আল-কিন্দির মতে দর্শন কি? তিনি কোন্ সংজ্ঞাটি ?দর্শনের সংগে ধর্মের সম্পর্কের বিষয়ে আল-কিন্দির

দর্শনের সাথে ধর্মের সম্পর্ক স্থাপনের বিষয়টি আল-কিন্দির সময়ে তেমন সহজ ছিল না। আল-কিন্দির
পূর্বে আর কেউ তেমন সাহসী ভ‚মিকা নিয়ে অগ্রসর হননি। সে কারণে আল-কিন্দিকে প্রথম দার্শনিক
বলা যায় যিনি দর্শনের সাথে ধর্মের বা যুক্তির সাথে প্রত্যাদেশের সমন¦য় সাধনের মত কঠিন কাজ
করার প্রয়াস পান। আল-কিন্দি এ দুরূহ কাজ করতে গিয়ে প্রথমে দর্শন কি তা বুঝানোর চেষ্টা করেন।
এরপর দর্শনের সাথে ধর্মের কোন্ বিষয়ে মিল আছে তা খুঁজে বের করেন এবং দর্শন ও ধর্মকে সমান
গুরুত্ব দিয়ে সমন¦য় সাধনের বা সম্পর্ক স্থাপনের দিকে অগ্রসর হন। তিনি অবশ্য পরবর্তীতে দার্শনিক
যুক্তির ঊর্ধ্বে ধর্মের স্থান নির্দেশ করারও চেষ্টা করেন। অবতীর্ণ গ্রন্থের বক্তব্য আল্লাহর বলে তা সম্পূর্ণ
সত্য; কিন্তু দর্শনের যুক্তি মানুষের বলে তা প্রশ্নাতীত নয়। আমরা এখন দেখি তিনি কিভাবে দর্শন ও
ধর্মের মধ্যে সম্পর্ক স্থাপন করেন।
দর্শন ও ধর্মের সম্পর্ক
আল-কিন্দি তাঁর কিতাব ..... ফিল ফালাসিফা আল উলা গ্রন্থে বলেন, “মানবিক কলার মধ্যে উচ্চতম
ও মহত্তম কলা হচ্ছে দর্শন।” তিনি দর্শন সম্পর্কে বলেন, " অর্থাৎ মানুষের সীমাবদ্ধ ক্ষমতার মধ্যে
বস্তুর বাস্তবতার জ্ঞানই দর্শন। এ প্রসঙ্গে তিনি আরও বলেন দার্শনিকদের জ্ঞানের প্রধান উদ্দেশ্য হল
সত্যে পৌঁছানো এবং সেই সত্য অনুসারে কর্ম সম্পাদন করা। দর্শনের বিষয়বস্তুর মহৎ উদ্দেশ্যের জন্য
আল-কিন্দি এভাবে দর্শনকে উচ্চে স্থান দেন। কারণ তাঁর মতে ঐসব বিষয়বস্তুর সংগে, চিরন্তন ও
সর্বজনীন বস্তুর সম্পর্ক আছে।
মুসলিম বিশ্বে বিশুদ্ধ একজন অগ্রদূত হিসেবে আল-কিন্দি দর্শনের বেশ কয়েকটি সংজ্ঞা প্রদান করেন।
তাঁর অনূদিত একটি গ্রন্থ এ গ্রন্থে তিনি যে সংজ্ঞা
প্রদান করেন সেগুলো এরূপ:
(১) কথাটি দুটি শব্দের সমন¦য়ে গঠিত-একটি চযরষড় অর্থাৎ বন্ধু, অপরটি
অর্থাৎ ‘জ্ঞান'। এভাবে শব্দটির অর্থ হল ‘জ্ঞানের প্রতি অনুরাগ'। এ সংজ্ঞা গ্রীক
শব্দাবলী থেকে নেওয়া হয়েছে।
(২) দর্শন হচ্ছে মানুষের স্বর্গীয় উৎকর্ষ লাভের সাধনা করা এবং এ সাধনার ফলে যতটুকু উৎকর্ষ বা শ্রেষ্ঠত্ব লাভ করা সম্ভব হয়।
(৩) দর্শন হচ্ছে মৃত্যুর জন্য অনুশীলন করা। মৃত্যুর অর্থ হল দেহ থেকে আত্মার বিচ্ছিন্নতা।
(৪) দর্শন হল বিজ্ঞানের বিজ্ঞান এবং জ্ঞানের জ্ঞান।
(৫) দর্শন মানুষের নিজস্ব জ্ঞান।
(৬) দর্শনের যথার্থ বিষয়বস্তুর সংজ্ঞা হল এটি সারধর্ম এবং মানুষের সীমাবদ্ধ ক্ষমতা অনুযায়ী বস্তুর কারণের বিজ্ঞান
উপরোক্ত সংজ্ঞাগুলোর মধ্যে আল-কিন্দি সর্বশেষে উল্লিখিত সংজ্ঞাটির ওপর সবচেয়ে বেশী গুরুত্ব
আরোপ করেন। এর সঙ্গে দর্শনকে যুক্ত করেন গুণের অনুশীলন বলে। তাঁর মতে, দার্শনিক হলেন
তিনিই যিনি সত্যের সন্ধান করেন এবং সে অনুসারে বেঁচে থাকেন। পূর্ণ দর্শন কেবল সত্যের জ্ঞান নয়,
বরং সত্যকে কর্মের মধ্যে পরিপূর্ণতা দান করা। তাঁর মতে প্রকৃত জ্ঞানী-জ্ঞান অনুসন্ধান করেন, এ জ্ঞান কার্যে পরিণত করেন।
গুণের অনুশীলন হিসেবে আল-কিন্দির দর্শনের ধারণা সক্রেটিস এবং স্টোয়িকদের মতই দর্শনের
পরিণতির সঙ্গে বা উদ্দেশ্যের সঙ্গে নৈতিকতা সম্পর্কিত। দার্শনিকের দর্শনচর্চার প্রধান উদ্দেশ্য হল
জানা এবং এ জ্ঞান অনুসারে বিজ্ঞের মত যথার্থ কাজ করা। জ্ঞান এবং গুণকে সমভাবে যুক্তির
গুরুত্বপূর্ণ কার্যাবলী বলে অভিহিত করা হয়েছে। এ ধরনের ধারণার মর্মার্থ হচ্ছে পালনীয় নৈতিক
কর্তব্যগুলোর ওপর থেকে ধর্মের ভ‚মিকা হ্রাস করা। অন্যকথায় তিনি নৈতিকতার ব্যাপারে অবতীর্ণ
বাণীর চেয়ে যুক্তিকে গুরুত্বপূর্ণ বলে দেখাতে চান। এ ধরনের ধারণা স্টোয়িক এবং মুতাযিলাদের
মানবীয় মনোভাবের মতই। আল- কিন্দির এ ধরনের মনোভাবের কাছাকাছি মুতাযিলাদের বিবেচনায়
মানুষ যুক্তির দ্বারা আল্লাহ এবং ন্যায় ও অন্যায়ের জ্ঞান অর্জন করতে পারে। যদি তাই হয় তবে
দর্শনকে শুধু তাত্তি¡ক চিন্তার মধ্যে সীমাবদ্ধ করা উচিত নয়; বরং দর্শনকে মানুষের জীবনের বাস্তব স্তর পর্যন্ত সম্প্রসারিত করা উচিত। আল্লাহর একত্বের বিজ্ঞান
আল-কিন্দি তাত্তি¡ক বিজ্ঞানের মধ্যে দর্শনকে ধর্মতত্ত¡ এবং আল্লাহর একত্বের বিজ্ঞান হিসেবে দু'ভাগে
ভাগ করেন। ব্যবহারিক বিজ্ঞানের মধ্যে তিনি নীতিশাস্ত্রকে অন্তর্ভুক্ত করেন। আল-কিন্দির এ অভিমত
এ্যারিস্টটলের অভিমতের অনুরূপ। যাহোক, আল-কিন্দি এখানে স্টয়িকদের আদর্শ গ্রহণ করেন।
কর্মের সংগে জ্ঞানের সম্মিলন ও যুক্তির কাজ শুধু চিন্তন নয়, বরং আবেগকে নিয়ন্ত্রিত করাই হচ্ছে
যথার্থ আদর্শ। যুক্তিকে জ্ঞানের হাতিয়ার হিসেবে প্রমাণ করার প্রচেষ্টার মধ্যে তাঁর উপরোক্ত ধারণার সমর্থন মেলে।
আল-কিন্দি একাধিকবার বলেন যে দর্শনের কার্যাবলীর মধ্যে অন্যতম প্রধান কাজ হচ্ছে সত্যের
অনে¦ষণ করা। তাঁর গ্রন্থে তিনি যেভাবে সত্যের অনুসন্ধান কর্মে প্রবৃত্ত হন, তা
এ্যারিস্টটলের কথাই স্মরণ করিয়ে দেয়। তিনি সত্যের অনুসন্ধান কর্মে প্রবৃত্ত সকল শ্রেণীর মানুষের
প্রতি কৃতজ্ঞতা পোষণ করেন। কারণ তাঁর মতে কোন মানুষই এককভাবে সত্য অর্জনে সক্ষম নন। যে
কারণে সত্য অনে¦ষণের কাজে সহযোগিতা ও সমনি¦ত প্রচেষ্টার প্রয়োজন।
সত্যের মত দর্শনকেও তিনি আক্রমণের হাত থেকে রক্ষা করার প্রচেষ্টা করেন যদিও এখানে তাঁকে
যুক্তি ও অবতীর্ণ বাণীর মধ্যে বিরাজমান সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়। আল-কিন্দি দু'পর্যায়ে এ সমস্যার
মোকাবিলা করেন ঃ প্রথমটি দর্শন ও ধর্মের লক্ষ্যের অভিন্নতার ওপর ভিত্তিশীল; দ্বিতীয়টি জ্ঞানতত্তে¡র ওপর ভিত্তিশীল অর্থাৎ জ্ঞানতাত্তি¡ক।
দর্শন ও ধর্মের অভিন্ন লক্ষ্য
দর্শন ও ধর্মের নৈতিক লক্ষ্যের অভিন্নতা প্রসঙ্গে আল-কিন্দি দর্শনের প্রয়োজনীয়তা এবং এর সঙ্গে
ধর্মের সুসংগতির কথা উল্লেখ করেন। তিনি বলেন যে, দর্শন প্রয়োজনীয়, এটি কোন বিলাসিতা নয়।
তিনি বলেন, যারা দর্শনের বিরোধী তাঁদের বলা উচিত দর্শন প্রয়োজনীয় অথবা অপ্রয়োজনীয়। তাঁরা
যদি দর্শনকে প্রয়োজনীয় বলেন তাহলে তাদের উচিত এর অনে¦ষণ করা। অপরদিকে, তাঁরা একে
অপ্রয়োজনীয় মনে করলে তাঁদের মতের প্রমাণের জন্য তাঁদের যুক্তি প্রদান করতে হবে। তিনি মনে
করেন, এক্ষেত্রে যুক্তি এবং প্রমাণ উপস্থাপন করাই হচ্ছে দর্শন। সুতরাং উভয় ক্ষেত্রে দর্শন
প্রয়োজনীয়।
আল-কিন্দির মতে দর্শন ও ধর্মের কতগুলো অভিন্ন লক্ষ্য আছে। এগুলো হল আল্লাহর একত্বের জ্ঞান
এবং গুণের অনে¦ষণ। তাঁর মতের সমর্থনে তিনি বলেন দর্শনের আওতার মধ্যে পড়ে ধর্মতত্ত¡, আল্লাহর
একত্বের বিজ্ঞান, নীতিশাস্ত্র এবং অন্যান্য ঐ সমস্ত বিজ্ঞান যা মানুষকে মঙ্গলের দিকে পরিচালিত করে
এবং অমঙ্গলকে পরিহার করতে উদ্বুদ্ধ করে। ধর্মের প্রধান কাজও একই রকম। সকল অবতীর্ণ ধর্মের
প্রধান কাজ হচ্ছে আল্লাহর অভিনব একত্বের ও স্বর্গীয় মহিমার প্রচার এবং আল্লাহর দৃষ্টিতে প্রশংসনীয়
সব গুণাবলীর নির্বাচন ও চর্চা করা।
অন্যদিকে আল-কিন্দি মনে করেন তাত্তি¡কভাবে দর্শন ও ধর্ম একই রকম কতগুলো সমস্যার আলোচনা
করে, এর মধ্যে প্রধান সমস্যাটি হচ্ছে আল্লাহর একত্ব। বাস্তব দিক দিয়ে দর্শন ও ধর্মের অভিন্নতর
লক্ষ্য হল মানুষকে উচ্চতর নৈতিক জীবন যাপনের পথে আহবান করা। সুতরাং এই উভয় দিক দিয়ে
আল কিন্দির চিন্তায় এ সত্য ফুটে ওঠে যে দর্শন ও ধর্মের লক্ষ্য একই হওয়ায় এদের মধ্যে কোন তাৎপর্যপূর্ণ পার্থক্য নেই।
ধর্ম ও দর্শনের সম্পর্কের ব্যাপারে আল-কিন্দি ধর্মতত্ত¡কে দর্শনের আওতাভুক্ত করায় তিনি সমস্যার
সম্মুখীন হন। দর্শনের কাজ যদি ধর্মের অবস্থানকে সুদৃঢ় করা হয় তাহলে দর্শন ধর্মের হাতিয়ার
(যধহফসধরফ)-এ পরিণত হয়। আবার অন্যদিকে দর্শন ও ধর্মের সম্পর্কের বিষয়ে জ্ঞানতাত্তি¡ক সমস্যার
উদ্ভব হয়। নৈতিকতার ক্ষেত্রে দর্শন ও ধর্মের লক্ষ্য যদি একই হয়, তবে জ্ঞানতাত্তি¡ক সমস্যার
সমাধানের ক্ষেত্রে দর্শন ও ধর্মকে কি একই সমান ধরা হবে? কোন্ ধরনের জ্ঞান নিশ্চয়াÍক, যুক্তিভিত্তিক
বা নবীকর্তৃক প্রদত্ত জ্ঞান? নবী কর্তৃক প্রদত্ত জ্ঞান কি যুক্তিভিত্তিক, নাকি উভয় প্রকার জ্ঞান বিভিন্ন
উপায়ে একই সত্যে উপনীত হয়?
আল-কিন্দি এ সমস্যার ব্যাপারে কোন সামঞ্জস্যপূর্ণ অবস্থান গ্রহণ করেননি। এক সময় তিনি যৌক্তিক
ও স্বর্গীয় জ্ঞানকে একই রকম নিশ্চয়াÍক বলেন। তিনি স্বর্গীয় জ্ঞানকে যৌক্তিক ও স্বর্গীয় জ্ঞানের
অন্তর্ভুক্ত মনে করেন। আবার অন্য সময় তিনি বলেন যে মানবীয় জ্ঞান নবীর জ্ঞানের চেয়ে নিকৃষ্টতর।
আল-কিন্দির এ ধরনের সমস্যার সম্মুখীন হওয়ার পেছনে যেসব কারণ আছে সেসব কারণগুলো হল ঐ
যুগের চিন্তার প্রবাহ। ধর্মীয় পরিমন্ডলের কথা ব্যাখ্যা করলে তা বুঝা যাবে। তিনি স্বেচ্ছায় এ ধরনের
সমস্যা সৃষ্টি করেননি। কারণ দার্শনিক জ্ঞানকে ধর্মীয় জ্ঞানের চেয়ে বেশি গুরুত্ব প্রদান করা তাঁর যুগে
এক প্রকার অসম্ভব ছিল। কিন্তু আল-ফারাবী এবং ইবনে সিনা তা করতে পেরেছেন পরবর্তীযুগে।
যাহোক, আল-কিন্দির কৃতিত্ব হল, তিনি সকল বাধা দূর করে এবং সাহসিকতার সাথে ধর্ম এবং
দর্শনের সম্পর্কের কথা তাঁর গ্রন্থে তুলে ধরেন। অন্যদিকে তাঁর সময়ে দর্শনের কোন সূক্ষè আলোচনাও
তেমনভাবে গড়ে ওঠেনি। আবার তাঁর গ্রন্থ থেকে বুঝা যায় যে তাঁর পদ্ধতি বিশ্লেষণাÍক ছিল না; বরং
এটি সমন¦য়ধর্মী ছিল। তিনি ধর্ম ও দর্শনের সম্পর্ককে সাধারণ অর্থেই দেখেন। এক্ষেত্রে তিনি দর্শনের
সমস্যার গূঢ়তাত্তি¡ক দিক বিশ্বেষণ করেননি। ধর্ম ও দর্শনের মধ্যে সমন¦য় সাধনের সময় তাঁর মনে এক
ধরনের সমন¦য়ের ব্যাপারে কোন সংশয়ের উদ্রেক হয়নি। এ কারণে তিনি বলেন, “সত্যবাদী মুহাম্মদ
(সঃ)-এর সুন্নাহ এবং যে বাণী তিনি সর্বক্ষমতাবানের নিকট থেকে পান তা বুদ্ধিবৃত্তিক যুক্তি দ্বারা
নিশ্চিত করা যায়। কেবল যথার্থ যুক্তিবিবর্জিত ও অজ্ঞ লোকজনই তা প্রত্যাখ্যান করে।” যাহোক এ
ব্যাপারে তিনি প্রথম ব্যক্তি যিনি প্রতিপাদিত সত্য অনে¦ষণে যুক্তিবিদদের
পদ্ধতি গ্রহণ করেন।
আপাতদৃষ্টিতে, আল-কিন্দি দর্শন ও ধর্মের সম্পর্কের ক্ষেত্রে বা যুক্তি ও প্রত্যাদেশের ক্ষেত্রে যে
সংকটের সম্মুখীন হন, তিনি সে সম্পর্কে নিজেই তাঁর গ্রন্থে এর সমাধানের দিকে
ইঙ্গিত করেন এবং এজন্য তিনি কোরআনের আয়াতের ব্যাখ্যার বিশেষ পদ্ধতি অবলম্বন করেন। তিনি
অবতীর্ণ বাণীকে প্রতীকাশ্রয়ী পদ্ধতির সাহায্যে ব্যাখ্যা করে দেখান যে দর্শন ও ধর্মের সুসম্পর্ক
রয়েছে।
কিন্তু তিনি যখন বলেন যে মানবীয় জ্ঞান (যঁসধহ শহড়ষিবমফমব) নবীর প্রাপ্ত জ্ঞানের চেয়ে নিকৃষ্টতর
তখনই সমস্যাটি স্পষ্ট হয়ে ওঠে। তিনি বলেছেন ধর্ম ও দর্শনের মধ্যে সুসম্পর্ক আছে। কিন্তু মানবীয়
জ্ঞান বা দার্শনিক জ্ঞান যদি স্বর্গীয় জ্ঞানের চেয়ে নিকৃষ্ট হয় তাহলে ধর্ম ও দর্শনের মধ্যে সামঞ্জস্য
কোথায়? আবার তিনি মানুষের ক্ষমতার সীমাবদ্ধতার কথা বলেছেন। অর্থাৎ মানুষ তার সীমাবদ্ধ
ক্ষমতার সাহায্যে আল্লাহ প্রদত্ত জ্ঞানের সমত‚ল্য জ্ঞান অর্জন করতে সক্ষম নয়। দার্শনিক দৃষ্টিকোণ
থেকে নিঃসন্দেহে এটি একটি সমস্যা। আল- কিন্দি খুব সম্ভবত তা অনুধাবন করে এর উত্তর দেন এভাবে:
সুতরাং বুদ্ধিমান মানুষ এ স্পষ্ট সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে যেহেতু এ জ্ঞান বিদ্যমান, সেহেতু এ জ্ঞান
আল্লাহপ্রদত্ত। অথচ সাধারণ মানুষ তাদের প্রকৃতি বা ক্ষমতার সাহায্যে এ ধরনের জ্ঞান অর্জনে সক্ষম
নয়; কারণ এটি তাদের প্রকৃতি (বা ক্ষমতার) এবং যে উপায় তারা অবলম্বন করেন তার ঊর্ধ্বে।
সুতরাং তারা নিজেরাই মান্য করার জন্য আত্মসমর্পণ করেন এবং রাসূলের বাণীর সত্যতায় দৃঢ়ভাবে
বিশ্বাস করেন।
আল-কিন্দির মতে মুসলমানগণ কুরআন বর্ণিত আল্লাহর বাণী অনুসরণ করেন এবং তাঁরা এ বাণীর
নিশ্চিত যুক্তি বিশ্বাসী। দার্শনিকগণ যৌক্তিক প্রতিপাদনে বিশ্বাসী। তাঁদের জ্ঞান যুক্তি প্রতিপাদনের
কতকগুলি স্বচ্ছ নীতির ওপর নির্ভর করে। আল-কিন্দি বলেন, কোরআনের যুক্তি স্বর্গীয় বিধায় তা
দার্শনিক যুক্তির চেয়ে অধিক নিশ্চিত, সুস্পষ্ট ও বিশ্বাসযোগ্য। কোরআন শূন্য থেকে সৃষ্টি এবং
কেয়ামতের মত গুরুত্বপূর্ণ সমস্যার সমাধান দেয়। তাঁর মতে, কোরআনের যুক্তি পরিষ্কার এবং
প্রসারিত বিশ্বাস হওয়ায় এগুলো নিশ্চয়তা এবং নিশ্চয়াÍক বিশ্বাসের উদ্রেক করে। সুতরাং এসব
কোরআনিক যুক্তি দার্শনিক যুক্তির চেয়ে নিঃসন্দেহে শ্রেষ্ঠতর। আল-কিন্দি বলেন, কুরআন থেকে এ
ধরনের যুক্তির উদাহরণ দেওয়া যায়। কুরআনে বর্ণিত আছে একজন অবিশ্বাসী জিজ্ঞাসা করল,
“মাটির সঙ্গে মিশে যাওয়ার পর কে কিভাবে আবার হাড়গুলোতে জীবনদান করবে? উত্তরে কুরআনে
বলা হয়েছে “তিনিই জীবন দান করবেন যিনি আদমকে সৃষ্টি করেছেন।”
কুরআনের দার্শনিক ব্যাখ্যা
আল-কিন্দি কুরআনের দার্শনিক ব্যাখ্যার দ্বার উন্মোচন করেন এবং দর্শন ও ধর্মের সমন¦য় সাধন
করেন। তিনি গ্রন্থে নক্ষত্র গাছপালা এবং অন্যান্য
প্রাকৃতিক বস্তুর আল্লাহকে সিজদা করার উদাহরণ দেন। এখানে এসবের ক্ষেত্রে, সাজাদা শব্দটি
ব্যবহার করেন এবং বলেন যে এরাও আল্লাহকে মান্য করে এবং সিজদাহ করে। এর অর্থ হল
কুরআনে বর্ণিত আয়াতের অর্থ ও যুক্তি অভ্রান্ত এবং মানবীয় যে কোন দার্শনিক যুক্তির চেয়ে উন্নত।
কিন্তু তাই বলে দর্শনের সঙ্গে যে এর বিরোধিতা আছে তা তিনি স্বীকার করেন না, কারণ আয়াতগুলো
যুক্তির সাহায্যে ব্যাখ্যাযোগ্য এবং যুক্তি প্রতিপাদন দর্শনের কাজ।
উপরোক্ত আলোচনার সারমর্মে আমরা বলবো যে তাঁর আলোচনায় আপাতত দুটি বিরোধী ধারা দেখা
যাচ্ছে যার উল্লেখ আগেই করা হয়েছে। একটি ধর্মকে দর্শনের সমান ভাবা বা ধর্মের ব্যাখ্যাকে দর্শনের
যুক্তির প্রভাবাধীন করা এবং আরেকটি হচ্ছে দর্শনের যুক্তির চেয়ে স্বর্গীয় বাণীর উৎকর্ষতা প্রমাণ করা।
তাঁর আলোচনায় এ ধরনের অসঙ্গতির মূলে দুটি কারণ থাকতে পারে। এর একটি হচ্ছে তিনি ঋরৎংঃ
চযরষড়ংড়ঢ়যু গ্রন্থটির পরে তাঁর মনোভাব কিছুটা পরিবর্তন করে ঙহ ঃযব ঘঁসনবৎ ড়ভ অৎরংঃড়ঃষবং
ইড়ড়শং গ্রন্থটি লিখেন। এ গ্রন্থে দ্বিতীয় যুক্তিটি তুলে ধরেন। দ্বিতীয় কারণটি হচ্ছে যৌক্তিকভাবে তাঁর
আলোচনায় কিছুটা অসঙ্গতি ধরা পড়েছে কারণ যুক্তিবিদ্যার সূক্ষè বিশ্লেষণ ও পদ্ধতির প্রয়োগ তখনও
তেমনভাবে শুরু হয়নি। অনেকে পরবর্তী কারণের কথাই বলেন। সে যাহোক তিনি তাঁর যুগের
প্রতিক‚ল পরিবেশে ধর্মকে দর্শনের সঙ্গে যেভাবে যুক্ত করেছেন তা সাহসী পদক্ষেপ। এক ফলেই
পরবর্তীতে আল- ফারাবী, ইবনে সিনা এবং ইবনে রুশদ ধর্ম ও দর্শনের সম্পর্ক নিয়ে আরো খোলাখুলিভাবে আলোচনা করার সুযোগ পেয়েছেন।
অনুশীলনী
আল-কিন্দি কিভাবে ধর্ম ও দর্শনের মধ্যে সমন¦য় সাধন করেন? তাঁর সমন¦য় সাধনের প্রচেষ্টায় কি কোন
অসংগতি আছে? চিন্তা করুন ও লিখুন।
পাঠোত্তর মূল্যায়ন
সত্য-মিথ্যা
১। আল-কিন্দির মতে ধর্ম ও দর্শনের মধ্যে কোন সম্পর্ক নেই। সত্য-মিথ্যা
২। আল-কিন্দির মতে ধর্ম দর্শনের চেয়ে নিকৃষ্টমানের। সত্য-মিথ্যা
৩। আল-কিন্দির মতে দর্শন ও ধর্ম আল্লাহর একত্ব প্রমাণ করে। সত্য-মিথ্যা
৪। আল-কিন্দির মতে দর্শন মানুষের নিজস্ব জ্ঞান। সত্য-মিথ্যা
৫। আল-কিন্দি সর্বপ্রথম দর্শন ও ধর্মের মধ্যে সম্পর্ক স্থাপনের চেষ্টা করেন। সত্য-মিথ্যা
নৈর্ব্যক্তিক প্রশ্ন
১। আল-কিন্দির মতে মানবিক কলার মধ্যে উচ্চতম এবং মহত্তম কলা হচ্ছে
(ক) বিজ্ঞান (খ) চারুকলা
(গ) দর্শন (ঘ) সৌন্দর্য বিজ্ঞান
২। আল-কিন্দির মতে দর্শনের অন্যতম প্রধান কাজ হচ্ছে
(ক) যুক্তির অনে¦ষণ করা (খ) সত্যের অনে¦ষণ করা
(গ) খোদার অনে¦ষণ করা (ঘ) কোনটিই নয়।
৩। আল-কিন্দি ধর্মতত্ত¡কে দর্শনের
(ক) আওতাভুক্ত করেন (খ) বিরোধী মনে করেন
(গ) শাখা মনে করেন (ঘ) কোনটিই মনে করেন না।
৪। আল-কিন্দির মতে কোরআনের যুক্তি দর্শনের যুক্তির চেয়ে
(ক) নিশ্চয়াÍক (খ) দুর্বল
(গ) শক্তিশালী (ঘ) কোনটিই নয়।
৫। আল-কিন্দির মতে যুক্তি জ্ঞান অর্জনের
(ক) হাতিয়ার (খ) ভিত্তি
(গ) লক্ষ্য (ঘ) কোনটিই নয়।
রচনামূলক প্রশ্ন
১। আল-কিন্দির মতে দর্শন কি? তিনি কোন্ সংজ্ঞাটি বেছে নেন?
২। দর্শনের সংগে ধর্মের সম্পর্কের বিষয়ে আল-কিন্দির বক্তব্য সংক্ষেপে লিখুন।
৩। আল-কিন্দির দর্শন ও ধর্মের সম্পর্কের আলোচনায় যে অসংগতি দেখা যায় তা চিন্তা করে বের
করুন এবং লিখুন।
উত্তরমালা
সত্য-মিথ্যা
১। মিথ্যা ২। মিথ্যা ৩। সত্য ৪। সত্য ৫। সত্য
নৈর্ব্যক্তিক প্রশ্ন
১। গ ২। খ ৩। ক ৪। ক ৫। ক।

FOR MORE CLICK HERE
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস মাদার্স পাবলিকেশন্স
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস ১ম পর্ব
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস
আমেরিকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস
বাংলাদেশের ইতিহাস মধ্যযুগ
ভারতে মুসলমানদের ইতিহাস
মুঘল রাজবংশের ইতিহাস
সমাজবিজ্ঞান পরিচিতি
ভূগোল ও পরিবেশ পরিচিতি
অনার্স রাষ্ট্রবিজ্ঞান প্রথম বর্ষ
পৌরনীতি ও সুশাসন
অর্থনীতি
অনার্স ইসলামিক স্টাডিজ প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত
অনার্স দর্শন পরিচিতি প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত

Copyright © Quality Can Do Soft.
Designed and developed by Sohel Rana, Assistant Professor, Kumudini Government College, Tangail. Email: [email protected]