যুক্তিবিদ্যার প্রকৃতি বা বিষয়বস্তু যুক্তিবিদ্যার প্রয়োজনীয়তা আলোচনা করুন।

মানুষ জীববৃত্তি ও বুদ্ধিবৃত্তিসম্পন্ন জীব। বুদ্ধিবৃত্তিসম্পন্নবৈশিষ্ট্যের কারণে মানুষ সবিচার চিন্তা বা অনুমান
গঠনে অগ্রসর হয়। কিন্তু অজ্ঞানতা, সংস্কার ও নানাবিধ আবেগ এই কার্যে প্রায়শ বাধা হয়ে দাঁড়ায়।
ফলে এমন একটি বিদ্যার প্রয়োজন যা মানুষকে সঠিকভাবে চিন্তা বা অনুমান করতে সাহায্য করবে।
যুক্তিবিদ্যার প্রয়োজন ও প্রাসঙ্গিকতা এখানেই। যুক্তিবিদরা শুদ্ধ যুক্তির বৈশিষ্ট্য নির্ণয় এবং শুদ্ধ যুক্তি
থেকে অশুদ্ধ যুক্তি পৃথক করার জন্য নানা প্রকার পদ্ধতি ও নিয়মকানুন প্রণয়ন করেন।
ব্যুৎপত্তিগত অর্থ
যুক্তিবিদ্যার ইংরেজি প্রতিশব্দ হলো খড়মরপ। ইংরেজি শব্দ খড়মরপ এসেছে গ্রিক শব্দ খড়মরশব থেকে।
খড়মরশব হলো বিশেষণ, খড়মড়ং হলো বিশেষ্য। খড়মড়ং এর অর্থ চিন্তা, শব্দ বা ভাষা। ব্যুৎপত্তিগত
দিক থেকে খড়মরপ শব্দটির অর্থের সাথে উপরোক্ত দুটি গ্রীক শব্দের সম্পর্ক রয়েছে। ব্যুৎপত্তিগত অর্থে
যুক্তিবিদ্যা হলো চিন্তা সম্পর্কিত বিজ্ঞান বা ভাষায় প্রকাশিত চিন্তন সম্পর্কিত আলোচনা। তবে
যুক্তিবিদ্যায় আলোচিত চিন্তন হলো বিচারমূলক চিন্তন যাতে অনুমান থাকে। এই অনুমানমূলক চিন্তন
সঠিক বা বেঠিক অথবা বৈধ কিংবা অবৈধ হতে পারে।
যুক্তিবিদ্যা ও মনোবিদ্যা
চিন্তা কথাটি ব্যাপক। প্রত্যক্ষ, স্মৃতি, কল্পনা, ধারণা, অবধারণ, অনুমান সবই চিন্তার অন্তর্গত।
মনোবিদ্যায় এ সবই আলোচিত হয়। চিন্তন ক্রিয়া ও চিন্তার নিয়মাবলী নিয়ে আলোচনায় মনোবিজ্ঞানীরা
শুদ্ধচিন্তা, অশুদ্ধ চিন্তা, যুক্তিচিন্তা, অযৌক্তিক চিন্তা প্রভৃতি নিয়েও আলোচনা করেন। অর্থাৎ
মনোবিজ্ঞানীগণ সকল প্রকার চিন্তা নিয়ে বিজ্ঞানসম্মত আলোচনা করেন। পক্ষান্তরে, যুক্তিবিদরা কেবল
শুদ্ধ অনুমানমূলক চিন্তা এবং যুক্তিচিন্তার স্বরূপ ও তার নিয়মাবলী নিয়ে আলোচনা করেন। যুক্তিচিন্তা
(জবধংড়হরহম) মানসিক প্রক্রিয়া হিসেবে কিরূপ সে বিষয়ে যুক্তিবিদদের মধ্যে তেমন কোন আগ্রহ নেই;
যুক্তিচিন্তাটি বাস্তবে প্রকাশ হওয়ার পর তা শুদ্ধ না অশুদ্ধ তা বিবেচনা করাই মূলত যুক্তিবিদের কাজ।
যুক্তিবিদ্যার সংজ্ঞা
যুক্তিবিদের কাজ হলো শুদ্ধ বা বৈধ যুক্তিকে অশুদ্ধ বা অবৈধ যুক্তি থেকে পৃথক করা। যুক্তিবিদের
জিজ্ঞাসা হলো প্রদত্ত আশ্রয়বাক্য থেকে সিদ্ধান্তটি অনিবার্যভাবে নিঃসৃত হয় কিনা? যদি সিদ্ধান্তটি
আশ্রয়বাক্য থেকে অনিবার্যভাবে নিঃসৃত হয় অর্থাৎ আশ্রয়বাক্য যদি সিদ্ধান্তের পক্ষে উপযুক্ত ভিত্তি বা
সমর্থন যোগায় যাতে আশ্রয়বাক্য সত্য বলে গ্রহণ করলে সিদ্ধান্তকেও সত্য বলা যায়, তাহলে যুক্তিটি
হবে শুদ্ধ বা বৈধ; অন্যথায় যুক্তিটি হবে অবৈধ বা অশুদ্ধ। অবৈধ যুক্তি থেকে বৈধ যুক্তির পার্থক্য
নির্ণয়ের জন্য যুক্তিবিদরা নানারকম নিয়মকানুন প্রণয়ন করেছেন। যুক্তিবিদ্যার সংজ্ঞা প্রসঙ্গে আধুনিক
যুক্তিবিদ আরভিং এম. কপি তাই যথার্থই বলেন, যুক্তিবিদ্যা হলো মন্দ যুক্তি থেকে ভালো যুক্তিকে পৃথক
করার জন্য ব্যবহৃত পদ্ধতি ও নিয়মকানুন সমূহের আলোচনা
যুক্তিবিদ্যার বিষয়বস্তু
শুদ্ধ বা বৈধ যুক্তির প্রকৃতি এবং তা নিরূপণের নিয়মাবলী যুক্তিবিদ্যার মূল আলোচ্য বিষয়। এই মূল
আলোচ্য বিষয়ের অনুষঙ্গী হিসেবে আরো বহুবিধ বিষয় যুক্তিবিদ্যায় আলোচিত হয়। যেমন: যুক্তি ও
অনুমানের মধ্যে পার্থক্য সামান্য। অনুমান ভাষায় প্রকাশিত হলে যুক্তি হয়। অনুমান বা যুক্তি দু’প্রকার,
যথা অবরোহী ও আরোহী। উভয় প্রকার অনুমানই যুক্তিবিদ্যার আলোচ্য বিষয়। অনুমানের যথার্থতা বা
বৈধতা-অবৈধতা নিরূপণ করা যুক্তিবিদ্যার কাজ। এজন্য আকারগত সত্যতা কিংবা বৈধতা, বস্তুগত
সত্যতা প্রভৃতি বিষয় যুক্তিবিদ্যায় আলোচিত হয়।
যুক্তির কাঠামোতে থাকে বচন। বচনের মধ্যে থাকে পদ। বচন ও পদের প্রকৃতি ও প্রকার তাই
যুক্তিবিদ্যায় স্বাভাবিকভাবে আলোচিত হয়। পদের আলোচনায় সংজ্ঞা, বিভাজন, শ্রেণীকরণ প্রভৃতি বিষয়
অবশ্যম্ভাবীরূপে এসে পড়ে। যুক্তি, বচন, পদ, সংজ্ঞা-সবই যেহেতু ভাষায় প্রকাশিত হয় সেহেতু সঠিক
যুক্তিবিন্যাসের স্বার্থে ভাষার সাথে চিন্তা বা যুক্তির সম্পর্ক জানা প্রয়োজন। যুক্তিবিদ্যায় ভাষার বিভিন্ন
প্রকার ভ‚মিকা, ভাষার অস্পষ্টতা, দ্ব্যর্থকতা প্রভৃতি বিষয় গুরুত্বের সাথে আলোচিত হয়।
যুক্তিবিন্যাসের সঠিক নিয়মাবলী লঙ্ঘন করার কারণে যেসব অশুদ্ধ যুক্তি বা অনুপপত্তির সৃষ্টি হয় সে
সবের প্রকৃতি ও প্রকার নিয়ে যুক্তিবিদ্যা আলোচনা করে। প্রতিটি বিজ্ঞানের মত যুক্তিবিদ্যায় কিছু
স্বীকার্য-সত্য রয়েছে, যথা কার্যকারণ তত্ত¡, প্রকৃতির নিয়মানুবর্তিতা নীতি, চিন্তার মৌলিক স‚ত্রাবলী
। চিন্তার মৌলিক সূত্র বা নিয়মাবলী হলো অভেদ নিয়ম, বিরোধ নিয়ম, মধ্যম রহিত নিয়ম প্রভৃতি।
যুক্তিবিদ্যা : বিজ্ঞান ও কলা
বিজ্ঞান সাধারণ নিয়মাবলীর তত্ত¡গত জ্ঞান) প্রদান করে। কলা এই
তত্ত¡গত জ্ঞান বাস্তবে প্রয়োগ করতে শেখায়। যুক্তিবিদ্যা একটি বিজ্ঞান। কেননা যুক্তিবিদ্যা শুদ্ধ চিন্তার
নিয়মাবলী উদ্ভাবন করে এবং শুদ্ধ চিন্তার প্রকৃতি কি তা আমাদেরকে অবহিত করে। যুক্তিবিদ্যা একটি
কলা। কেননা যুক্তিবিদ্যা সত্য-অনুসন্ধানের জন্য নিয়মাবলী নির্দেশ করে এবং বাস্তবে ভ্রান্তিপরিহার করে
সত্যে উপনীত হতে শেখায় । সুতরাং যুক্তিবিদ্যা বিজ্ঞান ও কলা উভয়ই। অর্থাৎ এটি রন্ধনবিদ্যা বা
চিকিৎসাবিদ্যার মতই একটি বিদ্যা।
যুক্তিবিদ্যার প্রয়োজনীয়তা
কপির উপরেউল্লিখিত যুক্তিবিদ্যার সংজ্ঞাটির অর্থ এই নয় যে, যুক্তিবিদ্যার শিক্ষার্থীরাই কেবল
সঠিকভাবে যুক্তি দিতে পারেন। যুক্তিবিদ্যা না পড়েও লোকে যুক্তিসংগত চিন্তা করতে পারেন। কেননা
কপির মতানুসারে মানুষ বুদ্ধিবৃত্তিসম্পন্নতথা যুক্তিবোধের অধিকারী জীব। সুতরাং স্বভাবগত সক্ষমতার
পিছনে যুক্তিবিদ্যার কোন ভ‚মিকা বা অবদান থাকার কথা নয়। বস্তুত যুক্তিবিদ্যা এ ধরনের দাবিও করে
না। যুক্তিবিদ্যা মানুষের স্বভাবগত যুক্তিবোধকে কিভাবে অর্থাৎ কি সব নিয়মকানুনের আওতাধীনে
ব্যবহার করলে ভ্রান্তিপরিহার করা সম্ভব হবে কেবল তা নিয়ে ব্যস্তথাকে। অন্যকথায়, যুক্তিবিদ্যা
যুক্তিসংগত চিন্তার সৃষ্টিতে কোন ভ‚মিকা রাখে না, ভ‚মিকা রাখে তার বৈধতা নিরূপণ ও প্রয়োগ-
কৌশলের ক্ষেত্রে। একথা কে না জানে, ম্যারাডোনা বা রোনান্ডো তাঁদের কোচের তুলনায় ভাল খেলবে
অর্থাৎ স্বভাবগত ক্রীড়াবিদ দক্ষ প্রশিক্ষকের চেয়ে ক্রীড়াঙ্গনে অধিক সফলতা অর্জন করবে। তথাপি
কোচ বা প্রশিক্ষকের প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য। একই কথা প্রযোজ্য যুক্তিবিদ্যার ক্ষেত্রে। দু’জন সমমেধা
সম্পন্ন ব্যক্তির মধ্যে যিনি যুক্তিবিদ্যা পাঠ করেছেন তিনি আর যিনি এ বিদ্যা পাঠ করেননি তার চেয়ে
শুদ্ধভাবে যুক্তি দিতে পারবেন, এই আশা করা যায়। তাছাড়া, দ্বিতীয় ব্যক্তির তুলনায় প্রথমোক্ত ব্যক্তির
মর্যাদা ও সুবিধা এখানে যে, তিনি জানেন কোথায় ও কিভাবে ভুল সংঘটিত হয় এবং কি পন্থায় তা দূর
করা সম্ভব। বস্তুত এ জানাই একজন মানুষকে সতর্ক করে তোলে। ফলস্বরূপ তাঁর যুক্তি-প্রয়োগ
সাধারণত অধিক শুদ্ধ, সূক্ষèও সার্থক হয়।
অবশ্য যুক্তিবিদ্যা পাঠ করেও মানুষ ভুল যুক্তি দিতে পারে। স্বাস্থ্যবিজ্ঞান পড়লেই যেমন স্বাস্থ্যবান হওয়া
যায় না তেমনই যুক্তিবিদ্যা পড়লেই সঠিক যুক্তিদাতা হওয়া যায় না। তবে স্বাস্থ্যবিজ্ঞানের পাঠ একজন
মানুষকে যেমন স্বাস্থ্যবান হওয়ার কৌশল শিক্ষা দেয়, তেমনই তা মান্য করে স্বাস্থ্যবান হওয়ার একটা
প্রবল জ্ঞানতাত্তি¡ক তাগিদ দান করে যার গুরুত্ব অনস্বীকার্য। একই কথা যুক্তিবিদ্যার ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য।
যুক্তিবিদ্যার চর্চা আমাদের মনকে উচ্ছ¡াস, সংস্কার ও অন্ধবিশ্বাস থেকে মুক্ত হতে সাহায্য করে। এটির
চর্চা মানুষকে সামাজিক যোগাযোগের ক্ষেত্রে প্রভাবশালী হতে সাহায্য করে। জনৈক মনীষী বলেন, যে
যুক্তি দিয়ে কথা বলতে পারে সে কিছু একটা করতে পারে। যুক্তিবিদ্যার পাঠ আমাদের স্বাধীনভাবে ও
নিরপেক্ষভাবে চিন্তা করতে উদ্বুদ্ধ করে, তথাকথিত শক্তি-সন্ত্রাসের বদলে যুক্তির ভাষা গ্রহণে উৎসাহিত
করে। গণতান্ত্রিক সমাজ নির্মাণের জন্য তাই যুক্তিবিদ্যা পাঠের প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য। এখানে থমাস
জেফার্সনের কথা স্মরণ করা যায়: সর্বোপরি যুক্তিবিদ্যা সঠিক চিন্তার সাধারণ নিয়মাবলী সরবরাহ করে জ্ঞানের প্রতিটি শাখাকে সুশৃঙ্খল হতে সাহায্য করে।
উপসংহার
যুক্তিবিদ্যা হলো অশুদ্ধ যুক্তি থেকে বৈধ যুক্তিকে পৃথক করার পদ্ধতি ও বিধিবিধানসমূহের আলোচনা।
সময়ের দীর্ঘ পরিসরে যুক্তিবিদরা এজন্য বিভিন্ন পদ্ধতি ও নিয়মকানুন উদ্ভাবন করেছেন। এসব পদ্ধতি
ও নিয়মকানুনের উদ্ভাবন ও বিকাশের স্বার্থে সংজ্ঞায়ন, বিভাজন, শ্রেণীকরণ প্রভৃতি বিষয় যুক্তিবিদ্যার অন্তর্ভুক্ত হয়েছে এবং একে সমৃদ্ধ করে তুলেছে।
রচনামূলক প্রশ্ন
১। যুক্তিবিদ্যার প্রকৃতি বা বিষয়বস্তু ব্যাখ্যা করুন।
২। যুক্তিবিদ্যার প্রয়োজনীয়তা আলোচনা করুন।
সংক্ষিপ্ত উত্তরমূলক প্রশ্ন
১। যুক্তিবিদ্যার সংজ্ঞা প্রদান করুন।
২। যুক্তিবিদ্যার সাথে মনোবিদ্যার পার্থক্য প্রদর্শন করুন।
বহু নির্বাচনী প্রশ্ন
সঠিক উত্তর লিখুন
১। মানুষের বৈশিষ্ট্য হলো
ক) জীববৃত্তি খ) বুদ্ধিবৃত্তি
গ) জীববৃত্তি ও বৃদ্ধিবৃত্তি। ঘ) উপরের কোনটিই নয়।
২। লজিকের অর্থ
ক) শব্দ খ) ভাষা
গ) চিন্তা। ঘ) উপরের সবগুলোই।
৩। যুক্তিবিদ্যা আলোচনা করে
ক) বিজ্ঞান নিয়ে খ) মানসিক প্রক্রিয়া নিয়ে
গ) চিন্তার ফলাফল নিয়ে। ঘ) উপরের কোনটিই নয়।
৪। যুক্তিবিদ্যা হলো
ক) বিজ্ঞান খ) কলা
গ) বিজ্ঞান ও কলা। ঘ) উপরের কোনটিই নয়।
সঠিক উত্তর
১। গ) জীববৃত্তি ও বৃদ্ধিবৃত্তি। ২। ঘ) উপরের সবগুলোই। ৩। গ) চিন্তার ফলাফল নিয়ে।
৪। গ) বিজ্ঞান ও কলা।

FOR MORE CLICK HERE
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস মাদার্স পাবলিকেশন্স
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস ১ম পর্ব
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস
আমেরিকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস
বাংলাদেশের ইতিহাস মধ্যযুগ
ভারতে মুসলমানদের ইতিহাস
মুঘল রাজবংশের ইতিহাস
সমাজবিজ্ঞান পরিচিতি
ভূগোল ও পরিবেশ পরিচিতি
অনার্স রাষ্ট্রবিজ্ঞান প্রথম বর্ষ
পৌরনীতি ও সুশাসন
অর্থনীতি
অনার্স ইসলামিক স্টাডিজ প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত
অনার্স দর্শন পরিচিতি প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত

Copyright © Quality Can Do Soft.
Designed and developed by Sohel Rana, Assistant Professor, Kumudini Government College, Tangail. Email: [email protected]