উনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের কারণসমূহ কী ছিল?

উনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থানের প্রেক্ষাপট
পাকিস্তানি শাসন-শোষণ, নির্যাতন ও নিস্পেষণ পূর্ব বাংলার জনগণের উপর যতই বৃদ্ধি পেতে থাকে, ৬-দফা
কর্মসূচিভিত্তিক আন্দোলন তত দ্রæত বিস্তার লাভ করে। এ আন্দোলন দমনে আইয়ুব সরকারের ‘আগরতলা ষড়যন্ত্রমামলা’র
(১৯৬৮) আশ্রয় গ্রহণ এক বিস্ফোরণমুখ পরিস্থিতির উদ্ভব ঘটায়। এ মামলায় বঙ্গবন্ধুকে এক নম্বর আসামী করা হয়।
ঠিক এ সময়ে পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র লীগ, পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন (মেনন ও মতিয়া উভয় গ্রæপ), সরকারি ছাত্র সংগঠন
জাতীয় ছাত্র ফেডারেশনের ‘দোলন গ্রæপ’ এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) ঐক্যবদ্ধ হয়ে আইয়ুব বিরোধী
মঞ্চ কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠনপূর্বক ৬-দফা কর্মসূচির প্রতি সর্বাত্মক সমর্থনসহ ১১-দফা কর্মসূচি ঘোষণা করে,
যা আন্দোলনে নতুন গতির সঞ্চার করে। কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ ‘আগরতলা ষড়যন্ত্রমামলা’ প্রত্যাহার এবং বঙ্গবন্ধুসহ
সকল রাজবন্দীর মুক্তির দাবিতে দেশব্যাপী ছাত্র আন্দোলন আরম্ভকরে। বস্তত ১৯৬৮ সালের নভেম্বর মাস থেকে ১৯৬৯
সালের মার্চ পর্যন্ত, এ পাঁচ মাস সমগ্র পূর্ব বাংলায় গণবিদ্রোহ দেখা দেয়। একই সময় পশ্চিম পাকিস্তানেও আইয়ুব বিরোধী
ছাত্র আন্দোলন গড়ে ওঠে। পূর্ব বাংলায় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হওয়ার পর ১৯৬৯ সালের ৮ জানুয়ারি
ঢাকায় পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ (৬-দফা পন্থী), ন্যাশনাল আওয়ামী পাটি (ন্যাপ), নেজাম-ই-ইসলাম পাটি,
জমিয়ত-উল-উলামা-ই-ইসলাম, নিখিল পাকিস্তান মুসলিম লীগ (মমতাজ দৌলতানা), ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট,
জামায়াত-ই-ইসলামি, পাকিস্তান আওয়ামী লীগ (নওয়াবজাদা নসরুল্লাহ খান) -এ ৮টি রাজনৈতিক দল ৮-দফা দাবিতে
ঐক্যবদ্ধ হয়ে ডেমোক্রেটিক এ্যাকশন কমিটি (উঅঈ-ডাক) গঠন করে। ৮-দফা দাবিনামার মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাধীনে
সংসদীয় পদ্ধতির সরকার প্রতিষ্ঠা, প্রাপ্ত বয়¯কদের ভোটাধিকারের ভিত্তিতে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠান, অবিলম্বে জরুরি
অবস্থা প্রত্যাহার এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবসহ সকল রাজনৈতিক বন্দীর মুক্তি ইত্যাদি অন্তর্ভুক্ত ছিল।
ক্ষমতাসীন আইয়ুব সরকারের বিরুদ্ধে এতদিন আন্দোলনে মূলত ছাত্র সমাজের প্রাধ্যন্য ছিল। কিন‘ ১৯৬৯ এর
মাঝামাঝিতে অন্যান্য গোষ্ঠী বিশেষতঃ কৃষক, শিল্প শ্রমিক, রাজনৈতিক কর্মী সকলে আন্দোলনে নিজেকে সম্পৃক্ত করে।
ফলে আইয়ুব বিরোধী গণ-আন্দোলন গণ-অভ্যুত্থানের রূপ পরিগ্রহ করে।
১৯৬৯ এর গণ-অভ্যুত্থানের কারণ
গণতন্ত্রের পূর্ণ বাস্তবায়ন, পাকিস্তানি সামরিক-বেসামরিক আমলাতন্ত্রের কর্তৃত্ব বিলোপ, পাকিস্তানের উভয় অঞ্চলের
মধ্যকার বিরাজমান অর্থনৈতিক বৈষম্য দূরীকরণ, যাবতীয় গণবিরোধী শক্তির মূলোৎপাটন এবং সর্বোপরি স্বায়ত্তশাসন
প্রতিষ্ঠা ইত্যাদি লক্ষ্যকে সামনে রেখে ১৯৬৯ সালে যে গণ-অভ‚্যত্থানের সূচিত হয় তার প্রধান কারণগুলো ছিল নি¤œরূপ:
১. ১৯৫৮ সালের ঘোষিত সামরিক শাসনের ফলে পাকিস্তানের গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ বিকাশের পথ রুদ্ধ হয়। পূর্ব
বাংলার জনগণের আশা আকাক্সক্ষা পর্যদুস্তহয় পাকিস্তানি সামরিক বেসামরিক আমলাতন্ত্রের অগণতান্ত্রিক
আচরণে। অবরুদ্ধ জনতা ক্ষোভে ফেটে পড়ে, সূচিত হয় গণ-অভ্যুত্থান।
২. পূর্ব বাংলার বাঙালিদের সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক দাবি-দাওয়ার প্রতি পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর
চরম ঔদাসীন্য ও বৈষম্যমূলক দৃষ্টিভঙ্গী বাঙালিদের প্রান্তিকীকরণ করে। ফলে সৃষ্টি হয় গণ-অভ্যুত্থানের।
৩. পাকিস্তানে গণবিরোধী ও অশুভশক্তির বিশেষত মৌলিক গণতন্ত্রীদের ক্রমাগত ক্ষমতাবৃদ্ধি ও ক্ষমতার
অপব্যবহার ‘রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় জনগণের সত্যিকার প্রতিনিধিদের অংশগ্রহণের সুযোগ বন্ধ’ ইত্যাদি গণঅভ্যুত্থানকে ত্বরান্বিত করে।
৪. পাকিস্তান রাষ্ট্রে পূর্ব বাংলার বাঙালিদের সামাজিক, অর্থনৈতিক, সাং¯কৃতিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে স্বকীয়তা
বজায় রাখা দুরূহ হয়ে পড়ে, যা কার্যত উনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের মুখ্য কারণ হিসেবে বিবেচিত হয়।
৫. বাঙালিদের স্বার্থের আপোসহীন প্রতিনিধি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও অপর ৩৪ জনের বিরুদ্ধে আইয়ুব
সরকারের ‘আগরতলা ষড়যন্ত্রমামলা’ দায়ের এবং বিশেষ ট্রাইবুনালে তাঁদের বিচার অনুষ্ঠান ঊনসত্তরের
গণঅভ্যুত্থানকে অনিবার্য করে তোলে।
গণঅভ্যুত্থানের চূড়ান্তপর্ব
আগরতলা ষড়যন্ত্রমামলার প্রাত্যহিক কার্যবিবরণী যতই বিভিন্ন দৈনিকে প্রকাশিত হতে থাকে, বাঙালিরা ততই বিক্ষুদ্ধ
হয়ে ওঠে। পূর্ব বাংলার আপামর জনতা ১৪৪ ধারা লঙ্ঘন, কাফর্‚ ভঙ্গ, পুলিশ-ই.পি.আর-সেনাবাহিনী উপেক্ষা করে রাস্তায়
ক্ষোভে ফেটে পড়ে। চতুর্দিক প্রকম্পিত করে ধ্বনিত হতে থাকে গগনবিদারী শ্লোগান: ‘জেলের তালা ভাঙ্গবো, শেখ
মুজিবকে আনবো’, ‘তোমার নেতা আমার নেতা, শেখ মুজিব, শেখ মুজিব’, ‘তোমার আমার ঠিকানা, পদ্ধা-মেঘনা-যমুনা’
ইত্যাদি। ১৯৬৯ সালের ২০ জানুয়ারি পুলিশের গুলিতে ছাত্রনেতা আসাদুজ্জামান (আসাদ)-এর মৃত্যু, ২৪ জানুয়ারি
পুলিশের বুলেটে নবকুমার ইনস্টিটিউটের দশম শ্রেণীর ছাত্র মতিউরের মৃত্যু, ১৫ ফেব্রæয়ারি বন্দী অবস্থায় ঢাকার
সেনানিবাসে ‘আগরতলা ষড়যন্ত্রমামলা’র অন্যতম আসামী সার্জেন্ট জহুরুল হকের গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হওয়া, ১৮
ফেব্রæয়ারি ই.পি.আর-এর গুলিতে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর ও রসায়ন বিভাগের শিক্ষক ড. শামসুজ্জোহার শাহাদত
বরণ ইত্যাদি মর্মান্তিক ঘটনা সমগ্র পূর্ব বাংলায় প্রত্যন্তঅঞ্চল পর্যন্তবিদ্রোহের অগ্নিস্ফুলিঙ্গ ছড়িয়ে দেয়। আইয়ুব শাসন
বিরোধী উনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান পায় চ‚ড়ান্তরূপ।
শেখ মুজিবুর রহমানকে বঙ্গবন্ধু উপাধি প্রদান
আইয়ুব বিরোধী গণঅভ্যুত্থান যখন চ‚ড়ান্তপর্বে উপনীত, তখন দিশেহারা হয়ে জেনারেল আইয়ুব প্রথমে শেখ মুজিবুর
রহমানকে প্যারোল (চধৎড়ষব)-এ মুক্তিদানে তার সম্মতির কথা ঘোষণা করেন। কিন‘ শেখ মুজিব তাতে রাজী হননি।
অবশেষে ২২ ফেব্রæয়ারি জেনারেল আইয়ুব তাঁকে (শেখ মুজিবুর রহমানকে ) নিঃশর্ত মুক্তিদানে ও আগরতলা ষড়যন্ত্র
মামলা প্রত্যাহারে বাধ্য হন। পরের দিন অর্থাৎ ২৩ ফেব্রæয়ারি ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের উদ্যোগে ঢাকার তৎকালীন রেসকোর্স
ময়দানে (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) লাখো ছাত্র-জনতার স্বতঃস্ফ‚র্ত উপস্থিতিতে শেখ মুজিবুর রহমানকে এক
ঐতিহাসিক গণসম্বর্ধনা দেওয়া হয়। এ অনুষ্ঠানে কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের সভাপতি ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয়
ছাত্র সংসদ (ডাকসু)-এর সহ-সভাপতি তোফায়েল আহমদ কর্তৃক কারামুক্ত শেখ মুজিবুর রহমানকে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধিতে
ভ‚ষিত করা হয়। অতঃপর ১৯৬৯ সালের ২৫ মার্চ জেনারেল আইয়ুব ক্ষমতা থেকে বিদায় নিতে বাধ্য হন।
সারকথা
১৯৬৬ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ৬-দফা কর্মসূচি ঘোষণা করলে বাঙালিদের মধ্যে দ্রæত আন্দোলন ছড়িয়ে
পড়ে। এর মোকাবেলা করতে আইয়ুব সরকার ১৯৬৮ সালে বঙ্গবন্ধুকে প্রধান আসামি করে ‘আগরতলা ষড়যন্ত্রমামলা’
দায়ের করেন। মামলার অভিযোগ ছিল ভারতের সহযোগিতায় সশস্ত্রপন্থায় পূর্ব পাকিস্তানকে স্বাধীন করা। এ মামলার
উদ্দেশ্য ছিল ৬-দফা ভিত্তিক বাঙালিদের স্বাধিকার আন্দোলন নস্যাৎ করা। আইয়ুব সরকারের এই ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে
বাঙালিরা বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। পূর্ব বাংলার ছাত্র সমাজ ১১-দফা কর্মসূচি দিয়ে কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের ব্যানারে
আইয়ুব - বিরোধী আন্দোলনের অগ্রভাগে এসে দাঁড়ায়। পুলিশের গুলিতে ছাত্রনেতা আসাদ ও দশম শ্রেণীর ছাত্র
মতিউরের মৃত্যু, বন্দী অবস্থায় আগরতলা ষড়যন্ত্রমামলার অন্যতম আসামী সার্জেন্ট জহুরুল হককে গুলি করে হত্যা,
ই.পি.আর -এর গুলিতে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর ও শিক্ষক ড. শামসুজ্জোহার নিহত হওয়ার ঘটনা ইত্যাদি
আন্দোলনের অগ্নিস্ফুলিঙ্গ চতুর্দিকে ছড়িয়ে দেয়। সংঘটিত হয় ৬৯-এর গঅভ্যুত্থান। বঙ্গবন্ধুশেখ মুজিবসহ আগরতলা
ষড়যন্ত্রমামলার সকল আসামীকে নিঃর্শত মুক্তি দেওয়াহয় এবং মামলা প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়। এর কিছুদন পর আইয়ুব সরকারের পতন ঘটে।
সঠিক উত্তরে টিক চিহ্ন দিন
১. ডেমোক্রেটিক এ্যাকশন কমিটি বা ডাক কখন গঠিত হয়?
ক. ১৯৬৮ সালের ১৮ এপ্রিল
খ. ১৯৬৯ সালের ১৯ জুন
গ. ১৯৬৯ সালের ৮ জানুয়ারি
ঘ. ১৯৬৮ সালের ১৮ জানুয়ারি
২. শহীদ মতিউর কোন্ বিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলেন?
ক. ঢাকা ল্যাবরেটরী হাইস্কুল
খ. আইডিয়াল স্কুল
গ. মতিঝিল হাইস্কুল
ঘ. নবকুমার ইনস্টিটিউশন
৩. ড. শামসুজ্জোহা কোন্ তারিখে শাহাদত বরণ করেন?
ক. ১৯৬৯ সালের ১৫ ফেব্রæয়ারি
খ. ১৯৬৯ সালের ১৮ ফেব্রæয়ারি
গ. ১৯৬৯ সালের ২৪ জানুয়ারি
ঘ. ১৯৬৯ সালের ২০ জানুয়ারি
৪. কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের ঐতিহাসিক গণসম্বর্ধনায় কোন তারিখে শেখ মুজিবুর রহমানকে বঙ্গবন্ধু উপাধিতে
ভ‚ষিত করা হয়?
ক. ১৯৬৯ সালের ১৮ ফেব্রæয়ারি
খ. ১৯৬৯ সালের ১৯ ফেব্রæয়ারি
গ. ১৯৬৯ সালের ৩০ মার্চ
ঘ. ১৯৬৯ সালের ২৩ ফেব্রæয়ারি
সঠিক উত্তর মালা: ১। গ, ২। ঘ, ৩। খ, ৪। ঘ
সংক্ষিপ্ত উত্তরমূলক প্রশ্ন
১. কখন এবং কিভাবে কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়?
২. ডেমোক্রেটিক এ্যাকশন কমিটি বা ডাক কখন ও কিসের ভিত্তিতে গঠিত হয়?
রচনামূলক প্রশ্ন
১. উনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের কারণসমূহ কী ছিল?

FOR MORE CLICK HERE
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস মাদার্স পাবলিকেশন্স
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস ১ম পর্ব
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস
আমেরিকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস
বাংলাদেশের ইতিহাস মধ্যযুগ
ভারতে মুসলমানদের ইতিহাস
মুঘল রাজবংশের ইতিহাস
সমাজবিজ্ঞান পরিচিতি
ভূগোল ও পরিবেশ পরিচিতি
অনার্স রাষ্ট্রবিজ্ঞান প্রথম বর্ষ
পৌরনীতি ও সুশাসন
অর্থনীতি
অনার্স ইসলামিক স্টাডিজ প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত
অনার্স দর্শন পরিচিতি প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত

Copyright © Quality Can Do Soft.
Designed and developed by Sohel Rana, Assistant Professor, Kumudini Government College, Tangail. Email: [email protected]