আল-কিন্দির কর্মজীবনের পরিচয় দিন। তিনি কি কেবল দার্শনিক ছিলেন?

আবু ইয়াকুব ইসহাক ইবনে আল-কিন্দি দার্শনিক সম্প্রদায়ের মধ্যে প্রথম দার্শনিক। কোরআন ও
হাদীসের দর্শনের সংগে বিদেশী বিশেষত গ্রীক দর্শনের সম্মিলন ঘটিয়ে মুসলিম দর্শনকে পূর্ববর্তী
মুতাযিলা বা আশারিয়া দর্শনের প্রভাবমুক্ত করেন আল-কিন্দি। তিনি মুসলিম বিশ্বের উন্নতির সময়ে
তদানীন্তনকালের খলিফাদের আনুক‚ল্য লাভ করেন। ফলে ভিন্ন ধারায় ও ভিন্ন আঙ্গিকে দর্শনচর্চা করা
তাঁর পক্ষে সম্ভব হয়েছিল। দর্শন চর্চার অনুক‚ল এ কালের সুযোগকে কাজে লাগিয়ে তিনি প্রথম
প্রথামাফিক বা রীতিসিদ্ধ দর্শনের সূত্রপাত করেন। ফলে পরবর্তীকালে আল-ফারাবী, ইবনে সিনাসহ
অন্যান্য দার্শনিকদের পক্ষে সাহসী ভ‚মিকা পালন করা সম্ভব হয় এবং দর্শনের ইতিহাস ভিন্নখাতে
প্রবাহিত হয়। মুসলিম দর্শনের ইতিহাসে আল-কিন্দি কৃতিত্বের দাবীদার। আল-কিন্দি আব্বাসীয় খিলাফতের এক স্বর্ণযুগে (৮১০ থেকে ৮৭১ খ্রিঃ) দার্শনিক হিসেবে দর্শন
অঙ্গনে আবির্ভূত হন। ৮০৯ থেকে ৮৬১ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত এ সময়ে খলিফা আল-আমিন, আল-মামুন,
আল-মুতাসিম, আল ওয়াসিক এবং আল-মুতাওক্কিল বাগদাদের খলিফা ছিলেন। আব্বাসীয়
খিলাফতের এই সময় মুসলিম বিশ্বে রাজনৈতিক, সামরিক এবং বুদ্ধিবৃত্তিক দিক দিয়ে এক স্বর্ণোজ্জ্বল
অধ্যায়ের সূচনা হয়। বাইজান্টিয়াম থেকে বসরা পর্যন্ত মুসলিম সাম্রাজ্যের সর্বত্র এক সুশৃংখল
প্রশাসনিক ব্যবস্থা গড়ে ওঠে। সারা বিশ্বে এ সময়ে বাগদাদ শহর একটি স্বপ্নের শহরে পরিণত হয়।
ঐ সময়ে জীবনের প্রয়োজনীয় বিশাল প্রাসাদ, বাগিচা, আমোদ প্রমোদের সামগ্রী, উন্নত বাজার এবং
উন্নত সামগ্রীর সব কিছুই সেখানে ছিল। আল-কিন্দির আবির্ভাবের সময় জাগতিক উন্নতির সাথে সাথে
বৈজ্ঞানিক এবং বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চা প্রভ‚ত পরিমাণে বেড়ে যায়। গ্রীক দার্শনিক এবং দর্শন গ্রন্থের আরবী
ভাষায় অনুবাদ চিন্তাবিদদের জন্য এক নতুন দ্বার উন্মোচন করে। এ সময়ে খলিফাদের পৃষ্ঠপোষকতায়
বিজ্ঞান, দর্শন ও চিকিৎসাসংক্রান্ত গ্রীক ও সিরিয়াক ভাষার অনূদিত গ্রন্থাবলী নতুনভাবে শিক্ষার ও
জ্ঞানচর্চার ভিত্তি রচনা করে। খলিফা আল-মামুন জ্ঞান চর্চার জন্য বায়তুল হিকমাহ বা জ্ঞান র্চচার কেন্দ্র
স্থাপন করেন এবং বিদেশী ভাষায় রচিত পুস্তক আরবী ভাষায় অনুবাদের জন্য প্রচুর অর্থ ব্যয় করেন।
আল-খাওয়ারাজমি এ সময়ে জ্যামিতির ওপর তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ রচনা করেন। অন্যান্য চিন্তাবিদগণ
তাঁর পৃষ্ঠপোষকতায় নিকটপ্রাচ্যে জ্ঞান, বিজ্ঞান ও দর্শন চর্চার যে অতুলনীয় উন্নতি সাধন করেন তাঁর
সঙ্গে একমাত্র আলেকজান্দ্রিয়া যুগের তুলনা করা চলে।
এ সময়ে বুদ্ধিবৃত্তিক কার্যকলাপ দুটি ধারায় প্রবাহিত হয়। এদের একটি ধারার সূচনা ও উন্নতি হয়
মুসলিম সংরক্ষণবাদীদের দ্বারা। তাঁরা ইসলামিক নীতির ওপর ভিত্তি করে ভাষাতত্ত¡, ইতিহাস এবং
আইনের দর্শনের উন্নতি সাধন করেন এবং কোরআন ও সুন্নাহর ওপর জ্ঞানচর্চার ভিত্তি স্থায়ী করার
মানসে কাজ করেন। এ দলে আবু হানিফা, আল সাফী, ইবনে হাম্বল এবং মালিক ইবনে আনাসের মত
ধর্মতত্ত¡বিদদের আবির্ভাব হয়। অন্যদিকে হেলেনীয় জ্ঞান বিজ্ঞানের সংমিশ্রণে ইসলামি চিন্তার বিকাশ
ঘটানোর জন্য অন্য সব চিন্তাবিদ গ্রীক, সিরীয় এবং পার্সিয়ান সংস্কৃতি ও দর্শনের সাহায্য গ্রহণ করেন
এবং জ্ঞান বিজ্ঞানকে সুন্নাহর ভিত্তির পরিবর্তে যুক্তিভিত্তিক করার প্রচেষ্টা করেন। এ দলের চিন্তাবিদদের
মধ্যে মুতাযিলারা ছিলেন অন্যতম। এ দু'দলের দ্বিমুখী পদ্ধতি অবলম্বন মুসলিম বিশ্বে এক ধর্মীয়
সংস্কার সৃষ্টি করে। কিন্তু জ্ঞানবিজ্ঞান ও দর্শন চর্চার ক্ষেত্রে খলিফাদের পৃষ্ঠপোষকতায় এ সংকট দূর
হয়। ফলে এ সময়ে মুক্তবুদ্ধি চর্চার এক অনুক‚ল পরিবেশ বিরাজিত থাকে। এ সময়টি সম্পর্কে জর্জ,
এন আটিয়েহ বলেন:
আল-কিন্দির জীবনী
আপনি ইতোমধ্যে লক্ষ্য করেছেন যে আল-কিন্দির জন্ম,বয়োবৃদ্ধি এবং কর্মজীবনের সময়টিতে
জ্ঞানবিজ্ঞান ও দর্শন চর্চার একটি অনুকূল পরিবেশ বিরাজমান ছিল। এ ধরনের একটি অনুকূল
পরিবেশে আল-কিন্দি ১৮৫/৮১০ খ্রিষ্টাব্দে দক্ষিণ আরবের কিন্দাহ গোত্রে জন্মগ্রহণ করেন। মর্যাদা,
সংস্কৃতি ও শিক্ষার দিক দিয়ে এ কিন্দাহ গোত্র সেসময় আরব জগতে খ্যাতিমান ছিল। কিন্দির পূর্ণনাম
ছিল আবু ইউসুফ ইবনে ইসহাক ইবনে ইমরান ইবনে ইসমাইল ইবনে আল'আস ইবনে ফাইস আলকিন্দি। তিনি কিন্দাহ গোত্রে জন্মগ্রহণ করেন বলে কিন্দি তাঁর নামের সঙ্গে যুক্ত হয়। তিনি আল-কিন্দি
নামে সমধিক পরিচিত। তাঁর পিতামহ আল'আস আস ইবনে কাইস ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। আল'
আস রাসূলের সাহাবাদের মধ্যে অন্যতম সাহাবা ছিলেন। আল-আস'আস কতিপয় বিশিষ্ট মুসলিম
সহযোগীর সংগে কুফায় গমন করেন। সেখানে তিনি এবং তাঁর বংশধরগণ বসবাস করেন। আব্বাসীয়
খলিফা আল-আল-রশিদের খিলাফতকালে আল-কিন্দির পিতা ইসহাক ইবনে আল-সাব্বাহ কুফার
গভর্ণর ছিলেন। এ সময়ে কুফা এবং বসরা ইসলামী সংস্কৃতির দুটি প্রতিদ্বন্দ¡ী কেন্দ্র ছিল। কুফায়
বুদ্ধিবৃত্তিক বা র‌্যাশনালিস্টিক চিন্তাধারার চর্চা শুরু হয় এবং বসরা ধর্মতাত্তি¡ক চিন্তাধারার শ্রেষ্ঠ কেন্দ্র
ছিল। আল-কিন্দি কুফায় জন্মগ্রহণ করায় শৈশব থেকেই সেখানে প্রচলিত চিন্তাধারার পরিবেশে তাঁর
শিক্ষাজীবন শুরু হয়। তিনি আরবের একটি গোত্রে জন্মগ্রহণ করেন বলে তাঁকে আরবদের দার্শনিক
বলা হয়। দার্শনিকদের মধ্যে তিনিই প্রথম আরব বংশোভ‚ত।
আল-কিন্দি তাঁর বাল্যকালে তদানীন্তন পাঠ্যক্রম অনুসারে আল কুরআন মুখস্ত করেন। এর সাথে তিনি
আরবী ব্যাকরণ, সাহিত্য ও প্রাথমিক গণিতশাস্ত্রে শিক্ষালাভ করেন। এরপর তিনি ফিকাহ শাস্ত্র এবং
নূতন শাস্ত্র কালাম অধ্যয়ন করেন। সেনাধ্যক্ষ বা রাজপথে অধিষ্ঠিত হওয়ার শিক্ষাগ্রহণ না করে তিনি
জ্ঞানচর্চার দিকে আকৃষ্ট হন। কুফার পরিবেশ তাঁকে এ ব্যাপারে উদ্বুদ্ধ করে। তিনি কুফায় শিক্ষাজীবন
শেষ করে আরও অধিক জ্ঞান লাভের উদ্দেশে বসরায় গমন করেন। বসরা এ সময়ে জ্ঞানের ক্ষেত্রে
অত্যধিক উন্নত এক কেন্দ্র ছিল। এখানেই মুতাযিলা এবং আশারিয়া সম্প্রদায়ের উদ্ভব হয়। বসরায়
তাঁর অবস্থানকাল, কার্যক্রম ও শিক্ষাগ্রহণ সম্পর্কে তেমন কোন তথ্য পাওয়া যায়নি। তবে এটুকু জানা
যায় যে বসরায় শিক্ষা গ্রহণ শেষে তিনি বাগদাদে গমন করেন। বাগদাদে তাঁর শিক্ষা জীবন অত্যন্ত
তাৎপর্যপূর্ণ ছিল। এখানে তিনি গ্রীক এবং মিসরীয় ভাষা আয়ত্ত করেন এবং অনেক সিরীয় ও
পারসিয়ান পন্ডিতের সান্নিধ্যে আসেন। জানা যায় বাগদাদেই তিনি গ্রীক দর্শনের ও বিজ্ঞানের গূঢ়তত্ত¡
সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করেন। খুব সম্ভবত আল-কিন্দি আরবদের বিশিষ্ট কয়েকজন চিন্তাবিদদের মধ্যে
অন্যতম যিনি যথার্থভাবে গ্রীক এবং মিসরীয় ভাষায় ব্যুৎপত্তি লাভ করেন। গ্রীক, পারসিয়ান এবং
ভারতীয় সাহিত্যে তাঁর প্রগাঢ় জ্ঞান বাগদাদে তাঁকে প্রভ‚ত খ্যাতি এনে দেয়।
বাগদাদে আল-কিন্দির জ্ঞানের গভীরতার কথা খলিফা আল-মামুনের কানে পৌঁছলে খলিফা তাঁকে তাঁর
দরবারে আমন্ত্রণ করেন এবং গ্রীক বিজ্ঞান ও দর্শনসংক্রান্ত পুস্তক অনুবাদে নিয়োজিত বিশেষজ্ঞদের
সার্কেলে যোগদানের আহবান জানান। তিনি এ আহবানে সাড়া দিয়ে তাঁর কর্মজীবন আরম্ভ করেন।
আল-কিন্দি খলিফা আল-মুত্তালিসের পুত্র আহমদ ইবনে আল মুতাসিমের টিউটর নিযুক্ত হন। তিনি
খলিফা আল-মামুন এবং আল-মুতাসিমের পূর্ণ পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করেন এবং রাজপরিবারে শিক্ষক ও
চিকিৎসক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। আল-কিন্দির কয়েকটি গ্রন্থ আহমদ বা আল-মুতাসিমের নামে
উৎসর্গিত। তিনি এ সময়ে ঈর্ষনীয় খ্যাতি লাভ করেন এবং রাজদরবারে তাঁর প্রভাব প্রভ‚ত পরিমাণে
বেড়ে যায়। ইবনে নাবাতাহ বলেন, “আল-কিন্দি এবং তাঁর গ্রন্থ আল মুতাসিমের সাম্রাজ্যকে অলংকৃত
করেছে।” তিনি খলিফা আল-মুতাওয়াক্কিলের পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করেন। কিন্তু কিছুদিন পর
মুতাওয়াক্কিলের মুতাজিলা বিরোধী মনোভাব ও কিছু ঈর্ষাপরায়ণ লোকের ষড়যন্ত্রের ফলে আল-কিন্দি
তাঁর বিরাগভাজন হয়ে পড়েন। উল্লেখ্য আল-কিন্দি নিজে মুতাজিলা ছিলেন না, কিন্তু তাঁদের প্রতি তাঁর সহানুভ‚তি ছিল।
কর্মজীবন
কথিত আছে যে মুসা ইবনে শাকিরের পুত্রদ্বয় মুহাম্মদ এবং আহম্মদ বৈজ্ঞানিক হিসেবে মুতাওয়াক্কিলের
বিজ্ঞানচর্চা কেন্দ্রে নিযুক্ত ছিলেন। তাঁরা আল-কিন্দির খ্যাতি এবং খলিফার অতি প্রিয়ভাজন হওয়ার
বিষয়টি বরদাস্ত করতে না পেরে তাঁর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র শুরু করেন। তাঁরা সানাদ ইবনে আলী নামক
এক ব্যক্তিকে খলিফার নিকট প্রেরণ করেন। ঐ ব্যক্তি খলিফাকে আল-কিন্দির বিরুদ্ধে এমনভাবে
উত্তেজিত করে ফেলেন যে খলিফা মুতাওয়াক্কিল আল-কিন্দিকে চাকুরি থেকে বরখাস্ত করেন এবং
তাঁকে প্রহার করার আদেশ দেন। খলিফা আল-কিন্দির ‘আল-কিন্দাহ‘ নামে যে গ্রন্থাগার ছিল সে
গ্রন্থাগারটিও বাজেয়াপ্ত করার হুকুম দেন এবং গ্রন্থাগার অন্যত্র সরিয়ে দেওয়ার আদেশ দেন। কিন্তু
রাজদরবারে তাঁর হৃত মর্যাদা তিনি আর ফিরে পাননি। এ মহান দার্শনিক ২৫২/৮৬৬ খ্রিষ্টাব্দে
মৃত্যুবরণ করেন।
আল-কিন্দির জ্ঞানের গভীরতার জন্য সুখ্যাতির পাশাপাশি জিঘাংসা চরিতার্থ করার মানসে সেকালের
কিছু লেখক তাঁর কুখ্যাতির কথাও বলেন। বিশেষ করে আল-জাহিম তাঁর কিতাব আল-বুখালা গ্রন্থে এ
ধরনের কুৎসা রচনা করেন। কেউ কেউ তাঁকে ইহুদী, আবারও কেউ তাঁকে খ্রিষ্ট্রীয়ান বলেও চিহ্নিত
করার চেষ্টা করেন। এগুলি নিছক কুৎসা ছিল কারণ তাঁর নাম তাঁর পিতামহ এবং পিতার পরিচয় এর
প্রমাণ। যাহোক আল-কিন্দি একজন ব্যক্তিত্ববান, মর্যাদাসম্পন্ন এবং জ্ঞানের প্রতি উৎসর্গিত প্রাণপুরুষ
ছিলেন বলে তাঁর প্রতি ঈর্ষাপরায়ণ ব্যক্তিদের কুৎসা তাঁর মহান অবদানকে ¤øান করতে পারেনি।
চিকিৎসক আল-কিন্দি
আল-কিন্দি প্রাসাদোসম একটি গৃহে আরামদায়ক জীবন যাপন করতেন। তাঁর বাগিচায় তিনি অনেক
রকম প্রাণী পুষতেন। খুব সম্ভবত তিনি সমাজ থেকে দূরে কিছুটা নির্জন জীবনযাপন করতেন। আলকিফতী তাঁর সম্পর্কে একটি চমৎকার ঘটনার উল্লেখ করেন। আল-কিফতী বলেন যে, আল-কিন্দির
এক ধনী প্রতিবেশী ছিলেন। কিন্তু এ প্রতিবেশী কখনও জানতেন না যে আল-কিন্দি ছিলেন একজন
খ্যাতিমান চিকিৎসক। একদিন অকস্মাৎ এ ধনী ব্যবসায়ীর পুত্র প্যারালাইসিস রোগে আক্রান্ত হয়ে
পড়ে। ঐ ব্যবসায়ী তাঁর সন্তানের সুচিকিৎসার জন্য বাগদাদের সকল চিকিৎসককে নিয়োগ করেও তাঁর
সন্তানের রোগ দূর করতে পারেননি বলে হতাশ হয়ে পড়েন। এ অবস্থায় ঐ মহল্লায় কেউ ঐ
ব্যবসায়ীকে বলেন যে, তাঁর প্রতিবেশী আল-কিন্দি খুবই উচ্চস্তরের চিকিৎসক। ঐ ব্যবসায়ী আল
কিন্দির নিকট ছুটে যান এবং তাঁকে তাঁর সন্তানের চিকিৎসা করার অনুরোধ করেন। আল-কিন্দি ঐ
রোগীকে মিউজিকের সাহায্যে রোগমুক্ত করেন। আল-কিন্দি শুধু একজন চিকিৎসকই ছিলেন না, তিনি
একজন উচ্চস্তরের বৈজ্ঞানিক ও ইঞ্জিনিয়ার ছিলেন। তাঁর বিজ্ঞানসংক্রান্ত গ্রন্থাবলী এবং তাঁর ওপর
গবেষণা করে বাইহাকী বলেন যে তিনি একজন বৈজ্ঞানিক ছিলেন। বাইহাকী তাঁকে একজন ভাল
ইঞ্জিনিয়ার বলে অভিহিত করেন। এতদসত্তে¡ও তাঁর দার্শনিক পরিচয়ই ছিল সর্বাগ্রে।
উপরোক্ত আলোচনায় দেখা যায় দার্শনিক আল-কিন্দি বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী ছিলেন। তাঁর মেধা
ও জ্ঞানের আরো পরিচয় পাওয়া যায় তাঁর গ্রন্থাবলীর মধ্যে।
আল-কিন্দির গ্রন্থাবলী
আল-কিন্দির ব্যাপক এবং বহুমুখী জ্ঞানের পরিচয় পাওয়া যায় তাঁর গ্রন্থাবলী থেকে। ইবনে নাদিমের
মতে আল-কিন্দির গ্রন্থের সংখ্যা ছিল ২৪২ খানা। তিনি এসব গ্রন্থের বিষয়বস্তু অনুসারে এগুলিকে (১)
দর্শন, (২) যুক্তিবিদ্যা, (৩) গণিতশাস্ত্র, (৪) স্ফেরিক্স, (৫) চিকিৎসা, (৬) জ্যোতির্বিদ্যা, (৭)
পদার্থবিদ্যা, (৮) মনোবিজ্ঞান, (৯) রাজনীতি, (১০) মেটেওরলজি, (১১) ভিভিনিশন ও (১২)
বিবিধভাগে ভাগ করেন। ফ্লুগেল আল-কিন্দির ২৬২ খানা গ্রন্থের তালিকা সংগ্রহ করেন এবং এগুলিকে
বিভিন্নভাগে বিভক্ত করেন। বিজ্ঞান ও দর্শনের ঐতিহাসিক আল-কিফতী এবং ইবনে আবি উসাহবিয়াহ
এ রকম সংখ্যক গ্রন্থের কথা উল্লেখ করেন। আল কিন্দির গ্রন্থের ব্যাপারে এসব তথ্য খুবই মূল্যবান।
অনুমান করা হয় খুব সম্ভবত আল-কিন্দি তাঁর কিছু গ্রন্থের শিরোনাম দেননি। ১৯৬২ সালে বাগদাদে
আল-কিন্দি স্মরণে এক সম্মেলনে আর. জে. ম্যাকফারথী উপস্থাপিত আল-কিন্দির গ্রন্থের তালিকা
বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। জর্জ এন আতিয়েহ বিভিন্ন উৎস খতিয়ে দেখে মোট ২৭০ খানা গ্রন্থের
একটি তালিকা প্রস্তুত করেন। তিনি বিষয়বস্তু অনুসারে গ্রন্থগুলিকে বিভিন্নভাগে ভাগ করে উপস্থাপন
করেন। আমরা মূলত তাঁর তালিকা থেকে প্রধান প্রধান গ্রন্থগুলি উল্লেখ করব।
ক. দর্শন সংক্রান্ত গ্রন্থ
(১) কিতাব আল-কিন্দি ইলা মু‘তাদিম বিল্লাহ ফিল ফালাসিফা আল-উলা। এ গ্রন্থটি "ঙহ ঋরৎংঃ
চযরষড়ংড়ঢ়যু" নামে খ্যাত।
(২) কিতাব আল-ফালসিফাহ আল-দাখিলাহ ওয়াল মাসাইল আল-মানতিকিয়াহ ওয়াল মুতাসাহ ওয়া
মা ফাউক আল-তাবিয়াত। এ গ্রন্থটি দর্শন, যুক্তিবিদ্যা ও অধিবিদ্যার ওপর লিখিত।
(৩) কিতাব ফি আন্নাহু লা তুনাল আল-ফালাসিফাহ ইলা বি ইলম আল-বিয়াদিয়াত। অংকশাস্ত্র ও
দর্শনের জ্ঞান সংক্রান্ত।
(৪) কিতাব আল-হাসস আলা তায়াল্লুম আল-ফালাসিফাহ-দর্শন পাঠ সংক্রান্ত গ্রন্থ।
(৫) রিসালা ফি কাম্মিয়াত কুতুব অ্যারিস্টুতুওয়া মা ইয়ুহতাজু ইলাইহি ফি তাহসিল আলফালাসিফাহ। এ গ্রন্থখানিতে এ্যারিস্টটলের দর্শনের বিষয়বস্তু এবং গুরুত্ব সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত
আলোচনা করা হয়েছে।
(৬) কিতাব ফি কাস্দ এ্যারিস্টতাসিস ফিল মাকুলাত-এতে এ্যারিস্টটলের ক্যাটেগরিজ সম্পর্কে
আলোচনা করা হয়েছে।
(৭) কিতাব ফি সাইয়াত আল-ইলম ওয়া আকসামিহি-বিজ্ঞানের প্রকৃতি বিভাগ সম্পর্কিত।
(৮) কিতাব আকসাম আল-ইলম আল-উনস-মানব বিজ্ঞানের বিভাগ সম্পর্কে।
(৯) কিতাব রিসালাতুহুল কুবরা ফি মিকিয়ামিহিল ইলমী-বৈজ্ঞানিক নিয়মাবলী সংক্রান্ত তাঁর বড় গ্রন্থ।
(১০) কিতাব রিসালাতুহুল সুগরা ফি খিমায়া সিহিল ইলমী-বৈজ্ঞানিক নিয়মাবলী সম্পর্কে তাঁর ছোট
গ্রন্থ।
(১১) ফি আন্না আফয়াল আলবারী কুল্লুহা আদল লা জাওর ফিহা-সৃষ্টিকর্তার সব কর্ম ন্যায়সংগত এবং
তিনি অন্যায়ের ঊর্ধ্বে।
(১২) রিসালা ফি মাইয়িয়াত মালা ইয়ুসকিন আন ইয়াকুনা লা নিহায়াত লাহু ওয়া মাল্লাজী ইয়ুকালু লা
সিহায়্যাত লাহু-যা কখনও ইনফাইনিট হতে পারে না এবং যাকে ইনফাইনিট বলা হয়।
(১৩) কিতাব ফিল ইবানা আন্নাহু লা ইয়ুমকীন আন ইয়াকুনু .......... ফিল ফুয়া-পৃথিবী অসীম হতে
পারে না এবং এটি কেবল সম্ভাব্যতার মধ্যে।
(১৪) কিতাব ফিল ফাইলাহ ওয়াল মুনফাইলাহ মিন আল তিব-ইয়্যাত আল-উলা পদার্থবিদ্যার প্রথম
পুস্তক সম্পর্কিত।
(১৫) কিতাব ফিল ইবারাত আল জাওয়ামি আল-ফিকরিয়াহ-কিছু বিস্তারিত ধারণা সম্পর্কীয় গ্রন্থ।
(১৬) কিতাব ফি মাসাইল সু‘ইলা আনহা ফি সানফা‘আত আল-রিয়াদিয়াত-গণিত শাস্ত্রের উপকারিতা
সম্পর্কে কিছু প্রশ্নের উত্তর।
(১৭) কিতাব ফি বাহশ কাওল আল মুদ্দাই আল আশইয়া আল খুলকা-প্রাকৃতিক প্রয়োজনীয়তা
সম্পর্কে।
(১৮) কিতাব ফি আওয়াইল আল-আসইয়া আল মাহসুসাহ-সংবেদনশীল বস্তু সম্পর্কে প্রাথমিক
উপাত্ত।
(১৯) রিসালা ফিল তারাফকুক ফিল সিনায়াত-কলা (অৎঃং) সম্পর্কীয় গ্রন্থ।
(২০) রিসালা ইফ রাস্ম রিকা ইলাল খুলাফা ওয়াল ওয়াজুয়া-কিভাবে খলিফা এবং মন্ত্রিদের নিকট
আবেদন করতে হয় এ সম্পর্কে গ্রন্থ।
(২১) রিসালা ফি কিসমাত আল-ফাকুন-আইনের বিভাগ সম্পর্কিত।
(২২) রিসালা ফি মাইয়াত আল আক্ল-বুদ্ধিবুদ্ধি সম্পর্কে এটি দু'বার ল্যাটিন ভাষায় অনূদিত। গ্রন্থটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
(২৩) রিসালা ফিল ফায়েল হাক্ক আল-আওয়াল ওয়াল ফায়েল আল-নাকিস আল্লাজী হুয়া বিল সাজাযপ্রথম সত্য ও আদর্শ এজেন্টের ওপরে লিখিত।
(২৪) রিসালা ইলা আল মামুন ফিল ইল্লাহ ওয়াল মালুল-মামুনের জন্য কার্যকারণ তত্ত¡ সম্পর্কে লিখিত।
(২৫) কিতাব আল তুফফাহ-এ গ্রন্থটি ল্যাটিন ও হিব্রæ ভাষায় অনুবাদ করা হয়।
ইংরেজীতে 'দি বুক অফদি এ্যাপল‘ নামে খ্যাত।
(২৬) ফিল জাওয়াহীর আল-খাম্শাহ-এই বইটি ল্যাটিন ভাষায় অনূদিত হয়।
(২৭) রিসালা ফি ইসতিহ্দার আল আরওয়াহ-স্পিরিট সম্পর্কিত।
(২৮) রিসালা হুদুদ আল আসইয়া ওয়া রুসুমিহা-বস্তুর সংজ্ঞা এবং বিবরণ সম্পর্কিত গ্রন্থ।
(২৯) রিসালা ইলা আলী ইবনে জাহম ফি ওয়াহদানিয়াত ওয়া তানাহি জিরম আল আলম- খোদার
একত্ব এবং বিশ্বের দৈহিক সীমাবদ্ধতা সম্পর্কে লিখিত।
(৩০)আল রিসালাহ আল-হিকমিয়াহ ফি আসরার আল-রুহানিয়া-আত্মার গোপনীয়তা সম্পর্কে
দার্শনিক গ্রন্থ।
(৩১) রিসালা আন্নাহু তুজাদ জাওয়াহীর বিল-আজলাস-দেহ ছাড়া দ্রব্যের অস্তিত্ব সম্পর্কে গ্রন্থ।
আপনি লক্ষ্য করেছেন আল-কিন্দির উপরোক্ত গ্রন্থগুলি দর্শন সংক্রান্ত গ্রন্থ। তাঁর দর্শন সংক্রান্ত গ্রন্থের
সবগুলি এখানে উল্লেখ করা হয়নি। তবুও যেসব গ্রন্থের উল্লেখ করা হল সেগুলির দিকে দৃষ্টিপাত
করলে অনুধাবন করা যায় যে তিনি কত বড় দার্শনিক ছিলেন।
এখন আমরা তাঁর যুক্তিবিদ্যা সংক্রান্ত কিছু গ্রন্থের উল্লেখ করব।
যুক্তিবিদ্যার ওপর লিখিত গ্রন্থ
(৩২) ইখতিসার কিতাব ইসাগহুজি লি ফারফুরিস-পরফাইরির ইসাগোগের সংক্ষিপ্ত সার।
(৩৩)রিসালাতুহু ফিল মাদখাল আল মানতিকী বি ইসতিফা আল কাউল ফিহি-যুক্তিবিদ্যার ভ‚মিকা।
(৩৪)রিসালা বি ইজাম ওয়া ইখতিসার ফিল বুরহান আল মানতিকী।
(৩৫)রিসালা ফি মাকুলাত আল-আসর-দশ ক্যাটেগরি সংক্রান্ত পুস্তক।
(৩৬) রিসালা ফিল ইবানা আন কাউল এ্যারিস্টাটলিস ফি আনালুটিকা-এটির একটি দীর্ঘ নাম আছে।
এতে এ্যারিস্টটলের অ্যানালাইটিকার ওপর আলমাগেস্টের মতামত আছে।
(৩৭)রিসালা ফিল ইখতিরাস মিন খিদা আল সুফিসতাইয়াহ-সফিস্টদের বিবাদকে কিভাবে প্রতিরোধ
করা যায়।
(৩৮)রিসালা ফিল আসওয়াত আল খামসাহ-অন দি ফাইভ ভয়সেস।
(৩৯) রিসালা ফি আমাল আলাহ মুখরিজাত আল-জাওয়াসী-গণিতশাস্ত্রের ভ‚মিকা।
উপরোক্ত দর্শন ও যুক্তিবিদ্যার গ্রন্থ ছাড়াও তিনি মনোবিজ্ঞানের ওপর বেশ কয়েকটি গ্রন্থ রচনা
করেন। এ গ্রন্থগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল-
(৪০)রিসালা ফি আন্না আলা নাফ্স জাওহার বাসিত গাইর দাসির মুয়াশ্সির ফি আল আজলাস-আতœা
সরল দ্রব্য, অমর ও শরীরের ওপর ক্রিয়াশীল।
(৪১) রিসালা ফি মাই ইয়াত আল ইনসান ওয়াল উদাওয়া আল রাইস মিনহু-মানুষের প্রকৃতি এবং তাঁর
প্রধান অংগ প্রত্যংগসমূহ।
আপনি লক্ষ্য করেছেন আল-কিন্দির গ্রন্থের তালিকা বেশ লম্বা হয়ে গেছে। কিন্তু সমস্ত গ্রন্থের তুলনায় প্রদত্ত গ্রন্থের সংখ্যা খুবই কম। যাহোক আল-কিন্দি যদি আরও দু'শত ত্রিশটি বই না লিখতেন তবুও এখানে প্রদত্ত গ্রন্থের তালিকা দেখে আমরা নি:সন্দেহে জানতে পারতাম যে আল-কিন্দি একজন অত্যন্ত উঁচু স্তরের দার্শনিক ছিলেন।
অনুশীলনী
আল-কিন্দির আবির্ভাবকাল ও জীবনী সম্পর্কে একটি বিবরণ দিন এবং তাঁর গ্রন্থাবলীর পরিচয় দিন।
পাঠোত্তর মূল্যায়ন
সত্য/মিথ্যা
১। আল-কিন্দি উমাইয়া যুগে জন্মগ্রহণ করেন। সত্য/মিথ্যা
২। আল-কিন্দি কিন্দাহ গোত্রে জন্মগ্রহণ করেন। সত্য/মিথ্যা
৩। আল -কিন্দিকে অনারব দার্শনিক বলা হয়। সত্য/মিথ্যা
৪। আল-কিন্দি দ্বিতীয় দার্শনিক ছিলেন। সত্য/মিথ্যা
৫। আল-কিন্দির পিতা একজন ব্যবসায়ী ছিলেন। সত্য/মিথ্যা
নৈর্ব্যক্তিক প্রশ্ন
১। আল-কিন্দির পিতামহ ছিলেন
(ক) একজন ব্যবসায়ী (খ) একজন চিকিৎসক
(গ) একজন সাহাবী (ঘ) কোনটিই নয়
২। আল-কিন্দির গ্রন্থের সংখ্যা ছিল
(ক) একশতটি (খ) একশত পঞ্চাশটি
(গ) দু'শত সত্তরটি (ঘ) তিনি কোন গ্রন্থ লিখেননি
৩। আল-কিন্দিকে চাকুরি থেকে বরখাস্ত করেন
(ক) আল-মুতাওয়াক্কিল (খ) আল-মুতাসিম
(গ) আল-মামুন (ঘ) তিনি বরখাস্ত হননি
৪। আল-কিন্দি আব্বাসীয় রাজদরবারে
(ক) দার্শনিক ও চিকিৎসক ছিলেন (খ) কোষাধ্যক্ষ ছিলেন
(গ) সেনাধ্যক্ষ ছিলেন (ঘ) কোনটিই ছিলেন না
৫। আল-কিন্দিকে বলা হয়
(ক) উমাইয়া দার্শনিক (খ) আরব দার্শনিক
(গ) গ্রীক দার্শনিক (ঘ) কোনটিই নয়
রচনামূলক প্রশ্ন
১। সংক্ষেপে আল কিন্দির আবির্ভাবকালে দর্শনচর্চার পরিবেশ সম্পর্কে আলোচনা করুন।
২। আল-কিন্দির কর্মজীবনের পরিচয় দিন। তিনি কি কেবল দার্শনিক ছিলেন?
৩। আল-কিন্দির গ্রন্থাবলী সম্পর্কে মন্তব্য করুন এবং তাঁর দশটি গ্রন্থের নাম লিখুন।
উত্তরমালা
সত্য/মিথ্যা
১। মিথ্যা ২। সত্য ৩। মিথ্যা ৪। মিথ্যা ৫। মিথ্যা
নৈর্ব্যক্তিক প্রশ্ন
১। গ ২। গ ৩। ক ৪। ক ৫। খ।

FOR MORE CLICK HERE
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস মাদার্স পাবলিকেশন্স
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস ১ম পর্ব
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস
আমেরিকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস
বাংলাদেশের ইতিহাস মধ্যযুগ
ভারতে মুসলমানদের ইতিহাস
মুঘল রাজবংশের ইতিহাস
সমাজবিজ্ঞান পরিচিতি
ভূগোল ও পরিবেশ পরিচিতি
অনার্স রাষ্ট্রবিজ্ঞান প্রথম বর্ষ
পৌরনীতি ও সুশাসন
অর্থনীতি
অনার্স ইসলামিক স্টাডিজ প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত
অনার্স দর্শন পরিচিতি প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত

Copyright © Quality Can Do Soft.
Designed and developed by Sohel Rana, Assistant Professor, Kumudini Government College, Tangail. Email: [email protected]