আল-ফারাবীর জীবনের প্রথম ভাগের বিবরণ দিন।

আল-কিন্দির পর দ্বিতীয় প্রবীণ এবং কারও মতে সর্বশ্রেষ্ঠ মুসলিম দার্শনিক আবু নসর আল-ফারাবী
মুসলিম দর্শনের ইতিহাসে দ্বিতীয় শিক্ষক হিসেবে পরিচিত। আল-কিন্দির দার্শনিক ধারা বজায় রেখে
তিনি মুসলিম দর্শনকে আরও সুষ্ঠু এবং পূর্ণরূপ দান করেন। আল-কিন্দির দুর্বোধ্য কতকগুলো বিষয়কে
তিনি বোধগম্য করে প্রকাশ করার ফলে ইবনে সিনার দর্শন আরও প্রাঞ্জল ও সমন¦য়ধর্মী করে তোলা
ইবনে সিনার পক্ষে সম্ভব হয়। আল-ফারাবীর কৃতিত্ব এবং খ্যাতির আরেকটি মূল কারণ হল
এ্যারিস্টটলের দর্শনের ব্যাখ্যা। তিনি এ্যারিস্টটলের যুক্তিবিদ্যাকে অতি সূক্ষèভাবে ব্যাখ্যা করেন এবং
অধিবিদ্যাকে প্রাঞ্জল করে প্রকাশ করেন। প্লেটোর দর্শনকেও তিনি বিভিন্নভাবে ব্যাখ্যা করে মুসলিম
দর্শনকে সমৃদ্ধ করেন। পদার্থবিদ্যা, অধিবিদ্যা, রাষ্ট্র ও সমাজ দর্শনে তাঁর অবদান ও প্রগাঢ় জ্ঞান
মুসলিম দর্শনকে নিঃসন্দেহে সমৃদ্ধ করেছে। > জীবনী
আবু নসর আল-ফারাবীর পূর্ণ নাম মোহাম্মদ ইবনে তারখান ইবনে উযলাখ আবু নসর আল-ফারাবী।
মধ্যযুগে তিনি আবু নসর নামে পরিচিত ছিলেন। তাঁর ল্যাটিন নাম ছিল আবু নাসের।
দার্শনিক আল-ফারাবীর জীবন সম্পর্কে কিছু আলোচনা করার পূর্বে একটি কথা উল্লেখ করা প্রয়োজন।
আল ফারাবীর যুগের প্রথা অনুযায়ী তিনি নিজের জীবন বৃত্তান্ত সম্পর্কে কোন জীবনীগ্রন্থ লিখেননি
বলেই জানা যায়। ইবনে সিনার শিষ্য আল-জুরজানী যেমন তাঁর শিক্ষক সিনা সম্পর্কে বিস্তারিত
জীবনীগ্রন্থ লিখেন, আল-ফারাবীর কোন শিষ্য সেভাবে কোন গ্রন্থ লিখেননি। ফলে জীবনী লেখকদের
নিকট তাঁর জীবনকথা সম্পর্কে তেমন বেশি তথ্য ছিল না। ওফায়াত আল-আয়াস গ্রন্থে তাঁর জীবনী
সম্পর্কে যেসব তথ্য দেওয়া হয়েছে সেগুলো সমালোচনার ঊর্ধ্বে নয় এবং অনেকেই এর যথার্থতা নিয়ে
প্রশ্ন তুলেছেন। সুতরাং আল-ফারাবীর জীবন প্রসঙ্গে যেসব তথ্য অস্পষ্ট এবং যেসব তথ্য এখনও
অজানা রয়ে গেছে সেগুলো সম্পর্কে ব্যাপক অনুসন্ধানের প্রয়োজনীয়তা অবশ্যই আছে।
ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ দশক থেকে তাঁর জীবনীগ্রন্থ, দর্শন সংক্রান্ত গ্রন্থ এবং যেসব গ্রন্থ এখনও
প্রকাশিত হয়নি সে সম্পর্কে বেশ প্রচেষ্টা চালানো হয়েছে। ১৯৫০ সালে তাঁর মৃত্যুবার্ষিকী পালন
উপলক্ষে কতিপয় তুর্কি গবেষক পাÐুলিপি আকারে রক্ষিত তাঁর কিছু গ্রন্থ আবিষ্কার করেন এবং আলফারাবী সম্পর্কে কিছু অসংগতিমূলক তথ্য চিহ্নিত করেন। কিন্তু এতদ্সত্বেও এখনও বলা যাবে না যে
তাঁর সম্পর্কে সব তথ্য পাওয়া গেছে বা জটিলতার অবসান হয়েছে। জানা গেছে বিশ্বের বিভিন্ন
ইসলামিক গ্রন্থাগারে তাঁর লিখিত গ্রন্থের পাÐুলিপি সীলমোহর করে রেখে দেওয়া হয়েছে। অনেকেরই
বিশ্বাস এগুলো প্রকাশিত হলে তাঁর জীবনী ও দর্শন সম্পর্কে আরও বিস্তারিত তথ্য জানা সম্ভব।
যাহোক, আমরা প্রাপ্ত তথ্য অনুসারে তাঁর সংক্ষিপ্ত জীবনী আলোচনা করার চেষ্টা করব।
আল-ফারাবীর জীবনকালকে মোটামুটি দু'ভাগে বিভক্ত করা যায়। প্রথমভাগে তাঁর জন্ম থেকে তাঁর
পঞ্চাশ বছর বয়সকাল অন্তর্ভুক্ত। দ্বিতীয় বিভাগে অন্তর্ভুক্ত পঞ্চাশ বছর বয়সের পর থেকে তাঁর মৃত্যু
পর্যন্ত। মোটামুটিভাবে এটা স্বীকৃত যে, তিনি জন্মসূত্রে তার্কিস বা তুর্কি ছিলেন। তাঁর পিতাও একজন
তুর্কি ছিলেন এবং তিনি সেনাধ্যক্ষ ছিলেন। কিন্তু তিনি নিজে কাজী বা বিচারক হিসেবে কিছুদিন কাজ
করেন। তৃতীয় হিজরী শতাব্দীর গোড়ার দিকে ইসলাম ফারাবে পৌঁছার পর সেখানে ইসলামী সভ্যতা
ও সংস্কৃতি দ্রæত প্রসার লাভ করে। আল-ফারাবী বাল্যশিক্ষা এ পরিবেশে আরম্ভ করেন। প্রখ্যাত
ভাষাতত্ত¡বিদ, আল-সিহাহ্'র সংকলক আল-জাওহারী তাঁর সমকালীন ছিলেন। আল-ফারাবী শৈশবে
ধর্মীয় ও ভাষাতত্তে¡ ব্যাপক শিক্ষালাভ করেন। তিনি ইসলামী আইন, হাদিস এবং কোরানের ব্যাখ্যা ও
বিশ্লেষণ অধ্যয়ন করেন এবং আরবী, তুর্কি ও ফারসি ভাষাতেও পারদর্শিতা লাভ করেন। এছাড়া ইবনে
মাল্লিকানের বর্ণনা অনুযায়ী তিনি ‘সত্তর'টি ভাষায় কথা বলতে পারতেন। কারও কারও মতে তিনি গ্রীক
ভাষাও আয়ত্ত করেন। কিন্তু কেউ কেউ আবার এ ব্যাপারে সন্দেহ পোষণ করেন। সাফসাতাহ্
(সফিস্ট্রি) শব্দটির ব্যাখ্যা তিনি যেভাবে করেনÑ তা থেকে অনেকেই অনুমান করেন যে, তিনি গ্রীক
ভাষা জানতেন না। তাঁর শিক্ষা জীবনকালে তিনি তাঁর অবস্থানস্থলে প্রাপ্ত যৌক্তিক জ্ঞান আহরণে
কোনসময় দ্বিধা করেননি। এজন্য তিনি অংকশাস্ত্র ও দর্শন পাঠ শুরু করেন অনেক পূর্ব থেকেই।
অন্যান্য দার্শনিক বিশেষত আল-কিন্দির মত তিনি চিকিৎসা শাস্ত্রের প্রতি তেমন আগ্রহ দেখাননি। তাঁর
নিজ শহরে দর্শন সংক্রান্ত শিক্ষালাভ করার পর তিনি যখন দর্শনের প্রতি অধিক আকর্ষিত হয়ে পড়েন,
তখন তিনি যা শিখেছিলেনÑতাতে আর সন্তুষ্ট থাকতে পারেননি। গভীর জ্ঞান অর্জনের তাগাদায় উদ্দীপ্ত
হয়ে তিনি তাঁর নিজ শহর ত্যাগ করেন এবং জ্ঞান অর্জনের জন্য বিভিন্ন স্থান পরিভ্রমণ করেন।
আল-ফারাবী দর্শনচর্চায় সম্পূর্ণ মনোনিবেশ করার পূর্বে বিভিন্ন বিষয় অধ্যয়ন করেন। ইবনে
খাল্লিকানের বর্ণনা অনুযায়ী তিনি যথাক্রমে এ্যারিস্টটলের ‘ডি এ্যানিমা' গ্রন্থটি দু'শত বার এবং পদার্থ
বিষয়ক গ্রন্থটি চল্লিশবার অধ্যয়ন করেন। অধ্যয়নের প্রতি তাঁর নিষ্ঠা ও প্রচেষ্টার আরও অনেক বিবরণ
জানা যায়।
আল-ফারাবীর দ্বিতীয় পর্যায়ের জীবন শুরু হয়Ñ তাঁর পঞ্চাশ বৎসর বয়সের পর থেকে। এ সময় সারা
বিশ্বে বাগদাদ নগরী শিক্ষার এক অনন্য কেন্দ্র ছিল। তিনি এজন্য বাগদাদ গমন করেন এবং দীর্ঘদিন
যাবৎ বিদ্যা চর্চায় নিয়োজিত থাকেন। তিনি বাগদাদে গমন করার পর সেখানে অনেক দার্শনিক এবং
অনুবাদকের সাক্ষাৎ লাভ করেন। এঁদের মধ্যে ইবনে মাত্তা, কুয়াইরী এবং ইয়্যুহান্না বিন হাইলাস
অত্যন্ত খ্যাতিমান যুক্তিবিদ হিসেবে পরিচিত ছিলেন। এঁদের অবস্থানের কারণেই খুব সম্ভবত বাগদাদ
এসময় যুক্তিবিদ্যার প্রধান কেন্দ্রে পরিণত হয়। যাহোক, ইবনে আবী ওসায়বিয়াহ্র মতে, আল-ফারাবী
ইয়্যুহান্না বিন হাইলাসের কাছে যুক্তিবিদ্যা অধ্যয়ন শুরু করেন এবং কিছুদিন তাঁর নিকট থেকে
যুক্তিবিদ্যা শিক্ষালাভ করেন। এক সময় তিনি তাঁর শিক্ষক ইয়্যুহান্নাকে যুক্তিবিদ্যার জ্ঞানের দিক দিয়ে
ছাড়িয়ে যান। সে সময়ের সবচেয়ে প্রখ্যাত যুক্তিবিদ্যাবিশারদ ইবনে ইউনুসকেও তিনি ছাড়িয়ে যান।
এ সময়ে এ্যারিস্টটলের যুক্তিবিদ্যায় পুরোপুরি দক্ষতা ও জ্ঞানলাভ করায় তিনি “দ্বিতীয় শিক্ষক” বা
মুয়াল্লিমুস সাথী হিসেবে পরিচিত ও খ্যাত হন। তাঁর শিষ্যদের মধ্যে বিখ্যাত যুক্তিবিদ ইয়াইয়া ইবনে
আদী অন্যতম।
আল-ফারাবী বাগদাদে বিশ বৎসর অতিবাহিত করেন। খুব সম্ভবত রাজনৈতিক গোলযোগের কারণেই
তিনি বাগদাদ ত্যাগ করেন। জানা যায়, বাগদাদে অবস্থানকালে তিনি অঙ্কশাস্ত্রে শিক্ষালাভ করেন।
তিনি মিউজিকের ওপরও দু'একটি পুস্তক রচনা করেন। বাগদাদ থেকে তিনি আলেন্নো গমন করেন।
এই সময় আলেন্নো জ্ঞান-বিজ্ঞানের একটি বিখ্যাত কেন্দ্র ছিল। আল-ফারাবী হামাদাসী রাজকুমার
সাইফ-আদ-দৌলার সঙ্গে পরিচিত হন। জানা যায়, রাজকুমার দৌলা আল-ফারাবীকে অত্যন্ত শ্রদ্ধার
চোখে দেখতেন। বিদ্যানুরাগী এই রাজকুমারের দরবারে এ সময় বহু কবি, ভাষাতত্ত¡বিদ, দার্শনিক
এবং আরও অনেক পন্ডিত সমবেত হন। আরবদের প্রতি বিশেষ সহানুভ‚তি থাকা সত্তে¡ও, কোন প্রকার
জাতীয় বৈষম্য বা কুসংস্কার এ দরবারের বৈদগ্ধ সাংস্কৃতিক পরিবেশকে দূষিত করতে পারেনি।
এখানে আরব, তুর্কি এবং পার্সিয়ান পন্ডিতগণ একত্রে বসে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে তর্ক-বিতর্ক করতেন।
কোন কোন বিষয়ে তাঁরা একমত হতেন আবার কোন কোন বিষয়ে দ্বিমত পোষণ করতেন। এই
দরবারে আল-ফারাবী একজন স্কলার এবং সত্য-অনুসন্ধানী হিসেবে অবস্থান করতেন। রাজদরবারের
জাকজমকপূর্ণ জীবন ও খ্যাতি তাঁর চরিত্রের ওপর কোন প্রভাব ফেলতে পারেনি। তিনি বরং এখানে
একজন সুফীর জীবন যাপন করতেন। জানা যায়, সরকারী কোষাগার থেকে তাঁকে যে ভাতা দেওয়া
হতো তা থেকে তিনি প্রতিদিনের জন্য মাত্র চার দিরহাম গ্রহণ করতেন। তিনি প্রখ্যাত চিন্তাবিদ এবং
শিক্ষক হিসেবে তাঁর কর্মে বিমুগ্ধ থাকতেন। এ সময় তিনি তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থের মধ্যে বেশ কয়েকটি
গ্রন্থ রচনা করেন।
আল-ফারাবী জীবনের এ পর্যায়ে কিছু ছোটখাট ভ্রমণ ছাড়া তেমন ব্যাপকভাবে আর কোথাও ভ্রমণ
করেননি। ইবনে আবি উসাইবিয়াহ্র মতে, আল-ফারাবী মিশর সফর করেন তাঁর জীবনের শেষদিকে।
এ সময় মিশর এবং সিরিয়ার মধ্যে অত্যন্ত সুসম্পর্ক ছিল। আল-ফারাবী এরপর ৩৩১/৯৫০ খ্রিস্টাব্দের
ডিসেম্বর মাসে ৮১ বৎসর বয়সে দামেস্কে ইন্তেকাল করেন। আমির সাইফ-উদ-দৌলার দরবারে তিনি
এমন সম্মানিত ও খ্যাতিমান ব্যক্তি ছিলেন যে, তাঁর মৃত্যুর পর স্বয়ং আমির সাইফ তাঁর লোকজনসহ
আল-ফারাবীর দাফন-কাফন অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন। তাঁকে উমাইয়া কবরগাহে খলিফা মাবিয়ার পার্শ্বে সমাহিত করা হয়।
আল-ফারাবীর গ্রন্থাবলী
আল-কিফতী এবং ইবনে আবী উসাইবিয়ার মতে আল-ফারাবী সত্তরখানা গ্রন্থ রচনা করেন। তাঁর
সমকালীন দার্শনিক আল-কিন্দি এবং আল-রাজীর তুলনায় তাঁর গ্রন্থের সংখ্যা কম মনে হয়। তবে
একথা মনে রাখা ভাল যে, জীবনী লেখকদের মতে তাঁর একই গ্রন্থের শিরোনাম দু'বার বা তারও
অধিকবার দেওয়া হয়েছে। অন্য ভাষ্য অনুযায়ী তাঁর গ্রন্থের সংখ্যা একশতের অধিক।
আল-ফারাবীর গ্রন্থাবলীকে দু'ভাগে ভাগ করা যেতে পারে। প্রথম ভাগে কেবল যুক্তিবিদ্যার আলোচনা
অন্তর্ভুক্ত এবং দ্বিতীয় বিভাগে অন্য সব বিষয়ের ওপর লিখিত গ্রন্থ অন্তর্ভুক্ত। যুক্তিবিদ্যা সংক্রান্ত
গ্রন্থগুলি এ্যারিস্টটলের অর্গানন গ্রন্থের বিভিন্ন অংশ সম্পর্কীয়। এসব গ্রন্থ এখনও পাÐুলিপি আকারে
রক্ষিত আছে। দ্বিতীয় বিভাগের গ্রন্থগুলো অন্যান্য বিভিন্ন বিষয়ের ওপর লিখিত। এসব বিষয়ের মধ্যে
আছে দর্শনের বিভিন্ন শাখা, পদার্থবিদ্যা, অংকশাস্ত্র, অধিবিদ্যা, নীতিবিদ্যা এবং রাজনৈতিক দর্শন।
দ্বিতীয় বিভাগের অন্তর্ভুক্ত বিষয়ে অনেক গ্রন্থ পাওয়া যায়। এর ফলে আল-ফারাবীর দর্শনের বিভিন্ন
দিকের স্পষ্ট ধারণা পাওয়া সম্ভব।
ইবনে খাল্লিকানের মতে আল-ফারাবীর প্রায় সমস্ত গ্রন্থ বাগদাদ এবং দামেস্কে লিখা হয়। কারণ তাঁর
পঞ্চাশ বছর বয়সের পূর্বে তিনি কোনও গ্রন্থ লিখেছেন বলে জানা যায় না। জীবনী লেখকরা এ
ব্যাপারে একমত। কোন কোন পÐিতব্যক্তি তাঁর গ্রন্থের ক্রমানুযায়ী তালিকা তৈরি করার চেষ্টা করেন।
তবে এখানে উল্লেখযোগ্য বিষয় হলÑ তিনি তাঁর জীবনের শেষ ত্রিশ বছরে তাঁর সমস্ত গ্রন্থ রচনা করেন
এবং যখন তিনি গ্রন্থ রচনা শুরু করেন তখন তিনি পুরোপুরি পরিপক্ক একজন চিন্তাবিদ। এ কারণে
তাঁর চিন্তার মধ্যে পুনরাবৃত্তি বা তেমন কোন পরিবর্তন লক্ষযোগ্য নয়।
আল-ফারাবীর লেখার ধরন বিশেষভাবে লক্ষণীয়। তাঁর গ্রন্থ সংক্ষিপ্ত এবং পরিচ্ছন্ন। তিনি তাঁর লেখায়
প্রতিটি শব্দ সজ্ঞানে বেছে নিয়ে তাঁর ধারণা এবং চিন্তাকে প্রকাশ করেন। এজন্য তাঁর লেখা গভীর
তাৎপর্যপূর্ণ। তিনি একই বিষয়ের পুনরাবৃত্তি এবং আড়ম্বরপূর্ণ শব্দাবলী পরিহার করেন। তাঁর লেখার
পদ্ধতিও তাঁর স্টাইলের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ। তিনি তথ্য সংগ্রহ করে সেগুলোকে সর্বজনীন রূপ দেন।
তিনি তথ্য সাজান, সমন¦য় সাধন করেন এবং বিশ্লেষণ করেন। তাঁর গ্রন্থে বিভাগ, উপ-বিভাগ এবং
শ্রেণীকরণÑ তাঁর লেখার বৈশিষ্ট্যের পরিচয় বহন করে। তাঁর কোন কোন গ্রন্থে বিভাগ এবং শ্রেণীকরণ
করাই মুখ্য উদ্দেশ্য বলে মনে হয়। তিনি প্রধানত এ্যারিস্টটলের গ্রন্থের উদ্দেশ্য এবং স্টাইলের বিষয়ে
বিশেষভাবে নিয়োজিত ছিলেন। মুসলিম দর্শনের ইতিহাসে সর্বপ্রথম বিজ্ঞানের শ্রেণীকরণ করেন আলফারাবী। আল-ফারাবীর লেখার আরেকটি বৈশিষ্ট্য হল পদের বিপরীত পদ খুঁজে বের করা। যেমন
নঞর্থক-এর বিপরীত সদর্থক এবং সত্তার বিপরীত অ-সত্তা ইত্যাদি।
আল-ফারাবীর গ্রন্থাবলী দশম এবং একাদশ শতাব্দীতে প্রাচ্যে ছড়িয়ে পড়ে। ঘটনাক্রমে এগুলো
পাশ্চাত্যেও পৌঁছে যায়। ফলে তাঁর আন্দলুসীয় কিছু শিষ্য ও ভক্ত হয়ে পড়েন। তাঁর কিছু গ্রন্থ হিব্র“
এবং ল্যাটিন ভাষায় অনূদিত হয় এবং খ্রিষ্টান ও ইহুদী স্কলাশটিসিজদের ওপর প্রভাব বিস্তার করে। এ
গ্রন্থগুলো ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষভাগে প্রকাশিত হয়। এসব গ্রন্থের মধ্যে বেশ কিছু গ্রন্থ ইউরোপের
বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত হয় এবং তাঁর জ্ঞানের পরিচয় সেসব দেশে ছড়িয়ে পড়ে।
আল-ফারাবী এ্যারিস্টটলের দর্শনচর্চায় অত্যন্ত আগ্রহী ছিলেন। তাঁর আগ্রহের পরিচয় পাওয়া যায়Ñ
এ্যারিস্টটলের গ্রন্থাবলীর ওপর তাঁর ভাষ্য রচনায়। তাঁর টীকা-ভাষ্যগুলো উচ্চস্তরের বৈদগ্ধময় ভাষ্য। কোনরকম যতিবিরতি ছাড়াই এ ভাষ্যগুলো পরবর্তীকালের গ্রীক দার্শনিক মতবাদসমূহের ধারা বজায়
রাখে। এসব টীকা-ভাষ্যগুলোর একটি সংকলন সাম্প্রতিককালে মূল্যবান ও বিশাল কলেবরে নির্ঘণ্টসহ
সম্পাদিত হয়েছে। এ্যারিস্টটলের অর্গানন, ফিজিক্স এবং নিকোম্যাকিয়ামন এথিক্স-এর ওপর তাঁর
তাৎপর্যপূর্ণ টীকাভাষ্য আছে। ওপরোক্ত গ্রন্থ ছাড়াও আল-ফারাবীর বিষয়ভিত্তিক গ্রন্থাবলীর একটি
সংক্ষিপ্ত পরিচয় দেওয়া হল। যুক্তিবিদ্যার ওপর তাঁর গ্রন্থগুলো হল:
(১) আত-তাওতি ‘আ ফিল-মানতিক
(২) কমেন্টারী অন অ্যানালাইটিকা পোস্টেরিয়া
(৩) কমেন্টারী অন-অ্যানালাইটিকা প্রিওয়া
(৪) কমেন্টারী অন দি ইসাগোগ
(৫) কমেন্টারী অন টপিকা
(৬) কমেন্টারী অন সফিস্টিকা
(৭) কমেন্টারী অন দি ইন্টারপ্রেটেশান
(৮) কমেন্টারী অন দি ক্যাটেগরিয় এবং
(৯) আশ্শের।
এ গ্রন্থগুলো ছাড়াও যুক্তিবিদ্যার ওপর তাঁর আরও ভাষ্য আছে বলে জানা যায়।
পদার্থবিদ্যার ওপর লিখিত গ্রন্থের মধ্যে যেসব গ্রন্থের পরিচয় পাওয়া যায় সেগুলো হলÑ অন ভাক্যুয়াম
এবং ফিল আকল বা ডি ইনটেলেক্ট। এগুলো তুর্কী, ল্যাটিন এবং জার্মান ভাষায় অনূদিত হয়েছে।
অধিবিদ্যার ওপর তাঁর প্রধান গ্রন্থ হলÑ ফিল ওয়াহিদ ওয়াল ওয়াহাদ বা অন দি ওয়ান এবং অ্যাবাউট
দি ইস্কপ অব এ্যারিস্টটল মেটাফিজিক্স। জার্মান এবং ইংরেজী ভাষায় এগুলো অনূদিত হয়েছে।
নীতিশাস্ত্রের ওপর তাঁর প্রধান গ্রন্থ হলÑ আত তানবীহ আলা সাবিলিস সা'আদা বা রিমাইনডার অব দি
ওয়ে অব হ্যাপিনেস। এটি মধ্যযুগে ল্যাটিন ভাষায় অনূদিত হয়েছে। ফুসলুল মাদানী বা
অ্যাফোরিজমস অব দি স্টেটসম্যান আরেকটি গ্রন্থ। এটি ল্যাটিন ভাষায় টীকাসহ অনূদিত হয়েছে।
ফিল মিল্লা আল ফাদিলা বা অন দি বেস্ট রিলিজিওয়ন তাঁর আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ।
রাষ্ট্রদর্শনের ওপর তাঁর গ্রন্থের সংখ্যাও কম নয়। তাঁর লিখিত যেসব গ্রন্থের সন্ধান পাওয়া গেছে
সেগুলো হলÑ (১) আল-মদিনাতুল ফাযিলাহ (আদর্শ রাষ্ট্র), (২) সিয়াসাতুল মাদানিয়া (নগর রাষ্ট্রের
শাসন ব্যবস্থা), (৩) আরাউয়াল আহ্লিল, (৪) জাওয়ামিনুস সিয়াসত, (৫) ইজতিমাউ মাদানিয়াত।
রাষ্ট্রদর্শনের ওপর উপরোক্ত গ্রন্থগুলো ছাড়াও প্লেটোর রিপাবলিক এবং এ্যারিস্টটলের দি পলিটিকস
গ্রন্থের অনুবাদ ও ভাষ্য তিনি রচনা করেন।
আল-ফারাবী বিভিন্ন বিষয়ের ওপর তাঁর চিন্তাধারা প্রকাশ করে গ্রন্থ রচনা করেন। অন্যান্য বিষয়ের
ওপর যেসব গ্রন্থ রচনা করেন সেগুলো হলÑ
(১) আল-জাম বায়ানার রায়ায়ি আল-হাকিম আফলাতুন আল-ইলাহি ওয়া আরিসতুতালিসÑ জার্মান
ভাষায় অনূদিত।
(২) উয়্যুনুল মাসাইল (প্রধান প্রশ্নসমূহ)।
(৩) ফুসুস আল-হিকাম।
(৪) জওয়াব মাসাই সুইলা আসহা (প্রশ্নের উত্তর)Ñ জার্মান ভাষায় অনূদিত।
(৫) কিতাব ইহসাইল উলুম (বিজ্ঞান সমূহের জরিপ)Ñল্যাটিন ভাষায় অনূদিত।
(৬) ফি তাহসিলিস সা'আদাÑইংরেজী ভাষায় অনূদিত।
(৭) অন দি ফিলোসফি অব প্লেটো (প্লেটোর দর্শনের ওপর)।
(৮) অন দি ফিলসফি অব এ্যারিস্টটল (এ্যারিস্টটলের দর্শনের ওপর)।
(৯) ফি মাসাদি আরা আহ্লিল মাদিনা আল-ফাসিলাÑইংরেজি ভাষায় অনূদিত।
(১০) ইন্ট্রোডাকশন টু লজিক (যুক্তিবিদ্যার ভ‚মিকা)।
(১১) অ্যাসাইনমেন্ট অব লজিক।
উপরোল্লিখিত গ্রন্থ ছাড়াও আল-ফারাবীর আরও অনেক গ্রন্থের পরিচয় ল্যাটিন ভাষায় অনুবাদের
মাধ্যমে পাওয়া যায়। এসব গ্রন্থে আল-ফারাবীর গবেষণা ও সমীক্ষার ফলাফল ও তাঁর সুদূরপ্রসারী
মনোভাবের সারাংশ ও সারমর্ম নিহিত আছে। এই গ্রন্থগুলো রচনার মাধ্যমে তাঁর লক্ষ্য ছিল
চিন্তাজগতে ও নিখুঁত সমাজ গঠনে দর্শনকে সার্বভৌম অবস্থান দান করা। এসবের সঠিক উপলব্ধিই
আল-ফারাবীর চিন্তাধারাকে সম্যক উপলব্ধি হল করার মূল চাবিকাঠি।
অনুশীলনী
১। আল-ফারাবীর জীবনীর সংক্ষিপ্ত বিবরণ দিন এবং চিন্তা করুন তিনি কোন ধরনের সাধক ছিলেন?
২। আল-ফারাবীর জীবনী আলোচনা করুন এবং তাঁর গ্রন্থাবলীর একটি বিবরণ দিন। তাঁর গ্রন্থাবলী সম্পর্কে আপনার মন্তব্য থাকলে লিখুন।
পাঠোত্তর মূল্যায়ন
সত্য/মিথ্যা
১। আল-ফারাবী একজন পার্সিয়ান ছিলেন। সত্য/মিথ্যা
২। আল-ফারাবীর বয়স ছিলÑ একানব্বই বৎসর। সত্য/মিথ্যা
৩। আল-ফারাবীকে তৃতীয় শিক্ষক বলা হয়। সত্য/মিথ্যা
৪। আল-ফারাবী এ্যারিস্টটলের গ্রন্থের প্রধান ভাষ্যকার। সত্য/মিথ্যা
৫। রাষ্ট্রদর্শনের ওপর আল-ফারাবীর কোন গ্রন্থ ছিল না। সত্য/মিথ্যা।
নৈর্ব্যক্তিক প্রশ্ন
১। আল-ফারাবীর জীবনকে ভাগ করা যায়
(ক) পাঁচ ভাগে (খ) দু'ভাগে
(গ) তিন ভাগে। (ঘ) ওপরের কোনটিই নয়।
২। আল-ফারাবীর পিতা ছিলেন একজন
(ক) ব্যবসায়ী (খ) লেখক
(গ) সেনাধ্যক্ষ (ঘ) নাবিক
৩। রাষ্ট্রচিন্তায় আল-ফারাবী ছিলেন
(ক) প্লেটোর ভাবশিষ্য (খ) এ্যারিস্টটলের ভাবশিষ্য
(গ) আলেকজান্ডারের ভাবশিষ্য (ঘ) পোরফাইরির ভাবশিষ্য।
৪। আল-ফারাবীকে বলা হয়
(ক) সুফীসাধক (খ) ব্যবসায়ী
(গ) দ্বিতীয় শিক্ষক (ঘ) ভবঘুরে।
৫। আল-ফারাবী গ্রন্থ রচনা শুরু করেন
(ক) ত্রিশ বছর বয়সে (খ) পঞ্চাশ বছর বয়সে
(গ) ষাট বছর বয়সে (ঘ) আলেন্নোয় গমনের পর।
রচনামূলক প্রশ্ন
১। আল-ফারাবীর জীবনের প্রথম ভাগের বিবরণ দিন।
২। আল-ফারাবী কোন সময়ে গ্রন্থ রচনা শুরু করেন? গ্রন্থ রচনা শুরু করার পর থেকে তাঁর জীবনী
আলোচনা করুন।
৩। আল-ফারাবীর গ্রন্থাবলীর পরিচয় ও সংক্ষিপ্ত তালিকা দিন।
উত্তরমালা
সত্য/মিথ্যা
১। মিথ্যা ২। মিথ্যা ৩। মিথ্যা ৪। সত্য ৫। মিথ্যা।
নৈর্ব্যক্তিক প্রশ্ন
১। খ ২। গ ৩। ক ৪। গ ৫। খ।

FOR MORE CLICK HERE
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস মাদার্স পাবলিকেশন্স
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস ১ম পর্ব
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস
আমেরিকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস
বাংলাদেশের ইতিহাস মধ্যযুগ
ভারতে মুসলমানদের ইতিহাস
মুঘল রাজবংশের ইতিহাস
সমাজবিজ্ঞান পরিচিতি
ভূগোল ও পরিবেশ পরিচিতি
অনার্স রাষ্ট্রবিজ্ঞান প্রথম বর্ষ
পৌরনীতি ও সুশাসন
অর্থনীতি
অনার্স ইসলামিক স্টাডিজ প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত
অনার্স দর্শন পরিচিতি প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত

Copyright © Quality Can Do Soft.
Designed and developed by Sohel Rana, Assistant Professor, Kumudini Government College, Tangail. Email: [email protected]