনে করেন, তবে তিনি শূন্য থেকে কোন কিছু সৃষ্টি করেন না
এরপর ইবনে সিনা খোদার নিকট থেকে কিভাবে জগৎ অস্তিত্ববান হল সে সম্পর্কে তাঁর অধিবিদ্যায়
বিস্তারিত আলোচনা করেন। ইবনে সিনা সৃষ্টি প্রক্রিয়ার জন্য অন্যান্য মুসলিম দার্শনিকদের মতই
নির্গমন তত্তে¡র সাহায্য গ্রহণ করেন।
খোদা বা আবশ্যিক সত্তা এক এবং অদ্বিতীয়। তাহলে এই অদ্বিতীয়ের মধ্য থেকে বহু বিচিত্র বস্তুর সৃষ্টি
কিভাবে হল? ইবনে সিনা বলেন, খোদা এক বিশুদ্ধ চিন্তনের মাধ্যমে ঋরৎংঃ রহঃবষষরমবহপব বা বিশ্ব-
আত্মা সৃষ্টি করেন। এ বিশ্ব-আত্মা এক এবং সরল। বিশ্ব আত্মা এর সারসত্তার প্রেক্ষিতে সম্ভাব্য, কিন্তু
আবশ্যিক সত্তার সংযোগে আবশ্যিক। আবশ্যিক আত্মা থেকে নির্গমনের মাধ্যমে বিশ্ব-আত্মা
প্রয়োজনীয়তা এবং সম্ভাবনার অধিকারী এবং এজন্য এই আত্মা একাধারে
এক এবং বহু। একইভাবে একই প্রক্রিয়ায় ঐ আত্মার মতই শক্তি নিয়ে দ্বিতীয় শক্তির নির্গমন হয়।
এরূপে বিশ্ব-আত্মা থেকে তিনটি বস্তুর নির্গমন হয়: (১) দ্বিতীয় শক্তি (২) প্রথম পরিমন্ডলের আত্মা যা
এর আকার এবং (৩) এর দেহ যা এর উপাদান। একইভাবে দ্বিতীয় শক্তি থেকে তৃতীয় শক্তির
উৎসারণ হয় এবং অন্য একটি পরিমন্ডলের আকার ও দেহের নির্গমন হয়। এভাবে এ প্রক্রিয়া চলতে
থাকে এবং এর সমাপ্তি ঘটে শেষশক্তির নির্গমন পর্যন্ত। এই শেষশক্তি থেকে আমাদের আত্মার নির্গমন
হয়। এই শেষশক্তি পৃথিবীর পরিমন্ডলের শক্তি যাকে চালক শক্তি বলা হয়। পৃথিবী সসীম বলে এবং
আর কোন শক্তির নির্গমনের প্রয়োজনীয়তা নেই বলে এখানে আর কোন শক্তির উৎসারণ হয় না।
ইবনে সিনার মতে এসব শক্তি অন্ধভাবে পরিচালিত নয়। বরং এ পৃথিবীতে শৃ´খলা স্থাপনের এবং
মঙ্গল সাধনের জন্যই এগুলোর নির্গমন। এদের প্রত্যেকের নিজস্ব স্বাধীন পরিমন্ডল আছে জড় ও
আকারসহ। এই আকার এর আত্মা। মর্যাদা ও ক্রমের দিক দিয়ে এদের পার্থক্য আছে এবং
একটির চেয়ে অপরটি বেশি প্রয়োজনীয়। এসব শক্তির মাধ্যমেই এ বিশ্বের বৈচিত্র্যময় বস্তুর সৃষ্টি
হয়েছে। এখানে উল্লেখ্য যে, প্রথম শক্তি বা স্বয়ং খোদার নিকট থেকে উৎসারিত।
তাই খোদার সাথে এর সম্পর্ক প্রত্যক্ষ। কিন্তু অন্যান্য শক্তির সঙ্গে খোদার সম্পর্ক পরোক্ষ। খোদার
সর্বক্ষমতা থাকা সত্তে¡ও তিনি তাঁর সৃষ্ট শক্তির প্রক্রিয়ায় বা প্রকৃতি বিরোধী কোন কিছু করেন না।
ইবনে সিনার দর্শনের বিশেষত্ব এখানেই।
ইবনে সিনার অধিবিদ্যার আলোচনা শেষ করার পূর্বে আরেকটি প্রশ্নের উত্তর দেওয়া দরকার। প্রশ্নটি
হচ্ছেÑআল্লাহ যে প্রাকৃতিক পদ্ধতিতে বিশ্ব এবং এর মধ্যস্থিত বস্তুসমূহের সৃষ্টি করেছেন তাতে তিনি
বিশ্বের সমুদয় ব্যক্তি বা বস্তুর জ্ঞান কি রাখেন বা এদের সম্পর্কে তিনি কি সচেতন? ইবনে সিনা এর
উত্তরে বলেন যে, এ বিশ্ব সম্পর্কে আল্লাহ্র অনবহিত হওয়ার কোন কারণ নেই। বিশ্বের খুঁটিনাটি
বিষয়ে তাঁর জ্ঞান ব্যাপকতাময় (আসুমী)। মানুষের মনে বস্তুর জ্ঞান একের পর এক এবং প্রমাণের
মাধ্যমে আসে। কিন্তু খোদার নিকট জ্ঞান আসে এক সঙ্গে এবং দেশকাল নিরপেক্ষভাবে। অন্যদিকে
সমগ্র বিশ্ব সত্তার জন্য ঐশী সত্তার প্রেমানুভ‚তি থাকায় তিনি সব কিছুকে নিজস্ব পরিব্যাপ্তির মধ্যে
অন্তর্ভুক্ত করে রেখেছেন। বিশ্বের সব কিছুর জ্ঞান এর অন্তর্ভুক্ত। ইবনে সিনা নব্য প্লেটোবাদীদের
তত্তে¡র অনুসরণ করে বলেনÑ আল্লাহ আত্মপ্রকাশের প্রয়াসী বলে তাঁর সৌন্দর্য সমস্ত সৃষ্টির মধ্যে
প্রতিবিম্বিত হয়। এর ফলে সব কিছুই তাঁর জ্ঞানের মধ্যেই অস্তিত্ববান।
প্রাকৃতিক ধর্মতত্ত¡
ইবনে সিনার অধিবিদ্যা আলোচনার পর আসুন এবার আমরা তাঁর একটি নতুন ধারণার ব্যাপারে
কিছুটা চিন্তা করি। এ নতুন ধারণাটি হচ্ছে প্রাকৃতিক ধর্মতত্ত¡ সম্পর্কে।
প্রকৃতি থেকে সৃষ্টিকর্তার অস্তিত্ব প্রমাণের প্রচেষ্টা সম্পর্কীয় আলোচনা বা যুক্তির সাহায্যে পরম সত্তার
ধারণায় উপনীত হওয়ার প্রচেষ্টা সংক্রান্ত বিশ্লেষণকে প্রাকৃতিক ধর্মতত্ত¡ বলা যেতে পারে। প্রকৃতি থেকে
পরম সত্তার অস্তিত্বের প্রমাণ পাওয়ার বিষয়টির ইঙ্গিত পবিত্র কোরানের কোথাও কোথাও স্পষ্টভাবেই
করা হয়েছে। বিভিন্ন যুগের মুসলিম চিন্তাবিদগণ কোরানের এই ইঙ্গিত অনুসারে প্রকৃতি থেকে আল্লাহর
অস্তিত্বের প্রমাণ সংগ্রহের চেষ্টাও করেছেন। বর্তমান যুগের অনেক মুসলিম চিন্তাবিদ পদার্থ বিজ্ঞানকে
ইসলামিক ভাবধারায় অন্তর্ভুক্ত মনে করেন যারা প্রাকৃতিক বিজ্ঞান বা পদার্থ বিজ্ঞানের গবেষণায়
নিয়োজিত। তাঁরাও মুসলিম বলে অভিহিত। প্রাকৃতিক ধর্মতত্তে¡র প্রবক্তাদের মূল বক্তব্য হচ্ছে যে,
ধর্মের যৌক্তিক ব্যাখ্যা ও দর্শনের স্বাধীন চিন্তার মধ্যে মৌলিক কোন পার্থক্য নেই। বরং এ দুটি এক ও
অভিন্ন এবং উভয়েই পরমসত্তার ধারণায় উপনীত হতে সক্ষম।
খুব সম্ভবত ধর্ম ও দর্শনের মধ্যে সুষ্ঠু সম্পর্ক স্থাপনের তাগিদে বা প্রত্যাদেশের সাহায্যে অবতীর্ণ ধর্মের
ব্যাখ্যার ক্ষেত্রে যুক্তির প্রয়োজনীয়তা অনুধাবনযোগ্য করে তোলার মানসে মুসলিম দর্শনের ইতিহাসে
সর্বপ্রথম ইবনে সিনা তাঁর চিন্তাধারায় প্রত্যাদেশ ছাড়াও পরমসত্তার ধারণায় পৌঁছানো সম্ভব বলে চিন্তা
করার অবকাশের সৃষ্টি করেন। ফলে ইবনে সিনার পরবর্তী যুগে কেউ কেউ মনে করেন যে, আল্লাহ
যদি তাঁর নবীদের মাধ্যমে প্রত্যাদেশ প্রেরণ করে নিজেকে প্রকাশ নাও করতেন, তবুও দার্শনিকগণ,
মরমীসাধক ও বৈজ্ঞানিকগণ-প্রকৃতি, বিশ্বজগৎ ও মানবাÍাকে অনুধাবনের মাধ্যমে তাঁকে আবিষ্কার
করতে সক্ষম হতেন। আল্লাহর অস্তিত্ব প্রমাণ এবং তাঁকে জানার জন্য এটিই হচ্ছে অভিজ্ঞতাভিত্তিক
পদ্ধতি। প্রাকৃতিক ধর্মতত্ত¡বাদীদের মতে আল্লাহ হচ্ছেন বিশ্ব জাগতের ঐক্য বিধায়ক শক্তি এবং সত্য
দার্শনিকগণ সহজেই তা অনুধাবন করতে পারেন। মরমী সাধকগণ তন্ময়তার দ্বারা আল্লাহর পরিচয় ও
নৈকট্য লাভ করেন বা তাঁর সাথে সংযোগ স্থাপন করেন। ইবনে সিনার মতে মরমী সাধকদের আত্মা
নিশ্চিতরূপেই ঐশী আত্মায় অংশগ্রহণ করে থাকে।
উপরোক্ত চিন্তাধারাকে স্পষ্টরূপে অনুধাবন করার জন্য ইবনে সিনা ‘হাই ইবনে ইয়াকযান' শীর্ষক
একটি উপন্যাস লিখেন। পরবর্তী যুগে ইবনে তোফায়েল একই শিরোনামে আরও স্পষ্টরূপে উপরোক্ত
চিন্তাধারা প্রকাশের মানসে একটি উপন্যাস লিখেন। সে যাহোক, ইবনে সিনা তাঁর গ্রন্থে এ ধারণা
উপস্থাপন করার চেষ্টা করেন যে, ব্যক্তিজীবনের দুর্ভোগ ও দু:খ-কষ্ট মানুষের অন্তরে ঐশী আলো ও
কৃপা প্রত্যক্ষীভ‚ত করে এবং তাঁর আত্মার পরিশুদ্ধতা আনয়ন করে। এ ধরনের পরিশুদ্ধতা দ্বারা
পরমসত্তার ধারণা লাভ করা সম্ভব। এ ধারণার যথার্থতা প্রমাণের জন্য ‘হাই ইবনে ইয়াকযান' শীর্ষক
যে গল্পটির অবতারণা করেন তা সংক্ষেপে এরূপÑইবনে সিনা একদিন তাঁর কয়েকজন সঙ্গী সাথীর
সঙ্গে শহরের উপকণ্ঠে এলোমেলোভাবে ঘুরে বেড়াচ্ছিলেন। এ সময় হঠাৎ তিনি এক বৃদ্ধের সাক্ষাৎ
পান। বৃদ্ধের নাম হাই ইবনে ইয়াকযান। সিনা তাঁকে তাঁর সঙ্গে সীমাহীন ভ্রমণ পথের সাথী করে
নেওয়ার জন্য অনুরোধ করেন। কিন্তু বৃদ্ধ তাঁকে বলেন এ ভ্রমণ করা সিনার পক্ষে সম্ভব নয় কারণ,
সিনা তাঁর সঙ্গী সাথীদের ছেড়ে যেতে পারবেন না। এ গল্পে সিনা নিজেকে যৌক্তিক আত্মার (ৎধঃরড়হধষ
ংড়ঁষ) প্রতিভ‚রূপে এবং তাঁর সঙ্গী সাথীদেরকে সংবেদন ও প্রত্যক্ষণের প্রতীক হিসেবে প্রদর্শন করেন।
‘হাই ইবনে ইয়াকযান' সিনার গল্পে অতি মানবীয় আত্মা, যে আত্মা সাধনাবলে সংবেদীয় ও
প্রত্যক্ষণশীল জগতের ঊর্ধ্বে আরোহণ করে পরম সত্তার ধারণা লাভ করতে সক্ষম হয়েছে।
ইবনে তোফায়েল ইবনে সিনার এ শিরোনামটি এবং ‘সালমান ওয়া আবযাল' শিরোনামটি গ্রহণ করে
দার্শনিক উপন্যাস রচনা করেন। এতে এ ধারণা তুলে ধরেন যে, যৌক্তিক ও অনুমানলব্ধ জ্ঞান এবং
স্বজাত ও প্রত্যক্ষ জ্ঞানের মধ্যে স্বজাত ও সাক্ষাৎ জ্ঞানের মাধ্যমেই পরমসত্তার সজীব সংস্পর্শ লাভ
করা যায়। ইবনে সিনার ধারণালব্ধ উপাখ্যান থেকে পরবর্তীকালে ইবনে তোফায়েলসহ অনেকেই প্রাকৃতিক ধর্মতত্তে¡র ধারণাটি লালন করেন।
ইবনে সিনার অধিবিদ্যার পাঠশেষে সারসত্তা ও অস্তিত্ব, আবশ্যিক ও সম্ভাব্য সত্তা এবং নির্গমন তত্তে¡র
ওপর পৃথক পৃথক বিবরণ দিন।
পাঠোত্তর মূল্যায়ন
সত্য/মিথ্যা
১। ইবনে সিনার অধিবিদ্যা হল সত্তাকে সত্তা হিসেবে অধ্যয়ন। সত্য/মিথ্যা
২। ইবনে সিনার মতে সত্তা জাতি নয়। সত্য/মিথ্যা
৩। ইবনে সিনার মতে সত্তা চার প্রকার। সত্য/মিথ্যা
৪। ইবনে সিনার মতে সারসত্তা ও অস্তিত্ব একই। সত্য/মিথ্যা
৫। সিনার মতে প্রথম কারণই খোদা। সত্য/মিথ্যা
নৈর্ব্যক্তিক প্রশ্ন
১। ইবনে সিনার অধিবিদ্যার মূল উপাদান হল
(ক) সারসত্তা (খ) অস্তিত্ব
(গ) সত্তার ধারণা (ঘ) কোনটিই নয়।
২। ইবনে সিনার মতে প্রত্যেক বস্তুর বিশেষ বাস্তবতা হচ্ছে এর
(ক) অস্তিত্ব (খ) সারসত্তা
(গ) আবশ্যিকতা (ঘ) সম্ভাব্যতা।
৩। ইবনে সিনার মতে খোদা হচ্ছেন
(ক) উপাদান কারণ (খ) নিমিত্ত কারণ
(গ) রূপগত কারণ (ঘ) কোনটিই নয়।
৪। ইবনে সিনা চালক শক্তিকে বলেন
(ক) প্রথম শক্তি (খ) দ্বিতীয় শক্তি
(গ) সর্বশেষ শক্তি (ঘ) কোনটিই নয়।
৫। সিনার মতে জড় হচ্ছে
(ক) অস্থায়ী (খ) চিরস্থায়ী
(গ) চিরন্তন (ঘ) ক্ষণস্থায়ী।
রচনামূলক প্রশ্ন
১। ইবনে সিনার মতে অধিবিদ্যা কি? অধিবিদ্যার বিষয়বস্তু কি?
২। আবশ্যিক সত্তা এবং সম্ভাব্য সত্তার বিবরণ দিন।
৩। ইবনে সিনার সৃষ্টি-তত্তে¡র ব্যাখ্যা কর। তাঁর নির্গমন তত্ত¡টি কি সমর্থনযোগ্য।
উত্তরমালা
সত্য/মিথ্যা
১। সত্য ২। সত্য ৩। মিথ্যা ৪। মিথ্যা ৫। সত্য
নৈর্ব্যক্তিক প্রশ্ন
১। গ ২। খ ৩। খ ৪। গ ৫। গ

FOR MORE CLICK HERE
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস মাদার্স পাবলিকেশন্স
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস ১ম পর্ব
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস
আমেরিকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস
বাংলাদেশের ইতিহাস মধ্যযুগ
ভারতে মুসলমানদের ইতিহাস
মুঘল রাজবংশের ইতিহাস
সমাজবিজ্ঞান পরিচিতি
ভূগোল ও পরিবেশ পরিচিতি
অনার্স রাষ্ট্রবিজ্ঞান প্রথম বর্ষ
পৌরনীতি ও সুশাসন
অর্থনীতি
অনার্স ইসলামিক স্টাডিজ প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত
অনার্স দর্শন পরিচিতি প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত

Copyright © Quality Can Do Soft.
Designed and developed by Sohel Rana, Assistant Professor, Kumudini Government College, Tangail. Email: [email protected]