দুরদর্শিতা বলতে কী বুঝায়? দূরদর্শিতার সাথে নৈতিকতার যোগসূত্রটি নৈতিকতার সাথে দূরদর্শিতার পার্থক্য করুন। এ প্রসঙ্গে সক্রেটিসের দৃষ্টিভঙ্গি

নৈতিকতা এবং অন্যান্য আরো কিছু মানব সংশ্লিষ্ট বিষয় আমরা বিশেষ করে সমাজের সঙ্গে নৈতিকতার সংশ্লিষ্টতার বিষয়টি বুঝতে পেরেছি। কিন্তু
নৈতিকতা ছাড়াও সমাজকে তথা সমাজের মানুষকে আরো অনেক বিষয় নিয়ে ভাবতে হয়। এসব
ভাবনার সঙ্গে নৈতিকতার কিছু যোগসূত্র থাকা খুবই স্বাভাবিক ব্যাপার। নৈতিকতা সম্পর্কে অধিকতর
জ্ঞান লাভের জন্য আমাদেরকে তাই ঐ যোগসূত্রগুলোর প্রকৃতি সম্পর্কে জানতে হবে। ব্যক্তি বা সমাজ জীবনে গুণ হিসেবে দূরদর্শিতা খুবই মূল্যবান বিষয় বিবেচিত হয়ে থাকে। এর
প্রকাশ দেখা যায় সমাজে দূরদর্শী লোকদের প্রশংসায়। আমরা যখন নেতা নির্বাচন করি তখন দূরদর্শী
লোকদেরই প্রাধান্য দেই এবং ব্যক্তিগত আপদে-বিপদে দূরদর্শী লোকদের উপদেশ মেনে চলি। এর
কারণ একটাই। দূরদর্শী লোক কোথায় আমাদের সুবিধা নিহিত তা আগে থেকে দেখতে পান। এই
সুবিধার ব্যাপারটা বহুকাল থেকে বিভিন্ন লোকের নৈতিক চিন্তায় বেশ গুরুত্ব পেয়ে আসছে। এর ফলে
অনেকেই দূরদর্শিতাকে নৈতিকতার সঙ্গে অভিন্ন করে দেখায় অভ্যস্তহয়ে গেছেন। তাঁদের মতে
নৈতিকতা পরিণামে আমাদেরকে লাভবান করে। এই বিষয়টাকে বিভিন্ন উপকথা-উপাখ্যানের
মাধ্যমে তুলে ধরার প্রচেষ্টা খুবই প্রাচীন। আমরা এখানে রাখাল ও বাঘের গল্পটির কথা উল্লেখ করতে
পারি।
রাখাল নিছক মজা করার জন্য প্রায়ই ‘বাঘ!’ ‘বাঘ!’ বলে চিৎকার করে। লোকজন তার চিৎকার
শুনে অস্ত্রহাতে বেরিয়ে আসে তাকে সাহায্য করার জন্য। রাখাল হাসতে থাকে লোকদেরকে বোকা
বানাতে পেরেছে বলে। একদিন কিন্তু সত্যি সত্যিই বাঘ আসে। রাখাল সেদিনও চিৎকার করে, বাঘ!
বাঘ! কিন্তু কেউ আর সেদিন আসে না। তারা বুঝে গেছে রাখাল সত্য কথা বলছে না। অতএব
রাখালের স্থান হয় বাঘের পেটে। প্রমাণিত হয় সত্য কথা না বলার পরিণাম হয় কি দুঃখজনক।
রাখাল দূরদর্শী হলে কখনো মিথ্যা বলত না। দূরদর্শিতা আর নৈতিকতার মধ্যে অভিন্নতার এর চেয়ে
আর বড় প্রমাণ কি হতে পারে? গল্পের শেষে তাই প্রায়ই উপদেশ লেখা থাকে “সত্যের জয়
সুনিশ্চয়”, কিংবা “মিথ্যা ধ্বংস টেনে আনে” ইত্যাদি।
ঘুঘু ও পিপীলিকার গল্পটিও কম শিক্ষাপ্রদ নয়। ছোট্ট পিপীলিকাকে ভেসে যেতে দেখে ঘুঘু একটি
গাছের পাতা ছিঁড়ে ফেলে দেয় পিপীলিকার সামনে। তাতে চড়ে পিপীলিকার প্রাণ বাঁচে। পিপীলিকা
একথা ভুলে না। একদিন সে দেখে এক শিকারী সেই উপকারী ঘুঘুটির দিকে তীর নিশানা করে
আছে ছোড়ার অপেক্ষায়। সে কামড়ে দেয় শিকারীর পা। এতে শিকারীর লক্ষ্য ভ্রষ্ট হয়। পালিয়ে যায়
ঘুঘু। প্রমাণ হয় “উপকারীর উপকার কখনো বৃথা যায় না”।
এই সব গল্পের শিক্ষা গোড়ার দিকে দার্শনিকদেরকে বেশ প্রভাবিত করেছে বলেই মনে হয়। তাই
দেখা যায় প্লেটোর ‘রিপাবলিক’ গ্রন্থে গøাউকন ও এডিমেন্টাসের সঙ্গে তর্কে লিপ্ত হয়ে সক্রেটিস
দূরদর্শিতা প্রশংসনীয় গুণ তাই অনেকেই দূরদর্শিতাকে নৈতিকতার সংগে অভিন্ন করে দেখেন। দূরদর্শী লোক দেখেন, মিথ্যা ধ্বংস ডেকে আনে। তাঁরা আরো দেখেন, উপকারীর উপকার বৃথা যায় না। সক্রেটিসও নৈতিকতার ক্ষেত্রে দ রদর্শিতার নীতিকে স্বীকৃতি দিয়েছেন।
নৈতিক জীবনের পক্ষে যে যুক্তি দেন তা দূরদর্শিতার নীতিকে অস্বীকার করে না। তিনি অন্তত স্বীকার
করেন যে, নৈতিকতা ও সুবিধার নীতি পরস্পর বিরোধী নয়। গ- াউকন ও এডিমেন্টাসের যে যুক্তির
বিরুদ্ধে তিনি তার বক্তব্য উপস্থাপন করেন তা এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে। তাঁদের যুক্তি ছিল
মানুষ সুযোগ পেলে খারাপ হবেই। একটা গল্পের মাধ্যমে তাঁরা তাঁদের বক্তব্যকে তুলে ধরেন। গল্পটি
এ রকম: এক রাখাল ঘটনাক্রমে এমন একটি আংটির অধিকারী হয় যা আঙ্গুলে পরার পর উল্টো
দিকে ঘুরালে সে অদৃশ্য হয়ে যায়। এই অদৃশ্য হয়ে যাওয়ার ক্ষমতা অর্জন করার পর নিরীহ রাখালটি
তার দেশের রাজার স্ত্রীকে প্রলুব্ধ করে এবং তার সহায়তায় রাজাকে হত্যা করে রাজ্য দখল করে
নেয়। এই গল্পটি উল্লেখ করে তাঁরা যুক্তি দেখান: “এখন ধরা যাক এ ধরনের দুটো যাদুর আংটি
রয়েছে, যাদের একটি পড়েছে একজন ন্যায়পরায়ণ ব্যক্তির হাতে এবং অপরটি পড়েছে একজন
অন্যায়কারীর হাতে। এই অবস্থায় এমন কোন লৌহকঠিন প্রকৃতিসম্পন্ন লোকের কথা কল্পনা করা যায়
না যে ন্যায়ের পক্ষে দৃঢ়ভাবে দাঁড়াবে। কেউ, যা তার নিজের নয় এমন বস্তুর ওপর থেকে তার হাত
সরিয়ে নিবে না যখন সে বাজারে যা পছন্দ করে তা নিরাপদে উঠিয়ে নিতে পারবে; অথবা মানুষের
ঘরে ঢুকে যে কারো সাথে শুয়ে পড়তে পারবে; অথবা যে কাউকে হত্যা করতে বা বন্দীদশা থেকে
মুক্ত করতে পারবে এবং এসব করে মানুষের মাঝে সে দেবতাতুল্য হয়ে যেতে পারবে। তখন
ন্যায়কারীর কাজ হবে অন্যায়কারীর কাজের মত। অবশেষে তারা একই বিন্দুতে এসে পৌঁছাবে।
এটাকেই আমরা এর একটা বড় প্রমাণ ধরতে পারি যে মানুষ ইচ্ছাকৃতভাবে ন্যায়বান হয় না অথবা
এজন্যও হয় না যে ব্যক্তিগতভাবে ন্যায় তার কোন উপকারে আসবে। বরং সে ন্যায়বান হয় দায়ে
পড়ে। কেননা যখনই কেউ মনে করে যে, সে সহিহ-সালা মতে অন্যায়কারী হতে পারবে, সে তাই
হয়। কেননা সব মানুষই সর্বান্তকরণে বিশ্বাস করে যে, ব্যক্তির জন্য অন্যায় ন্যায়ের চেয়ে অনেক
বেশি লাভজনক... যদি আপনি কল্পনা করতে পারেন যে কারো এই ধরনের অদৃশ্য হয়ে যাওয়ার
ক্ষমতা রয়েছে এবং তদ্সত্তে¡ও কখনো কোন অন্যায় কাজ করছে না, অথবা অন্যের জিনিষে হাত
রাখছে না, তাহলে দর্শকরা তাকে মনে করবে অত্যন্তজঘন্য বোকা গর্দভ বলে, যদিও তারা একে
অন্যের কাছে তার প্রশংসা করবে এবং একে অন্যের সঙ্গে মেলামেশা করবে এই ভয় থেকে যে
তাদের ওপর অন্যায় হতে পারে”।
নৈতিক জীবন যাপনের বিরুদ্ধে এহেন অপবাদের বিরুদ্ধে নৈতিকতার বাস্তব সুবিধার দিকগুলোর
প্রতি সক্রেটিসের অঙ্গুলি-নির্দেশকে অসমীচীন বলা চলে না। বিশেষ করে নৈতিকতায় বিশ্বাসী
মানুষের জন্য এটা খুবই প্রয়োজনীয়। তবে সক্রেটিসের এ প্রচেষ্টাকে গতানুগতিক দূরদর্শিতার নীতি
বলা চলে না, এই কারণে যে প্রকৃত নীতিবান লোক কোন পুরস্কারের আশায় নৈতিক জীবন যাপন
করে তা তিনি মনে করতেন না, কেননা সদ্গুণ নিজেই তার পুরস্কার একথা তিনি প্রচার করতেন।
তার জীবন যাপনেও তার প্রকাশ দেখতে পাওয়া যায়।
দার্শনিকদের বৃহৎ অংশ শেষোক্ত সক্রেটিসেরই অনুসারী। ভাল-মন্দ, ন্যায়-অন্যায় বোধের নিজস্ব
একটা মূল্য রয়েছে এ ধারণা অধিকাংশ দার্শনিকই পোষণ করে থাকেন। তাঁরা অন্তত একথা মনে
করে থাকেন যে, নৈতিক দৃষ্টিকোণ বলতে যা বুঝায় তার সঙ্গে ব্যক্তি মানুষের কামনা-বাসনা বা
সুবিধা-অসুবিধার বিষয়গুলো খুব একটা খাপ খায় না। আমাদের কান্ডজ্ঞানও এই মত সমর্থন করে।
শুধু তাই নয় এর পেছনে মনস্তাত্তি¡ক দিক থেকেও সমর্থন রয়েছে। এই শতাব্দীর প্রথম দিকে
ব্যাপকভাবে আদৃত ফ্রয়েডীয় মনস্তত্তে¡ নৈতিকতা ও দূরদর্শিতার পার্থক্য স্বীকার করা হয়েছে। ফ্রয়েড
মানুষের ব্যক্তিত্বে তিনটি স্তর আছে বলে মনে করতেন। এগুলো হচ্ছে ইড্, ইগো ও সুপার ইগো। তবে সক্রেটিস বিশ্বাস করতেন যে, প্রকৃত নীতিবান লোক কোন পুরস্কারের আশায় নৈতিক জীবন যাপন করে না। বেশির ভাগ দার্শনিক শেষোক্ত সক্রেটিসের অনুসারী। এমনকি মনস্তত্ত¡বিদ ফ্রয়েডও এই দলে রয়েছেন।
ইড্ হচ্ছে মানুষের এমন এক বাসনা যা অন্ধের মত তার লক্ষ্যের দিকে ছুটতে চায়। ইগো বাস্তব
পরিবেশ পরিস্থিতির আলোকে একে নিয়ন্তণ করে। অর্থাৎ ইগো ইডকে দূরদর্শিতার নীতি শেখায়।
কিন্তু ইডের ওপরে রয়েছে সুপার-ইগো যা বাস্তবতার ঊর্ধ্বে কোন আদর্শ বা নৈতিকতার আলোকে
ব্যক্তির জীবনকে পরিচালিত করার চেষ্টা করে। মনোবিজ্ঞানে আজকাল ফ্রয়েডীয় তত্তে¡র ততটা
সমাদর না থাকলেও দার্শনিক তত্ত¡ হিসেবে এর এখনো ঢের মূল্য রয়েছে।
নৈতিকতা ও দূরদর্শিতা এক নয় একথা স্বীকার করে নিলেও তারা যে একেবারে সম্পর্কহীন একথা
বোধ হয় পূর্বোক্ত আলোচনার আলোকে নিঃসংশয়ে বলা যায় না। কিন্তু এমন দার্শনিকও আছেন যিনি
এ ব্যাপারে আপোসহীন। তিনি হচ্ছেন জার্মান দার্শনিক কান্ট। আমরা যথাস্থানে তাঁর সম্পর্কে আলোচনা করব। যারা দূরদর্শিতাকে নৈতিকতার সংগে সম্পর্কহীন মনে করেন তাঁদের মধ্যে সবচাইতে বিখ্যাত হচ্ছেন জার্মান দার্শনিক কান্ট।
রচনামূলক প্রশ্ন
১। দুরদর্শিতা বলতে কী বুঝায়? দূরদর্শিতার সাথে নৈতিকতার যোগসূত্রটি ব্যাখ্যা করুন।
২। নৈতিকতার সাথে দূরদর্শিতার পার্থক্য করুন। এ প্রসঙ্গে সক্রেটিসের দৃষ্টিভঙ্গি ব্যাখ্যা করুন।
নৈর্ব্যক্তিক প্রশ্ন
সঠিক উত্তর লিখুন
১। নেতা নির্বাচনের ক্ষেত্রে আমরা দূরদর্শী লোকদের প্রাধান্য দেই, কেননা
ক. দার্শনিকেরা আমাদের এরূপ করার উপদেশ দিয়েছেন।
খ. দূরদর্শী লোকেরা অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারী।
গ. দূরদর্শী লোকেরা কোথায় আমাদের সুবিধা নিহিত তা আগে থেকে দেখতে পান।
২। সক্রেটিস অন্ততঃ স্বীকার করেন যে
ক. নৈতিকতা ও সুবিধার নীতি পরস্পর বিরোধী নয়।
খ. নৈতিকতা ও সুবিধার নীতি পরস্পর বিরোধী।
গ. নৈতিকতা পরিণামে অশুভ ফল বয়ে আনে।
৩। গøাউকন ও এডিমেন্টাসের মতে
ক. মানুষ সুযোগ পেলেও অনেক সময়ই খারাপ হয় না।
খ. খারাপ হওয়ার যথেষ্ট সুবিধা থাকা সত্তে¡ও অনেক মানুষ ভালো থেকে যায়।
গ. মানুষ সুযোগ পেলে খারাপ হবেই।
৪। দার্শনিকদের বৃহৎ অংশের মতে
ক. ভাল-মন্দ, ন্যায়-অন্যায় বোধের নিজস্ব একটি মূল্য রয়েছে।
খ. ভাল-মন্দ, ন্যায়-অন্যায় বোধের কোন নিজস্ব মূল্য নেই।
গ. ভাল-মন্দ, ন্যায়-অন্যায় বোধের মূল্য ব্যক্তির কামনা-বাসনার সাথে জড়িত।
সত্য/মিথ্যা
১। দূরদর্শী লোক কোথায় আমাদের সুবিধা নিহিত তা আগে থেকে দেখতে পান- সত্য/মিথ্যা।
২। সক্রেটিস মনে করতেন নৈতিকতা ও সুবিধার নীতি পরস্পর বিরোধী- সত্য/মিথ্যা।
৩। নৈতিকতা ও দূরদর্শিতার সম্পর্ক ব্যাখ্যার ক্ষেত্রে সক্রেটিস ছিলেন গøাউকন ও এডিমেন্টাসের
অনুসারী- সত্য/মিথ্যা।
৪। ফ্রয়েডীয় মনস্তত্তে¡ নৈতিকতা ও দূরদর্শিতার মধ্যে পার্থক্য স্বীকার করা হয়েছে- সত্য/মিথ্যা।
৫। সক্রেটিস মনে করতেন সদ্গুণ নিজেই তার পুরস্কার- সত্য/মিথ্যা। সঠিক উত্তর
নৈর্ব্যক্তিক প্রশ্ন: ১। গ ২। ক ৩। গ ৪। ক
সত্য/মিথ্যা: ১। সত্য ২। মিথ্যা ৩। মিথ্যা ৪। সত্য ৫। সত্য

FOR MORE CLICK HERE
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস মাদার্স পাবলিকেশন্স
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস ১ম পর্ব
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস
আমেরিকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস
বাংলাদেশের ইতিহাস মধ্যযুগ
ভারতে মুসলমানদের ইতিহাস
মুঘল রাজবংশের ইতিহাস
সমাজবিজ্ঞান পরিচিতি
ভূগোল ও পরিবেশ পরিচিতি
অনার্স রাষ্ট্রবিজ্ঞান প্রথম বর্ষ
পৌরনীতি ও সুশাসন
অর্থনীতি
অনার্স ইসলামিক স্টাডিজ প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত
অনার্স দর্শন পরিচিতি প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত

Copyright © Quality Can Do Soft.
Designed and developed by Sohel Rana, Assistant Professor, Kumudini Government College, Tangail. Email: [email protected]