আল-ফারাবীর যুক্তিবিদ্যা আলোচনা করুন। তাঁর মতে যুক্তিবিদ্যা কি দর্শনের হাতিয়ার? । আল-ফারাবীর ‘দশ চালিকাশক্তি তত্ত¡' ‘বুদ্ধিবৃত্তিতত্ত¡' সংক্ষেপে ব্যাখ্যা করুন

আবু নসর আল-ফারাবী বিচিত্র প্রতিভার অধিকারী ছিলেন। তিনি ছিলেন একদিকে গণিতবিদ এবং
অন্যদিকে পদার্থবিদ। আবার তিনি যুক্তিবিদ এবং দার্শনিক হিসেবে সামধিক পরিচিত। সেকালের
প্রচলিত ভাবধারা অনুযায়ী তিনি চিকিৎসাশাস্ত্র অধ্যয়ন করেন। কিন্তু চিকিৎসাকে কখনও পেশা হিসেবে
গ্রহণ না করে তিনি জ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় তাঁর দীর্ঘকালের প্রচেষ্টাকে কাজে লাগিয়ে অংকশাস্ত্রের মত
দুরূহ বিষয়ে তাঁর নিজস্ব ধ্যান-ধারণা প্রদান করেন। মধ্যযুগের যুক্তিবিদদের মধ্যে তিনি নিঃসন্দেহে
অন্যদের চেয়ে শ্রেষ্ঠ। সামগ্রিকভাবে তাঁর দর্শনের মধ্যে যুক্তিবিদ্যা এক বিরাট ভ‚মিকা পালন করেছে।
তিনি পরিণত বয়সে দার্শনিক চিন্তাধারায় মনোনিবেশ করেন বলে তাঁর দর্শনের মধ্যে তাঁর নিজস্ব ভাব
স্পষ্ট। এই পাঠে আমরা অংকশাস্ত্র, যুক্তিবিদ্যা এবং দর্শনের সংক্ষিপ্ত আলোচনার মাধ্যমে তাঁর সম্পর্কে
উক্ত দিকগুলোর সত্যতা অনে¦ষণ করব।
অংকশাস্ত্র
অন্যান্য শাস্ত্রের ন্যায় আল-ফারাবী অংকশাস্ত্রেও একজন পÐিত ছিলেন। গাণিতিক নিয়মে চিন্তাধারা
প্রকাশের প্রতি তাঁর বিশেষ আগ্রহের পরিচয় পাওয়া যায় তাঁর চিন্তাধারার সর্বত্রই। তিনি বিজ্ঞানের
বিভিন্ন শাখার আলোচনায়, এমনকি ব্যবহারিক দর্শনেও অংকের উদাহরণ দিয়ে চিন্তাধারা প্রকাশের
ক্ষেত্রে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির সূচনা করেন। আল-ফারাবী অংকশাস্ত্রকে বিভিন্ন বিভাগে ভাগ করেন।
বিভাগগুলো হলÑ
(১) গণিতবিদ্যা
(২) জ্যামিতি
(৩) সমস্যার বিভিন্ন দিকের আপাতসংযোগ বিদ্যা (
(৪) জ্যোতি:শাস্ত্র বা জ্যোতির্বিজ্ঞান
(৫) মিউজিক
(৬) গতিবিদ্যা
(৭) বলবিদ্যা
তাঁর মতে উপরোক্ত বিজ্ঞানসমূহের দু'টি অংশ আছে। এর একটি তাত্তি¡ক এবং আরেকটি ব্যবহারিক।
প্রতিটি বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে এ দু'টি বিভাগ অবশ্য নির্ভর করেÑ বিজ্ঞানের বিমূর্ত ধারণা বা নীতির সংগে
সংশ্লিষ্ট থাকার ওপর। আবার কলা বা বাণিজ্যের ক্ষেত্রে এ দু'টি অংশ নির্ভর করে এদের প্রয়োগের
ওপর। তিনি উদাহরণস্বরূপ তাত্তি¡ক জ্যোতির্বিজ্ঞানের কথা বলেন। এই বিদ্যা পার্থিব এবং স্বর্গীয়
(যবধাবহষু) দ্রব্যকে তিনটি প্রেক্ষিতে আলোচনা করে। এ প্রেক্ষিতগুলো হলÑ (১) আকার (ভরমঁৎব),
ভর এবং আপেক্ষিক দূরত্ব (২) এদের সাধারণ ও বিশেষ গতি সংযোগ এবং (৩) পৃথিবী এর প্রধান অংশের সম্পর্কে এদের অবস্থান।
অন্যদিকে ব্যবহারিক জ্যোতির্বিজ্ঞান এমন পদ্ধতির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট যেখানে গ্রহগুলোর গতি পরিভাষণের
(ঢ়ৎড়মহড়ংরং) সূচক হিসেবে কাজ করে। এর অন্য কাজটি হচ্ছে পৃথিবীতে ঘটনাবলীকে বুঝার ইঙ্গিত
নির্দেশ করা।
আল-ফারাবী জ্যোতির্বিজ্ঞানী আবু ইসহাক ইব্রাহিম বিন আব্দুল্লাহ আল-বাগদাদীর অনুরোধে
জ্যোতির্বিজ্ঞান সম্পর্কে একটি গ্রন্থ রচনা করেন। এই গ্রন্থে তিনি ধৈর্যের সঙ্গে জ্যোতির্বিজ্ঞানকে একটি
বৈধ শাখা বলে প্রমাণ করেন। তাঁর পর্যবেক্ষণ অনুসারে পৃথিবীর ঘটনাবলী হয় বিশেষ কতকগুলো
কারণ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত যাকে নিশ্চিত বলে ধরা যায়, না হয় এগুলো দৈবাৎ বা আকস্মিক এবং এদেরকে
নিশ্চিত বলে ধরে নেওয়ার কোন কারণ নেই। স্বর্গীয় দ্রব্য (যবধাবহষু নড়ফরবং) পার্থিব ঘটনাবলীর
ওপর এক প্রকারের কারণিক (পধঁংধষ) প্রভাব বিস্তার করে। এ প্রভাব দু' ক্যাটেগরির (প্রকারের); এর
প্রথম ক্যাটেগরিতে ঐসব প্রভাব অন্তর্ভুক্ত যেগুলোকে জ্যোতি:শাস্ত্রীয় গণনার মাধ্যমে নির্ধারণ করা
যায়। উদাহরণস্বরূপ তিনি বলেনÑ যেমন পৃথিবীর কোন কোন অঞ্চলের সূর্যের তুলনামূলক নিকটবর্তী
অবস্থানে হওয়ায় অপেক্ষাকৃত উষ্ণ অঞ্চলে পরিণত হওয়া। অন্য ক্যাটেগরিকে নির্ধারণ করা যায় না।
দ্বিতীয় প্রকার প্রভাবের ক্ষেত্রে জ্যোতির্বিজ্ঞানীগণ পূর্বলক্ষণ এবং কল্পনাপ্রসূত গণনা নিয়ে
সন্তুষ্ট হন কিন্তু এটি বিশ্বাসজনক নয়। আল-ফারাবী আরও মনে করেন যে, জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের মধ্যে
যারা বিখ্যাত তাঁরা নিজেদের জ্যোতি:শাস্ত্রীয় আবিষ্কার অনুসারে তাঁদের নিজস্ব কর্মকাণ্ড সমাধা করতে
তেমন প্রবণতা দেখান না। ফলে আমরা ধারণা করতে পারি যে, তাঁদের পরিভাষণ
মুনাফা লাভের জন্যই করা হয়ে থাকে।
আল-ফারাবীর অংক বা গণিত শাস্ত্রের জ্ঞানের একটি শাখা সম্পর্কে আলোচনা করে আমরা অনুধাবন
করতে পারছি যে, তিনি গণিত শাস্ত্রের সাতটি বিভাগ নিয়েই গবেষণা করেছেন। তাঁর গণিতশাস্ত্রের
জ্ঞানের পরিচয় বহন করে তাঁর পদার্থবিদ্যার জ্ঞানÑকারণ এ দু'টি বিজ্ঞান ওতপ্রোতভাবে জড়িত।
আংশিক নিয়মে চিন্তাধারা প্রকাশ করার সাথে তাঁর সামগ্রিক চিন্তাধারাও অত্যন্ত সামঞ্জস্যপূর্ণ এবং স্বচ্ছ।
আল-ফারাবীর অংকশাস্ত্রের সঙ্গে তাঁর যুক্তিবিদ্যারও ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বিদ্যমান। আমরা এখন তাঁর যুক্তিবিদ্যা আলোচনা করে এর সত্যতা অনুধাবনের চেষ্টা করব।
আল-ফারাবীর যুক্তিবিদ্যা
মুসলিম দার্শনিকদের মধ্যে আল-ফারাবীকে শ্রেষ্ঠতম যুক্তিবিদ বললে অত্যুক্তি করা হবে না। তাঁকে
বিশ্বের যুক্তিবিদদের মধ্যে অন্যতম শ্রেষ্ঠ যুক্তিবিদ বলা হয়। যুক্তিবিদ্যায় তাঁর জ্ঞানের গভীরতার
পরিমাপ করা যেতে পারেÑ যুক্তিবিদ্যার ওপর লিখিত তাঁর গ্রন্থের সংখ্যা থেকে। তিনি এ্যারিস্টটলের
যুক্তিবিদ্যার ওপর বহু ভাষ্য এবং টীকা রচনা করেন। যুক্তিবিদ্যা সম্পর্কিত তাঁর গ্রন্থগুলো হলÑ
(১) কমেন্টারী অন অ্যানলাইটিকা পোস্টেরিয়া
(২) কমেন্টারী অন অ্যানালাইটিকা প্রায়োরিয়া (
(৩) কমেন্টারী অন দি ইসাগোগ
(৪) কমেন্টারী অন টপিকা বুকস-
(৫) কমেন্টারী অন সফিস্টিকা (
(৬) কমেন্টারী অন দি ইন্টারপ্রেটেশন
(৭) কমেন্টারী অন দি ক্যাটেগরি
(৮) ন্যাশেসারী অ্যান্ড একজিসটেনসিয়াল প্রেমিজেস
(৯) প্রপোজিশনস অ্যান্ড সেলোজিমস্ এমপ য়েড ইন অল সায়েন্সেস -
আল-ফারাবীর মতে যুক্তিবিদ্যা ভাষাবিজ্ঞান এবং বিশেষভাবে ব্যাকরণ থেকে পৃথক। যুক্তিবিদ্যা প্রত্যয় এবং প্রত্যয়কে অনুশাসনকারী নিয়মসমূহ নিয়ে আলোচনা করে। ভ্রান্তি
থেকে দূরে থাকার উপায়সমূহও এর অন্তর্ভুক্ত। তিনি মনে করেন, এ সমস্ত নিয়মের সঙ্গে পরিচিত
হওয়া এবং এগুলোকে মেনে চলা অপরিহার্য। তিনি আরও বলেন যে, যুক্তিবিদ্যা “বাহ্যিক” ও
“অভ্যন্তরীণ” বক্তব্যের নিয়মের সঙ্গেও সংশ্লিষ্ট। কারণ এসব নিয়ম মানবজাতির সমস্ত ভাষার
ব্যাপারে সর্বজনীনভাবে প্রযোজ্য এবং এগুলো ব্যাকরণের মত গতানুগতিক নয়। তিনি স্পষ্ট ও
বৈজ্ঞানিকভাবে প্রকাশের জন্য যুক্তিবিদ্যাকে মোট আটটি ভাগে ভাগ করেন। এ ভাগগুলো নিæরূপÑ
১। দি ক্যাটেগরিজ ঃ এগুলো প্রত্যয়ের নিয়ম এবং একক পদের ব্যবহার সম্পর্কিত।
২। পেরী হারমেনিয়াস ঃ এগুলো দু' বা ততোধিক পদের সমন¦য়ে গঠিত বাক্য সম্পর্কে আলোচনা
করে।
৩। অ্যানালাইটিকা প্রায়োরিয়া ঃ পাঁচ প্রকারের যুক্তিতে ব্যবহৃত ন্যায়-অনুমানের নিয়ম সম্পর্কিত
আলোচনা। যুক্তিগুলো হচ্ছেÑ (১) প্রতিপাদিত (২) দ্বান্দি¡ক (৩) সফিসটিক্যাল (৪) রেটোরিক্যাল
এবং (৫) কাব্যিক।
৪। অ্যানালাইটিকা পোস্টেরিয়াঃ প্রতিপাদিত প্রমাণের নিয়ম এবং বৈজ্ঞানিক জ্ঞান প্রকৃতির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট।
৫। টপিকা ঃ দ্বান্দি¡ক প্রশ্ন ও উত্তরের সঙ্গে জড়িত।
৬। সফিসটিকা বা ‘ভ্রান্ত জ্ঞান' ঃ ভ্রান্ত জ্ঞান এবং এ জ্ঞান থেকে দূরে থাকার উপায় নিয়ে আলোচনা
করে।
৭। রেটোরিকা ঃ প্ররোচনার বিভিন্ন প্রকার সম্পর্কীয় আলোচনার সঙ্গে যুক্ত।
৮। পোয়েটিকা ঃ কাব্য রচনার নিয়ম এবং বিভিন্ন ধরনের কাব্যিক বক্তব্যের সঙ্গে সম্পর্কিত।
আল-ফারাবীর যুক্তিবিদ্যার উপরোক্ত আলোচনার পর তাঁর যুক্তিবিদ্যায় আলোচিত বিষয়বস্তু সম্পর্কে
অবহিত হওয়া দরকার। আসুন, এবার আমরা এদিকে নজর দেই।
যুক্তিবিদ্যার বিষয়বস্তু
আল-ফারাবীর মতে, যুক্তিবিদ্যা কেবলমাত্র বৈজ্ঞানিক চিন্তনের বিশ্লেষণই নয়, এটি জ্ঞানতত্তে¡রও
আলোচনা করে। তাঁর মতে, যুক্তিবিদ্যা ব্যাকরণ থেকে স্বতন্ত্র। কারণ ব্যাকরণ কেবলমাত্র কোন এক
শ্রেণীর লোকের ভাষার মধ্যে সীমাবদ্ধ, কিন্তু যুক্তিবিদ্যা মানবজাতির সামগ্রিক চিন্তাধারায় ভাষার
প্রকাশকে নিয়ন্ত্রণ করে। বক্তব্যের সরলতম উপাদান থেকে এটা জটিলতম আকারের দিকে এবং শব্দ
থেকে বাক্যে এবং যুক্তিবিন্যাসের দিকে অগ্রসর হয়।
আল-ফারাবী যুক্তিবিদ্যাকে বাস্তবতার সঙ্গে সম্পর্কিত বিষয়বস্তু অনুযায়ী দু'ভাগে বিভক্ত করেন। এর
প্রথম ভাগে প্রত্যয় বা ধারণা এবং সংজ্ঞা (তাসাব্বুর) সংক্রান্ত মতবাদ অন্তর্ভুক্ত। দ্বিতীয় ভাগে
অবধারণ, অনুমান এবং প্রমাণ (তাসদিক) সংক্রান্ত মতবাদ অন্তর্ভুক্ত। সংজ্ঞার সঙ্গে ধারণা বাহ্যিক
সান্নিধ্যের (পাশাপাশি অবস্থান) মাধ্যমে শ্রেণীভুক্ত হলেও, বাস্তবতার সঙ্গে ধারণাগুলোর কোন সম্পর্ক
নেই। অর্থাৎ এ ধারণাগুলো সত্যও নয় আবার মিথ্যাও নয়। আল-ফারাবী এসব ‘ধারণার' মধ্য থেকে
সরলতম মানসিক আকারের ধারণাসমূহকে স্বীকার করেন। এ ধারণাসমূহের মধ্যে প্রথম প্রকার হলÑ
সংবেদীয় প্রত্যক্ষণ থেকে উদ্ভূত বা জ্ঞাত একক বস্তুসমূহের প্রতিবেদন। দ্বিতীয় প্রকার ধারণা হল
ঐসব ধারণা যা প্রথমটি থেকে (অর্থাৎ প্রতিবেদন থেকে) মনের ওপর মুদ্রিত হয়। এ ধরনের ধারণার
উদাহরণ হল আবশ্যিক, বাস্তব এবং সম্ভাব্যের ধারণা। এরূপ প্রতিবেদন ও ধারণাসমূহ তাৎক্ষণিকভাবে
নিশ্চিত। কোন মানুষের মন এগুলোর দিকে পরিচালিত হতে পারে এবং তার আত্মা এগুলোর ব্যাপারে
সচেতন হয়ে ওঠতে পারে; কিন্তু এগুলো তার নিকট প্রতিপাদিত হতে পারে না; কিংবা যা জ্ঞাত তা
থেকে আহরণ করে এগুলোকে ব্যাখ্যাও করা যায় না। কারণ এ ধারণাগুলো নিজেরাই সর্বোচ্চ মাত্রার
নিশ্চয়তাসহ স্পষ্ট।
আল-ফারাবীর মতে, অবধারণ হচ্ছে প্রতিবেদন বা ধারণার সংযোগকরণের ফল। এসব অবধারণ সত্য
বা মিথ্যা হতে পারে। এ জাতীয় অবধারণের ভিত্তির জন্য অনুমান ও প্রমাণের প্রক্রিয়ার মাধ্যমে এমন
কোন যুক্তিবাক্যে উপনীত হতে হবে যা আদিতে বোধের মধ্যে নিহিত, তাৎক্ষণিকভাবে স্পষ্ট এবং
স্বত:সমর্থিত। ফারাবীর মতে সমস্ত বিজ্ঞানের মত এরূপ মৌলিক যুক্তিবাক্য বা স্বত:সিদ্ধ, অধিবিদ্যা,
গণিতশাস্ত্র এবং নীতিশাস্ত্রের জন্য অত্যাবশ্যক।
আল-ফারাবী বলেন, প্রমাণতত্তে¡র সাহায্যে প্রারম্ভে জ্ঞাত ও সুপ্রতিষ্ঠিত কোন কিছু থেকে পূর্বে অজ্ঞাত
কোন বস্তুর জ্ঞানে উত্তরণ করা যায়। তাঁর মতে, এই প্রমাণ তত্ত¡ই হচ্ছে যথার্থ যুক্তিবিদ্যা। প্রত্যয়ের
সঙ্গে পরিচিতি, অবধারণে এদের সমন¦য় এবং অনুমানে সমন¦য় যুক্তিবিদ্যার কেবলমাত্র ভ‚মিকার সূচনা
করে। এগুলো ক্যাটেগরিজ, হারমেনিউটিকস এবং ফার্স্ট অ্যানালাইটিসের কাজ। কিন্তু প্রমাণ তত্তে¡র
প্রধান লক্ষ্য হল সর্বজনীনভাবে বৈধ এবং প্রয়োজনীয় বিজ্ঞানের মানদন্ড (ঘড়ৎসং) অথবা নীতিসমূহ
নিশ্চিত করা। তাঁর মতে, দর্শনেরও এরূপ মানদন্ড ও নীতির আবশ্যকতা আছে।
আল-ফারাবীর মতে এরকম অবস্থায় এখানে বিরোধবাধক নীতি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং এসব নীতিকে
তিনি সর্বোচ্চ নীতি বলে মনে করেন। একটি একক জ্ঞানীয় ক্রিয়ার দ্বারা আমরা সত্য এবং যৌক্তিক
বাক্যের অনিবার্যতার বিষয়ে অবহিত হতে পারি এবং এর বিরুদ্ধ বাক্যের মিথ্যা ও অসম্ভাব্যতা সম্বন্ধেও
এ নিয়মের সাহায্যে অবহিত হওয়া যায়। একথা থেকে বুঝা যায়, আল-ফারাবী বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি
হিসেবে এ্যারিস্টটলীয় “পলিটমি” (ঢ়ড়ষরঃড়সু) পদ্ধতির চেয়ে প্লেটোর “ডিকোটমি” পদ্ধতিকে
অধিকতর শ্রেয় মনে করেন।
সে যাহোক, আল-ফারাবী প্রমাণ তত্তে¡র আকারগত বা প্রাতিষ্ঠানিক দিক নিয়ে সন্তুষ্ট নন। এ তত্ত¡
পদ্ধতি-বিজ্ঞানের (সবঃযড়ফড়ষড়মু) চেয়েও আরও কিছু উচ্চস্তরের। পদ্ধতি-বিজ্ঞান কেবলমাত্র সত্য
পথের ইঙ্গিত দেয়। এ তত্ত¡ সহানুমানের উপাদান হিসেবে কেবলমাত্র অবধারণ নিয়ে আলোচনা করে
না, এটি বিশেষ বিজ্ঞানের প্রেক্ষিতে সত্যেরও অনুসন্ধান করে। ফলে এ তত্ত¡ কেবলমাত্র দর্শনের
পরিপূরকই নয়, বরং দর্শনের অপরিহার্য অংশ। এসব কারণে আল-ফারাবী যুক্তিবিদ্যাকে দর্শনের অঙ্গ
বলেন; কিন্তু তাঁর মতে, যুক্তিবিদ্যা স্বয়ং দর্শন নয়।
উপরোক্ত আলোচনা থেকে আমরা লক্ষ্য করছি যে, প্রমাণতত্ত¡ শেষাবধি নিশ্চয়াত্মক সত্যের সঙ্গে
সংগতি রেখে নিশ্চয়াত্মক জ্ঞানে পরিণত হয়। কিন্তু ফারাবীর মতে সম্ভাব্যতার মধ্য থেকে আমরা
আবার সম্ভাব্য জ্ঞানও লাভ করতে পারি। সম্ভাব্যতার বিভিন্ন মাত্রাগুলোর বা করণপ্রণালীর (সড়ফব) (যা
থেকে সম্ভাব্য জ্ঞানলাভ করা যায়) আলোচনা টপিকা, সফিস্টিকা, রেটোরিকা এবং পোয়েটিকায় করা
হয়েছে। অন্যদিকে শেষোক্ত তিনটি বিষয় কেবলমাত্র ব্যবহারিক লক্ষ্যের সঙ্গে সংযুক্ত। কিন্তু ফারাবী
টপিকাকেও এদের সঙ্গে যুক্ত করেন এবং দ্বান্দি¡ক পদ্ধতিতে প্রশ্নোত্তরের বিষয়টিকে জড়িত করেন।
ফারাবীর মতে, সত্যবিজ্ঞান দ্বিতীয় অ্যানালাইটিকার নিশ্চয়াত্মক যুক্তিবাক্য থেকে গড়ে ওঠে; কিন্তু ঐ
সম্ভাব্যতা সত্যের অলীক মূর্তির মধ্যে ¤øান হয়ে যায়। অর্থাৎ সম্ভাব্যতার বা সত্যের সন্ধান প্রায় সময়
নাও মিলতে পারে। সম্ভাব্যতার এ ব্যাপারটি দ্বান্দি¡ক অবধারণ থেকে শুরু করে কাব্যিক অবধারণ পর্যন্ত
বিস্তৃত। এভাবে ফারাবীর মতে কাব্য স্কেলের একেবারে তলায় অবস্থান করে এবং এটি মিথ্যা ও
অনৈতিক অযৌক্তিকতা ছাড়া আর কিছু নয়। কাব্য সম্পর্কে আল-ফারাবীর এ ধরনের মন্তব্য প্লেটোর কাব্যের প্রতি অনীহার কথা স্মরণ করিয়ে দেয়।
আল-ফারাবী পারফাইরীয় ইসাগোগ গ্রন্থের ওপর মন্তব্য করতে গিয়ে ‘সার্বিক' সম্পর্কে
আলোচনা করেন। তিনি বলেন, বিশেষকে কেবলমাত্র বস্তুসমূহে এবং ইন্দ্রিয় প্রত্যক্ষণেই
পাওয়া যায় না, চিন্তনেও পাওয়া যায়। একইভাবে সার্বিক একক বস্তুসমূহে কেবলমাত্র
অবান্তর লক্ষণ হিসেবে অস্তিত্বশীল নয়; ‘দ্রব্য' হিসেবে মনেও অস্তিত্বশীল। মানবমন
বস্তুসমূহ থেকে ‘সার্বিক'কে বিমূর্তন করে অর্থাৎ বস্তুসমূহ থেকে বা বিশেষ থেকে সার্বিকের ধারণায়
উপনীত হয়। কিন্তু এর অর্থ এই নয় যে, সার্বিকের অস্তিত্ব এসবের পূর্বে ছিল না। তাঁর মতে সার্বিক
পূর্ব থেকেই অস্তিত্বশীল ছিল। মানবমন কেবলমাত্র এগুলোকে পরবর্তীতে উপলব্ধি করে।
যুক্তিবিদ্যায় আল-ফারাবীর সূক্ষè দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় পাওয়া যায় অন্য এক প্রেক্ষিতে। কতকগুলো প্রশ্ন
যে অহেতুক দর্শনের অনেক ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায় এটি ফারাবীর দৃষ্টি এড়ায়নি। প্রশ্নগুলো হল মামুলী সত্তা (সবৎব নবরহম) কি সার্বিকের সঙ্গে জড়িত? বা অস্তিত্ব কি ফলশ্রæতিতে বিধেয়? এসব
ভ্রান্তিকর প্রশ্নের কোন উত্তর ছিল না। ফারাবী পূর্ণভাবে এবং বিশুদ্ধরূপে এসব প্রশ্নের উত্তর দেন। তাঁর
মতে অস্তিত্ব ব্যাকরণগত বা যৌক্তিক সম্পর্কিত। এটি বাস্তবতার কোন প্রকার (পধঃবমড়ৎু) নয়, কারণ
এ প্রকার বস্তুসমূহ সম্পর্কে দৃঢ়োক্তিমাত্র। কোন বস্তুর অস্তিত্ব স্বয়ং সেই বস্তু ছাড়া অন্য কিছু নয়।
আল-ফারাবীর এ মত আধুনিক কালের দার্শনিক কান্টের দেশ-কাল সম্পর্কিত মতবাদের ইঙ্গিত
বাহক।
আমরা এতক্ষণ আল-ফারাবীর যুক্তিবিদ্যা সম্পর্কে আলোচনা করেছি। এতে একটি বিষয় লক্ষ্য
করেছেন যে, আল-ফারাবীর মতে যুক্তিবিদ্যা দর্শনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত। যুক্তিবিদ্যার উচ্চস্তরে
যুক্তিবিদ্যা দর্শনে রূপান্তরিত হয়। সুতরাং আল-ফারাবীর যুক্তিবিদ্যার আলোচনার পর তাঁর দর্শন
আলোচনার প্রয়োজনীয়তা প্রাসঙ্গিক। এজন্য এখন আমরা তাঁর দর্শন সম্পর্কে আলোচনা করব।
আল-ফারাবীর দর্শন
আল-ফারাবীর দর্শনের স্পষ্ট বৈশিষ্ট্য ও লক্ষ্য সহজেই চোখে পড়ে। তিনি পূর্ববর্তী দার্শনিকদের কোন
কোন মতবাদ গ্রহণ করেন এবং মুসলিম জগতে গ্রহণযোগ্য করে এগুলোকে পুন:রূপ দান করেন। তাঁর
দর্শন এমন সুসংবদ্ধ যে, প্রায় সকলের মতে এ দর্শন অত্যন্ত সামঞ্জস্যপূর্ণ ও সুশৃ´খল। তাঁর দর্শন
চিন্তা, প্রকাশ, যুক্তি এবং আলোচনার দিক দিয়ে শালীন ও যৌক্তিক।
আল-ফারাবীর দর্শনকে সমন¦য়ধর্মী দর্শন বলা যায়, কারণ তিনি পেরিপ্যাটেটিক দর্শনকে প্লেটোনিক
আকার দিয়েছেন। এর পশ্চাতে তাঁর লক্ষ্য ছিল ইসলামের মূলনীতির সঙ্গে ঐ দর্শনকে সুসমনি¦ত করে
তোলা এবং ধর্মীয় সত্যকে যৌক্তিক ব্যাখ্যার ওপর প্রতিষ্ঠিত করা। আসলে ফারাবী দর্শনকে ধর্মীয়
আবরণে প্রকাশ করেন এবং ধর্মকে দার্শনিক রূপ দান করেন। এ লক্ষ্য হাসিলের উদ্দেশ্যে তিনি
পেরিপ্যাটেটিক দর্শনে যে সংশোধন আনয়ন করেন, তাঁর সঙ্গে তিনি বিশ্বতাত্তি¡ক এবং মনোবৈজ্ঞানিক
তত্তে¡র সংযোজন করেন। এ দু'টি তত্তে¡র প্রকাশ পায়Ñ তাঁর ‘দশম চালিকাশক্তি তত্তে¡' এবং ‘বুদ্ধিবৃত্তি
তত্তে¡'। তাঁর যৌক্তিক ব্যাখ্যা আবার অন্য দু'টি তত্তে¡র সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। এর একটি হচ্ছে ‘নব্যুয়ত তত্ত¡'
এবং অন্যটি ‘কোরানের ব্যাখ্যা তত্ত'¡। আল-ফারাবীর সমগ্র দর্শনকে এ চারটি তত্তে¡ সার-সংক্ষেপিত
করা হয়েছে কারণ এসব তত্ত¡ একটি অপরটির সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। তাঁর এ তত্ত¡গুলোর
সংক্ষিপ্ত আলোচনাই হবে তাঁর দর্শন আলোচনা।
মুসলিম দর্শনে তাঁর ‘চালিকাশক্তি তত্ত¡' গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে আছে। এ তত্ত¡টি জগৎ-আসমান,
পৃথিবীর ব্যাখ্যা এবং গতি ও পরিবর্তনের ঘটনাবলী ব্যাখ্যা করে। এ ব্যাখ্যাই ফারাবীর মতে,
পদার্থবিদ্যা এবং জ্যোতির্বিজ্ঞানের ভিত্তি। সে যাহোক, এ তত্তে¡র প্রধান উদ্দেশ্য হলÑ ‘এক' এবং
‘বহু'র মধ্যে নিহিত সমস্যার সমাধান করা এবং পরিবর্তনশীল ও অপরিবর্তনশীলের মধ্যে তুলনা করা।
আল-ফারাবী বলেন আল্লাহ এক এবং স্বয়ং অত্যাবশ্যক । সুতরাং তাঁর
অস্তিত্ব ও স্থায়িত্বের জন্য অন্য কারও প্রয়োজন নেই। তিনি এমন চালিকা শক্তি যিনি স্বয়ং নিজেকে
জানতে সক্ষম। তিনি বুদ্ধিমান এবং সুগম্য; তাঁর সারসত্তায় তিনি অনন্য। তাঁর কোন তুলনা বা তাঁর সমকক্ষ আর কেউ নেই।
তিনি যদি এমনই হন, তবে বিশ্বের ওপর তাঁর প্রভাব কি এবং তাঁর ও ‘বহু'র মধ্যে সম্পর্ক কি? আলফারাবী এ প্রশ্নের উত্তর প্রদানের জন্য নির্গমন তত্তে¡র সাহায্য গ্রহণ করেন। আল-ফারাবী বলেন, একক
নিশ্চয়াত্মক সত্তার নিজস্ব জ্ঞান ও সদিচ্ছা বা মঙ্গলের দ্বারা প্রথমে এক শক্তির নির্গমন হয়। এই নির্গত
শক্তিই প্রথম চালিকাশক্তি এখানে জ্ঞানই সৃষ্টির সমার্থক। কারণ কোন বস্তুর
ধারণা পোষণ করার অর্থই হল এর অস্তিত্ব। প্রথম চালিকাশক্তি স্বয়ং সম্ভাব্য, কিন্তু অন্যের নির্গমনের
প্রেক্ষিতে নিশ্চয়াত্মক। এ শক্তি পরম এককের এবং নিজের চিন্তা করে। এটি নিজের সত্তায় এক এবং
এসবের বিবেচনায় বহু। আল-ফারাবী এ সূত্র থেকেই বহুত্বের উদ্ভবের পথে অগ্রসর হন। প্রথম
চালিকাশক্তির পরম একত্বের চিন্তা থেকেই আরেকটি চালিকাশক্তি নির্গমন হয়। নিজেকে সম্ভাব্য ভাবার
ফলে এ চালিকাশক্তি থেকে প্রথম “আগমনের” উপাদান ও আকারের নির্গমন হয়, কারণ প্রতিটি
বলয়ের নিজস্ব বিশিষ্ট আকার আছে এবং এ আকারটি এর আত্মা। এভাবে চালিকাশক্তির একের পর
এক নির্গমন হতে থাকে দশম চালিকাশক্তি পর্যন্ত। এর সাথে নয়টি বলয় এবং এদের নয়টি আত্মারও
নির্গমন হয়। নিযুক্তক বা প্রতিনিধি চালিকাশক্তি বা দশম ও শেষ চালিকাশক্তি পার্থিব জগতকে নিয়ন্ত্রণ
করে। এই চালিকাশক্তি থেকেই মানুষের আত্মার এবং চারটি উপাদানের নির্গমন হয়। এ চারটি
উপাদান হল খনিজ পদার্থ, উদ্ভিদ, প্রাণী এবং সর্বশেষে মানুষ।
প্রথম চালিকাশক্তিসহ এসব শক্তির সংখ্যা দশটি। নয়টি চালিকাশক্তির সঙ্গে গ্রহ নক্ষত্র এবং বলয়সমূহ
জড়িত এবং এগুলো ও আত্মাসমূহ গতির উদ্ভাবক। প্রতিটি বলয়ের নিজস্ব চালিকাশক্তি এবং আত্মা
আছে। দশম চালিকাশক্তি পার্থিব জগতের যাবতীয় বিষয়াদির ব্যবস্থা করে। আত্মা বলয়ের নিকটবর্তী
চালক এবং আত্মা চালিকাশক্তি থেকে ক্ষমতা অর্জন করে। আত্মা এর কামনার মাধ্যমে চালিকাশক্তির
জন্য গতিশীল হয়। সুতরাং এর কামনাই এর গতির উৎস। অন্যদিকে চালিকাশক্তি সর্বদাই কামনার
জগতে থাকে। নিæতর উচ্চতরের কামনা করে এবং এভাবে সকলেই পরম একককে কামনা করে। এই
পরম এককই প্রাইম মুভার বা ‘প্রধান চালক', যদিও নিজে অচালিত।
আল-ফারাবী এভাবে চালিকাশক্তি তত্তে¡র মাধ্যমে গতি ও পরিবর্তনের সমস্যাটির সমাধান করেন।
তিনি এক এবং বহুর সমস্যাটি সমাধানের জন্যও এই তত্ত¡টি ব্যবহার করেন। উপাদান দশটি
চালিকাশক্তির মতই পুরাতন; কিন্তু উপাদান সৃষ্ট, কারণ উপাদান দশ চালিকাশক্তি থেকে নির্গত।
আল্লাহ্র এককত্ব প্রমাণের জন্য তিনি এই দশ চালিকাশক্তির মধ্যস্থতা গ্রহণ করেন।
বুদ্ধিবৃত্তি তত্ত¡
আল-ফারাবীর দর্শনে বুদ্ধিবৃত্তির আলোচনা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ; কারণ বুদ্ধিবৃত্তি চালিকাশক্তির সঙ্গে
জড়িত। এজন্য আমরা এখন তাঁর বুদ্ধিবৃত্তি তত্তে¡র আলোচনা করব। আল-ফারাবী তাঁর “ঙহ ঃযব
উরভভবৎবহঃ গবধহরহমং ড়ভ ঃযব ওহঃবষষবপঃ” গ্রন্থে বুদ্ধিবৃত্তি সম্পর্কে তাৎপর্যপূর্ণ আলোচনা করেন। তিনি
জ্ঞানতত্তে¡র সঙ্গে সম্পর্কিত বুদ্ধিবৃত্তি তত্তে¡র গুরুত্ব উপলব্ধি করে তাঁর গ্রন্থসমূহের বেশ কিছু অংশে এ
তত্তে¡র উল্লেখ করেন। তিনি বুদ্ধিবৃত্তি সম্পর্কীয় এ সমস্যাকে তাঁর দর্শনের সঙ্গে যুক্ত করেন; কারণ
তিনি অনুভব করেন যে, এ তত্ত¡ “দশ চালিকাশক্তি তত্ত¡” এবং “নব্যুয়ত তত্তে¡র” সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে
সম্পর্কিত।
আল-ফারাবী বুদ্ধিবৃত্তিকে ‘ব্যবহারিক বুদ্ধিবৃত্তি' এবং ‘তাত্তি¡ক বুদ্ধিবৃত্তি'তে বিভক্ত করেন। তাঁর মতে,
ব্যবহারিক বুদ্ধিবৃত্তি অনুমান করে ‘কি করা উচিত'। অপরদিকে তাত্তি¡ক বুদ্ধিবৃত্তি আত্মার পূর্ণতা অর্জনে
সহায়তা করে। তাত্তি¡ক বুদ্ধিবৃত্তিকে তিনি ‘জড়ীয়' বা ‘উপাদানগত', ‘স্বভাবজাত', এবং ‘অর্জিত'
এ তিনভাগে বিভক্ত করেন। উপাদানগত বা সম্ভাব্য বুদ্ধিবৃত্তি হল
আত্মা বা আত্মার অংশ বা এমন একটি শক্তি যা বস্তুর সারাংশকে বুঝায় এবং যার বিমূর্তন করার
ক্ষমতা আছে। এটিকে এমন উপাদানের সঙ্গে তুলনা করা যায় যার ওপর বস্তুর আকারের ছাপ অঙ্কিত;
যেমন গালার ওপর সীলমোহর অঙ্কন করা যায়। এগুলোকে অভিলিখন বলা হয়। এই অভিলিখনগুলো
প্রত্যক্ষণ ও সুবোধ্য ব্যতীত আর কিছু নয়। সুতরাং সুবোধ্য-সম্ভাব্যতায় বস্তুর মধ্যে
অস্তিত্ববান হয় এবং ইন্দ্রিয় থেকে এগুলোকে যখন বিমূর্তন করা হয় তখন এগুলো বাস্তবতায় মনের
মধ্যে অস্তিত্বশীল হয়। এটিই হল প্রত্যক্ষণ এবং বিমূর্তন । এগুলো মনের গুরুত্বপূর্ণ কর্ম
যার ফলে মন সম্ভাব্যতা থেকে বাস্তবতায় সুবোধ্যকে (রহঃবষষরমরনষবং) আনয়ন করে। এই সুবোধ্যগুলো
মনে বাহিত হলে বুদ্ধিবৃত্তি সুপ্ত অবস্থা থেকে সক্রিয় অবস্থায় রূপান্তরিত হয়।
সুপ্ত ও সক্রিয় বুদ্ধিবৃত্তি
এই অবস্থায় সক্রিয় বুদ্ধিবৃত্তি বা স্বভাবজাত বুদ্ধিবৃত্তি কতকগুলো সুবোধ্যকে অর্জনের ব্যাপারে মনের
একটি আনুভ‚মিকে বা সমতলে আরোহণ কত। মন যেহেতু সব সুবোধ্যকে একই সঙ্গে বোধে আনতে
সক্ষম নয় বা অন্যকথায় হৃদয়ঙ্গম করতে সক্ষম নয়, সেহেতু এটি সক্রিয় বুদ্ধিবৃত্তি যা প্রত্যক্ষণ করে তাঁর প্রেক্ষিতে এবং যা প্রত্যক্ষিত হয়নি তার প্রেক্ষিতে। ফলে এটি সুপ্ত বুদ্ধি। সুবোধ্যগুলো স্বয়ং সুপ্ত
অবস্থায় ইন্দ্রিয়ের মধ্যে অস্তিত্বশীল থাকে।
সুবোধ্যগুলোকে (ইন্দ্রিয় থেকে) উন্মোচিত করা হলেই সেগুলো সক্রিয় বুদ্ধিবৃত্তিতে পরিণত হয় এবং
মানুষ এই আনুভ‚মিকের বা সমপর্যায়ের সক্রিয় বুদ্ধিবৃত্তি লাভ করলে, সে নিজেকে বুঝতে সক্ষম হয়।
এই ধরনের বোধের সঙ্গে বাহ্যিক জগতের কোন সম্পর্ক নেই। এটি মানসিক বিমূর্ত বোধ।
বুদ্ধিবৃত্তি একবার এভাবে বিমূর্তনকে হৃদয়ঙ্গম করতে বা বুঝতে সক্ষম হলে এটি আরও উচ্চ পর্যায়ে
উন্নীত হয়ে অর্জিত বুদ্ধিবৃত্তিতে পরিণত হয়। এটি অসময়ে এমন স্তরে পৌঁছে, যে স্তরে পৌঁছলে
মানবীয় বুদ্ধিবৃত্তি এমন বিমূর্তকে ধারণ করে যার সঙ্গে জড়ের কোন সংযোগ থাকে না। ফলে এটি
যৌক্তিক ধারণার রূপ লাভ করে।
এই যৌক্তিক ধারণা এবং ইন্দ্রিয়-প্রত্যক্ষণের মধ্যে পার্থক্য হচ্ছে যে, যৌক্তিক ধারণা এ পর্যায়ে এক
প্রকার সংজ্ঞা এবং অনুপ্রেরণায় পরিণত হয় বা অন্যকথায় এক প্রকার তাৎক্ষণিক বোধে পরিণত হয়।
এটিই হল মানবীয় বোধের মহত্তম পর্যায়। এই অর্জিতবোধে (খবাবষ) কতিপয় এবং নির্দিষ্ট সংখ্যক
মানুষ পৌঁছতে পারে। এ স্তরে কেউ পৌঁছলে তাঁর নিকট গোপন রহস্য উন্মোচিত হয় এবং তিনি স্বতন্ত্র
চালিকাশক্তির সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ স্থাপনে সক্ষম হন।
এভাবে ক্রমান¦য়ে বুদ্ধিবৃত্তি ‘সুপ্ত' থেকে ‘সক্রিয়' এবং ‘সক্রিয়' থেকে ‘অর্জিত' বুদ্ধিবৃত্তিতে উন্নীত হয়।
সুপ্ত বুদ্ধিবৃত্তি কেবলমাত্র ইন্দ্রিয়জাত আকার গ্রহণকারী, আর সক্রিয় বুদ্ধিবৃত্তি সুবোধ্যকে
সংরক্ষণ করে এবং ধারণাকে বুঝে। অর্জিত বুদ্ধিবৃত্তি যোগাযোগ, আধ্যাত্মিক
সিদ্ধিলাভের অনুভ‚তি এবং প্রেরণার পর্যায়ে উন্নীত হয়।
ক্রমান¦য়ে এ ধরনের এক স্তর থেকে আরেক স্তরে উত্তরণ স্বত:স্ফ‚র্ত নয়। কারণ এর প্রারম্ভিক স্তরে সুবোধ্য এবং বুদ্ধিবৃত্তি সুপ্ত অবস্থায় থাকে। এর সম্ভাব্যতা থেকে বাস্তবতায় উত্তরণ কেবলমাত্র প্রতিনিধি চালিকাশক্তি বা সর্বশেষ চালিকাশক্তির প্রভাবের ফলেই ঘটে। মানবীয় জ্ঞান স্বতন্ত্র চালিকাশক্তির
বিচ্ছুরণের ওপর নির্ভর করে এবং প্রতিনিধি চালিকাশক্তি আমাদের
চক্ষুর সঙ্গে সূর্যের সম্পর্কের মত মানবীয় বুদ্ধিবৃত্তির সাথে একই রকমভাবে সম্পর্কিত হয়। আমাদের
চক্ষু দৃষ্টির জন্য দিবালোকের ওপর নির্ভরশীল এবং একইভাবে মানুষের বুদ্ধিবৃত্তি কেবল তখনই
বোধের জগতে প্রবেশ করে যখন প্রতিনিধি চালিকাশক্তি ঐ বুদ্ধিবৃত্তিকে উন্মোচিত করে (অর্থাৎ এর
সামনে থেকে পর্দা সরিয়ে নেয়)। এই চালিকাশক্তি বুদ্ধিবৃত্তির পথ আলোকিত করে। এখানেই আমরা
দেখতে পাই যে, মরমীবাদ দর্শনের সঙ্গে একীভ‚ত হয়ে যায়। তবে এ তত্তে¡ মানুষের মনকে কিছু
অবমূল্যায়িত করা হয়। কারণ প্রতিনিধি চালিকাশক্তির প্রভাব ছাড়া মন আর ঊর্ধ্বলোকের দিকে অগ্রসর
হতে পারে না। এ কারণেই হয়তো সুফীরা আল-ফারাবীর এ তত্ত¡কে মনেপ্রাণে গ্রহণ করে নেননি।
কিন্তু এতদ্সত্বেও আল-ফারাবীর এ তত্ত¡ মুসলিম দর্শনে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও তাৎপর্যপূর্ণ ভ‚মিকা পালন করে। এমনকি খ্রিষ্ট দর্শনেও এর গুরুত্ব কম ছিল না।
নব্যুয়ত তত্ত¡
দর্শনে নব্যুয়ত তত্ত¡ বুদ্ধিবৃত্তি তত্তে¡র সঙ্গে জড়িত এবং এ তত্ত¡ গুরুত্বপূর্ণ ভ‚মিকা পালন করে আলফারাবীর। তিনি নব্যুয়তের ধর্মীয় ব্যাখ্যাকে দার্শনিক ভিত্তি প্রদানের চেষ্টা করেন। বুদ্ধিবৃত্তির
আলোচনায় আমরা লক্ষ্য করেছি যে, প্রতিনিধি চালিকাশক্তির প্রভাবে অর্জিত বুদ্ধিবৃত্তি আলোকপ্রাপ্ত
হয়ে অনন্ত রহস্যের সন্ধানপ্রাপ্ত হয়। এ অবস্থায় অর্জিত বুদ্ধিবৃত্তি প্রতিনিধি চালিকাশক্তির সঙ্গে
যোগাযোগ স্থাপন করে এবং অনুপ্রাণিত হয়। আল-ফারাবী নব্যুয়তের বিষয়টিকে সরাসরি আল্লাহপ্রদত্ত
না বলে উপরোক্ত বুদ্ধিবৃত্তির আলোচনার সঙ্গে সংযুক্ত করেন এবং এটিকে দার্শনিক রূপ দেন। এ তত্তে¡ ঐতিহ্যবাদের সঙ্গে যৌক্তিকতার সমন¦য় সাধনের চেষ্টা করা হয়েছে। তাঁর
মনোবিজ্ঞানে ও অধিবিদ্যায় এই তত্তে¡র ভিত্তি লক্ষণীয়। আল-ফারাবীর রাষ্ট্রদর্শন ও নীতিশাস্ত্রের সঙ্গে
এ তত্ত¡ সম্পর্কিত।
আল-ফারাবী সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিবেশের প্রভাবের গুরুত্ব অনুধাবন করে সমাজ ও আদর্শ
রাষ্ট্রের চিন্তা করেন। তিনি সমাজ ও আদর্শ রাষ্ট্রের প্রধান নেতার যে গুরুত্ব ও গুণাবলীর উল্লেখ করেন
তা প্রায় প্লেটোর দার্শনিক রাজার কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। কিন্তু দার্শনিক রাজার যে গুণটির কথা
প্লেটো চিন্তা করেননি, আল-ফারাবী তা চিন্তা করে প্রধান নেতার গুণাবলীর সঙ্গে যুক্ত করেন। এ গুণটি
হচ্ছে সাধনা বলে এই প্রধানকে প্রতিনিধি চালিকাশক্তির আনুভ‚মিকে বা লেভেলে পৌঁছতে হবে এবং
তিনি সে স্তরে পৌঁছলে প্রত্যাদেশ ও অনুপ্রেরণা লাভ করবেন।
প্রত্যাদেশ ও অনুপ্রেরণা প্রাপ্ত হলে প্রধান নেতা শুধু জাগতিক নয়, পারলৌকিক বিষয়েও নেতৃত্ব দান
করতে পারবেন। কারণ তিনি তখন স্বর্গীয় আলোকপ্রাপ্ত। ফারাবীর মতে কেবলমাত্র দার্শনিক এবং
মহান সাধকগণ এই আলোকপ্রাপ্ত হয়ে গুপ্ত রহস্যের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে আলোর জগতকে প্রত্যক্ষণ
করতে সক্ষম হন। “এই পবিত্র আত্মা' ঊর্ধ্বলোকের প্রতি নিবিষ্টচিত্ত থাকায় অধ:লোকের প্রতি
কর্ণপাত করবে না এবং এর বাহ্যিক সংবেদন অভ্যন্তরীণ সংবেদনকে আচ্ছন্ন করতে পারবে না। এই
আত্মার প্রভাব অন্যান্যদেরকে প্রভাবিত করবে এবং স্বীয় দেহের ঊর্ধ্বে আরোহণ করে এই পৃথিবীর
সমস্ত বস্তুকে প্রভাবিত করবে। এবং ফেরেস্তাদের নিকট থেকে এ আত্মা জ্ঞান লাভ
করবে। আল-ফারাবী তাঁর আস-শামারাত আল-মারাদিয়্যাহ গ্রন্থে মহান আত্মা সম্পর্কে উপরোক্ত
উক্তির মাধ্যমে এসব গুণাবলীর উল্লেখ করেন এবং বলেন যে, নিরবচ্ছিন্ন ধারণামূলক অধ্যয়ন বা
অনুশীলনের সাহায্যে ঐ আত্মা প্রতিনিধি চালিকাশক্তির সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করতে পারবেন। তাঁর মতে এ রকম আত্মার অধিকারী হবেন মহান নবী।
আল-ফারাবী আরও বলেন যে, প্রতিনিধি চালিকাশক্তির সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন কল্পনা (রসধমরহধঃরড়হ),
স্বপ্ন এবং দিব্যদৃষ্টির মাধ্যমেও সম্ভব। কল্পনাশক্তির মাধ্যমে আধ্যাত্মিক জগতের আদলে
মানসিক প্রতিরূপ সৃষ্টি করা যায়। এ অবস্থায় নিদ্রামগ্ন ব্যক্তি স্বর্গ এবং এর অধিবাসীদেরকে অবলোকন
করতে পারেন এবং অপার আনন্দ অনুভব করেন। কল্পনা স্বর্গীয় কল্যাণময় জগতে আরোহণ করতে
পারে এবং প্রতিনিধি চালিকাশক্তির সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করে কোন বিশেষক্ষেত্রে স্বর্গীয় রায় ও
ব্যক্তিগত ঘটনাবলীর বিষয় অবগত হতে পারে। দিনে বা রাত্রে সংঘটিত এ যোগাযোগের মাধ্যমে
নব্যুয়ত কে ) ব্যাখ্যা করা যায় কারণ এটিই সত্যস্বপ্ন এবং প্রত্যাদেশের উৎস। এখানে
উল্লেখ্য যে, এই কল্পনাশক্তি সাধারণ কল্পনা নয়, এটি অর্জিত সৃজনশীল কল্পনা।
আল-ফারাবীর মতে যিনি এভাবে নব্যুয়তপ্রাপ্ত হন তিনি নবী। এ নবীর প্রধান বৈশিষ্ট্য হলÑস্পষ্ট কল্পনা
অর্জন যার মাধ্যমে তিনি জাগ্রত বা নিদ্রিত অবস্থায় প্রতিনিধি চালিকাশক্তির সঙ্গে যোগাযোগ করতে
পারবেন এবং দিব্যদৃষ্টি ও অনুপ্রেরণা লাভ করতে পারবেন। তাঁর মতে প্রত্যাদেশ প্রতিনিধি
চালিকাশক্তির মাধ্যমে আল্লাহর তরফ থেকে নির্গমন ছাড়া আর কিছু নয়। কিছু লোকের অপেক্ষাকৃত
কম শক্তিশালী কল্পনার মাধ্যমে অপেক্ষাকৃত কম মাত্রার দিব্যদৃষ্টি এবং অনুপ্রেরণা লাভ করতে
পারেন। আল-ফারাবী এঁদেরকে নবীর চেয়ে কম মাত্রার মহাপুরুষ বলে অভিহিত করেন। সাধারণ
লোকের কল্পনা অত্যন্ত দুর্বল হওয়ায় দিনে বা রাত্রে তাদের পক্ষে প্রতিনিধি চালিকা শক্তির সঙ্গে
যোগাযোগ স্থাপন করা সম্ভব নয়। সংক্ষেপে এটিই হল তাঁর নব্যুয়ত তত্ত¡।
ফারাবীর এই নব্যুয়ত তত্ত¡ নি:সন্দেহে নব্যুয়তের ব্যাপারে প্রত্যাদেশ এবং যুক্তির বা ধর্ম এবং দর্শনের
সুষ্ঠু সমন¦য়ের প্রয়াস। তাঁর এ তত্তে¡ এ্যারিস্টটলের প্রভাব সুস্পষ্ট। কিন্তু এ্যারিস্টটলের সঙ্গে ফারাবীর
পার্থক্য বেশ স্পষ্ট। এ তত্তে¡র প্রভাব মধ্যযুগ এবং আধুনিক যুগে প্রাচ্য এবং পাশ্চাত্যে লক্ষণীয়। ইবনে
সিনা এ তত্তে¡র অনুকরণ করেন। ইবনে রুশ্দ এ তত্তে¡র বৈধতা স্বীকার করেন এবং এ ব্যাপারে আলগাযালীর সমালোচনায় বিস্মিত হন। ইহুদী মাইমোনীওল এ তত্তে¡র অনুসরণ করেন এবং স্পিনোজার ট্রাকটেটাল থেওলজিকোÑপলিটিকাসেও এ ধরনের তত্ত¡ লক্ষণীয়।
আল-ফারাবীর কোরানের বিষয়বস্তুর ব্যাখ্যাতত্ত¡
পবিত্র কোরানের কিছু ধর্মীয় নীতি ঐতিহ্যগত এগুলোকে যুক্তির সাহায্যে প্রতিপাদন বিচার দিবস, শেষদিবস, পুলসেরাত, বিচার এবং শাস্তি।
এসব সামিয়াতকে গ্রহণ করে নেওয়া ধর্মের ভিত্তিস্বরূপ। বিশ্বাসীদেরকে এগুলো গ্রহণ করতে হবে এবং
তদানুসারে কাজ করতে হবে। কিন্তু কিছু চিন্তাবিদ এগুলোর ভিন্ন ব্যাখ্যা বা যৌক্তিক ব্যাখ্যা দেন বা
এগুলোকে প্রাকৃতিক আইনের আওতায় আনার চেষ্টা করেন। মুতাজিলারা এ দলভুক্ত। এছাড়া আরও
কিছু চিন্তাবিদ আছেন যেমন ইবনে রাওয়ান্দি এবং আল-রাজী।
আল-ফারাবী এ ব্যাপারে ভিন্নমত পোষণ করেন। তিনি মোজেজার বৈধতা স্বীকার করে
বলেন, এগুলো নব্যুয়তের প্রমাণের উপায়। তিনি মনে করেন মোজেজা অতিপ্রাকৃতিক হলেও প্রাকৃতিক
আইনের বিরোধী নয়Ñ কারণ এগুলোর উৎস বলয়ের জগতে এবং চালিকাশক্তিতে দেখা যায়। এরাই
স্বর্গীয় মন্ডলের ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে নিয়োজিত। কাজেই ঐ জগতের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপিত হলেই
স্বভাবগত বিষয়ের বাইরের এসব ঘটনা ঘটে। একজন নবী তাঁর আধ্যাত্মিক ক্ষমতাবলে প্রতিনিধি
চালিকাশক্তির সঙ্গে সংযুক্ত হয়ে যায়। এই সংযোগের ফলে তিনি বৃষ্টিপাত ঘটান, চন্দ্রকে দু'খন্ডে
বিভক্ত করেন, লাঠিকে সাপে পরিণত করেন বা অন্ধ এবং অসুস্থ রোগীকে সুস্থ করে তোলেন। এভাবে
আল-ফারাবী কার্যকারণকে স্বভাবগত বিষয়ের ঊর্ধ্বের বিষয়ে পরিণত করেন। তিনি লওহে মাহফুজ
এবং কালকে শাব্দিক অর্থে না বুঝে সংক্ষেপিতকরণ ও সংরক্ষণের অর্থে বুঝার কথা বলেন। তাঁর মতে
কোনো বিশ্বাসীই এগুলোর অবমূল্যায়ন করতে পারে না।
আল-ফারাবীর এই মনোভাব নি:সন্দেহে আধ্যাত্মিকতার মনোভাব। ইবনে সিনা এ তত্ত¡কে গ্রহণ করে
আরও বিস্তারিত ব্যাখ্যা দেন। আল-গাযালী এ তত্তে¡র সমালোচনা করেন। কিন্তু ইবনে রুশ্দ বলেন,
এসব বিষয়ের নিরাপত্তার কারণে এখানে দর্শন ও ধর্মকে আলাদা রাখা উচিত। উপরোক্ত আলোচনার
মাধ্যমে আল-ফারাবীর দর্শনের মোটামুটি একটি চিত্র আমাদের সামনে ফুটে ওঠে।
অনুশীলনী
১। আল-ফারাবীর যুক্তিবিদ্যার সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যা দিন। তাঁর দর্শনের সঙ্গে যুক্তিবিদ্যার সম্পর্ক কি?
২। আল-ফারাবীর চালিকাশক্তি তত্ত¡ এবং বুদ্ধিবৃত্তি তত্তে¡র আলোচনা করুন। চালিকাশক্তি তত্তে¡র
সঙ্গে নব্যুয়ত তত্তে¡র কি কোন সম্পর্ক আছে? চিন্তা করে আলোচনা করুন।
সত্য/মিথ্যা
১। অংকশাস্ত্রে আল-ফারাবীর কোন অবদান নেই। সত্য/মিথ্যা
২। আর-ফারাবী যুক্তিবিদ্যাকে আটভাগে ভাগ করেন। সত্য/মিথ্যা
৩। আল-ফারাবীর মতে প্রমাণ তত্ত¡ই যথার্থ যুক্তিবিদ্যা নয়। সত্য/মিথ্যা
৪। আল-ফারাবীর দর্শনকে সমন¦য়ধর্মী দর্শন বলা যায়। সত্য/মিথ্যা
৫। আল-ফারাবী বুদ্ধিবৃত্তিকে তিনভাগে ভাগ করেন। সত্য/মিথ্যা।
নৈর্ব্যক্তিক প্রশ্ন
১। আল-ফারাবীর অংকশাস্ত্র ও যুক্তিবিদ্যার মধ্যে পার্থক্য
(ক) নেই (খ) আছে
(গ) সামান্য (ঘ) ওপরের কোনটিই নয়।
২। আল-ফারাবীর মতে অবধারণ হচ্ছে
(ক) প্রতিবেদন (খ) প্রতিপাদন
(গ) ধারণা (ঘ) কোনটিই নয়।
৩। আল-ফারাবীর মতে চালিকাশক্তি
(ক) বারটি (খ) দশটি
(গ) ষোলটি (ঘ) ওপরের কোনটিই নয়।
৪। আল-ফারাবীর বুদ্ধিবৃত্তি
(ক) চার প্রকার (খ) নয় প্রকার
(গ) কোন প্রকারভেদ নেই (ঘ) ওপরের কোনটিই নয়।
৫। আল-ফারাবীর মতে প্রত্যাদেশ হল চালিকাশক্তির মাধ্যমে
(ক) প্রেরিত (খ) নির্গমন
(গ) প্রতিপাদন (ঘ) কোনটিই নয়।
রচনামূলক প্রশ্ন
১। cc এবং আল-কিন্দির এ তত্তে¡র সঙ্গে পার্থক্য
কোথায় তা নির্ণয় করুন।
উত্তরমালা
সত্য/মিথ্যা
১। মিথ্যা ২। সত্য ৩। মিথ্যা ৪। সত্য ৫। মিথ্যা
নৈর্ব্যক্তিক প্রশ্ন
১। খ ২। ক ৩। খ ৪। ক ৫। খ

FOR MORE CLICK HERE
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস মাদার্স পাবলিকেশন্স
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস ১ম পর্ব
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস
আমেরিকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস
বাংলাদেশের ইতিহাস মধ্যযুগ
ভারতে মুসলমানদের ইতিহাস
মুঘল রাজবংশের ইতিহাস
সমাজবিজ্ঞান পরিচিতি
ভূগোল ও পরিবেশ পরিচিতি
অনার্স রাষ্ট্রবিজ্ঞান প্রথম বর্ষ
পৌরনীতি ও সুশাসন
অর্থনীতি
অনার্স ইসলামিক স্টাডিজ প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত
অনার্স দর্শন পরিচিতি প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত

Copyright © Quality Can Do Soft.
Designed and developed by Sohel Rana, Assistant Professor, Kumudini Government College, Tangail. Email: [email protected]