আইন কি? নৈতিকতা ও আইনের স¤পর্ক ব্যাখ্যা করুন।

নৈতিকতা ও আইনের মধ্যে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক লক্ষ্য করা যায়। দেখা যায় পৃথিবীতে যেসব ফৌজদারী ও
দেওয়ানী আইন রয়েছে তার বেশির ভাগই কোন না কোন নৈতিক নিয়মকে সমর্থন করে। হত্যা,
চুরি, ডাকাতি, ধর্ষণ ইত্যাদি আইন-বিরুদ্ধ কর্মসমূহ নৈতিকতা-বিরুদ্ধও বটে। এ থেকে
স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্নওঠতে পারে, আইন মানার মধ্যেই কি নৈতিকতা নিহিত? এই প্রশ্নের উত্তরে
আবার সক্রেটিসের দ্বারস্থ হওয়া যেতে পারে। এবার প্লেটোর বিখ্যাত সংলাপ ক্রিটো থেকে
সক্রেটিসের বক্তব্য আমরা তুলে ধরব। দৃশ্যটা এই রকম: এথেন্সের বিচারকদের রায়ে সক্রেটিসের
প্রাণদন্ড হয়ে যাওয়ার পর তাঁকে যে কক্ষে অন্তরীণ করে রাখা হয়েছে সেখানে তাঁর শিষ্য ক্রিটো এসে
তাঁকে প্ররোচিত করছে পালিয়ে যাওয়ার জন্য। বস্তুত অবস্থাটা এমনি ছিল যে, সক্রেটিস পালিয়ে
যেতে পারতেন। এমন ইঙ্গিতও পাওয়া যায় যে, কর্তৃপক্ষও তাই চাচ্ছিলেন। কিন্তু এ ব্যাপারে
সক্রেটিসের বিন্দুমাত্র আগ্রহ ছিল না, কেননা তিনি মনে করতেন যে, আইনের প্রতি অশ্রদ্ধা প্রদর্শন
করা অনৈতিক। ক্রিটোকে প্রদত্ত তাঁর যুক্তি ছিল এই রকম:
“ধরো, যখন আমরা এখান থেকে পালিয়ে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছি তখন এথেন্সের আইন ও তার
সংবিধান এসে আমাদের সামনে দাঁড়াল এবং প্রশ্ন করল, “সক্রেটিস এখন তুমি কি করতে যাচ্ছে?
তুমি কি অস্বীকার করতে পার যে, তুমি যে কাজটি করার চিন্তা করছ তার দ্বারা তুমি তোমার সাধ্যমত
আমাদেরকে আইন ও সমগ্র রাষ্ট্রকে ধ্বংস করার মতলব আঁটছো না? তুমি কি কল্পনা করতে পার যে,
একটি শহর টিকে থাকবে এবং তাতে কোন উলট-পালট ঘটবে না যদি এতে যেসব আদালতের রায়
হয় তার কোন প্রয়োগ থাকে না, বরং প্রজাবর্গের দ্বারা তা বিলুপ্ত ও ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়? এই প্রশ্নের ও
অন্যান্য প্রশ্নের কী করে আমরা উত্তর দিব ক্রিটো?”
এরপর সক্রেটিস রাষ্ট্রের সঙ্গে ব্যক্তির সম্পর্ক নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেন। এ সম্পর্ককে তিনি
পিতা-মাতার সঙ্গে সন্তানের সম্পর্ক কিংবা অভিভাবকের সঙ্গে তাঁর প্রতিপাল্যের সম্পর্ক কিংবা
প্রতিশ্রæতের সঙ্গে প্রতিশ্রæতি-দানকারীর সম্পর্ক হিসেবে চিত্রিত করেন। শেষোক্ত সম্পর্কটির ব্যাপারে
সক্রেটিসের মতে আইন যা বলতে পারে তা হচ্ছে, “বাধ্যতা প্রদর্শনের প্রতিশ্রæতি দান সত্তে¡ও সে
আমাদেরকে না গ্রাহ্য করছে, না আমাদের সিদ্ধান্তের ব্যাপারে আমাদের যদি কোন ত্রæটি থেকে থাকে তা শোধরানোর জন্য অনুরোধ করছে; যদিও আমাদের সকল আদেশই হচ্ছে পৃথিবীতে বেশির ভাগ আইনই নৈতিক নিয়ম সমর্থন করে। সক্রেটিসের মতে আইনের প্রতি অশ্রদ্ধা প্রদর্শন অনৈতিক, কারণ এর ফলে রাষ্ট্রে বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়। সক্রেটিসের মতে রাষ্ট্রের সংগে আইন পালনের ব্যাপারে মানুষ প্রতিশ্রæতিবদ্ধ। অতএব আইন মানা নৈতিকভাবে জরুরী।
প্রস্তাবনার আকারে উপস্থাপিত, কোন জংলী ফরমান নয় এবং যদিও আমরা তাঁকে তার পক্ষে
আমাদের মনে প্রত্যয় উৎপাদন করার চেষ্টা করার অথবা আমরা যা বলি তা মানার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত
নেয়ার স্বাধীনতা দিয়েছি, সে বাস্তবে এর একটিও করছে না।”
সক্রেটিসের উপর্যুক্ত বক্তব্যে নৈতিকতার ওপর যেমন আইনের দাবিকে প্রতিষ্ঠিত করার প্রচেষ্টা দেখা
যায়, তেমনি আইনের ওপর নৈতিকতার দাবিরও সমর্থন মিলে। প্রথমতঃ তিনি দেখিয়েছেন যে,
আইনের উৎস হচ্ছে রাষ্ট্র এবং ব্যক্তির মধ্যে একটি অলিখিত চুক্তি যাতে ব্যক্তি কর্তৃক রাষ্ট্রকে মান্য
করার একটি প্রতিশ্রæতি বর্তমান; আর যে কোন প্রতিশ্রæতি প্রদান এবং তা রক্ষা করার ব্যাপারই
নৈতিকতার অন্তর্গত। আবার তাঁর বক্তব্যে এ কথারও সমর্থন রয়েছে, রাষ্ট্রের আদেশ ব্যক্তির জন্য
মানা তখনই উচিত যখন তা যথেষ্ট নৈতিক গুণসম্পন্ন হয়। আইনের পক্ষে নৈতিক গুণসম্পন্ন হওয়ার
প্রধান লক্ষণ হচ্ছে এই যে, এ নিছক জংলী ফরমান হবে না, এর মধ্যে সভ্য মানুষের জীবন ধারার
প্রতিফলন থাকবে।
আধুনিক ভাষায় বললে বলতে হয়, সক্রেটিসের মতে সব আইনই মানুষ কর্তৃক সৃষ্ট আইন
(চড়ংরঃরাব ষধ)ি। তবে তিনি একথাও স্বীকার করেন যে যদি এসব আইনের পেছনে প্রাকৃতিক
আইনের (ঘধঃঁৎধষ ষধ)ি কোন সমর্থন না থাকে তবে তা আইন পদবাচ্য হতে পারে না। প্রাকৃতিক
আইন বলতে ঐসব আইনকে বুঝায় যাতে প্রাকৃতিক ন্যায়ের (ঘধঃঁৎধষ লঁংঃরপব) ধারণা বিদ্যমান
থাকে যা সর্ব অবস্থায় সর্ব সমাজে প্রযোজ্য কিছু নৈতিক বিধান বৈ নয়। এগুলোর যথার্থতা মানুষ
ন্যূনতম বুদ্ধি প্রয়োগ করলেই বুঝতে পারে।
অনেকেই মনে করেন, প্রাকৃতিক আইনের এই ধারণা আইনের ক্ষেত্রে নৈতিকতাকে টেনে আনার
ব্যাপারে বড় ভ‚মিকা পালন করলেও পরিণামে আইনী ও নৈতিক সংস্কারকে অসম্ভব করে তুলে।
তাঁদের মতে বিশ্বের পরিবেশ পরিস্থিতির মধ্যে যে বৈচিত্র্য রয়েছে এবং সময়ের আবর্তনে সর্বত্র যে
পরিবর্তন সাধিত হয়ে চলছে তাতে এক সর্বজনীন ও সর্বকালীন আদর্শ মানুষের বাস্তব
প্রয়োজনীয়তাকে অস্বীকার করতে পারে। অন্তত আমাদের আইনী ও নৈতিক চিন্তার মধ্যে একটা
অস্পষ্টতা ও অনিশ্চয়তা যে সৃষ্টি হতে পারে এ ব্যাপারে কোন সন্দেহ নেই। এই অস্পষ্টতা ও
অনিশ্চয়তার ব্যাপারটিকে সিজউইক এভাবে ব্যক্ত করেছেন “ধরা যাক, আমি একজন দাস মালিক,
এমন এক সমাজে যেখানে দাস-প্রথা প্রচলিত। আমার দৃঢ় বিশ্বাস যে, মানুষকে সম্পত্তি করে রাখার
এই ব্যবস্থাকে আইনের মাধ্যমে তুলে দিতে হবে। কিন্তু এর মানে এই নয় যে, আমার দাসটিকে
এখনি মুক্তি দিয়ে দেয়া আমার নৈতিক দায়িত্ব। আমি এই ধরনের চিন্তা করতে পারি যে,
তাৎক্ষণিকভাবে সাধারণ দাসত্বের অবসান শুধু নিষ্ফলই নয়, এমনকি দাসদের জন্যও অসুবিধাজনক।
তাদের জন্য প্রয়োজন, আস্তেআস্তেস্বাধীনতার জন্য শিক্ষা গ্রহণ করা : এর অর্থ হলো সাময়িকভাবে
ঐ ধরনের আইনী পরিবর্তন লক্ষ্য হওয়া উচিত যা দাস প্রথার সব চাইতে খারাপ বিষয়গুলো সামাল
দিবে এবং এর মধ্যে দাসদের সঙ্গে মানবিক ও বিবেচনাপূর্ণ ব্যবহারের উদাহরণ তুলে ধরবে।” বলা
বাহুল্য, এই ধরনের চিন্তা দাসপ্রথা তুলে দেয়ার ক্ষেত্রে সহায়ক হতে পারে না। নৈতিক চিন্তায়
উপর্যুক্ত অস্পষ্টতার কারণে অনেক সময় মানুষের ভোগান্তির সীমা থাকে না। আমাদের সমাজ জীবন
থেকে একটি দৃষ্টান্তনেয়া যাক। পতিতাবৃত্তি অনৈতিক তা কে না মানে? কিন্তু রাষ্ট্রীয় আইন একে সহ্য
করে এমন সব যুক্তি দিয়ে যাদেরকে বাস্তবতার নিরিখে অগ্রাহ্য করা যায় না। রাষ্ট্র আবার আইন করে আইন মানা নৈতিকভাবে জরুরী, তবে আইনকেও নৈতিক গুণসম্পন্ন হতে হবে। সক্রেটিসের মতে প্রাকৃতিক আইনের সমর্থন না থাকলে কোন আইনই প্রকৃত আইন হয় না।
একে বৈধও করতে পারে না নৈতিক চাপের কারণে। ফলে এই পেশার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট নারীদের সব
ধরনের অবিচারের শিকার হতে হয়।
কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, নৈতিক আদর্শ বাস্তবায়নের ব্যাপারে অনিশ্চয়তা ও অস্পষ্টতার কারণে আইন থেকে
এর পুরোপরি বিযুক্তি কি আদৌ কাম্য? মনে হয় সক্রেটিস কখনো তা সমর্থন করতেন না, কেননা,
আমরা দেখেছি, রাষ্ট্রীয় আচরণে একটা মোটামুটি নৈতিক ছাপ থাকার কারণেই তিনি রাষ্ট্র থেকে
পালাতে চাননি। কিন্তু সক্রেটিসের এ আচরণ রাষ্ট্র যখন গুরুতর নৈতিক স্খলন প্রদর্শন করে তখনও
অনুসরণযোগ্য হবে তেমন মনে করার কোন কারণ নেই। আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের কথাই ধরা
যাক। যাঁরা এর সমর্থক ছিলেন তাঁরা যদি মনে করতেন যে, তাঁরা পাকিস্তানের আইন মানার চেয়ে
মহত্তর নৈতিক আদর্শের জন্য সংগ্রাম করছেন না তাহলে কি বাংলাদেশের জন্ম সম্ভব হতো? এক্ষেত্রে
তৎকালীন পাকিস্তানের আইন না মানা কি অনৈতিক ছিল? অপরপক্ষে, যাঁরা মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষে
এখানে কাজ করেছিলেন তাঁরা কি শুধু দেশের আইন রক্ষার জন্যই নিজেদের জানপ্রাণ বাজি
রেখেছিলেন? প্রকৃত কথা হচ্ছে আইন থেকে নৈতিকতাকে বিযুক্ত করা যায় না, তবে রাষ্ট তথা আইন
নৈতিক সংস্কারকের ভ‚মিকায় অবর্তীণ হতে পারে। দাসপ্রথা উচ্ছেদে রাষ্ট্রই প্রথম উদ্যোগ নেয় এবং
পরে এ জনসাধারণের সম্মতি লাভ করে এবং এখন একে সম্পূর্ণ অনৈতিক মনে করা হয়। নারীর
প্রতি বৈষম্য বিলোপের ব্যাপারে রাষ্ট্রীয় উদ্যোগই দেশে দেশে বড় ভ‚মিকা পালন করছে। এখন এটাও একটা নৈতিক মাত্রা পেয়েছে। তবে আইন থেকে কোন কারণেই নৈতিকতার বিযুক্তি কাম্য নয়।
রচনামূলক প্রশ্ন
১। আইন কি? নৈতিকতা ও আইনের স¤পর্ক ব্যাখ্যা করুন।
২। নৈতিকতা ও আইনের মধ্যে মূল পার্থক্য কি রূপ? আইনের ওপর নৈতিকতার প্রভাবের
বিস্তারিত ব্যাখ্যা দিন।
৩। নৈতিকতার ওপর আইনের প্রভাব সম্পর্কে আলোচনা করুন। আইন কি নৈতিক সংস্কারক
হিসেবে কোন ভ‚মিকা পালন করতে পারে ?
নৈর্ব্যক্তিক প্রশ্ন
সঠিক উত্তর লিখুন
১। আইন ও নৈতিকতার মূল পার্থক্য হল
ক. আইন বাধ্যতামূলক কিন্তু নৈতিকতা বাধ্যতামূলক নয়।
খ. আইন ব্যক্তির ওপর প্রযোজ্য, নৈতিকতা ব্যক্তির ওপর প্রযোজ্য নয়।
গ. উপরের কোনটিই নয়।
২। সক্রেটিসের মতে আইনের উৎস হল
ক. প্রচলিত বিশ্বাস ও ধ্যানধারণা।
খ. রাষ্ট্র ও ব্যক্তির মধ্যে একটি অলিখিত চুক্তি, যাতে ব্যক্তি কর্তৃক রাষ্ট্রকে মান্য করার
প্রতিশ্রæতি থাকে
গ. অভিজাত শ্রেণীর ইচ্ছা।
৩। সক্রেটিসের মতে কোন আইন প্রকৃত আইন পদবাচ্য হতে পারে না, যদি
ক. তার পেছনে প্রাকৃতিক আইনের সমর্থন না থাকে।
খ. তার সাথে প্রাকৃতিক আইনের কোন সামঞ্জস্য থাকে।
গ. উপরের কোনটিই নয়।
৪। আইন থেকে নৈতিকতাকে বিযুক্ত করা যায় না, কেননা।
ক. নৈতিকতার উৎস হচ্ছে আইন খ. নৈতিকতা ও আইন উভয়েই বাধ্যতামূলক
গ. উপরের কোনটিই নয়।
সত্য/মিথ্যা
১। আইন বাধ্যতামূলক, কিন্তু নৈতিকতা বাধ্যতামূলক নয়- সত্য/মিত্যা।
২। অধিকাংশ ফৌজদারী ও দেওয়ানী আইনের ক্ষেত্রে নৈতিকতার কোন সমর্থন নেইসত্য/মিথ্যা।
৩। সক্রেটিস মনে করেন, যথার্থ আইনের পেছনে প্রাকৃতিক আইনের সমর্থনের কোন প্রয়োজন
নেই-সত্য/মিথ্যা।
৪। কোন কোন অনৈতিক বিষয়কে রাষ্ট্রীয় আইন সহ্য করে এমন সব যুক্তি দিয়ে যাদেরকে
বাস্তবতার নিরিখে অগ্রাহ্য করা যায় না- সত্য/মিথ্যা।
৫। রাষ্ট্র তথা আইন কখনোই নৈতিক সংস্কারকের ভ‚মিকায় অবতীর্ণ হতে পারে না- সত্য/মিথ্যা।
সঠিক উত্তর
নৈর্ব্যক্তিক প্রশ্ন: ১। ক ২। খ ৩। ক ৪। গ
সত্য/মিথ্যা: ১। সত্য ২। মিথ্যা ৩। মিথ্যা ৪।সত্য ৫। মিথ্যা

FOR MORE CLICK HERE
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস মাদার্স পাবলিকেশন্স
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস ১ম পর্ব
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস
আমেরিকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস
বাংলাদেশের ইতিহাস মধ্যযুগ
ভারতে মুসলমানদের ইতিহাস
মুঘল রাজবংশের ইতিহাস
সমাজবিজ্ঞান পরিচিতি
ভূগোল ও পরিবেশ পরিচিতি
অনার্স রাষ্ট্রবিজ্ঞান প্রথম বর্ষ
পৌরনীতি ও সুশাসন
অর্থনীতি
অনার্স ইসলামিক স্টাডিজ প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত
অনার্স দর্শন পরিচিতি প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত

Copyright © Quality Can Do Soft.
Designed and developed by Sohel Rana, Assistant Professor, Kumudini Government College, Tangail. Email: [email protected]